ফেইরিটেল পর্ব-১২+১৩

0
790
ফেইরিটেল
গল্পেরমহল ধারাবাহিক গল্প

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–12

নগরী তখন ঘুমিয়ে আছে। সারাদিনের তপ্ত, গুমোট ভাবটা ক্রমশ কমে গিয়ে আধার রজনীতে হীম শীতল বাতাসের আবির্ভাবে পরিবেশ ক্ষণে ক্ষণে ঠাণ্ডা হতে আরম্ভ করেছে। মেঘে ঢাকা পরে গেছে চাঁদখানা। তির্যকভাবে সামান্য হলেও নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে চাঁদ মামা। জানালার কিনার ঘেঁষে লোহা দিয়ে বানানো শিকে হাত রাখল ইমান। শিকের গোড়ায় জং ধরে গেছে। পুরনো জানালায় মরিচা ধরে ক্ষত প্রায়৷

দূরে কোথায় কুকুরের দল ক্ষুধায় কান্না করছে। মৃদ্যু শব্দে সেই কান্নার আওয়াজ ভুতুরে লাগছে। পাশের গাছটার পাতা মড়মড় আওয়াজ তুলে মৃদু কম্পিত হচ্ছে৷ জানালা দিয়ে নাম না জানা ফুলের সুমিষ্ট ঘ্রাণও ভেসে আসছে। সে ঠাওর করতে পারছে না কোন ফুলের গন্ধ এতো মিষ্টি? কালকেই খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে আশেপাশে কোনো ফুলের গাছ আছে কীনা। সে জানালার ফাঁক দিয়ে দৃষ্টি নিয়ে গেল একদম অসীমে। যেখানটায় আজ তারার হাঁট বসেছে। মিটমিট কিরণ দিয়ে তারারা হাসছে, খেলছে। দূরের নক্ষত্র থেকেও খানিক আলো বিকিরণ হচ্ছে!

সে একটা দম ফেলল। ঘুম আসছে না তার। ঘড়ির কাটা জানান দিচ্ছে তিনটা বাজে দশ মিনিট । বাংলাদেশ আসার সাত দিন অব্দি তার সমস্যা ছিল জেটলকের কারণে৷ ঘুম হতো না রাতে আর সারাদিন চোখে ঘুম খেলা করত। বহু কষ্টে জেগে থাকলেও দেখা যেত সে বিকেলের মধ্যে ঘুমে মগ্ন। আপাতত এই অভ্যাস পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু তবুও আজ বিশেষ এক কারণে ঘুম আসছে না তার। কারণটা হলো আজ সে যেই রুমটায় অবস্থান করছে সেই রুমটা তার মায়ের। কোন এককালে মা এরুমে থাকতেন। তারপর সোনালী আপুর দখলে চলে যায় রুমটা। আজ আপুও চলে গেলে দ্বিতীয়বারের জন্য। রুমটা শূন্য হয়ে গেল৷ আপুর রুমেই আজ ইমান নিজের শোয়ার ব্যবস্থা করেছে৷ খাট-পালং নাকী আগের গুলোই আছে। একথা নানী তাকে জানিয়েছে। তবে পড়ার টেবিল আর আলমারি নতুন কেনা হয়েছে৷ মা যে বিছানায় একসময় ঘুমাতেন সেই বিছানায় আজ সে ঘুমাবে। ভাবতেই হৃদয়ে এক শীতল মন খারাপ হুহু করে প্রবেশ করছে৷ অথচ তার ভালো লাগার কথা ছিল!

বিকট শব্দে মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলে সে চকিত দৃষ্টিতে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকায়। “জুই” ইজ কলিং লেখা দেখামাত্র মনের মধ্যে কেমন উত্থাল-পাতাল শুরু হলো। জুই কেন কল করছে তাকে? তাও এতো রাতে! অবশ্য সেখানে এখন রাত নয়৷ ইমান ফোন হাতে নিলেও রিসিভ করল না। সাইলেন্ট করে রাখল৷ ফোন কেটে গিয়ে আবারো রিং বাজল। সে নির্বিকার চিত্তে জানালা গলে মৃদ্যু চাঁদের আলো দেখায় ব্যস্ত। কী ভীষণ সুন্দর লাগছে জং ধরা সেই লোহায় জানালাটা৷

মায়ের স্পর্শ রাখা সবকিছুই কী সন্তানের কাছে শ্রেষ্ঠ? এই শিকগুলোয় মায়ের পরশ আছে। নানী তো বলেছেন, মা নাকী রোজ শিক ধরে দাঁড়িয়ে ওই দূরের রাস্তা দেখত। কী দেখত তা কেউ জানে না৷ কিন্তু মিনিটের পর মিনিট তার অতিবাহিত হত এই জানালার ধারে৷ মা নাকী প্রকৃতিপ্রেমী খুব!

