প্রেমমানিশা পর্ব-১৮+১৯+২০

0
210

#প্রেমমানিশা(১৮)

সানাহ্ তখন রেডি হচ্ছিল আর ফারহান ঘরের যেসব জিনিস ঢাকায় নিবে সেগুলো আরেকবার চেক করছিল । হঠাৎ ঘরের দরজায় মৃদু টোকা পড়তেই সানাহ্ গায়ে ওড়না জড়িয়ে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে দরজা খুলতে গেলো। দরজা খুলেই বাইরে হাসি মুখে দাড়িয়ে থাকা মিসেস জয়িতাকে চোখে পড়লো। ঘরের দরজায় নক করার শব্দ ফারহানও পেয়েছিল তাই কে এসেছে দেখতে সে ছুটে এলো। ঘরের দরজার কাছে আসতেই ফারহানের নজরে মিসেস জয়িতা পড়লেন।

হুট করে সকাল সকাল সানার বাড়িতে কোনো তাগড়া যুবককে দেখবেন সেটা মোটেও আশা করেননি মিসেস জয়িতা। ফারহানকে দেখে তার চোখ যেন বিস্ময়ে কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। উনি নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না যে এটা উনি কি দেখলেন। চোখ বড় বড় করে অবাক হয়ে বললেন ‘ এই ছেলে তুমি কে ? ‘

মিসেস জয়িতাকে যদিও ফারহান আশা করেনি তবে সে এটা বুঝতে পারছে যে এখনই পরিস্থিতি সামলাতে হবে নাহলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে। তাই ফারহান মুচকি হেসে বলল ‘ আমি ফারহান ইমতিয়াজ…… এ প্রফেসর অফ বাংলা লিটারেচার ডিপার্টমেন্ট। আমি সানার ফিয়ন্সে…… ‘

এবার যেন মিসেস জয়িতা খানিকটা সস্তি পেলেন। নিজের বড় হয়ে যাওয়া চোখ দুটো তাদের স্বাভাবিক অবস্থায় এনে বললেন ‘ তুমি ওর ফিয়ন্সে হলে এতদিন আসোনি কেন ? আর সানার যে বিয়ে ঠিক হয়েছে সেটা তো জানতাম না। ‘

‘ আমিও জানতাম না সানাহ্ এখানে…… ‘ ফারহান স্মিত হেসে বললো।

এবার ফারহানের কথা শুনে ভ্রু কুচকালেন। ফারহানের কথা কেন যেন তার অদ্ভুত লাগছে। বিয়ে ঠিক হয়েছে অথচ হবু বউ কোথায় সেটাই জানে না। মিসেস জয়িতা তার কৌতুহল মেটাতে বললেন ‘ মানে ? তোমার হবু বউ অথচ তুমিই জানতে না ও কোথায় থাকে ? তুমি কি আদৌ ওর হবু বর ? সানাহ্ তুই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন ? কিছু বলছিস না কেন ? নাকি এই ছেলে তোকে ভয় দেখিয়েছে ? ‘

এবার বেশ ভালই ফ্যাসাদে পড়লো ফারহান। সে ভাবেনি ভদ্র মহিলা এভাবে তিলকে তাল বানিয়ে ফেলবে। অবশ্য আজকাল যা চলছে তারপর ভদ্র মহিলার কাছ থেকে এই ব্যবহারই প্রত্যাশিত। বরং এহেন ব্যবহার না করলে ফারহান আরও অবাক হতো। তবে মহিলার ভুল ধারণা তো ভাঙতে হবে। তাই ফারহান সপ্রতিভ হেসে বললো ‘ নাহ্ ম্যাডাম আপনার ভুল হচ্ছে। আপনি যেরকম ভাবছেন সেরকম কিছুই নয়। সানার সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছিল সেই ঝগড়ার এক পর্যায়ে আমি বলেছিলাম আমি তাকে বিয়ে করবো না। তাই সে অভিমানে রাগ করে ঘর ছেড়েছিল। সেই রাগের বশেই ঢাকা থেকে সিলেট পর্যন্ত একা এসেছে তাও আবার কাউকে কিছু না বলে। টানা সাত দিন খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে ওর খোঁজ পেয়ে এখানে ছুটে এলাম। যেহেতু আমার সাথে রাগ করে এসেছিল তাই আমারই দায়িত্ত্ব রাগ ভাঙিয়ে নিয়ে যাওয়া। সেই দায়িত্ত্বই এখন পালন করছি। ‘

ফারহানের এহেন গোছানো কথা এবার মিসেস জয়িতার মনে ধরলো। উনি সন্তুষ্ট হয়ে বললেন ‘ ওকে নিয়ে যাচ্ছ যাও কিন্তু আবার ওকে রাগাবে না। আর সানাহ্ তোর হবু বর যদি তোকে আবারও রাগায় তাহলে নিশ্চিন্তে তুই আমার কাছে চলে আসবি। আমি তোকে আমার কাছে রেখে দিবো। ‘

মিসেস জয়িতার কথা শুনে সানাহ্ হালকা মাথা নেড়ে সায় দিল যে সে মিসেস জয়িতার কথা মতই করবে। মিসেস জয়িতা সন্তুষ্ট বুঝতে পেরে ফারহান বললো ‘ তাহলে ম্যাডাম আপনার সঙ্গে যখন দেখা হয়েই গেছে তখন বিদায় বেলার বিদায় দিয়েই যান। স্যারকে কি পাওয়া যাবে ? সানাহ্ আপনাদের থেকে বিদায় নিয়ে যেতে চায়। ‘

ফারহানের এত সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে মিসেস জয়িতা মুগ্ধ। এত সুন্দর করেও মানুষ কথা বলতে পারে সেটা তার জানা ছিলনা। কিন্তু এই ছেলেটার উপরই যে সানাহ্ রাগ করে বসে আছে সেটা আদৌ সম্ভব মনে হলো না। এত সুন্দর ছেলের উপর কেউ রাগ করে থাকতে পারে ? প্রশ্নটা মিসেস জয়িতার মগজে না ঢুকলেও উনি আর এ নিয়ে কিছু বললেন না।

মিসেস জয়িতা আর হরিহরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফারহান আর সানাহ্ তাদের গন্তব্যে রওনা দিলো। এতক্ষণ সব নীরব ছিল কিন্তু হঠাৎ সানাহ্ বললো ‘ আমাকে ঢাকায় আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দিন। আপাতত আমি কোনো আত্মীয় স্বজনের প্রবলেম ফেস করতে রাজি না। যা দেখা করার সবার সঙ্গে ঢাকায়ই দেখা করবো। ‘

ফারহান সানার কথা শুনে আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো। সে গাড়ি ঢাকার দিকেই নিলো। এখন সিলেট থেকে গাড়িতে ঢাকা যেতে প্রায় ছয় ঘণ্টার কাছাকাছি সময় লাগবে। এই ছয় ঘণ্টায় বিরতি হিসেবে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য কোনো হোটেলে গাড়ি থামালেই চলবে। আর তখনই যদি সবাইকে ফোন করে দেওয়া যায় তাহলে আরও ভালো। এমনিতেও তো ওরা বের হয়েছেই দেরি করে। দুপুর সাড়ে বারোটায়। এটা ওটা গুছাতে গুছাতেই যত সময় লাগলো।

