প্রেমের ঐশ্বর্য পর্ব-২৬+২৭+২৮+২৯

0
200

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৬

কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে বসে আছে ইফান। মাঝে মাঝে নাক টানছে সে। সামনের টেবিলে টিস্যুর বক্স। টেবিলের বিপরীত পাশের চেয়ারে কপালে হাত দিয়ে বসে আছে জুবায়ের। মাঝে মাঝে ঘুমের জন্য হাই তুলছে সে। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,
“তোর নাটক কমপ্লিট? তাহলে ঘুমাতে যাই?”

“এটা প্রেম ভাই কিভাবে করতে পারল বল? ক্যান ইউ ইমাজিন? প্রেম ভাইয়ের মতো একটা মানুষ হুট করে সবাইকে চমকে দিয়ে বিয়ে করে ফেলবে? তাও আর কাউকে পেলো না আমার ক্রাশকেই! প্রেম ভাই এতো নিষ্ঠুর কি করে হতে পারলো?”

গত আধঘন্টা ধরে শুধুমাত্র ইফানের এমনসব নাটকীয় কথাবার্তা শুনে চলেছে জুবায়ের। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু না ইফান নিজে ঘুমাচ্ছে আর না জুবায়েরকে ঘুমোতে দিচ্ছে। যদিও বিষয়টাতে জুবায়ের নিজেও হতবাক! কেননা, প্রেম যে কাউকে স্বইচ্ছায় ভালোবেসে বিয়ে টিয়ে করে ফেলতে পারে এ ধারণার বাহিরে। কেউ ভাবতেই পারবে না। কারণ প্রেমের কস্মিনকালেও কোনো মেয়ের প্রতি ইন্টারেস্ট ছিল না। শুধু সবসময় নিজের পড়াশোনা আর পড়াশোনা শেষে বাবার অফিস সামলেছে। এতটুকুতে সীমাবদ্ধ যার জীবন সেও যে প্রেমে পড়তে পারে সেটাতে সকলেই হতভম্ব! ভাবনা থেকে জুবায়ের বেরিয়ে এসে বলল,
“এমনিতেও ওই মেয়ে তোকে সাত জন্ম সাধনা করলেও পাত্তা দিতো না।”

“আমি কি দেখতে এতোই খারাপ?”

গলা খাঁকারি দিয়ে বলল ইফান। জুবায়ের সহজ গলায় বলল,
“না তুই অত্যন্ত বেশি হ্যাংলা। আর যে কান্নাকাটি জুড়েছিস সেটা জমছে না। চোখে পানি নেই একদম। কাঁদতে হলে কাঁদার মতো কাঁদবি। এই নে পানির বোতল। দরকার হলে চোখে পানি দিয়ে কাঁদতে থাক। তাও যদি পাত্তা পাস। আমি ঘুমাব। তোর এমন আধম*রা নাটক দেখে নিজের ঘুম নষ্ট করার মোটেও কোনো ইচ্ছে নেই।”

এই কথা বলেই ইফানের হাতে পানির বোতল ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল জুবায়ের। ইফান বসে রইল একা একা।

সকাল হতে না হতে বিয়ের আয়োজন শুরু হয়েছে। আজ প্রেম আর ঐশ্বর্যের রেজিস্ট্রি হবে। আবারও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে। তাই চারিদিকে এতো আয়োজন। খুব বড় করে নয়। ছোটখাটো করেই সেড়ে নেওয়া হবে অনুষ্ঠান। অনুভব আর মাধুর্য আসবে আজ। সাথে আসবে তাদের কিছু চেনা পরিচিত লোকজন। বাড়ি হালকা করে সাজানো হচ্ছে। মিসেস. পরিণীতা এদিক ওদিক সামলাচ্ছেন। ব্যস্ততার মাঝে উনি মিতালিকে ডেকে বললেন,
“ওপরে গিয়ে দেখে এসো প্রেম আর ঐশ্বর্যের ঘুম এখনো ভাঙেনি? সকালের খাবার খেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে আর একটু পরেই হয়ত মি. আর মিসেস. সিনহা আসবেন। ঐশ্বর্যকে তৈরিও হতে হবে। আরো কিছু জুয়েলারি আছে। সেসব ওকে দিয়ে আসতে হবে। তুমি উপরে গিয়ে দেখো।”
মিতালি মাথা নাড়িয়ে উপরে উঠে যায় প্রেমের ঘরের উদ্দেশ্যে।

সবেমাত্র শাওয়ার নিয়ে বাহিরে বেরিয়েছে ঐশ্বর্য। আধ পড়া হলুদ রঙের একটা শাড়ি পড়ে বেরিয়েছে সে। বাকি কুঁচিটা তার দ্বারা হচ্ছেই না। শত চেষ্টা করার পরেও পারছে না। রেগেমেগে চোখমুখ লাল করে ঘেমে একাকার হয়ে বেরিয়ে এসেছে সে। তার ধারণামতে প্রেম এখনো ঘুমে মগ্ন। নির্বিঘ্নে শাড়ির কুঁচি ইচ্ছেমতো খোলামেলা করে ঠিক করা যাবে। শাড়ির দিকেই মনোযোগ দিয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল সে। বিরক্তির ‘চ’ এর ন্যায় শব্দ করে পুনরায় শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে লাগল। ফলাফল শূন্য। এই মূহুর্তে তার রাগে চিৎকার করতে মন চাইছে। ক্রুদ্ধ হয়ে শাড়ির কুঁচি ফেলে দিতেই আঁচল থেকে শুরু করে সব খুলে গেল তার। কোমড়ে হাত দিয়ে হতাশ চোখে আয়নার দিকে চাইতেই সে দেখতে পেলো জাগ্রত প্রেমকে। লোকটা হতভম্ব নয়নে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। ঐশ্বর্য বড় কপালে তুলে তাকালো। তারপর নিজের দিকে তাকালো। লজ্জায় মাথা ঘুরে যাবার উপক্রম তার। গলা শুঁকিয়ে এলো তার। গালে দেখা গেল হালকা গোলাপি বর্ণ। তড়িঘড়ি করতে লাগল শাড়ি ঠিক করতে। লাভ হলো না প্রেম যা দেখার দেখেই ফেলেছে। ঐশ্বর্যের দৃঢ় বাসনা জাগলো এই মূহুর্তে মাথা ঠুকে গিয়ে কিছুক্ষণ অজ্ঞান থাকার। তা আর পূরণ হলো না।

প্রেম মাত্র ঘুম থেকে উঠেছিল। ঘুম পুরোপুরি চোখ থেকে সরেনি। চোখ কচলাতে কচলাতে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে হাই তুলছিল। এতটুকু মূহুর্তে সে ভুলে গিয়েছিল ঘরটা তার একার নয়। ঘরে এক সুন্দরী রমনী রয়েছে। যাকে কিনা প্রেম গত রাতে বিয়ে করেছিল। ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণের জন্য তার মাথা থেকে এসব বেরিয়ে গিয়েছিল। আচমকা আয়নায় নিজেকে দেখতে চাইতেই দিনের আলো পড়া এক অর্ধ শাড়ি পরিহিত নারীকে দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় সে। খোলা কোমড়ে খেলা করছিল তার কোঁকড়ানো ভিজে চুল। টপটপ করে ফ্লোরে পড়ছিল পানি। তার সামনের দৃশ্য ছিল আর ভয়াবহ। উম্মুক্ত পেট আর সেই লাল চোখমুখ প্রেমের চোখ ছলকে উঠেছিল। চোখ সরিয়ে নিতে চেয়েছিল তৎক্ষনাৎ তবে সেই শক্তিও যেন শুষে নিয়েছিল। এমন পরিস্থিতি বুঝে উঠে ঢক গিলে বেশখানিকটা সময় পর চোখ সরিয়ে নেয় প্রেম। তার শরীর কাঁপছে। তড়তড় করে ঘামছে। মনে হচ্ছে তার শরীরে কেউ একটা আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে।

অন্যদিকে ঘুরে বসে থাকতে থাকতে প্রেম প্রশ্ন করল,
“ঘরে একটা ওয়াশরুম বলেও জিনিস থাকে। ভুলে গেছো সেটা? যা ঠিক করার সেখানে ঠিক করে আসতে পারতে।”

“আমি ভেবেছিলাম আ…আপনি ঘুমাচ্ছিলেন। সেজন্যই বাহিরে এসেছিলাম। তাছাড়া এতক্ষণ তো কুম্ভকর্ণকে রেসে হারিয়ে দিয়ে হা করে ঘুমাচ্ছিলেন। এমন সময়েই ঘুম ভাঙতে হলো আপনার?”