ম্যাসেজের টোন কানে আসল। পুনরায় সে ফোন হাতে নিল। জ্বলজ্বল করে কৃত্রিম আলো তার চোখে এসে ধাক্কা খেল। ম্যাসেজে লেখাঃ কল মি ব্যাক এজ সুন এজ পসিবেল।

ইমান অগত্যা কল লাগায় সাত সমুদ্র তের নদী দূরের দেশ আমেরিকায়৷ মুহুর্তেই ফোন রিসিভ হলো। মিহি কণ্ঠে আমেরিকান এ্যাকসেন্ট নিয়ে সে বলে উঠে, হাই।

— হ্যালো। কোন দরকার?

মেয়েটা ফোনের ওপাশ থেকে আহ্লাদী কণ্ঠে বলে, আমার কী শুধু দরকারেই ফোন দেওয়ার অনুমতি আছে?

সে হাল্কা হেসে বলে, ঠিক তা না। কিন্তু ম্যাসেজটা এমনই ছিল যে দরকার আছে৷

— আমি বলেছিলাম দ্রুত কল দাও৷

— এর অর্থই তো জরুরি কিছু।

মেয়েটা ওপাশ থেকে চমৎকার শব্দে হাসল। এরপর বলে উঠে, ওই বাক্যের আরো অনেক মানে আছে মিস্টার খান৷

ইমান বুদ্ধি খাটিয়েও ধরতে পারল না, ওই বাক্যেটা আর কী কী অলটারনেটিভ অর্থ বহন করতে পারে। কিন্তু অসফল হলো সে।

জুই বলে উঠে, তুমি বাসায় নাকী একবারও কল দাওনি। এমন কী পৌঁছেও কল দাও নি। আংকেল জো ইজ ওরিড ফর ইউ। চিন্তায় আছেন। আজকে মিট হলো ওনার সঙ্গে। আমাকে ব্যাপারটা জানালো। সো আই কলড ইউ৷

ইমান হাল্কা হাসল। সে ভাবনাতেই আনেনি যে কাউকে জানাতে হবে সে ঠিকভাবে বাংলাদেশ পৌঁছে গেছে৷ তাকে নিয়ে চিন্তা করার কেউ নেই এটা সে খুব ভালো করেই জানে৷ তবুও বলে উঠে, আচ্ছা কল দিব। এনিওয়ে, ওদিকে সব ঠিক?

জুই রিনরিনে আওয়াজে বলে, ওনেস্টলি আই এম মিসিং ইউ।

সে যেন হোচট খেল। মিস ইউ শব্দটা তার বিরক্ত লাগে খুব। আজ অব্দি কাউকে এ”দুটো শব্দ সে উচ্চারণ করে শোনায়নি৷

ইমান নিশ্চুপ রইল। সে বলে উঠে, কাজের চাপ খুব৷ আমার মনে হয় তোমাকে দ্রুত নিউইয়র্ক ফিরে আসতে হবে। তোমাকে ছাড়া কাজ আগাচ্ছে না।

— ওখানে কোন সমস্যা হয়েছে কী?

— পাচজন ওয়াকার ছাটাই করা হয়েছে। নিউ ডিল সাইন করা হয়েছে কিন্তু প্রজেক্টের কাজ আগাচ্ছে না। আটকা পড়ে যাচ্ছে৷ আগামী আসেই প্রজেক্ট লঞ্চ করতে হবে। তোমাকে বুঝি দ্রুত ফিরে আসতে হবে৷

— দেখি৷

— তোমার কাজিনের বিয়ে কেমন হলো?

ইমান এবারে কিছু বলার মতো শব্দ খুজে পেল নিজ শব্দভাণ্ডার থেকে। সে স্নান হেসে বলে, খুব ভালো। আজকেই আপুর বিয়ে হলো।

— অনুষ্ঠান শেষ তাহলে?

— বলতে গেলে হ্যাঁ। মেইন প্রোগ্রাম শেষ। তবে ফিরানি বাকি আছে।

— ফিরানি কি জিনিস?

