ফেইরিটেল পর্ব-২২+২৩

0
857
ফেইরিটেল
গল্পেরমহল ধারাবাহিক গল্প

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–22

মিরার অভিব্যক্তি দেখে সামান্য হাসে ইমান। সে কণ্ঠস্বর নিচু করে বলে, “অবাক হচ্ছো কেন?”

মিরা নিজের অভিব্যক্তি লুকানোর চেষ্টা করছে৷ কিন্তু সম্ভবত চোখ-মুখ থেকে তার চমকে যাওয়ার সেই আভা মুছে যায়নি। সে বিষ্মিত চোখে বলে উঠে, “আপনি চলে যাবেন?”

ইমান হাল্কা হেসে বলে, “চলে যাব না, বরং ফিরে যাব। তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছো আমি এখন বাংলাদেশের মেহমান। আর আমেরিকার সিটিজেন৷”

মিরা একবার তার পানে তাকালো। এরপর সোজা হয়ে বসে পরে৷ ইমান দেয়ালের সঙ্গে ঘেঁষে আরাম করে বসে বলে,”হুট করে কাবুলিওয়ালাদের কথা মনে পড়ল।”

সে জানার আগ্রহ নিয়ে তার দিকে তাকালো। ইমান বলতে থাকে, ” আগেকার দিন অন্য লোকালয় থেকে সুদর্শন ব্যবসায়ীরা এদেশে এসে ব্যবসা করত। এরপর সুযোগ পেয়ে এদেশের ধনবান ব্যক্তিদের কন্যাকে বিয়ে করে কিছুদিন সংসার করে, সংসার, বউ রেখে নিজ দেশে ফেরত যেত আর আসত না৷”

“আর আসত না” শুনে মিরার বুক কেঁপে উঠে। সেও কী তাহলে মিরাকে রেখে বিদেশ পাড়ি দিবে এবং আর ফিরে আসবে না? তখন তার কী হবে? সে প্রশ্নবিদ্ধ করে তাকে।

” আপনি কী তাহলে কাবুলিওয়ালাদের মতো করবেন? ”

ইমান আবারো হাসল। উত্তর দিল না।

সে ভীতগ্রস্থ হয়ে বলে, “আমার প্রশ্নের জবাব দিন?”

— “করতেও পারি। আমি তোমার জীবনে পলাতক সুদর্শন কাবুলিওয়ালাও হতে পারি। ইউ নেভার নো!আর হলেও অসুবিধা কী? আমি তো আর তোমাকে বউ হিসেবে মানি না। বরং প্রতিশোধ নিতে এসেছি।”

— “প্রতিশোধ তো নিতে পারলেন না৷”

ইমান তার দিকে আরেকটু ঘেঁষে বসল। দুইজনের মধ্যে দূরত্ব রইল না একবিন্দু৷ সে তার কাঁধের কাছে হামাগুড়ি খেতে থাকা চুলের গাছি নিজের আংগুলের ভাঁজে তুলে নিল। এরপর কিছুক্ষণ চুল নিয়ে খেলা করল।সম্পূর্ণ সময় মিরা মূর্তির মতো বসে রইল৷ এই লোকটার স্পর্শ তাকে ভিতর থেকে দুর্বল করে দেয়। সে নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা তখন।

ইমান তার কানের পেছনে চুল গুটিয়ে দিয়ে বলে, “বিয়ের কয়েকদিনের মধ্যে সম্পর্কটা ভেঙ্গে গেলে, এই সমাজের মানুষ তোমাকেই দোষী ভাববে। তোমার চরিত্রেই দোষ খুঁজবে৷ কাহিনি রটাবে৷ তখন তোমার বাবা-মা অপমানিত হবে। এর চেয়ে ভালো প্রতিশোধ আর কী হতে পারে?”