“ও হ্যালো! আমি প্রতিদিন সকাল ৮ টার মধ্যে ঘুম থেকে উঠি। এখন সারারাত যদি আমার বুকে একজন আরামে কাটিয়ে দিয়ে আমার ঘুম হারাম করে দেয় সেই দায়ভার আমি নেব না নিশ্চয়?”

প্রেমের এমন কথায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল ঐশ্বর্য। শাড়িটা এলোমেলো করে হলেও জড়িয়ে নিল নিজের সাথে। মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইল আয়নার সামনে। তারপর মিনমিন করে বলল,
“আমি শাড়ির কুঁচি করতে পারছি না আসলে। হেল্প করবেন?”

বড় একটা শ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়াল প্রেম। ধীরে এগিয়ে এসে ঐশ্বর্যের পেছনে দাঁড়িয়ে তার হাতে থাকা শাড়ি ধরল। আয়নার দিকে তাকিয়ে একটু একটু করে কুঁচি করতে লাগল। যদিও সেও ঠিকঠাক কাজটা পারে না। তবুও এভাবে চালিয়ে নেওয়া যায়। কুঁচি করতে করতে প্রেম ব্যস্ত কন্ঠে বলে,
“জীবনে শুধু জিন্স, কোট, জ্যাকেট, টপস, স্কার্ট পড়তেই শিখেছো। আর ঘাড়ে হাতে ট্যাটু করতে শিখেছো। আর ঝুলি ভর্তি রাগ আর জেদ নিয়ে জন্মেছো। শাড়ি পড়া আর নম্রতা শিখলে খুব একটা ক্ষতি হতো না। মেয়েদের নম্র স্বভাবে মানায় এমন দাম্ভিকতা নয়। যে হাতে ট্যাটু আঁকো আর ঘড়ি পড়ো সেই হাতে চুড়ি অনেক সুন্দর মানাবে। যেই কানে বড় বড় রিং আর টপ পড়ো সেখানে ঝুমকো ফুটে উঠবে। যেই ঘাড়ে ট্যাটু আঁকাও সেখানে সুন্দর একটা পেন্ডেন্ট মাধুর্য সৃষ্টি করবে। যেই চুল স্টাইল করে ওপরে বেঁধে রাখো সেই চুল খুলে রেখে একটা ফুল গুঁজলে অপরূপা লাগবে।”

ঐশ্বর্য নিজে যেন হারিয়ে গিয়েছিল প্রেমের কথায়। প্রতিটা অক্ষর প্রতিটা কথায় সে ডুবে গিয়েছিল। বারংবার বেজে যাচ্ছে সেসব কথা। কথা শেষ হতে না হতে ঘাড় ঘুরিয়ে প্রেমকে দেখার চেষ্টা করে ঐশ্বর্য। তখন প্রেম ঐশ্বর্যের ঘাড়ের কাছে এসে কুঁচির শেষদিকটা ঠিক করার চেষ্টায় মগ্ন ছিল। তৎক্ষনাৎ ঘটে গেল এক দুর্ঘটনা। ঐশ্বর্যের ঠোঁট নিয়ে স্পর্শ করল প্রেমের ওষ্ঠদ্বয়। দুজনে অনুভূতিশূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। দুজনের চোখে চোখ পড়তেই সরিয়ে ঐশ্বর্য দ্রুত সরে এলো। তার ওষ্ঠদ্বয় এখনো তিরতির করে কাঁপছে। চোখে ভাসছে একটু আগে ঘটা দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনা নাকি মহা দুর্ঘটনা বলা উচিত? এ যেন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। প্রেম এখনো মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে। একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে বের হতে পারছে না সে। তাড়াতাড়ি করে ঐশ্বর্য নিজের শাড়ির কুঁচি প্রেমের হাত থেকে নিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে গিয়ে ওয়াশরুম লক করে দিল। ওয়াশরুমের বেসিনের সামনে এসে দাঁড়াল সে। পানি ছেড়ে দিয়ে বড় বড় শ্বাস নিতে থাকল। কোথা থেকে কি হয়ে গেল? এখন প্রেমের সামনে কি করে দাঁড়াবে সে। দাঁড়ানোর আগে লজ্জায় জ্ঞান হারাবে না তো?

সব মাথার ওপর দিয়ে গেল প্রেমের। মস্তিষ্কের সবটা যেন শূন্য হয়ে গিয়েছে। দেহের মাঝে থাকা প্রতিটা রক্তের ফোঁটা টগবগ করে ফুটছে। খাটে ধপ করে বসে পড়ে নিজের ঠোঁটে আলতো স্পর্শ করে দেখল সে। অস্থিরতা যেন কাটছেই না।

গাড়িতে বসে রয়েছে অনুভব আর মাধুর্য। তারা যাচ্ছে প্রেমের বাড়ি। আজ তাদের মেয়ের বিয়ে। যদিও বিয়েটা আগেই হয়ে গিয়েছে। তবুও তার উপস্থিতি ছিল না সেখানে। তাই বেশ রমরমা ভাব নিয়েই বেরিয়েছিল তারা। মেয়েটার বিয়ে নিয়ে যা ভাবনা ছিল তা যাতে একাংশ পূরণ করতে পারে। তবে বর্তমানে তাদের দুজনের মাঝে নিরবতা। মাধুর্যের মুখ ভার চিন্তায় আর অনুভব ভুগছে অস্থিরতায়। নিরবতা ভেঙে অনুভব চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল,
“এতো কিছু একা একা করে ফেললে একবার আমাকে জানাতে পারতে মাধুর্য। আর এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত! ঠিক হবে কিনা আমরা কিন্তু কিছুই জানি না।”

মাধুর্য ভার কন্ঠেই উত্তর দিল,
“সবকিছু শুনে আমি এতোটাই ভয় পেয়েছিলাম যে কাউকে কিছু বলার মতো পরিস্থিতি ছিল না। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। শুধু আমার মাথায় একটাই কথা ঘুরছিল যে আমাদের ঐশ্বর্যের প্রাণ রক্ষা করতে হবে। সেটা যেকোনো উপায়ে বা যেকোনো মূল্যে। সেকারণেই আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলাম।”

“আর শেষ মূহুর্তে যদি তা না হয়?”

“আমার আর আপনার ভালোবাসার এক বিশেষ চিহ্ন ঐশ্বর্য। আপনার আর আমার অপেক্ষাকৃত এক ভালোবাসার প্রণয়। যে ভালোবাসার জন্য আমার মৃত্যুর পরেও আপনি নিজেকে প্রাণহীন করে ফেলেছেন অতঃপর আমাদের অপূর্ণ প্রেমগাঁথা পূর্ণ হয়েছিল। সেই পূর্ণতাকে আমরা হারাতে দেব না। আমাদের প্রাণকে আমরা হারাতে দেব না অনুভব। আর যার সঙ্গে ঐশ্বর্যের এই সুন্দর বন্ধন তৈরি হয়েছে সেও হারাতে দেবে না। আমি জানি।”

চলবে….

