#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–18
— “কী হলো? কথা কানে যাচ্ছে না? বললাম না নিচে গিয়ে বস। এখনো আমার বেড থেকে উঠার নাম নিচ্ছো না! তোমাকে আমার বেডে বসার পারমিশন কে দিয়েছে? ”
ইমান ধমকের সুরে কথাগুলো বললো। তার ধমক খেয়ে মিরা হতবিহ্বল হয়ে যায়। আতকে উঠে সে, সামান্য ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। ফলে আইসক্রিম মাখা হাতটা বেডশিটে রাখে। এবং ভড়কে যাওয়া চাউনিতে তার পানে তাকায়। সবকিছুই তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ইমান নিশ্চয়ই মজা করছে। ছেলেটা এতো ফাজিল! অবশ্যই এটা নতুন কোন ফাজলামি তাকে ডিস্টার্ব করার৷
মিরাকে মূর্তির মত এককোণে বসে থাকতে দেখে, ইমান বলে উঠে, “তোমার জন্য আমার কোন অনুভূতি নেই, মিরা। কাজেই আমার রুম, আমার বাসা এবং আমার সংসারে তোমার কোন জায়গা হবেনা। আর এই বিয়েটাও শুধুমাত্র লোক দেখানো বিয়ে। এম আই ক্লিয়ার টু ইউ?”
তার কথাগুলো কর্ণকুহরে পৌছানো মাত্র মিরা থ হয়ে যায়৷ ক্রমশ বোধশক্তি লোপ পায় তার। তার চোখ ভরে উঠতে লাগে। সে উঠে দাড়ালো বহু কষ্টে। সামান্য উঠে দাড়াতেই যেন তার সব শক্তি ফুরিয়ে গেল। কথা বলার জন্য একফোঁটা শক্তি সঞ্চিত রইল না।
সে কম্পনরত গলায় বলে, “কী বললেন আপনি?”
— যা তুমি শুনলে, সেটাই বলেছি। নিশ্চয়ই তুমি বয়রা নও।”
— আপনি যেসব কথা বলেছেন সেগুলো সব ভুল৷ মজা করছিলেন তাই না?
একথায় ইমান হাসল। ধারালো সেই হাসির রেখা। মিরা চমকে উঠে সেই হাসির দিকে তাকিয়ে।
সে বলে উঠে, তোমার কী মনে হয় আমি মজা করছি?
মিরা মাথা নাড়ালো যার অর্থ সে ধারণা করছে ইমান তার সঙ্গে দুষ্টুমি-ফাজলামি করছে এতোক্ষণ যাবত।
ইমান এবারে শব্দ করে হাসল। সেই হাসির শব্দ কেমন পৈশাচিক শোনালো। তার চোখ আপনা-আপনি ভরে আসতে ধরে৷ শ্বাসরুদ্ধদ্বার এমন পরিস্থিতিতে কান্না আটকে রাখা দায়। তবুও মিরা উদাসিন গলায় বলে, “আপনাকে আমি কখনোই চিনতে পারি না৷”
ইমান পকেটে হাত রেখে বলে, “আমার আসল রুপ কখনো দেখোনি জন্য আমাকে চিনতে পারছো না। আসল রুপ দেখলেই বুঝতে পারবে আমি কেমন৷”
— এতোদিন যা দেখলাম সেটা আপনার আসল রুপ ছিল না? সব মিথ্যা ছিল? নাটক করতেন আমার সঙ্গে?