মিরা মাথা নিচু করে নিল। এরপর বলে উঠে, ” “আপনি খুব নিষ্ঠুর।”

–” কী জানি। লোকে বলে আমি মানুষটা ভালো৷”

মিরা তাচ্ছিল্য ভরা হাসি দিয়ে বলে, “ভালো মনের মানুষরা প্রতিশোধ পরায়ণ হয়না। আপনি কাপুরষ। এজন্য আমাদের পেছন থেকে আঘাত করলেন তাও ছলনা করে। বিশ্বাসঘাতকতা করে৷”

ইমান তার কাধে মাথা রেখে বলে, “মিরা আমার হাতে তোমার সর্বনাশ লেখা আছে৷ বিশ্বাসঘাতকতা যুদ্ধের অংশ। প্রতিটা যুদ্ধেই বিশ্বাসঘাতকতার ভূমিকা পরোক্ষভাবে জড়িত৷ ”

মিরা তার মাথা সরানোর চেষ্টা করে বলে, “আপনার উদ্দেশ্য আমি সফল হতে দিব না৷”

ইমান তার হাত চেপে ধরে বলে, “ওকে, লেটস সি, তুমি কী করতে পারো৷ আগামী একমাসের মধ্যে তোমাদের এই বাসা ছেড়ে দিতে হবে৷”

মিরা আতকে উঠে প্রশ্ন করে, “কেন?”

— “বিল্ডারর্সকে দিব। দশতলা বিল্ডিং হবে৷”

মিরা কথাটা শুনে থমকে দাড়ালো। তার জন্ম এই বাসাটায়। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কত স্মৃতি আনাচে-কানাচেতে লুকিয়ে আছে৷ অথচ ইমান মুহুর্তের মধ্যে সেই স্মৃতি গুলো হত্যা করবে৷

তার চোখ ফেটে কান্না উপচে পড়তে থাকে।

ইমান হেসে ফেলে বলে,” এই মনোবল নিয়ে আমার সঙ্গে গেম খেলতে নেমেছো? প্রথম রাউন্ডেই তুমি হেরে গেলে! আরো তো তিন রাউন্ড বাকি আছে।”

— “আমি হেরে যাইনি, বরং আপনি আপনার বিবেক হারাচ্ছেন৷”

অবশ্য এই কথার পালটা জবাব দিল না সে। চুপচাপ বসে থাকলো দুইজন। পাশ দিয়ে কেউ গেলে ভাববে, দুইজনের মধ্যে কত কম দূরত্ব। অথচ সম্ভবত এই মূহুর্তে তারাই সবচেয়ে পর। যোজন যোজন দূরত্ব তাদের মধ্যে! একজনের মনে কুৎসিত সব ভাবনা। প্রতিশোধের আগুনে হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়েছে তার৷

_____________

সূর্যের আলো চোখে এসে বারি খেতেই মিরার ঘুম ছুটে যায়। সে নিজেকে বদ্ধ কিছুর মধ্যে অনুভব করলো। নিজেকে ধাতস্থ করতেই পরিচিত ব্যক্তির গায়ের গন্ধ নাকে এসে লাগলো। মাথা সামান্য উচিয়ে সে দেখল, ইমানের বুকে তার মাথা। তারা দুইজনই চেয়ারে বসে, একে অপরের গায়ে হেলে পড়েছে। মিরাকে আবার সে নিজের বাহু দ্বারা ধরে রেখেছে যেন সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে না যায়৷ মিরা আশেপাশে তাকালো। ভোর হওয়ায় কেউ নেই কলিডোরে। সে ইমানের গায়ে একটা চিমটি কাটে। সঙ্গে সঙ্গে সে নড়েচড়ে বসে৷ মিরা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সরে আসতে গেলেই টান লাগলো চুলে৷ সে পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে, ইমানের শার্টের বোতামের সঙ্গে তার চুল জট পেকে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে বিরক্ত হয় সে। যতোই সে দূরে যেতে চাচ্ছে, কেন ততোবারই নিকটে আসছে তারা? শার্টের বোতামের সঙ্গে এক প্রকার টানা-হেঁচড়া শুরু করে মিরা৷ কিন্তু এতে চুল আরো জট পাকিয়ে যাচ্ছে৷ এক সময় সে ঝুঁকে কাজে মনোনিবেশ করে৷ বোতাম থেকে চুলকে মুক্ত করতেক হবে তার। জেদ চেপে গেছে যেন৷

ইমানের বুকের সঙ্গে লেপ্টে থাকা বোতামের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে কখন যে, সে জেগে গেছে সেদিক হুশ নেই মিরার। নিজের কাজে ব্যাহত ঘটে যখন তার হাতজোড়া ইমান নিজের হাত দিয়ে চেপে ধরে।

তড়িঘড়ি করে মিরা সরে আসতে চাইলে, ইমান বলে উঠে,” ঘুমন্ত অবস্থার সুযোগ নিচ্ছিলে নাকী?”

