প্রেমমানিশা পর্ব-৯+১০+১১

0
220

#প্রেমমানিশা(০৯)

বারান্দার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে ফারহান, হাতে তার সিগারেট। অন্ধকারের মাঝে ধোঁয়া উড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে । মস্তিষ্কে অনবরত ঘুরতে থাকা প্রশ্নগুলো তার কাঁধ বোঝায় নুজ্য করে দিয়েছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ফারহান এখনও একটা অদৃশ্য ঘোরের মাঝে আছে। ওর বিশ্বাস হচ্ছে না সানার মতো বিদেশিনী রূপের অধিকারী রমণীও তাকে পছন্দ করতে পারে,তাকে ভালোবাসতে পারে।

তার মধ্যে এমন কি আছে যা সানাহ্কে আকৃষ্ট করেছে । ওর তো বাংলা সাহিত্যে ডিগ্রি আছে, খাটি বাঙালি সে। তাহলে সানাহ্ তার মতো পুরো দস্তুর বাঙালিকে কি করে পছন্দ করে ? সানার রুচি তো বিভিন্ন বড় বড় PhD ডিগ্রিধারী অফিসার তাই নয় কি ? তাহলে ?
আর যদি সানাহ্ তাকে অযাচিত কারণে পছন্দ করেও থাকে তাহলে তার কি করা উচিত ? সানার অনুভূতিকে সম্মান করে এই বিয়েতে মত দেওয়া উচিত নাকি শুধু নিজের দিকটা ভেবে সানাহ্কে কষ্ট দিয়ে বিয়েটা ভেঙে দেওয়া উচিত। এটা কি আদৌ সম্ভব তার দ্বারা ? সে কি পারবে সানার মত কোমল হৃদয়ের মেয়েকে কষ্ট দিতে ?

ফারহানের মস্তিষ্ক গড়বড় করতে শুরু করেছে, কী করবে বুঝতে পারছে না। মস্তিষ্কের সঙ্গে মস্তিষ্কের বিবাদ চলছে। একদিকে মন বলছে বিয়েতে মত দিতে আরেক দিকে বিবেক বলছে কেন সে মত দিবে ? সে কি সানাহ্কে ভালোবাসে ? ভালো না বাসলে বিয়ে করে সানাহ্কে সারাজীবন কষ্ট দেওয়ার কি মানে দাঁড়ায় ? পারবে সে সানার সঙ্গে এভাবে অন্যায় করতে ?

দ্বন্দ্বে দ্বন্দ্বে ফারহান দিশেহারা। নাহ্ সে কিছুই ভাবতে পারছে না আর ভাবতে চায়ও না। বিয়ে নিয়ে চিন্তা করলেই তার মাথা ব্যাথা ধরে যাচ্ছে। পারছে না সে এত চাপ সইতে। কাল মাথা ঠান্ডা করে ফুরফুরে মেজাজে সানার সঙ্গে কথা বলা বলে তার কাছ থেকে সময় চাওয়া যাবে, আসলে খোলাখুলি কথা বলা দরকার। সবই এখন নির্ভর করছে আলোচনার উপর।

–—

‘ আপাই আজ না অবর বিয়ে হয়ে গেছে জানো ? ‘

অতসীর কথা শুনে মুচকি হাসার চেষ্টা করলো সানাহ্ তবে সে পারলো না মিথ্যে হাসি হাসতে। ব্যর্থ চেষ্টা এড়িয়ে সহজ গলায় বললো ‘ ছেলেটাকে চিনে অবনি ? ওর যে বিয়ের কথা চলছে সেটা তো আগে বলিস নি। তাহলে গিয়ে ওর বিয়ের গিফট দিয়ে আসতাম….…ফর্মালিটি ইউ নো…… ‘

‘ নাহ্ অব জহিরকে চিনে না। অবর বরের নাম জহির… মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। ওরা যখন অবকে দেখতে আসে তখন কিছু না বললেও পরের দিন জহিরের বোন ফোন করে বলে যে জহিরের মায়ের অবকে পছন্দ না হলেও জহির বিয়ে করলে অবকেই করবে। আমি নিজেই তো কাল জানলাম…… ভাবিনি আজই বিয়ে হয়ে যাবে। শুধুই কি ফর্মালিটি পূরণ করতে যেতে ? আপাই তুই এমন কেন ? তোর কোনো বান্ধবী নেই, কখনও কাউকে নিজের বান্ধবী করিসনি..…আবার আমার বান্ধবীদেরও এড়িয়ে চলিস !! কেন ? ‘

অতসীর কথায় অন্ধকারের মাঝেই রাতের নিস্তব্ধতায় নীরব রইলো সানাহ্..…জবাব দিলো না কিংবা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না। রাতের নিস্তব্ধতা তাকে গ্রাস করেছে……সানার রক্তিম কেশরাশি অন্ধকারে কুচকুচে কালো হয়ে ধরা পড়েছে।

‘ আপাই আজ দুলাভাইকে নতুন ম্যাডাম রিয়াশার সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি..…শুনেছি উনি দুলাভাইয়ের কলেজ জীবনের ফ্রেন্ড। ইচ্ছে তো করছিলো হাত ঘুরিয়ে দুটো মুক্কা মারি ম্যাডাম রিয়াশাকে……কেন ফ্রেন্ড হলেই গাঁয়ে পড়ে কথা বলতে হবে ? কত বড় সাহস আমার দুলাভাইয়ের সঙ্গে হেসে হেসে তার গাঁয়ে পড়ে কথা বলে..… but unfortunately l couldn’t…… ‘ নিরলস গলায় সানাহ্কে খানিকটা হাসানোর চেষ্টা করে বললো অতসী।

ফল সুপ্রসন্ন…সানাহ্ দুর্বোধ্য হেসে উঠলো। অন্ধকারে তার আর অতসীর অজান্তে তার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো দুফোঁটা দুর্বোধ্য রহস্য। মুচকি হেসে বলল ‘ তোর দুলা..…ভাই..… যদি তাকে হেসে হেসে কথা বলার সুযোগ দেয় তাহলে তার কি করার আছে ? নারীকে সুযোগ না দিলে নারীর কিছুই করার ক্ষমতা নেই। যেই পরনারীরা বিবাহিত পুরুষের ঘর ভাঙ্গে তাদের পুরুষরাই সুযোগ দেয়..… ‘

‘ এভাবে বলিস না আপাই…… দুলাভাই সেরকম মানুষই নন যে উনি যেচে কোনো মেয়েকে সুযোগ দিবেন উনার কাছে যাওয়ার..… উনি হয়তো এতকিছু ভাবেন নি। ‘

‘ হুম জানি তো….… উনি এরকম মানুষই নন। উনি তোর আর আমার জানা অজানার পরিধির বাইরে। উনাকে চেনার সাধ্য আমার নেই আর না ছোঁয়ার…… ‘ সানাহ্ রাতের আঁধারে মলিন হেসে বললো যা অতসীর নজর এড়িয়ে গেলো।

অতসী বুঝতে পারলো কথাটা তার আপাইকে বলে ভুল করেছে..…না বললেই বরং ভালো হতো। যাক যা হওয়ার হয়ে গেছে। আপাইকে এখন স্বাভাবিক রূপে ফিরিয়ে আনতে হবে। অতসী সেই ভেবে কিছু বলবে তার আগেই সানাহ্ বললো ‘ এতক্ষণ বুঝি অবনির বিয়েতেই ছিলি ? ‘

অতসী নিঃশব্দে মাথা নেড়ে সায় দিল। সানাহ্ তা দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো ‘ যা মাকে গিয়ে বল খাবার দিতে……আমার খিদে পেয়েছে…… ‘

অতসী সানার কথা শুনে অবাক হলো। সানার গাঁয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে বললো ‘ কই তোর তো জ্বর এখনও ছাড়েনি..… আপাই তুই জ্বর অবস্থায় খেতে চাইছিস ? এটা কি আদৌ সম্ভব ? আমি ভুল শুনছি নাতো…… ‘

‘ নাহ্ তুই ভুল শুনছিস না..…আমি আসলেই খেতে চাইছি। সারাদিন কিছুই খাওয়া হয়নি। পেটে আমার ছুঁচো দৌড়চ্ছে……তাড়াতাড়ি গিয়ে মাকে রুটি দিতে বল ‘ বললো সানাহ্।

সানার কথায় অতসী ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ‘ হ্যাঁ হ্যাঁ বলছি ‘ বলে ছুটে গেলো মিসেস কায়নাতকে কথাটা বলতে আর এইদিকে সানাহ্ বারান্দার খোলা রেলিংয়ের দিকে এগিয়ে গেল কিছু অতীতের দুর্বিষহ স্মৃতি চারণে..…