গাড়ি ছুটে চলেছে পাকা পিচ ঢালা রাস্তার উপর দিয়ে।
আশেপাশের পরিবেশ দেখে যে কারোর মন জুড়িয়ে যাবে।চারপাশে হাজার মানুষের আনাগোনা। কেউ ফেরিওয়ালা তো কেউ চা ওয়ালা। আবার ছোটো ছোট বাচ্চারা এই হালকা রোদে পানির বোতল নিয়েও ঘুরছে দুটো রোজগারের আশায়। বাচ্চাদের দেখে ফারহানের মায়া লাগলো। ইচ্ছা করলো বাচ্চাটার কাছ থেকে দুটো বোতল কিনে তাকে সাহায্য করতে।

ফারহান বরাবরই তার ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেয় বেশি তাই আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। গাড়ি থামিয়ে গাড়ির জানালা নামিয়ে ইশারায় বাচ্চাটাকে ডাক দিল। বাচ্চাটা নতুন এক ক্রেতার ডাক পেয়ে স্বানন্দে চলে এলো। ফারহান বলল ‘ এক বোতল কত করে ? ‘

‘ তিরিশ টাকা সাহেব ‘

‘ তাহলে চারটা দাও ‘ বলে ফারহান তার ওয়ালেট বের করে তার থেকে একটা একশো টাকার নোট আর দুটো দশ টাকার নোট বের করে এগিয়ে দিল। টাকা হাতে নিয়ে বাচ্চাটা চারটা বোতল এগিয়ে দিলো। ফারহান মুচকি হেসে বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে আবারও গাড়ি স্টার্ট দিল।

সানাহ্ কানে ইয়ার পড গুঁজে চোখ বন্ধ করে গান শুনতে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু হঠাৎ মনে হলো চলন্ত গাড়ি থেমে গেছে। সেই অনুভূতির জেরেই সানাহ্ চোখ খুলে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করলো। ফারহানকে বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দেখে আর কিছু বললো না। সিটের গায়ে আবারও গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলো।
ফারহান কিছু একটা মনে করে সানার দিকে তাকালো কিন্তু সে হতাশ হলো। তার মনে হয়েছিল সানাহ্ তাকে দেখছে কিন্তু তার ধারণা ভুল। সানাহ্ তাকে দেখা তো দূর সে তো চোখ বন্ধ করে গান শুনতে ব্যস্ত।

দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য পথেই কুকিস্তার সামনে গাড়ি দাঁড় করাতে হলো ফারহানকে। গাড়ি থামিয়ে যখন সানার দিকে চোখ দিল তখন দেখলো ঘন্টা দুয়েকের ব্যবধানেই সানাহ্ ঘুমিয়ে কাদা। যাকে বলে একেবারে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে । ঘুমন্ত সানার নিষ্পাপ মুখ দেখেও তার মনে এক অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করলো। ইচ্ছা করলো সানার ললাটে আবারও স্নেহ মাখা চুম্বন এঁকে দিতে কিন্তু কাল রাতে যেটা হয়েছে সেটা আজ আর সম্ভব না।

ঘুমের ঘোরেই সানার হঠাৎ মনে হলো কেউ তাকে দেখছে। ব্যপারটা সানার কাছে অদ্ভুত ঠেকলো তাই সে ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ে তার ঘুমন্ত চোখ জোড়া মেলে ধরলো। চোখ মেলে তাকাতেই দেখলো তার ধারণাই সঠিক। ফারহান তাকে দেখছে এক দৃষ্টে। সানাহ্ যে ঘুম থেকে উঠেই এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে সেটা তার ভাবনায় ছিলনা। সে কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। গলা খাকারি দিয়ে বললো ‘ গাড়ি থামালেন যে ? ‘

সানার কথায় ফারহানের জ্ঞান হলো। ব্যস্ত হয়ে গাড়ি থেকে নেমে সানার সিটের দরজা খুলে বললো ‘ দুপুরের লাঞ্চটা করে নিলেই ভালো হয়। পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর পার হবে। এমনিতেই অনেক দেরি হয়েছে বের হতে। ‘

সানাহ্ প্রতি উত্তরে আর কিছু বললো না। সোজা গাড়ি থেকে নেমে ফারহানকে অনুসরণ করল। ফারহান ধীর পায়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। রেস্টুরেন্টে ঢুকেই সানার হাত জোড়া নিজের আয়ত্বে এনে সানাহ্কে নিয়ে কনার দিকে টেবিলে বসলো। কোনার দিকে বসার কারণে কাচের স্লাইডের ঐপাশ থেকে কেউ আর এখন ওদের দেখতে পারবে না।

‘ এখন আমরা কোথায় আছি জানেন ? ‘ ফারহান সানাহ্কে জিজ্ঞেস করলো।

‘ মাধবপুর লেকের কাছাকাছি..… ঢুকতে সময় রেস্টুরেন্টের ব্যানারে দেখলাম। ‘ সানাহ্ মৃদু গলায় উত্তর দিলো।

‘ যাক চিনেছেন তাহলে। এক কাজ করি..… এখন আমরা খাওয়া দাওয়া শেষ করি তারপর আপনাকে নিয়ে মাধবপুর লেকে যাবো। সেখান থেকে আবার আপনাকে নিয়ে শ্রীমঙ্গলে যাবো। তারপর দুজনে মিলে আয়েশ করে শ্রীমঙ্গল খ্যাত সাত রঙের চা খাবো। কোনওদিন খেয়েছেন ? ‘ ফারহান খুশি হয়ে বললো।

‘ আপনি কি এখন আমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন ? ‘ সানাহ্ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো।

‘ হুম, চিন্তা করবেন না। আপনাকে আজ যত রাতই হোক বাড়ি পৌঁছে দিবো। এখানে এসেছি ভাবলাম আর কবে আসি না আসি তার থেকে বউকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করে যাই। ‘

‘ আমি আপনার বউ ? আমাদের তো বিয়ে এখনও হয়নি। ‘ সানাহ্ অবাক হয়ে বললো। তার কাছে ফারহানের ব্যবহার বড়ই অবাক লাগছে। এ কোন ফারহানকে দেখছে সে। ফারহান কখনোই এত মন খুলে কথা বলতো না। ওর সঙ্গে তো একেবারেই না। হ্যাঁ তবে ফারহান গম্ভীর প্রকৃতির নয়। সে খুবই সহজ সরল সাধাসিধা মানুষ। জগতের সবকিছু দেখে সরল চোখে।

‘ হন নি, হতে কতক্ষন ? আজ বাদে কাল আমাদের বিয়ে। দেখবেন চোখের পলকে দুই সপ্তাহ কেটে গেছে। তাছাড়া বাড়ি ফিরে তো অনেক কাজ করতে হবে। মা বলছিলো আপনার শাড়ি থেকে শুরু করে গয়না সব একদিন সময় করে কিনতে। ‘ ফারহান বললো।

‘ এতকিছুর পরও আপনার মনে হয় আন্টি আপনাকে আমাকে বিয়ে করতে দিবেন ? আর দিলেও উনি কি আমাকে ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিবেন ! ‘ সানাহ্ দৃষ্টি নত রেখেই বললো।