— “ছিঃ!”

— “ছিঃয়ের কী দেখলে? স্বামীর কাছ থেকে সুযোগ লুফে নেওয়া যায়। প্যারা নাই।”

মিরা নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে বলে, “আপনাকে আমি স্বামী হিসেবে মানি যে সুযোগ নিব?”

ইমান সপ্রতিভ হয়ে বলে, “মানো না?”

–” ততোদিন অব্দি মানব না, যতোদিন অব্দি আপনাকে আমাকে মেনে নিচ্ছেন না৷”

— “নাইস। তাহলে মনে হয় এই জামানায় তোমার জামাই হওয়ার সাধ মিটবে না৷”

বলেই ফিচেল হাসি দেয় সে।

মিরা সটাং হয়ে দাঁড়িয়ে যায় এবং নিজের আটকে থাকা চুলগুলো বেশ জোরে করেই ছিঁড়ে ফেলে। এরপর গটগট করে হেঁটে অন্য বেঞ্চে বসে৷ ইমান বসে রইল। তার শার্টের বোতলে লম্বা চুল প্যাচ লাগিয়ে পড়ে আছে। বিষয়টা বিব্রতকর!

দু’দিনের অবজারভেশন শেষে আজমল তালুকদার সাহেবকে বাসায় আনা হয়৷ এখন উনি মোটামুটি সুস্থ। গতকাল রাতেই সে এসেছে বাসায়। তার সঙ্গে হাসপাতালে প্রতিনিয়ত ইমান ছিল। সোনালী আপুও থেকেছে৷ ইমান বাসায় এসে নিজের রুমে ফ্রেস হতে গিয়ে দেখে, মেঝেতে ওলরেডি তোষোক পেতে রাখা হয়েছে। সে ভাবলো, নিশ্চয়ই তার জন্য মিরা আধিখ্যেতা দেখিয়ে ফ্লোরিং করে সাহায্য করছে৷ কস ম্যাডাম তো আর ফ্লোরে ঘুমাবে না৷

সে বাথরুম থেকে ফিরে এসে দেখে, রুমের দরজা লাগানো। এবং আশ্চর্যজনকভাবে মিরা ফ্লোরে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ দরজা বন্ধ করার ব্যাপারে ইমান নিজেই লজ্জা পেল। না জানি বাইরে কে কী ভাবছে! ইশ! বাংলাদেশে এইসব এতো কমপ্লিকেটেড কেন?

সে বিছানায় এসে বসে। এবং বেডে শুয়ে পড়ে।হাত-পা ছড়িয়ে শুলো। দুইদিন পর এমন আরাম করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে পেরে চোখ আপনা-আপনি বুজে গেল তার৷ শান্তিতে তার গা ছেড়ে দিল।

সকালে ঘুম থেকে উঠে ইমান বুঝলো, এই বাসার পরিবেশ আবারো আগের মতোই। তার শ্বাশুড়ি রান্না করছে। শ্বশুড় রুমে বসে পেপারে চোখ বুলাচ্ছে। বড়মামা ড্রয়িংরুমে বসে আছে৷ ইরা স্কুলে গেছে। বাসায় মিরা আছে। তার তাকে সাহায্য করছে৷

ইমান বড়মামাকে নিয়ে খেতে বসে৷ দাদীও এসে বসলেন৷ মিরা রুটি এনে প্লেটে সাজিয়ে দিচ্ছিলো৷ এমনই সময় ইমান বলে উঠে, মামা, “আমার ফ্লাইট আগামী বুধবার। মানে আর দু’দিন পর৷”

মামা আহত গলায় বলে,” তোমার যাওয়ার সময় হয়ে গেল!”