ইমান ভুলেই গিয়েছিল যে জুই বাংলাদেশী না। তার জানার কথা না, ফিরানির অর্থ৷

সে বলে উঠে, “ফিরানি বাঙ্গালী ঐতিহ্যর একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠান। কন্যা কে শ্বশুড়বাড়ি পাঠানো হয়। এরপর প্রথম যেদিন বিয়ের পর মেয়ে নিজের বাবার বাড়ি আসে স্বামীসহ সেই দিনটায় ফিরানির অনুষ্ঠান করা হয়৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাবা-ভাই গিয়ে মেয়েকে নিয়ে আসে বাড়ি।মেয়েকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয় জন্য ফিরানি৷”

— তোমাদের দেশের মেয়েরা কি বিয়ের পর আর নিজের বাবার বাসায় আসতে পারে না?

— পারে তো৷

— তাহলে ফিরানি কেন হবে? তার বাড়ি সে যখন ইচ্ছা আসবে। এখানে উৎসবের কোনো প্রয়োজন দেখছি না। সে তো আর মেহমান না৷

— অনুষ্ঠান তো অনুষ্ঠানই। এতো লজিক দেখে বাংলাদেশে কাজ হয় না। এখানে মুসলমানিতেও দাওয়াত করে খাওয়ানো হয়৷

— বাংলাদেশ তোমার অনেক প্রিয় আর পছন্দের তাই না?

— হ্যাঁ।

জুই সুরেলা কণ্ঠে বলে, আর আমি?

ইমান কিছুটা ভড়কে গেল আচমকা আউট অফ টপিক কথা শুনে। সে কি বলবে ভেবে পেল না তাই প্রসঙ্গ পালটে বলে, আমি অনেক ক্লান্ত। আজ রাখছি। ঘুম পাচ্ছে প্রচুর৷

— গুডনাইট। তোমার ফিরে আসার অপেক্ষায় আছি।

ইমান সত্যি সত্যি এবারে বিছানায় শুয়ে পরে ফোন কল কেটে দিয়ে। জুইয়ের সঙ্গে কথা বলার পর তার প্রচুর ক্লান্ত লাগছে। অবসাদ এসে ভর করছে শরীরে এবং মনের কোথাও যেন একটা অনুতপ্ত এবং একই সঙ্গে অপরাধবোধ কাজ করছে। জুইয়ের সঙ্গে কী সে অন্যায় করতে চলেছে? বাস্তবতা এতো বিষাক্ত কেন? সবকিছুই মুহুর্তের মধ্যে অসহ্য লাগতে শুরু করল৷ প্রচুন্ড মাথাব্যথা অনুভব করতে লাগলো সে৷ খুব করে বলতে ইচ্ছা করছিল, “আমার ফিরে আসবাব অপেক্ষা করো না” কিন্তু শব্দগুলো না বলা রয়ে গেল। সাহস সঞ্চার করে সে বলতে পারলো না৷

★★★

মিরা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে। আপুর শ্বশুড়বাড়িতে তার ঘুম ভালো হয়েছে৷ এক ঘুমে রাত পার৷ সে একটা হাই তুলে বাথরুমে গেল। এরপর রুমের বাইরে পা রাখতেই দেখা মিলা রাকিবের। সে রাকিবকে দেখে সামান্য হাসল৷

রাকিবও বিনিময়ে হাসি দিল এবং বলল, তুমি যে এত কাদতে পার এটা চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না৷

মিরা সামান্য লজ্জা পেল। সে আমতা করে বলে, আপুর জন্য কষ্ট লাগছিল৷

রাকিব আচমকা ছুটে গিয়ে তার জন্য এক কাপ চা এনে বলে, বেড টি!

চা হাতে নেওয়ার সাথে সাথে মিরা চায়ের তরল অংশে ইমানের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। তার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। মাথাটাই গেছে নিজের। যেখানে সে নেই, সেই-খানেও আজ-কাল তাকে দেখা শুরু করে দিয়েছে৷

রাকিব বলে উঠে, আজকের দিনের মতো প্রতিদিন বেডটি সার্ভ করতে দিলে নিজেকে ভাগ্যবান ভাববো।

চলবে।

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–13

মিরা অদ্ভুত নয়নে তাকালো। আশেপাশে কোথায় ইমান নেই কিন্তু তার প্রতিচ্ছবি সে ভুলবশত দেখে ফেলেছে।কালকেও নিদ্রাভাব আসার সময় একবার স্বপ্নে সে ইমানকে দেখেছে। কিন্তু জাগ্রত অবস্থায় কেন ভুল দেখলো সে? নাকি রাকিবের কথাগুলো তাকে ইমানকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে? সে তার সদ্য বলা কথাটা হজম করতে পারেনি বিধায় চোখ-মুখ শক্ত হয়ে আসে৷ রাকিবের কথার সঠিক ভাবার্থ সে না বুঝলেও আংশিক বুঝে ফেলেছে। তার দৃষ্টি যখন ক্রমশ নরম থেকে শক্ত হয়ে উঠে রাকিব পরিবেশ সামাল দেওয়ার জন্য হাল্কা হেসে বলে, “জোকস এ পার্ট৷ আসলে আমার পড়াশুনার যা অবস্থা, তাতে চাকরি-বাকরি কিছু তো পাব না এইজন্য তোমার বাসায় চা-কফি বানানোর জব অগ্রীম নিতে চাইছি।