‘ বিয়েটা আমাদের তাই সেখানে অন্য কারোর মতের প্রয়োজন নেই। আর একান্তই যদি মায়ের মত আপনার কাছে মেটার করে তাহলে আমি বলে দেই আমার মা সেরকম নয়। তার কাছে আমার খুশিটাই তার খুশি। এখন এসব কথা ছাড়ুন। আমি অর্ডার দিচ্ছি। তাড়াতাড়ি খাওয়ায় হাত লাগান। অনেক ঘোরাঘুরি বাকি। ‘ ফারহান মেনু কার্ড দেখতে দেখতে বললো।

ফারহানের কথা মেনে সানাহ্ও আর কিছু বললো না। আসলেই তারও এসব ব্যাপারে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। এখন এই মুহূর্ত উপভোগ করার সময়। ফারহান নিজে থেকে চাইছে তাকে নিয়ে ঘুরতে তাই এসব বলে সে ফারহানের মুড নষ্ট করতে চায় না। যা কথা বলার বাড়ি ফিরে ঠিক করবে।

ফারহান মেনু কার্ড দেখতে দেখতে বললো ‘ আপনি কি খাবেন ? ‘

‘ যা আপনি খাওয়াবেন তাই ‘

‘ কিন্তু খাবার তো পেটে আপনার যাবে আর আমি তো অন্তর্যামী নই যে আপনার পেটের খবর জানবো। সুতরাং আপনার পছন্দমত অর্ডার দেওয়াটাই যৌক্তিক। ‘ ফারহান মেনু কার্ডের দিকে চোখ রেখেই বললো।

‘ ব্রাউন রাইস অ্যান্ড চিকেন কারি উইথ লেস স্পাইস ‘

‘ তাহলে এটাই ফাইনাল করি। ‘ বলে ফারহান ওয়েটারকে ইশারায় ডেকে পাঠালো। ওয়েটার আসতেই ওয়েটারকে সানার বলা ডিশ আর নিজের পছন্দের রাইস বোল উইথ চিকেন এন্ড ভেজিটেবল অর্ডার দিলো।

মিনিট বিশেক পর ওয়েটার একে একে সব ডিশ প্রেজেন্ট করলো। ফারহান নিজ দায়িত্বে সানাহ্কে ডিশ সার্ভ করা থেকে শুরু করে তার ড্রিংকস গ্লাসে দেওয়া পর্যন্ত সবই করলো। সানাহ্কে সবকিছু পাস করে এবার নিজের খাওয়ায় মনযোগ দিল। ওদের খাওয়া দাওয়া শেষ হলো বেশ নির্বিঘ্নে,বিনা বাক্য ব্যয়ে….

~ চলবে ইনশাআল্লাহ্…..

#প্রেমমানিশা(১৯)

রেস্টুরেন্ট থেকে মাধবপুর লেকে যেতে পনেরো মিনিট সময় লাগে। গাড়িতে দশ মিনিট আর পায়ে হেঁটে পাঁচ মিনিট। ফারহান সানাহ্ গাড়িতে উঠে বসতেই গাড়ি স্টার্ট দিল। গাড়ি যত এগোচ্ছে আশেপাশের প্রকৃতি ততই বদলে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে গাড়ি রোদেলা ভূমি ছেড়ে অরণ্যে ঢুকছে। সানাহ্ সেসব নিঃশব্দে দেখছে। কিছু দূর যাওয়ার পরই ফারহান গাড়ি থামিয়ে দিল। ফারহান গাড়ি থামাতেই সানাহ্ ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।

সানাহ্কে এভাবে তাকাতে দেখে ফারহান বললো ‘ আমরা এই পর্যন্তই গাড়ি দিয়ে যেতে পারবো। এরপরে পায়ে হেঁটে যেতে হবে। বেশি না পাঁচ মিনিটের পথ। কষ্ট হবে না ‘

সানাহ্ ফারহানের কথা শুনে কিছু বললো না। অপেক্ষা করতে লাগলো ফারহান কখন গাড়ি ছেড়ে বেরোবে। ফারহান গাড়ি ছেড়ে বের হতেই সেও গাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো। সানাহ্কে বেরোত দেখে ফারহান গাড়ির চাবি জিন্সের পকেটে রেখে সানাহ্কে ইশারা করলো এগোতে, সে সানার পিছন পিছন যাবে।

কিন্তু ফারহানের ইশারা বুঝতে পেরেও সানাহ্ তার জায়গা থেকে এক চুলও নড়লো না। ফারহান এবার বেশ বিরক্ত হলো। মেয়েটা কিছু বলছেও না যে তার মনোভাব বুঝবে ফারহান। ফারহান এগিয়ে গিয়ে সানাহ্কে ইশারায় জিগ্গেস করলো কি হয়েছে ? সানাহ্ তার উত্তর না দিয়ে ফারহানের হাত ধরে এগোতে লাগলো। ফারহান এতক্ষণে সানার বুঝতে পেরে অমায়িক হাসলো যা সানার নজর না এড়ালেও সানাহ্ কিছু বললো না। দুজনে চুপচাপ পথ চলতে লাগলো।

মাধবপুর লেকের আশেপাশের প্রকৃতি নয়নাভিরাম। এই জায়গায় যদি ফারহান সানাহ্কে না আনতো তাহলে হয়তো সানার কোনোদিনই এরকম একটা জায়গাকে নিজ চোখে দেখার অভিজ্ঞতা হতো না। লেকের চার পাশ দিয়েই উচুঁ উচুঁ টিলা আছে যার গায়ে গড়ে উঠেছে চা বাগান। লেকের সামনের দিকে লেকে নামার জন্য সিড়ি আছে তবে লেকে নামা নিষেধ।

মাধবপুর লেকের এক অন্যতম সৌন্দর্য্য লেকের শাপলা ফুল। রয়েছে ছোটো, বড় হরেক রকমের শাপলা ফুল। সেকি লাল নীল রঙে রঞ্জিত শাপলা। দেখলে একেবারে মন জুড়িয়ে যায়। সানার একবার ইচ্ছে করলো হাত বাড়িয়ে দুটো ফুল নিতে কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়লো লেকে আসার সময় লেক নিকটবর্তী ব্যানারে লিখা ছিলো লেক থেকে ফুল তোলা যাবে না। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়ে নিজের ইচ্ছা শক্তি বিসর্জন দিয়ে লেকের সিমেন্ট বাঁধানো ঘাটে বসে জলের ভিতরে স্বচ্ছ ধারা দেখায় মন দিলো।

লেকের আরেকটি সুন্দর দৃশ্য হলো এখানে লেক জুড়ে সাঁতার কাটছে সরালি, পানকৌড়ি আর জলপিপি। সঙ্গে লেকের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া সহস্র পরিযায়ী পাখি তো আছেই। সময়টা শীতকাল বিধায় অতিথি পাখির আনাগোনাও আছে। শীতকালীন সময়টাতে মাধবপুরে লেকে অনেক টুরিস্ট আসে যারা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নিজেরা নিজেরা সময় কাটিয়ে যায়। একে অন্যের সঙ্গে আড্ডা দেয়। কেউ কেউ কতৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে গ্রুপ পিকনিকও করে।