ইমান একথার উত্তর দিল না। সে ঝাঝালো কন্ঠে বলে উঠে, “তোমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার কর্ম না।”
মিরা অদ্ভুত চোখে তাকালো তার দিকে। সে আক্রোশ মাখা কণ্ঠে বলে উঠে, “তোমাকে প্রচণ্ড ঘৃণা করি।”
মিরার সারা শরীরে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলো। নিজের কানকে যেন বিশ্বাস হলো না তার। চোখ ফেটে নোনাজল গড়িয়ে পরে৷
সে নিস্তেজ গলায় বলে, ঘৃণা করেন আমাকে কিন্তু আমি কী করেছি? আমার মনে পড়ে না যে আমার দ্বারা আপনি কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন৷
ইমানের মুখে সুক্ষ্ম ও চাপা বেদনা ছেয়ে যায়। সে মিরার দিকে এগিয়ে এসে তার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বলে, “খবরদার, ক্ষতি শব্দটা উচ্চারণ করবে না মিরা। যদি লাভ-ক্ষতির হিসাব করা শুরু করি না, তাহলে অনেককিছু হারাতে হবে তোমাদের৷ আমি যদি আমার প্রাপ্ত অধিকার চাই, তাহলে তোমাকে আর তোমার পরিবারকে মাথার উপরের ছাদ হারাতে হবে৷”
মিরা নিষ্প্রাণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইমান বেশ আঘাত দিয়েই তার বাহু ধরে আছে৷ সে যন্ত্রণায় ছটফট করছে। নিজেকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে। ডাঙ্গায় ছটফট করা মাছের মতো সে নড়চড় করছে।
ইমান তাকে আরো জোরে শক্ত করে চেপে ধরে এনে বলে, মানুষ সাধারণত শান্তিতে থাকার জন্য বিয়ে করে আর আমি অশান্তি দেওয়ার জন্য বিয়ে করেছি তোমাকে৷
এবারে মিরার সহ্যের বাধ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। সে চোখ পাকিয়ে বেশ উচু আওয়াজে বলে উঠে, সবসময় ফান ভালো লাগে না ইমান। ঘৃণা করলে নিশ্চয়ই কেউ কাউকে বিয়ে করে না।আর আপনি তো আমাকে ভালোবাসেন।
এবারে ইমান হেসে ফেলে। সে বলে উঠে, আমি যে তোমাকে ভালোবাসি সেকথা একবারও মুখে বলেছি?
তার খেয়াল হলো, আসলেই সে তো কোনদিন মুখে একবারও বলেনি। কিন্তু, কিন্তু তার কাজ-কর্ম, কথার ধরণ তো এমনই কিছু ইঙ্গিত করত৷ মিরার মাথা ঘুরে গেল। সে মাথা চেপে ধরে বলে, ইমান এইসব কী বলেই যাচ্ছেন সেই থেকে। আজকের এই রাত আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই স্মরণীয় রাতে এভাবে কারণ ছাড়া আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন কেন?
— কষ্ট দেওয়া তো মাত্র শুরু।
— আপনার ধারণা আছে আপনি তখন থেকে কীসব আজেবাজে বকে যাচ্ছেন। হুশ আছে নিজের?
ইমান এবারে তার চুলের মুঠি ধরে ফেলে বলে, “আমার সামনে আওয়াজ উচু করবা না।”
মিরা নিজের চুল ছাড়ার বৃথা চেষ্টা করে ছলছল চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, “আমার লাগছে কিন্তু। ব্যথা পাচ্ছি, কষ্ট হচ্ছে। ছাড়েন৷”
সে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,” কষ্ট দেওয়ার জন্যই তো এমন করছি৷ সুখে রাখার নিয়ত থাকলে এতোক্ষণে আদরে ভরিয়ে দিতাম৷ কিন্তু আমার নিয়ত তো আলাদা। আমার ধ্যানে-জ্ঞানে কেবল তোমার পরিবারের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার ভূত চেপেছে। আমি আমার মায়ের চোখের পানিকে সাক্ষী রেখে এদেশে শুধুমাত্র তোমাদের দ্বিগুণ কষ্ট ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ফিরে এসেছি৷”
মিরা যেন মাঝ সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া এক অসহায় নাবিক। যার একূলেও ঠাই নেই, ওকূলেও রেহাই নেই। ইমানের চোখে যে হিংস্রতা সে দেখছে এতে নিশ্চিত যে সে মিথ্যা বা ফাজলামি করছে না। তাহলে এতোদিন সে নিজে একটা ঘোরে ছিল? দিবাস্বপ্ন দেখছিল ভুল মানুষকে নিয়ে? তার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। সে নির্বাক হয়ে চেয়ে থাকল। বুলিরা সব হাওয়ায় বিলিন হয়ে গেছে যেন৷
অনেকক্ষণ পর ইমান তার চুলের মুঠি ছাড়ে। এতো জোরে টেনে ধরে রেখেছিল যে মাথার ওইপাশ ব্যথায় চিনচিন করে উঠে। সে চোখের জলে নিরব প্রতিবাদ জানাচ্ছে। তবুও অল্প সময়ের ব্যবধানে সে ইমানকে প্রশ্ন করে, ফুপুর সঙ্গে বাবার কী কোন ঝামেলা হয়েছিল? যার জন্য আপনার এতো ক্ষোভ?
