প্রেমের ঐশ্বর্য পর্ব-৩০+৩১+৩২+৩৩

0
178

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩০

নতুন সকালের আগমন। সবে সূর্যোদয় হতে চলেছে। আস্তে আস্তে সূর্যের তীব্র রশ্মি চারিপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। পাখিরা ডানা মেলেছে নতুন আশায়। হালকা ঠান্ডা বাতাস আশপাশটাকে স্নিগ্ধ করে তুলেছে। এই মোহনীয় পরিবেশ ঐশ্বর্যের কাছে যেন একটা গুমোট মূহুর্ত। ‘ভালোবাসা’ এটি যেন একটা ম্যাজিকাল ওয়ার্ড। কে-ই বা জানতো একসময় কারো পরোয়া না করা ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস ঐশ্বর্য একটা সাধারণ মানুষের পরোয়া করবে? কে জানতো যে একটা মানুষকে ভালোবেসে তার অগ্নিকুণ্ডে গড়া এক সাম্রাজ্য পায়ের তলে পিষে দিয়ে তার পুরো পৃথিবী থমকে যাবে? জানা ছিল না। কারোরই জানা ছিল না! পরবর্তীতে কি হতে চলেছে তাও কারোর জানা নেই!

সূর্যের আলো যখনই পড়ল ঐশ্বর্যের ঘাড়ে রেলিংয়ে ভর দিয়ে ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে বসে থাকা ঐশ্বর্য চোখমুখ খিঁচে সোজা হয়ে বসলো। হাত উল্টে ঘাড়ে দিতে না দিতেই সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে নিল মৃদু আর্তনাদের সাথে। তার শরীর রোদে পুড়ছে। ভ্যাম্পায়ারদের স্কিন রীতিমতো বড্ড পাতলা হয়ে থাকে। রোদের তাপ এরা নিতে পারে না। তবে ঐশ্বর্যের ক্ষেত্রে এই সমস্যা হয়নি কখনো। হঠাৎ কেন হচ্ছে সে বুঝছে না। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায় সে। দরজার দিকে এসে দরজা খুলে দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করতে নেয়। তৎক্ষনাৎ ধাক্কা খায় সামনে থাকা এক প্রশস্ত মানবের সাথে। চোখ থেকে এখনো ঘুম যায় ঐশ্বর্যের। তাই এতো খেয়ালে আসেনি তার। নিজেকে সামলাতে না পেরে সামনের মানবটিকে জড়িয়ে ধরেছিল কিছু মূহুর্তের জন্য। উষ্ণ অনুভূতি যেন সেই মূহুর্তেই হানা দিয়েছিল। কারো হৃদয়ের স্পন্দন কানে এসেছিল। সরে এসে মাথা উঁচু করে লম্বা মানুষটার দিকে তাকালো ঐশ্বর্য। লাল চোখ, ফোলা মুখ দেখে কিছুক্ষণের জন্য স্তম্ভিত হয়ে রইল সে। এ কি অবস্থা? ঐশ্বর্য কিছুটা বিরক্তির ভঙ্গি করেই বলল,
“এভাবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে কেউ? আশ্চর্য! কমন সেন্স হারিয়েছেন নাকি?”

“রাগ কমেছে?”

গমগমে গলায় আওয়াজ। ঐশ্বর্যের ভেতরটা কেঁপে উঠল। বেডের দিকে আপনাআপনি চোখ চলে গেল তার। যেভাবে সেটা সাজানো ছিল ঠিক তেমনই সাজিয়ে রাখা আছে। কোনো নড়চড় হয়নি। এবার থতমত খেয়ে প্রেমের দিকে তাকালো। আটকা আটকা গলায় জিজ্ঞেস করল,
“আপনি ঘুমান নি?”

প্রেম স্পষ্ট জবাব দিল,
“ঘুম কেঁড়ে নিয়ে চলে গেলে ঘুমাব কি করে মিস. সরি মিসেস. ইরিটেটিং?”

“তার মানে আপনি সারারাত… ”

“এভাবেই স্টিল দাঁড়িয়ে ছিলাম।”

ঐশ্বর্যের চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে এলো। নিজের বিস্ময়ের রেশ কাটিয়ে বলল,
“আপনি কি পাগল নাকি?”

“মাঝে মাঝে অপর মানুষ যখন পাগলের সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন নিজেকে একটু পাগল হতে হয়। নয়ত অপর মানুষটাকে সামলানো যায় না।”

“সামলাতে কে বলেছে আপনাকে? আমি বলেছি? বলিনি তো। আমি জোর করে এই দায়বদ্ধতা নিয়েছেন।”

“কি আর করা যাবে বলো। সারাজীবন তাহলে পাগল হয়েই থাকতে হবে। আর সামলাতে তো কোনো বিরক্তি নেই। তাহলে বিরক্ত হচ্ছো কেন?”

ঐশ্বর্য এবার রাগে ফুঁসে ওঠে। লোকটার সাথে কথায় পারা যাচ্ছে না কেন? ঝাঁঝালো কণ্ঠে পাল্টা জবাব দিয়ে বলে,
“আপনি দিনেদিনে এমন তর্ক করছেন কেন বলুন তো? আপনার সাথে কথা বলায় বেকার। কেন কথা বলছি সেটাও বুঝছি না। আপনার সঙ্গে কথা বলাই তো উচিত না।”

প্রেম মুচকি হাসে হঠাৎ। তার হাসিতে বুক কেঁপে ওঠে ঐশ্বর্যের। প্রেম সহজে হাসেনা। পর্যন্ত সে প্রেমকে দুইবার হাসতে দেখেছে। হাসিটা কোনো কারণ ছাড়াই হৃদয় কাঁপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। গলা শুঁকিয়ে আসে ঐশ্বর্যের। অন্যদিকে তাকিয়ে বলে,
“আ…আপনি এভাবে আমার সামনে হাসবেন না তো।”

“কেন?”

“আমি কেমন জানি লাগে। হাসবেন না আপনি। অন্য যার কাছে গিয়ে পারেন তার কাছে গিয়ে হাসেন। আমার সামনে না।”

প্রেম হাসিটা আরো প্রসারিত করে।
“আমার হাসি যে যার তার সামনে আসে না মিসেস. ইরিটেটিং। ইউ নো দ্যাট। আমার হাসিতেই তুমি এভাবে শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে গেলে পরবর্তীতে কি হবে?”

“পরবর্তীতে মানে?”

ভ্রু বাঁকিয়ে প্রশ্ন করে ঐশ্বর্য। প্রেম মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়,
“কিছু না।”

ঐশ্বর্যের রাগ কমেনি একটুও। বরং আরো বাড়ছে। প্রেমের মুখের দিকে তাকালেই গত কালকের কথপোকথনগুলো কানে বাজছে। তাই দেরি না করে টাওয়াল দিয়ে হাতে একটা শাড়ি নিয়ে গটগট করে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল সে।

ওয়াশরুম থেকে যখন ঐশ্বর্য বের হয় তখনও প্রেম স্টিল চেয়ারে বসে। তাও ওয়াশরুমের দিকেই তাকিয়ে ছিল সে। বুকে হাত জড়িয়ে একনাগাড়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকতেই যখন ঐশ্বর্য বেরিয়ে এলো তখনি চোখ বড় করে বলল,
“কুঁচি করতে শিখেছো? বাবাহ! ট্যালেন্টেড গার্ল!”

ঐশ্বর্য চোখ গরম করে তাকালো এবার। তারপর শাড়ির দিকে তাকালো। প্রেমও সেদিকে লক্ষ্য করে ব্যাঙ্গ করে বলল,
“ওহ হো! কাকে দিয়েছি রানীর পাট! কুঁচিই তো করো নি। পড়ে যাবে তো? এসো কুঁচি করে দিই!”

