প্রেমমানিশা পর্ব-৬+৭+৮

0
251

#প্রেমমানিশা(০৬)

‘ একি এসব কি ? এই জামা কাপড় তোরা কোথায় পেলি ? ‘

বিল্টু,ময়না ওদের গাঁয়ে নতুন জামা কাপড় দেখে অতসী যেন আকাশ থেকে পড়লো। ও কপালে হাত দিয়ে কথাটা বললো কারণ ওর জানা মতে এখানে আশেপাশে এমন কেউ নেই যারা এই বাচ্চাদের জিনিস দিয়ে সাহায্য করবে। করার হলে এতদিনের অপেক্ষা করতো না, আরও অনেক আগেই করতো।

‘ দিদিভাই আজ না অনেক ভালো দেখতে একটা ভাইয়া এসেছিল, সেই তো এসে এগুলো দিয়ে গেলো আমাদের আর তোমার জন্যও একটা চিরকুট দিয়েছিল… চিরকুটটা কার হাতে দিয়েছিলাম যেন ? ‘ উত্তরের সন্ধানে মাথায় হাত দিয়ে মনে করার চেষ্টা করলো সন্ধি।

‘ কে এসেছিল ? আর তোরাও বা যার তার হাত থেকে জিনিস কেন নিলি ? তোদের না আমি আগেই বলেছি যে তোরা কারোর কাছ থেকে কিছু নিবি না ? ‘ অতসী চোখ পাকিয়ে শাসনের সুরে বলল ।

‘ দিদিভাই আমরা প্রথমে নিতে চাইনি কিন্তু ওই ভাইয়াটাই আমাদের হাতে এগুলো ধরিয়ে দিল আর এই যে এই চিরকুট দিয়ে বললো এই চিরকুট দেখার পর তোমাদের দিদিভাই আর রাগ করবে না…… ‘ বলে বিল্টু ওর পকেট থেকে একটা কালো রঙের কাগজ বের করে সেটা অতসীর হাতে দিল ।

বিল্টুর হাত থেকে কালো রঙের কাগজটা নিয়ে তার দিকে অনিমেষ পানে চেয়ে রইলো অতসী। অতসী ভেবে পেলো না এই কালো রঙের কাগজে কি লেখা থাকতে পারে। অতসী শত ভেবেও যখন ঠাওর করতে পারলনা তখন বাধ্য হয়ে কাগজটা খুলে পড়তে শুরু করলো ।

‘ টুকরো টুকরো ভালোবাসায় শুধু তুমি কেন অধিকার দেখাবে ? এই ভালোবাসায় আমারও অধিকার আছে তাই তোমার হয়ে অন্ধকারে কিছু আলো নাহয় আমিও ছড়ালাম। দুজনে মিলে নাহয় এই বাচ্চাদের মুখে আলো ফুটাবো। তুমি সামনে থেকে আর আমি আড়াল থেকে…… ‘ কালো রঙের কাগজে এক রাশ শুভ্রতা ছড়িয়ে শুভ্র রঙে রাঙিয়ে লিখা কথাগুলো।

চিরকুটটা পড়ে হতভম্ব হয়ে গেলো অতসী। চিরকুটের আগাগোড়া কিছু না বুঝলেও এটা ঠিকই বুঝলো যে ওর উপর কেউ নজর রাখছে আর সেই মানুষটা কে সেটা খুঁজে বের করতে হবে অতসীকে। কিন্তু মানুষটাকে খুঁজে বের করবে কি করে ? অতসীর ভাবনায় ছেদ পড়ল যখন ফোন বেজে উঠলো। চিরকুটটা পকেটে রেখে ফোন ধরলো অতসী।

‘ কিরে আসবি তো নাকি আজ ? ‘ ওপাশ থেকে অবনি বলল।

‘ হ্যাঁ তুই থাক আমি আসছি । আর আমি কিন্তু এসে গল্প শুনবো…… ‘ অতসী হাসতে হাসতে বললো ।

‘ গল্প……কিসের গল্প ? ‘ অবনি অবাক হয়ে বললো ।

‘ তোকে দেখতে আসার গল্প…… কাছে আসার গল্প…… ‘ অতসী দুষ্টু হাসি হেসে বললো।

‘ তুই কি ফোন রাখবি ? এসব কি অ’শ্লী’ল কথাবার্তা বলছিস ? তোর কি মুখে কোনোই লাগাম নেই ? তুই আজকাল বড্ড অভদ্র হয়ে গেছিস অতস…… ‘ বলে কপট রাগ দেখিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে অবনি ফোন রাখলো অন্যদিকে হাসিতে গড়াগড়ি দিতে দিতে বাচ্চাদের বিদায় জানিয়ে অতসী ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো।

–—

ভার্সিটির ক্যান্টিনের চেয়ারে বসে শান্ত ভঙ্গিতে আচার খেতে ব্যস্ত অতসী। তার এই শান্ত ভঙ্গিমা অবনিকে অতিষ্ট করে তুলছে। অবনি নীরবে ছটফট করতে করতে ক্যান্টিনের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় পায়চারি করছে। চিন্তা আর উত্তেজনা তার আকাশ সমান।

অবনির চিন্তার বিষয় হলো কাল তাকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল। পাত্রের নাম জহির আর সে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। পাত্রকে দেখে প্রথম দেখায়ই অবনি তার সুন্দর ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়ে গেছে। জহিরের সুন্দর, মৃদু গলায় কথা বলা, কিছু হলেই অবাক চাহনী দিয়ে তাকানো সবই তাকে জহিরের প্রতি আসক্ত করেছে।

তবে পাত্রকে এক দেখায় অবনির পছন্দ হলেও সে লোকলজ্জার ভয়ে এই কথা কাউকে বলতে পারছে না, এমনকি তার বান্ধবী অতসীকেও না। তবে ইতিমধ্যে অবনির ভাব ভঙ্গিমা দেখে অতসী ব্যাপারটা খানিকটা আন্দাজ করতে পারলেও অবনিকে প্রশ্ন করে বিব্রত করেনি পাছে বান্ধবী অসস্তির মুখে পড়ে।

অবনির জহিরকে পছন্দ হলেও জহিরেরও যে অবনিকে পছন্দ হয়েছে সেরকম কোনো ভাব কাল জহিরের আচরণে দেখেনি অবনি। উল্টো জহিরের পরিবার বলেছে পাত্রী পছন্দ হয়েছে নাকি হয়নি সেটা আজ জানাবে। এই তো এখনই জানানোর কথা,সকাল দশটায়। মা ফোন করলো বলে।

অবনি প্রকাশ করতে পারছে না কিন্তু ভয়ে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে তার মন পছন্দের পাখি এখনই খাঁচা ছেড়ে পালালো বলে। উপায় না পেয়ে নিজেকে শান্ত করতে মতি মিয়াকে কফি আনতে বলে অতসীর মুখোমুখি বসলো।

মতি মিয়া কফি দিয়ে যেতেই অবনি কাপে চুমুক দিয়ে নিরবতা ভেঙে কিছু বলার উদ্দেশ্যে উদ্যত হতেই অবনিকে বিরক্ত করে অবনির ফোন বেজে উঠলো। হাত থেকে কফির কফি কাপটা নামিয়ে বিরক্তিকর ‘চ’ শব্দ করে ফোনটা রিসিভ করে বললো ‘ হ্যাঁ মা বলো……টেলিফোন কেন করলে ? পাত্রপক্ষের আমাকে পছন্দ হয়নি এই বলেছে তাইতো ? এটা তো অস্বাভাবিক কিছু না মা……এর আগেও অনেকবার আমার জন্য সম্বন্ধ এসেছে আর সেগুলো সবগুলোই তো কোনো না কোনো কারণে ভেঙে গেছে তাই এবারও ভাঙলে আমি অবাক হবো না। ‘

অতসী মনযোগ দিয়ে অবনির কথা শুনছে। মেয়েটার মুড সুইংস খুব বেশি হয়, মুড অনেক তাড়াতাড়ি বদলায়। জিনিসটা ভালো নয় তবে মেয়েদের তো এরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক। এর আগেও একাধিকবার অবনির জন্য সম্বন্ধ এসেছে কিন্তু মেয়ে পছন্দ হওয়ার পর,কথা একটু আগানোর পরই অজানা কারণে পাত্রপক্ষ পিছিয়ে পড়ত। জিনিসটা অতসীর কাছে অদ্ভুত লাগলেও অতসী সেটা পাত্তা দেয়নি কারণ সে সময়গুলোতে অবনির কোনো পাত্রকেই পছন্দ হয়নি, শুধু পরিবারের পছন্দে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ করা এই যা।

