#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–27
টেক্সাস, মার্কিন মুলুকের একটি অন্যতম বিখ্যাত রাজ্য। আলাস্কার পর নাকি টেক্সাসই বৃহত্তম অঙ্গরাজ্য৷ বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠী নিয়ে এই শহর গড়ে উঠেছে। বিশাল, উচু বিল্ডিংয়ের মাঝে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রশংসনীয়। তবে ইমানের এই শহরটা ভালো লাগে কারণ এর তিনদিকে ঘেরাও করে আছে নদী৷ সমুদ্রের তীরবর্তী এলাকা গুলো চোখ ধাধানো সৌন্দর্যের অন্যতম নিদর্শন। পূর্বের দিকে সাবিনে নদী টেক্সাসকে এবং লুইজিয়ানাকে বিভাজন করেছে। সাবিনে নদীর সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য এখন অব্দি ইমানের হয়নি। সে আপাতত ডালাসে যাবে। ডালাস নর্থ টেক্সাসে অবস্থিত। ব্যবসা বা কমার্শিয়াল কাজের জন্য ডালাস জনপ্রিয় এক নাম৷
ডালাসের ওয়েদার আজ ফুরফুরে। যেন বসন্ত লেগেছে ডালাসে। গাছে গাছে সবুজ-হলুদ পাতায় ভরপুর। আবহাওয়া না অতি গরম, না অতি শীতল। পারফেক্ট ওয়েদার যাকে বলে আজকের ডালাসের আবহাওয়াও সেইরকম। এটাও এক ধরনের সৌভাগ্য। গতবার ওয়েদার খারাপ হওয়ায় তাকে ভুগতে হয়েছিল বেশ। এজন্য ওয়েদার রিপোর্ট দেখে একদিন আগেই এসেছে। ক্লাইটের সঙ্গে আলাপ করে মিটিংয়ের ডেট এগিয়ে এনেছে সে। তার ক্লাইট রবার্ট হিউস্টনে থাকে।
হাইওয়ে রুট ধরে সে আর জুই এগিয়ে যাচ্ছে। ড্রাইভিং কন্ট্রোল করছে জুই। আমেরিকান মেয়েরা ড্রাইভিংকে খুব ইঞ্জয় করে। এক ধরনের গেম মনে করে৷
জুই হাইওয়েতে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল৷ ইমানের সামান্য ভয় লাগলো। এতো স্পিডে গাড়ি চালানো ঠিক না। হুট করে নিয়ন্ত্রণ হারা হলে বিপদ। তাছাড়া এই রাস্তায় আশির উপরে উঠানোর নিয়ম নেই। পুলিশ দেখলেই হলো। সঙ্গে সঙ্গে ফাইনে মোটা অংক কষবে৷ কিংবা কে জানে ইতিমধ্যে তাদের গাড়ির নাম্বার টুকে নেওয়াও শেষ তাদের৷ জুই গাড়ির কাঁচ খুলে দিয়ে গাড়ির স্পিড আরো বাড়ায়। বাতাসে তার চুল উড়ছে৷
ইমানের শার্টটাও টলছে, এতো বাতাস আজ। সে সর্তক বার্তা দিয়ে বলে, ” গাড়ির স্পিড কমাও। ট্রাফিক রুলস ব্রেক করছো।”
জুই হাসি দিয়ে বলে, “লেটস ব্রেক ওল দ্যা রুলস টুডে।”
–” ভেরি ফানি। গাড়ির স্পিড কমাও প্লিজ।”
এবারে কাজ হলো। সে স্পিড বেশ কমিয়ে দিয়ে বলে, “তুমি কিছু অনুরোধ করলে, আমি সেটা না করে থাকতে পারব না।”
ইমান ভ্রু কুচকে বলে, সর্যি?
ঠিক সেই মুহুর্তে হর্ণ বাজিয়ে দুটো পুলিশের জীপ তাদের সামনে থামল। ক্ষণেই দুইজন পোশাকধারী পুলিশ জীপ থেকে বের হয়ে তাদের পথ আটকালো৷
ইমান চোখ পাকিয়ে জুইয়ের পানে তাকালো। জুই জিভে কামড় দিয়ে বলে, “ওহ শিট!”
পুলিশ এসে তাদের দুইজনকেই বের হতে বলে একগাদা লেকচার দিল সঙ্গে জরিমানা ফ্রি!