–“জি।”

আজমল তালুকদার কিছু বললেন না। ইমান বিয়ের সময়ই বলেছে তার সবটা গুছিয়ে নিতে সময় লাগবে। এবার তার পক্ষে মিরাকে আমেরিকা নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়৷ তবে খুব শ্রীঘ্রই সে মিরাকে নিয়ে যাবে। আজমল সাহেব চাচ্ছেন মিরা ভার্সিটি ভর্তি হোক। স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশ যাক৷ কিন্তু আদৌ এটা বাস্তবায়ন সম্ভব কীনা তিনি জানেন না। তবে ইমানকে সে সময় দিবে। আর মিরারও পরিবার থেক্ব দূরব থাকার জন্য সাহস, সময় ও মানসিক প্রস্তুতি দরকার

মিরা আর বাকিটা শুনলোনা। সে প্লেট হাতে রান্নাঘরে ঢুকে পরে। আচমকা তার চোখ বেয়ে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পরে৷

পরের দু’টো দিন খুব দ্রুত কাটলো৷ ইমান ট্রলি গুছাতে ব্যস্ত ছিল। রাতে মিরা নিচে ঘুমালো। ইমান খাটে। তাদের মধ্যে কথা হত না কোন। অবশ্য যাওয়ার দিন সকালে ইমান ঘুম থেকে উঠে তাকে বলে, ” আজকে থেকে তুমি বেডে ঘুমাতে পার। আমাদের আর দেখা নাও হতে পারে সরাসরি। আমি নেক্সট কবে ঢাকা আসব নিজেও জানি না। সো গুডবাই৷”

মিরা ঘুম ঘুম গলায় বলে, “গুডবাই।”

এয়ারপোর্টে সবাই তাকে সি অফ করতে গেল৷ মিরাও সঙ্গে ছিল। তার কোন অনুভূতি হচ্ছে না। সে চুপচাপ সবার সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। ইমান আজকে ধূসর রঙের একটা টিশার্ট পরেছে। মিরা তাকে অনেকবার দেখল। প্রতিবার দেখার সঙ্গে সঙ্গে বুক মোচড় দিয়ে উঠছিল। সে সবার কাছ থেকে আলাদা ভাবে বিদায় নিল। দাদী ওর হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। সোনালী আপু প্রান্ত ভাইয়ার সঙ্গে কথা বললো। এর সুপ্তি বেগমকে বলল, ” নিজের যত্ন নিবেন মা৷”

এই প্রথম মিরার মাকে সে মা বলল। মিরা ও সুপ্তি বেগম দুইজনই চমকে উঠে। সুপ্তি বেগম তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। পাশেই মিরা দাড়ালো ছিল। তাকে ইগনোর করে সে ইরার কাছ থেকে বিদায় নিল৷

এয়ারপোর্টে ঢুকে যায় সে সবার কাছে বিদায় নিয়ে। তখনো তাদের মধ্যে কোন আলাপ হলো না৷ মিরা বিষন্ন চোখে তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল৷

ইমান ইমিগ্রেশন শেষ করে সামনে পা বাড়ালো। তখনই এক জায়গায় লেখা দেখল, “ওয়েলকাম টু নিউইয়র্ক। ”

কেমন শিহরণ বয়ে গেল তার মনের কুঠরীতে। বাংলাদেশ থেকে সে চলে যাচ্ছে। অনেকদূর। এতো খারাপ কেন লাগছে? কেন মন চাচ্ছে সব ছেড়ে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে যেতে? কোন পিছুটান কী কাজ করছে?

চলবে।

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–23

নিউইয়র্কের কোন একদিন সকালেঃ

খুবই সাধারণ নিয়মে শুরু হওয়া একটা দিন। সকাল থেকেই আবহাওয়া বেশ আদুরে। সূর্য যেন আপন মনে হাসছে৷ কোথাও বিষাদের একটুখানি ছোঁয়া নেই। সবাই ব্যস্ত হয়ে ছুটছে কাজে৷ এ যেন কাজের দেশ! এখানে কেউ এক সেকেন্ডও কাজ ছাড়ে থাকে না। সবার মধ্যে কাজ করার নেশা৷