তবে এবারের ব্যাপারটা আলাদা। অতসী তার বান্ধবীকে দেখে পরিষ্কার বুঝতে পারছে এই পাত্র পক্ষকে তার বান্ধবীর মনে ধরেছে নাহলে একটু আগে এত টেন্সড ছিল এখন আবার এত তাড়াতাড়ি মুড বদলে হতাশ হয়ে পড়ল কি করে ? এর আগে যতবার সম্বন্ধ এসেছে ততবারই অবনি বেশ রিল্যাক্স ছিল যেন বিয়েটা ওর নয় অন্য কারোর। অবনির তার মায়ের সঙ্গে কি কথা হলো সেটা জানা গেলনা তবে কিছুক্ষনের মধ্যেই অবনির চোখ বড় বড় হয়ে গেলো আর ওর হাত গলে ফোনটা ওর কোলে পড়লো। ফোন বেচারা আরেকটুর জন্য মাটিতে পড়ে আছাড় খেয়ে টুকরো টুকরো হওয়া থেকে বেঁচে গেছে।

‘ আন্টি কি বললো ? ‘ অতসীর সন্দিহান দৃষ্টি অবনির দিকে।

‘ মা বললো পাত্রপক্ষ নাকি রাজি হয়ে গেছে আর আজই বিয়ের ডেট ঠিক হয়েছে। আজই নাকি আমায় বিয়ে করে ঘরে তুলবে…… ‘ অবনির কাপা কাপা গলা অতসী স্পষ্ট টের পেলো।

‘ তো এতে এভাবে রিয়েক্ট করার কি আছে ? তোকে ওদের পছন্দ হয়েছে তাই আজই বিয়ে দিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে । ‘ অতসী অবাক গলায় বললো কারণ কাহিনী শুনে ওর বান্ধবী যেভাবে রিয়েক্ট করলো ব্যাপারটা সেভাবে রিয়েক্ট করার মতো না।

‘ ওদের না শুধু জহিরের পছন্দ হয়েছে…… ‘

‘ মানে ? ‘ অতসী অবনির কথা শুনে অবাক চোখে তাকিয়ে বললো।

‘ জহিরের মায়ের আমাকে পছন্দ হয়নি। জহিরের বাবা কাল আসেননি। শুধু জহির,জহিরের ছোট বোন আর জহিরের মা এসেছিলো। জহিরের মা আমাকে দেখে বলেন আমার সঙ্গে উনার ছেলের বিয়ে দিবেন না কারণ আমার আগেও অনেকবার বিয়ে হতে হতে ভেঙে গেছে। জহিরের মায়ের কথা শুনে ওর বোন কিছু বলতে না পারলেও জহির স্পষ্ট কথায় জানিয়ে দিয়েছে বিয়ে করলে আমাকেই করবে নয়তো আর কাউকে নয়। ‘

‘ বাহ্ তাহলে তো ভালো কথা। মনে হচ্ছে হবু দুলেভাই তোকে বহুত পছন্দ করে ? ‘ ভ্রূ নাচিয়ে নাচিয়ে দুষ্টু হাসি হেসে বললো অতসী।

‘ ব্যাপারটা আমার কেন জানি ঠিক স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। অতসী তোর কাছে জিনিসটা সহজ হলেও আমার কোথাও না কোথাও খটকা ঠিকই লাগছে। ‘ অবনি মনে মনে কথাগুলা বললো ।

‘ যাক তাহলে তোর বিয়ে ঠিক হওয়ার খুশিতে আজ নাহয় আমিই তোকে ট্রিট দিবো। আজ পুরো ফ্রেন্ড সার্কেলকে আমার তরফ থেকে আড্ডা তে আড্ডা বসানোর ট্রিট। আড্ডার মেইন কিচেন খালি করে দিবো। দরকার পড়ে বাবাকে বলে আমার ক্রেডিট কার্ডে ট্রান্সফার করিয়ে নিবো । ইয়াহু……মেরে ইয়ার কি শাদি হ্যা…. ‘ বলে অতসী মিটমিটিয়ে মুখে হাত দিয়ে হেসে উঠলো।

অতসীর খুশি দেখে অবনি কিছু না বললেও ওর মনে তৈরি হওয়া সন্দেহের দানা মিটে নি। তবে বান্ধবীর খুশিতে বাঁধা দিলো না। অবনিও যোগ দিলো অতসীর খুশিতে।

—-

‘ ডক্টর ও ঠিক হয়ে যাবে তো ? ‘ চিন্তিত মুখে মেয়ের দিকে এক নজর দৃষ্টি বুলিয়ে ডক্টরের উদ্দেশ্যে বললেন মিসেস কায়নাত।

‘ ওর অবস্থার তো উত্তরোত্তর অবনতি ঘটছে। আমার মনে হচ্ছে ও কোনো মেন্টাল ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এই কয়দিনে কি এমন কিছু ঘটেছে যাতে সানার এই অবস্থা হতে পারে ? ‘ ডক্টর সবেদার বললেন।

‘ না……এই কয়দিনে এমন কিছুই হয়নি যাতে সানাহ্ এরকম অসুস্থ হয়ে পড়বে। তবে ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে। ‘

মিসেস কায়নাতের কথা শুনে ডক্টর কেমন যেন চমকে উঠলেন। সন্দিহান দৃষ্টিতে মিসেস কায়নাতের দিকে তাকালেন আর বললেন ‘ আপনারা কি ওর জোর করে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন ? ‘

‘ কি আশ্চর্য্য !! আমি আমার মেয়ের বিয়ে জোর করে কেন দিতে চাইবো ? ‘ মিসেস কায়নাত অবাক হয়ে বললেন ।

‘ তাহলে আপনি বলতে চাইছেন সানাহ্ আপনাদের ঠিক করা পাত্রের সঙ্গে বিয়েতে বসতে রাজি ? ‘ ডক্টর সবেদারের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মিসেস কায়নাতের দিকে।

মিসেস কায়নাত ডক্টর সবেদারের দৃষ্টি দেখে ভরকে গেলেন। পরিস্থিতির গুরুগম্ভীরতা সামলাতে মেয়ের চিন্তায় অস্থির হয়ে ঘরে হাজির হলেন মিস্টার কবির। ঘরে ঢুকেই মিস্টার কবির একবার মেয়ের দিকে চোখ বুলালেন। সানাহ্ অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছে বিছানায়, চোঁখের নিচে তার কালি, চুলগুলো বালিশের উপর জড়ো হয়ে আছে মাথায় পানি দেওয়ার কারণে। মেয়ের এই অবস্থা তাকে ভিতর থেকে পোড়াচ্ছে।

সানাহ্কে এই অবস্থায় দেখে মিস্টার কবিরের মনে পড়লো তার ভাইয়া ভাবির কথা। সানাহ্ তাদের অনেক আদরের মেয়ে। সানাহ্কে মিস্টার কবির খুব ভালোবাসেন বলেই ছোটো সানার আবদার রাখতে বিয়ে করেছিলেন সানার খালামণি কায়নাতকে। ভাইয়া আর ভাবি মারা যাওয়ার পর কায়নাত আর কবির মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে সানাহ্কে নিজেদের মেয়ের মত বড় করবেন। আর আজ সেই মেয়েরই এই অবস্থা মিস্টার কবিরের পিতৃত্বকে বেশ কষ্ট দিয়েছে।

‘ ডক্টর কি হয়েছে সানার ? ‘

‘ মনে হচ্ছে সানাহ্ কোনো কারণে ডিপ্রেসড তাই আমার মনে হয় আপনাদের ওকে একটু ওয়েদার চেঞ্জের জন্য নিয়ে যাওয়া উচিত। এতে যদি একটু ইমপ্রুভমেন্ট হয় তাহলে তো ভালই নাহলে ইমিডিয়েট ট্রিটমেন্ট এর জন্য ওকে দেশের বাইরে ট্রান্সফার করতে হবে। এই রোগ আর ফেলে রাখা যাবে না। এত বছর তো চেষ্টা করলাম……মাঝখানে যা উন্নতি হয়েছিল এখন তার দ্বিগুণ অবনতি হলো। ‘

‘ তাহলে কি ওকে আমাদের বান্দরবনের বাড়িতে নিয়ে যাবো ? ‘

‘ সে আপনি ওকে যেখানে ইচ্ছা নিয়ে যান তবে পাহাড়, সমুদ্র এসবের কাছে গেলে মনটা রিফ্রেশ হবে। আর যত তাড়াতাড়ি পারুন ওর ওয়েদার চেঞ্জের ব্যবস্থা করুন। সম্ভব হলে ও সুস্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওর বিয়ের আগে পর্যন্ত ওকে কোথাও একটা পাঠিয়ে দিন। এই লোকালয় থেকে যত দূরে যাবে তত স্ট্রেস কমবে। ‘