ট্রাফিক পুলিশের জীপ যেতেই ইমান বলে, ” এখন আমি ড্রাইভ করব৷”
জুই “ওকে” বলে তার দিকে চাবিটা থ্রো করলে ইমান বাম হাত দিয়ে তা অনায়াসে ধরে ফেলে। জুই হাততালি দিয়ে বলে, “নাইস ক্যাচ।”
সে শুধু হাসে। এরপর গাড়ির ড্রাইভিং সীটে গিয়ে গুগল ম্যাপ অন করে। তারা ডালাসের দিকে যাত্রা করছে৷ কিন্তু এখনো ডালাস শহরে ঢুকেনি। আরো পনের মিনিট পর ডালাসে ঢুকবে। সে চাবি ঘুরিয়ে গাড়ি চালু করল। জুই এবার তার পাশে বসে গুনগুন করে গেয়ে উঠে,
Oh, baby, I wish you were here
But the only way I can see you, darlin’, is in my dreams
It’s a highway song
You sing it on and on
On and on
গানের শ্রুতিমধুর শব্দ কানে আসতেই ইমান ফিরে তার দিকে তাকালো। ও খুব সুন্দর করে গায়। এতো মিষ্টি ভয়েজ! হাইওয়েতে এমন মিষ্টি গান শুনতে কার না ভালো লাগে৷
নদীর পাশ ঘেঁষে হাইওয়ে দিয়ে তারা ডালাসের ভেতরে প্রবেশ করে। গাড়িতে গ্যাস লাগবে। এক বাতি গ্যাস সো করছে। এইজন্য ইমান নিকটতম গ্যাস স্টেশনে এসে গাড়ি থামায়। ডালাসের গ্যাস স্টেশন সবসময়ই ছিমছাম ফাঁকা থাকবে। প্রতিটি স্টেশনে একজন করে কর্মীকে পাওয়া যাবে। এই স্টেশনের পাশেই ছোট একটা বেভারেজ স্টল। অনেকক্ষণ ধরে না খাওয়া তারা। গ্যাস নেওয়ার ফাকে ইমান জুস কিনল। সঙ্গে খাবার কেনার ইচ্ছা জাগলো তার। সে জুইকে প্রশ্ন করে, ” কী খাবে?”
জুই বলে উঠে,” বিস্কুট আছে?”
— “আছে৷”
— “পাইনাপেল ফ্লেভারের আনো।”
ইমা৷ জুস তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিস্কুট কিনতে যায়। গ্যাস কাউন্টারের লোকটি তাদের আগ্রহ নিয়ে দেখছিল। ইমান যেতেই সে জুইকে স্প্যানিশ ভাষায় প্রশ্ন করে, “ছেলেটা তোমার কে হয়?”
টেক্সাসে ম্যাক্সিমাম মানুষ ইংলিশেই কথা বলে। তবে গুটিকয়েকজন মানুষ আছে যারা স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে। জুই হাল্কা-পাতলা স্প্যানিশ জানে। কিন্তু পটু না। সে লোকটার কথা বুঝে যায়। এবং উত্তরে বলে, ” বয়ফ্রেন্ড হয়।”
লোকটা হাসল এবং বলল, “বেস্ট উইশের ফর বোথ অফ ইউ৷”
ইমান ফিরে আসলে তারা রওনা হলো। জুইকে মিটমিট করে হাসতে দেখে ইমান প্রশ্ন করে, “ব্যাপার কী? হুট করে এতো হাসছো কেন?”
জুই জানালার দিকে তাকিয়ে বলে, “হুট করেই মন এতো ভালো হয়ে গেল!”
