#ফেইরিটেল
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–10
তখনো ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেনি। গাড়ির ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার। কেমন গুমোট, ভূতুড়ে ভাব। গা ছমছমে অবস্থা। ইমান খুবই সন্তপর্ণে নিশ্বাস ফেলছে৷ মিরা গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন। তার নিশ্বাসের উষ্ণতা ইমানের বুকে এসে আছড়ে পরছে৷ সে বেশ শক্ত করেই মেয়েটাকে নিজের বুকে আগলে রেখেছে।সে নাহয় সৌজন্যবশত তাকে নিজের বুকে জায়গা দিয়েছে তাই বলে কী, তাই বলে কী, তার বুকটাকে বালিশের সাবস্টিটিউট বানাতে হবে? হুহ!
আনমনে মিরার এলোমেলো চুলগুলোকে নিজের হাতের ভাঁজে গুজে নিল। ভীষণ সিল্কি চুল তার। সে গাড়ির ছোট্ট টিউব লাইটটা জ্বালিয়ে দিল যেন সব পরিষ্কার দেখতে পায়। আচমকা তার মনে হলো, কোন দৃশ্যটা সে ক্লিয়ারলি দেখতে চাচ্ছে? মিরাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে চায় না তো সে? কিয়ৎক্ষণ পর পাখিদের আনাগোনা শোনা গেল। কিচিরমিচির শব্দে মুখোরিত হলো চারপাশ। হালকা আলো এসে চোখে লাগলো। সম্ভবত মৃদু হাওয়াও বইছে। ইমান চুপচাপ বসে থাকলো। এরপর সোনালী আপুর নাম্বারে কল লাগায়৷ আপুও সঙ্গে সঙ্গে ফোন রিসিভ করে যেন তার ফোন কলের অপেক্ষায় ছিল৷
ইমান ফোন কানে নিয়ে বলে, আপু নিচে নামো ইরাকে নিয়ে৷
— মিরু কী করছে?
ইমান প্রশ্নটা শুনেই চোখ নামিয়ে একবার নিজের বুকে মাথা নত করে রাখা রমনীর দিকে তাকায়৷ রমনী তখন নিশ্চিত ঘুমে। সে যেন ঘুমরাজ্যের গ্রীনকার্ড প্রাপ্ত বাসিন্দা।
সে ছোট করে উত্তর দেয়, “আরামে ঘুমাচ্ছে৷”
— ওহ আচ্ছা৷ আমরা নামছি৷ তুই গাড়ি স্টার্ট দে৷
ইমান তড়িৎ গতিতে মিরাকে নিজের বুক থেকে সরিয়ে কাত করে তাকে শুইয়ে দিয়ে।তখন সে ঘুমের মধ্যেই বিরক্তি প্রকাশ করে। যা দেখে ইমান হাল্কা হেসে ফেলে। এরপর নিজে ড্রাইভিং সীটে গিয়ে বসে। মুহুর্তের মধ্যে মনে হলো, বুকটা শূন্য হয়ে গেল। আরো কিছুক্ষণ সেভাবে থাকলে মন্দ হত না।
আপু মিনিট দশের মধ্যে ইরাকে নিয়ে নেমে আসলো। এরপর গাড়ি চলতে শুরু করে বাসার উদ্দেশ্যে।সবার মুখে-চোখে একটা চিন্তার ছাপ। যদি ধরা পড়ে যায়? যদিও তাদের ফুলপ্রুভ প্লান আছে তাও অচেতন মিরাকে নিয়ে যতো ঝামেলা৷ গাড়ি বাসার সামনে আসতেই সোনালী আপু প্রশ্ন করে, মিরু তো গভীর ঘুমে। ওকে বাসায় নিয়ে যাব কীভাবে?