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৭

সোফায় একধ্যানে বসে রয়েছে মাধুর্য। তার চোখ স্থির ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে থাকা ঐশ্বর্যের দিকে। ঐশ্বর্য মনোযোগ দিয়ে চুলে খোঁপা করার চেষ্টায় আছে। কিন্তু সে পারছে না। বিরক্তি নিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে আবারও চেষ্টা করছে। মাধুর্য নিজের দুটো ওষ্ঠদ্বয় হা করে বসে পলকহীন দৃষ্টিতে দেখছে। ঐশ্বর্য এবার হতাশ চোখেমুখে তার মায়ের দিকে তাকালো।
“মা, এভাবে কি দেখছো? তুমি খুব ভালো করে জানো আমি এসব কোনোদিন কখনো করিনি। তোমার উচিত না হেল্প করা? তা না করে কি দেখে চলেছো বলো তো?”

ধ্যান ভাঙে মাধুর্যের। নড়েচড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঐশ্বর্যের সামনে এসে স্থির হয়ে দাঁড়ায় সে। পুলকিত নয়নে তাকিয়ে ঐশ্বর্যের বাহু ধরতেই হতবাক হয়ে তাকায় ঐশ্বর্য। মাধুর্য প্রফুল্ল মুখে বলে,
“আমি কি স্বপ্ন দেখছি ঐশ্বর্য? এটা তুমি? এটা ঐশ্বর্য সিনহা? যাকে কিনা কোনোদিন শাড়ি পড়ানো শিখিয়ে উঠতে পারা তো দূরে থাক যাকে কখনো শাড়ি হাতে ধরাতে পারিনি সেই মেয়ে শাড়ি পড়ে খোঁপা করার চেষ্টা করছে? কি জাদু দিয়ে তোমায় এমন বানালো প্রেম বলো দেখি?”

দৃষ্টি সরু হয়ে এলো ঐশ্বর্য। মুখ ঘুরিয়ে নিল। হাসতে গিয়ে হাসলো না। লাজুকতায় ছেয়ে গেল মুখশ্রী। আয়না দিয়ে ঐশ্বর্যের সেই লাজুক মুখশ্রী মাধুর্যের চোখে স্পষ্ট ধরা দিল। সে আর কথা না বাড়িয়ে ঐশ্বর্যকে বসিয়ে দিয়ে বলল,
“বিয়ে তো হুট করে ফেলেছো। তোমায় নিজের মন মতো সাজাতে পারিনি। ইচ্ছে ছিল নিজের মেয়েকে একবারে ভ্যাম্পায়ার কুইন রুপে সাজিয়ে বিয়েতে নিয়ে যাব। কিন্তু তোমার ভাগ্য জুড়ে আছে একটা সাধারণ মানুষের সাথে সেটা কারো তো জানা ছিল না। আজকে তোমাকে না হয় বধূ রূপেই সাজিয়ে দিই।”

ঐশ্বর্য কিছু একটা বলতে চাইলো। তবে বলল না। শুধু শুনে নিরব চাহনি নিয়ে বসে রইল। মাধুর্য ঐশ্বর্যকে এক সাইড করে সুন্দর করে খোঁপা করে দিল। দেওয়ার পর পরই গয়নায় হাত দিতেই ঐশ্বর্য বলে উঠল,
“মা একটু খোঁপায় কোনো ফুল গুঁজে দেবে?”

মাধুর্য ভ্রু কুঁচকে বলে,
“আমি?”

“তো কে করে দেবে? তুমিই তো সাজিয়ে দিচ্ছো আর আমি এসব কিভাবে করে কিছুই তো জানি না।”

“উঁহু, এই কাজটা আমি করে দেব না।”

ঐশ্বর্য ঘাড় ঘুরিয়ে মাধুর্যের দিকে অসহায় চোখে তাকায়। প্রেম বলেছিল মেয়েদের নাকি খোঁপায় বা চুলে ফুল গুঁজলে অপরূপা লাগে? সেও প্রেমের চোখে অপরূপা লাগতে চায়। সেজন্যই তার ইচ্ছে জেগেছে। সে ঠোঁট উল্টিয়ে কন্ঠস্বর চাপা করে জিজ্ঞেস করল,
“তবে?”

“যার দেওয়ার সে ঠিকই তোমার সাজ পরিপূর্ণ করে দেবে। আমি চাই না তার কাজটা করে দিতে।”

ঐশ্বর্য তার মায়ের কথার আগামাথা কিছুই না বুঝে ভ্যাবাচেকা চোখে তাকিয়ে রইল। আস্তে আস্তে ঐশ্বর্যকে পড়ানো হলো তার স্বামী অর্থাৎ প্রেমের বাড়ি থেকে দেওয়া গয়না। মিসেস. পরিণীতা কোনো কমতি রাখেন নি। ঐশ্বর্যের জন্য গা ভর্তি গয়না দিয়েছেন। ঐশ্বর্যকে চুড়ি পড়াতে লাগলো মাধুর্য। বাম হাতে চুড়ি পড়াতে গিয়েই তার খেয়ালে এলো ঐশ্বর্যের হাতের চিহ্নটা। যেই চিহ্ন ডেভিল কুইনের আশঙ্কা থাকার চিহ্ন। সেটার চিহ্ন হালকা হয়ে এসেছে। চিহ্নটির ওপর হাত নাড়িয়ে দেখতে দেখতে বলে,
“চিহ্নটা অবশেষে মিশতে শুরু করেছে।”

ঐশ্বর্যও হকচকিয়ে তাকায়। প্রগাঢ় চিহ্নটা কিছুটা হালকা হয়েছে। সেও হাত বুলিয়ে দেখে নেয়। আর বলে,
“সত্যিই তো। কিন্তু এটা হঠাৎ মিলিয়ে যাওয়ার কারণ কি মা? ছোট থেকে তো একইভাবে দেখে আসছি। চিহ্নটা আরো গাঢ় হতো। আজ হঠাৎ এভাবে হালকা হয়ে আসছে কেন বলো তো?”

গলা খাঁকারি দিয়ে থতমত খেয়ে মাধুর্য বলল,
“সেটা তো আমার জানা নেই। তবে মিশে যাচ্ছে যেহেতু যাক। ক্ষতি কি?”

ঐশ্বর্য কিছু বলল না শুধু চিহ্নটার দিকে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। তখনই দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে মা ও মেয়ে দুজনই পেছন ফিরে তাকায়। দরজা ঠেলে হাতে একটা পাতলা দোপাট্টা নিয়ে প্রবেশ করেন মিসেস. পরিণীতা। স্বভাবসুলভ হাসি মুখে ঐশ্বর্যের পানে চেয়ে ওর কাছে এসে দাঁড়িয়ে থুঁতনিতে হাত দিয়ে একটু ঝাঁকিয়ে বলে,
“বাহ কি সুন্দর লাগছে তোমায়। নজর না লাগে কারো!”

মাধুর্যও উনার কথায় হাসে। অতঃপর মিসেস. পরিণীতা বলেন,
“মানতে হবে, ঐশ্বর্য যে আপনার মেয়ে দেখেই বোঝা যায়। আপনার মতোই হরিণী চোখের অধিকারী সে। এতো সুন্দর চকচকে স্বর্ণের মতো গায়ের রঙে শাড়ি আর গয়নার সৌন্দর্য একেবারে বেড়েছে।”

“ঐশ্বর্য কিন্তু কখনো কোনো ঘরোয়া কাজ করেনি। এমনকি সে সামান্য কাজও জানে না। তাই আপনাকে একটু মানিয়ে নিতে হবে।”

“তা তো অবশ্যই। আমিও একসময় এই বাড়িতে নতুন বউ হয়ে এসেছিলাম। তখন আমি ঐশ্বর্যের মতোই ছিলাম। কোনো কাজ পারতাম না। দরকার হলে ওকে কোনো কাজ করতেই হবে না। বাড়িতে তো অনেক লোক রয়েছে ওসব কাজের জন্য। এই দোপাট্টা এনেছি। নিচে ডাক পড়েছে। তোমায় যেতে হবে এখন। সকলে প্রেম আর ঐশ্বর্যকে এক সাথে দেখতে চাইছে। প্রেমও তৈরি হয়ে গিয়েছে। ওকে এই ঘরে আসতে বলি? একসাথে দুজন যাবে সুন্দর লাগবে দেখতে।”

মাধুর্য সম্মতি দিতেই ঐশ্বর্যের মাথার ওপর লাল রঙের দোপাট্টা দিয়ে আধো মুখ ঢেকে দেন মিসেস. পরিণীতা। তারপর মাধুর্যের সঙ্গে বেরিয়ে যান।

মিনিট দুয়েক স্থির বসে থাকতেই ধপ করে উঠে দাঁড়ায় ঐশ্বর্য। চোখমুখ জড়িয়ে নিজের মাথায় দোপাট্টা নামিয়ে দিয়ে বলে,
“জীবনে যা কিছু করিনি সেসব করতে হচ্ছে। আর একটু হলে দমবন্ধ করে মরে টরে গেলে আমার সদ্য বিবাহিত হাজবেন্ডের কি হতো?”