নিদিষ্ট স্থানে এসে পৌঁছাতে তাদের দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। ইমান হোটেল বুক করে রেখেছে অনলাইনের মাধ্যমে। দুইটা রুম বুক করাই আছে। হোটেলে এসে ফ্রেশ হলো তারা। সন্ধ্যায় ক্লাইটদের সঙ্গে মিটিং আছে৷ দেরি করতে চায় না সে। আজকে এই মিটিং শেষ হলে সকালে একটা ছোটো কাজ সেরে দুপুরেই বাসায় ফিরে যাওয়ার প্লান আছে তার৷
বিকেলে জুই তাকে কল দিয়ে পুল সাইডে আসতে বলে। তার এই মূহুর্তে পুলে ঘুরাঘুরি করার ইচ্ছা নেই। একদম সন্ধ্যায় রুম থেকে বের হবে সে। ফাইলপত্র গুছিয়ে নিয়ে সে কিছুক্ষণ রেস্ট নিল। সন্ধ্যায় নিচে নেমে এসে সে ক্লাইটকে কল দিল। ক্লাইট তথা মিষ্টার রবার্ট জানালো, সে ওলরেডি পুল সাইডে জুইয়ের সঙ্গে গল্প করছে৷
ইমান জানে রবার্ট জুইয়ের প্রতি উইক। গতবারই ইমান ধারণা করতে পেরেছিল। যাইহোক সে পুলের দিকে আগালো। পুল সাইডে বেশিরভাগই কাপলরা একসঙ্গে টাইম স্পেন্ড করে৷ খোলামেলা ভাবে অনেককিছুই ঘটায় তারা। ইমান এসবে অভ্যস্ত হলেও বেশ অস্বস্তি লাগে যদি সঙ্গে কেউ থাকে৷
জুই আর রবার্ট কী নিয়ে যেন হাসাহাসি করছে। সে আসতেই রবার্ট হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করল।
ইমান বলে উঠে, “মিটিং শুরু করি তাহলে? ”
জুই তখনই বলে উঠে, ” বলেছিলাম না মিষ্টার খান এসেই বলবে লেটস স্টার্স্ট।
রর্বাট সায় দিয়ে বলে, ” তোমার ওয়ার্কোহলিক অভ্যাস নিয়েই আমরা হাসাহাসি করছিলাম।আজকে ভাবছি লেট নাইট পার্টি করব। এন্ড ইউ হ্যাভ টু কাম।”
ইমান বলে, ” সেটা পরে দেখা যাবে।”
ইমানের জোরাজোরিতে তারা কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠে। সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা অব্দি কাজ করে সকলেই ক্ষুধার্ত হয়ে গেছে। রবার্ট ইমানের কাজে বেশ সন্তুষ্ট। তাই সে অফার দিল আজকে ডিনার তার তরফ থেকে। উনি ইমানকে প্রশ্ন করে,” কী খেতে মন চাচ্ছে? ”
সে বলে উঠে, “ভাত আর আলুভর্তা৷”
রবার্ট অবাক হয়ে বলে,” বুঝিনি।”
ইমান হেসে ফেলে বলে, ” আপনি যা অর্ডার দিবেন তাই খাব।”
রবার্ট খাবার অর্ডার দিতে গেল। জুই আর সে একা বসে আছে। পাশের টেবিলেই একটা খুব সুন্দরী ইরানী মেয়ে তার ব*য়ফ্রে*ন্ডকে নিয়ে এসেছে। দুইজনের মধ্যে দূরত্ব অনেক কম। ঘ*নি*ষ্ঠ অবস্থায় যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত! ইমান একবার সেদিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। জুইয়ের সামনে এমন দৃশ্যপটের কবলে পড়ায় সে বেশ বিব্রত করছে৷
জুই বলে উঠে, ” রবার্ট আমাকে একটা ড্রেস গিফট করল।”
–” আজকে পার্টিতে পরার জন্য করেছে । ”
–“ইয়েস।”
–“বাহ”।
— “বাট আচমকা আমাকে কেন সে গিফট দিবে?”
ইমান ফোন হাতে নিয়ে বলে, ” উনি তোমার জন্য কিছু ফিল করে।”
জুই ভড়কে গিয়ে বলে, ” তুমি কীভাবে জানলে?”
–” বোঝা যায়।”
সে সামান্য হেসে বলে, ” তুমি এইসবও বুঝো? আমি তো ভেবেছি প্রোগ্রামিং ছাড়া তুমি কিছু বুঝো না।”
ইমান বলে উঠে, ” মাঝে মাঝে বুঝি।”
জুই বিড়বিড় করে বলে, ” সবসময় বুঝলে ভালো হত।”
ইমান নিজ থেকে বলে উঠে, “রবার্ট অনেক ভালো একজন মানুষ। তুমিও সিঙ্গেল। তোমাদের একসাথে মানাবে বেশ। ”
জুই তার চোখে চোখ রেখে বলে, “আমি মনে মনে ওলরেডি টেকেন।”
ইমান অবাক হয়ে বলে, ” সিরিয়াসলি! হু ইজ হি?আই মিন হু ইজ দ্যা লাকি গাই? কোনদিন জানাওনি তো!”