ইরা অবশ্য কিছুই বুঝে পাচ্ছে না। হুট করে সোনালী আপু তার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়ে বললো, এখন এই ভোরবেলা নাকী তারা বাসায় যাবে৷ অথচ আপুর ননদ রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে বলেছিল, তাদের জন্য নাকী সে সকালে ব্রেকফাস্টে কুকিজ বানাবে৷ এখন আবার মিরা আপু গাড়িতেই ঘুমাচ্ছে। ঘটনাগুলো তার কাছে সন্দেহজনক লাগছে। আপুকে জিজ্ঞেস করার সাহস হচ্ছে না। সে গাড়ি থেকে নেমে গেল। ইরা আরো অবাক হলো যখন ভাইয়া নিজ থেকে মিরা আপুকে কোলে তুলে নিল। মানে আপুকে ডাক দিলেই তো পারত৷ পারত না? আর আপুই বা এতো কেন ঘুমাচ্ছে যে একজন তাকে শূন্যে তুলে নিলেও ঘুম থেকে জেগে উঠবে না। সবকিছু কেমন রহস্যময় লাগছে তার কাছে৷
_________________________
মিরার যখন ঘুম ভাঙ্গল। তখন বেলা অনেক। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। অথচ সে ঘেমে-নেয়ে একাকার। ঘুমের মধ্যেই ঘেমে গেছে। উঠে বসতেই সে দারুণ আশ্চর্যজনক দৃশ্য দেখল। এই দৃশ্যকে হ্যালির ধূমকেতুও বলে যেতে পারে তাহলোঃ ইরা পড়তে বসেছে। তাও সোনালী আপুর বিয়ের দিন। উঠে বসার পর-পর সে অনুভব করব তার মাথা ব্যথা করছে৷ সে মনে করার চেষ্টা করল রাতে কী হয়েছিল? পার্টি থেকে বাসায় ফিরলো কীভাবে? কিন্তু কিছুই মনে করতে পারলো না৷ তাই বাধ্য হয়ে ইরা ডেকে উঠে সে।
ইরা অমনোযোগী হয়ে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিল। বোনের ডাক শুনেই বই বন্ধ করে দিল৷
সে চেয়ার ঘুরিয়ে বোনের দিকে ঘুম করে মুখ কালো করে বলে, কী?
— ঘটনা কী রে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না৷ আমরা না পার্টিতে ছিলাম। বাসায় কি করে আসলাম?
ইরা ঠোঁট বাকিয়ে উত্তর দেয়, ঘুমিয়ে থাকলে জানবে কীভাবে?
মিরা ভ্রু কুচকে বলে, মানে?
ইরা বিরক্ত গলায় বলে, তুমি ঘুমাচ্ছিলে জন্য বেচে গেছো৷ বড় আব্বু জেনে গেছে আমরা ফুপুর বাসায় যাইনি৷ পরে আমাদের তিনজন কে নাস্তার টেবিলে জেরা করল। ভাগ্যিস ইমান ভাইয়া ছিল জন্য বেশি বকা খাইনি। ভাইয়া বলেছে গাড়ির ইঞ্জিন মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেছে জন্য সাহায্যের জন্য সোনালী আপু খুব ভালো এক ফ্রেন্ডেকে কল দিতেই জোর করে বাসায় নিয়ে গেল। ডিনার করিয়ে আর ছাড়ে না। রাতে সেখানেই থেকেছি। ওনার মা খুব রিকুয়েষ্ট করছিল থেকে যাবার জন্য। বড় আব্বু অবশ্য বকেনি৷ কিন্তু মা বকেছে। এইজন্য এখন পড়ছি।
মিরা ঠোঁট গোল করে, ও বলে। এরপর বলে কিন্তু আমি বাসায় আসলাম কীভাবে?