সানার অতিরিক্ত জ্বর নিয়েই কেটেছে আরও এক রাত, একদিন। অবস্থা যেই কি সেই, কোনোই উন্নতি ঘটেনি। এই একদিনে ডক্টর আরও একবার এসেছিলেন কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। শরীরের তাপমাত্রা এখন ১০৩° অথচ এই জ্বর নিয়েই মেয়েটা নীরবে বারান্দার চেয়ারে বসে আছে। ওর এই এত জ্বর নিয়ে সকলেই শঙ্কিত। মিসেস কায়নাত আর মিস্টার কবির মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জ্বর যদি কাল সকালেও না কমে তাহলে সানাহ্কে ঢাকা মেডিক্যালে নিবেন সেই সঙ্গে আশা আর ফারহানদেরও জানাবেন।

মিসেস কায়নাতের সবথেকে বেশি ভয় লাগছে এই নিয়ে যে সানার চোখ যত লাল হচ্ছে তার পাগলামি ততই বাড়ছে, উল্টোপাল্টা সব কথা বলছে সে। এই অবস্থায় হুট করে সানার বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়, এর আগেও এরকম করেছে সে।

তাই অতসী,মিসেস কায়নাত আর মিস্টার কবির মিলে ঠিক করেছেন আজ রাতটা অতসী সানার সঙ্গেই কাটাবে,এমন কি সানাহ্ সুস্থ হওয়ার আগ অব্দি এই নিয়মই জারি থাকবে। এই কারণেই অতসী আজ ভার্সিটিও যায়নি, অবশ্য সানাহ্ অনেকবার তাকে বলেছিল যেতে তবে জ্বরের ঘোরে শরীরের শক্তি কুলোয়নি বলে তর্ক করেনি।

রাত দশটা……সানাহ্ বারান্দায় বসে আছে। অতসী ঘরে ঘুমোচ্ছে। সকলের ধারণা ওর এই জ্বরে খুব কষ্ট হচ্ছে কিন্তু ওর কষ্ট তো আসলে এই জ্বরে না, ওর যে হৃদয় পুড়ছে। প্রতি নিয়ত হাজার রকম ভাবে, হাজার দিক থেকে ওর হৃদয় দহন হচ্ছে আর এই দহন আটকানোর সাধ্য কারোর নেই। ওর এখন ইচ্ছা করছে সব ছেড়ে দূরদেশে কোথাও পালিয়ে যেতে।

এই রাত তোমার আমার
ঐ চাঁদ তোমার আমার
শুধু দুজনের…

আচমকা ফোন বাজার শব্দে সানার চিন্তায় ছেদ ঘটলো। খানিকটা কষ্ট করে এগিয়ে গিয়ে বারান্দায় থাকা টি টেবিল থেকে ফোনটা নিয়ে কলার আইডি দেখলো..…ফোনের স্ক্রিনে ফারহানের নাম ভেসে উঠেছে। ‘ কবি সাহেব ‘ কি সুন্দর নাম তাইনা ?

সানার চিন্তার মাঝে ফোন কেটে গিয়ে আবার বেজে উঠলো। দ্বিতীয়বার ফোন বেজে ওঠার পর সানাহ্ কল রিসিভ করলো। ফোন রিসিভ করে কানে দিতেই ফোনের ওপার থেকে ফারহান বললো ‘ কেমন আছেন ? ‘

আচ্ছা সানাহ্ কতদিন পর এই মানুষটার গলা শুনলো ? প্রায় দুই দিন পর……এই দুই দিনকেই সানার এখন দুই বছর মনে হচ্ছে। মানুষটার গলা শোনামাত্র তার শরীরে অজানা কাপন ধরে গেলো। সে নিজেকে সামলে হিস হিস শব্দ করে বললো ‘ যেমনটা আপনি রেখেছেন ‘ কিন্তু সেটা ফারহানের কান অব্দি পৌঁছালো না। তবুও ফারহানের মনে হলো সানাহ্ কিছু একটা বলেছে।ফারহান সন্দিহান গলায় বললো ‘ কিছু কি বললেন ? ‘

সানাহ্ নিঃশব্দে হাসলো……মলিন হাসি। নির্বিঘ্নে বললো ‘ হুম বললাম..…আপনার কথারই উত্তর দিলাম। যেমন থাকার কথা তেমনই আছি,ভালো। খারাপ থাকার মত কিছু তো হয়নি। ‘

সানার কথাটা ঠিক মনঃপুত হলো না ফারহানের, হতাশ হলো সে। ভেবেছিল সানাহ্ বলবে ‘ নাহ্ ভালো নেই আমি, একেবারেই ভালো নেই। আপনাকে ছাড়া আমি ভালো নেই,আপনার জন্য ভালো নেই। আপনাকে ছাড়া ভালো থাকা যায়না……আপনি শুনছেন কবি সাহেব ? ‘

কিন্তু সানাহ্ ফারহানের আশাকে দুরাশা করে দিয়ে এমন কিছুই বললো না। অবশ্য তাতে খানিকটা মন খারাপ হলেও ফারহান তা পাত্তা না দিয়ে বললো ‘ আজকাল ভার্সিটিতে আপনার দেখাই পাওয়া যায় না.… কি ব্যাপার ? আপনি কি ভার্সিটিতে আসেন না ? আজ অতসীও এলো না ? ‘

‘ আপনার সঙ্গে ভার্সিটিতে আমার কবেই বা দেখা হয়েছে কবি সাহেব ? ব্যাপার কিছুই না……আপনারা আমাদের বাড়ি যেদিন এলেন তারপর থেকে আমি ভার্সিটি যাইনি। আর অতসী কেন যায়নি সেটা তো সে জানে । তাকে অবশ্য বলেছিলাম যেতে কিন্তু সে যায়নি, এতে আমি কি করতে পারি ? ‘ নিজের মনে থাকা কষ্টের বাঁধ ভেঙে ফারহানের কথায় তেতে গিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে রাগী গলায় বললো সানাহ্।

‘ হ্যাঁ তা ঠিক যে আপনার আমার সঙ্গে ভার্সিটিতে দেখা হয়না তবে আপনার ভার্সিটি না যাওয়ার কারণ কি ? আহা আপনাকে তো কিছু করতে বলছি না আমি… আমি তো ব্যাস…… ‘

ফারহানকে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়েই মাঝে সানাহ্ বললো ‘ আমি ভার্সিটি কেন যাইনি সে একান্তই আমার ব্যাপার আর এতে বাইরের কারোর হস্তক্ষেপ আমি মানব না। আপনার কি কোনো জরুরি কথা আছে ? থাকলে বলুন নাহলে আমি ফোন রাখছি…… ‘

‘ আমি কি বাইরের কেউ ? ‘ ফারহান থমথমে গলায় বললো।

‘ সে তো আপনিই ভালো করে বলতে পারবেন…… ‘ সানাহ্ বললো তীক্ষ্ণ গলায়।

কথা বাড়াতে ইচ্ছা করছে না ফারহানের,ঝগড়া তো মোটেই নয়। তবে সানার তাকে বাইরের লোক বলাটা তাকে বেশ কষ্ট দিয়েছে তারই অজান্তে। সে ব্যাপারটাকে পাত্তা না দিয়ে বললো ‘ হুম কথা তো আছেই…… তার জন্যই আপনাকে ফোন দেওয়া। সত্যি বলতে আমি কাল সারারাত,আজ সারাদিন ভেবেছি। অনেক ভেবেছি আর এত ভাবনার পর আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই সিদ্ধান্তই আপনাকে জানাতে এত রাতে ফোন দিলাম। ‘

‘ কি সিদ্ধান্ত ? ‘ তীক্ষ্ণ গলায় বললো সানাহ্।

‘ আমি চাই আমার আর আপনার বিয়েটা হোক……তবে এর জন্য আমার একটু সময় দরকার। আমি সেইটুকু সময়ে আপনার সঙ্গে মানিয়ে নিতে চাই। ‘

এই প্রথম ফারহানের কথায় চমকে উঠলো সানাহ্। সে ভাবেনি এত রাতে ফারহান তাকে ফোন করে এভাবে চমকে দিতে পারে। ফারহানের কথা তার মনে প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি করলেও মুহূর্তের মধ্যে তার কিছু একটা মনে পড়লো আর সে সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে আবারও নিজের শক্ত খোলসে বেধে নিয়ে বললো ‘ হঠাৎ মাঝ রাতে ফোন করে এই কথা বলার কারণ ? আপনি তো আমাকে বিয়ে করতে চাইছিলেন না তাইনা ? ‘