সানাহ্ যখন উদাস মনে লেকের পানির কলকলে ধ্বনি শুনতে ব্যস্ত তখন হঠাৎ ফারহানের চোখে পড়লো লেকের দান দিকের সাইডে দুটো ছেলে দাড়িয়ে আছে যারা সানাহ্কে দেখিয়ে দেখিয়ে একে অপরের মধ্যে কথা চালাচালি করছে। ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারল না ফারহান। বুঝতে না পেরে ফারহানের ভ্রু কুচকে গেলো। ফারহান চুপচাপ দাড়িয়ে থেকে ছেলেগুলো কান্ড কারখানা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো

আসল কাহিনী কি সেটা তখন বুঝলো যখন ছেলেগুলো সানাহ্কে দেখে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। ফারহানের রাগ লাগল। নাহ সানার উপর নয় আর না ছেলেগুলোর উপর। রাগ লাগলো নিজের উপর কারণ সে ব্যর্থ প্রেমিক বলেই প্রেমিকাকে অলক্ষুণে দৃষ্টি থেকে রক্ষা করতে পারছে না। পারছে না বলে তো আর হাল ছেড়ে দিলে হয়না। ফারহান ধুপধাপ পা ফেলে সানার দিকে এগিয়ে গেলো যেটা দেখে ছেলেগুলো সানার দিকে তাদের পদক্ষেপ থামিয়ে দিল। তবে ছেলেগুলো এইদিকে আসা থামালেও ফারহান থেমে নেই।

ফারহান নিজ মনে ছক কষে নিলো কি বলে সানাহ্কে এখান থেকে সরাবে । ফারহান সানার দিকে এগিয়ে গিয়ে সানার উরুতে রাখা ডান হাত টেনে সানাহ্কে তুললো। ফারহানের এহেন কাজে সানাহ্ অবাক। ফারহান সানার মনোভাব বুঝতে পেরে বললো ‘ শুধু পানি দেখলে হবে ? পাহাড় দেখতে হবে তো। এভাবে কচ্ছপের গতিতে একটা জিনিস দেখতে থাকলে সাত রঙের চা আর খাওয়া হবে না। আমার সঙ্গে আসুন। ‘

ফারহানের কথায় এবার সানার ভ্রু কুচকে গেলো। সানাহ্ ফারহানের দিকে ভ্রু কুচকে মুখ ভার করে তাকিয়ে রইল কারণ ফারহান তাকে ইন্ডিরেক্টলি কচ্ছপ বলেছে। সানার মুখ ভার দেখে ফারহান বললো ‘ কি হয়েছে ? মুখ এমন ভার কেন ? ‘

সানাহ্ উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না বিধায় চুপ করে রইলো। সানার এই নীরবতা ফারহান বিশেষ পাত্তা দিলোনা। সে সানার হাত ধরে আপন গতিতে এগিয়ে গেলো। এগিয়ে এসে দাঁড়ালো একটা উচুঁ টিলার সামনে যার গা দিয়ে এগিয়ে গেছে টিলাতে উঠার সিড়ি। ফারহান সানার হাত শক্ত করে ধরে বললো ‘ আমরা এখন এই টিলায় উঠবো তারপর সেখান থেকে লেক দেখবো। আমি আপনাকে ধরছি। আপনি সাবধানে আমার পিছন পিছন আসুন। ‘

কথা বলতে দেরি হলেও সানার পা চালাতে দেরি নেই। সানাহ্ ফারহানের কাছ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে দ্রুত বেগে টিলার সিড়ি দিয়ে উঠতে লাগলো।কি থেকে হয়ে গেলো বুঝতে ফারহানের সময় লাগলো। যখন বুঝতে পারল তখন সানাহ্ অনেকটা উঠে গেছে। ‘ আরে আরে আমার জন্য দাড়ান। আমাকে ফেলে যাচ্ছেন কেন ? ‘ বলতে বলতে ফারহানও সিড়ি দিয়ে এগোল ।

সানাহ্ টিলার চূড়ায় উঠে দেখলো সত্যিই ফারহান ভুল কিছু বলেনি। এই উচুঁ টিলা থেকে লেক দেখতে আরও বেশি সুন্দর। সানাহ্ যখন মুগ্ধ হয়ে সেই দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত ফারহান তখন সবে সবগুলো সিড়ি পেরিয়ে চূড়ায় উঠে এসেছে। প্রকৃতির মুগ্ধতায় ব্যস্ত সানাহ্কে হাপাতে হাপাতে বললো ‘ রাগ করেছেন নাকি ? এভাবে আমাকে ফেলে চলে এলেন যে ? ‘

সানাহ্ এবার প্রকৃতির দিক থেকে চোখ ফারহানের দিকে নজর দিল। ফারহানের গলা এই শীতকালেও ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে আছে। মাথা দিয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। প্রশস্ত বুকে দুটো হাপরের মতো উঠানামা করছে। ফারহান বড্ড হাপাচ্ছে…. প্রয়োজনের চেয়েও বেশি হাপাচ্ছে। সানাহ্ এই দৃশ্য দেখলে গম্ভীর গলায় বললো ‘ বয়স হচ্ছে জানার পরেও এত উচুঁ টিলা বেয়ে উঠতে গিয়েই এই অবস্থা তাহলে আপনার হাঁটুর বয়সী মেয়েকে বিয়ে করে আপনার কি অবস্থা হতে পারে ভাবতে পারছেন ? ‘

ফারহান যেন হতভম্ভ সানার কথা শুনে। তার কয়েক মুহূর্ত লাগলো সানার গম্ভীর ভঙ্গিমায় তাকে নিয়ে করা মজা ধরতে। ফারহান সানার কৌতুক ধরতেই বুঝতে পারলো সানাহ্ গম্ভীর মুখে সরাসরি তাকে বুড়ো বলে সম্বোধন করেছে। ফারহান সানার মজা ধরতে পেরে বললো ‘ শুনেছি বাঘের বউ বাঘিনী হয় আর সিংহর বউ সিংহী হয়। তারমানে বুড়োর বউ বুড়ি হয়। ‘

সানাহ্ যখন বুঝতে পারল ফারহান তারই করা মজার উত্তর দিয়েছে তখন রাগে সানার মুখ থমথমে হয়ে উঠলো। গম্ভীর গলায় বললো ‘ বুড়ির বর যদি বুড়ো হয় আর বাঘিনীর বর যদি বাঘ হয় তাহলে কচ্ছপের বর কি হবে ? কচ্ছপী ? ‘
এবার ফারহান বুঝতে পারলো সানার রাগটা কোথায় ? মেয়েটা তার ওই সময় অন্যদের উপর রাগ করে তাকে কচ্ছপ বলায় অভিমান করেছে । আসল রহস্য ধরতে পেরে ফারহান অজান্তেই হেসে দিলো।

সানাহ্ দাড়িয়ে আছে চূড়ার সমতল জায়গায়। অভিমানে তার মুখ ভার। অভিমানের বশে তার এখন ফারহানের চেহারাও দেখতে ইচ্ছা করছে না। ইচ্ছে করছে আবার সব ছেড়েছুঁড়ে চলে যেতে। কিন্তু পারছে না কারণ এই ফারহানের অদৃশ্য মায়াজালেই সে আবদ্ধ। এই মায়াজাল মাকড়সার জাল থেকেও কঠিন। বড় বড় মানুষরাও পারেনি এই জাল ছেড়ে বের হতে তাহলে সে কি করে পারবে ?

আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাই নি।
তোমায় দেখতে আমি পাই নি।
বাহির-পানে চোখ মেলেছি, আমার হৃদয়-পানে চাই নি ॥

অভিমানিনী সানাহ্ যখন ফারহানের গলায় গান শুনল তখন আর সে তার অভিমান ধরে রাখতে পারল না। তার অভিমান অশ্রু হয়ে ঝড়ে পড়লো। সে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো ফারহানের দিকে। ফারহান তার দিকে অমায়িক হেসে তাকিয়ে আছে আর গান গাইছে…

আমার সকল ভালোবাসায় সকল আঘাত সকল আশায়
তুমি ছিলে আমার কাছে, তোমার কাছে যাই নি ॥

গান গাইতে গাইতে ফারহান সরে গেলো তার জায়গা ছেড়ে। এগিয়ে এলো সানার দিকে। সানার সামনে হাঁটু মুড়ে বসলো। পকেট থেকে কিছু একটা বের করলো। তারপর সেটা সানার সামনে ধরলো। সানাহ্ লক্ষ করলো ফারহানের হাতে গাছ লতা পাতা দিয়ে বানানো এক সুন্দর আন্টি। ফারহান আবারও সুর ধরলো….

তুমি মোর আনন্দ হয়ে ছিলে আমার খেলায়–
আনন্দে তাই ভুলেছিলেম, কেটেছে দিন হেলায়।
গোপন রহি গভীর প্রাণে আমার দুঃখসুখের গানে
সুর দিয়েছ তুমি, আমি তোমার গান তো গাই নি ॥

নিজের এত সুখ সইলো না সানার। তার একেবারই বিশ্বাস হচ্ছে না কেউ তাকে ভালোবেসে এতকিছু করছে। অবাধ্য চোখের অবাধ্য জল বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে কিন্তু সানাহ্ ভয় পায় তার অশ্রু নামক দূর্বলতা প্রকাশ করতে। সানার বাবাই আফজাল করিম বলতেন ‘ মানুষের কান্না হলো তার সবচেয়ে বড় দূর্বলতা। এই দূর্বলতা যার তার সামনে প্রকাশ করতে নেই। একমাত্র কাছের মানুষই এই কান্নার সাক্ষী হতে পারে। ‘

সেই কথা আজ পর্যন্ত সানাহ্ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছে। দেয়নি কারোর সামনে নিজেকে ভেঙে পড়তে। সবসময় পাথরের মত কঠিন হয়ে সামলেছে নিজেকে। নিজ প্রয়োজনে নিজেকে বানিয়েছে কঠোর। হয়েছে কঠিন শিলা। বিসর্জন দিয়েছে সব ধরনের অনুভূতি। কিন্তু এই একটা দিন তাকে ভেঙে দিচ্ছে। বের করে আনছে তার চিরকালীন সত্তা থেকে।

‘ আমার ধারণা ভুল ছিল। আমি ভেবেছিলাম কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠার জন্য পছন্দ অপছন্দের মিল থাকা আসল । কিন্তু আসল হলো মনের মিলটা। আই থিঙ্ক সেটা আমাদের মধ্যে আছে। আমি চাইবো না আপনি নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিজের মনে কথা বলুন। বরং আমি চাই আপনি নিজের মতো করে কোনো এক বিশেষ দিনে বিশেষ কথাটা বলে আমার সেই দিনকে স্মরণীয় করে রাখুন। আমি অপেক্ষা করবো ততদিন…

এক টানে নিজের কথাগুলা বলে উঠে দাঁড়ালো ফারহান। সে চায়না সানাহ্ তার মনের বিরুদ্ধে তাকে মেনে নিক। যতদিন সানাহ্ নিজে থেকে কোনো ইনিশিয়েটিভ না নিবে ততদিন ফারহানও আর এই ব্যাপারে কিছু বলবে।

‘ এত কথা বলতে পারলেন অথচ আংটিটা নিজ হাতে পড়াতে পারলেন না ? আংটি কি আমার নিজেকে নিজে পড়ানোর দায়িত্ত্ব ? ‘

ফারহান যখন তার ভাবনায় ব্যস্ত তখন নীরবতা ভেঙে সানাহ্ কথাগুলো বললো। সানার কথা শুনে ফারহান হতভম্ভ। সে চোখ দুটো বড় বড় করে অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে আছে সানার দিকে। সানাহ্ এবার ফারহানকে আরও অবাক করে দিয়ে নিজের বাম হাতটা এগিয়ে দিয়ে বললো ‘ নিন আমার অনামিকায় পড়িয়ে দিন… আর বাড়ি গিয়ে বলবেন বিয়ের সব ব্যবস্থা করতে। ‘
সানার কথায় অবাক হয়ে বললো ‘ আপনি বিয়ের কথা বলছেন ? আপনি না আমাকে হেট করেন ? ‘

‘ হুম হেট করি বলেই তো বলছি। কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের ঘৃনা করার পরও জীবন সঙ্গী বানানো যায়। আপনাকে আমি ভালোবাসলে জীবনের একসময় এমন আসবে যখন আমি আপনাকে ভুলে যাবো। কিন্তু ঘৃনা করলে কখনও ভুলবো না। ঘৃণার জায়গা ভালোবাসার থেকেও উপরে। তাই আমি যাকে ঘৃনা করি তাকেই বিয়ে করবো। আমাদের বিয়েটা লাভ ম্যারিজ নয় হেট ম্যারিজ। নিন এবার আংটি পড়ান ‘ বলে সানাহ্ তার হাত ঝাঁকি দিল।

ফারহান হতভম্ব অবস্থাতেই সানাহ্কে তার আনা আংটি পরিয়ে দিল। ফারহান এখনও একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে না সানাহ্ কি করতে চাইছে। একবার মনে হচ্ছে সানাহ্ তাকে ভালোবাসে কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে পড়ছে সানাহ্ বলেছিল সে তাকে ঘৃনা করে। তাহলে কোনটা সত্যি ?

ফারহান আংটি পড়িয়ে দিতেই সানাহ্ এগিয়ে এসে ফারহানকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ গুজে বললো ‘ আমাকে তাড়াতাড়ি আপনার কাছে নিয়ে যান। আমার নতুন সংসারে নিয়ে যান যেখানে কেউ আমাকে নিয়ে প্রতি নিয়ত ভয়ে থাকবে না। আমাকে শুধু আপনিই পারবেন সামলাতে, আপনার মায়ায় জড়াতে। আপনার বন্দিনী করে রাখতে পারবেন। ‘

এতক্ষণে ফারহানের ঠোঁটে হাসি ফুটলো। সানাহ্ হয়তো তার মনের কথা বলেনি কিন্তু তার আচার ব্যবহারই হলে দিচ্ছে সে ফারহানকে অনেক ভালোবাসে। ফারহান আলতো হেসে সানাহ্কে জড়িয়ে ধরে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো ‘ খুব তাড়াতাড়ি নিয়ে যাবো আমার কাছে। ‘

~ চলবে ইনশাআল্লাহ্…

#প্রেমমানিশা(২০)

‘ আপনি আগে কখনও সিলেট আসেননি তাইনা ? ‘ গাড়ির স্টিয়ারিং এ হাত রেখেই কথাটা বললো ফারহান।