নিজের হাত দ্বারা বৃথা চোখেমুখে বাতাস দেওয়ার চেষ্টা করে অতঃপর এসির রিমোট হাতে নিয়ে এসির পাওয়ার বাড়িয়ে বলে,
“এতো গরম লাগছে কেন আমার উফফ…!”

এসির পাওয়ার বাড়তেই বড় একটা শ্বাস নিয়ে আশেপাশে তাকায় ঐশ্বর্য। এতোসব কিছু হয়ে যাবার পর তার বর্তমান বেডরুম অর্থাৎ প্রেমের রুমটা ভালো করে দেখেই নি ঐশ্বর্য। রুমটার চারিদিক দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে বলে,
“এই লোকটা যেমন গম্ভীর ঘরের রঙটাও তেমন গম্ভীর। ঘরের চেহারাটাই গম্ভীর করে রেখে দিয়েছে। পুরো আদিম যুগের ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট কোনো রুম।”

প্রেমের ঘরের রঙটা পুরোপুরি সাদা। আর যতপ্রকার আসবাবপত্র রয়েছে সবই কালো রঙের। সোফা থেকে শুরু করে ড্রেসিং টেবিল অবধি কালো। সাদা রঙের পাতলা পর্দা লাগানো বড় বড় দুটো জানালায়। দেয়ালের একপাশে কিছু ছবি টানানো। হয়ত কোনো বিখ্যাত পেইন্টিং হবে। বেডের দুইপাশে লম্বা দুটো ল্যাম্পশিট। তার থেকে কিছুটা দূরত্বে রয়েছে বড়সড় একটা আলমারি। তার বিপরীত পাশে রাখা কাবার্ড। ঘুরতে ঘুরতে ঘরের ডান দিকের দেয়ালে নজর পড়ে ঐশ্বর্যের। মোটামুটি তার সমান একটা ছবির ফ্রেম। ফ্রেমে জ্বলজ্বল করছে প্রেমের ছবি। মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া এক ফর্মাল জামাকাপড়ে পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। স্বভাবসুলভ গম্ভীর তার মুখভঙ্গি। গালে হাত দিয়ে সেটা দেখলো ঐশ্বর্য। এটা হয়ত সকালে কাপড় দেওয়া ছিল তাই খেয়ালেই আসেনি। এখন দেখে হা হয়েছে সে। আস্তে আস্তে গালে হাত দিয়ে পিছাতে লাগল সে। পুলকিত হয়ে কিছুটা জোরেই বলে উঠল,
“হায় মে মার যাওয়া! এই লোকটা এতো সুন্দর কেন?”

পিছাতে পিছাতে আচানক একটা লম্বা কিছুর সাথে ধাক্কা খায় সে। তার বাহু ধরে ফেলে পেছন থেকে কেউ। মাথা ঘুরিয়ে পিছু ফিরে তাকাতেই দেখে ব্যক্তিটি স্বয়ং প্রেম। ঢক গিলতেই প্রেম বলে ওঠে,
“আমাকে দেখে এতো ম*রে যেতে হবেনা। পারলে সামনাসামনি যত ইচ্ছে দেখে নাও।”

নিজেকে সামলে উঠে প্রেমের সামনাসামনি দাঁড়ায় ঐশ্বর্য। দৃষ্টি নিচে রাখে সে। আস্তে আস্তে প্রেমকে আপাদমস্তক দেখে ফেলে। প্রেমের ছবিটা দেখে ঐশ্বর্য যতটা না পুলকিত হয়েছিল প্রেমকে এই রূপে দেখে তার চেয়ে দ্বিগুন পুলকিত হয়েছে। মোটামুটি তার ভীমড়ি খাওয়ার উপক্রম। প্রেম আজ খয়েরী রঙের শেরওয়ানি পড়েছে। শেরওয়ানিতে রয়েছে গোল্ডেন রঙের কারুকার্য। পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশস্ত হাসে ঐশ্বর্য। তারপর এগিয়ে গিয়ে পায়ের পাতা উঁচু করে প্রেমের সমান হওয়ার বৃথা চেষ্টা করে সে। প্রেম ভ্রু কুঁচকায়। ঐশ্বর্য প্রেমের শেরওয়ানির গলা ঠিক করে দিয়ে বলে,
“মি. পারফেক্ট!”

চলবে…

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৮

“আই থিংক মি. পারফেক্টের সাথে মিসেস. পারফেক্টকে মানাবে? এম আই রাইট?”

প্রেম হালকা ঝুঁকে ঐশ্বর্যের দিকে গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল। ঐশ্বর্য প্রেমের দিকে তাকিয়ে এবার নিজের দিকে তাকালো। তারপর নিচু সুরে বলল,
“আই নো আমি কখনো মিসেস. পারফেক্ট হতে পারব না। পারফেক্ট হওয়ার মতো কিছুই তো নেই আমার মধ্যে। আপনার মতো পারফেক্ট হওয়া তো অসম্ভব আমার পক্ষে।”

“কে বলেছে অসম্ভব? আর একটু হলেই মিসেস. পারফেক্ট হবে তুমি।”

উৎসুক চাহনি নিয়ে তাকালো এবার ঐশ্বর্য। প্রেম এবার ভালো করে ঐশ্বর্যকে দেখছে। ঐশ্বর্য কানে বড় ঝুমকো পড়েছে আজ। হাত ভর্তি চুড়ি। পরনে খয়েরী আর গোল্ডেন রঙের শাড়ি। গলায় গহনা রয়েছে। খোঁপা করেছে বাঁকা করে। প্রেম গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
“তুমি একা রেডি হয়েছো?”

“না। মা হেল্প করেছে। আমি এসব পারি নাকি?”

“বাট সামথিং ইজ মিসিং!”

ঐশ্বর্য ভ্রু নাচালো। কি মিসিং বুঝতে কিছুটা সময় লাগল তার। তবে তার আগেই নিজের হাতে ফুল নিয়ে নিয়েছে প্রেম। আস্তে করে ঐশ্বর্যের হাত ধরে কাছে টানতেই নিষ্পলক চোখে তাকায় ঐশ্বর্য। অতঃপর নিজহাতে খোঁপায় ফুলটা লাগিয়ে দিতেই ঐশ্বর্যের মনে আসে তার মায়ের বলা কথাগুলো। ‘যার দেওয়ার সে ঠিকই তোমার সাজ পরিপূর্ণ করে দেবে। আমি চাই না তার কাজটা করে দিতে।’
এই কারণেই তবে মাধুর্য এই কথাগুলো বলেছিল! ফুল লাগিয়ে দেওয়া শেষে খানিকটা পিছিয়ে দাঁড়ায় প্রেম। আবারও দৃঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঐশ্বর্যকে দেখে নেয়। তারপর আশেপাশে তাকায়। দোপাট্টা পড়ে আছে বিছানায়। সেটা নিজহাতে তুলে নেয় প্রেম। ঐশ্বর্যের নিকটে ফিরে এসে দোপাট্টা ঝেড়ে ঐশ্বর্যের মাথায় দিয়ে দেয়। ঐশ্বর্য নিরবে এই মূহুর্ত আপন করতে থাকে। এতো সুন্দর অনুভূতি হয়নি কখনো তার। এই মূহুর্ত কি এখানেই থামিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়? ঐশ্বর্য যদি এই কাজটা পারত তাহলে সেটাই করত!