“কোনো দরকার নেই। আমাকে দয়া করা বা সাহায্য করার আর কোনো রকম দরকার নেই আপনার। বুঝেছেন? যেচে পড়ে আমার হেল্প করতে আসবেন না।”

প্রেম নির্বিকার হয়ে বলে,
“ওহ ওকে।”

ঐশ্বর্য হেঁটে আসতে শুরু করে ড্রেসিং টেবিলের দিকে। পায়ের ছোট ছোট ধাপ ফেলছে। বড় ধাপ ফেলবে কি করে? তার জন্য তো শাড়িতে কুঁচি থাকতে হবে। হাঁটতে গিয়ে টাইলসের ওপর পা পিছলেও যাচ্ছে মাঝে মাঝে। এবার নিজের কৃতকর্মের জন্য নিজেই পস্তাচ্ছে সে। মায়ের কথায় হালকা কাজ আর মেয়েলি জামাকাপড় পড়া শিখলে মন্দ হতো না। ভালোই হতো! অন্তত সামনের মানুষটার এই গা জ্বালানো হাসি দেখতে হতো না।

ঠিক বেডের পাশ দিয়ে হাঁটতে গিয়েই ঘটল বিপত্তি। কার্পেটের সাথে পা লেগে নিজেকে সামলাতে না পেরে একেবারে ফুল সজ্জিত বেডের ওপর পড়ে গেল ঐশ্বর্য উপুড় হয়ে। ফুল দিয়ে সাজানোর বেড লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল পরমুহূর্তেই। ভাগ্য ভালো ছিল! নিচে ফ্লোরে পড়ে যায়নি সে। নয়ত এতোক্ষণে কোমড়ের কয়টা হাড় ভেঙেছে গুনতে হতো।

চোখমুখ কাঁচুমাচু করেই প্রেমের দিকে তাকালো ঐশ্বর্য। চোখে ঘুম জড়ানো প্রেম যেন পুরো দমে হাসি আটকানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। শেষ মূহুর্তে না পেরে বেশ জোরেই হেঁসে দিল সে। ঐশ্বর্য উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। প্রেম তখনি বলে উঠল,
“তোমার জন্ম কি হুটহাট ঠুকঠাক করে পড়ে যাওয়া লগ্নে?”

“আপনি হাসি থামাবেন? নাকি গিয়ে গলা টিপে দেব?”

ক্রুদ্ধ হয়ে বলে ঐশ্বর্য। প্রেম হাসি থামায়। উঠে দাঁড়িয়ে ঐশ্বর্যের নিকট এসে তার হাত খপ করে ধরে এক টানে তুলে নেয় তাকে। ঐশ্বর্য সবে শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে। এখনো আধভেজা তার অবস্থা। এমতাবস্থায় সব ফুল আর পাপড়ি একজোট হয়ে লেগে গিয়েছে কোনটা গালে, নয়ত পেটে নয়তবা হাতে। আস্তে আস্তে করে সেসব ঝাড়লো। আচানক তার উম্মুক্ত কোমড়ে ঠান্ডা স্পর্শে চোখ বড় বড় করে স্থির হয়ে দাঁড়াল ঐশ্বর্য। বুঝতে সময় লাগল না স্পর্শটা কার। হাত-পায়ের লোম ইতিমধ্যে দাঁড়িয়ে গেছে ঐশ্বর্যের। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“এটা কি ক…করছেন?”

প্রেম সেখান থেকে হাত সরিয়ে কয়েকটা ফুলের পাপড়ি ঐশ্বর্যের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“এইযে এই পাপড়ি মহাশয় আপনার উম্মুক্ত কোমড় পছন্দ করে ফেলেছিল। তাই তাদের সরিয়ে দিলাম।”

ভ্যাবাচেকা খেয়ে থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল ঐশ্বর্য। প্রেম এবার হাতে টাওয়াল নিয়ে বলল,
“আমার হাতে তো শাড়ি পড়বে না বুঝতেই পারছি। আমি শাওয়ার নিয়ে এসে মিতালিকে ডেকে দিচ্ছি। ততক্ষণ টাইম পাস করো। সাবধান! আবার ধুপধাপ করে পড়ে যেও না।”

ঐশ্বর্যের এবার ইচ্ছে করল নিজের আসল রুপে এসে প্রেমের গলা টিপেই দিতে। কিন্তু আফসোস সেটা সে কখনোই পারবে না। এ জীবনে তা সম্ভব না।

ঐশ্বর্য বসে ছিল। সারা রাত না ঘুমানোর কারণে তার চোখে ঘুম আসছে আবার। ঘুমের রেশ কাটে দরজায় টোকা পড়াতে। ঐশ্বর্য জিজ্ঞেস করে,
“কে?”

“আমি ইফান!”

ওপাশ থেকে উত্তর আসে। বেশ বিরক্ত হয় ঐশ্বর্য। এই ছেলেটাকে তার ভালো লাগে না প্রথম দিন থেকেই! তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে উত্তর দিল,
“ইয়েস। ভেতরে আসুন।”

ইফান আস্তে করে ঘরে ঢোকে। আশেপাশে তাকিয়ে বলে,
“প্রেম ভাই নেই?”

“ওয়াশরুমে গেছেন।”

“ঠিক আছে। কিছু কথা ছিল ভাইয়ের সাথে। যখন এসেছি তখন ভাবলাম আপনার সাথে কিছু কথা বলে যাই।”

ভ্রু কুঁচকায় ঐশ্বর্য। ইফান এক গাল হেঁসে বলে,
“তেমন কোনো কথা নয় জাস্ট এমনিই।”

ঐশ্বর্য উত্তর দেয় না। ওকে নিরব থাকতে দেখে ইফান প্রশ্ন করে,
“তা আপনার আর প্রেম ভাইয়ের লাভ ম্যারেজ? মানে ভালোবেসে বিয়ে? আসলে ভাইকে প্রশ্ন করলে এসব কিছুই বলে না তাই।”

“আই ডোন্ট নো! বাট এটা বলতে পারি আপনার ভাই আমাকে কখনো ভালোবাসেন নি।”

“মানে কি বলছেন। ভাইকে দেখে তো তা মনে হয় না।”

ঐশ্বর্য দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলে,
“তাতে কি? সত্যি তো এটাই। দ্যা রিয়েলিটি। উনি তো দয়া করে বিয়ে করেছেন না? এটাকে আর যাই হোক লাভ বলে না।”

ইফান কিছুটা বিস্ময়ের সাথে তাকায়। তারপর বলে,
“দয়া? কি যে বলেন। ভাইয়ের অবশ্য এই গুনটা ভালোই আছে। যে কাউকে হেল্প করতে নিজেকে উপড়ে দেয়। কিন্তু আপনার মতো মানুষকে দয়া করে বিয়ে বিষয়টা মানতে পারছি না।”

ইফানের এরূপ কথায় ফট করে মেজাজ আরো বিগড়ে যায় ঐশ্বর্যের। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“এখন তো প্রেম নেই। আপনি পরে এলে খুব ভালো হয়। সো এক্সকিউজ মি!”

“ওহ ইয়েস।”
ইফান আর কথা বাড়ায় না। বেরিয়ে যায়। ঐশ্বর্য ক্রোধে বড় বড় শ্বাস ফেলতে শুরু করে। ক্রোধ আবারও সীমাহীন ভাবে বাড়ছে ইফানের সেসব কথা শোনার পর থেকে। সারা শরীর রাগে থরথর করে কাঁপছে। হাতের নখ বড় হয়ে তীক্ষ্ণ হতেই সেটা দিয়ে বেডের চাদর খামচে ধরতেই চাদর তৎকালীন ছিঁড়ে যায়। তবুও যেন রাগ কমে না।

খাবার টেবিলে সকলে ব্রেকফাস্ট করতে বসেছে। অনুভব আর মাধুর্যও উপস্থিত সেখানে। আজ সকালেই চলে যাবে তারা। ঐশ্বর্যও মাথা নিচু করে বসে আছে। একবারও তার মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখছে না। মাধুর্য বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছে ঐশ্বর্যের সঙ্গে কথা বলতে তবে ঐশ্বর্য নিজের সিদ্ধান্তে অটল। সে মায়ের কোনো কথা শুনতে চায় না।

মিতালি খাবার পরিবেশনের পর পরই খেতে শুরু করল সকলেই। খেতে খেতে কবির সাহেব বলে উঠলেন,
“প্রেম! তোমাকে না বলে একটা কাজ করে ফেলেছি।”

প্রেম খাওয়া থামালো। মুখে খাবার রেখে বলল,
“কি বাবা?”