তারা এখন বর্তমানে ঢাকার দিকে রওনা দিয়েছে। ধরণীতে আঁধার নেমে এসেছে অনেক আগেই। আজ পুরোটা সময়ই কাটিয়েছে সিলেটের বিভিন্ন দর্শনার্থী স্থানে ঘুরে বেড়িয়ে। কথা ছিলো শুধু মাধবপুর লেকে আর নীলকন্ঠ টি কেবিনে যাবে। কিন্তু সেই কথা ভেঙে তারা সিলেট টি স্টেট এও গিয়েছিল। আজ এই প্রথম দুজনে অনেকটা সময় একসঙ্গে কাটিয়েছে। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকেই তারা শুধু রাতের আঁধারেই একে ওপরের কাছে কথাবার্তা আদান প্রদান করেছে। তবে আজ তারা দিনের আলোতেও একে অপরের সান্নিধ্য পেয়েছে।

‘ উহু, সিলেট আগেও অনেকবার এসেছি। ‘ সানাহ্ ফোনে সোসিয়াল মিডিয়া স্ক্রল করতে করতে বলল ।

‘ তাহলে মাধবপুর লেক, নীলকন্ঠ টি কেবিন, সিলেট টি স্টেট, রাতারগুল, বিছানাকান্দি একটাও চিনেন না কেন ? ‘ ফারহান ড্রাইভিং করতে করতেই অবাক হয়ে বললো।

‘ এখানে আগে মামনি আর বাবাইয়ের সঙ্গে আসতাম। তারা মারা যাওয়ার পর বেশ কয়েকবার মা আর বাবার সঙ্গেও এসেছি। এখানে আমার বড় ফুপির বাড়ি। একটা সময় তার বাড়িতে বছরে তিন চারবার আসতাম যেখানে আমি ঘর ছেড়ে বেরই হই না। ‘ সানাহ্ এবার ফোন রেখে ফারহানের দিকে তাকিয়ে উৎসুক চোখে বললো।

‘ ওহ আই সি,তারমানে আপনার ফুপিই আপনাকে হেল্প করেছে সিলেটে বসতি গড়তে ? আপনার একার পক্ষে তো কখনোই সম্ভব না একলা একা এই শহরে এতকিছু অ্যারেঞ্জ করা। তারমানে উনিই সাহায্য করছিলেন। ভদ্র মহিলা দেখি আমার নয়া সংসার হওয়ার আগেই ভেঙে দিচ্ছিলেন। ‘ ফারহান সরু চোখে সানার দিকে তাকিয়ে বললো ।

‘ এভাবে বলছেন কেন ? বড় ফুপি কিছু করেনি, আমি জাপান ভাইয়ের থেকে হেল্প নিয়েছিলাম ‘ সানাহ্ ভ্রু কুচকে বললো।

‘ এখন এই জাপান ভাই কে ? নাম এত অদ্ভুত কেন ? এই নাম কে রেখেছে ? ‘ ফারহান বিরক্তিতে ভ্রু কুচকে বললো। সানার মুখে অন্য কোনো ছেলের নাম তার শুনতে একদমই ভালো লাগছেনা। কে এই জাপান ভাই যার কাছ থেকে প্রখর আত্মসম্মান সম্পন্ন সানাহ্ও হেল্প নিলো ?

‘ জাপান ভাই আমার বড় ফুপির ছোটো ছেলে। তারা দুই ভাই। বড় ভাইয়া হলো আরাব ভাই আর জাপান ভাই হলো ছোটো। জাপান ভাইয়ের সঙ্গে আমার বেশ মিল কিন্তু আরাব ভাই আমার সঙ্গে দেখা হলেই ঝগড়া করেন তাও ইচ্ছা করে। অবশ্য এসব এখন কমেছে কারণ এক তো তার বিয়ে হয়ে গেছে আর দ্বিতীয়ত আমি আর ফুপির বাড়ি যাই না। প্রথম প্রথম বিয়ের পরেও ঝগড়া করতো কিন্তু এখন আর করে না। ‘ সানাহ্ বেশ উৎসুক হয়ে বললো। ফারহানকে তার পরিবারের ব্যাপারে বলতে তার বেশ ভালই লাগছে। সানাহ্ কখনোই আত্মীয় স্বজন নিয়ে এতটা সিরিয়াস ছিলনা কিন্তু ফারহানের সঙ্গে কথা বলতে হলেও তো তার একটা যুতসই বিষয় দরকার।

সানাহ্ কথাগুলা যত উৎসাহ নিয়ে বললো ফারহান তার অর্ধেক উৎসাহ নিয়েও কিছু বললো না। শুধু মলিন গলায় ‘ ওহ্ ভালো ‘ বলে কথা কাটিয়ে গেলো। বস্তুত সানার কাছ থেকে তার চিন জাপান ভাইয়ের কথা শুনতে একদমই ইচ্ছা করছে না। ভেবেছিল দুজনে সারাদিন একসঙ্গে সময় কাটাবে,নিজেদের ফিউচার প্ল্যানিং করবে কিন্তু বালাইশাট। সানার তো সেই দিকে নজরই নেই। সানাহ্ ব্যস্ত তার চিন জাপান ভাইয়ের গুণগান গাইতে।

সানাহ্ যেরকম গম্ভীর আর আনসোসিয়াল টাইপের মেয়ে তাতে তার বন্ধু হওয়া তো দূরে থাক কেউ তার সঙ্গে কথাই বলে না। সেখানে তার সাথে তার জাপান ভাইয়ের রীতিমত বন্ধুত্ত্ব ফারহানের ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে ওই চিন জাপান সানাহ্কে নিজের দিকে টানতে চাইছে। কী আছে কি ওই চিন জাপানের মধ্যে ?

ফারহানের কাছ থেকে কোনো যুতসই উত্তর না পেরে সানাহ্ আর কথা বাড়ালো না। বুঝলো ফারহান কোনোকিছু নিয়ে চিন্তায় আছে বলেই তার কথার উত্তর দিচ্ছে না ঠিক মত। এই সময় ফারহানকে আর কিছু বলে লাভ নেই। সে হয়তো কানেই তুলবে না। এসব ভেবে সানাহ্ চুপ করে গেলেও ফারহান নিজে থেকেই কথা বলতে শুরু করলো। সবকিছুই তার জাপান ভাইকে নিয়ে আর সানাহ্ও খুশি মনে উত্তর দিল। তার আর জানা হলো না ফারহান কেন জাপানকে নিয়ে এত প্রশ্ন করছে আর ফারহানেরও জানা হলো না জাপান অলরেডি এনগেজড।

বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে রাত প্রায় দশটা বেজে গেলো। বাড়ি ফিরতে সময় ফারহানের সঙ্গে বাইরে থেকে খেয়ে এসেছিল বলে বাড়ি ফিরে আর খাওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না সানাহ্। বাড়ি ফিরে এতটাই ক্লান্ত ছিল যে ফারহানকে ঠিক মত বিদায়ও জানালো না। উল্টো কোনমতে ঢুলতে ঢুলতে ঘরে গিয়ে ঢুকলো। অবশ্য মিসেস কায়নাত মেয়ের এহেন ব্যবহারে লজ্জিত। মেয়েটা জামাইকে একটু বিদায়ও জানালো না।