‘ তাহলে আমি ওর সুস্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওকে আমাদের বান্দরবনের বাড়িতে নিয়ে যাবো। ‘ কথাটা বলেই মিস্টার কবির নিজেকে এই বুঝ দিলেন যে তার মেয়ে খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।

—-

ক্লাসে প্রণয় হাজির হতেই সকলে উঠে দাড়িয়ে প্রণয়কে কুর্নিশ জানালো। প্রণয় সবাইকে বসতে বলে আড়চোখে একবার সবার পিছনের সারির শেষ মাথায় বসা অতসীর দিকে তাকালো তবে সেটা অতসীর চোখে পড়লো না। অতসীর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে এবার নিজের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো আর স্টুডেন্টদের উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করলো ‘ সো স্টুডেন্টস আজ থেকে আমরা নতুন টপিক পড়বো আর প্রত্যেকটা টপিকের কিছুটা অংশ পড়ার পর আমি যখন কোনো প্রব্লেম আছে কিনা জিজ্ঞেস করবো তখন তোমরা তোমাদের প্রবলেমের কথা আমায় বলে সলভ করে নিতে পারো। তবে আমার ডিসকাশনের মাঝে ইন্টারাপট করা যাবে না……আই ডোন্ট লাইক দেট। সো ইস দেট ক্লিয়ার ? ‘

প্রণয়ের কথা শুনে সকলে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল আর সেটা দেখে প্রণয় অতসীর দিকে দৃষ্টি দিল এই ভেবে যে ও যদি কিছু বলে । কিন্তু প্রণয়ের আশা ভঙ্গ করে অতসী কিছুই বললো না। অতসীকে চুপচাপ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রণয়ের চাপা রাগ হলো যা একেবারেই তার অজান্তে তবে সেটা সে বুঝতেই পারল না। কেবল নিজের রাগ চেপে রেখে পিছনের সারিতে বসে থাকা অতসীর দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে বললো ‘ এই যে মিস…. ‘

প্রণয়ের এহেন কাজে সব স্টুডেন্ট একসঙ্গে পিছন ফিরে অতসীর দিকে তাকালো আর অতসী ভরকে গেল। অতসী যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়িয়ে বললো ‘ স্যার আমাকে বলছেন ? ‘

‘ ইয়েস তোমাকেই বলছি…… কি নাম তোমার ? ‘

‘ সাইয়ারা কবির অতসী…. ‘

‘ তাহলে মিস অতসী তুমি একটু কষ্ট করে তোমার বন্ধু বান্ধবদের ছেড়ে সামনের দিকের সিটে এসে বসো কারণ এভাবে বসলে তো হয়না ম্যাডাম। পড়াশুনা বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে হয়না। বন্ধুত্ব ক্লাসের বাইরে রেখে আসাটাই ভালো নাহলে তোমারও ক্ষতি আবার তোমার বন্ধুদেরও ক্ষতি। কী আমি কিছু ভুল বললাম ? ‘

প্রণয়ের কথায় অতসী মাথা নেড়ে না ইশারা করলো কারণ কথা তো প্রণয় কিছু ভুল বলেনি। প্রণয় অতসীর মাথা নাড়া দেখে বলল ‘ তাহলে ম্যাডাম আপনি চলে আসুন সামনে…… আর আজ থেকে আপনি এখানেই বসবেন আমার চোখের সামনে । ‘

প্রণয়ের কথা শুনে অতসী চোখ বড় বড় করে বলল ‘ কি বললেন স্যার ? ‘

‘ বুঝতে পারছেন না ? আমি বলেছি এখন থেকে আপনি আমার চোখের সামনে থাকবেন যাতে আমি আপনার অ্যাকটিভিটি নজরে রাখতে পারি। আর দাড়িয়ে থাকবেন না…… ফাস্ট ফাস্ট তাড়াতাড়ি এসো। ক্লাসের সময় আসছে না বরং যাচ্ছে……ডু ইট ফাস্ট। ‘

অতঃপর অতসী আর উপায় না পেয়ে ওর জায়গা আর ওর বন্ধু বান্ধবদের ছেড়ে মলিন চোখে সামনের দিকে গিয়ে প্রণয়ের সামনাসামনি বসলো। অতসীর ওর জায়গা বসতেই প্রণয় এবার ক্লাসে পড়ানোতে মনযোগ দিল।প্রণয় ওর টপিক ডিসকাশন শেষ করার ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক প্রশ্ন করলো যার মোটামুটি সব উত্তরই অতসী দিল। অতসীর এরকম অ্যাক্টিভনেস দেখে প্রণয় মনে মনে খুশি হলেও প্রকাশ করলো না। টপিক ডিসকাশন শেষে শেষবারের মতই জিজ্ঞেস করে সকলের প্রবলেম সলভ করে আড়চোখে অতসীকে দেখে গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলো প্রণয় আর সেই দিকে তাঁকিয়ে অতসী মনে মনে দুষ্টু হাসি হেসে বললো ‘ যাও যাও চান্দু যাও….এরপর তোমার সাথে কি হবে সেটা তো একমাত্র আল্লাহই জানেন। ‘

~ চলবে ইনশাআল্লাহ্….

#প্রেমমানিশা(০৭)

‘ বইনা আমার এরকম কি না করলেই নয় ? স্যার যদি দেখে ফেলে তাহলে আমাদের মেরেই ফেলবে। প্লিজ অতস এসব রাখ……স্যার দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। ‘ অবনি ভয়ে দুঃখে মিনমিনিয়ে বললো।

‘ আরে ছাড় তো ওই ব্যাটা কিচ্ছু করতে পারবে না। যদিও বেটা আমাকে আমার দোষেই ক্লাস থেকে বের করেছিল তবে একটু না জ্বালালে আমি শান্তি পাবো না। কথায় আছে না Self satisfaction is the biggest thing… ‘

‘ আচ্ছা যা করার তাড়াতাড়ি কর নাহলে স্যার এসে দেখে নিলে আমাদের গুষ্টি উদ্ধার করে ফেলবে। ‘

‘ আরে দোস্ত নো প্রবলেম….…আমরা এখন ভার্সিটি ক্যাম্পাসের বাইরে আছি আর ভার্সিটি ক্যাম্পাসের বাইরে না সে আমাদের প্রফেসর আর না আমরা তার স্টুডেন্ট। ব্যাস এই শেষবার আরেকটা খোঁচা মারলেই শেষ……মিস্টার প্রণয়বাবু এখন আপনি কি করবেন ? আপনি তো কিছুতেই এই ফাটা বাঁশের মত চুপসে যাওয়া গাড়ির টায়ার নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবেন না। দিন শেষে তো আপনাকে আমার হেল্পই নিতে হবে। ‘ বলে হাতের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়ালো অতসী।

‘ হয়েছে তোর ? এবার তাড়াতাড়ি চল,তুইতো স্নেহা, রুহি ওদের ট্রিট দিবি বলেছিলি। মা বলেছে তাড়াতাড়ি খেয়ে বাড়ি ফিরতে কারণ জহিররা আজ সন্ধ্যাতেই আসছে…… ‘

‘ হুম চল…… ‘ বলে অতসী সামনে ফিরে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে খানিকটা দূরে রাখা ওর স্কুটিটা নিয়ে এগলো। কিছুটা এগোতেই দেখলো প্রণয় ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। প্রণয়ের দৃষ্টিতে খেলা করছে হাজার প্রশ্ন । প্রণয়ের দৃষ্টি দেখে অতসী আর অবনি দুজনেই শুকনো ঢোক গিললো।

‘ তোমরা এখানে কি করছ ? ‘

‘ স্যার..…স্যার……না মানে আমরা…. ‘ অবনি আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করলো কিন্তু আপসোস মিথ্যা কথা বলার সময় যারা মিথ্যা বলতে পারদর্শী নয় তাদের কথা গলাতেই আটকে যায়।

‘ এত ভয় পাওয়ার কি আছে অব ? সত্যি কথাটা বললেই হয়..… আমরা এখানে আমার স্কুটি নিতে এসেছিলাম…… ‘

অতসীর কথা শুনে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো অবনি। শান্তির নিশ্বাস ফেললো। প্রথমে অতসীর কথা শুনে ভেবেছিল এই বুঝি মেয়েটা সব সত্যি বলে দিলো তবে অতসী অতটাও পাগল নয় যে সত্যি বলে নিজের বারোটা বাজাবে। তাই যখন অতসী বুদ্ধি করে কথাটা বললো তখন অবনির ভয়টা কেটে গেলো।