‘ হুম এটা ঠিক যে শুরুতে আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাইনি কিন্তু এখন চাই কারণ কথাটা কঠিন হলেও এটাই সত্যি যে আপনার আমাকে প্রয়োজন……আর হয়তো আমারও আপনাকে। ‘ প্রথমে কথাগুলো জোরে বললেও শেষের কথাটা ফারহান বেশ আস্তেই বললো যার ফলে সানার কান অব্দি সেই কথা পৌঁছয়নি।

আচমকা সানার মনে হলো ফারহান তাকে বিয়ে করে তার উপর দয়া করতে চাইছে কিন্তু তার তো এই দয়ার প্রয়োজন নেই। আজ পর্যন্ত তো সকলে তাকে দয়াই করে এসেছে, দয়ার ভারে তার কাঁধ নুজ্জ্ব হয়ে এসেছে। আর চাইনা তার দয়া,আর চাইনা তার কাধে বোঝা। এতদিনের ঋণের ভার থেকে সে কবে মুক্ত হবে তার ইয়ত্তা নেই সেখানে নতুন ঋণের বোঝা সে সইতে পারবে না।

‘ আপনার কেন মনে হলো আমার আপনাকে প্রয়োজন ? ‘ শক্ত গলায় বললো সানাহ্হঃ।

‘ পৃথিবীতে সবারই কাউকে না কাউকে দরকার হয়,দরকার হয় জীবন সঙ্গীর। তেমনই আপনারও আপনার পাশে কাউকে দরকার। আপনার সঙ্গে তো আমার বিয়ে ঠিক হয়েছেই তাহলে আপনার জীবন সঙ্গী হতে সমস্যা কোথায় ? আপনার সঙ্গে আমার মেল বন্ধন সৃষ্টিকর্তাই ঠিক করেছেন নাহলে আমার মা আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করতেন না। এখন শুধু পালা একটু সময় নিয়ে সবটা সাজিয়ে নেওয়ার। এই সময়টা আমি পাবো তো ? ‘

‘ সুযোগ যখন সৃষ্টিকর্তা করে দিয়েছেন তখন তার ভবিষ্যৎ কি হবে সেটাও তো সৃষ্টিকর্তাই ঠিক করবেন তাইনা ? আপনি সময় পাবেন কি পাবেন না সেটা তো তার ইচ্ছা। এর উপর তো আর আমার হাত নেই..… ‘ সনাহ্ বললো।

‘ কথাটা আপনার খাঁটি হয়েছে…. যাই হোক মাঝরাতে ফোন দিয়ে বিরক্ত করলাম। আপনাকে যেই কথাগুলো বলতে চেয়েছিলাম সেই কথাগুলো বলে ফেলেছি আমি। এখন আমি দায়মুক্ত। আপনি এক কাজ করুন।এখন শুয়ে একটা শান্তির ঘুম দিন,বেশি রাত জাগবেন না। তারপর কাল সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে ভার্সিটি আসবেন। কাল তাহলে আমাদের নতুন করে প্রথম দেখা হবে ভার্সিটিতে ? ‘ ফারহান বললো।

‘ কাল দেখা হবে কি হবে না সেটাতো উপরওয়ালাই জানেন। ভবিষ্যৎ তো উনার হাতে..…আমি তাহলে রাখি ‘ সানাহ্ বললো।

‘ কথা ঠিক……মনে হচ্ছে মিস সানাহ্ আমাকে খুব দ্রুত তাড়াতে চাইছেন। ব্যাপার না..…কাল দেখা হবে..…খোদা হাফেজ। ‘

‘ খোদা হাফেজ ‘

—-

রাতের অন্ধকারে রাস্তার মাঝ দিয়ে হেঁটে চলেছে সানাহ্। আজ সে দায়মুক্ত……সকল ঋণের ভার পিছনে ফেলে রেখে এগিয়ে চলেছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। গন্তব্য তার অনিশ্চিত, ঠিক তার ভবিষ্যতেরই মতো। সানাহ্ বরাবরই নিস্তব্ধ, নীরব প্রকৃতি প্রেমিকা তবে আজকের এই মাঝ রাত্তিরের নীরবতা তার আরও বেশি পছন্দের কারণ আজ সে সব দায় থেকে মুক্ত।

বাড়িতে কঠিন রকমের পাহারা বসানো হয়েছে। সানার ঘরে অতসী শুয়েছে যাতে সানাহ্ ঘর ছেড়ে বের হতে না পারে। বাড়ির বাইরেও মেইন গেটে দুটো দারোয়ান, যারা সার্বক্ষণিক পালা করে পাহারা দিচ্ছে। এদের পর ভোর ছয়টায় আরও দুজন আসবেন যারা এদের পরিবর্তে পাহারা দিবে।

তবে সানাহ্ যে এত পাহারা ফাঁকি দিয়ে এভাবে পালিয়ে আসবে তা কেউ ভাবতে পারেনি,এমন কি সানাহ্ও না। সানাহ্ তার আলমারিতে রাখা তার মামণির পুরোনো এক শাড়ি বারান্দার রেলিংয়ে ঝুলিয়ে তা দিয়েই নেমে গেছে খুব সাবধানে। কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি এত কঠিন পাহারার বেড়াজাল পেরিয়ে সানাহ্ এত সহজেই বেরিয়ে পড়বে। সানাহ্ এগিয়ে যাচ্ছে তার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে হাসিমুখে অথচ অসুস্থ শরীর নিয়ে। অসুস্থ মন নিয়ে নতুন শুরু কি তার জীবনকেই অসুস্থ করে তুলবে ?

~ চলবে ইনশাআল্লাহ্…

#প্রেমমানিশা(১০)

‘ দাদা এক পাতা প্যারাসিটামল হবে ? ‘

আচমকা এই প্রশ্নে দোকানি চমকে গেলো,খানিকটা ভ্যাবাছ্যাকাও খেয়েছে মনে হয়। আজকের সময়ে দাড়িয়ে কোনো ফার্মেসিতে প্যারাসিটামল না থাকাটা যেখানে অপরাধের কথা সেখানে ফারাইরার প্যারাসিটামল আছে কিনা জিজ্ঞেস করা আরও বড় অপরাধ।

দোকানির এহেন হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার মানে খুঁজে পেলো না ফারাইরা। এই দৃষ্টির মানে যেহেতু ফারাইরার মস্তিষ্কে ঢোকেনি সেহেতু সে আবারও বললো ‘ প্যারাসিটামল কি আছে দাদা ? ‘

দোকানি যথারীতি আবারও বিরক্ত হলো ফারাইরার কথায় তবে প্রতি উত্তরে কিছু না বলে এক পাতা প্যারাসিটামল এনে ফারাইরার সামনে রাখলো। ফারাইরা ওষুধের পাতা হাতে নিয়ে বলল ‘ দাদা এক পাতা কত ? ‘

এবার যেন দোকানি আকাশ থেকে পড়লো। ফারাইরার দিকে সংকীর্ণ চোখে তাকিয়ে বললো ‘ দশ টাকা পাতা…… ‘

ফারাইরা দোকানির কথামত ব্যাগ থেকে দশ টাকা বের করে দোকানিকে দিয়ে ওষুধ হাতে নিয়ে বাসের দিকে দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটা দিলো। সকলে অপেক্ষা করে বসে আছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। ফারাইরা পৌঁছলেই বাস ছাড়বে।

ফারাইরা বাসে উঠে বাসের ডান দিকের সারির দুই নাম্বার সিটের সামনে দাড়িয়ে মৃদু গলায় বললো ‘ আপু…. আপু আপনার ওষুধ ‘ ।

মেয়েলি গলার আভাস পেয়ে সানার ঘুম ভেংগে গেল। সে তার হরিণী চোঁখ মেলে চাইলো। ঘুমঘুম ভাবটা এখনও কাটেনি বলে ঘুমের ঘোরে বুঝতে পারছে না সামনে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটা কে। মেয়েটা কে ঠাওর করতে না পেরে সানাহ্ সংকীর্ণ দৃষ্টিতে বললো ‘ তুমি…তুমি কে ? Who are you ? ‘

‘ আমি……আমি ফারাইরা..…ফারাইরা জামান দৃঢ়তা । কাল রাতে আপনাকে এলোমেলো ভাবে রাস্তায় হাঁটতে দেখে বাস থামিয়ে আপনাকে যে বাসে উঠিয়েছিলাম ‘ ফারাইরা স্বচকিত দৃষ্টিতে বললো।