— ইমান ভাইয়া তোমাকে কোলে তুলে নিয়ে এসেছে। এতো ঘুমাচ্ছিলে তুমি। এই পরিস্থিতিতে একটা মানুষ ঘুমায় কীভাবে? সোনালী আপু যখন ভোরে আমাকে ডাকল, ভয়ে আমার হাত জমে যাচ্ছিল।
ইরার কথায় গুরুত্ব দিল না আর সে। সে আপাতত অন্য চিন্তায় মগ্ন। ছাদের বেশিরভাগ কথাই তার মনে আসছে না। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর সে কার কাছ থেকে পাবে? ইমান্ন?অসম্ভব! ওই ফাযিলকে সে কোনদিন কিছু জিজ্ঞেস করবে না৷
সে উঠে বসল। নিজের হাতের দিকে তাকায় সে।কি সুন্দর রাঙ্গা রঙ ধারণ করেছে! দেখলেই মন ভালো হয়ে যাচ্ছে। সে দু’হাত নিজের নাকের কাছে এনে মেহেদীর ঘ্রাণ নিল। মেহেদীর গন্ধটা তার ভালো লাগে। লাল টকটকে দু’হাত ভর্তি মেহেদী দেখে তার নিজেকেই বধূ লাগছে। এতো গর্জিয়াস করে কেন আর্টিস্ট তাকে মেহেদী পড়িয়ে দিল? ইরার মেহেদী সে দেখেছে, খুবই সিম্পেল ডিজাইনে হাতের উল্টোপিঠে শুধু দেওয়া। অথচ তার হাতে একদম ব্রাইডাল ডিজাইনে মেহেদী দেওয়া। বিষয়টা অদ্ভুত।
আজ সকাল থেকে ব্যস্ততা যেন বহুগুণ বেড়ে গেল। বিয়ের অনুষ্ঠান বিকেলে। আপু ইতিমধ্যে পার্লারে যাবে। তার সঙ্গে মিরাও যাবে। এইজন্য সে নিজের লেহেঙ্গা ব্যাগে গুছিয়ে নিয়ে আপুর অপেক্ষা করতে লাগলো। সে জীবনে প্রথম পার্লারে গিয়ে সাজবে। এক্সাইটমেন্টে যেন সময় থমকে গেছে। ওমন সময় তার রুমের দরজায় নক হওয়ার শব্দ ভেসে এলো।
সে বলে উঠে, কে?
— এক কাপ চা বানায় দাও তো৷
আদেশকারীর কণ্ঠ শুনেই তার মেজাজ চটে গেল। সবসময়ই কী ব্যাটা তাকে দিয়েই কাজ করিয়ে নিবে? মানে কাজের সময় মিরা আর অন্যসময় ঘুরেও তাকাবে না।
মিরা দরজা খুলে দিয়ে বলে, পারব না৷
— তাহলে আমিও তোমাদের ড্রাইভারি করতে পারব না৷
— ড্রাইভার আংকেল কই?
— বড় মামার সঙ্গে বাজারে গেছে৷
মিরার মুখে কালো মেঘের আনাগোনা। সে দ্রুত যেতে ধরলে, ইমান বলে উঠে, আজকে লবণ দিলে খবর আছে কিন্তু।
মিরা ভেংচি কেটে রান্নাঘরে অগ্রসর হয়। মিনিট পনের পর সে যখন চা নিয়ে ইমানের রুমের প্রবেশ করে। তখন জনাব চুলে জেল লাগাচ্ছিল। মিরা দেখবে না দেখবে না করেও তিনবার তাকে পরখ করে নিল। এরপর চা টেবিলে রেখে চলে যেতে ধরলে সে বলে উঠে, দাড়াও৷
মিরা থেমে গিয়ে বলে উঠে, কি?
— চায়ে একটা স্লিপ দাও৷
— মানে?
— গতবার লবণ দিয়েছিলে এবার যদি বিষ দাও? কাজেই এবার তুমি আগে খাবে৷ এরপর পাচ মিনিট পর আমি খাব। চায়ে বিষ থাকলে এই পাচ মিনিটে নিজের জালে নিজে ফাসবা৷
মিরা দাতে দাত চেপে চায়ে স্লিপ দিল এবং সত্যি সে পাচ মিনিট দাড়িয়ে থাকল৷
ইমান চুল স্পাইক করে তার সামনে এসে দাড়ালো এবং চায়ের কাপ হাতে তুলে নিয়ে যেদিকটা দিয়ে মিরা চুমুক দিয়েছে সেই জায়গায় একটা স্লিপ দিয়ে বলে, একটু বেশিই মিষ্টি৷
— চিনি একদম ঠিক আছে। দু’চামচে মোটেও বেশি মিষ্টি হয় না৷
ইমান হাসলো। কিছু বললো না।