ফারহান কাল রাতেই সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিল যে তারা আজ ফিরে আসছে। ফারহানের কথা শোনামাত্রই সকলেই সকাল সকাল রওনা দিয়েছিলেন যার কারণে দুপুর হতেই তারা বাড়ি পৌঁছে গেলেন। মিসেস কায়নাত ভেবেছিলেন মেয়ে ফিরে এলে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে বসে খাবেন তাই বান্ধবী কাম হবু বেয়াইনকে আজ রাতটা থেকে যেতে বলেছিলেন। বান্ধবীর অনুরোধ ফেলতে না পেরে আর অনেকদিন পর সানার সঙ্গে দেখা হবে এই ভেবে মিসেস আশাও রাজি হয়ে গেছিলেন। কিন্তু কেউ ভাবেনি সানাহ্ বাড়ি ফিরে কারোর চেহারা না দেখে সোজা নিজের ঘরেই ঢুকবে। এমন কি একবারের জন্য ফারহানের দিকে পর্যন্ত তাকায়নি।

সানাহ্ রুমে ঢুকে ঘুম ঢুলতে ঢুলতে কোনমতে হট শাওয়ার নিলো। শীতকাল হওয়ায় হট শাওয়ার নেওয়ায় আরাম লাগছে। গোসল সেরে জামা কাপড় বদলে কোনমতে চুল হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়েই গা এলিয়ে দিল বিছানায়। বেড সাইড ল্যাম্প অফ করে গায়ে নরম কম্বল টেনে দিল। আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে। সিলেট থাকাকালীন এতদিন এরকম আরামে থাকেনি। বিছানায় শুয়েছে ঠিকই কিন্তু নিজের বিছানার মত আরাম পায়নি। উল্টো ওখানে শীত বেশি হওয়ায় শীতে কেপেছে।

মেয়েকে এভাবে উপরে চলে যেতে দেখে লজ্জিত মিসেস কায়নাত নতমুখে বললেন ‘ তুমি কিছু মনে করোনা বাবা। আমি বুঝতে পারিনি ও বাড়ি ফিরেই কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা ঘরে ঢুকে যাবে। জানলে ওকে আটকে দিতাম। মেয়েটা যে কিভাবে আনসোস্যাল হলো গড নোজ। আশা তুই কিছু মনে করিস না বোন। ‘

‘ আমি কিছু মনে করিনি আন্টি। সানাহ্ আসলে আনসোস্যাল নয়। সে বড্ড মিশুকে কিন্তু মানুষ বুঝে সঙ্গ দেয়। এতদিন সেরকম কাউকে পায়নি তাই মিশতে পারেনি। তবে ওর এরকম ব্যবহারের পিছনে আমি দায়ী। আজ সারাদিনে ওকে অনেক খাইয়েছি। আসার সময়ও ডিনার করে এসেছি দুজনে। আজ সানাহ্ তার ডায়েট চার্ট আর হেলদি লাইফ স্টাইল ভুলে অনেক কিছু খেয়েছে যার ইফেক্ট পড়ছে এখন। ডিনার করে যখন আমরা ফিরছিলাম তখনই ঘুমে ঢুলছিল। আসলে সারাদিন জার্নি করলো তার উপর অভ্যাসের বাইরে খাওয়া দাওয়া তো তাই। ‘ ফারহান তার মা আর মিসেস কায়নাতের উদ্দেশ্যে বললো।

‘ এসব তুই কি বলছিস কায়নাত ? তোর আমাকে সেরকম মানুষ মনে হয় ? মনে রাখিস আমি সানাহ্কে আমার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে তাকে আমার মেয়ে হিসেবে আমার বাড়িতে তুলবো, ছেলের বউ হিসেবে নয়। আমার দুটো ছেলে। একটাও মেয়ে নেই। ফারহানের বাবা আর আমার অনেক ইচ্ছা ছিল একটা মেয়ে হবে। কিন্তু সেটা তো পুরন হয়নি। কিন্তু সানার মাধ্যমে আমার সেই ইচ্ছা পূরণ হবে। আপসোস এটাই যে ফারহানের বাবা মেয়েকে দেখে যেতে পারলেন না। ‘ মলিন গলায় বললেন মিসেস আশা।

মায়ের কথার ধরণে ফারহানের বুঝতে দেরি হলো না যে ওর মা ওর বাবার কথা মনে করে মন খারাপ করছে। বস্তুত ফারহান তার মায়ের মন খারাপ মোটেই দেখতে পারেনা। মাকে এক ফোঁটা চোখের জল ফেলতে দেখলেই তার বুক চিড়ে ব্যথা অনুভব করে। কিন্তু এখন মায়ের মন খারাপ ভাব সরাতে হলে তার মাইন্ড ডাইভার্ট করতে হবে। ফারহান মিসেস আশার মাইন্ড ডাইভার্ট করতে বললো ‘ তাহলে আন্টি এবার উঠি..… বাড়িতে কিছু কাজ আছে। সেগুলো করা দরকার। তাছাড়া কাল সকালে বেরোতে হবে। অনেকদিন তো ভার্সিটি যাইনা। ‘

‘ সেকি তুমি চলে গেলে কি করে হবে ? আমি যে ভাবলাম কাল সকালে সবাইকে নিয়ে ব্রেকফাস্ট করবো। ‘ মিসেস কায়নাত বললেন।

‘ সরি আন্টি আপনার কথা রাখতে পারলাম না। আরেকদিন সবাই একসাথে খাওয়া দাওয়া হবে। আজ থাক। অনেকদিন ভার্সিটি যাইনি তাই কাল থেকে রেগুলার হতে হবে। এত মিস দিলে বিয়ের সময় ছুটি নিয়ে প্রবলেম হবে। ‘ ফারহান একান্তই মিসেস কায়নাতের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিল কারণ এমনিতেই অনেকদিন ছুটি কাটিয়ে এসেছে। এখন আর ছুটি কাটানো যাবে না ।

ফারহানের কথা শুনে হতাশ হলেন মিসেস কায়নাত। অসহায় গলায় বললেন ‘ এত করে যখন বলছো তখন আর কি করবো। তুমি নাহয় চলে যেও কিন্তু আশাকে রেখে যাও। ও বেচারি সানার সঙ্গে এখনও কথাই বলেনি। ‘

‘ আচ্ছা ঠিকাছে কিন্তু আন্টি কাল সকালে সানাহ্ যখন ঘুম থেকে উঠবে তখন বলবেন পরীক্ষার আগে যতদিন আছে ততদিন যেন ক্লাসটা রেগুলার করে। এমনিতেই অনেক দিন গ্যাপ গিয়েছে। এখন বেশি গ্যাপ দিলে সমস্যা হবে। আর দয়া করে জিজ্ঞেস করবেন না ও এতদিন কোথায় ছিল, কি করেছে আর বাড়ি ছেড়েই বা কেন গেছে। আমি চাইনা আপনি এসব জিজ্ঞেস করুন। ব্যাপারটা একেবারেই আমাদের ব্যক্তিগত। ‘

ফারহানের বিনীত গলায় করা অনুরোধ মিসেস কায়নাতের মন ছুঁয়ে দিলো। উনি সাত পাঁচ না ভেবেই বললেন ‘ আচ্ছা ঠিকাছে তুমি যেটা বলেছ সেটাই হবে। আমরা কেউ ওকে কিছু জিজ্ঞেস করবো না। তুমি নিশ্চিন্তে যাও। তোমার হবু বউয়ের সর্বোচ্চ যত্নআত্তি করবো আমরা । ‘