বেখেয়ালিভাবে প্রেমের দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকা ঐশ্বর্যের ধ্যান ভাঙে হাতে টান অনুভূত করাতে। প্রেম তাকে টেনে এনে আয়নার সামনে দাঁড় করায়। অতঃপর কানের কাছে বলে ওঠে,
“লুক এট দিস গার্ল! সি ইজ মোর বিউটিফুল দ্যান ডেয়ারিং ঐশ্বর্য।”

ঐশ্বর্য আয়নায় তাকায়। আয়নার দুপাশে ঝলমলে লাইটে তার অন্যরূপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। নিজেকে এ রূপে দেখে বেশ চমকে উঠল ঐশ্বর্য। আগের ঐশ্বর্যকে কল্পনা করে নিল সে। আগের সে কেমন ছিল? ডেয়ারিং, আধুনিক, সবসময় কালো রঙটা বেশি পছন্দ করতো। কালো জ্যাকেট, কালো জিন্স, কালো শার্ট, কালো হাই হিল সব মিলিয়ে আগের ঐশ্বর্য ছিল একেবারে ভিন্ন। কিন্তু এই ঐশ্বর্য! সে একেবারে অন্য। তার মাঝে ফুটে উঠেছে মেয়েলি হাবভাব। গালের দুপাশে হালকা গোলাপি বর্ণ বুঝিয়ে দিচ্ছে সে লজ্জা পাচ্ছে নিজেকে দেখে। তার ভাবমূর্তি বুঝতে পেরে সরে আয়না থেকে সরে দাঁড়াতে চাইলে প্রেমের হাতটা আগলে ধরে ঐশ্বর্য। শান্ত সুরে বলে,
“একটা কথা বলি? আপনি গেলে এই বিউটিফুল ঐশ্বর্যকেও অসুন্দর আর অসম্পূর্ণ লাগবে। আপনার দ্বারা এই ঐশ্বর্য সম্পূর্ণ হয়। তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়।”

ঐশ্বর্যের এমন কথায় বাকহারা হয়ে স্থির তার পেছনেই দাঁড়িয়ে থাকে প্রেম। বারংবার বাজতে থাকে ঐশ্বর্যের বলা কথাগুলো। এই মূহুর্তটা এতো সুন্দর আর অভাবনীয় কেন?

কারো হিংস্র চিৎকারে সারা ডেভিল কিংডম কেঁপে উঠছে। অন্ধকারে ভরা রাজ্যে ছেয়ে আছে হিংস্র চিৎকার। মাঝে মাঝে কিছু ছুঁড়ে ফেলার শব্দ আসছে। কারো নিশ্বাসের সাথে পড়ছে ক্রোধের বিষ। বিষে ছারখার হচ্ছে আশপাশ তবুও শান্ত হতে নারাজ রোজি। কালো রঙের ফুলদানিতে রাখা কালো রঙের কাঁটাযুক্ত কালো গোলাপ হাতে তুলে নেয় রোজি। সেটা বিক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে নজর দিয়ে হাতেই দুমড়েমুচড়ে দেয় সেই কাঁটাযুক্ত গোলাপ। কাঁটা ফুটে হাতটাকে র*ক্তা*ক্ত করে দেয়। রক্তের একেকটা ফোঁটা পড়তে থাকে নিচের কার্পেটে। র*ক্তের বিষা*ক্ত ফোঁটা সেই কার্পেটের কিছু অংশ পুড়িয়ে ফেলে। রোজি ডেভিল। তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছেয়ে আছে বি*ষ সাথে কুকর্ম। নিজের হাতের দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে সে চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে,
“পারলাম না আমি। অসফল হয়ে গেলাম। এই রাজ্যের সবথেকে শক্তিশালী হয়েও আমাদের ডেভিল কুইনকে আমাদের রাজ্যে প্রবেশ করাতে পারলাম না। উল্টে আমাকে হারিয়ে দেওয়া হলো। ওই মানুষের বাচ্চা, ওই প্রেম বিয়ে করে নিল আমাদের কুইনকে। আমি জানতেও পারলাম না। কোথা থেকে কি হয়ে গেল!”

“তবে কি আমাদের উদ্দেশ্য কখনো সফল হবেনা? কখনো আমাদের রাজ্য আগের মতো শক্তিশালী আর বিদ্বেষী হয়ে উঠবে না? সব আশা যে জলে চলে গেল। রোজি, তোমার সাথে তো প্রেমের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। যার আমাদের কুইন প্রেম নামক ওই মানুষটার কাছাকাছি না আসতে পারে সেজন্যই তো তুমি বিয়ে করতে চেয়েছিলে। তবে কি এমন ঘটল যে রাতারাতি সব পাল্টে গেল?”

বেশ চিন্তিত হয়ে বলে ওঠে এরিক। রাজ্যের সকলে অপেক্ষা করছে তাদের কুইনকে দেখার জন্য। তার অভিষেকের জন্য। তবেই তো এই পুরো পৃথিবীকে ধ্বং*স করতে পারবে তারা। রোজি পুরো রাজ্যের সামনে বলেছিল আগামী অমাবস্যার মধ্যে ডেভিল কুইনকে এনে উপস্থিত করতে এই রাজ্যে। কিন্তু সমস্ত কথা হয়ত মুখেই থেকে যাবে তার। কাজে আর করতে পারবে না। রোজি হিসহিসিয়ে বলে,
“আমার মনে হচ্ছে এই বিষয়ে কোথাও না কোথাও মাধুর্য মানে ওই ভ্যাম্পায়ার কুইনের হাত আছে। এর আগেও ও আমাদেরই মিত্র বংশ ওয়ারউলফ দের ধ্বং*স করেছিল। আমার মনে হয় কোনোভাবে আবারও ওর জন্যই এসবকিছু হচ্ছে।”

“শান্ত হও তোমরা। এভাবে নিজেদের ক্রোধকে বেকার নষ্ট করে কোনো লাভ নেই। তা জমিয়ে রাখো। আমরা যে একেবারেই অসফল হয়েছি তা কিন্তু নয়। আমরা এখনো এটা জানি না যে ওই প্রেম এখনো বর্তমান ঐশ্বর্য মানে তার বর্তমান ভ্যাম্পায়ার প্রিন্সেস পরিচয়টা জানে কিনা। আর তোমরা এটা ভুলে যেও না উনার হাতের চিহ্ন যতদিন থাকবে ততদিন উনার ডেভিল কুইন হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে। যেদিন প্রেম আর উনার মাঝে কোনো বড় সত্যি বা পরিচয় লুকায়িত থাকবে না। সব প্রকাশিত হবে। তারপরেও যদি তাদের ভালোবাসা অটুট থাকে সেদিনই পুরোপুরি হেরে যাব আমরা। আর আমি এই বিষয়ে নিশ্চিত যে প্রেম এখনো কিছু জানে না।”

রোজির বাবা বিষয়গুলো বেশ ভাবনাচিন্তা করে বলে ওঠে। রোজি এবার আগ্রহ নিয়ে বলে,
“তবে আমাদের করণীয়? কি করব আমরা এখন?”

“নজর রাখতে হবে ওদের ওপর। সবসময়ের জন্য। আরেকটা কাজ করতে হবে। সেটা হচ্ছে ডেভিল কুইনকে সবসময় ক্রোধের মাঝে রাখতে হবে। ক্রোধের মাঝে উনি সবসময় হিংস্র হয়ে উঠবেন। এতে আশঙ্কা বাড়বে। বুঝতে পেরেছো?”