অতসীর কথা শুনে প্রণয় আর কিছু বললো না, শুধু এক পলক তাকিয়ে ওদের পাশ কাটিয়ে কিছু না বলেই এগিয়ে গেলো তার গাড়ির দিকে। প্রণয়ের এহেন ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখে অতসীর গা পিত্তি জ্বলে উঠলো তবে অতসী নিজেকে সামলে নিয়ে দাতে দাঁত চেপে দাড়িয়ে প্রণয়ের কান্ড কারখানা দেখতে লাগলো।

প্রনয় গাড়িতে উঠেই গাড়ি স্টার্ট দিল। গাড়ি স্টার্ট হওয়ার পর পার্কিং লট ছেড়ে বেরোতেই ফুস করে শব্দ করে গাড়ি থেমে গেলো। গাড়ির হঠাৎ থেমে যাওয়া দেখে প্রণয়ের ভ্রূ কুচকে এলো। প্রণয় ব্যাপারটা কি দেখতে গাড়ি থেকে বের হতেই গাড়ির ফ্রন্ট টায়ারের অবস্থা দেখে প্রণয়ের মাথায় হাত পড়ল।

দূর থেকে প্রণয়ের মাথায় হাত পড়তে দেখে অতসী অবনির দিকে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হাসে আর অবনি ওকে হাসতে দেখে চোখ গরম করে তাকায়। অতসী অবনিকে এভাবে চোখ গরম করতে দেখে বলে ‘ এবার প্ল্যান বি এর পালা…… অব তুই রিক্সাতে করে আড্ডায় চলে যা। আমি একটু স্টুডেন্ট হওয়ার দায়িত্ব পালন করি..… ‘

‘ মানে ? তুই আবার কি করতে চাইছিস ? ‘ অবনি অবাক হয়ে বলল ।

‘ কি করতে চাইছি সেটা পরে শুনিস আগে আমি আমাদের নিউ প্রফেসরকে একটু সেবা করি আফটার অল প্রফেসরের বিপদে তো আমরা স্টুডেন্টরাই পাশে দাড়াব তাইনা ? ‘

‘ তোর এই উদ্ভট ব্যবহারই বলে দিচ্ছে তুই উল্টাপাল্টা কিছু একটা করবি। আমি জানিনা তোর স্যারের সঙ্গে কি শত্রুতা তবে তোর কপালে যে শনি নাচছে এটা আমার ভালো করেই জানা। ‘

‘ এত কথা না বলে যা না……’

—-

‘ উফফ ডিসগাস্টিং এখন এই খাটারা গাড়ি নিয়ে আমি বাড়ি কি করে ফিরবো ? দাদু তো আমার জন্য টেনশন করছে……ফোন করে যে বলবো টায়ার পাঞ্চার হয়েছে এটা শুনলে আরও বেশি চিন্তা করবে। উফফ গড এটা তুমি কি করলে ? ‘ রাগে দুঃখে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে গাড়ির গায়ে হাত বারি দিয়ে বললো প্রনয়।

‘ ক্যান আই হেল্প ইউ স্যার ? ‘

হঠাৎ পিছন থেকে মেয়েলি কণ্ঠস্বর শুনে পিছন ফিরে প্রণয়ের ভ্রূ কুচকে গেলো। প্রণয় বিরক্তি প্রকাশ করে বললো ‘ তুমি এখানে ? ‘

‘ হ্যাঁ স্যার আমি এখানে…… আসলে কি বলুন তো আমি এইদিকে দিয়েই যাচ্ছিলাম তারপর হঠাৎ দেখি আপনি গাড়ি নিয়ে দাড়িয়ে আছেন আর আপনমনে নিজেই নিজের সঙ্গে কথা বলছেন। ভাবলাম কি হলো জিজ্ঞেস করে যাই……ওমা এসে দেখি আপনার গাড়ির টায়ার পাঞ্চার হয়ে গেছে। তাই কোনোভাবে যদি আপনাকে হেল্প করতে পারি তাহলে আমি কৃতার্থ হবো। ‘ অতসী এক গা জ্বালানো হাসি দিয়ে বললো।

অতসীর কথার ধরণ আর তার হাসি দেখে প্রণয়ের মুখ থমথমে হয়ে গেলো। ও শান্ত গলায় বললো ‘ আমার তোমার হেল্পের দরকার নেই…… ‘

‘ ভেবে বলছেন তো স্যার ? এখন যদি আমি চলে যাই তাহলে আপনিই বিপদে পড়বেন। আরেকবার ভেবে দেখুন…… না না এর জন্য আপনাকে আমাকে থ্যাংক ইউ বলতে হবে না। আমি তো শুধু আমার দায়িত্ত্ব পালন করছি ‘

‘ এখানে ভেবে দেখার কিছু নেই অতসী, আমি যা বলছি ভেবেই বলছি। আর তোমাকে দায়িত্ত্ব পালন করতে হবে না। আমি তোমাকে দায়িত্ত্ব পালন করা থেকে অব্যহতি দিলাম। ‘ প্রণয় নিরস মুখে বললো।

‘ ঠিকাছে তাহলে কি আর করার ? আমি তাহলে চললাম স্যার..… ‘ বলে অতসী তার মাথায় হেলমেট পড়ে স্কুটি নিয়ে বেরিয়ে গেলো।

অতসী স্কুটি নিয়ে বেরিয়ে যেতেই প্রণয় হাফ ছেড়ে বাঁচলো। কেন জানি মেয়েটাকে ওর সহ্যও হয়না আবার তাকে ভুলতেও পারেনা। নো মেয়েটাকে ভুলতে হবে নাহলে বিপদ আছে এই ধারণা মাথায় ঢুকিয়ে নিলো প্রণয়। তবে ক্ষনিকের মধ্যেই ওর আবার আপসোস হতে শুরু করল। মেয়েটাকে এভাবে তাড়িয়ে না দিয়ে ওর কাছ থেকে সামান্য লিফট নিলেই পারতো। লিফট নিলে এতক্ষণে পৌঁছে যেত…… কে জানে কোন পাগলে ওর গাড়ি পাঞ্চার করেছে।

তবে প্রণয়ের আপসোস কিছুক্ষনের মধ্যেই উবে গেল কারণ অতসী আবারও তার ফেমাস স্কুটি নিয়ে হাজির হয়েছে । অতসীকে দেখে প্রণয় অবাক হয়ে বললো ‘ একি তুমি না চলে গিয়েছিলে ? ‘

‘ আমি চলে গেলে কি করে হয় বলুন তো স্যার……আপনি টিচার মানুষ তাই হয়তো আপনার ইগোতে বাঁধছে আমার থেকে লিফট নিতে কিন্তু আমি তো স্টুডেন্ট। আমার তো ইগো থাকতে নেই তাই চলে গিয়েও ফিরে এলাম শুধু আপনার জন্য। ‘

‘ মানে ? ‘ প্রণয়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি অতসীর দিকে।

‘ মানে হলো আপনাকে লিফট দিতেই তো ফিরে এলাম। তা আসুন তাড়াতাড়ি উঠে পড়ুন……আমার আবার আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আড্ডায় যেতে হবে ‘ স্কুটির ডিকি থেকে একটা এক্সট্রা হেলমেট নামিয়ে প্রণয়ের হাতে দিল অতসী।

‘ হঠাৎ আড্ডায় কেন ? ‘ অতসীর হাত থেকে হেলমেট নিয়ে সেটা পড়তে পড়তে বললো প্রণয়।

‘ আমার যেই বান্ধবীকে আমার সঙ্গে দেখেছিলেন তার বিয়ে ঠিক হয়েছে । ছেলে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার……পাত্রপক্ষ ঠিক করেছে আজই বিয়ে হবে তাই সেই খুশিতে আমি সবাইকে ট্রিট দিচ্ছি ‘ বলে প্রনয় উঠার পর স্কুটি স্টার্ট দিল অতসী।

‘ তাহলে তো ট্রিট তোমার বান্ধবীর দেওয়ার কথা কারণ বিয়ে তার ঠিক হয়েছে। তার বিয়ে আর ট্রিট দিবে তুমি ? ভেরি স্ট্রেঞ্জ !! ‘

‘ আমরা এমনই স্যার….… দা স্ট্রেঞ্জেস্ট পারসন। আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই এমন। আসলে বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে একটু পাগলামি না থাকলে আর কাদের মধ্যে থাকবে। এই ভার্সিটি লাইফ তো বন্ধু বান্ধবদের সাথে পাগলামি করার জন্যই। আপনি আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলে থাকলে বুঝতেন আমরা কতটা ইনজয় করি এসব। আপনি আমাদের প্রফেসর নাহলে আজ আপনাকেও ট্রিট দিতাম। বাই দ্যা ওয়ে আপনি চাইলে কিন্তু আমি দিতে পারি। ‘ স্কুটির ফ্রন্ট ক্যামেরা দিয়ে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে বললো অতসী।