মিরা এবারে কিছুটা স্বাভাবিক হলো। সে মৃদ্যু গলায় বলে, “ও তাই বলো! আমি অন্যকিছু ভাবছিলাম। ”

রাকিব তাকে বাজিয়ে দেখার জন্য বলে, “কী ভাবছিলে?”

–” বিশেষ কিছু নয়। তবে আমার ভাবনা সত্য হলে তোমার সাথে আজই শেষ দেখা হত।”

রাকিব স্নান হেসে বলে, “শেষ দেখার কথা আগেভাগে বলে ফেলা উচিত না। পৃথিবীটা গোল। হয়তো ঘুরতে ঘুরতে কোন এক সময় ভিন্ন এক পরিস্থিতিতে, স্থানে হঠাৎ মোলাকাত হলেও হতে পারে৷”

মিরা তার চোখের দিকে তাকালো। রাকিবের চোখে অন্য কিছু দেখতে পাচ্ছে সে৷ কিন্তু ধরতে পারছে না। হয়তো চোখের ভাষা জানা নেই জন্য রাকিবের চোখের চাউনির ভাষা সে পড়তে পারছে না। তবে তার কথাগুলো ভালো লেগেছে। আচ্ছা ইমান যখন তার থেকে বহুদূর চলে যাবে তখন কী তাদের আর দেখা হবে না? পৃথিবী বৃত্তাকার জন্য যদি কোন একসময় তাদের আবার সাক্ষাৎ হয়? সে চা টেবিলে রেখে বলে, “আমি তেমন একটা চা খাই না। কিন্তু লাস্ট কিছু দিনে চা বানাতে বানাতে টি-এক্সপার্ট হয়ে গেছি৷”

— “তোমার ফ্যামিলির সবাই কী টি-লাভার?”

–“না একদম না। বড় আব্বু তো দুধচা খান না। মা খায় শুধু তাও একবেলা।”

— “তাহলে কার জন্য তুমি চা বানাতে বানাতে এক্সাপার্ট হয়ে গেলে?”

মিরা মুখ ফোসকে বলে দেয়,” ভাইরাস তো দিনে চার-পাঁচ বার চা-কফি খায়৷”

রাকিব শব্দ করে হেসে বলে, “আজকাল ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়াও চা পান করে। বাহ্! আমাদের সময় তো ওদের অনুবিক্ষণযন্ত্র দিয়ে দেখতেই বেগ পেতে হত৷”

মিরা সামান্য লজ্জা পেল। ভাইরাস সে ইমানকে মনে মনে ডাকে। কিছু মনের কথা কাউকে বলতে ইচ্ছে হয় না। এই কথাটাও তেমনি তার একটা মনো-সিক্রেট কথা। অথচ রাকিব শুনে ফেলল৷

সে অবশ্য চুপ রইল। রাকিব প্রসঙ্গ পালটে বলে, “ভাইরাসরা যখন তোমার হাতের চা খাওয়ার সৌভাগ্য পাচ্ছে, আমি নাদান হোমো-সাপিয়েন্স কী তোমার হাতের চা খাওয়ার সৌভাগ্য রাখতে পারি না?”

সামান্য একটা চায়ের আবদার করল রাকিব তবুও এতে যেন মিরার অস্বস্তি ও রাগ হতে লাগে। অথচ, ইমান! সে তো এতো সুন্দর করে অনুরোধ করেই না, বরং এসেই ক্যাচক্যাচ করতে থাকে চা দেও, চা দেও করে। কান ঝালাপালা করে দেয়৷ তখন অবশ্য মিরা বিরক্ত হয়৷ প্রচুর মেজাজ খারাপ হয়৷ কিন্তু রাগ হয় না। বরং মনে হয়, তাকে চা বানিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব একান্ত মিরার। আর মিরাও চা বানাবে কেবল তার জন্য।

রাকিব তার ভাবনার ঘোর ভাঙ্গিয়ে দিয়ে বলে, “আজকে সকালে আমরা প্লান করেছি নদীর তীরে যাব। তুমিও জয়েন করে। ওখান থেকে ঘুরে তারপর বাসায় যেও৷”

–” বাসা থেকে নিতে চলে আসবে।”

— “না, না। কালকে চাচী বলছিল ভাবীর পরিবার বিকেলের পর আসবে৷ এখানে ডিনার করবে। আর আমরা লাঞ্চ করেই ব্যাক করব৷”

— “কে কে যাবে?”