“আমি মালদ্বীপে যাওয়ার দুটো টিকেট কেটেছি সাথে হোটেলের রুম বুক করে ফেলেছি।”

“কিন্তু কেন?”

কবির সাহেব নিরাশ হয়ে বললেন,
“তুমি দেখছি নিজের কাজের বাহিরে অন্য কোনো কিছুই বুঝতে শিখলে না। তোমার আর ঐশ্বর্যের নতুন বিয়ে হয়েছে। তুমি কাজের মধ্যে ডুবে থাকলে কি করে চলবে। তাই আমি ব্যবস্থা করেছি তোমাদের…”

প্রেম কপাল ভাঁজ করে তাকায়। কবির সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন,
“হানিমুনের।”

এবার ঐশ্বর্যও খাওয়া থামায়। প্রেমের দিকে তাকায়। যে কারণে গিয়ে হয়েছে তার আবার হানিমুন? নিজের প্রতি নিজেকে তাচ্ছিল্য দেখাতে ইচ্ছে করছে ঐশ্বর্যের। তবে ইতিমধ্যে ঐশ্বর্যকে অবাক করে দিয়ে প্রেম বলে উঠল,
“নো প্রবলেম। আমরা যাচ্ছি মালদ্বীপে।”

চলবে…

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩১

ঐশ্বর্য বিষম খেয়ে কাশতে শুরু করে দিল সেই মূহুর্তেই। কাশতে কাশতে চোখ খিঁচে বন্ধ করে দিল। প্রেম তাড়াহুড়ো করে পানি গ্লাসে ঢেকে ঐশ্বর্যকে এগিয়ে দেওয়ার আগেই ইফান তার আগে ঐশ্বর্যের সামনে পানির গ্লাস ধরে বলল,
“টেক ইট।”

ঐশ্বর্য কাশতে কাশতে হাতে পানির গ্লাস তুলে পানিতে চুমুক দিল। তবুও কাশি থামছে না কিছুতেই। পানি পান করতে করতে কাশছে সে। অতঃপর প্রেম তার পেটে হাত দিয়ে বেশ কয়েকবার ধীরে থাবা দিয়ে বলল,
“আর ইউ ওকে?”

অবশেষে ঐশ্বর্যের কাশি থামল। পানির গ্লাস রেখে চোখ ছোট করে তাকালো প্রেমের দিকে। প্রেম ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় জানতে চাইলো ঐশ্বর্যের এমন দৃষ্টির কারণ। তবে ঐশ্বর্য কিছু বলল না শেষমেশ। ঘাড় ঘুরিয়ে সোজা করে খেতে আরম্ভ করল। মাধুর্য ওপর পাশে অস্থিরতার সাথে প্রশ্ন করল,
“তুমি ঠিক আছো ঐশ্বর্য?”

ঐশ্বর্য জবাব দিল না। নির্বিকার ভঙ্গিতে খেতে শুরু করল। তার জবাব না পেয়ে মাধুর্য নিরাশ হয়ে নিজেও খেতে শুরু করল। কবির সাহেব ফট করে বলে উঠলেন,
“ফ্লাইটটা কিন্তু কালকে সন্ধ্যা ৭ টার দিকে। সো বি রেডি।”

ঐশ্বর্য কিছু বলতে উদ্যত হলো তখনি। প্রেম বিষয়টা বুঝে ঐশ্বর্যের হাত চেপে ধরল। ঐশ্বর্য চমকে তাকালো। প্রেম মাথা নাড়িয়ে না করল তবে ঐশ্বর্য সে শোনার পাত্রী নয়। বলে বসল,
“বাট আঙ্কেল, অফিস আছে। সেটা কে সামলাবে? আমাদের কোম্পানির সাথে বিগ ডিলস হয়েছে আপনাদের কোম্পানির। সো…”

“সো হোয়াট? ঐশ্বর্য! আমি এতোটাও বুড়ো হয়ে যাইনি যে প্রেম কয়েকদিন অফিস না করলে আমি অফিস চালাতে পারব না। ইভেন ওর আগে আমিই তো অফিস সামলেছি। অফিস নিয়ে এতো চিন্তা করো না।”
ঐশ্বর্যের আর বলার কিছু রইল না। নিরব হয়ে খেতে থাকল।

মাধুর্য আর অনুভব নিজেদের বাড়িতে এসেছে। বাড়িতে পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে নিল অনুভব। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে মাধুর্যের মনমরা চেহারা দেখে কিছু একটা আন্দাজ করে তার নিকট এগিয়ে গেল অনুভব। মাধুর্য জানালার কাছে সোফার ওপর বসে জানালার ধারে হাত রেখে কিছু একটা ভাবছে। অনুভব আস্তে করে মাধুর্যের পাশে বসল। তার হাতে হাত রেখে কাঁধে নিজের থুঁতনি ঠেকিয়ে দিতেই কিছুটা চমকে উঠল মাধুর্য। তবে পরক্ষণেই আবার শান্ত হয়ে গেল।
“কি ব্যাপার? হঠাৎ করে মেয়ের শ্বশুড়বাড়ি থেকে আসার পর থেকে মিসেস. বিউটিফুলের এই অবস্থা কেন? মেয়ের জন্য মন খারাপ করছে?”

“সেই কারণটা তো আছেই। তবে আরেকটা কারণ আছে। ঐশ্বর্য সব জেনে গেছে অনুভব। ও জেনে গেছে প্রেম আমার কথায় বিয়েতে রাজি হয়েছে। আর ওর সেল্ফ রেসপেক্টে খুব বেশি আঘাত লেগেছে। ও আমার সাথে কোনো কথাই বলছে না। জানি না প্রেমের সাথে কেমন ব্যবহার করছে!”

মাধুর্যের চিন্তা ভরা কন্ঠ। অনুভব দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। আর বলে,
“আমি এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম। ঐশ্বর্যের রাগ সম্পর্কে তো তোমার ধারণা আছে মাধুর্য। আর ওর ইগো বজায় রাখতে অনেক কিছু করতে পারে।”

“আমি তো ওর ভালোর জন্যই করেছিলাম। আমরা তো কেউই আমাদের রাজ্যের শার্লি, মৌবনী আর ইলহানের পরিকল্পনা সম্পর্কে তো অবগত ছিলাম না। ভাগ্যিস একদিন ওদের পরিকল্পনা করার সময় আমি সেখানে উপস্থিত থেকে গেছিলাম। নয়ত এতোদিনে যদি বিয়ের খবরটা ওরা না পেতো তবে হয়ত ঐশ্বর্যের উপর আক্র*মণ হতোই। আর আমি এতে সিউর ছিলাম এতে ঐশ্বর্য নয় ওদেরই প্রা*ণ চলে যেতো। আর আমি একজন মা হিসেবে আমার মেয়ে আর রাণী হিসেবে আমার প্রজাদের ভালোবাসি তাই কোনোদিকেই সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে অবশেষে বিয়ের কথা মাথায় এলো। অবশ্য আমি এটাও জানতাম না ঐশ্বর্য প্রেমকে ভালোবাসে। সেদিন যখন প্রেমের ডিল ঐশ্বর্য ক্যানসেল করার পর প্রেম আমাদের বাড়ির এখানে এসে উপস্থিত হয় সেদিন সব জেনে ফেলেছিলাম ওদের অগোচরে।”

অনুভব দৃষ্টি কিছুটা কুঁচকে যায়। ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলে,
“তুমি ইলহানদের ক্ষমা করতে পারো কিন্তু এই বিশ্বাসঘাতকতার জন্য আমি ওদের ক্ষমা করতে পারব না। ওরা যাদের আশ্রয়ে এতোদিন নিরাপদে ছিল তাদেরই ক্ষ*তি করার চেষ্টা করেছে। আর এটা ভ্যাম্পায়ার রাজ্যে এটা নীতিবিরুদ্ধ।”