ইমান পুনরায় তাচ্ছিল্য ও বেদনাভরা হাসি দিয়ে বলে, ঝামেলা!তোমার কাছে ওই ঘটনাকে ঝামেলা লাগে?
মিরা ইতস্তত করে বলে, কোন ঘটনার কথা বলছেন আপনি? আমি সত্যিই জানি না ইমান।
ইমান দ্বিতীয়দফায় তার উপর আক্রমণ করে। এবারে মিরার একটা হাত পেছন দিয়ে মুচড়ে ধরে, আরেক হাত দিয়ে তার গাল ভীষণ শক্তি দিয়ে চেপে ধরে বলে, তোর বাপ একটা প্রতারক। জানোয়ার একটা। এই ধরনের মানুষকে কেটে-কুটে কুত্তার ভোগ দেওয়া উচিত।
ইমানের বলা প্রতিটা কথা যেন মিরার বুককে ফালা-ফালা করে দিয়ে গেল৷ বাবাকে নিয়ে বানে কথা তার সহ্য হচ্ছে না। চূর্ণবিচূর্ণ এবং বিধ্বস্ত হতে থাকে তার মন। সে বাম হাত দিয়ে থাপ্পড় বসায় ইমানের গালে। সম্ভবত এমন কিছুর জন্য ইমান প্রস্তুত ছিল না৷ সে চরম অপমানিত বোধ করে৷ চোখ দুটো হিংস্রতায় আরো জ্বলজ্বল করে উঠে। সাপের মতো হিশহিশ করে উঠে বলে, তোমাদেরকে ধ্বংস না করা অব্দি আমি শান্তি পাব না।
— আপনি ভুলেও আমার বাবাকে নিয়ে আজেবাজে কিছু বলবেন না।
— বাপের আসল রুপ সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছে?
মিরা কেঁদে ফেলে বলে, চুপ করুন৷ আমি এখনি বাইরে গিয়ে সবাইকে ডেকে আনব। আজকে আপনার এই রুপ প্রকাশ পাওয়া দরকার। কতোটা হিংস্র আপনি তা সবার জানা উচিত।
ইমান যেন এতে আরো রেগে যায়। সে বলে উঠে, “আমাকে হুমকি দিবা না। আর হ্যাঁ, ভুলেও কাউকে কিছু বলতে যাবা না।”
এবারে মিরা শান্ত-শীতল দৃষ্টিতে তার পানে তাকিয়ে বলে, ভয় পাচ্ছেন?
ইমান তাকে অবাক করে দিয়ে শব্দ করে হাসা শুরু করে। এরপর বলে উঠে, যাও তোমার পরিবারের প্রতিটা মানুষকে গিয়ে বল, ইমান খান তাদের আদরের মেয়ের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে। একরাতেই জীবন নরক বানায় ফেলেছে।”
— আপনার মাথা গেছে।
ইমান নিজ থেকে দরজা খুলে দিয়ে বলে, যাও। অপেক্ষা কেন করছো? কোলে করে তুলে নিয়ে যাব?
মিরা হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে থাকে।
ইমান বলে উঠে, বাট ওয়েট, তুমি যদি নিজ থেকে কাউকে কিছু বলে দাও, তাহলে এর পরিনাম খারাপ হবে৷
— আমাকে হুমকি দিলেন?
— নো, নো। আমি হুমকিতে বিশ্বাসী নই। আই লাভ একশন৷
— তাই নাকি? কী একশন নিবেন আপনি?