ইমান মাত্র নিউইয়র্কে পা রাখলো। মাত্র প্লেন ল্যান্ড করল। এখনো প্লেনের মধ্যে আছে সে। একটু পর সকল যাত্রীর মধ্যে নেমে পরার তাড়াহুড়ো লেগে গেল। বেশ কয়েকজন এয়ারহোস্টেজ এসে সাহায্য করছে তাদের৷ ইমান দেখল, বাংলাদেশ থেকে একটা কাপল এসেছে। ওদের সে বহুক্ষণ ধরেই নোটিশ করছে৷ ছেলেটা সম্ভবত এখানেই থাকে৷ তার সঙ্গে মেয়েটা এসেছে। সালোয়ার কামিজ পরে এসেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সদ্য বিবাহিত সে৷ কেঁদে কেঁদে মেয়েটার চোখ ফুলে গেছে। পরিবার থেকে বিচ্ছেদের ব্যথা ও এতোদূর জার্নি করার ধকলে মেয়েটা কাহিল৷ কিন্তু ছেলেটার মধ্যে এ নিয়ে কোম হেলদোল নেই। বরং সে মেয়েটার কর্মকাণ্ডে বিরক্ত! মেয়েটাকে আরেকবার পর্যবেক্ষণ করে সে৷ ক্ষণেই সে চমকে উঠে। আচ্ছা কাঁদলে কী সব মেয়েদেরই চোখ ফুলে যায়?

আচানক একটা সুরেলা কণ্ঠের আওয়াযে তার চিন্তার অবসর ঘটে৷

–” স্যার, ডু ইউ হ্যাভ এনি প্রবলেম?”

— “না। কোন সমস্যা নেই৷”বলে সে এয়ারহোস্টেজের দিকে তাকালো। মেয়েটা অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বোঝা যাচ্ছে সে ইমানের বলা কথা বুঝেনি৷ মুহূর্তে তার মনে পড়ে যায় সে বাংলা ভাষায় বলেছে। সাদা, ধবধবে গায়ের রঙের মেয়েটির বাংলা বোঝার কথা নয়৷

সে অপ্রস্তুত হেসে উঠে দাঁড়ালো৷ মেয়েটা সরে যায়৷

প্লেন থেকে নামার আগ মুহূর্তে কোথা থেকে যেন মেয়েটা পুনরায় তার কাছে এসে বলে, “ওয়েলকাম ব্যাক টু নিউইয়র্ক। হ্যাভ এ নাইস ডে, স্যার৷”

ইমান হাসলো। কিন্তু ভভদ্রতাসূচক কোন কথাবার্তা বলল না৷ কিন্তু এই দেশে ভদ্রতার অনেক দাম। সবাই ভদ্র আচরণ করতে চায়৷ সে নিচে নেমে এলো৷ এরপর মিনিট এক দাঁড়িয়ে থাকল৷ কেমন বিষন্নতা ছেয়ে আছে মন জুড়ে। বাসায় কাউকে জানিয়ে আসেনি সে। কেউ জানে না সে আসবে আজ। হুট করে বাসায় গেলে তার জন্য অবশ্য কেউ খুশি হবে না। তবুও নিজের সেই বিছানার জন্য মন কেমন করছে। ইমানের ভাবতেই অবাক লাগছে, মাত্র একটা দিনের ব্যবধানে সে বিশ্বের অপর প্রান্তে এসে পৌঁছালো। এখান থেকে চাইলেও কেউ আর তার চায়ে লবন মেশাতে পারবে না৷ তার বুকে আচানক মোচড় দিয়ে উঠল। সম্পূর্ণ ভ্রমণ জুড়ে সে ভীষণ উদাসীন ছিল৷ কিছুই খেতে পারছিল না। তার ট্রাভেল পার্টনার সান্ত্বনাস্বরুপ বলে, “প্রিয়জনদেরকে ফেলে এতোদূর আসলে, কষ্ট তো হবেই। তাই বলে, না খেয়ে থাকা কোন সমাধান না।

ইমান চকিতে উঠে। সে কী তার প্রিয়জনকে ফেলে এসেছে? কে জানে ভাই! সে কিচ্ছু জানে না। শুধু এই মন খারাপ থেকে ছুটি চায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা ছোট্ট ভারী বেদনাযুক্ত শ্বাস ফেলে সে।