“কিন্তু প্রথম ভুলে ক্ষমা করাও আমাদের রাজ্যের নিয়ম। হতে পারে ঐশ্বর্য আমাদের মেয়ে। কিন্তু শার্লিরা কিন্তু নির্দিষ্ট কারণে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তবে আমি রাজ্যে যাব আজ ওদের এটা বোঝাতে যে হিং*স্রতা আর যুদ্ধ দিয়েই সবকিছু হয় না। আর আমার মেয়ের ক্ষতি করার কথা ওরা যেন দ্বিতীয় বার না ভাবে।”

অনুভব এবার আবেশে জড়িয়ে ধরে মাধুর্যকে। স্নিগ্ধতার সাথে বলে,
“এই মনমরা চেহারা এতো মাধুকরী চেহারায় একদম মানায় না। তোমাকে সেই হাসিতে মানায় যেই হাসিতে সব প্রকৃতি সাড়া দেয়।”

মাধুর্য এবার না চাইতেও হাসে। অনুভবও হেঁসে দিয়ে বলে,
“ঐশ্বর্য ইজ মাই ডটার। অ্যান্ড আই নো হার। সে কখনো তার মায়ের ওপর এতো অভিমান করে থাকতে পারবে না। ওর ক্রোধ ভয়া*নক হলেও সেটা স্বল্প সময়ের জন্য।”

বেডের এক ধারে বসে পা দুলিয়ে ল্যাপটপ ঘাঁটছিল প্রেম। অফিস যাওয়া মানা কবির সাহেবের তরফ থেকে। নিউ ম্যারিড কাপল! অফিসে গিয়ে অযথা সময় নষ্ট করার মানে হয় না। তবুও প্রেম শত হলেও কাজ ভক্ত মানুষ। কাজ ছাড়া তার দিন যায় না। তবে আজকাল কাজ একটু কমই করে। বাড়িতে একজনকে বিয়ে করেছে এনেছে! সেই রমনীকে সামলানো কি কম বড় কাজ?

“আপনি হানিমুনে যাবার জন্য রাজি কেন হলেন?”

ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে ঘাড় সোজা করে দরজার কাছে দাঁড়ানো ঐশ্বর্যের দিকে তাকায় প্রেম। পুনরায় ল্যাপটপে মনোনিবেশ করে ভরাট গলায় বলে,
“কেন ভুল কি বলেছি? নিউ ম্যারিড কাপল আমরা! ম্যারিড কাপলরা কি হানিমুনে যায় না? আমরা কি প্রথম যাচ্ছি?”

“চুপ করুন তো আপনি। কিসের নিউ ম্যারিড কাপল? অন্য ম্যারিড কাপল আর আমরা এক না!”

এবার কপালে প্রগাঢ় ভাঁজ পড়ে প্রেমের। ল্যাপটপ রেখে উঠে দাঁড়ায়। এক ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
“তো আমরা অন্যরকম ম্যারিড কাপল? সো অন্য রকম কিরকম?”

ঐশ্বর্য চুপ হয়ে যায়। মুখভঙ্গি বদলে যায়। সে রাগছে খুব! তার চুপ থাকা দেখে প্রেম বলে ওঠে,
“আই নো হোয়াট ইউ মিন! ইউ আর এ বিউটিফুল গার্ল। তোমাকে রাস্তায় নিয়ে বের হওয়া রিস্ক আছে। কে কখন ছোঁ মেরে টেনে নিয়ে যেতে পারে ঠিক নেই। এমন সুন্দরী নারী আমার ওয়াইফ। সো হলাম তো আমরা অন্যরকম হাজবেন্ড ওয়াইফ?”

ঐশ্বর্য কথা বলার ক্ষমতা হারালো এবার। এই মানুষটাকে ঠিক কি বলা উচিত ভেবে পেল না। শুধু রাগে কটমট করতে থাকল। প্রেম নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর নিরবতা ভেঙে বলল,
“কালকে সন্ধ্যায় ফ্লাইট। সেই হিসেবে নিজের জামাকাপড় লাগেজে তুলে নেবে। আর রেডি থাকবে। কাল একটু অফিসে যাব। এসে তোমায় নিয়ে যাব। গট ইট?”

“টিপিক্যাল স্বামীর মতো বিহেব করবেন না তো। আমি না কোথাও যাচ্ছি আর না কিছু লাগেজে ভরছি। আমাকে আর ফেভার করতে হবেনা আপনাকে। বুঝেছেন? আপনার যেতে হলে আপনি একা যান।”

প্রেম বেশ হতাশ এই ত্যাড়া মেয়েটাকে নিয়ে। সহজে কোনো কথা মানতেই চায় না। কিছুটা শক্ত গলায় বলে,
“যদি নিজের জামাকাপড় না প্যাক করতে চাও তাহলে ইটস ওকে। আমার জামাকাপড় দিয়েই আই থিংক তোমার হয়ে যাবে। তোমার তো অভ্যেস আছে। তাই তোমার লাগেজ প্যাক না করলেও হবে। কথায় বলে না টু ইন ওয়ান! শেয়ারিং ইজ কেয়ারিং মিস. ইরিটেটিং।”

ঐশ্বর্য হতভম্ব। উত্তরে আর কোনো শব্দ মস্তিষ্কে এলো না। এই লোকটা দিন দিন একগুঁয়ে হয়ে যাচ্ছে না? পি*টিয়ে সোজা করা উচিত! তবে সেটা সে পারবে না!

দুপুরবেলা! রান্নাঘরে রান্নার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। মিতালি মিসেস. পরিণীতাকে সাহায্য করছে। মিসেস. পরিণীতা নিজেই রান্না করতে বেশ পছন্দ করেন। অন্যের রান্না খুব একটা ভালো লাগে না উনার। মিতালিকে সাথে রাখেন সাহায্যের জন্য এই যা। এসব রান্নাবান্না দেখে রান্নাঘরে এলো ঐশ্বর্য। পা টিপে টিপে রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়াতেই মিতালি চোখ ফিরিয়ে তাকালো তার দিকে। আর বলে উঠল,
“আরে আপনি রান্নাঘরে?”

ঐশ্বর্য খানিকটা চমকে উঠল। মিসেস. পরিণীতা রান্না ছেড়ে তাকালেন। একগাল হেঁসে বললেন,
“তুমি রান্নাঘরে? সাহায্য করতে এসেছো বুঝি?”

ঐশ্বর্য কি বলবে বুঝল না। শুধুমাত্র আমতা আমতা করতে থাকল। জীবনে নিজ বাড়িতে রান্নাঘরে ঢুকেছে কিনা সন্দেহ আছে তার। রান্নাঘর নামেও যে তার বাড়িতে কিছু ছিল সেটাই মাথায় আসছে না। আজ প্রেম ঘরে রয়েছে বলে এবং তার ওপর ঐশ্বর্য চরমভাবে চটে আছে বলে ঘুরতে ঘুরতে রান্নাঘরে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু মিসেস. পরিণীতা যে একথা বলবে সেটা সে জানতো না। ঐশ্বর্য হালকা হেঁসে বলে,
“ওই আরকি!”

“আসলে এই বাড়ির সব রান্না আমিই করি। আর মিতালি হেল্প করে। তোমাকে কোনো রান্নাবান্না করতে হবে না। বাই দ্যা ওয়ে, তুমি রান্নাবান্নার কোনো কাজ জানো নাকি এমনি হেল্প করতে চলে এসেছো শুনি?”