ইমান এবারে তার দিকে আগাতে থাকে। এরপর মুখোমুখি হয়ে বলে, এই বাড়িটা যেটা তোমাদের একমাত্র আশ্রয়। সেটা আমার নামে লেখা৷ নানাভাই আমার নামে লিখে দিয়ে গেছে। এইজন্য এই বাসায় আমার এতো কদর। তোমার মা এইজন্য আমার এতো যত্ন নেয়। বুঝলা সবাই স্বার্থ খুঁজে। আর সেখানে তোমরা এতো লোভী। টাকার জন্য রক্তের সঙ্গেও বেঈমানী করো৷
মিরা থমকে দাঁড়ায়। ইমানের কথা তার হজম হচ্ছে না।
ইমান অবলীলায় জানালো, আমি চাইলেই আমার বাসা থেকে যেকাউকেই অপমান করে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারি৷ কী পারি না?
— বলতে চাচ্ছেন আপনি আমাদেরকে বাসা থেকে বের করে দিবেন? তো দিন না। সমস্যা কোথায়?
— সমস্যা কোথায় তুমি জানো না?
— আমি সত্যিই কিছু জানি না। আপনি কেন আমার সঙ্গে এমন করছেন? বাবা দোষ যদি করেও থাকে সেই শাস্তি কেন আমার উপর চাপাচ্ছেন?
ইমান ধীরে-সুস্থে জবাব দেয়, যুদ্ধে নির্দোষ-দোষী দেখা হয় না। ইতিহাস সাক্ষী আছে, পিতার কর্মের জন্য সন্তানকে শাস্তি ভোগ করতে হয়। রাবণের কর্মের জন্যই কিন্তু মেঘনাদকে শাস্তি পেতে হয়৷
মিরা তার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে, আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন। আমাদের উপর এভাবে শোধ নেওয়া ঠিক হবে না৷ বাসার সবাই আপনাকে কত শ্রদ্ধা করে।আর আপনি আমাদেরই ক্ষতি করার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছেন৷ সেইম অন ইউ৷”
ইমান তার কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিতে দিতে বলে, বন্ধু ভেবে যার জন্য ফুল দিয়ে ঘর সাজাইলা সে হলো তোমার শক্রু৷ সাপ হয়ে দংশন করব, এসিড হয়ে তোমার সব সুখ জ্বালিয়ে দিব।
চলবে৷
#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–19
দীর্ঘ রজনী। গম্ভীর, নির্জন রাত। মেঘেরা ক্লান্ত হয়ে যেন ঘুমুচ্ছে। বৃষ্টির পরের হীম শীতল ও ঠাণ্ডা পরিবেশ বিদ্যমান। ইট-পাথরের রাস্তাগুলো, বিল্ডিং ও ল্যাম্পপোস্ট ও যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। মনে হয় না এই আরামদায়ক রাতে কেউ জেগে থাকবে। সবাই পাতলা কাথা মুড়ি দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। তবে শান্ত,ক্লান্ত এই প্রকৃতির মাঝে শ্রেফ মিরা-ই বুঝি অশান্ত, অস্থিরচিত্তে দাঁড়িয়ে আছে। মাথা ভর্তি প্রশ্ন ও দ্বিধা তার কিন্তু জবাব দেওয়ার জন্য উপযুক্ত কাউকে পাচ্ছে না। কে তার সকল প্রশ্নের উত্তর দিবে? ইমানের বলা প্রতিটা কথা তার কাছে অবিশ্বাস্য ও অসম্ভব কেচ্ছা-গল্প বলে মনে হচ্ছে। যেন বানোয়াট কোন সিনেমার স্ক্রিপ্ট বলে গেল সে। কিছুই তার মাথার ঢুকেনি। সবটা বুঝের বাইরে দিয়ে গেছে৷ শুধু এতোটুকু বুঝতে পারছে যে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এতো কষ্ট যে এক বুক কেদে ভাসালোও, যন্ত্রণা একরত্তি কমবে না৷ ইমানের রুঢ় আচরণ সে নিতে পারেনি৷ ব্যথা পাওয়া বাহুতে হাত রেখে সে টলমল চোখে দাঁড়িয়ে আছে৷ দাঁড়িয়ে আছে ইমানও। তবে সে সামান্য ব্যস্ত। ঝগড়া ও চেচামেচির মাঝেই ইমানের পকেটে থাকা ফোনটা বেজে উঠল। সে ফোন বের করে, হাট করে খুলে রাখা দরজা লাগিয়ে দেয় এবং ইশারায় মিরাকে বুঝিয়ে দেয়, “কথা এখনো শেষ হয়নি৷”