অতসীকে তার দিকে তাকাতে দেখে অপ্রস্তুত হলো প্রণয়। তড়িঘড়ি করে বললো ‘ নো আই এম ফাইন…. ‘

‘ এজ ইউর উইশ……আপনার এড্রেস বলুন দেখি। আমি অন্তর্যামী নই তাই এড্রেস না জেনে পৌঁছে দিতে পারছি না। ‘

অতসীকে এড্রেস না জানিয়েই লিফটের জন্য স্কুটিতে উঠে পড়াতে লজ্জায় পড়লো প্রণয়। নিজেকেই নিজে হাজারটা গালাগালি করলো নিজের এমন নির্বোধ কাজের জন্য।তারপর নিজেকে গালাগালি শেষে ওর বাড়ির অ্যাড্রেস বললো। প্রণয়ের বাড়ির এড্রেস শুনে অতসী অবাক গলায় বললো ‘ ও মাই গড আপনিই তাহলে একসময়কার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জালাল সাহেবের নাতি ? ‘

এবার যেন অতসীর এহেন আচরণে প্রণয়ও খানিকটা ঘাবড়ে গেল কারণ একে তো ওরা স্কুটিতে আছে তার উপর দিয়ে এহেন আচরণে স্কুটি ব্যালান্স হারালে দুজনেই উপরে চলে যাবে। তবে প্রণয় এটা ভেবেও অবাক হলো যে অতসী ওর দাদুর নাম কি করে জানে। প্রণয় নিজের বিস্ময় ভাব প্রকাশ করে বলল ‘ তুমি কি করে জানলে ? ‘

‘ দাদুকে আমি চিনব নাতো কে চিনবে ? দাদুর সঙ্গে বহু পুরনো পরিচিতি আছে আমার…… আপনি তো তখন দেশেও ছিলেন না। অবশ্য আমি আপনার ছবি দেখেছি তবে মনে ছিলনা। দাদুও আমাকে বলেছিল ওর নাতি আসবে কিন্তু আমি সময় করে দেখা করে উঠতে পারিনি ‘ অতসী এক গাল হেসে সামনের দিকে চোখ রেখে বলল।

আচমকা অতসীর কথায় প্রনয়ের রাগ হলো। কেন সে কি দেখতে সুন্দর নয় যে তার ছবি দেখার পরও তাকে মনে রাখা গেলো না ? প্রণয় তার মনে আসা প্রশ্নগুলো দমিয়ে রাখতে পারল না। নীরবতা ভেঙে বললো ‘ আমার ছবি দেখার পরও আমাকে মনে না পড়ার কারণ ? ‘

‘ আমি কি আপনাকে রোজ দেখি যে আপনার ছবি দেখলে আপনাকে মনে থাকবে ? দাদু হুটহাট যখন আপনার ছবি দেখায় তখন আমার আপনার কথা মনে পড়ে। ‘

‘ তাহলে তুমি বলছো যে তুমি আমাকে রোজ দেখলে তোমার আমার কথা মনে পড়বে ? ‘ প্রণয় ভ্রূ কুচকে জিজ্ঞেস করলো ।

প্রণয়ের প্রশ্নের জবাব দিলনা অতসী, প্রশ্নটা এক প্রকার এড়িয়ে গেলো। প্রনয়ও ওর প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে অতসীকে আর ঘাটালো না। অতসী কিছুক্ষণ পর বললো ‘ তো দাদুর সঙ্গে আমার কি করে পরিচয় হলো জানতে চাইবেন না ? ‘

‘ তুমি না বললে আমার জিজ্ঞেস করে নিরাশ হওয়ার মানে হয় না।তুমি বলতে চাইলে বলো..… ‘

‘ আলু পটল উঠাতে গিয়ে…… ‘

‘ মানে ? ‘ অতসীর কথা শুনে হতবাক প্রায় প্রণয়।

‘ দাদু একদিন দিদুনের সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল এই বলে যে সেও আলু পটল কিনে দেখিয়ে দিবে যে সে কারোর থেকে কম নয় কারণ দিদুন বলেছিল আলু পটল বেছে কিনা হাতের মোয়া না। দাদু যখন বাজার কিনে ফিরছিল তখন ব্যালেন্স করতে না পারায় দাদুর হাত থেকে বাজারের ব্যাগ পড়ে যায়। আমি তখন সেখান দিয়েই কলেজ থেকে ফিরছিলাম। বছর তিনেক আগে তখন আমি ইন্টার মিডিয়েটের স্টুডেন্ট। দাদু নিচু হয়ে নিতে পারছিল না বলে আমি সেগুলো তুলে দিয়ে দাদুকে বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিয়েছিলাম। সেই থেকে আমাদের পরিচয়…… ‘

‘ ভালো…… ‘

অতসীর যতটা উৎসাহ নিয়ে কথাগুলো প্রণয়কে বলছিলো প্রণয় কথাগুলো শোনার পর ঠিক ততটা রিয়াকশন দেয়নি, বলা চলে আমলেই নেয়নি। প্রণয়ের এহেন ব্যবহারে অতসী অবাক হলেও কিছু বললো না,নিজের কাজে মন দিল।

অতসী বাড়ির কাছে এসে থামতেই প্রণয় স্কুটি থেকে নামার উদ্দেশ্যে উদ্যত হলো তবে ওকে অবাক করে দিয়ে অতসী আগেভাগেই স্কুটি থেকে নেমে দৌড় দিল এই বলে যে ‘ স্যার আমার স্কুটি যেভাবে আছে সেভাবেই থাক, আপনি নিশ্চিন্তে আসুন ‘ । প্রণয় অবাক হলো এই ভেবে যে ওর বাড়িতে ওকে ড্রপ করতে এলো মেয়েটা অথচ ও নামার আগেই ওকে ফেলে নিজেই ঢুকে যাচ্ছে।

—-

‘ দাদু ও দাদু…… দিদুন……চাচী কোথায় তোমরা ? ‘ এক প্রকার হাকডাক করতে করতেই বাড়িতে ঢুকলো অতসী।

অতসীর গলার আওয়াজ পেয়ে লাইব্রেরি ঘর থেকে চোখের চশমা ঠিক করতে করতে বেরিয়ে এলেন জালাল সাহেব। অতসীকে দেখে জালাল সাহেবের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল,যেন অনেক দিনের হারিয়ে যাওয়া উজ্জ্বলতা ফিরে পেয়েছেন। অতসীর হাকডাকে মিসেস আসমা আর মিসেস ছায়াও রান্নাবান্না ছেড়ে রান্নাঘর থেকে ছুটে বেড়িয়ে এলেন। এশা বাড়িতে নেই কারণ সে কলেজে গিয়েছে।

জালাল সাহেব অনেকদিন পর অতসীকে দেখে বললেন ‘ অবশেষে এলি অতস ? আমি তো ছায়াকে কালই বলছিলাম অনেকদিন তোর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ নেই, ওই ফোনেই যা কথা হয়। তা এতদিন পর তোর আমার কথা মনে পড়লো ? তোর জোড়া চড়ুই কোথায় ? সে এলো না ? ‘

‘ আর বলো না দাদু……ওই মহারানীর আজ বিয়ে। তাকে ট্রিট দিবো বলেই সবাইকে রেস্টুরেন্টে জমা করেছি কিন্তু এখন ওসব ছেড়ে তোমায় দেখতে চলে এসেছি। দেখেছো আমি তোমাকে কত ভালোবাসী ? তোমায় ছেড়ে থাকতেই পারলাম না তাই তোমার টানে ছুটে এলাম…… কই এসো একটু শান্ত হয়ে বসতো। আমার তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে, কতদিন কথা বলিনা বলতো। আমার আবার তাড়াও আছে..…তাড়াতাড়ি যেতে হবে।’ বলতে বলতে অতসী জালাল সাহেবের হাত ধরে নিয়ে গিয়ে উনাকে সোফায় বসালো।

জালাল সাহেবকে বসিয়ে উনার মুখোমুখী একটা সোফায় বসে অতসী মিসেস আসমার উদ্দেশ্যে বললো ‘ কি গো সুন্দরী কেমন আছো ? ‘

‘ বাহ্ এতক্ষণে আমার খেয়াল হলো ? একজনের তো দাদুকে পেলেই হলো,আমার কথা আর মনে থাকে না। তা এতদিন আসা হলো না কেন শুনি ? ‘ মিসেস আসমা চোখ পাকিয়ে বললেন।