ফারহান যেন মিসেস কায়নাতের কথায় সস্তির নিশ্বাস ফেলল। মুচকি হেসে বলল ‘ ধন্যবাদ আমার কথার মান রাখার জন্য। আমি তাহলে আসি আন্টি। আপনারা সবাই ভালো থাকবেন। মা ভাল থেকো। আমি আসছি তাহলে। আল্লাহ্ হাফেজ…. ‘

—-

সকাল হতেই সানাহ্ তার বই খাতা গোছানো শুরু করে দিলো। দুই একদিন কি ছিলনা এর মধ্যেই পুরো ঘর ময়লা হতে বসেছে। আজ সময় নেই বিধায় আর সেসব নজর দিলো না। কোনোমতে ব্যাগ গুছিয়ে, নিজে রেডি হয়ে ব্যাগ কাধে সিড়ি দিয়ে নেমে এলো।

মিসেস কায়নাত খাবার ঘরেই ছিলেন। বান্ধবী আশার সঙ্গে মিলে সকালের নাস্তার বন্দোবস্ত করছিলেন। সিঁড়ি দিয়ে সানাহ্কে ধুপধাপ নামতে দেখে বললেন ‘ তুই এসে গেছিস ? আয় চেয়ারে বসে খেয়ে যা। তোর আশা আন্টি তোর সঙ্গে কথা বলবে। ‘

মিসেস কায়নাতের কথায় দ্বিরুক্তি করলো না সানাহ্। সে তার কাধের ব্যাগটা সোফায় রেখে খাবার টেবিলে এসে বসলো। মিসেস কায়নাত সানাহ্কে জিজ্ঞেস করলেন ‘ এখন এত সকালে কি খাবি ? ‘

‘ দুধ দিয়ে ওটস দাও…. আসসালামু আলাইকুম আন্টি। কেমন আছো তুমি ? ‘

‘ আমি ভালো আছি। তোমার শরীর এখন কেমন লাগছে ? ইজ এভরিথিং ফাইন ? ‘

‘ অল ইজ ওয়েল অ্যান্ড ফাইন। তুমি খাবে না ? ফারহান কি কাল রাতেই চলে গেছেন ? আসলে কাল আমি এত টায়ার্ড ছিলাম যে চোখই খুলে রাখতে পারিনি। হুট করে আজ মনে পড়লো ফারহানকে কাল বিদায়ও জানাইনি। ‘

‘ হুম চলে গেছে আর যেতে যেতে তোমাকে বলে গেছে যেন এখন থেকে ভার্সিটির ক্লাসটা তুমি রেগুলার করো। অনেকদিন তো গ্যাপ গেলো..… এখন নাহয় মন দিয়ে পড়। তোমাদের বিয়ের পরপরই তো তোমার পরীক্ষা। এটা তো ফাইনাল তাই না ? ‘

‘ হ্যাঁ এটা ফাইনাল ‘

‘ তারমানে এরপর তুমি অনার্স পাস করে যাবে। তাহলে তো আরও মন দিয়ে পড়তে হয়। আমি চাই সবাই বলুক আমি উমুকের শাশুড়ী। তোমার ইচ্ছা থাকলে তুমি বিয়ের পর চাকরিও করবে। কেউ তোমাকে কিছু বলবে না। করবে চাকরি ? ‘

আশার কথায় চওড়া হাসি দিল সানাহ্। তার এই বিস্তৃত হাসি তার গালে টোল ফেলল। সানাহ্ মৃদু গলায় বললো ‘ এখনই বলতে পারছি না আন্টি। দেখা যাক কি করি..… সেটা বিয়ের পর ভাবা যাবে। ‘

‘ কী হলো কি ? শাশুড়ী বউয়েতে কি কথা হচ্ছে ? আমার বদনাম করা হচ্ছে ? ‘ মিসেস কায়নাত এতক্ষণ রান্নাঘরে রুটি সেকছিলেন। রুটি সেকা শেষে রুটিগুলো নিয়ে খাবার ঘরে এসে ঢুকতে ঢুকতে বললেন।

‘ তোমার কেন মনে হয় আমরা সবসময় তোমাকে নিয়েই ডিসকাস করি মা ? আমাদের কি আর কাজ নেই যে তোমাকে নিয়ে ডিসকাস করবো। তুমি কখনোই আমাদের ডিসকাশনের টপিক ছিলে না। ইউ ওয়ের অলওয়েজ এপার্ট ফ্রম মি ‘ গম্ভীর গলায় বললো সানাহ্।

‘ আঃ এসব কি বলছো সানাহ্ ? কায়নাত তোমার মা..… ‘ মিসেস আশা অবাক হয়ে বললেন। আশা কখনও সানাহ্কে এভাবে কথা বলতে দেখেননি। সানাহ্ বরাবরই তার মাকে সম্মান দিয়ে কথা বলে এটাই তার জানা। তাই চিরচেনা সানার অন্য রূপ দেখে কিছুটা রুঢ় হলেন। মায়ের সঙ্গে সানার এরকম ব্যবহার উনার ভালো লাগেনি।

‘ শুধু জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না আন্টি। আত্মার সম্পর্ক থাকা লাগে। আই থিঙ্ক সেই সম্পর্ক একমাত্র মামণির সঙ্গেই ছিল আমার। আসলে কথায় আছে মায়ের থেকে মাসীর দরদ বেশি। মায়ের এই এক্সট্রা ইন্সিকিউরিটি আর তার আমাকে নিয়ে সবসময় টেনশন করা আমাকে সিক বানাচ্ছে। এসবের জন্যই আমি বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু ফারহান আমাকে ফিরিয়ে আনতে গিয়েছিলেন বলে উনাকে ফিরিয়ে দেইনি। তার সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক হতে যাচ্ছে…… তাকে ফিরিয়ে দেওয়া মানে নিজেকে অপমান করা। ‘

কথাগুলো এক নিশ্বাস বলে ধুপধাপ পা ফেলে আর কোনদিকে চোখ না দিয়ে কাধে ব্যাগ তুলে বেরিয়ে গেলো সানাহ্। তার এখন এই পরিস্থিতিতে মোটেই খাওয়ার ইচ্ছা নেই। সকাল সকাল মুডটাই খারাপ করে দিয়েছে।

মিসেস কায়নাত বিমূর্ষ ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন সানার যাওয়ার দিকে। এমনটা অস্বাভাবিক নয়। এরকম প্রায়ই ঘটে থাকে যখন সানাহ্ বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায় আর তাকে আবার ফিরিয়ে আনা হয়। সবার উপর তৈরি হওয়া ফ্রাস্ট্রেশন সানাহ্ তার উপর ফেলে।

তবে আজ মিসেস কায়নাত এটাও জেনে গেলেন সানার জীবনে সে আজও মায়ের জায়গা তৈরি করতে পারেনি যেটা তার ব্যর্থতা। ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন ‘ আশা তুই কিছু মনে করিস না। আসলে এখন সবকিছুর চাপ সবদিক দিয়ে আসছে তাই হুট করেই সানার মাথা গরম হয়ে গেছে। এমনিতে ও খুব ঠান্ডা মেয়ে। দেখিস না তোর সঙ্গে কি সুন্দর করে কথা বলে ? ‘
মিসেস কায়নাতের কথা শুনে মিসেস আশা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মৃদু গলায় বললেন ‘ হুম ‘

~ চলবে ইনশাআল্লাহ্……