রোজি আর এরিক দুজনেই মাথা নাড়ায়। অতঃপর রোজির বাবা আবারও বলে ওঠে,
“তবে এবার রোজি কাজটা করবে না। এরিক করবে। অন্যভাবে এবং অন্যরূপে তোমাকে কাজটা করতে হবে।”

আশেপাশে অন্ধকার স্পটলাইট শুধু পড়েছে বর্তমানে ঐশ্বর্য এবং প্রেমের দিকে। দুজন বসে আছে দুদিকে মুখ করে। রেজিস্ট্রির জন্য লইয়ার এসেছে। মাঝে মাঝে আঁড়চোখে তাকাচ্ছে ঐশ্বর্য। প্রেম আদেও বিয়েটা ইচ্ছেতে করেছে? অকারণে নিশ্চয় করেনি। তবে কারণটা কি? কারণটা খুঁজে না পেয়ে হতাশ ঐশ্বর্য। প্রেম কি তাকে ভালোবাসে? তাহলে কখনো প্রকাশ করেনি কেন? সবকিছু ভেবে মাথা ঘুরছে তার। এসব ভাবনা ফেলে মাধুর্যের দিকে তাকালো সে। মাধুর্য শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকেই চেয়ে আছে। তারপর মুখ ঘুরিয়ে আবারও প্রেমের দিকে চাইলো ঐশ্বর্য। প্রেম তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। সঙ্গে সঙ্গে নজর সরিয়ে নিল সে। তা দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো ঐশ্বর্য। লইয়ার হঠাৎ প্রেমকে বলে ওঠে,
“মি. শেখ আনন প্রেম। এখানে সাইন করুন।”

প্রেম পেপার হাতে নেয়। কাগজে চোখ বুলিয়ে নেয় একবার। তারপর বেশ সহজভাবেই সাইন করে দেয় যেন বিয়েটা সে মেনে নিয়েছে খুব সুন্দর ভাবে। এরপরই এলো ঐশ্বর্যের পালা। তাকে পেপার এগিয়ে দিয়ে সাইন করতে বলা হলো। হাতে পেপার নিলো সে। হাত কাঁপছে তার। সাইন কিভাবে করবে বুঝছে না সে। এমনসময় প্রেম হালকা ঝুঁকে তার দিকে তাকাতেই ঢক গিলে কাঁপা হাতেই কোনোরকমে সই করে দিল ঐশ্বর্য। লইয়ার পেপার ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
“এখন থেকে আপনারা আইনত স্বামী স্ত্রী। এখন শুধু সাক্ষী নেওয়া বাকি।”

একে একে বাকিদের সই নেওয়া হলো। সবশেষে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করা হলো। জনে জনে এলো ঐশ্বর্য আর প্রেমকে দেখতে। তাদের অভিনন্দন জানাতে। সব মিলিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ল ঐশ্বর্য। অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে গভীর রাত হলো। মাধুর্য আর অনুভবকে আজ আর যেতে দেওয়া হলো না। তারা রইল প্রেমের বাড়িতেই।

রাত হলেও বাড়িতে নতুন বিয়েতে গড়ে উঠেছে বেশ আমেজ। সবাই মিলে বেশ আড্ডায় বসেছে গার্ডেনে। ঠান্ডা মৌসুমে জমিয়ে উঠেছে আশপাশ। ঐশ্বর্যও সকলের সাথে বসেছে। তবে তার ক্লান্ত লাগছে সেই সাথে ঠান্ডা। মাধুর্য আর অনুভবের কিছু না হলেও ঐশ্বর্যের ঠান্ডা যেন একেবারে সহ্য হয় না। ঠকঠক করে কাঁপছে সে। পাশেই গম্ভীর মনোভাব নিয়ে বসে আছে প্রেম। ধীর কন্ঠে সে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,
“ঠান্ডা লাগছে তোমার?”

ঐশ্বর্য উত্তর দিল না। একটু নিরব থেকে বলল,
“একটু।”

বলার কিছুক্ষণ পর উঠে দাঁড়ায় প্রেম। ‘আমি আসছি’ বলে বাড়ির ভেতরে চলে যায় সে। সকলে আগের মতোই আড্ডায় মগ্ন হয়ে পড়ে। তবে মিসেস. পরিণীতা নেই সেখানে। কফি আর চা বানাতে গিয়ে উনি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তাই মাধুর্যও বিষয়টা দেখতে উঠে এলো সেখান থেকে। বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই সামনা-সামনি হলো প্রেমের। প্রেম শান্ত হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। মাধুর্য প্রেমকে দেখে আশেপাশে একবার দেখে নিল। কেউ নেই বুঝে সে প্রেমের উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতার সাথে বলল,
“তোমাকে যাই বলি না কেন সেটাই কম হবে প্রেম। আমি তোমায় আগেবার যখন ঐশ্বর্য জ্বরে ভুগেছিল তুমি তাকে সাহায্য করেছিলে তখন বলেছিলাম যে তোমার কোনো সাহায্য লাগলে আমি সবর্দা চেষ্টা করব। কিন্তু ভাগ্য দেখো আমার! উল্টে তোমার সাহায্য নিতে হলো আমার।”

“এভাবে কেন বলছেন আপনি? আমি সবসময় ঐশ্বর্যের ভালো চেয়েছি। তার জন্য যা করতে হয় আমি করেছি। ভবিষ্যতে যা করতে হবে আমি করব।”

মাধুর্য এবার উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করে,
“কেন করবে? কেন চাও ওর এতো ভালো? কেন সবসময় তুমিই ওর ভালো করতে চাও? আমার এক অনুরোধে তুমি ওকে বিয়ে অবধি রাজি হয়ে গেলে। জোর করে বিয়ে করে নিলে। সাহায্য পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু বিয়ে? এতো বড় একটা ডিসিশন! সারা জীবনের প্রশ্ন! তুমি তাও কম্প্রোমাইজ কেন করলে? ঐশ্বর্যের প্রতি তোমার অনুভূতি কি?”

প্রেম কিছুটা অপ্রস্তুত হয়। কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না। কারণ সে উত্তর জানেই না। তবুও নিজেকে সামলে উত্তর দিল,
“আই রিয়েলি ডোন্ট নো! কেন ওর এতো কেয়ার করি আমি জানি না। ওর ভালো করলে কেন যেন নিজেই ভালো থাকি। এসবের কারণ আমি জানি না। বাট হঠাৎ আপনি আমার এঙ্গেজমেন্টের দিন কেন বিয়ের অনুরোধ করেছিলেন জানতে পারি? সেদিন তো কেঁদেই দিয়েছিলেন ঐশ্বর্যের জন্য। কি এমন বিপদ আছে ওর? আপনি বলেছিলেন ওকে আমি বিয়ে না করলে ওর প্রা*ণ সংশয় হতে পারে পারে। ওকে কি কেউ মা*রার চেষ্টা করছে? যদি করেও থাকে তাহলে এর সাথে বিয়ের সম্পর্ক কি?”

মাধুর্য থতমত খায় এবার। কারণ সে এখনি সব বলতে পারবে না। পরক্ষণেই বলে ওঠে,
“এসবকিছু আমি এখনি বলতে পারব না। শুধু এটা জেনে রাখো ওকে যদি ওই সময় বিয়ে না দিতাম তাহলে খুব ভয়া*নক কিছু অপেক্ষা করছিল। আর প্রা*ণ সংশয় তো রয়েছেই। এর থেকে আর বেশি কিছু বলতে পারব না আমি।”

প্রেম কথা বাড়ালো না। বরং হতবিহ্বল হয়ে রইল।

চলবে…

#প্রেমের_ঐশ্বর্য
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৯

প্রেম গার্ডেনে এলো। তার হাতে একটা শাল। অনুভব আর কবির সাহেব বসে আরাম আয়েশে গল্প করছিলেন বটে। প্রেমকে দেখে গল্প থামিয়ে একবার তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন তারা। ঐশ্বর্য স্থির হয়ে বসে আছে। তার দৃষ্টিও ছোট ছোট ঘাসগুলোর দিকে স্থির। অন্যদিকে যেন কোনো খেয়াল নেই বেশ অন্যমনস্ক! তার পিঠে কোনো মোটা কাপড় পড়তেই বেশ হকচকিয়ে পিছু ফিরে তাকায় সে। প্রেম তার গায়ে শাল জড়িয়ে দিচ্ছে। ঐশ্বর্যকে ঢেকে তার হাতে শাল গুঁজে পাশের চেয়ারে বসে পড়ল প্রেম। তারপর খেয়াল করল অনুভব আর কবির সাহেব তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হালকা কাশল প্রেম। নড়েচড়ে বসতেই অনুভব হালকা মুখ টিপে হেঁসে অন্যদিকে তাকালো। কবির সাহেবও গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
“সো মি. সিনহা আমরা কি নিয়ে কথা বলছিলাম?”