‘ হ্যাঁ হ্যাঁ মা আচ্ছা করে জিজ্ঞেস করুন এতদিন আসেনি কেন…… কতদিন ওর জন্য লতি দিয়ে চিংড়ি করলাম,ফোন দিলাম অথচ মেয়ের পাত্তা নেই। আপনি আচ্ছা করে ধরুন……আমি দেখি কিছু নাস্তার ব্যবস্থা করি। ‘

‘ আহা সুন্দরীরা রেগে যাচ্ছ কেন ? আমি কি ফ্রী মানুষ বলো ? আমার কত কাজ বলতো……তোমরা কি জানো আপাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে ? ঐযে আমাদের ভার্সিটি প্রফেসর আছেন না ফারহান ইমতিয়াজ……উনার সঙ্গে। ‘

‘ ফারহান ইমতিয়াজ ? আমাদের বাংলা ডিপার্টমেন্টের হেড নাকি অতসী ? ‘ অতসীর ফেমাস স্কুটির একটা ব্যবস্থা করে ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই যখন প্রণয়ের কানে অতসীর কথাটা গেলো তখন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো।

অতসী প্রণয়ের কথা শুনে ওর দিকে ফিরল। বললো ‘ স্যার এতক্ষণ কোথায় ছিলেন ? আমি সেই কখন আপনাকে নামিয়ে দিয়ে ভিতরে চলে এলাম…… হুম আমাদের ভার্সিটি ডিপার্টমেন্ট হেড। উনার মা আর আমার মা বান্ধবী তাই সেই সুবাদে আমাদের পরিচয় আছে। আন্টি আর মা মিলে তাই বন্ধুত্বকে আত্মীয়তায় পরিণত করতে এই ডিসিশন নিয়েছে যে আপাই আর স্যারের বিয়ে দিয়ে দিবে। ‘

অতসী আর প্রণয়ের কথাবার্তা শুনে বাড়ির সকলে এক প্রকার ধাক্কার মত খেলো। ওরা ভাবেনি এই দুয়ের মাঝে আগে দেখা সাক্ষাৎ, কথাবার্তা চালাচালি হয়েছে। তারা একেবারে হতভম্ভ ভঙ্গীতে তাকিয়ে আছে অতসী আর প্রণয়ের দিকে।

‘ তোমার হয়তো তোমার স্কুটি নিয়ে টেনশন নেই কিন্তু আমার টেনশন আছে কারণ জিনিসটা আমাদের বাড়ির সামনে পার্ক করা আর সেটা চুরি হলে আমাদের বদনাম। লোকে বলবে জালাল উদ্দিনের বাড়িতে মেহমান আসার পর মেহমান স্কুটি চুরির শিকার। ফারহান স্যার তো আমাদের সিনিয়র। উনার সঙ্গে তোমার বোনের বিয়ে হবে ভাবিনি। তোমার বোন কি করে ? ‘

‘ লোকে না জানলে বলবে কি করে ? আর আমার আপাই অনার্স ফাইনাল ইয়ারে, ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট। ‘

‘ বাহ দুজনের দুই মেরুর, একজন বাংলার আর আরেকজন ইংলিশের। গুড জব…… ‘ বলে প্রণয় আর অতসী পাশ ফিরতেই দেখলো বাড়ির সকলে ওদের দিকে হতভম্ভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যা দেখে প্রণয় অপ্রস্তুত হলো।

~ চলবে ইনশাআল্লাহ….

#প্রেমমানিশা(০৮)

হঠাৎ তারস্বরে অতসীর ফোন বেজে ওঠায় সকলের ভাবনায় ছেদ পড়ল। অতসী তার জিন্সের পকেট থেকে ফোন বের করে রিসিভ করে কানে ধরেই বললো ‘ হ্যাঁ বল… আচ্ছা আমি আসছি……তোরা দশ মিনিট অপেক্ষা কর। না না দেরী হবে না..… আমি এক্ষুনি আসছি…… ‘

কথা শেষে অতসী ফোন আবার জায়গা মত রেখে দিয়ে জালাল সাহেবের উদ্দেশ্যে বললো ‘ তাহলে দাদু এবার তো আমার যেতে হয় ? আগেই ওদের না বলে এসেছে ভুল করেছি……এখন দেরী করলে আমায় ফেলে যেতে ওদের সময় লাগবে না…… ‘

অতসীর কথা শুনে মিসেস আসমা কিছু বলতে চাইছিলেন কিন্তু জালাল সাহেব উনাকে মাঝ পথেই থামিয়ে দিয়ে বললেন ‘ আচ্ছা তাহলে তুই যা.. পরে এক সময় করে আসিস ‘

‘ তাহলে সুন্দরীরা আসছি…… আবার দেখা হবে কোনো এক শরতের সন্ধ্যায়……ঠিক পুরনো দিনের মতো। ‘ বলে আনমনে হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে গেলো অতসী। অতসী ঠিক কিছুটা তার আপাই সানারই মত। কখন কোন কথা বলতে বলতে আচমকা গম্ভীর হয়ে যায় বলা যায় না।

অতসী বেরিয়ে যেতেই মিসেস আসমা আর জালাল সাহেব আড়চোখে প্রণয়ের দিকে দৃষ্টি দিলেন। প্রণয় সেই দৃষ্টি দেখে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল ‘ তোমরা যা ভাবছো তা নয় দাদু..… ও শুধুই আমার..… ‘

‘ তোর স্টুডেন্ট তাইতো ? অতসী যে ঢাবিতে পড়ে এটা আমি জানতাম কিন্তু তুই যে ওই ভার্সিটিতেই জয়েন করেছিস এটা আমার জানা ছিল না। তবে তোদের কথোপকথন আর অতসীর বারবার তোকে স্যার স্যার বলে সম্বোধন করাতে খানিকটা আন্দাজ করতে পেরেছি। তুই আমাকে যতটা উজবুক ভাবিস আই থিঙ্ক আমি ততটাও নই..… ‘ মুচকি হেসে বললেন জালাল সাহেব।

‘ তুমি যে অতিশয় বুদ্ধিমান সেটা তোমার ইমেজিনেশনই বলে দিচ্ছে দাদু…… তবে দিদুন কি ভেবেছিল আমিও সেটা ইমেজিন করতে পেরেছি…… ‘ প্রণয় বললো।

‘ হয়েছে হয়েছে……দুই দাদু নাতিতে মিলে আমার নামে এত বদনাম না করলেই নয় ? আমি যাচ্ছি আমার রান্নাঘরে…… বৌমা চলো…… ‘ মিসেস আসমা বললেন।

মিসেস আসমা আর উনার পুত্র বধূ দুজনেই চলে গেলেন রান্নার কাজে। জালাল সাহেব উনার লাইব্রেরী ঘরে গিয়ে বসলেন আর প্রণয় তার ঘরে গেলো ফ্রেশ হতে। কিছুক্ষণ পর ফ্রেশ হয়ে এসে প্রণয়ও ঢুকলো লাইব্রেরী ঘরে।

—-

‘ শুনছো ..… ‘ মিসেস কায়নাতের করুন ডাক।

‘ হু…… ‘

‘ তুমি যে বললে সানাহ্কে আমাদের বান্দরবনের ফার্ম হাউজে পাঠাবে…… সানাহ্ যেতে রাজি হবে ? ওর না বিয়ের এক সপ্তাহ পরই ফাইনাল সেমিস্টার ? ও বেকে বসবে নাতো ? ‘ মিসেস কায়নাতের গলায় স্পষ্ট ভয়ের আভাস।

‘ ও না যেতে চাইলেও তো লাভ নেই তাইনা ? ওকে সুস্থ রাখতে হলে ওর মর্জির বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও আমাদেরকে ওর যেটাতে ভালো সেটাই করতে হবে। অ্যান্ড ওয়ান থিং আমার যা মনে হয় সানার এই অসুস্থতার কথাটা আশা আর ফারহানের থেকে আমাদের লুকিয়ে রাখাটা ঠিক হবে না। ওদের বলে দেওয়া উচিত..… ‘

মিস্টার কবিরের কথা মিসেস কায়নাতের কর্ণ কূহরে যেতেই মিসেস কায়নাত যেন এক প্রকার চমকে উঠলেন, উনার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল। শক্ত গলায় বললেন ‘ না কখনোই না……কবির তুমি যা বলছো ভেবে বলছো তো ? ওর অসুস্থতার কথা ওরা জানলে ফারহানের সঙ্গে সানার বিয়ে হতে দিবে তো ? ‘