এরপর তারা সকলে অনুষ্ঠানে কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়৷ মিরা পার্লারে যায়। সেখান থেকে সোজা আপুর সঙ্গে কনভেনশন হলে সে পৌঁছে যায়৷ কনভেনশন হল তখন ফাকা৷ আপুর ফটোসেশান চলছিল। ওমন সময় একটা ফুলবিক্রেতা বাচ্চা এসে তাকে একটা গোলাপ এবং চিরকুট দিয়েই দৌড়ে যায়৷ মিরা হতভম্ব হলো তার কাজে। চিরকুট খুলতেই গোটা গোটা বাংলা অক্ষরে লেখাঃ গোলাপটা কানে গুজে দিলে আরো বেশি সুন্দর লাগবে৷
মিরার ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে উঠে৷ কে হতে পারে এই ব্যক্তি! সে খোলা চুলের ভাজে গোলাপ গুজে দিল। তখনই আরেকটা বাচ্চা এসে আরেকটা চিরকুট দিয়েই ছুট লাগায়। সে পুনরায় অবাক হয়ে অতি আগ্রহ নিয়ে চিরকুটের ভাজ খুলে সেখানে বাংলা অক্ষরে লেখাঃ গলার ডান পাশের আদুরে তিল জোড়া যেন আর কেউ না দেখে। ইতি তোমার সিক্রেট লাভার৷
চলবে৷
#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–11
সিক্রেট লাভারটা কে? তাকে খুঁজতে গিয়ে মিরা একদম ডিটেকটিভ শার্লক হোমস হয়ে গেল তবুও দ্যা গ্রেট লাভার কে হতে পারে তার বিন্দুমাত্র হিন্টস পাওয়া গেল না৷ কনভেনশন হলে ইনভাইটেশন পাওয়া ব্যক্তিবর্গের মধ্যেই নিশ্চয়ই লাভার বয় লুকিয়ে আছে৷ বলতে গেলে, এই অনুষ্ঠানে আপাতত কোন ছেলেই আসেনি। সে আর সোনালী আপুসহ পএখানে আরো তিনজন আছে। যারা সন্দেহের তালিয়ায় পরে না। সে একজন ওয়েটারকে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে৷
সে বলে উঠে, “এই যে মামা এই হলে কোন ছেলে এসেছে কী? মানে এন্ট্রি গেট দিয়ে কোন ছেলে ঢুকেছে?”
উনি মনে করার চেষ্টা করলেন এরপর বলে উঠে, “না আপা। কাউকে তো দেখলাম না৷”
মিরা আচ্ছা বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। ওয়াটার যেই না নিজ কাছে মন দিবে, ওমনি তার খেয়াল আসলো, ইমান ভাই একটু আগেই বেরিয়ে গেছে। উনি বিকেলেই এসে হলের ডেকোরেশন চেক করে গেছেন। কিন্তু এটা আর আপাকে বলা হলো না।
বিয়ের অনুষ্ঠান জমজমাট হলো। অনুষ্ঠানে গেস্ট ও এসেছেন অনেক। পরিবারের সবাই গেস্টদের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত। মিরার কলেজের ফ্রেন্ড এসেছে। সেও ব্যস্ত তাদের সঙ্গে মজা করায়৷ খাওয়া-দাওয়ার সময় মিরা তার ফ্রেন্ডদের সঙ্গে বসলো। উদ্দেশ্য একসঙ্গে মজা করা এবং ফ্রেন্ডদের যেন একা একা বোর ফিল না লাগে৷ ইমান আবার সোনালী আপুর ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করছে। প্রতি ব্যাচের প্রতি টেবিলে-টেবিলে গিয়ে গিয়ে দেখছে ঠিকমতো সব দেওয়া হচ্ছে কীনা। গেস্টরা খেতে পারছে কীনা৷ মিরা যেই টেবিলে বসেছে, তার সামনে গিয়েই সে দাঁড়ালো। আড়চোখে দু’জনের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় ঘটে৷ মিরা ইশারায়-ইশারায় তাকে ভেংচি কেটে এখান থেকে সরে যেতে ইঙ্গিত দেয়৷ সে বুঝেও এমন একটা ভান ধরে যেন কিছু-ই বুঝেনি৷
অতঃপর এগিয়ে আসে আরো কয়েক কদম। তারপর আগ বাড়িয়ে বলে উঠে,” হ্যালো সুন্দরী আপুরা তোমরা সবাই কেমন আছো?”
মিরার বান্ধবী লামিয়ে বলে উঠে, “ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”
প্রশ্নটা শুনে মিরা হা হয়ে যায়। প্রথম কথোপকথনেই ডিরেক তুমি!
ইমান মুচকি হেসে বলল, “তোমাকে দেখার পরও কী খারাপ থাকা সম্ভব?”