ঐশ্বর্য অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। হালকা কেশে বলে,
“পারি একটু আধটু।”

বেশ বড়সড় মিথ্যে বলল ঐশ্বর্য। যেখানে রান্নাবান্নাতে কি কি ব্যবহার হয় সেটাই জানা নেই সেখানে রান্নাবান্না পারা কেমন যেন বিলাসিতা! তবে একেবারেই যে রান্নায় ঢেঁড়স সেটা বলতেও কেমন জানি লাগছিল ঐশ্বর্যের। মিসেস. পরিণীতা তা শুনে বললেন,
“ঠিক আছে তবে যখন হেল্প করার ইচ্ছে পোষণ করেছো হেল্প করো আমায় একটু। এই মাছটা একটু তেলে ভাজতে দাও। আমার একটা কল করার আছে আমি আসছি। তুমি ততক্ষণ এই কাজটা করো। আর মিতালি তুমি প্রেমের ঘর ক্লিন করে এসো। ও তো অপরিষ্কার জিনিস পছন্দ করে না। ঘর এলোমেলো হয়ে গেছে কালকে থেকে।”

মিতালি মাথা নাড়ায় আর মিসেস. পরিণীতার সাথে বেরিয়ে যায়। রান্নাঘরে একা পড়ে রইক ঐশ্বর্য। এখন সে কি করবে? দিশেহারা হয়ে চেয়ে তাকায় মাছের দিকে। মাছটা ঝাল লবণ দিয়ে মাখানো। এটাকে কি করতে হবে সেটা ভাবতে থাকে সে। তাকে ভাজতে বলা হয়েছে। এর মানে আগুনে একটা বসিয়ে ভাজলেই হবে। এই ভেবে সে নিজে নিজেকে বলে,
“আহা! ঐশ্বর্য কি ব্রিলিয়ান্ট! হওয়ারই কথা।”

গ্যাসের চুলোর দিকে এগিয়ে যায় ঐশ্বর্য। কাঁপা হাতে উল্টোদিকে পেঁচাতে থাকে। এর থেকে আগুন কিভাবে বের হবে সেটাই তো তার মাথায় আসছে না। এরই মাঝে পুরুষালি গলায় হকচকিয়ে উঠে তাকায় সে।
“হোয়াট ইউ আর ডুয়িং?”

প্রেম এসেছিল ফ্রিজের ঠান্ডা পানি নিতে। এসে ঐশ্বর্যকে রান্নাঘরে দেখবে তার কল্পনায় আসেনি। ঐশ্বর্য ঝাঁঝালো গলায় উত্তর দেয়,
“রান্না করছি দেখতে পাচ্ছেন না?”

প্রেম আশেপাশে তাকায়। তারপর বলে,
“যেই শাড়ি অবধি পড়তে পারে না। সালোয়ার কামিজ পড়ার অভ্যেস নেই। সে রান্না করে? এই মেয়ে, তুমি রান্না পারো?”

“হ্যাঁ মানে না। একচুয়ালি আমি তো এখানে এসেছিলাম। শ্বাশুড়ি আন্টিকে বলে ফেলেছি আমি একটুআধটু রান্না পারি তাই উনি আমাকে মাছ ভাজতে দিয়ে গেছেন।”

প্রেম দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। এসব দেখার আগে সে অন্ধ হয় না কেন। তারপর নিরাশ গলায় বলে,
“ওভাবে গ্যাস চালু করতে হয় না। ওয়েট আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।”

প্রেম চুলোর কাছে গিয়ে সেটা ঠিকদিকে প্যাঁচ দিতেই একটা শব্দ হয় আর আগুন জ্বলে ওঠে। এমন ধপ করে আগুন জ্বলে ওঠায় লাফিয়ে ওঠে ঐশ্বর্য। এমন দৃশ্য যেন প্রথমবার দেখল সে। ভয়ে লাফিয়ে প্রায় প্রেমের হাত জড়িয়ে কিছুটা জোরেই বলে উঠল,
“এই আগুন!”

চলবে…

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩২

প্রেমের হাত খামচে ঝাপটে চোখ খিঁচে দাঁড়িয়ে আছে ঐশ্বর্য। মনে হচ্ছে প্রেমের হাতটা ছিঁড়ে ফেলার ধান্দা করছে মেয়েটা। প্রেম নিজেও চমকে গেছিল ঐশ্বর্যের এমন ব্যবহারে। অতঃপর বুঝল মেয়েটা একেবারেই ঢেঁড়স। মানে রান্নাবান্না নিয়ে কোনোরূপ ধারণা তো দূর চুলো থেকে ফট করে আগুন বের হয় সেটাও সে জানে না। উচ্ছ্বসিত হয়ে প্রেম বলল,
“চুলো থেকে আগুন বের হবে না তো কি পানি বের হবে?”

ঐশ্বর্যের হুঁশশ এলো। আসলেই তো! পানি দিয়ে তো আর রান্না করা যায় না। এতোটুকু অন্তত ঐশ্বর্যের জানা আছে। তারপর তার মনে হলো সে প্রেমের হাত জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যার ওপর সে ভয়ানক রেগে আছে। সঙ্গে সঙ্গে হাত ছেড়ে ছিটকে অন্যপাশে দাঁড়ালো সে। সাহস জুগিয়ে বলল,
“উঁহুম! হঠাৎ করে আগুন দেখে ভয় পেয়ে গেছিলাম। স্বাভাবিক ব্যাপার।”

“কাল রাতে তো খুব আগুনের কাছে গিয়ে বসে ছিলে চেয়ার নিয়ে গার্ডেনে। মনে হচ্ছিল যেন চেয়ার নিয়ে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আজকে আগুন দেখে ভয় লাগছে?”

“উঁহু, হুট করে এমনভাবে শব্দ করে আগুন বেরিয়েছে। যে কারোর ভয় লাগবে। সবসময় বেশি না বুঝলে হয় না তাই না আপনার? দেখি দূরে সরুন। আমার হেল্প করতে হবেনা আপনার। আমি একা করতে নিতে পারব।”

“আর ইউ সিউর?”

ঐশ্বর্যের দিকে খানিকটা ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল প্রেম। ঐশ্বর্য চুলোর দিকে খানিকটা তাকিয়ে বলল,
“ইয়াহ, আই এম সিউর।”

প্রেম আর কোনো কথা বাড়ালো না। কিছু দূরে গিয়ে কিচের কেবিনেটের সাথে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ঐশ্বর্যের কর্মকান্ড দেখতে লাগল। ঐশ্বর্য হালকা করে আগুনের দিকে এগিয়ে গেল। এবার আর তেমন ভয় লাগছে না। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আশেপাশে কিছু একটা খুঁজতে থাকলো। হঠাৎ করে চোখ থামলো বাসনের মিটসেফে। সেখানে গিয়ে বেশ ঘাঁটাঘাঁটি করেও বুঝতে পারল না কিসে রান্না করবে সে। অবশেষে একটা কাঁচের বড় বাটি বেশ কনফিউজড হয়েই হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল চুলোর দিকে। প্রেম বড় বড় করে চেয়ে রইল সেদিকে। ঐশ্বর্য কাঁচের বাটিটাই চুলোতে বসাতে গেল। প্রেম ধড়ফড় করে এগিয়ে বাটিটা ঐশ্বর্যের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বলল,
“ওহ মাই গুডনেস! কাঁচের বাটিতে কেউ রান্না করে? চুলোয় বসানোর সাথে সাথে বাটি ফেটে ভেঙে যাবে।”

ঐশ্বর্য ভ্যাবাচেকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তবে প্রেমকে বুঝতে দেওয়া যাবে না সে একেবারেই অকর্মন্ন। হালকা কেশে কন্ঠে গম্ভীরতা এনে বলল,
“জানি জানি। আমি এটা জানি। আমি তো জাস্ট আপনাকে চেক করছিলাম। যে আপনি এসব জানেন কিনা!”

প্রেম এবার পুরো হতভম্ব! মেয়েটা ভাঙবে তবুও মচকাবে না। কাঁচের বাটি নির্ধারিত জায়গায় রেখে একটা কড়াই এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এটাতে রান্না করে।”

ঐশ্বর্য কিছু না বলে সেটা ছোঁ মেরে নিয়ে চুলোয় বসালো। তারপর ঝাল লবণ দিয়ে মাখানো মাছের বাটি হাতে নিল। একবার কড়াই একবার মাছের দিকে তাকিয়ে মাছের এক অংশ হাতে নিয়ে সেটা কড়াইয়ে ছাড়তে যেতেই প্রেম তার হাত খপ করে ধরে ফেলল।
“মিস. ঢেঁড়স, আপনি যে রান্নার ব্যাপারে কতটুকু জানেন সেটা বুঝতেই পারছি। কড়াইয়ে আগে তেল দিতে হয়। তারপর সেটা গরম হলে মাছ দিয়ে ভাজতে হয়।”

ঐশ্বর্য মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেল। ফোঁস করে বলে উঠল,
“জানি আমি। আপনি আমাকে মিস. ঢেঁড়স বললেন কেন?”