ফারাইরার কথা শুনে সানাহ্ এবার পূর্ণ দৃষ্টি মেলে ফারাইরার দিকে তাকালো। ঘুমঘুম ভাব তার কেটে গেছে বলে ফারাইরার চেহারা তার কাছে স্পষ্ট হয়ে এসেছে। মেয়েটাকে চিনতে পেরে অপ্রতিভ হলো,মেয়েটা কাল রাতে ওকে হেল্প করলো আর ও তাকে চিনতেও পারলো না। নিরুচ্চারে বললো ‘ আর ইউ ব্লাইন্ড সানাহ্ ? ‘
সম্মুখে বললো ‘ হ্যাঁ তাইতো……আসলে ঘুমের ঘোরে ছিলাম তাই চিনতে পারিনি। আই অ্যাম সরি ফর দিস কাইন্ড অফ বিহেভিয়ার। ‘

সানার এহেন গোছানো কথা শুনে ফারাইরা অবাক না হয়ে পারলো না। নিরুচ্চারে বললো ‘ স্ট্রেঞ্জ…… কাল রাতে এমনভাবে কথা বলছিলেন যেন কোনোমতেই গুছিয়ে বলতে পারছেন না, লাইক এ ড্রাংক। আর আজ কী সুন্দর গুছিয়ে বলছেন……আসলেই জ্বর মানুষকে কাবু করতে পারে। ‘

ফারাইরা সম্মুখে বললো ‘ ইটস ওকে আপু……আপনার জন্য একটা প্যারাসিটামল এনেছি……খেয়ে নিন, খেলে গায়ের জ্বরটা ছাড়বে। ‘ ফারাইরা কথাগুলো বলেই সানার দিকে প্যারাসিটামল এগিয়ে দিল।

ফারাইরার হাতে থাকা প্যারাসিটামলের দিকে তাকিয়ে মৃদু তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো সানাহ্।এতদিন এত প্যারাসিটামল, এন্টি বায়োটিক খেয়েও তার জ্বর সারলো না আর এখন এই সামান্য 500mg Napa ট্যাবলেট খেয়ে সেরে যাবে। ব্যাপারটা বড়ই হাস্যকর। যেখানে এত হাইলি পাওয়ারের এন্টি বায়োটিক আর প্যারাসিটামল তার জ্বরকে কাবু করতে পারলো না সেখানে এই সামান্য পাওয়ারের ওষুধ পারবে ?

তবে সানাহ্ নেহাতই ভদ্রতার বসে কোনো উচ্চবাচ্য না করেই ফারাইরার হাত থেকে ওষুধের পাতাটা নিলো কারণ মেয়েটা নিজ উদ্যোগে গিয়ে কিনে এনেছে ও খাবে বলে তাই না নিলে খারাপ দেখায়। সানাহ্ পাতা থেকে ওষুধ বের করে মুখে দিতেই ফারাইরা পাশে থাকা রবিনের কাছ থেকে পানি বোতল নিয়ে বোতলের মুখ খুলে সানার দিকে এগিয়ে দিল। একটু আগে ফারাইরা তাকে বন পাউরুটি দিয়েছি, সেগুলো খেয়েই ওষুধ খেলো। ফারাইরার হাত থেকে বোতল নিয়ে তিন ঢোকে পানি খেয়ে সেটা ফেরত দিয়ে বললো ‘ থ্যাংক ইউ ফর ইউর হেল্প, আই উইল রিমেম্বার ইউ ‘ ।

‘ ইউর ওয়েলকাম ‘ মিষ্টি হেসে উত্তর দিলো ফারাইরা ।
তারপর ফারাইরার সঙ্গে আরও কিছু কথাবার্তা বলে বাসের সিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলো সানাহ্। তার মনে পড়লো এতক্ষণে কি ফারহান চিঠিটা পেয়ে গেছে ? আবার মনে হলো চিঠিটা কি নিজের ঘরে রেখে এসে ঠিক করলো ? অন্য কেউ আবার চিঠিটা পড়বে নাতো ? যদিও চিঠির উপরে স্পষ্ট লাল কালিতে লেখা ‘ মিস্টার ফারহান ছাড়া কারোর জন্য পড়া স্ট্রিকটলি প্রোহাইবিটেড ‘ । নাকি সরাসরি ফারহানের ঠিকানায় দিয়ে আসতে হতো ? কিন্তু এভাবে হলেও তো পাওয়ার চান্স নেই কারণ এখন যা পরিস্থিতি তাতে ফারহানের দিন রাত ওই বাড়িতে থাকারই সম্ভাবনা বেশি।

চোখ বুজেই সানার মনে পড়লো কাল রাতের কথা। কাল রাতে মেয়েটা যেভাবে সাহায্য করলো তার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে হয়তো এত কিছু করতো না। অন্য কেউ কেন সানাহ্ নিজেই করতো না। ফারাইরা প্রমাণ করে দিয়েছে পৃথিবীতে এখনও মানবতা বেচেঁ আছে।

ভাবাভাবির এক পর্যায় ওষুধের প্রভাবে সানার চোখ লেগে এসেছিল কিন্তু পাশ থেকে ফারাইরার ডাকে কান দুটো সজাগ হয়ে উঠলো। ঘুমঘুম চোখেই শুনলো ফারাইরার বলছে ‘ আপু আমরা রাজশাহী এসে গেছি, নামতে হবে আমাদের। আপু..…আপু উঠুন ‘ ।

ঘুম ভেংগে আড়মোড়া ভেঙে সিটের গা ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো সানাহ্। হঠাৎ খেয়াল করলো আশ্চর্যজনকভাবে Napa 500mg কাজ করতে শুরু করেছে। তার পুরো শরীর একেবারে ঘেমে নেয়ে একাকার। সানাহ্ তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার শরীর ঘিনঘিন করে উঠছে গরমে। কী ব্যাপার জ্বর কি নেমে গেলো নাকি ?

‘ আপু……আপনি কি জেগে আছেন ? ‘

পাশ থেকে ফারাইরার প্রতি নিয়ত ডাকাডাকিতে সানাহ্ বিরক্ত হয়ে চোখ খুললো তবে নিজের বিরক্তি ভাবটা চেহারায় ফুটে উঠতে দিলনা কারণ মেয়েটা তাকে অনেক সাহায্য করেছে। সানাহ্ চোখ খুলতেই ফারাইরা বললো ‘ আপু আমাদের নামতে হবে। আপনি নামবেন না ? ‘

‘ হুম চলো ‘ বলে সানাহ্ তার চেহারায় গম্ভির ভাব বজায় রেখে উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেলো আর ফারাইরা ওকে অনুসরণ করে পিছন পিছন এগোলো। ফারাইরা একসঙ্গে বাস থেকে নিচে নেমে বাকিদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো । সানাহ্ বললো ‘ থ্যাংক ইউ ফর ইউর কাইন্ড হেল্প…আই উইল অলওয়েজ রিমেমবার ইউ। তোমাদের কোনো হেল্প লাগলে নির্দ্বিধায় বলতে পারো। ‘

সানার কথা শুনে ফারাইরা কিছু বলবে তার আগেই ওর ফ্রেন্ড জুঁইতি বললো ‘ না না আপু আপনাকে হেল্প করাটা আমাদের কর্তব্য ছিল আর আমরা তাই করলাম। এর বদৌলতে আমাদের কিছু চাই না। উই আর হ্যাপি টু হেল্প ইউ…… ‘

‘ আপু আপনার কি শরীর বেশি খারাপ ? আপনি বললে আমরা দু একজন মিলে আপনাকে আপনার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি..…আপনার তো কোনো ব্যাগও নেই। সমস্যা হবে না……আমরা দিয়ে আসি। ‘ রবিন অনুনয়ের সুরে বলল।

‘ নো নো…… এর প্রয়োজন নেই। তোমরা শখ করে ঘুরতে বেরিয়েছিলে অথচ মাঝে আমি এসে ঝামেলা করে দিলাম। অথচ তোমরা আমার অনেক হেল্প করেছো কিন্তু বিনিময়ে আমি কিছুই করতে পারছি না। এখন আমি বাকিটা রাস্তা একাই যেতে চাইছি…… জ্বরটা আমার ছেড়ে দিয়েছে। বাড়ি গিয়ে রেস্ট নিবো..’ সানাহ্ অপরাধী মুখে বললো।

‘ আরে না না আপু কিসের কষ্ট ? আপনি এমনভাবে বলছেন যেন আমাদের হেল্প নিয়ে আপনি কোনো বড় গুনাহ্ করে ফেলেছেন…… আচ্ছা যাই হোক আপনি যখন চাইছেন একা যেতে তখন আপনি তাই করুন। তবে আপনি একটু আমাদের কারোর নাম্বারটা নিয়ে নিন, বাড়ি পৌছে জানিয়ে দিবেন যে আপনি পৌছে গেছেন নাহলে আমাদের টেনশন হবে ‘ জুঁইতি বললো।