–” আমরা কাজিনরা আর আমার একজন ফ্রেন্ড৷ তবে ভাইয়া-ভাবী যাবে না৷”

–” তাহলে আমিও না যাই৷”

রাকিব এবারে কিছুটা থেমে বলে উঠে, ” ভাইয়া যাবে না কারণ তার নতুন বিয়ে হয়েছে। আর ভাবী যাবে না কারণ সে নতুন বউ। তুমি তো আর নতুন বউ না। এটা তো আর তোমার শ্বশুড়বাড়ি না যে তুমি গেলে লোকে বাকা নজরে দেখবে। তুমি আসতেই পারো আমাদের সাথে । দেখবে ভালো লাগবে।”

মিরা খানিকক্ষণ চিন্তা করে,” ওকে” বললো। অনেকদিন ধরেই একটু নিরিবিলি কোথাও যাওয়া হয় না। এইচএসসির আগে সারাদিন বই নিয়ে বসে থাকত সে। পরীক্ষা শেষ হতেই আপুর বিয়ে নিয়ে মাতামাতি। কাজেই শান্ত, প্রকৃতির ধারে অনেকদিন যাওয়া হচ্ছে না। আজ ওদের সাথে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গিয়ে ঘুরে আসলে মন্দ হয় না৷

_______________________________

নিউইয়র্কে তখন কেবল সন্ধ্যা নামলো। সূর্য হেলেদুলে বিদাই জানাচ্ছে এনওয়াইসিকে। জুই বিশাল বড় থাই দিয়ে ঘেরা জানালার দিকে তাকালো। তার অফিসের কেবিন থেকে চমৎকার দেখা যায় সানসেট। ভালোই লাগে দেখতে। সানসেট দেখতে দেখতে সে কফিতে চুমুক দিল। এরপর আপনমনে বিড়বিড়িয়ে বলে,” সূর্যমামা, আপনি নিশ্চয়ই এখন মিস্টার খানের দেশের দিকে যাচ্ছেন। তাহলে আমার তরফ থেকে একটা বার্তা সঙ্গে নিয়ে যান। কী বার্তাবাহক হবেন তো?” তারপর এক পলক সূর্যের দিকে তাকালো। সূর্যের তেজ ক্রমশ কমে যাচ্ছে৷ জুই তাকাতেই কাঁচ ভেদ করে একটা আলোককণা ঝিলিক মেরে উঠে। বিষয়টা সম্পূর্ণ কাকতালীয় তবুও জুই যেন এ ঘটনায় একদম তেইশ বছরের তরুণী থেকে কিশোরী বনে গেল। সে হাততালি দিয়ে এক গাল হেসে বলে, ” সূর্যমামা মিস্টার খানকে বলে দিয়েন, তাকে আমি খুব করে ভালোবাসি৷ সে যেন সবসময়ই আমার থাকে৷ আর জলদি আমার কাছে ফিরে আসতে বলবেন৷”

সূর্য ঢলে পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই একটু একটু করে তার ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করে। আজকে অবশ্য সানি ডে ছিল। তবুও সূর্যের তেজ কমে যাওয়ার পর থেকে পরিবেশ কিছুটা শীতল হতে শুরু করেছে৷ সে ল্যাবটপ বন্ধ করে নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিল। আজকের জন্য কাজ শেষ। আপাতত তার ছুটি। সে কেবিন থেকে বের হলো। অফিস এতোই নীরব যে তার হাইহিলের টুকটুক আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দই কানে আসছে না। সে সোজা মিস্টার পিটারের রুমে ঢুকে গেল৷ মিস্টার পিটার তার বাবা হয়৷ তবে নিজের বাবা না। সে এডাপ্টেড ডটার হয় তার৷

পিটার মশাই তখন কাজে মগ্ন ছিলেন। জুইকে রুমে প্রবেশ করতে দেখেই সে হেসে দিয়ে বলে, “হাই মাই প্রিন্সেস!”

জুইও বিনিময়ে হেসে বলে, “হাই হ্যান্ডসাম!”