“মিসেস. ঢেঁড়স বললে মি. ঢেঁড়স আমি হয়ে যাব। অ্যান্ড আমি ঢেঁড়স নই। একটুআধটু হলেও রান্নাবান্না জানি। বিদেশে থেকেছি। তাই রান্না টুকিটাকি শিখতে হয়েছে। আর আপনি কতটা জানেন সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি।”

মুখ টিপে হেঁসে জবাব দিল প্রেম। ঐশ্বর্য আর কিছু বলল না। অপমানে মুখশ্রী লাল বর্ণ ধারণ করল। প্রেম তেল কড়াইয়ে দিল। তারপর বলল,
“এখন মাছগুলো কড়াইয়ে দিতে পারো।”

ঐশ্বর্য জবাব না দিয়ে মুখ ফুলিয়ে মাছের একটা অংশ তুলে তেলে ছেড়ে দিতেই তেল ছিটকে পড়তে লাগল। যেটা সাধারণত হয়ে থাকে। ঐশ্বর্যের প্রাণ ভয়ে শুঁকিয়ে এলো। লাফিয়ে গিয়ে মাথা লাগিয়ে দিল প্রেমের বুকে। একহাত দিয়ে প্রেমের গেঞ্জি খামচে দিয়ে মৃদু চিৎকার দিয়ে বলে উঠল,
“এটা কি হচ্ছে!”

“কিছু ভাজতে গেলে এমন হয়ে থাকে। কোনোদিন তো রান্না ঘরের ছায়া পর্যন্ত দেখোনি। কিভাবে জানবে এসব!”

ঐশ্বর্য এবার একচোখ খুলে তেলে দেওয়া মাছের দিকে তাকালো। বিষয়টা তো বড়ই ঝামেলার। তখনি কেউ চিৎকার দিয়ে উঠতেই ঐশ্বর্য আর প্রেম দুজন দুইদিকে ছিটকে গিয়ে দাঁড়াল।
“হায় হায়! বিশ্বাস করো আমি কিছু দেখি নাই। রান্নাঘরে রান্নার বদলে এগুলা চলতেছে জানলে আসতাম না। আমি আর আসব না।”

এই বলে রান্নাঘরের দরজা থেকে দৌড় দিল মিতালি। ঐশ্বর্য আর প্রেম দুজন দুজনের দিকে তাকালো। ঐশ্বর্যের চোখ গেল প্রেমের সাদা গেঞ্জির দিকে। যেটা সে নিজের ঝাল লবণ দিয়ে মাখানো হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল। বর্তমানে তার গেঞ্জি হলুদ হলুদ বর্ণে পরিণত হয়েছে। ঐশ্বর্যের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। তবে কিছু বলল না। প্রেম সেখান থেকে বেরিয়ে গেল তৎক্ষনাৎ।

রাত হয়েছে। অর্ধ থালার মতো চাঁদ আকাশে জ্বলজ্বল করছে। মিটমিট করছে অসংখ্য তারা। জানালা দিয়ে প্রবেশ করছে শীতল হাওয়া। হাওয়ায় উড়ছে পর্দা। ঠান্ডায় এসি অফ করা। এসির ঠান্ডা ঐশ্বর্য সহ্যও করতে পারে না। সবেমাত্র খেয়েদেয়ে নিজের ঘরে ঢুকলো প্রেম। ঘুম পেয়েছে বেশ। বিছানায় শুয়ে বেশ ভালোমতো ঘুম দেওয়ার পরিকল্পনা তার। হাই তুলে বেডের দিয়ে এগিয়ে যেতেই চক্ষু চড়কগাছ তার। জোর গলায় বলে ওঠে,
“এই মেয়ে কি করছো এটা?”

ঐশ্বর্য দড়ি দিয়ে পর্দা বাঁধছিল। প্রেমের কন্ঠ শুনে পিছু ফিরে তাকালো। সমস্যা হচ্ছে পর্দাটা ঐশ্বর্য বেডের একদম মাঝ বরাবর পর্দা টানিয়ে দিচ্ছে। ঐশ্বর্য অকপটে উত্তর দেয়,
“দেখছেন না? পর্দা দিয়ে দিচ্ছি বেডের মাঝখানে?”

“দেখছি। বাট বেডের মাঝে কে পর্দা দেয়?”

“আসলে কি বলুন তো আমার কোনো ইচ্ছেই নেই যেই লোক আমার সাথে বাধ্য হয়ে একই ছাঁদের নিচে আছে সেই লোকের সাথে এভাবে ঘুমাতে তাই এই কাজ। আমাদের মাঝে পর্দা থাকবে।”

প্রেম এবার হতাশ চোখে তাকায়। মেয়েটার রাগ এখনো কমেনি। বিন্দুমাত্র কমেনি। এভাবে আর রেগে থাকবে কতক্ষণ! প্রেম এগিয়ে বেডের কাছে এলো। ঐশ্বর্য বেডের ওপর দাঁড়িয়ে চাদর টানিয়ে দিচ্ছে। প্রেম গাম্ভীর্যের সাথে বলল,
“ওখান থেকে নামো।”

“চাদর লাগিয়ে দেই আগে তারপর।”

“আমি বলছি নামো।”

ঐশ্বর্য শুনে শোনে না। চুপচাপ নিজের কাজ করতে থাকে। বিরক্ত হয়ে ঐশ্বর্য এক হাত ধরে নেয় প্রেম। হাত টেনে বলে,
“কত সুন্দর প্রথমদিন বুকে চোরের মতো ঘুমিয়েছিলে তখন তো চাদর টানিয়ে ঘুমোনোর কথা মনে পড়েনি!”

“তখন তো জানতাম না আপনার এইসব কথা। জানলে আপনার ছায়াও মারতাম না। হাতটা ছাড়ুন।”

প্রেম হাতটা ছাড়ে না। দুজনের এমতাবস্থায় হঠাৎ করে নিজেকে সামলাতে না পেরে চাদর নিয়েই বেডে পড়ে যায় ঐশ্বর্য। প্রেমও তা সামলাতে পারে না। সেও ধপ করে আধশোয়া হয়ে পড়ে এমন কর্মকান্ডে। দুজনেই হতভম্ব! চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে থাকে দুজনের দিকে। প্রেমের মুখের ওপর পর্দা পড়ে আছে। ঐশ্বর্য পর্দার ওইপারে তাকিয়ে দেখছে পর্দায় আবৃত প্রেমের আবছা মুখ। ঐশ্বর্য নিজেকে সামলে ওঠার চেষ্টা করল। সাথে সাথে প্রেম চেপে ধরল তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। ঐশ্বর্য ঢক গিলল। চিকন সুরে বলল,
“আমার প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুমাব।”

“তো ঘুমাও।”

“ঘুমানোর জন্য শুয়ে পড়তে হবে। আর আপনি আমাকে ধরে রেখেছেন।”

প্রেম নির্বিকার কন্ঠে বলল,
“প্রথমদিন তুমি আমাকে ধরে ঘুমিয়েছিলে। আর আজ আমি তোমায় ধরে ঘুমাব। ইটস রিভেঞ্জ সুইট গার্ল!”

ঐশ্বর্য তিক্ত মেজাজ নিয়ে বলল,
“আপনি না ছাড়লে আর পর্দা না লাগাতে দিলে গতকালকের মতো আমি আবারও বাহিরে গিয়ে রাত কাটাবো। বলে রাখলাম।”

প্রেম একগাল হেঁসে বলে,
“তোমাকে না ছাড়লে তুমি যাবে কিভাবে? আর তুমি ভুলে যাচ্ছো তুমি পর্দা টানিয়ে রাখার কথা বলোনি। একটু আগে তুমি বলেছিলে আমাদের মাঝে পর্দা থাকবে। টানিয়ে রাখবে নাকি ঝুলিয়ে রাখবে এ কথা একদম বলো নি। লুক! আমাদের মাঝখানেই পর্দা আছে। সো গুড নাইট।”

“দেখুন আপনি… আপনি কিন্তু…!”
কোনো শব্দ আর মুখে আসেনা ঐশ্বর্যের। প্রেম চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। ঐশ্বর্য বেশ কিছুক্ষণ ছটফট করে। এই মূহুর্তে ইচ্ছে করছে সামনে থাকা শক্তিশালী পুরুষটিকে নিজের আসল রুপে এসে বড় নখ দিয়ে একেবারে চেহারা পরিবর্তন করে দিতে। কিন্তু বড়ই আফসোস। এটা অসম্ভব! একেবারেই অসম্ভব!