এরপর সে ফোনে ডুবে যায়৷ কারো সঙ্গে চ্যাটিং চলছে সম্ভবত। মুখের অভিব্যক্তি দেখে বোঝা যাচ্ছে কোন খবর আছে যেই খবরটা তার মন মতো নয়। মিনিট দশেক পর ইমান ফোনটা চটকা দিয়ে বিছানায় ফেলে। এরপর এক গ্লাস পানি ঢেলে ঢকঢক করে পান করে৷ মিরা সবটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। তার উপস্থিতি যেন মুহুর্তেই নাই হয়ে গেছে। ইমান তাকে দেখতেই পাচ্ছে না এমনটা ফিল হচ্ছে তার। মিরার ইচ্ছা করল একবার, কী হয়েছে জানার৷ কিন্তু পরমুহূর্তেই সে থেমে যায়৷ এমন একটা মানুষের সঙ্গে তার কথা বলার রুচি উঠে গেছে৷ তার কাছে পুরা বিষয়টাই একটা দুঃস্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে। ইমান কীভাবে এতোটা খারাপ হতে পারে? তার মন এতোটা কালো অথচ মিরা তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ হিসেবে বিবেচনা করে এসেছে। নিজের ভাবনার প্রতি নিজেরই রাগ হচ্ছে। সে এতোবড় প্রতারণা সামলাবে কীভাবে? ক্ষণেই গাল বেয়ে দু’টো মোটামোটা অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ল৷
তার চিন্তার সুতো কেটে যায় যখন ইমান গমগমে সুরে বলে, “আমার যা যা বলার সবটা বলেই দিলাম। আমার কাছ থেকে কোন ধরনের দায়বদ্ধতা বা দায়িত্ব পূরণের আশা করবে না৷”
মিরা ভেবেচিন্তে উত্তর দেয়, “আপনার কাছ থেকে আমার কোনকিছুই চাই না৷”
— “গুড। তাহলে তো ভালোই। আমি ঘুমাতে যাচ্ছি। ডোন্ট ডিস্টার্ব মি। ”
সে বিছানায় এসে গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে এবং লাইট নিভিয়ে দিল।
মিরা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইল। যেহেতু একবার বেড থেকে উঠে যেতে বলেছিল কাজেই মিরা আর বেডে গেল না। সে ভেবেছিল ইমান তাকে ডেকে আনবে৷ কিন্তু আধঘন্টার বেশি পার হলেও এমন কিছু করল না ইমান। মিরার চোখ আবারো ভরে আসতে লাগে। এটা তার বাসা অথচ তাকেই দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে এমন ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খেলেই সে চকিত উঠে৷ এটা আদৌ তার বাসা? তার বাসা হলে নিশ্চয়ই আজকে এমন পরিস্থিতি আসতে হত না। আচ্ছা তারা কী ইমানের মেহেরবানীতে এখানে বাস করছে? এটা সে মানতে পারছে না৷ তার বাবা তো ব্যবসা করে বড় আব্বুর সাথে। দুইভাই মিলে ব্যবসা করে৷ তাদের কেন অন্যের বাড়িতে থাকতে হবে? মিরা মাথা চেপে ধরে। আচমকা ফোনের রিংটোনে তার আত্মা কেপে উঠে। ইমানের ফোন আবারো বাজছে৷ ইমান সম্ভব ঘুমিয়ে পড়েছিল। ফোনের আওয়াজে হকচকিয়ে উঠে সে। মিরা তখনো আলমারির সঙ্গে ঠেশ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ এতোক্ষণ একাধারে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য তার পা ব্যথা হয়ে গেছে। তবুই সে বসল না। বরং ফোনকল বেজে উঠায় আরো টানটান হয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে। প্রথম বার ইমান ফোন কেটে দিল। দ্বিতীয়বার আবারো ফোন বেযে উঠলে মিরা আস্তে করে বলে, “চাইলে ফোনটা রিসিভ করতে পারেন।”
ইমান তার কথা শুনে বা নিজ ইচ্ছায় ফোন ধরে। ফোন কানে নিয়ে সে শুয়ে পরে। মিহি গলায় কথার ফিসফিস শব্দে মিরার অস্থির লাগা শুরু করে। সে সারারুম জুরে পায়চারি করে। এরপর বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়৷ বারান্দায় যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে সে আড়চোখে তাকিয়ে দেখে, ইমান শুয়ে শুয়ে কারো সঙ্গে ফোনে কথা বলছে আর হাসছে। বেশ প্রাণবন্ত সেই হাসি। মিরার গায়ে কাটা দিয়ে উঠে। মানুষ কী করে পারে কেউ কাদিও হাসতে? এতো নিষ্ঠুর হওয়া কীকরে সম্ভব কারো পক্ষে?
সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে কান্না করল। এই কান্নার নাম হলো বোবা কান্না। কান্নার শব্দ কেউ শুনতে পায় না। এই কান্নার কোন কোন উৎস নেই। অসীমে অচীরেই এই কান্নার শব্দ তলিয়ে যায়। সে আরো বিশ মিনিট পর রুমে ফিরে তখন ইমান ফোন রেখে দিয়েছে৷ সে গিয়ে আলমারিতে গা ঘেঁষে হাটু ভাজ করে বসে। দাঁড়িয়ে থাকার ফলে পা’জোড়া ব্যথা করছে খুব। সে বসতেই আচমকা ইমান বলে উঠে, আমি এতোটাও পাষাণ না যে সারারাত তোমাকে দাড় করিয়ে রাখব। আলমারির পাশে তোষোক আর বালিশ আছে। টেনে করে বিছিয়ে নিয়ে শুতে পার৷
মিরা তার কথায় যেন বশ হলো। সে তোষোক আর বালিশ বের করে। ক্ষণেই তার ধ্যানভঙ্গ হলো। তার তো এভাবে মেঝেতে পাটি বিছিয়ে শোয়ার কথা ছিল না। আচমকা খুব রাগ-জিদ উঠে যায় তার। সে বালিশটা ছুড়ে মেরে বলে, ” আমি ঘুমাব না এই ফ্লোরিং তোষোকে৷”
–“এজ ইউর উইশ৷”
ইমান ওপাশ হয়ে শুতেই, মিরা উঠে দাড়ালো এবং বিছানায় এসে বসল। ইমানকে অতিরিক্ত কিছু করতে না দেখে সেও বেডে শুয়ে পরে। তবে একদণ্ডের ব্যবধানে ইমান উঠে বসে, নেমে যায় নিচে৷ এবং সে তোষোক-বালিশ বের করে নিজে সেখানে শুয়ে পরে। মিরা সবটা দেখল নীরবে। এরপর চুপচাপ শুয়ে থাকে। তার কিছু ভালো লাগছে না। সবকিছু অসহ্য লাগছে। এতো যন্ত্রণাময় কেন এই রাত্রিটা?