অনুভব আমতা আমতা করে বলে,
“একচুয়ালি আমিও ভুলে গিয়েছি।”

“তা প্রেম তুমি ঐশ্বর্যের জন্য শাল আনলে। তোমার নিজের ঠান্ডা লাগছে না? তুমি তো নিজেও শুধু একটা গেঞ্জি পড়ে আছো।”

নিজের বাবার কথায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে প্রেম। তার হালকা ঠান্ডা লাগছে। না লাগা নয়। তবে নিজের দিকে খেয়াল ছিল না এতো। সে শুধু দেখেছে ঐশ্বর্যকে ঠান্ডায় কাঁপতে। ব্যাস… তার মন মস্তিষ্ক আর অনুভূতি কোনোটাই নিজের প্রতি কাজ না করে চলে গেল ঐশ্বর্যের জন্য শাল আনতে। প্রেম নিচু সুরে জবাব দেয়,
“আসলে তেমন একটা ঠান্ডা লাগছে না বাবা।”

“কি বলছো? এতো ঠান্ডা এই রাতে। শিশির পড়ছে। তাপমাত্রা বেশ কম। আর তোমাকে ঠান্ডা লাগছে না? তোমার তো অল্পতেই ঠান্ডা লেগে যায়।”

অনুভব এবার তাদের কথোপকথনের মাঝে বলে,
“আহ মি. শেখ, বিয়ে করেছেন কম দিন তো হয়নি। জানেন না বিবাহিত পুরুষদের নিজেদের থেকে বেশি বউয়ের খেয়াল রাখতে হয়। বউয়ের কিছু হলেই তো নিজেকেও গুরুতর অসুস্থ হতে হয়। এটা তো বিয়েগত নিয়ম!”

সময়টা কম হলেও কবির সাহেবের সাথে অনুভবের বেশ বন্ধুত্ব জমেছে। আর আগে থেকেই তো অনুভবের মুখের লাগাম নেই বললেই চলে। কবির সাহেব মুচকি হাসেন। আর বলেন,
“ঠিকই বলেছেন। কিন্তু আমার ছেলেও যে এমন বিয়েগত নিয়মে বাঁধা পড়বে ভাবতেও পারিনি। ইহা যেন পৃথিবীর আশ্চর্যজনক ঘটনার মধ্যে একটি।”

বলেই বেশ উচ্চস্বরে হেঁসে দিলেন কবির সাহেব। তাল মিলিয়ে অনুভবও হাসলো। হাসতে হাসতে কবির সাহেব এবার অনুভবের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়লেন।
“বাট মি. সিনহা! মানতেই হবে আপনাকে মনেই হয় না যে আপনার একটা মেয়ে আছে আবার তারও বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ইভেন মিসেস. সিনহা দেখেও মনে হয় না। বরং আপনাদের দেখেই নিউ ম্যারিড ক্যাপল লাগে। চশমাটা খুললে হয়ত আপনাকে আবার একটা বিয়ে দেওয়া যাবে।”

বলেই হাসির গতি বাড়িয়ে দিলেন উনি। অনুভব শুনে শুধু হালকা হাসলো। এসবের কারণ সে জানে। তাদের বয়স ভার হওয়ার কথা নয়। এমন সময় ঐশ্বর্য উঠে দাঁড়ায়। গায়ের শালটা খুলে নিয়ে প্রেমের কাছে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
“এটা আপনি রাখুন। আমি ভেতরে যাচ্ছি।”

ঐশ্বর্যের কন্ঠে কোনো উচ্ছলতা নেই। বেশ শান্ত গলার সুর। তাকে দেখে বেশ অন্যরকম লাগছে। প্রেমের নজর এড়ালো না তা। অনুভব ঐশ্বর্যের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে উঠল,
“তুমি তো রাত জেগে থাকতে পছন্দ করো। ভেতরে কোথায় যাচ্ছো? এখানেই থাকো। লুক, আমরা সবাই এখানে।”

“আমার ঘুম পাচ্ছে বাবা। আমি ঘুমোতে যাব। গুড নাইট।”

ঐশ্বর্য কথার জবাবের অপেক্ষা না করে কংক্রিটের তৈরি গার্ডেনের মাঝে রাস্তাটি ধরে হাঁটতে শুরু করে। প্রেম ক্ষীণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সেই আবছা আলোতে হেঁটে যাওয়া জ্বলজ্বল করতে থাকা একটা প্রদীপের ন্যায় মেয়েটির দিকে।

মিসেস. পরিণীতা আর মাধুর্য হাতে চা আর কফির ট্রে নিয়ে সবেমাত্র বের হচ্ছিল গার্ডেনের দিকে। তখন ঐশ্বর্য হুড়মুড়িয়ে সদর দরজা পেরিয়ে ঢুকে পড়ে বাড়ির ভেতর। তাকে দেখে মিসেস. পরিণীতা উৎকন্ঠিত হয়ে বলেন,
“কি হলো ঐশ্বর্য? সবাই সবেমাত্র আড্ডা শুরু করছিল তুমি চলে এলে। কিছু হয়েছে?”

“নাহ কিছু হয়নি। আসলে আমার টায়ার্ড লাগছে। আমি ঘুমোতে চাই।”

“ঠিক আছে। আসলেই অনেক ধকল গেছে তোমার ওপর দিয়ে। তুমি বিশ্রাম নাও যাও।”

ঐশ্বর্য কথা বাড়ালো না। মাধুর্য কিছু একটা বলতে চাইলো তাকে। তবে ঐশ্বর্য কেন যেন তার দিকে মুখ তুলে তাকিয়েও দেখলো না। ধীর পায়ে সিঁড়ির দিকে চলল ঐশ্বর্য। মাধুর্য আর কিছু বলল না। বেরিয়ে এলো গার্ডেনে। কফির ট্রে টা রেখে বেশ কিছুক্ষণ গল্পগুজবে মেতে উঠেও যেন মন বসল না। মন টানলো ঐশ্বর্যের দিকে যেতে। মনটাকে প্রাধান্য দিয়ে এক বাহানায় সেখান থেকে উঠে এলো সে।

বেশ দ্রুত ঘরের সামনে গিয়ে দেখল ঘর এখনো বাহির থেকে লক করা। এর মানে ঐশ্বর্য ঘরে আসেনি। এলেও আবার বাহিরে চলে এসেছে। তাহলে কোথায় গেল? নিশ্চয় মেয়েটার কিছু হয়েছে। নয়ত এমন আচরণ করার মেয়ে সে নয়। অনেক খুঁজে খুঁজে সবশেষে ছাঁদে এলো মাধুর্য। দরজা পেরিয়ে ছাঁদে প্রবেশ করতেই আবছা আলোতেও একটা অবয়ব স্পষ্ট দেখতে পেতে বেগ পেতে হলো না মাধুর্যের। শাড়ি ছেড়ে ঐশ্বর্য একটা হুডি গায়ে দিয়েছে। হুডির পকেটে হাত দিয়ে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সে। মাধুর্য ঐশ্বর্যের কাছে যেতে যেতে বলে,
“শাড়ি ছেড়ে হুডি গায়ে দিয়েছো কেন? এখন এসব অভ্যেস পরিবর্তন করতে হবে তোমায় ঐশ্বর্য।”