লামিয়া হাসল। ইমানও হাসে। তাদের হাসি দেখে মিরার মেজাজ খারাপ হতে লাগে। সে জগ উঠালো অথচ পানি গ্লাসে ঢাললো না। এরপর শব্দ করে কাঁচের জগটা টেবিলে রেখে নিজের উপস্থিতি জানান দিল৷
ইমান বলে উঠে, তোমাদের কোন সমস্যা হলে জাস্ট একবার আমাকে মনে করবে৷
মিরা মনে মনে বলে, সমস্যার ভাণ্ডার নাকি সমস্যার সমাধান করবে? কই তার নিজের কত-শত সমস্যা, একবারও তো জনাব জিজ্ঞেস অব্দি করেনা, মিরা তোমার সব ঠিকঠাক? কোন অসুবিধা নেই তো? বরঙ যেন আরো বুদ্ধি আটে কীভাবে তাকে ফাঁসাবে, কোন ঝামেলায় ফেলানো যায়৷
আচমকা তার খাবারের প্লেট থেকে ইমান জালি-কাবাবের পিস নিজের হাতে তুলে নিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে চলে গেল। এমন না যে কাবাব নিয়ে যাওয়ায় মিরার সমস্যা। এতো ছোট মন নয় তার। বরং সে অবাক এইজন্য যে, ইমানের সামনেই সে কাবাবে একটা কামড় বসিয়েছে। সেই আধ খাওয়া কাবাব কেন সে খাবে? বাটিতেই তো নতুন দু-দু’কাবাব এখনো আছেই।
সে সঙ্গে সঙ্গে ইমানকে ফোন দিল। আজকে সকালে কেন যেন সোনালী আপুর কাছ থেকে পার্লারে যাওয়ার টাইমে তার নাম্বার নিয়েছে। কেন যেন নাম্বার নেওয়ার সময় তার বড্ড লজ্জা লাগছিল। সোনালী আপু তো মুখ ফোসকে বলেই দিল, তুই যেমন লজ্জা পাচ্ছিস সামান্য ফোন নাম্বার পেতে, টাংকি কেমনে মারবি?
মিরা আরোও লজ্জা পেয়ে বলে, উফফ আপু,আমি মোটেও টাংকি মারব না। হুহ।
সোনালী আপু হোহো করে হেসেছিল শুধু। অতীতের চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে মিরা তাকে কল দিল। বলার ইচ্ছা ছিল, আপনি কেন আধ-খাওয়া কাবাব নিবেন? আপনার খেতে ইচ্ছা হলে ফ্রেসটা নিন। কাবাব শেষ হয়ে গেলে, দরকার পড়লে আমি ভেজে খাওয়াব আপনাকে। এই মধুর কথাগুলো, ফোনের ওপাশে আর পার হলো না। বরং মিরা কর্কশ গলায় বলে, আপনি পারমিশন না নিয়ে আমার প্লেট থেকে কেন কাবাব তুলে নিলেন?
ওপাশ থেকে উত্তর এলো, নিজের প্লেট থেকে খাবার তুলে নিতেও পারমিশন লাগে?
মিরা বিরক্ত হয়ে বলে, এটা মোটেও আপনার প্লেট না।
— ওহ সর্যি। আমি ভেবেছিলাম ওইটা আমারই প্লেট৷
মিরা বিরক্তিতে চ বর্ণ উচ্চারণ করে ফোন কেটে দিল। সঙ্গে সঙ্গে সে মাথায় একটা ভাবনা আসলো, ইমান একবার জিজ্ঞেস কেন করল না ফোনের অপর প্রান্তে কে? ইমান কী আগে থেকেই তার নাম্বার নিজের ফোনে সেইভ করে রেখেছে?
এই ছেলের সঙ্গে কথা বলা মানে নিজের পায়ে কুড়াল মারা৷ কীজন্য সে এই ছেলেটাকে ভালোবাসল? সৃষ্টিকর্তার কাছে সে মনে-প্রাণে দোয়া করছে যেন তার ভালোবাসা দিনকে দিন কমে যায়৷ কিন্তু নাহ, উলটা আরো বাড়ছে। এই যে ও তার আধ-খাওয়া কাবাবটা মনের ভুলে খেয়ে নিল, তার কী যে ভালো লাগছে! নিজেকে স্পেশাল লাগছে। সিনেমায় দেখায় না? এক আইসক্রিম দুইজনে মিলে খায়! তারাও একই কাবাব দু’জনে মিলে খেল।
তাকে চিন্তার রাজ্য থেকে বেরিয়ে আনলো তার ফ্রেন্ড লামিয়া। সে খেতে খেতে বলে উঠে, মিরু, তোর কাজিনটা সেই হ্যান্ডসাম রে৷ উফফফ পোলা নাতো যেন আগুনের দলা। আমার সঙ্গে সেটিং করায় দে না দোস। তারপর বিয়ে করে সোজা নিউইয়র্ক যাব৷
মিরা মনে মনে ক্ষুব্ধ হলো৷ তার বান্ধবী কত বড় লুচু মেয়ে।
সে ঝারি মেরে উঠে বলে, খবরদার ওনার দিকে তাকাবি না৷
লামিয়া চোখ গোল গোল করে বলে, কেন রে?তোর উনি কী আমাদের দুলাভাই যে প্রেম করা যাবে না?