মিস্টার কবির উনার প্রিয়তমা স্ত্রীয়ের কথা শুনে চোয়াল শক্ত করে ফেললেন। দৃঢ় গলায় বললেন ‘ বিয়ে নাহলে না হবে……আমার মেয়ের জন্য কি পাত্রের অভাব পড়েছে ? যে আমার মেয়ের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মেয়েকে বিয়ে করতে আপত্তি করবে তার সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার কোনো মানে হয় ? যেই মেয়েকে এত ভালোবেসে বড় করলাম তাকে কষ্ট পাওয়ার জন্য এমন একটা লোকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার কোনো মানেই হয় না যে আমার মেয়ের মন বোঝে না। এই কবি কেমন কবি যে মেয়েদের মনই বোঝে না ? ‘

মিসেস কায়নাত বুঝলেন স্বামী তার মেয়ের নিরাপত্তা আর জীবনের কথা ভেবে মেয়ে বিয়ে দিতে ঘাবড়ে আছেন। মিসেস কায়নাত এবার গলা নরম করে বললেন ‘ তুমি যা ভাবছো তা একেবারেই নয়…… তুমি একবারও সানার সঙ্গে কথা বলেছ ? বললে বুঝতে এই বিয়ে নিয়ে ওর মনে এক প্রকার আগ্রহ আছে, হয়তো ফারহানকে ওর পছন্দ। তুমি পারবে বাবা হয়ে মেয়ের আনন্দে ব্যাঘাত ঘটাতে ? তাছাড়া এখন লুকাচ্ছি বলে তো এই নয় যে ফারহান কখনোই ওর এই অসুস্থতার কথা জানবে না.. বিয়ের পর এক সময় না এক সময় ঠিকই জানবে। তাছাড়া এমনও তো হতে পারে বিয়ের পর মেয়ে আমাদের সুস্থ হয়ে গেলো…… ‘

স্ত্রীর কথা শুনে শান্ত হলেন মিস্টার কবির। ব্যাপারটা ভেবে দেখেননি উনি,মেয়ে উনার সত্যিই এই বিয়ের কথা চলাকালীন কোনো প্রতিবাদ করেনি। তাহলে কি মেয়েটা তার সত্যিই এই বিয়ে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে ? কিন্তু সত্যি তো এটাই বাবা হয়ে সে পারেনা তার মেয়েকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে। মেয়েটা যে তার অন্তপ্রাণ।

সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে মনোরম পরিবেশে বারান্দার বেতের সোফায় বসে আছে সানাহ্। জ্বরটা তার একটু কমেছে কিন্তু শরীরের জ্বর কমলে কি হবে, মনের জ্বর তো তার কমেনি। যেখানে মনের অসুস্থতা গুরুত্ব পায় সেখানে দেহের অসুস্থতা গুরুত্বহীন। মনটা তার প্রতি নিয়ত ভঙ্গুর হচ্ছে কাল রাতে ফারহানের বলা কথাগুলো মনে করে।

মানুষটাকে সে বেশ সমীহ করেই চলে আবার তাকে অপ্রত্যাশিত ভাবেই নিজের কাছেও পেতে চায়। মন তার বড়ই বেহায়া, সময়ে অসময়ে ফারহানকে পেতে চায়। সানাহ্ জানে ফারহানের দিক থেকে এই বিয়েতে কোনো মত নেই কিন্তু তবুও মনে ক্ষীণ একটা আশা ছিল যে নিজের মায়ের মুখের দিকে চেয়ে হলেও ফারহান নিঃশব্দে মেনে নিবে এই বিয়ে।

তবে কাল রাতে ফারহানের বলা প্রত্যেকটা কথা প্রতি মুহূর্তে সানাহ্কে বুঝিয়ে দিয়েছে ফারহানের জীবনে তার কোনো ভূমিকা নেই, শি ইজ নন-এনটিটি । কিন্তু সে তো চেয়েছিল ফারহানের প্রিয়তমা হতে। ফারহান যদি তাকে সেই অধিকার দিত তাহলে আজ এই রাত তার আর ফারহানের হতো।

মনটা মানছে না, বারবার করে বলছে এখানে তোর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে সানাহ্, পালিয়ে যা তুই দূরদূরান্তে। এরকম তার প্রায়ই হয়, যখনই সে ডিপ্রেসড হয়। কিন্তু এইবার এই চাওয়ার মাঝেও জোর আছে, আছে যুক্তি। যেখানে তার প্রয়োজন নেই,সেখানে তার থাকার কোনো মানে হয়না। সে তো বলেইছিল তার মাকে যে বিয়ের কথা বলে লাভ নেই,ফারহান মানবে না। কিন্তু মানেনি তার মা, বারবার বলেছে আশা বললে শুনবে। সানাহ্ এমন কি এও বলেছিল তাদের যেন ওর রোগটার ব্যাপারে আর তার অতীতের ব্যাপারে বলে দেয় কিন্তু ওর মা গ্রাহ্য করেনি। এই কথাটাও এড়িয়ে গেছে। সবকিছু গ্রাহ্য না করার পরিণতি আজ তাকে ভোগ করতে হচ্ছে।

‘ তোর শরীরটা এখন কেমন আছে আপাই ? ‘

আবছা অন্ধকারে জোনাকির দিকে তাকিয়ে যখন সানাহ্ তার ভাবনায় মশগুল তখন আচমকা পিছন থেকে অতসীর গলা পেয়ে চমকে উঠলো। পাশ ফিরে দেখলো বারান্দার দরজায় ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে আছে অতসী। অতসীকে দেখেই সানার মনে পড়লো তার মামনির কথা, মানুষটা এভাবেই তার ঘরের বারান্দার কাছে দাড়িয়ে থাকত। সানাহ্ দ্রুত চোখ সরিয়ে নিয়ে মৃদু স্বরে বলল ‘ ভালো ‘।

অতসী তার আপাইয়ের মৃদু গলায় বলা কথা শুনেই বুঝলো ভালো নয়,কিছুই ভালো নয়। তার আপাইয়ের সবকিছু আবারোও লন্ডভন্ড হয়ে গেছে আর তার আপাই পারছেনা সেটা নতুন করে সাজাতে। তার আপাই এমনই বাউন্ডুলে, অগোছালো মনের মানুষ।
কখন কোন পরিস্থিতিতে কিভাবে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয় তা সে জানেনা,নিজেকে সামলে নিতে জানেনা। তার আপাই অনেক কিছুই পারেনা আবার কিছু না পেরেও অনেক কিছুই পারে। খুব ভালো রান্না করতে জানে, মায়ের থেকে শিখেছে। ঘর গোছানো, গান, নাচ সবই। তানপুরার তালে তালে গান আর ঘুঙুরের সঙ্গে নাচ দুইই তার ডান হাতের কাজ তবে পারেনা শুধু নিজেকে সামলাতে। এই মানুষটা যদি জীবন সংগ্রামে নিজের পাশে ফারহান স্যারের মতো কোনো মানুষকে পায় না তাহলে এক সময় সেও নিজেকে সামলে নিতে পারবে এটা অতসীর দৃঢ় বিশ্বাস ।

–—

ঘরের এক কোণায় থাকা স্টাডি টেবিলের টেবিল ল্যাম্প জেলে ভার্সিটির কিছু কাজ করছিলো ফারহান। ইদানিং বড়ই ব্যস্ততায় যাচ্ছে তার সময়। সামনে অনার্সের পরীক্ষাও আছে তাই তারও একটা চাপ আছে, প্রশ্ন তৈরির প্রেসার। তাছাড়া হলে গার্ডও পড়তে পারে। এমনিতেই ফারহান সারা বছরই অনেকটা ব্যস্ততায় থাকে, দম ফেলবার সুযোগ তার প্রায়শই হয় না।অনার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা যেন ব্যস্ততা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে, বাড়িতেও এখন আর বেশি সময় থাকে না। সারাদিন কাটে ভার্সিটিতেই।

হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজে ফারহানের ধ্যান ভঙ্গ হলো। ঘাড় ঘুরিয়ে সদ্য আসা মানুষটাকে এক পলক দেখে আবারও কাজে মন দিল। মিসেস আশা নিঃশব্দে ফারহানের স্টাডি টেবিলের কাছে থাকা আরেকটা চেয়ার টেনে বসলেন। ব্যস্ত ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ফারহান কাজের দিকে চোখ রেখেই বললো ‘ কিছু বলবে মা ? ‘