‘ আচ্ছা ‘

‘ এই ফারাইরা তোর নাম্বারটা দে ‘ জুঁইতি বললো।
আচমকা জুঁইতির গলা শুনে চমকে উঠলো ফারাইরা। সে এতক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়েছিল সানার দিকে। কাল রাতে খেয়াল করেনি তবে আজ কেন জানি সানাহ্কে তার চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে সানাহ্কে কোথাও দেখেছে কিন্তু মনে করতে পারছে না। কে এই সানাহ্ ?
কিন্তু জুঁইতির ডাক শুনে ভাবনা ছেড়ে বেরিয়ে এলো। স্বচকিত গলায় বললো ‘ হুম, আপু আপনি আপনার নাম্বার দিন। আমি সেভ করে নিচ্ছি ‘ বলে সানার দিকে দৃষ্টি দিলো ফারাইরা।

ফারাইরার কথায় সানাহ্ ওর নাম্বারটা ফারাইরাকে দিলো। ফারাইরা বললো ‘ আপু কি দিয়ে সেভ করব ? ‘

‘ সানাহ্ ‘

সানাহ্ নামটা শুনে এবার যেন ফারাইরা আরও চমকে উঠলো। কি আশ্চর্য নামটাও চেনা চেনা লাগছে কিন্তু কিছুতেই কিছু মনে করতে পারছে না ? নামটা কি ওর পরিচিত কেউ বলেছিল ? জাপান ? জাপান বলেছিল ? নাহ্ পিকনিক থেকে ফিরেই জাপানকে জিজ্ঞেস করতে হবে। এখনই সানাহ্কে কিছু বলা যাবে না। দেখা গেলো পরে অনুমান ভুল বের হলো ।

—-

মিসেস রাহেলা যখন বাড়ির বাগানের মালির কাছ থেকে কাল বিকেলে বাগান ছেড়ে কোথায় গিয়েছিল তার কৈফিয়ত নিতে ব্যস্ত তখনই কথার এক পর্যায়ে তার চোখ গেলো বাড়ির ফটকের দিকে। দীর্ঘ ফটক পেরিয়ে ভিতরে আসছে সানাহ্। সানার হাঁটা চলা আর ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে সে খানিকটা অসুস্থ। হুট করে সাত সকালে সানাহ্কে দেখে মোটেই অবাক হননি মিসেস রাহেলা কারণ এরকমটা প্রায়ই ঘটে থাকে। তবে এবার বেশ কয়েক দিন পর এরকম হয়েছে।কতদিন হলো ? প্রায় এক বছরের কাছাকাছি..…

তবে পরিস্থিতির বিবেচনায় মিসেস রাহেলা তার ভাবাভাবির চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে সানার দিকে এগিয়ে গেলেন। সানার কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বললেন ‘ সানাহ্ তোকে এরকম অসুস্থ দেখাচ্ছে কেন ? ‘

ক্লান্তিময় রোদের পরশ সানার চোখে মুখে আছড়ে পড়ছে। সেই রোদের দিকে তাকিয়েই ঘর্মাক্ত মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে সানাহ্ বললো ‘ সারারাত জার্নি করে এসে আমি বহুত টায়ার্ড তাই এরকম দেখাচ্ছে। ‘

‘ আচ্ছা তুই এক কাজ কর……এখানে মাথার উপর খাড়া রোদে দাড়িয়ে না থেকে ঘরে চল। ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করে রেস্ট নিবি।একটু রেস্ট করলেই দেখবি শরীর চাঙ্গা হয়ে গেছে ‘ বলে সানার কাধে হাত রেখে নিজ উদ্যেগে সানাহ্কে বাড়ির ভিতর নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলেন।

—-

‘ রাহেলা এদিকে এসো..…একটু বাম হাতের মাছের ব্যাগগুলো নাও তো ‘ বলতে দুই হাত ভর্তি নানান বাজারের ব্যাগ হাতে বাড়ি ঢুকলেন মিস্টার আমান।
মিস্টার আমানের ডাক শুনে হাতের কাজ রেখে এক ছুটে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন মিসেস রাহেলা। তড়িঘড়ি করে মিস্টার আমানের হাত থেকে মাছের ব্যাগ নিয়ে বললেন ‘ ভাইজান কোথায় ? আপনার সাথে না বের হয়েছিল ? ‘

‘ সে আর বলো না……পথে ফিরতে সময় তার এক মক্কেলের ফোন……আর্জেন্ট দেখা করতে হবে তাই সে ছুটলো দেখা করতে। এই পনেরো মিনিটের মধ্যে ফিরবে। তা ওই শাহজাদা ওঠে নি এখনো ঘুম থেকে ? ‘ এক হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন মিস্টার আমান।

‘ আহ্ এভাবে বলছেন কেন ? আজকে ছুটির দিন…একটা দিন তো বেচারাকে একটু শান্তিতে ঘুমোতে দিন। রোজ তো অফিস করে, আজ নাহয় ঘুমাক। ‘ মিসেস রাহেলা রান্নাঘরে বাজারের ব্যাগ রাখতে রাখতে বললেন।

মিস্টার আমান স্ত্রীয়ের পিছন পিছন রান্নাঘরে এসে হাজির হয়ে বললেন ‘ এখন তো ঘুমোচ্ছে কিন্তু বিয়ের পর ? বিয়ের পর কি করবে ? বিয়ের বয়স তো হয়ে গেছে তার..… এই তুমিই শায়খকে মাথায় তুলছো। কোনো ঘুমোনো নেই……আমি তুলছি ওকে ‘ বলে মিস্টার আমান দ্রুত পা চালিয়ে রান্নাঘরের বাইরে চলে গেলেন আর মিসেস রাহেলা সেই পানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাজার গোছানোর কাজে লেগে পড়লেন। ঠিক করলেন আজ ছুটির দিন তাছাড়া সানাহ্ও বাড়ি এসেছে,কিছু ভালোমন্দ রান্না করবেন ।

খাবার টেবিলে সকলে জড়ো হয়েছে, অপেক্ষা চলছে সানার প্রবেশাধিকারের। ইতিমধ্যে সানার বড় মামা মিস্টার আশরাফও মক্কেলের সঙ্গে দেখা করে ফিরেছেন। সানার ছোটো মামা শায়খও তার ভাগ্নির আশার খুশিতে কোনো উচ্চবাচ্য না করেই দ্রুত আরামের ঘুম ছেড়ে খাবার টেবিলে হাজির হয়েছে।

সানার আগমনের খুশিতে মিস্টার আমানও আরেক প্রস্থ বাজারে গিয়ে মাঝারি সাইজের চিংড়ি মাছ কিনে এনেছেন, ভাগ্নির পছন্দ বলে। মিস্টার আশরাফ তার ভাগ্নির আগমনে লাইব্রেরী ঘরের ধুলোয় মিশে থাকা নভেলগুলো নিজ হাতে ঝেড়ে পরিষ্কার করেছেন, অবসর সময়ে ভাগ্নির সঙ্গে নভেল পড়ে কাটাবেন বলে। তবে যেই সানার আগমনে এতকিছু ঘটে গেলো সেই সানারই কোনো পাত্তা নেই।

‘ ভাবী তুমি গিয়ে একটু দেখে আসতো সানাহ্ এখনও আসছে না কেন ? ও কি রেস্ট নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ? ‘ শায়খ বললো। শায়খের কথায় সম্মতি দিয়ে মিসেস রাহেলা উঠতে যাচ্ছিলেন তবে তখনই সানাহ্ ধীরে ধীরে পা ফেলে সিড়ি দিয়ে নেমে এলো।

‘ কোনো দেখাদেখির প্রয়োজন নেই মামা। তুম বুলায়ে ওর হাম না আয়ে…… সানাহ্ তোমারে সামনে হাজির হ্যাঁ ‘ কথাগুলো বলতে বলতে সানাহ্ শায়খের মুখোমুখি বসলো।

‘ তুই যে হুট করে এসে হাজির হয়েছিস সেটা কি আদৌ ছোটো আপা আর কবির ভাইকে জানিয়ে হাজির হয়েছিস ? ‘ শায়খ সানার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো।

‘ কেন না বলে এলে কি আমাকে তোমাদের বাড়ি থাকতে দিবে না ? না দিলে বলো আমি এখনই বের হয়ে যাচ্ছি তাছাড়া ইটস কম্প্লিটলি ডিপেন্ড অন মি আমি কাউকে বলে আসবো নাকি না বলে আসবো..… ‘ খেতে খেতে গম্ভির ভঙ্গিমায় বললো সানাহ্ ।