__________________
সকালে ঘুম ভাঙ্গে দরজার ঠকঠক আওয়াজে। ইমান বিরক্তিভরা মুখে উঠে বসল। বেকায়দায় শুয়ে তার ঘাড় ব্যথা হয়ে গেছে৷ সে একবার ডানে এবং আরেকবার বামে ঘার ঘুরালো। এরপর হাই তুলল একটা। রাতে ঘুম হয়নি বললেই চলে। মধ্যরাত অব্দি সম্ভবত মিরা কেদেছে। চাপা কান্নার আওয়াজ তাকে কাল রাতে ঘুমুতে দেয়নি। চোখ বন্ধ করলেই কোন এক অজানা কারণে তার চোখ খুলে গেছে। পুনরায় দরজার ঠকঠক আওয়াজে তার ঘোর কাটে। আওয়াজ তীব্র হলে মিরাও বিছানা থেকে নড়েচড়ে উঠে। তবে বোধহয় ঘুম ছুটেনি৷ ওপাশ থেকে এবারে সোনালী আপুর কণ্ঠ ভেসে আসছে। সে বলে, “এই ইমান, এই মিরা উঠবি না? আর কত ঘুমাবি? সকাল দশটা বাজে। সবাই তোদের জন্য নাস্তা না করে বসে আছে। উঠ৷”
ইমান তড়িৎগতিতে উঠে একবার সারা রুম দেখে নিল এবং দ্রুততম গতিতে তোষোক সরিয়ে রেখে, দরজা খুলে দিল।
সোনালী আপু দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে দেখে হেসে বলে, কিরে? এতোসময় লাগলো দরজা খুলতে? কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি৷
— সর্যি আপু। আসলে উঠতে দেরি হয়ে গেল৷
আপু হেসে বলে, “অনেক গাঢ় ঘুম হয়েছে মনে হচ্ছে। মিরা এখনো উঠেনি?
— না৷
আপু মাথায় হাত দিয়ে বলে, এই তো আমাদের নাক ডুবাতে। বিয়ের পরেরদিন কেউ এতোবেলা অব্দি ঘুমায়। ওকে ডেকে আন।
— আচ্ছা।
সোনালী আপু চলে যেতে ধরলে সে প্রশ্ন করে, তোমরা খেয়ে নাও। শুধু শুধু এতোবেলা অব্দি না খেয়ে আছো।
আপু আচমকা হোহো করে হেসে দিল। সে ভড়কে গেল।
আপু বলে, একরাতেই মিরা তো সব বুদ্ধি খেয়ে ফেলেছে। এখনমাত্র সাতটা বাযে পাগল।
ইমান হতভম্ব হয়ে বলে।,তাহলে তখন দশটা কেন বললে?
আপু হামি তুলে বলে, যেন টনক নড়ে। আই নো যে তোরা ঘুমাসনি সারারাত৷
ইমান চমকে উঠে। আপু কিভাবে জানল তারা ঘুমায়নি? বাই এনি চান্স সে সব জেনে গেছে?কিন্তু কিভাবে এটা সম্ভব?
তার ভাব-সাব দেখে আপু বলে উঠে, আরে বাসররাতে কেউ ঘুমায় না বুঝলি। সবাই জেগে থাকে। একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ভাবের আলাপ করে। তোরাও নিশ্চয়ই জেগেই ছিল। একে অন্যকে ছেড়ে উঠতে মন চাচ্ছিল না রাইট?এইজন্য নিনজা টেকনিক খাটালাম। এবার ফ্রেস হয়ে বাইরে আয়। বাসায় মুরুব্বি আছে। বেশি সময় রুমে থাকিস না৷
ইমান স্নান হেসে বলে, নাইস টেকনিক।
আপু চলে গেলে সে নিজে ফ্রেস হলো। এরপর দশ মিনিট ধরে সিগারেট খেল৷ এখনো মিরার উঠার কোন লক্ষণ সে দেখল না। কিছুটা বিরক্ত হয় সে। মেয়েটার কোন সেন্স নাই? বিয়ের পরের দিন এখনো ঘুমাচ্ছে। দেশের বাইরে থেকেও সে বাঙ্গালী সব কালচার জানে। আর উনি দেশে থেকেও একটা কালচারও জানে না৷ ইমান ফোন বের করে এলার্ম সেট করল। এক মিনিট পর সেই এলার্ম বেজে উঠলে, সে ফোনটা মিরার কানের পর্দার সামনে ধরল। বিকট আওয়াজে ঘুম ছুটে যায় মিরার। সে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে চিৎকার দিতে গেলে, ইমান তার মুখ চেপে ধরে বলে, ডোন্ট সাউট! ডোন্ট সাউট!