পিটার চশমা খুলে হাসতে হাসতে বলে, “আমি বুড়ো আর হ্যান্ডসাম কই? হ্যান্ডসাম তো তোমার বয়ফ্রেন্ড।”

জুইয়ের মুখ মুহূর্তে কালো হয়ে গেল। মলিন হলো তার হাসি। সে মিইয়ে যাওয়া গলায় বলে,” ও আমাকে কোনদিন প্রোপোজই করলো না৷ অফিশিয়ালি আমরা রিলেশনে নেই৷”

পিটার অবাক হয়ে বলে, “লাস্ট সামার তোমরা ডেটিং করোনি?”

জুই কিছুটা লজ্জা পাওয়া গলায় বলে,” ওটা ডেট ছিল না, পাপা। আমরা একসাথে বিজনেস মিটিং এ গিয়েছিলাম। এন্ড লাকিলি ওয়েদার খারাপ হলো। দেন তিনদিন টেক্সাস এ থেকেছি একসঙ্গে।”

–” আই সি৷”

— “বাট ওই তিনটা দিন আমার জন্য শ্রেষ্ঠ ছিল।”

পিটার হাসল। এরপর বলল, ও নাই জন্য সব কাজের প্রেশার আমার উপর দিয়ে যাচ্ছে। এই বুড়ো বয়সে কীভাবে এতো ধকল নেই বলো তো?

জুই তড়িঘড়ি করে বলে, ওকে চলে আসতে বলো৷

— বললেই কী আর আসবে? কতদিন পর ছুটি নিয়েছে৷

জুই বলে উঠে, ওর জন্য কাজই সব৷ইন ফ্যাক্ট আমার চেয়েও কাজকে ও বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসছে। সো কাজের কথা শুনলে ঠিক সব ফেলে চলে আসবে। তুমি একটা মেইল দাও ওকে। আমার সিউর ও তোমার কথা ফেলবে না।

পিটার ভাবতে থাকলো। আসলেই এবারে একটা মেইল দেওয়া উচিত ওকে। সে আর লোড নিতে পারছে না৷ পিটার সাহেব সঙ্গে সঙ্গে ল্যাবটপের স্ক্রিনে মেইল অপশন বের করে একটা ফরমাল মেইল দেখা শুরু করে দিলেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে সেটা পাঠিয়ে দিলেন। মুহুর্তের মধ্যে মেইল ডেলিভার হলো সুদুর বাংলাদেশে। পিটার বহুকষ্টে ইমানের দেশের নাম উচ্চারণ করল। তাও ভুলভাবে সে প্রোনাউন্স করে। ভাংলাদেশ। সে এই দেশটাকে চেনেই ইমানের দেশ হিসেবে। অবশ্য এগারো সালে ক্রিকেট ওয়াল্ডকাপের সময় প্রথম এই দেশের নাম শুনে সে। তবুও সে বাংলাদেশ বলে না সবসময়ই বলে ইমানের মায়ের দেশ।

__________

বেলা এগারোটা। মিরা ফোন হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তার ফোন হ্যাং মেরে অফ-অন করছে। চালু হচ্ছে না। মোবাইল তার নস্ট হওয়ার পথে ছিল। কিন্তু তবুও গুতাগুতি করে সে সর্বক্ষণ ফোনেই মাতোয়ারা থাকত। আজ যখন একদমই কাজ করছে না তখন তার মন খারাপ হলো। নিউ ফোন কিনতে হবে। ভার্সিটি উঠলেই সে নতুন মোবাইল নিবে৷ মোবাইলটা ব্যাগে ঢুকিয়ে সে সোনালী আপুর কাছ থেকে পারমিশন নিল বুড়িগঙ্গার তীরে যাওয়ার জন্য। আপু অবশ্য তাকে মানা করল না। অগত্যা সে রাকিবের কাজিনদের সঙ্গে রওনা দেয়৷ যাওয়ার পথে মাইক্রো গাড়ি দিয়ে সবাই একসঙ্গে যাচ্ছিল। অস্বস্তি লাগেনি তার৷ কিন্তু কিছুক্ষণ পর যখন রাকিব তার পাশের সীটে এসে বসে তখন সে বিব্রতবোধ করে। এবং আরো একটা বিষয় লক্ষ্য করে তাহলোঃ রাকিব যখন তার পাশে বসলো, তখন ওর কাজিনদের মধ্যে চাপা উত্তেজনার ঢল বয়ে গেল। কে যে একটা হিন্দি রোমান্টিক গান ছেড়ে দিল। যেটা মিরার একদমই ভালো লাগলো না। এবং ক্ষণেই সে চকিতে উঠে। একে এক দুই মেলাতে চেষ্টা করে কিন্তু মেলাতে পারছে না হিসাব৷ আজ সকালেই রাকিব আর প্রান্ত ভাইয়ের এক পিচ্চি কাজিন তাকে ভাবী বলে ডেকেছিল নাস্তা খাওয়ার সময়ে। মিরা ভেবেছে ছোট মানুষ তাই সোনালী আপু আর তার মধ্যে গোলমাল করে ফেলেছে। তাই তাকে শুধরে দিয়ে বলেছিল “আমি ভাবী না তোমার।” তখন পিচ্চিটা মিচকা হাসি দিচ্ছিল। সে আমলে নেয়নি। এখন একে এক যোগ করে মনে হচ্ছে এখানে আসা উচিত হয়নি৷ সে ভেতরে ভেতরে ঘাবড়ে যাচ্ছে কিন্তু নরমাল থাকার চেষ্টা করছে। রাকিব একবার জিজ্ঞাসা করেছিল, কোন সমস্যা আছে কীনা। সে উত্তর দেয়নি।