সানার এহেন কথাবার্তায় শায়খ খানিকটা ঘাবড়ে গেল কারণ সানাহ্ যদি একবার ভাবে সে বেরিয়ে যাবে তাহলে সে সত্যি সত্যি বেরিয়ে যাবে আর তখন চাইলেও ওকে আর খুজে পাওয়া যাবে না।এইদিকে সানার এহেন কথাবার্তায় মিস্টার আমান বেজায় রেগে গেলেন শায়খের উপর। আগ্রাসী কন্ঠে বললেন ‘ খাওয়ার সময় কি তোর এসব কথা না তুললেই নয় শায়খ ? একদিন বাড়িতে আছিস শান্তিতে খা দা আর ঘুমা। এত কথা কিসের ? ‘

তবে দুই ভাইয়ের মাঝে মিস্টার আশরাফ কিছু না বলে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলেন। উনি নীরব,নিজের মতো খাচ্ছেন। যদিও উনি উনার ভাগ্নিদের খুব ভালোবাসেন তবে সেটা কাজে প্রকাশ করেন, কথাবার্তায় নয়।

‘ থাক আপনাদের আর ঝগড়া করার দরকার নেই। শায়খ তুমি খাওয়াটা শেষ করো……একদিন বাড়ি আছো..…তোমার ভাইয়ের সঙ্গে ঝামেলা করে কি লাভ ? ‘ মিসেস রাহেলা দুই ভাইয়ের কথার মাঝে বললেন। মিস্টার আমানও আর কথা বাড়ালেন না।

‘ বড় মামা…… লাইব্রেরির নভেলগুলোর কি অবস্থা ? সংখ্যা কি বেড়েছে ? ‘ সানাহ্ বললো ।

‘ হুম নিউ সিরিজ এসেছে…… ওই যে নামটা কি ? The Chronicles of Prydain,Outlander,. A Wizard of Earthsea,The Broken Earth Trilogy..… আপাতত এই কয়েকটাই এনেছি তবে আমার মনে হয়না তোর পক্ষে খুব তাড়াতাড়ি এসব শেষ করা সম্ভব হবে। তুই কতদিন আছিস ? ‘ মিস্টার আশরাফ বললেন।

‘ হুম ঠিক বলেছো……সম্ভব হবে না। বলতে পারছিনা যে বড় মামা.. একদিনও থাকতে পারি আবার দশ দিনও থাকতে পারি। এবার মন চাইলে শুধু আজ রাতটাই থাকতে পারি। তা মামা তোমার অফিস কেমন চলে ? মেয়ে কি কোনো দেখেছো ? বয়স তো হচ্ছে…… বিয়ে করবে না ? ‘ সানাহ্ বললো।

‘ আমার বিয়ে হলে তোর পরেই হবে কারণ ছেলেরা অত তাড়াতাড়ি বিয়ে করে না। আমার বয়স হচ্ছে ? আমি কতই বা বড় তোর ? পাঁচ বছর থেকে দুই মাস কম মানে চার বছর দশ মাসের বড়…… এটা কে তুই বড় বলছিস ? তোর চোখ নষ্ট হয়েছে ? ‘ শায়খ বললো কপট রাগ দেখিয়ে।

‘ হুম সত্যি বলেছো..… নষ্টই হয়েছে ‘ আনমনে বললো সানাহ্……

~ চলবে ইনশাআল্লাহ্….

#প্রেমমানিশা(১১)

সানাহ্দের বাড়িতে কেমন যেন হইচই বেঁধে গেছে। প্রতিবেশীরা চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ শুনেও এবার আর কৌতূহল মেটাতে বাড়ির সামনে এসে হাজির হননি কারণ এই ঘটনা এখন তাদের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। এরকম প্রায় কয়েক মাস পরপরই হয় তবে এবার প্রায় এক বছর পর হয়েছে।

মিসেস কায়নাত,অতসী আর মিস্টার কবির মিলে পুরো বাড়ি উল্টেপাল্টে একাকার করে ফেলেছেন তবুও কোথাও সানার খোঁজ নেই। একসময় খোঁজাখুঁজি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে মিসেস কায়নাত বসার ঘরের সোফায় নিজের ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহ এলিয়ে দিলেন।
অতসীও পাশে বসে জিরোচ্ছে আর অদূরে মিস্টার কবির থানার এসআই এর সঙ্গে কথা বলছেন সানাহ্কে খোঁজার ব্যাপারে। খানিক জিরিয়ে নিয়ে হঠাৎ মিসেস কায়নাত কেঁদে উঠলেন। অতসী তার মাকে আচমকা কাদতে দেখে অবাক হয়ে গেলো, মিস্টার কবিরও এসআই এর সঙ্গে কথা বলা থামিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন স্ত্রীয়ের দিকে।

‘ এইসব আমার অবহেলার ফল, মেয়েটার দিকে যদি আরেকটু নজর দিতাম তাহলে মেয়েটা আমার এভাবে বাড়ি ছেড়ে রাতের বেলা একলা বেরিয়ে যেতে পারতো না। কবির..…ও কবির আমার মেয়েকে তুমি খুঁজে এনে দাও। ওকে বলো তুমি ফিরে আসতে……আমি আর ওর উপর রাগারাগি করবো না,ওকে কোনকিছুতে জোর করবো না। ‘ এক প্রকার বিলাপ করতে করতেই কথাগুলো বললেন মিসেস কায়নাত।

অতসী তার মাকে এভাবে কপাল চাপড়ে বিলাপ করতে দেখে হতবাক। মিস্টার কবির কি করবেন বুঝতে না পেরে ফোন কানে দিয়ে এস আইকে বললেন ‘ স্যার আই উইল টক উইথ ইউ আফটার ফিউ মিনিটস..…প্লিজ স্টার্ট লুকিং ফর মাই ডটার…… ‘ । এস আই কি বললেন শোনা গেলনা তবে মিস্টার কবির ফোন রেখে দিয়ে অতসীকে বললেন ‘ অতস তোর মাকে সামলা…… ওকে শান্ত কর ‘ । অতসী তার বাবার কথা শুনে মিসেস কায়নাতের দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে শান্তনা দিতে দিতে মিস্টার কবিরকে বললো ‘ বাবা তুমি আশা আন্টিকে ফোন দাও……এখন আন্টি ছাড়া কেউ সামলাতে পড়বে না মাকে। তুমি আন্টিকে এখনই ফোন করো…… ‘

—-

‘ ফারহান তুই কি ঠিক করলি কোনদিন সানাহ্কে নিয়ে বিয়ের শপিংয়ের কাজগুলো সারবি ? ‘ ছেলের পাতে রুটি দিতে দিতে বললেন মিসেস আশা।

ফারহান সবে রেডি হয়ে নামছিল ব্যাংকের কিছু কাজ মিটিয়ে আসবে বলে। মিসেস আশার কথা শুনে জায়গা মতো বসতে বসতে বললো ‘ হুম দেখি কাল পরশুর মধ্যেই যাবো…… সানাহ্কে বলে সন্ধ্যার দিকে সময় বের করতে হবে…… ‘

‘ কাল পরশু তোদের বিয়ে হতে চলেছে আর তুই এখনও সানাহ্কে আপনি করে সম্বোধন করিস ? ‘

‘ তো তুমি কি চাও আমি উনাকে কি বলে সম্বোধন করি ? ‘

‘ অবশ্যই নাম ধরে আর তুমি বলে ডাকবি। দুদিন পর তোদের বিয়ে..…এখন তুই ওকে এভাবে আপনি আপনি করে ডাকলে লোকে কি বলবে ? ‘

‘ বিয়েটা আমার আর সানার,ভবিষ্যতের সংসারটাও নিশ্চই আমাদের। এখানে লোকে কি বলবে ভাবলে জীবন কি করে চলবে ? আমাদের সবে বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমরা এখনও একে অপরকে চিনি না, জানি না,বুঝি না। আগে সেগুলো হোক তারপর আস্তে আস্তে আপনি থেকে তুমিতে নেমে আসবো…… ‘ ফারহান বললো।

‘ বুঝলাম……ছেলেটা আমার বড় হয়েছে, সে এখন আর বাচ্চা নেই। আমার বাচ্চা ছেলেটা এখন সম্পর্কের সমীকরণ, বোঝাপড়া সবই বুঝে। ‘ মিসেস আশা অশ্রুজল চোখে বললেন।
ফারহান তার মাকে কাদতে দেখে মৃদু হাসলো। মিসেস আশা যে তার ছেলের উন্নতিতে কাদছেন বুঝতে পেরেই এই হাসি। প্রশান্তির এক হাসি,মায়ের ইচ্ছা পূরণ করতে পারার হাসি।