জুই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, যেই হোক না কেন, রবার্ট সাহেবকে আমি সুযোগ দিব না।”
তখনই রবার্ট আসলেন। তিনজন একসঙ্গে ডিনার করে, কিছুক্ষণ পার্টির আমেজে থেকে জুই বলে উঠে মাথা ব্যথা করছে তার। সে রেস্ট নিতে চায়৷ জুই গেলেও ইমান যায় না।
সে রাত অব্দি রবার্টের সাথে ড্রিংক করলো।
_________________
নিউইয়র্কে এসে সময় এতো জলদি অতিবাহিত হতে লাগলো ইমানের যে ঠিকঠাক মতো খাওয়ার সময় পায়না। কীভাবে কীভাবে যেন চারটা মাস কেটে গেল সে টের পর্যন্ত পেল না। বাংলাদেশে কারো সঙ্গে যোগাযোগ নেই তার৷ বিল্ডার্সের সঙ্গে অবশ্য কথা হয়। তবে শুধু কাজের কথা৷
ইমান নিউইয়র্ক আসলে ওখানকার কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখে না৷ এটা নতুন কিছু না। এর আগেও করত। তবে বড় মামা কিছু দিন আগে ফোন দিয়ে বলেছে, সে মিরার ওখানে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে কীনা৷ মুখে চেষ্টা করছি বললেও ইমান আসলে তেমন কোন উদ্যোগ নেয়নি। খালি একটা ভার্সিটির খোজ নিয়েছিল এই যা! মামা ওপাশ থেকে বলেছিল, আমিও চেষ্টা করছি৷ ব্যাস এরপর এক প্রকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।মিরার সঙ্গে কোন এক কারণে তার কথা হয় না৷ মেয়েটা তার ফোন ধরেনা। ইমান দু’বার কল দিয়েছিল কিন্তু ধরেনি। অন্য নাম্বার থেকেও দিয়েছিল৷ সীম আমেরিকান হওয়ায় মিরা সেই নাম্বার রিসিভ করেনি। এজন্য রাগে-দুঃখে, ক্ষোভে সে আর কল দেয় না।
আজ অফিসে প্রচুর প্রেশার ছিল। কাজ শেষ করে মাত্র সে লাঞ্চ করতে যাবে, ওমনি তার নাম্বারে হাসনাহেনার কল আসে। সে অবাক না হয়ে পারল না। এই মহিলার সঙ্গে এক ঘরে থেকেও তার কথা হয়না। আজকে ফোন দিচ্ছে কেন? সে ফোন রিসিভ করামাত্রই উনি বিরক্তভরা কণ্ঠে বলে উঠে, “ইমান, বাংলাদেশ থেকে তোমার মেহমান এসেছে। এভাবে বাসায় কাউকে না বলে অপরিচিত মানুষকে কীভাবে তুমি আসতে বল? আক্কেল-জ্ঞান নেই তোমার? ”
ইমান যেন সাত আসমান থেকে পড়ল। বাংলাদেশ থেকে তার কোন আত্নীয় আসলো? সে নিজেই তো কিছু জানে না।
হাসনাহেনা বলে উঠে, “তুমি বাসায় ফেরো জলদি। এখনই আসো। এসব উটকো ঝামেলা কেন কর তুমি? তোমার মেহমান দুইটা বড় ল্যাগেজ নিয়ে এসেছে। কতদিন থাকবে ও? অসহ্য! ”
ইমান থমথমে খেয়ে যায়। কী বলবে সে? কে এসেছে? তার দমবন্ধ হয়ে আসছে। বাংলাদেশ থেকে কেউ তার বাসায় বুঝি এই প্রথম বার আসল!
আসছি বলেই সে অফিস থেকে বের হলো। এবং অফিস থেকে বের হয়ে সে দেখল বাইরে প্রচন্ড বেগে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। বৃষ্টি হচ্ছে এটা অফিসে থাকায় সে বুঝেনি। অফিসের গাড়ি নিয়েই সে বাসার উদ্দেশ্য ফিরে যায়৷ কোন অতিথি এসেছে জানতে হবে তাকে।
বাসায় সে বিশ মিনিটের মধ্যে ফিরে এলো।পুরোটা সময় জুড়ে তার মন ও মস্তিষ্কে অস্থিরতা বিরাজ করছিল। গাড়ি থেকে নেমে বাসায় গেইট অব্দি যেতেই সে কাকভেজা। বেল বাজাতেই হাসনাহেনা বিরক্ত মুখে দরজা খুলে দিয়ে ইশারায় ড্রয়িংরুম দেখালো। অর্থাৎ গেস্ট সেখানেই আছে।
ইমান দেখল, বাসার মেইন ডোরের সামনে দুটো বড় ল্যাগেজ। সে ভেজা গায়ে ডাইনিং রুমের সামনে এলো।
সোফায় ওমুখ হয়ে একজন বসে আছে। সেও তার মতো সম্পূর্ণ ভেজা। ঠাণ্ডায় সে ঠকঠক করে কাঁপছে৷
ইমান তাকে দেখেই ভূত দেখার মতো চমকে দু কদম পিছিয়ে যায়। তার হাতে থাকা ফোন ধপ করে নিচে পরে যায়। সেই আওয়াজে সদ্য আগমনী মেহমান তার দিকে ফিরে তাকায়৷ সঙ্গে সঙ্গে ইমানের মনে বজ্রপাত ঘটে৷
চলবে৷
#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–28
ইমান বিষ্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকল। কখন যে তার হাত থেকে ফোন পড়ে গেছে সেদিকে খেয়াল নেই তার। সে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার৷
সে শক্তি সঞ্চায় করে বলে, “ত..তুমি! এ… এখানে! মানে, আই মিন…….” তাকে আর কষ্ট করে বাক্যটা সম্পূর্ণ করতে হলো না।
এর আগেই রিনরিনে আওয়াজে অপর পাশের শ্রোতা এখন বক্তায় পরিনত হয়ে বলে উঠে, ” আমি আসায় খুব চমকে গেছেন দেখছি। ভয় পেয়েছেন নাকী?”