মিরা লামিয়ার চুল টেনে বলে, খুব শখ না ওনার সঙ্গে প্রেম করার? বেয়াদব মেয়ে৷
লামিয়া রেগে যাওয়ার পরিবর্তে হাসল৷ সে জানে মিরার যখন রাগ উঠে তখন সে অন্যের চুল ধরে টানে। সেই ছোট্টকাল থেকে মিরার ফ্রেন্ড হওয়ায় কতবার যে মিরার চুল টানার স্বীকার হলো সে!
সে হাসতে হাসতে বলে, উনি-ই সেই বাদড় যার উপর ক্রাশ খেয়ে আপনি রাত একটায় বিছানায় গড়াগড়ি খেয়ে আমাকে ফোন দিয়েছিলেন?
মিরা তাকে সর্তক করে বলে, আস্তে বল। শুনে ফেললে?
— তোকে বাদড়ের সঙ্গে মানায় খুব৷ বাদড় ভাই শুনে ফেললে তো দারুণ হয়৷ এক দিনে দুইবোনের বিয়ে ডান।
মিরা লামিয়ার হাত ধরে ফেলে বলে, চুপ কর তো তুই। তোরা সবসময় আমার সঙ্গে মজা নিস৷ আর ওনাকে বাদড় বলবি না। উনি কী বাদড় নাকি?
— তুই-ই ডাকিস এই নামে।
-সে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে, আমি ডাকলে সমস্যা নাই।
লামিয়া আরেকদফা হেসে ফেলল।
_______________________
সোনালী আপুর বিয়ের অনুষ্ঠান প্রায় শেষ হতে লাগলো। আর কিছুক্ষণ পর বিদায়। মিরা স্টেজের সামনের সোফায় বসে মাত্র ফোন হাতে নিয়েছে৷ এমনই সময় সে দেখল, দাদী ইমানের হাত ধরে এদিকে হেঁটে আসছে। সে আমলে নিল না। কারণ বেশিরভাগ সময় দেখা যায়, দাদী ওর প্রতি অতিরিক্ত আদিখ্যেতা দেখায়৷ সে ফোনের স্ক্রিনে মনোযোগ দিতেই দেখল দাদী তার সামনে এসে থামল। মিরা দ্রুত ফোন সরিয়ে রাখল এবং মুখ তুলে তাকালো। তার সামনে ইমান দাঁড়িয়ে আছে৷ তার হাতে দাদীর পানের বাটা। এই জিনিসটা, ছেলেটার মিরার খুব ভালো লাগে, যে সে বড়দের প্রচুর সম্মান করবে, কেয়ার করে।
মিরা তাকে শক্রু ভাবলেও প্রশংসা না করে না পারে। যে ব্যক্তি নিজের শক্রুর গুণগুলোকে স্বীকার করে, বুঝে নিতে হবে সে চরিত্রবান।
দাদী হাসিমুখে বলে, এই মিরা দাঁড়া তো একটু৷
সে ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলে, আমি?
ইমান ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে বলে, আর কারো নাম কি মিরা?