ফারহান আর মিসেস আশা যখন খেতে ব্যস্ত তখনই বসার ঘরের টেলিফোন বেজে উঠলে। ফারহান উঠতে যাচ্ছিল ফোন ধরবে বলে কিন্তু মিসেস আশা ওকে আটকে দিয়ে বললেন ‘ তুই খা, আমি দেখছি ‘ । মিসেস আশা উঠে গিয়ে টেলিফোনটা রিসিভ করলেন। উনি ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মিস্টার কবির বললেন ‘ আসসালামু আলাইকুম আশা……আমি সানার বাবা ‘ ।

মিস্টার কবিরের কথার উত্তরে মিসেস আশা বললেন ‘ হ্যাঁ ভাইজান আমি বুঝতে পেরেছি..…ভাইজান কিছু কি হয়েছে ? আপনার গলা কেমন শোনাচ্ছে..… ‘

‘ অনেক কিছু হয়ে গেছে আশা..…সানাহ্কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বোধ করি কাল রাতেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছে আর এইদিকে মেয়েকে না পেয়ে মেয়ের মায়ের বেহাল দশা। সানার মা সেই থেকে বিলাপ করছে আর কান্নাকাটি করছে, অতসীও ওকে সামলাতে পারছেনা। এই সময় সানার মায়ের তোমাকে খুব দরকার। তুমি একটু আসতে পারবে ? ‘

মিস্টার কবিরের কথা শুনে মিসেস আশার মাথায় যেন বাজ পড়লো। উনি হতভম্ব ভঙ্গিতে দ্রুত বললেন ‘ অবশ্যই ভাইজান..…আমি এখনই রওয়ানা দিচ্ছি। দশ মিনিটের মধ্যে আপনাদের বাড়িতে হাজির হচ্ছি….. ‘।

‘ আচ্ছা ঠিকাছে তুমি তাহলো এসো..…আমি ফোন রাখছি, খোদা হাফেজ। ‘

‘ আল্লাহ হাফেজ ভাইজান ‘ বলেই মিসেস আশা ফোন রাখলেন। ফোন রেখে সঙ্গে সঙ্গে খাবার ঘরের দিকে গেলেন। খাবার ঘরে ঢুকে ফারহানকে বললেন ‘ ফারহান তুই কি আমাকে একটু সানাহ্দের বাড়ি নামিয়ে দিতে পারবি ? ‘

ফারহান তার মায়ের এহেন অস্থিরতা দেখে বললো ‘ কি হয়েছে মা ? তুমি এত অস্থির হচ্ছো কেন ? আর এমন অসময়ে তুমি ঐ বাড়ি যাচ্ছ যে ? তোমার না অফিসে যেতে হবে ? ‘

‘ অনেক বড় অঘটন ঘটে গেছে ফারহান। সানাহ্কে কাল রাত থেকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। এইদিকে কায়নাতের অবস্থা খারাপ, বেচারি মেয়ের চিন্তায় বিলাপ বকছে। ভাইজান টেনশনে টেনশনে অস্থির হয়ে আমায় ফোন দিয়ে বললেন আমি যেন ও বাড়ি যাই, এখন একমাত্র আমিই কায়নাতকে সামলাতে পারবো। তুই কি আমাকে একটু নামিয়ে দিতে পারবি বাবা ? ‘ মিসেস আশা চিন্তায় অস্থির হয়ে বললেন।

‘ শুধু নামিয়ে দেওয়ার প্রশ্ন আসছে কেন ? আমাদের উচিত সানাহ্কে খুঁজে বের করা। তুমি আসো,আমি গাড়ি বের করছি। ‘ ফারহান অস্থির হয়ে বললো।

‘ আচ্ছা তুই তাহলে গাড়ি বের কর..…আমি খাবারগুলো ফ্রিজে রেখে আসছি। ‘

‘ আচ্ছা ‘

—-

‘ মা.. মা তুমি একটু নিজেকে সামলাও,তুমি এভাবে ভেঙে পড়লে কি করে হবে ? তাহলে আপাইকে খুজে বের করবো কি করে ? নিজেকে সামলাও মা..… ‘ অতসী মিসেস আশার গাঁয়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল।

‘ খবরদার আমার গায়ে হাত দিবি না তুই..… তুই ইচ্ছে করে সানাহ্কে যেতে দিয়েছিস তাইনা ? তুই যদি তোর দায়িত্বে গাফিলতি না করতি তাহলে সানাহ্ এভাবে বেরিয়ে যেতে পারতো না। তুই কেন এরকম করলি অতসী ? এখন আমি আফজাল ভাই আর দিদিকে কি জবাব দিবো ? ওদের আমি কি বলবো যে তাদের মেয়েকে আমি আগলে রাখতে পারিনি ? সব আমার জন্য…… তোকে ওর কাছে থাকতে না দিয়ে আমারই থাকা উচিত ছিল..… ‘ অতসীকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়ে এক প্রকার বিলাপ করতে করতেই বললেন মিসেস কায়ানাত।

প্রিয়তমা স্ত্রীর এহেন ভঙ্গুর দশা দেখতে পারছেন না মিস্টার কবির। স্ত্রীকে যে শান্তনা দিবেন তারও অবকাশ নেই কারণ থানার এস আইয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন। ভদ্রলোক বললেন এখন জিডি করতে হলে উনাকে থানায় যেতে হবে আর বাড়ির যা অবস্থা তাতে আশা না আসা অব্দি বাড়ি ছেড়ে বের হওয়া যাবে না।

কিছুক্ষণ পরই মিসেস আশা আর ফারহান এসে সানাহ্দের বাড়ি পৌঁছলেন। মিসেস আশা বাড়িতে ঢুকেই প্রথমে বান্ধবীর কাছে গেলেন তাকে সামলাতে আর ফারহান গেলো মিস্টার কবিরের কাছে ব্যাপারটা পুরো ডিটেইলস এ জানার জন্য।

‘ আঙ্কেল ঘটনাটা আসলে কি সেটা আমাকে পুরোপুরি ডিটেইলসে বলুন…… ‘

‘ তোমরা তো উনিশ তারিখ এসেছিলে তোমার আর সানার বিয়ের ডেট ফিক্স করতে। তার একদিন পরে মানে একুশ তারিখ সকাল বেলা আমরা বুঝতে পারি সানার অনেক জ্বর,মনে হয় আগের দিন রাতে হয়েছিল। সানার জ্বর সাধারণ জ্বর নয়। একবার হলে কপালের রগ ফুলে নীল হয়ে যায়,মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায় আর জ্বর যত বাড়ে ততই ওর চোখও লাল হতে শুরু করে। সেই অবস্থায় ১০২° জ্বর নিয়ে মেয়ে আমার সারারাত বারান্দায় বসেছিল। তোমার আন্টি যে কতকিছু করলো..…মাথায় ঠান্ডা পানি দেওয়া,ডাক্তার ডেকে আনা সব হলো।

ডক্টর ওকে দেখলেন,দেখে বললেন এটা তো ওর সেই পুরোনো রোগ..…আবার হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে যাবে। এরকম সানার প্রায়শই হয়। জ্বর হলে চোখ লাল হয়ে যায়,মাথা বিগড়ে যায়। ওর এই জ্বর যত বাড়ে পাগলামিও ততই বাড়ে আর এই সময় ওর পক্ষে হুট করে বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।

এসব ভেবেই তোমার আন্টি ওর ঘরে অতসীকে শুতে বলেছিলেন যাতে অতসী সানাহ্কে পাহারা দিতে পারে। কিন্তু যেই কি সেই..…আমরা কেউ ভাবতে পারেনি পালানোর পথ খুজে না পেয়ে সানাহ্ আমরিন ভা..…মানে কায়নাতের শাড়ি বারান্দায় টাঙিয়ে নেমে যাবে। সেই থেকে তোমার আন্টির এই অবস্থা ‘ এক প্রকার মেয়ের চিন্তায় কাদো কাদো গলায় বললেন মিস্টার কবির।

‘ সানার যে এত জ্বর এই কথা আপনারা আগে কেন জানাননি আমাদের ? ‘ অবাক হয়ে বললো ফারহান।

‘ এমন জ্বর সানার প্রায়ই হয় তাই ভেবেছিলাম এবারও হয়তো সেরে যাবে। কিন্তু কাল যখন ডক্টর সবেদার লাস্ট দেখলেন তখন বললেন কালকের রাতটা দেখতে। কাল যদি জ্বর না সাড়ে তাহলে আজ ঢাকা মেডিক্যালে নিতে হবে। কিন্তু আজ সকাল হওয়ার আগেই তো আমার মেয়েটা সব ছেড়ে হারিয়ে গেলো। ফারহান..…বাবা এখন ওকে আমরা কোথায় খুঁজব ? ‘ মিস্টার কবির কাতর কণ্ঠে বললেন।

‘ আঙ্কেল তাহলে সবার আগে আমাদের ওর সব বন্ধু বান্ধবদের বাসায় খোঁজ নেওয়া উচিত এমনকি অতসীর যে বন্ধু বান্ধব আছে তাদের বাসায়ও ‘ ফারহান বললো।