বুড়িগঙ্গার তীরে এসে পৌঁছে বারোটার দিকে। মাথার উপর সূর্য তখন। গরম লাগছে কিছুটা৷ কিন্তু সেই চির পরিচিত দৃশ্য দেখা গেল। তীরে সারি সারি নৌকা, বোট সাজিয়ে রাখা হয়েছে। পাশেই ধোপারা কাপড় ধুতে ব্যস্ত এবং ড্রেন দিয়ে কালো ময়লা নদীতে নির্গত হতে দেখা যাচ্ছে দূর থেকে৷ চায়ের দোকানও দেখা যায় কিছুদূরে৷

সবাই নৌকা ভ্রমণ করতে চাইছিল জন্য রাকিব ইঞ্জিন চালিত একটা বড়সড় নৌকা ঠিক করল। সেখানে হৈচৈ করে তার কাজিনরা বসে পরে। এবং প্রতিটা সীট দখল হয়ে যায়। সে আরো একটা বৌঠা চালিত নৌকা ঠিক করে। কিন্তু কেবল তারা দু’জনই অবশিষ্ট রয়ে গেছে৷

মিরা বলে, একা একা কেন যাব আমরা? ওদের সঙ্গে যাই৷

রাকিব হেসে বলে, দুইজনে একলা কীভাবে হয়?

সে প্রশ্নের পালটা জবাবে কিছু বলে না। বরং সাহস জুটিয়ে নৌকায় বসে। যা হবে তা দেখা যাবে।

রাকিব উঠে বসতেই মাঝি নৌকা চালানো শুরু করে। আস্তে আস্তে নৌকা বেশ কিছু দূর চলে যায়। নদীর মাঝে নিরিবিলি পরিবেশ। আশেপাশে অবশ্য নৌকা চলছে। মিস্টি হাওয়া বইছে। বাতাসের জন্য আর গরম অনুভব হচ্ছে না৷ চারপাশে পানি আর পানি। দূর থেকে ঘরবাড়ি গুলোকে একটুখানি লাগছে দেখতে। চোখ যতোদূর যায় নদীও ততোদূর৷ একদম দিগন্ত যেন! খালি আকাশের নিচে ভালোই লাগছিল তার৷ পানির কলকলানির আওয়াজ আর বৈঠার শব্দে সে মুগ্ধ হচ্ছিল। বাতাসে উড়ন্ত চুলগুলোকে সে সামলাতে ব্যস্ত।

নীরবতা ভেঙে রাকিব বলে উঠে, “মিরা কিছুদিন ধরেই তোমাকেই একটা কথা জানাতে চাই। আসলে কথাগুলো না বললে মনের উপর চাপ পড়ছে৷”

সে নড়েচড়ে বসে বলে, কী কথা?

রাকিব হাল্কা করে কেশে গলা পরিষ্কার করে বলে, আসলে আমি জানি না তুমি কীভাবে বিষয়টা নিবে। বাট আমি বলতে চাই৷

— বলো৷

রাকিব একবার আকাশের দিকে তাকালো এরপর তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, আই লাভ ইউ।

মিরার বুকের ভেতর যেন ব্রজপাত ঘটে গেল। মস্তিষ্ক যেন সচল থেকে অকেজো হয়ে গেল৷ নিশ্বাস ঘন হতে লাগে। ঘাম ছুটে যায় কপাল বেয়ে৷