সে তৎক্ষনাৎ দাঁড়িয়ে পরে। দাদী তার হাত ধরে টেনে এনে তাকে, তার আর ইমানের মাঝে দাড় করিয়ে দিয়ে, তার কপালে একটা চুমু দিয়ে বলে, অনেক বড় হ।
দাদীর আদর মিরা অনেক দিন পর এভাবে পেল। দাদী অসুস্থ হওয়ার পর কেমন গুটিয়ে ফেলেছেন নিজেকে।
তখনই পাশে তার বাবা-মা আর বড় আব্বু এসে ভীড় জমালো৷ দাদী হুট করে তার ডান হাতটা ধরে একটা আংটি পরিয়ে দিল। সোনার আংটি। এবং তার হাতটা ইমানের হাতে তুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে মিরার গা বেয়ে যেন বিদ্যুৎ বয়ে গেল। সে আতকে উঠে। ঘটনার কিছুই তার বোধগম্য হচ্ছে না। সবটা পাখির মতো মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে৷ মায়ের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করলে সে দেখল, মা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে৷ এমন কী বড় আব্বুও মুচকি হাসলেন। তবে বাবার মুখ গোমড়া।
ইমানের হাতে পান বাটার চুন লেপ্টে ছিল। সেই চুন তার হাতে লেগে একদম ঘেটে গেল। সে তিনবার চেষ্টা করল নিজের হাতটা তার হাতের মুষ্টি থেকে সরিয়ে নেওয়ার। কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছে। সে অনেক শক্ত করে ধরেছে তাকে যেন মিরা ছাড়া পেলেই দৌড়ে পালিয়ে যাবে৷
সে ফিসফিস করে বলে, আমার হাত ছাড়ুন৷
সেও ফিসফিস করে বলে, ছেড়ে দিব বলে ধরিনি। ধরে রাখার জন্য ধরেছি। আর একবার ধরে রাখার জন্য ধরলে ছেড়ে দেওয়া বারং৷
— কি হচ্ছে এখানে?
— তোমার কথামতো, তোমার বাবা-মা, বড় আব্বুর পারমিশন নিয়ে তোমাকে কফি ডেটে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছি।
“কফি ডেট” শুনেই মিরার মুখ হা হয়ে যায়। সে চমচমের মতো চোখ গোল করে তাকায় ইমানের দিকে। ইমান হাসিমুখ করে সামনে তাকিয়ে আছে। কোন ফাঁকে যে ফটোগ্রাফার এসে তাদের ছবি তুলে ফেলল সে খেয়ালও করেনি৷ একটা সময় পর কাজের জন্য ইমান তার ছেড়ে দিয়ে চলে যায়।
আপুর বিদায়ের সময় মনে হয়, আপুর চেয়ে বেশি মিরাই কাঁদলো। কাদতে কাদতে হিচকি তুলার মতো অবস্থা। আরো কিছুক্ষণ সেভাবে কাঁদলে জ্ঞান হারাবে এই ভয়ে ইমান তাকে পানি খাওয়াচ্ছে। টিস্যু সাপ্লাই দিচ্ছে৷ সান্ত্বনাস্বরুপ এটাও বলল যে আগামীকাল সকালেই আপুর বাসায় তাকে নিয়ে যাবে৷ তবুও মিরা থামে না।এদিকে গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার সময় হচ্ছে৷
সোনালী আপু ইমানকে উদ্দেশ্য করে বলে, এই মেয়ে নিজের বিদায়ে কী কাণ্ড ঘটাবে কে জানে? তোর উপর দিয়ে অনেক ধকল যাবে রে।
মিরা কাদতে কাদতে হাল্কা থামল। আপুর কথায় হাল্কা যা আভাস পাচ্ছে তা সে কল্পনাও ভাবতে চায় না৷
ইমান মিটমিট করে হেসে বলে, কান্না থামাও তো তুমি।
মিরা তখন আরো বেশি কাদা শুরু করে। সেটা লক্ষ্য করে প্রান্ত ভাইয়া আর তার বোন বলে উঠে, মিরাও সোনালীর সঙ্গে আসুক। বোনের সঙ্গে তার শ্বশুড়বাড়ি গেলে এট লিস্ট তার কান্না থামবে৷ মিরাও যেতে রাজী হয়ে যায়৷ এবং আপুর সঙ্গে সে গাড়িতে উঠে পরে৷
সোনালী আপুর শ্বশুড়বাড়ি গেণ্ডারিয়া। এখান থেকে খুব দূরে না তবুও ইমানের কেন যেন মনে কু ডাকতে লাগল। মনের ভেতর খচখচ করতে লাগলো কিছু একটা৷ বিদায় পর্ব শেষ করে আপু গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ি চলতে শুরু করলে, ইমানের অস্বস্তি ক্রমেই বৃদ্ধি পায়৷
চলবে।