‘ কিন্তু সানার যে কোনোই বন্ধু বান্ধব নেই বাবা।মেয়ে আমার কারোর সঙ্গেই মিশতে পারে না আর কাউকে সহজে বিশ্বাসও করতে পারেনা। তাইতো ওর কোনো বন্ধু বান্ধব নেই। ‘

মিস্টার কবিরের কথায় অবাক হলো ফারহান। সে ভাবেনি একটা মেয়ে এতটা ইন্ট্রোভার্ট হতে পারে যে তার কোনো বন্ধু বান্ধবই থাকবে না।

হঠাৎ অজানা আশঙ্কায় ফারহানের বুক কেপে উঠল। মনে হলো সানার তো ও যেদিন বিয়ে করবে না বলেছিল তারপর থেকেই জ্বর আর কাল রাতেও ওর সঙ্গে সানার কথা হয়েছে। তাহলে কি মেয়েটা ওর জন্যই কষ্ট পেয়ে ঘর সংসার ছেড়েছে ? এমনটা যদি হয় তাহলে ফারহানের কি হবে ? সে কাকে তার প্রিয়তমা করবে ? তাহলে কি আবারও সেই বছর পুরনো অভিশাপ ফিরে এসে তার হতে যাওয়া প্রিয়তমা,তার জীবন সঙ্গীকে তার কাছ থেকে কেড়ে নিবে ?

নাহ্ আবারও নিজের মন মত পালটাবার আগেই সানাহ্কে খুজে বের করতে হবে। ফারহান নিজেকেই নিজে খুব ভয় পায়। একবার ওর মত পাল্টে ফেললে এরপর ও হাজার চেষ্টা করেও সানাহ্কে ফিরে পাবে না। তাকে যে সানাহ্কে চাই ই চাই, যে কোনো মূল্যে চাই।

ফারহানের ভয় করলো কিন্তু সে ভেঙে পড়লো না। এখন ভেঙে পড়া মানেই সময় নষ্ট করা। এর থেকে এইটুকু সময় কাজে লাগিয়ে সানাহ্কে খোঁজা যেতে পারে। ফারহান খানিকটা ভেবে বললো ‘ তাহলে আমাদের আগে অতসীর বন্ধু বান্ধবদের আর আপনাদের আশেপাশে যেসব আত্মীয় আছে তাদের কাছে খোঁজ করতে হবে। প্রথমে কাছের মানুষদের কাছে তারপর দূরের আত্মীয় স্বজনের কাছে খোঁজ করতে হবে। আঙ্কেল এভাবে ভেঙে পড়বেন না..…আপনি এভাবে ভেঙে পড়লে আমার একার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হবে না ‘

ফারহানের কথা শুনে মিস্টার কবির নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন যে উনি আর ভেঙে পড়বেন না।

—-

‘ মিসেস অবনি আপনার বান্ধবী মিস অতসী কি আজও আসেননি ? ‘

হঠাৎ প্রণয়ের গলা শুনে চমকে উঠলো অবনি। এভাবে এত জনের ভিড় ঠেলে প্রণয়ের নজর ওর উপরই পড়বে সেটা ও ভাবেনি। অবনি ধীরে সুস্থে দাড়িয়ে বললো ‘ নো স্যার……অতসী আজও আসেনি ‘

‘ উনি কেন আসছেন না সেটা কি আপনাকে জানাননি ? বা আপনি জানার চেষ্টা করেননি ? ‘ প্রণয় ভ্রু কুচকে বললো।

‘ জি না স্যার, ও আমাকে জানায়নি। আর আমি ওকে ফোন দিয়েছিলাম কিন্তু ওর ফোন সুইচড অফ কাজেই ওকে ফোনে পায়নি। ‘ অবনি নত সুরে বলল।

‘ ঠিকাছে আপনি এবার বসতে পারেন। ‘

প্রণয়ের অনুমতি পেয়ে অবনি বসে পড়লো আর প্রনয় ব্যস্ত হয়ে পড়লো কথার মাঝে। স্টুডেন্টদের পড়ানোর ব্যস্ততায় তার আর অতসীর কথা মাথাতেই রইলো না।
সারাদিন ভার্সিটির কাজ শেষে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো প্রণয়। আজ পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে হবে, গাড়িটা সকালে আসার সময় আনেনি বিশেষ এক কারণে। হেঁটে বাড়ির দিকে ফেরার সময়ই রাস্তায় থাকা বাচ্চাগুলো তার সামনে পরে বলে সে আর গাড়ি আনেনি। ভেবেছে ফিরতে সময় বাচ্চাদের সঙ্গে দেখা করবে।

ব্যাপারটি অদ্ভুত হলেও এটাই সত্যি যে এই দুদিন ধরে সেই সমাজ সেবিকা মেয়েটারও কোনো পাত্তা নেই,তার দেখাই পাওয়া যায় না। কে জানে মেয়েটার কি হলো ? আগে তো রোজই এসেছে আর প্রণয়ও রোজ একটা করে চিরকুট দিয়েছে। চিরকুটের কথা মনে পড়তেই প্রণয়ের মনে পড়লো কয়েকদিন আগে এক চিরকুটের কথা। সেই সেবিকা লিখেছিলো ‘ রোজ যে এভাবে একটা করে চিরকুট দিচ্ছেন কোনদিন যদি হুট করে আমার প্রেমে পিছলে পড়ে যান তখন নিজেকে বাঁচাবেন কি করে মিস্টার অপরিচিত ? প্রেমের জাল, বড় জাল……এই জাল থেকে নিজেকে বাঁচানো সহজ না বলেই লোকে বলে প্রেমে পড়া বারণ। তখন কিন্তু আমার দোষ দিলে হবেনা কারণ আমি কিন্তু আপনাকে আমার প্রেমে পড়তে বলিনি..…আমার কিন্তু একজন বিশেষ কেউ আছে। নাম বলবো ? নাহ্ থাক বলবো না..… ‘

হাঁটতে হাঁটতেই কখন যে বাচ্চাদের কাছে চলে এসেছে খেয়ালই ছিল না প্রণয়ের। ময়নার ভাইয়া ডাকে প্রণয়ের সম্বিত ফিরল। মুচকি হেসে বাচ্চাদের দিকে এগিয়ে ময়নার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল ‘ কেমন আছিস তোরা ? তোদের দিদিভাই আজ আসেনি ? ‘

‘ আমরা ভালো আছি ভাইয়া। নাহ্ অতসদি আজও আসেনি..… ‘ ময়না বললো।
‘ আচ্ছা তোদের দিদি আসছে না কেন বলতো ? তোদের কি কিছু জানা আছে ? ‘ প্রণয় চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল।

‘ নাহ্ তবে এরকম প্রায়ই হয়..…দিদি কোনোদিনই এরকম করে না তবে হুট করে একদিন না বলে না কয়ে আসা বন্ধ করে দেয়। তিন চারদিন গেলে আবারও নিয়মিত আসে ‘ বিল্টু বললো।

‘ জিজ্ঞেস করিসনি হঠাৎ কেন আসেনা ? ‘ প্রনয় বললো।

‘ জিজ্ঞেস করেছি কিন্তু দিদি কখনও বলেনি……শুধু বলেছে তার খুব কাছের কেউ অনেক অসুস্থ থাকে বলেই সে তাকে ছেড়ে আসতে পারেনা। ‘ বললো ময়না।
কথাটা শুনে প্রণয়ের খারাপ লাগলো। মেয়েটা নিশ্চই কোনো বড় ঝামেলায় আছে নাহলে এভাবে হুট করে কেউ ভোজবাজির মতো গায়েব হয়ে যায় না। প্রণয়ের বড়ই খারাপ লাগছে মেয়েটার জন্য, গড নোজ কোন ঝামেলায় ফেসেছে।

কাছের এক দোকান থেকে বাচ্চাদের খাওয়ার জন্য ভাত, তরকারি আর পানি কিনে দিয়ে বাচ্চাদের বিদায় জানিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলো প্রনয়। মনে মনে ভাবলো দাদুকে বলে ওই বাচ্চাদের দাদুর এনজিওতে থাকার ব্যবস্থা করে দেবে। তাহলে অন্তত বাচ্চাদের থাকার জায়গাটা পার্মানেন্ট হবে। প্ল্যানিং প্লটিং শেষে প্রণয় আবার অতসী আর সেই সমাজ সেবিকাকে নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করে দিলো। কি অদ্ভুত তাইনা ? এক মন দিয়ে দুই নারীকে নিয়ে চিন্তা…

~ চলবে ইনশাআল্লাহ্…