‘ সামনের মাসেই তোদের বিয়ে..…হাতে আছে আর পঁচিশ দিন। বিয়ের পরপরই পরীক্ষা বিধায় বিয়ের আগে বিয়ে ঘটিত যেসব জিনিসের দরকার পড়বে তা নিয়ে ঝামেলা করার সময় সানার থাকবে না। তুই যদি একদিন নিজে ওকে নিয়ে গিয়ে নিউ মার্কেট থেকে ওর জন্য লেহেঙ্গা,কসমেটিকস, জুয়েলারি কিনে আনতি তাহলে ভালো হতো..… ‘

মায়ের কথায় ব্যস্ত ফারহানের যেন টনক নড়লো। চমকে উঠে বললো ‘ কেন মিস সানাহ্ তোমাকে কিছু বলেনি ? ‘

ছেলের কথায় যে বড়ই অবাক হয়েছে তা সরাসরি প্রতীয়মান হলো মিসেস আশার মুখে। বিস্ময়ে উনার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। অবাক মিশ্রিত গলায় বললেন ‘ সানাহ্ আমাকে কি বলবে ? ‘

এবার যেন ফারহান আরও খানিকটা অবাক হলো। মনে মনে বললো ‘ কি ব্যাপার মিস সানাহ্ কি আঙ্কেল আন্টিকে ব্যাপারটা বলেননি ? আঙ্কেল আন্টিকে ব্যাপারটা বললে এতক্ষণে তো উনাদের মাকে বলে দেওয়ার কথা। নাহ্ মা গেলেই মিস সানাহ্কে ফোন করতে হবে। উনার সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলা দরকার…. ‘ ।

‘ বললি নাতো সানার আমাকে কি বলার কথা বলছিলি ? ‘

মিসেস আশার কথায় ফারহানের ভাবনায় ছেদ পড়ল। মুচকি হেসে বলল ‘ আমি মিস সানাহ্কে আগেই বলেছিলাম কবে আমরা শপিংয়ে যাবো……উনি বলেওছিলেন তোমাকে বলবেন। কিন্তু আজব ব্যাপার বললেন না কেন ? ‘

ছেলের কথায় মিসেস আশা মুচকি হেসে বললেন ‘ হয়তো ভুলে গেছে……জানিস ফারহান কাল কায়নাত বলছিলো সানাহ্ মনে হয় এই বিয়ে নিয়ে অনেক খুশি, ভীষণ আগ্রহ নিয়ে তোদের বিয়ের ব্যাপারে আলোচনা করত বিয়েতে কি পড়বি, কোন রঙের পড়বি সব।। তোদের যখন বিয়ের কথা চলছিল তখনও মেয়েটা কোনো আপত্তি করেনি..…আবার যে আমাকে সরাসরি কিছু বলবে সেটাও করেনি। আমি সানাহ্কে ভালো করে চিনি……ভীষণ স্ট্রেট ফরোয়ার্ড মেয়ে। আমার মনে হয় মেয়েটা তোকে খুব ভালোবাসে..…ওকে কখনও কষ্ট দিস না। ও তোকে খুব ভালোবাসে….… ‘

মায়ের কথা শুনে স্তম্ভিত ফারহান। তার দৃষ্টি পলক হারিয়েছে। সে কিছু বলার শব্দও খুঁজে পাচ্ছে না। তার শব্দকোষ শূন্যের কোঠায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, মস্তিষ্ক খালি খালি মনে হচ্ছে। চিন্তা ভাবনা করার শক্তিও হারিয়েছে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না সানাহ্ নামক এই বিদেশিনী প্রফেসরও তাকে ভালোবাসতে পারে।

‘ জানিস ফারহান তোর বাবার সঙ্গে যখন আমার বিয়ের কথা চলছিল তখন আমি সদ্য ইন্টার পাশ করা গ্রামের মেয়ে, শহরের কিছুই চিনি না। তোর বাবা ছিলেন বিরাট ব্যবসায়ী। বিদেশ থেকে এসেছিলেন ডিগ্রি নিয়ে। পরে শশুর মশাইয়ের ব্যবসায়ের কাজে যোগ দেন।

একদিন হুট করে শশুর মশাই আর শাশুড়ি মা তোর বাবাকে নিয়ে হাজির হন আর আমার বাবাও আশ্চর্যজনকভাবে তাদের দেখে স্বানন্দে স্বাগতম জানান। আমি তো বাবার এই অদ্ভুত ব্যবহারে অবাক হয়ে গেছি। পরে জানতে পারলাম আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। এই কথা জানার পর আমি বাবার সঙ্গে অনেক রাগারাগি করেছিলাম কিন্তু বাবা আমাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাদের সামনে নিয়ে যান।
আমাকে তোর বাবার সামনে নিয়ে যেতেই উনি উঠে দাড়িয়ে বললেন আমার সঙ্গে একান্তে কথা বলতে চান।

তখনকার সময়ে এই চাওয়াটা নিছকই পাপ কারণ তখন এভাবে পাত্র পাত্রীর একান্তে কথা বলা কেউ ভালো চোখে দেখত না। কিন্তু আমার বাবা বাঁধ সাধেননি। উনি সম্মতি দেওয়ার পর তোর বাবাকে আর আমাকে একান্তে রেখে আসা হলো বারান্দায়।
সেদিন মানুষটার সঙ্গে প্রথম দেখা অথচ উনি হঠাৎ নিরবতা ভেঙে বলে উঠলেন ‘ কাঠগোলাপ তোমার খুব পছন্দ তাইনা ? ‘

বিশ্বাস কর তোর বাবার মুখে এই কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়েছিলাম। জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনি কি করে জানলেন। উনি সেই প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন উনি আমায় এখন থেকে নয় প্রায় বছর খানেক আগে থেকে চিনেন। আমি গাছ নিয়ে বহুত সৌখিন ছিলাম বলে প্রায়ই বাগানে এটা ওটা লাগাতে গ্রামের বড় নার্সারিতে যেতাম। সেখান থেকে গাছ এনে লাগাতাম। একদিন এরকমই এক দুপুরে কাঠগোলাপ খুঁজতে গেছিলাম। এই গাছটা অনেকদিন ধরেই খুঁজছিলাম কিন্তু গ্রামের কোথাও ছিল না। পরে নার্সারির হরি কাকাকে বলে আনালাম আর সেদিনই নাকি উনি আমাকে দেখেছেন।

সেদিন থেকে প্রায়ই গ্রামে আসতেন আর আমার অজান্তে আমায় ফলো করতেন। এরপর একসময় আমার বাবা মায়ের খোঁজ নিয়ে সম্বন্ধ নিয়ে এলেন। বিশ্বাস কর তোর বাবার কথা শোনার পর আমি আর বিয়েতে না করতে পারিনি কারন যেই মানুষটা আড়ালে থেকে সবসময় আমার যত্ন নিয়েছে তার থেকে ভালো মানুষ আমি আর কাউকে পাবো না। এরপর আমাদের বিয়ে ঠিক হয়,কথা পাকা হওয়ার এক মাস পরে।

জানিস মানুষটার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হওয়ার পরপরই আমার মনে তার প্রতি এক আলাদা ভালো লাগা তৈরি হয়েছিল, বলতে পারিস তাকে আস্তে আস্তে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম। সৃষ্টিকর্তা মেয়েদের এমনভাবেই সৃষ্টি করেছেন যে তারা যেকোনো সময়,যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে। বিয়ের পর ভালো মন্দ বিচার না করেই নিজেদের জীবন সঙ্গীকে ভালোবাসতে পারে। তার জন্য সৃষ্টিকর্তা মেয়েদের মনকে অনেক নরম করে তৈরি করেছেন যার কারণে বেশিরভাগ মেয়েরাই বিয়ে ঠিক হলে হবু স্বামীকে আস্তে আস্তে ভালোবাসতে শুরু করে।

সানাহ্ তোকে এখন থেকে পছন্দ করে নাকি আগে থেকেই সেটা বলতে পারবো না কারণ ওর সঙ্গে তোর পরিচয় অনেক বছরের শুধু তুইই কখনও আলাদা করে কথা বলিসনি ওর সঙ্গে। কিন্তু আমি এটা বলতে পারি সানার মনে তোর প্রতি অনুভূতি আছে আর সেটা শতাধিক নিশ্চয়তা দিতে পারি কারণ মানুষের ঠোঁট মিথ্যে বলতে পারে,চোখ নয়। তোর মনে ওর প্রতি কেমন অনুভূতি আছে জানিনা তবে এটা বলবো আর যাই হোক ওকে কষ্ট দিস না। যাক অনেক রাত হয়ে গেছে……আমি উঠে খাবার দিচ্ছি তুই নিচে আয়…. বলেই মিসেস আশা চলে গেলেন তবে ফারহানের মনে রেখে গেলেন এক জোট প্রশ্ন।

~ চলবে ইনশাআল্লাহ্…