মিরা ঘুমের মধ্যেই ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ভয়ে এখনো বুক ধড়ফড় করছে। সে চোখ পাকিয়ে ইমানের দিকে তাকালো। কিছু বলার চেষ্টা করল৷ কিন্তু ইমান তার মুখে হাত চেপে রাখায় কিছু বলতে পারছে না। ইমানও হাত সরায় না। মুখে হাত চেপে ধরে কী যেন ভাবছে তার দিকে তাকিয়ে। এদিকে মিরা আচমকা তার দাঁত দিয়ে ইমানের হাতে কামড় বসায়। সঙ্গে সঙ্গে ইমান হাত সরিয়ে নেয়৷
ইমান অগ্নিচোখে তার দিকে তাকালো। মিরা হাই তুলে বলে, “সমস্যা কী আপনার? ম্যানার নাই কোন? এভাবে কোন মানুষকে ঘুম থেকে তুলে উঠায়? আরেকটু হলে আমার হার্টফেল তো।”
— তাই বলে তুমি আমাকে এতো জোরে কামড় দিতে? আর একটু হলে, মাংস উঠে যেত। ডাইনী কোথাকার৷
মিরা ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে তুলে বলে,” এটাকে প্রতিশোধ বলে। আর কিভাবে প্রতিশোধ নিতে হয় সেই ট্রেনিং আপনার কাছ থেকে নিব৷ আমাকে ট্রেনিং দিবেন তো?”
মিরার কথায় সে আরেকদফা শক খায়৷ কান্নাকাটি করে মেয়ের মাথা গেছে৷ ফোলা চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে তার আচানক মায়া হলো। সেই মায়ায় প্রশয় না দিয়ে বলে উঠে, এতো বেশি বকর-বকর করবে না। তোমার ভাঙ্গা রেডিও শোনার টাইম নেই আমার। আপু একবার ডেকে গেছে। দ্বিতীয়বার যেন ডাক দিতে নাহয়৷
মিরা উঠে দাড়ালো। এরপর সোজা বাথরুমের দিকে গেল। সে চলে যাওয়ার পর ইমান বিছানায় শোয়। গা-পা ব্যথা করছে তার৷ শুয়ে শুয়ে সিগারেট খাচ্ছি। সকাল থেকে এই নিয়ে তিনটা সিগারেট শেষ করল সে।
বাথরুমের দরজা খোলার শব্দে সে চোখ সেদিকে ঘোরালো। মিরা বেরিয়ে আসছে। হাল্কা গোলাপি রঙের শাড়ি পড়েছে। সদ্য স্লান করায় তার চুল ভেজা। ভেজা চুলের জন্য ব্লাউজের পেছন পাশ ভিজে গেছে। সে মোহযুক্ত চোখে একবার তাকালো। এটা মানতেই হবে মিরার অপরুপ সুন্দরী এক মেয়ে৷ যার দিকে তাকালে স্নিগ্ধতা টের পাওয়া যায়।
ইমানকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা আড়ষ্টতা বোধ করে মিরা৷ কাল সারারাত কান্না করায় ফলে মাথা ধরে ছিল বেশ৷ কাল রাতে সে বেশ বড়সড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে।এইজন্য আপাতত সে যথেষ্ট স্বাভাবিক আছে। ইমানের দুর্ব্যবহার যেন তাকে ছুঁয়ে যায়নি এমন ভান ধরে আছে সে। আস্তে-ধীরে আয়নার সামনে এসে সে চুল ঝারতে থাকে। এরপর চুল আছড়াতে গিয়ে বলে উঠে, “আমার মাথা ব্যথা করছে। নাস্তা খাওয়ার পর আমার জন্য এইচ প্লাস এনে নিবেন৷”
ইমান তার কথা শুনে উঠে দাড়ালো এবং বলল, তুমি কী ভুলে গেছো কালকে আমি তোমাকে কী বলেছি? এই বিয়ে আমি মানি না৷
মিরা যেন এসব কথা কানেই নিল না। চোখ কাজলে দেওয়ার আগে বলে উঠে, আজকের পর রুমে যেন সিগারেট খেতে না দেখি।”
আয়নায় প্রতিফলিত হওয়া ইমানের হতভম্ব চেহারা দেখে মিরার হাসি পেল বেশ৷
চলবে৷