বেশ ক্লান্ত হয় ঐশ্বর্য। চোখ লেগে আসে তার। পর্দার এপাশ দিয়ে ঘুম ঘুম বেশে তার মাথা ঢুলে পড়ে প্রেমের বুকে। চোখ লেগে আসে তার। প্রেমের বুকে ঢলে পড়ে ঐশ্বর্য। তাদের দূরত্ব সামান্য একটা পাতলা চাদরের। তবুও যেন এই পাতলা আবরণ তাদের আলাদা করতে অসফল!

চলবে….

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৩

পরেরদিন সকালের ব্রেকফাস্ট বানানোর তোড়জোড় চলছে। সকালে খুব হেলদি খাবার না বানানো হলেও স্যান্ডউইচ, ডিম, ফ্রুট স্যালাদ আর জুস হয়েই থাকে। কিন্তু সমস্যা সেখানে না। ঐশ্বর্য রান্নাঘরের চুলার সামনে দাঁড়িয়ে হাত কচলাচ্ছে। এদিকওদিক তাকিয়ে দেখে মিতালি নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। তার এমন উদ্ভট দৃষ্টি দেখে ঐশ্বর্য আমতা আমতা করে বলল,
“কি হয়েছে? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমাকে দেখতে কি ভূতের মতো লাগছে?”

“আসলে না বউমণি, ম্যাডাম অমলেটের কথা বলেছিল সেই জিনিসটা আপনি নিজের দায়িত্বে নিলেন। কিন্তু ম্যাডাম চলে যাবার পর থেকে আপনি ১০ মিনিট ধরে চুলার সামনে দাঁড়িয়েই আছেন। কিন্তু একটা অমলেট ভাজতে পারলেন না। তাই দেখছিলাম। আমি ভেজে দেব কি?”

ঐশ্বর্য কিছু না ভেবেই জোর গলায় বলে উঠল,
“একদম না। আমি তো এমনিই দাঁড়িয়ে ছিলাম। তুমি যাও ওইদিকে ব্রেকফাস্ট যেসব তৈরি হয়েছে নিয়ে যাও আর টেবিলে সাজাও আমি তৈরি করে নিয়ে যাচ্ছি।”

“কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করব? আপনি সত্যি রান্না পারেন তো?”

মিতালির কথাটা বলার সাথে সাথে চোখ গরম করে তাকালো ঐশ্বর্য। সঙ্গে সঙ্গে ঢক গিলে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল মিতালি। হাফ ছেড়ে চুলোর দিকে তাকালো ঐশ্বর্য। সব তো মিতালিই করছিল! তবে কেন যে শুধু শুধু সে রান্নাঘরে আসতে যায়! তার ঠিক নেই। কাঁপা কাঁপা হাতে চুলো ধরিয়ে নিজেই কেঁপে উঠল ঐশ্বর্য। অতঃপর নিজেকে সামলে নিয়ে একটা কড়াই এনে বসালো। তারপর কালকের মতো তেল দিয়ে নিল।

এরপর দিশেহারা হয়ে পড়ল ঐশ্বর্য। কি করতে হবে এখন তা তো কিছুই জানে না। তবুও আন্দাজ করে একটা ডিম হাতে নিল সে। এটা এখন কি করে ভেতর থেকে অংশগুলো বের করবে সেটা নিয়ে ভাবতে থাকল সে। তখনই কারো কন্ঠস্বর পেয়ে বেশ খানিকটা চমকালো। কন্ঠস্বর পরিচিত। তবে প্রেমের নয়। অন্যকারো সেই কন্ঠ। ভ্রু কুঁচকে পিছু ফিরে তাকায় সে।
“বাড়ির বউ রান্নায় মন দিয়েছে? ইন্টারেস্টিং!”

ইফান ফ্রিজ খুলতে খুলতে উদ্ভট হেঁসে কথাগুলো বলল। ঐশ্বর্যও কঠোরতা বজায় রেখে জবাব দিল,
“বাড়ির বউ বলে কথা! আপনি যদি হতেন আপনিও নিশ্চয় একই কাজ করতেন।”

“অভিয়েসলি নট। আপনার মতো এতো পাওয়ারফুল মানুষ হলে আমি অবশ্যই একাজ করতাম না। হ্যাঁ করতাম যদি সেটা সাধারণ বিয়ে হতো। দয়ার বিয়েতে এসব করা সাজে বলে মনে করি না। তাও আবার আপনার মতো একজন যে অন্যকে দয়া করে। দয়া নেয় না।”

ঐশ্বর্যের ভ্রু জোড়া আরো কুঁচকে গেল। স্মরণে এলো কথাগুলো কিন্তু ভুল নয়। আসলেই সঠিক। ঐশ্বর্য সিনহা! যে নিজের মতো বেঁচেছে আর নিজের পথ নিজে ঠিক করে নিয়েছে। সেখানে প্রেমের মতো একজন পুরুষের পদার্পণ তার এই ধোঁয়াশাময় জীবনে হয়েছিল ঠিকই। তবে মানুষটা তাকে দোটানায় ফেলে দিয়ে নিজে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করছে। প্রিয় মানুষটির দয়ার চেয়ে বোধহয় বিষাক্ত কিছু আর হতে পারে না। ইফান ফ্রিজ থেকে খুঁজে খুঁজে অ্যাপেল বের করে বেসিনে ধুয়ে তাতে কামড় বসিয়ে খেতে লাগল আর ঐশ্বর্যের মুখভঙ্গি দেখতে লাগল। মেয়েটা অসম্ভব রূপবতী। আগুনের সামান্য আঁচে যেন রক্তিমা হয়ে উঠেছে সে। বেগুনির সাথে সাদা পাড়ের শাড়িটা তার মাধুকরী রূপ শিরায় শিরায় ফুটে উঠেছে। ঐশ্বর্যের মৃদু কাঁপুনি আর চেহারায় রক্তিম বর্ণের গাঢ়তম হতে দেখে বুঝতে বাকি রইল না সে ক্রুদ্ধ হয়েছে। নিজেকে ক্রমাগত সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। ইফান আর কিছু বলল না। অ্যাপেল খুঁজতে এসেছিল। সেটা নিয়েই স্থান ত্যাগ করল সে। ঐশ্বর্য একা একা দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। আনমনে বেশ স্বাভাবিক কন্ঠে ঐশ্বর্য বলার চেষ্টা করল,
“বিয়েটা বিয়েই। আমি এখন না এর থেকে বের হতে পারব! আর না এই সম্পর্ক আমি ভাঙতে পারব। কারণ আমিও ভালোবেসেছিলাম। #প্রেমের_ঐশ্বর্য হতে চেয়েছিলাম। কোথাও একটা সেই মানুষটার ব্যক্তিগত হতে গিয়ে বেশ লোভী হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু এই বিষাক্ত ‘দয়া’ নামক শব্দটির কি হবে? যতবার চাই ভুলে যেতে ততবারই কেন সেই কথাই স্মরণে আসে? পরিত্রাণ চাই আমার!”

বেশ কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থেকে নিজের কাজে মন দিল ঐশ্বর্য। হাতে থাকা ডিম নিয়ে ভাবতে ভাবতে ফট করে ফাটাতে গেল সেটা। হঠাৎ করেই ডিমটা ফেটে একেবারে নিচে সব অংশ পড়ে যা তা অবস্থা করে ফেলল সে। চোখ কপালে তুলে কাঁদো কাঁদো হয়ে হাতে টিস্যু নিয়ে মুছতে লাগল। অতঃপর আবার চেষ্টা করল। পর পর ৩ বার পর অবশেষে কড়াইয়ে অমলেট রান্না শেষ হলো তার। চোখেমুখে ভীষণ ঘাম! যেন যুদ্ধ করেছে!