এখনো এয়ারপোর্টের মধ্যে আছে সে৷ নিজের ব্যাগ-ট্যাগ, ল্যাগেজ বুঝে নিয়ে বাসার পথের উদ্দেশ্য বের হলো। বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সকালের শুভ্র বাতাসে আরামবোধ হতে থাকলো তার। স্নিগ্ধ, দূষণমুক্ত বাতাসে মন ভালো হয়ে যাবে নিঃসন্দেহে যে কারো। সে বুক ভর্তি করে বহুদিন পর এমন দূষণমুক্ত বাতাস টেনে নিল। বাতাসের ঘ্রাণটা বদলে গেছে। অর্থাৎ সে যে স্থান পরিবর্তন করেছে এটা বাতাসের ঘ্রাণ থেকেই বোঝা যাচ্ছে।
একটা ক্যাব ভাড়া করল। এখান থেকে তার বাসায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য। ট্যাক্সি ড্রাইভার হেসে তাকে গুড মর্নিং জানালো। সে বিনিময়ে হেসে তাকেও গুড মর্নিং জানিয়ে উঠে পরে৷

শোশো করে গাড়ি চালাচ্ছে ড্রাইভার। জ্যামের কোন চিহ্ন নেই। তবে দু’বার সিগনালের জন্য থেমেছিল গাড়ি। দু’বারই সে মনের অজান্তেই জ্যামে পড়ে গেছে ভেবে নাক কুচকে ছিল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি চলতে আরম্ভ করলে, মনে পড়ে যায়, এদেশে কোন কারণ বা দুর্ঘটনা ছাড়া জ্যাম লাগার কথা না।

দু’পাশে সবুজ আর হলদে পাতায় ঘেরা প্রকৃতিকে পাশ কাটিয়ে তারা ছুটে চলছে গন্তব্যে। গাড়ি বেশ জোরে চলছে। সম্ভবত নব্বইয়ে গাড়ি তুলেছে। এই হাইওয়ে তে একশ অব্দি স্প্রিড তোলা যাবে৷ সে চোখ বুজে ফেলে৷ মাথা ব্যথা করছে৷ সেই সাথে তার সারা শরীর জুড়ে ব্যথা৷ একটানা চব্বিশ ঘন্টার বেশি বসে থাকায় পা, কোমড় ব্যথা হয়ে গেছে৷ প্লেনের শেষ মুহূর্তগুলোয় খুব অসহ্য লাগে৷ মনে হয় জানালা দিয়ে ঝাপিয়ে পড়ুক। বসে থাকতে থাকতে আর বসে থাকা সহ্য হয় না। অবসন্ন মন নিয়ে জার্নি করা খুব কঠিন৷

মিনিট বিশ পর গাড়ি থামল। সে চোখ খুলে ফেলে। পরিচিত দৃশ্য। তার বাসার সামনেই থেমেছে গাড়ি৷ দো’তলা বাড়িটির সামনের বাগান চোখে পড়ছে সবার আগে৷ বাগানে ফুটে থাকা রং-বেরঙের ফুলগুলো হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে।যেন তাকে স্বাগতম জানাচ্ছে তারা৷ সে নেমে ভাড়া চুকালো। আশি ডলার দিতে হলো ড্রাইভারকে৷ ড্রাইভার তাকে গুডবাই বলে শোশো করে গাড়ি নিয়ে চলে গেল। মিনিট এক গাড়ির যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে তার মনে হলোঃ পৃথিবীর প্রতিটা জীবের বৈশিষ্ট্য হলো ছেড়ে যাওয়া।

পাশের বাসার পাইন ট্রির সামনে সে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। নিজের বাসাটাকে কেমন অপরিচিত লাগছে। একমাসের মধ্যে বাড়িটা তাকে পর করে দিল কীনা? সে স্নান হাসলো। পরদেশে আসলে কেউই আপন হয়না! এই বাড়িও তার আপন না। তবুও আপন হওয়ার ভান সেজে থাকে।

বাসার সামনে এসে দাঁড়ালো সে। ল্যাগেজ আর ব্যাগগুলো একপাশে রেখে বেল টিপলো। এতোক্ষণে সবারই উঠে যাওয়ার কথা। বাবা নিশ্চয়ই এখন ব্রেকফাস্টের জন্য টেবিলে বসে আছে। সাদ মনে হয় এখনো রুম থেকে বের হওনি। সাদ তার ছোট ভাই। তার চেয়ে বয়সে বেশ ছোটই। ছেলেটা এবারে ইউনিভার্সিটিতে উঠেছে। ভাব-গতি ভালো না। সারাদিন গার্লফ্রেন্ডদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে৷ পড়াশোনায় মন নেই বললেই চলে। ডেটিং করায় ব্যস্ত থাকে। কেউ কিছু বললে এক কথা, “আমার লাইফে আমি যা ইচ্ছা করব৷” আমেরিকায় স্বাধীনতার কোন অভাব নেই। বরং যারা স্বাধীনতা কেড়ে নিতে চায় তাদের শাস্তি হয়। এজন্য তাকে কেউ ঘাটায় না। যে যার মতো নিজের লাইফ নিয়ে ব্যস্ত।