রাকিবের শেষ বাক্যটা তার কাছে খুব কুৎসিত আর বিষাক্ত লেগেছে। নিজের কাছে নিজেই ছোট হলো যেন। কেমন সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগতে শুরু করে। ওড়না খামচে ধরে সে।

রাকিব বলে উঠে,” তুমি সময় নাও। আমি অপেক্ষা করব৷ আমি আসলে প্রথম থেকেই তোমাকে পছন্দ করি৷ আমি চাই না রোজ তুমি আমার সঙ্গে কথা বলো। ডেইলি মিট কর। শুধু চাই আমাকে ভালোবাসো।”

মিরা কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল। মুখে কিছু বললো না। কথাগুলো জড়িয়ে আসছে জন্য নির্বাক রইল। বড় তৃষ্ণা পেল তার৷ রাকিবের কথাগুলো তার কানে বিষের কাঁটার মতো বিঁধছে৷

রাকিব চুপ হয়ে গেল৷ সেও চুপ থাকল৷ তার কেন যেন মনে হচ্ছে, রাকিবের কথাগুলো কারো অধিকার হনন করছে যার জন্য কেবলমাত্র মিরা নিজে দায়ী৷ সে নিজের চোখের দৃষ্টি নিবন্ধ করে হাতের আঙ্গুলে জ্বলজ্বল করতে থাকা সোনার রিংটার দিকে।

দুই মিনিট পর মিরা বলে উঠে, মামা নৌকা ঘুরিয়ে পারে নিয়ে যান৷

মাঝি বলে উঠে, আইচ্ছা আফা৷

রাকিব হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। সে আশা করিনি মিরা মাঝ পথে এভাবে ফিরে যাওয়ার আদেশ দিবে৷ একটা অপরিচিত মানুষের সামনে ঝামেলা করতে চায় না জন্য সে চুপ রইল। তাদের ঘাটে ফিরে যেতে দেখে ইঞ্জিন চালিত নৌকাও ফিরে আসতে লাগলো। ইঞ্জিনের ভটভট আওয়াজে মিরার মাথা ধরে গেল।

নৌকা ডাঙ্গায় ফিরতেই মিরা উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আমি যাই তাহলে।

রাকিব বলে, সেকী কেন! ঘুরাঘুরি তো শেষ হয়নি৷

— তোমরা ঘুরো৷ আমি যাই৷

— তোমার আপু কী ভাববে? তোমাকে ফেলে এভাবে রেখে এসেছি। তুমি চল আমাদের সঙ্গে।

মিরা কঠিন চোখে তাকিয়ে বলে, আমি ফেলনা না যে আমাকে ফেলে রেখে আসবে। নিজের পথে নিজে আগাতে পারি। আর এটা আমারই এলাকা।

— মিরা আমি সর‍্যি……..

মিরা তার কথা কর্ণপাত না করে সামনে আগায়। জোরে জোরে হেঁটে সে মেইন রাস্তায় আসে। সে আসলে রাকিবের থেকে দূরে পালাতে চায়৷ অসহ্য লাগছে তার৷ এলোমেলো পায়ে চলছে সে৷ আশেপাশে নজর নেই তার। চোখে জলের বৃষ্টি নেমেছে যেন৷ সে কী খুব খারাপ মেয়ে? তাকে দেখে কীভাবে রাকিব প্রেমে পড়ল? তার মাথা ভোভো করছে। নিজের উপর রাগ হচ্ছে। নিশ্চয়ই সে খারাপ মেয়ে। নাহলে অন্য একটা ছেলের নজর কাড়লো সে কীভাবে?

আচমকা হর্ণের শব্দে তার খেয়াল হলো সে মাঝপথে দাঁড়িয়ে আছে। এবং সজোরে একটা মোটরবাইক তার দিকে ধেয়ে আসছে। তার হাত-পা কাঁপা শুরু করে দিল৷বুদ্ধিমত্তা লোপ পেল তার। সরে যে আসবে এই সময়টাও পেল না। তার আগেই সব অন্ধকার লাগতে শুরু করে। দাঁতে দাঁত চেপে সে চোখ বন্ধ করে। কিয়ৎক্ষণ পর সে নিজের পায়ে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করে। ব্যথায় আর্তনাদ বেরিয়ে আসে মুখ থেকে। ব্যথায় সে ক্রমই জ্ঞান হারাতে থাকে৷ আশেপাশের সবকিছু ঝাপসা লাগে। চোখে অন্ধকার দেখা শুরু করে। আওয়াজগুলো মনে হচ্ছে দূর থেকে ভেসে আসছে৷ আচ্ছা সে কী মারা যাচ্ছে?

চলবে৷