কাছে এসে ঐশ্বর্যের হাত ধরে মাধুর্য। তার দিকে ঘুরাতেই ঐশ্বর্যের রুপ দেখে হকচকিয়ে ওঠে সে। চকিত চোখে তাকায় ঐশ্বর্যের দিকে। রক্তিম চোখে থরথর করে কাঁপছে ঐশ্বর্য। হাতের দিকে চোখ যেতেই দেখতে পায় ঐশ্বর্যের সেই ধারালো নখ। সব থেকে বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়ে মাধুর্য ঐশ্বর্যের হাতের সেই বিশেষ চিহ্নটি জ্বলজ্বল করতে দেখে। ওষ্ঠদ্বয় হালকা ফাঁকা থাকায় তা ঠেলে বেরিয়ে এসেছে দুইধার থেকে দুটো তীক্ষ্ণ দাঁত। কপালের রগ ফুলে ফেঁপে উঠেছে। বড় বড় শ্বাস ফেলছে সে। মাধুর্য ঐশ্বর্যের গালে স্নেহের সাথে হাত রাখে। অস্থিরতার সাথে বলে,
“কি হয়েছে তোমার ঐশ্বর্য? এমন করছো কেন? কি হয়েছে তোমার?”

মাধুর্যের হাত সরিয়ে দেয় ঐশ্বর্য। খানিকটা দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। ক্রুদ্ধ হয়ে বলে,
“আন্দাজ করেছিলাম আমি। মি. আনস্মাইলিং আমাকে নিজে থেকে বিয়ে করেন নি। তার মানে এসব কিছুর মাস্টারমাইন্ড তুমি ছিলে?”

ঐশ্বর্যের মুখে এমনসব কথা শুনে চমকিত হয়ে বলে,
“মা…মানে? তুমি কি ব…”

“মিথ্যে কথা বলা না হয় আমার মতো খারাপ মানুষদের ক্ষেত্রে যায়। তুমি তো ভ্যাম্পায়ার রাজ্যের রাণীমা! তোমাকে মিথ্যে মানায় না।”

“আগে শান্ত হও তুমি। ক্রোধ তোমাকে ধ্বং*স করে দিতে পারে।”

ঐশ্বর্য শান্ত হয় না। বরং আরো ক্রোধ জাগে তার মনে।
“আর আমাকে যে তুমি ছোট করে দিলে। তার বেলায়?”

“আমি যা করেছি তোমার ভালোর কথা ভেবে করেছি। প্রেম ছাড়া এমন কেউ ছিল না যে এতো দ্রুত আমার কথা বুঝতে পারত আর তোমার কথা ভাবতে পারতো। তোমাকে শুধু শত্রু নয় আমাদের রাজ্যের লোকেরাও ঘিরে ধরছে। তোমাকে আমাদের শত্রু ভাবছে।”

ঐশ্বর্য চোখমুখ খিঁচে ফেলে। নিজের হাত বার বার মুঠো করছে। অশান্ত সুরে বলে,
“ব্যাস… ব্যাস… তোমার এসব বাহানা আমি শুনতে চাই না। আমি আগেই বুঝেছিলাম উনি আমাকে ভালোবেসে বা নিজের ইচ্ছেই বিয়ে করেননি। এর পেছনে কোনো কারণ নিশ্চয় আছে। আজ তোমার আর উনার কথা শুনে আমি ক্লিয়ার হয়েছি। আমি উনার দায়িত্ব, বোঝা, কারণ হতে চাইনি। আমি উনার অকারণ হতে চেয়েছি। অকারণে ভালোবাসা হতে চেয়েছি। #প্রেমের_ঐশ্বর্য হতে চেয়েছি। নিজের কাছে আমি নিজে ছোট হয়ে গেছি।”

“শুধু আমার একটা কথা শোনো!”

“নো মোর ওয়ার্ডস।”

ঐশ্বর্য চলে আসে সেখান থেকে। কোনো প্রকার কথা শোনে না আর।

অনেকটা রাত হয়েছে। ঠান্ডা বেড়েছে। ঠান্ডার মাস শেষ দিকে। ফাল্গুন মাস পড়বে কয়েকদিন পরেই। কুয়াশামোড়ানো চারিদিক। সঙ্গে নিস্তব্ধতা বহমান। ঐশ্বর্য ঘরে বসে ছিল। নিজেকে শান্ত কিছুতেই করতে পারছিল না। এরই মাঝে দরজা খোলার শব্দে চোখ রাঙিয়েই সেদিকে তাকালো ঐশ্বর্য। প্রেম ঘরে প্রবেশ করে ক্লান্ত ভঙ্গিতে। হাই তুলতে তুলতে দেখে ঐশ্বর্য ঘুমায় নি। খানিকটা আশ্চর্য হয় নিজের ঘর দেখে। তার ঘর ফুলে ভরানো। মো মো করছে গন্ধে। সেই সাথে ঐশ্বর্যের মাতাল করা ঘ্রাণ প্রেম চিনে নিয়েছে। বেডে সুন্দর করে ঝুলিয়ে রাখা ফুল। ফ্লোরেও ছিটিয়ে রাখা গোলাপের পাপড়ি। কাল তাদের জন্য কোনো আয়োজন করা হয়নি। তাই বলেই হয়ত এমন কাজ করা হয়েছে আজ। এর চেয়ে বেশি হতবাক হয় ঐশ্বর্যকে জেগে থাকতে দেখে এবং তাকে হুডি পড়া অবস্থায় দেখে। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
“এখনো ঘুমাও নি? বললে যে ঘুমাবে?”

“বিয়ে কেন করেছেন আমায়?”

থতমত খেলো এতো রাতে ঐশ্বর্যের এরূপ প্রশ্নে। ঐশ্বর্য উঠে দাঁড়ায়। আর এগিয়ে আসতে থাকে। প্রেমের অতি নিকটে এসে বলে,
“বলুন কেন বিয়ে করেছেন আমায়?”

প্রেম ভ্যাবাচেকা খেয়ে কিছু বলার চেষ্টা করে। তবে ব্যর্থ হয়। ঐশ্বর্য চোখ রাঙিয়ে বলে,
“ভালোবাসেন?”

প্রেম বাকরুদ্ধ। ঢক গিলে নেয় দুইবার। ঐশ্বর্য অকপটে বলে,
“তাহলে ভালোবাসি বলুন।”

প্রেম নিরব। ভাঙা সুরে বলার চেষ্টা করে,
“এতো রাতে কি শুরু করেছো? ঘুমিয়ে পড়ো।”

“ভালোবাসি বলুন আমায়।”

প্রেম বিষয়টা ঘুরানোর চেষ্টা করতেই ঐশ্বর্য চেঁচিয়ে উঠে বলে,
“আপনি বলতে পারবেন না কারণ আপনি আমাকে ভালোবাসেনই না। ভালোবাসবেনও না। আমি জানি এটা। বিয়ে করেছেন শুধু এবং শুধু মায়ের অনুরোধে। আমি সব শুনেছি।”

প্রেম হতবিহ্বল এবার। বেশ চমকেছে তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ঐশ্বর্য আবারও বলে,
“এতোটা দায়িত্বশীল নাহ হলেও পারতেন আমার প্রতি।”

“এতো রাতে এসব বাদ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”

ঐশ্বর্য রাগে কটমট করে উল্টোদিকে ঘুরে যায়। গটগট করে চলে যায় বেলকনিতে। প্রেম পিছু পিছু যেতে নিতেই ঐশ্বর্য তার মুখের ওপর বেলকনির দরজা লাগিয়ে দেয়। প্রেম হতাশ চোখে দরজার কাছে এগিয়ে এসে তাকে ডাকে।
“ওপেন দ্যা ডোর ঐশ্বর্য। প্লিজ!”

ওপাশ থেকে ঐশ্বর্য নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রেম ওপাশে লাগাতার ডেকে চলেছে। ঐশ্বর্য আজ সাড়া দেবে না কিছুতেই না!

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই।]