মিনিট একের মধ্যে তার বাবা জহির খান দরজা খুলে দিল।

ইমান তাকে দেখে হাল্কা হেসে বলে, “হ্যালো।”

জহির সাহেব ভ্রু কুচকে তাকালেন ছেলের দিকে। কিছু বললেন না। গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল৷

ইমান বলে উঠে, “আমি ইমান। চিনতে পারছেন না? ”

জহির সাহেবের মুখ তখন দেখার মতো হল। সে সামান্য ভড়কে গেল৷ সে আরোও গম্ভীর হয়ে বলে, “চিনব না কেন? কিন্তু তুমি হুট কিছু না বলে চলে এলে!”

ইমান বাবার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। ড্রয়িংরুমে কাউকেই দেখা গেল না। যাক ভালো, সকাল-সকাল আন্টির মুখোমুখি হতে চায় না সে। ল্যাগেজ আর ব্যাগ টেনে নিয়ে গেল সে নিজের রুমে। রুম লক করে গিয়েছিল। কাজেই রুমের দরজা খুলতেই ভোটকা গন্ধ ভেসে আসলো। গুমোট, বদ্ধ থাকার জন্য ভ্যাপসা হয়ে আছে রুম। কোথাও কোথাও মাকড়সা জাল বুনেছে। সে জানালা খুলে দিল। বাতাসের তেজে ভ্যাপসা ভাব কেটে যেতে থাকে। সে এগিয়ে এসে নিজের বিছানায় বসল। বিছানায় ধুলো জমে গেছে৷ উঠে দাঁড়ালো সে। বিছানার বেডশিট বদলাতে হবে৷ এবং সে অনুভব করল, তার ক্ষুধা পেয়েছে।

সবার আগে নিজের রুম থেকে বের হয়ে সে কিচেনে গেল এবং ওর্টস বের করে নিল। আপাতত ওর্টসই খাবে৷ খাওয়া শেষ করে রুম পরিষ্কার করে একটা লম্বা ঘুম দিবে৷

ওর্টসের বাটি রুমে এনে টেবিলে রাখতেই মন আবারো বিষিয়ে গেল। আজ একা একা খেতে হবে৷ এ কয়েকদিনে অভ্যস বদলে গেছে তার। ডাইনিং টেবিলে সবার সঙ্গে ভাত-পরোটা খেত, এখন একা একা ওর্টস গিলতে পারলো না সে। এরমধ্যে বাবা একবার এসে দেখে গেল তাকে৷ উনি বলে উঠে,” তুমি সিক?”

ইমান তখন খাওয়ায় এক্সট্রা মমনোযোগ দিয়ে বলে, “না৷”

–“ওহ দেখে মনে হলো আরকি। আচ্ছা খাওয়া-দাওয়া কর৷ আমি পরে আসব।”

বাবা যাওয়ার পর সে আর খেতে পারল না৷ সে ক্ষুধা পেটে নিয়েই ওর্টস রেখে দিল। আর খেল না।
কোনমতে বিছানার চাদর বদলে ঘুমাবার জন্য প্রস্তুতি নিল।

______________

জুই অফিসে যাওয়ার জন্য মাত্র রেডি হলো। বাবা আগেই বেরিয়ে গেছে। সে দেরিতে যাচ্ছে। আজকে তার কাজের চাপ নেই। প্রজেক্ট আটকে আছে দুটো। এজন্য কাজও আপাতত আটকা পরে গেছে তার। সে নিজের রুমে রেড রোজের বুকেট সাজালো। প্রতিদিন নিজের রুমে তার ফ্রেস ফ্লাওয়ার চাই-ই। বাসার সবচেয়ে নিকটস্থ ফ্লাওয়ার শপের সঙ্গে তার চুক্তি আছে। তারা প্রতিদিন সকালে তাকে ফুলের বাকেট দিয়ে যায়। সে জানেও না কী ফুল দেওয়া হবে তাকে। এজন্য একটা আগ্রহ কাজ করে। এই যেমন আজ সকালেই লাল টকটকে গোলাপ দেখামাত্র তার মন খুশিতে নেচে উঠল৷ এবং মিষ্টার খানের কথা ভীষণ মনে পড়ে গেল৷ মিষ্টার খান ফুল তেমন একটা পছন্দ করে না। তবে গোলাপ দেখলে নাকে নিয়ে গোলাপের সুবাস নিবে৷