বিকেল তখন সাড়ে পাঁচটা। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে ঐশ্বর্য। গভীর ঘুমের মাঝে হঠাৎ কেঁপে উঠে পা ঝটকা মেরে সরিয়ে নিল সে। ঘুমন্ত অবস্থায় তার কপালে পড়ল দৃঢ় ভাঁজ। তার পায়ে কিছু একটা ঠেকছে। যা বড্ড সুড়সুড়ি দিচ্ছে। আবারও বিষয়টা অনুভূতি করায় হুড়মুড়িয়ে সদ্য ঘুম থেকে উঠে বসল সে। চোখ থেকে এখনো অবধি ঘুম যায়। অস্পষ্ট চারিদিকে। সর্বপ্রথম চোখ রাখল পায়ের কাছে। অস্পষ্ট হলেও চিনতে খুব একটা দেরি হলো না। গায়ে সাদা শার্টে ইন করা ফর্মাল লুক দেওয়া লোকটাকে দেখে কোনোমতেই বোঝা যাবেনা লোকটা দিনকে দিন ফাজিলের গোডাউন হয়ে চলেছে। চোখ কচলাতে কচলাতে ঝাঁঝালো গলায় বলল,
“কি সমস্যা আপনার? ঘুমাতে দেবেন না নাকি? লাইফটা দুর্বিষহ করে তুলছেন কেন?”

প্রেম এবার ঐশ্বর্যের পা ধরে নিজের এক হাত দিয়ে আবারও যত্ন সহকারে একই কাজ করায় লাফিয়ে ওঠে ঐশ্বর্য। পা ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিতে চায়। তবে প্রেম ছাড়ার পাত্র নয়। ভার কন্ঠে বলে,
“তোমার কি সমস্যা? আজকে আমাদের মালদ্বীপে যাওয়ার ফ্লাইট আছে তুমি ভুলে নিশ্চয় যাওনি। ভুলে যাওয়ার কথা নয় আমি জানি। আমি বলেছিলাম তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে। বাট তোমার তো জন্মগত স্বভাব আমি যা বলব ঠিক তার বিপরীত কাজ করা।”

“আমি যাব না আপনার সাথে। শুধুমাত্র এই কথা বলার জন্য আমার ঘুম ভাঙিয়েছেন? পা ছাড়ুন নয়ত খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিচ্ছি।”

অকপটে বলে ঐশ্বর্য। প্রেম তবুও ছাড়েনা। প্রেম আগের মতোই বলে ওঠে,
“উঠে পড়ো আর লাগেজে যা যা লাগবে সেসব তুলে নাও। পরে তোমারই প্রবলেম হবে।”

ঐশ্বর্যের রাগ ওঠে। রাগ চোখের রঙ পাল্টাতে থাকে। নীল রঙ ধূসর বর্ণে ভরে ওঠে। সেই চোখে কোনো অনুভূতি নেই। খুব জোরে চিল্লিয়ে উঠে বলে ওঠে,
“কি ভাবেন নিজেকে আপনি? খুব দয়ালু মানুষ? যাকে ইচ্ছে দয়া করবেন? ঐশ্বর্য সিনহা কারো দয়া নিয়ে চলে না। আপনার ধারণাও নেই আমি ঠিক কি কি করতে পারি! আমাকে রাগাবেন না। এর ফল আপনি ভুগবেন। আর হ্যাঁ আমি আপনার সাথে কোথাও যাব না। গেলে একটা জায়গায় যাব। সেটা হচ্ছে একান্ত আমার জায়গা, আমার রাজ্য। যেখানে না থাকবেন আপনি আর না থাকবে আপনার এই সো কলড দয়া।”

নিজের পা সর্বশক্তি দিয়ে ছাড়িয়ে নিজেকে ব্ল্যাঙ্কেট দিয়ে মুড়িয়ে শুয়ে পড়ে ঐশ্বর্য চোখ বন্ধ করে। প্রেম হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তাকে কিছু বলার সুযোগ দিল না? এমন ব্যবহার হঠাৎ কেন? কি হয়েছে আবার ঐশ্বর্যের?

বেশ কিছুক্ষণ পর আবারও যখন ঐশ্বর্যের হালকা ঘুম পেয়েছে তখনই তার পিঠে কারো ছোঁয়া লাগতেই ঘুম হারিয়ে চোখ মেলে তাকায় সে। এবার আগের চেয়ে বেশি বিরক্ত হয় সে। যখন নিজেকে শূন্যে অনুভব করে তখন চোখ বড় করে তাকাতেই যা ঘুম ছিল তাও যেন কর্পূরের মতো উড়ে যায়। তার চোখে সামনে একটু উপরে প্রেমের থুঁতনি দেখে। থুঁতনিও রয়েছে ছোট ছোট দাঁড়ি আবৃত। বেশ অদ্ভুত সুন্দর যা! তারপর তার খেয়াল হলো তাকে কোলে করে বাড়ির সদর দরজা পর্যন্ত আনা হয়েছে। নিচে নামার জন্য ছটফটিয়ে গেল ঐশ্বর্য। প্রেমের মুখে না আছে বিরক্তি আর না আছে কোনো শব্দ! সামনে পড়ল মিতালি। প্রেম শুধু তার উদ্দেশ্যে বলল,
“মিতালি, মা হয়ত নিজের ঘরে আছে। আমি বেরিয়ে যাচ্ছি। ফ্লাইট আছে।”

মিতালি হা হয়ে তাকিয়ে থাকে প্রেম আর কোলে থাকা ঐশ্বর্যের দিকে। হালকা কেশে জবাব দেয়,
“কিন্তু তার তো দেরি আছে।”

“আমি এখনি বের হচ্ছি।”

আর কোনো প্রকার কথা না বলে সোজা গার্ডেনে গাড়ির কাছে এসে খোলা দরজা দিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দেয় ঐশ্বর্যকে প্রেম। ঐশ্বর্য কিছু বলতে উদ্যত হওয়ার আগেই প্রেম এবার তাকে ঝাড়ি দিয়ে বলে উঠল,
“শাট আপ! জাস্ট শাট আপ। আর যদি একটা কথাও বলেছো ঠাস করে চড় মেরে দেব। তখন তুমি চিল্লিয়ে কথা বলেছো আমি কিছু বলিনি। বাট ইটস মাই টার্ন। অ্যান্ড ইউ হ্যাভ টু শাট ইউর মাউথ!”

“আমি আপনাকে আগেও বলেছি এখনো বলছি আমি যাব না আপনার সাথে। আপনি কিসের জোরে আমার সাথে এমন করতে পারেন?”

প্রেম উত্তর না দিয়ে আগে গাড়িতে বসে। গাড়ির ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দেয়। ঐশ্বর্য দ্রুত গাড়ি থেকে নামতে চাইলেও তার হাত টেনে ধরে প্রেম। আর দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
“আর একবার যদি এমন ছটফট করেছো তবে আমি তোমায় ছেড়ে দিয়ে রোজের কাছে যাব। তাও এখনি।”

ঐশ্বর্য থমকায়। তার ছটফটানি কমে। কন্ঠের ঝাঁঝালো ভাবটা কমে। শান্ত সুরে বলে,
“রোজ কেন?”

“তোমাকে ঘুরতে নিয়ে যেতে চাইছি তুমি তো যেতে চাইছো না। এখন রোজকে গিয়ে একই প্রস্তাব দিলে সে তখনি রাজি হবে আমার সাথে ঘুরতে দেওয়ার জন্য আমি গ্যারান্টি দিতে পারি। দেখবে?”

“না থাক!”

প্রেম হালকা হেঁসে বলে,
“দেন ইউ আর রেডি টু গো উইথ মি?”

ঐশ্বর্য জবাব দেয় না। শুধু হালকা করে মাথা নাড়ায়। প্রেম নিজের হাসি প্রসারিত করে ঐশ্বর্যের গাল টেনে দিয়ে বলে,
“মাই সুইট ওয়াইফ!”

চলবে…