সে লাল লিপস্টিক ঠোঁটে মেখে রওনা হলো। লাল একটা টপস আর হুয়াইট জিন্স পরে নিল। আজকে গাড়ি সঙ্গে নিবে না৷ এমন ওয়েদারে সাইকেলিং করতে ইচ্ছা করে খুব। সে সাইকেল বের করে চালাতে লাগলো। আজকে অনেক তরুণ-তরূণী সাইকেল, স্কূটি চালাবে৷ অনেকেই সুইমিং করতে যাবে৷ পাখির কিচিরমিচির আওয়াজের মধ্যে দিয়ে হিমেল বাতাসের বিপরীতে সাইকেল চালাতে দিব্যি লাগছে তার। সঙ্গে এয়ারফোনে তার প্রিয় গান৷ গাছে গাছে পাতা। তীব্র বাতাসে পাতা ঝরে পরছে৷ একটা নাম না জানা গাছের হলদে সবুজ পাতা তার মাথায় টুপ করে এসে পরল এবং চুলে আটকে গেল। সে চুল থেকে পাতা সরালো না আর৷

মিষ্টার খানের বাসার সামনে আসতেই সে চমকে গেল।সাইকেল প্রচনশ বেগে থামিয়ে দিল জন্য গতির কারণে সামান্য সামনের দিকে ঝুকে পরে। দোতলার ও’পাশটার জানালা খোলা। ওইরুম তো মিষ্টার খানের। বিগত একমাসে কেউ জানালা খুলেনি। তবে আজ কেন খুলে দেওয়া হয়েছে? তার মস্তিষ্কে একটা ভাবনাই এলো, উনি ফিরে এসেছেন। আনমনে সে হেসে উঠে৷ উনি কী সত্যি এসে গেছে? সেদিনই তাদের কথা হলো। তাকে তো বলল না আজ ফিরবে। শুধু বলেছিল খুব দ্রুত ফিরবে। “খুব দ্রুত” যে এতো দ্রুত হবে তা বিন্দুমাত্র ভাবে নি সে। উত্তেজনায় তার হাত কাঁপতে লাগলো। কি করবে সে? ওনার বাসায় ঢুকবে? জুই সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এরপর মিষ্টার খানের নাম্বারে কল দিল। রিং বাজছে। সে খুশিতে লাগিয়ে উঠে৷ পথচারীদের অনেকেই তার দিকে তাকালো। জুইকে হাসতে দেখে তারাও হেসে ফেলে এবং তাকে অতিক্রম করে চলে গেল।

জুই এবারে কনফার্ম যে মিষ্টার খান এসেছে। রিং যাচ্ছে ফোনে। মানে ফোনে সীম লাগিয়েছে ইতিমধ্যেই। কিন্তু তাকে একবার জানানো যেত না? তাহলে সে এয়ারপোর্টে গিয়ে রিসিভ করত৷ জুই আরেকটু দাঁড়িয়ে থাকল উপরের দিকে তাকিয়ে। ইমান এখন বোধহয় খুব ক্লান্ত। বিকেলে এসে দেখা করবে সে। এছাড়াও আংকেল জোয়ের সঙ্গেও দেখা হয় না কয়েকদিন ধরে৷কতবার আংকেল তাকে বাসায় আসতে বলেছিল। কিন্তু সে গেল না। আজকে সে আসবে এবাসায়। কারণ যার জন্য এই একমাসে একবার ও এ বাসামুখো হয়নি। সেতো চলে এসেছে। অতএব সে আজকে আসবেই। এবং আসার সময় মিষ্টার খানের জন্য কিছু স্পেশাল গিফট নিয়ে আসবে। স্পেশাল গিফট ফর স্পেশাল পারসন!

চলবে।