ইমানের কপালের বলিরেখা ভাঁজ হয়ে আসে। সে গহীন গলায় বলে, ” ভয় পাচ্ছি না৷ কিন্তু বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে। ”
— “আশা করেননি কোনদিন আমি এখানে আসব?”
— “একদম আশা করিনি৷”
— “অথচ আপনার উচিত ছিল আমাকে নিজের সঙ্গে এখানে আনা।”
ইমানের নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোন কর্ম নেই আপাতত। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মিরা৷ মিরা, যার সাথে ফিরে আসবার আগে সে একটাবারও বিদায় নেয়নি। যার সঙ্গে সে দুর্ব্যবহার করেছিল বিয়ের প্রথম রাতে। গত তিনটা মাস ধরে তার কোন যোগাযোগ নেই৷ কিন্তু এই দূরত্ব তাকে পীড়া দিচ্ছে বেশ। প্রতিদিন মনে মনে অন্তত একবার ভাবত যদি তার সঙ্গে একটাবার কথা বলতে পারত! আজকে তার ভাবনা বাস্তবে রুপ পেল। সত্যি বলতে কী, মিরা কে এই পরদেশে দেখে সে খুশি হয়েছে।তার এই খুশি অবশ্য অভিব্যক্তিতে প্রকাশ পাচ্ছে না। সে নিজেও জানে না কেন সে এতো খুশি হলো। এদেশে মিরা তার জন্য উটকো এক ঝামেলা। সে পরখ করে মিরাকে দেখতে লাগলো। চুল থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে৷ কামিজ ভেজা। ভেজা কামিজ শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। তার মুখখানি শুকিয়ে একটুখানি হয়ে আছে। নিশ্চয়ই এই বাসায় কেউ তাকে একফোঁটা পানিও অফার করেনি৷ অথচ মেয়েটা মিনিমাম আধ ঘন্টা আগে এসেছে৷
হাসনাহেনা ড্রয়িংরুমে এসে প্রবেশ করে তাদের দুইজনকে দেখল৷ মিরাকে দেখামাত্র সে মুখ বাকালো। বিরক্তিতে কপাল কুচকে গেল৷ সে বলে উঠে, “ওকে তোমার দোতলায় নিয়ে যাও। নিচে কই ফ্রেশ হবে? উপরে নিয়ে যাও৷”
ইমান মিরাকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আসো।”
সে মিরাকে সঙ্গে নিয়ে ড্রয়িংরুম থেকে বের হলো। এবং তার চোখে ল্যাগেজ পরে থাকার দৃষ্টি এড়ালো না৷ পাচঁ মিনিট আগেও ল্যাগেজ সোজা করে রাখা ছিল। এখন উলটে মেঝেতে পড়ে আছে। সে তড়িৎ গতিতে ল্যাগেজ দুটির দিকে এগিয়ে গিয়ে সোজা করল এবং দুই হাতে দুটো ল্যাগেজ নিয়ে উপরে দোতলায় উঠে৷ দোতলায় পুরো কাজ এখনো কমপ্লিট হয়নি। ইমান দুইটা রুম মিলে থাকছে সেখানে। তার আদেশমতেই বাকি কাজ থেমে আছে৷ সে দুটো রুমের সমান স্পেস নিয়ে নিজের একটা সাবলেট টাইপ বাসা বানিয়েছে। রুমের সঙ্গে এটাচ বাথ, ব্যালকনি আছে।
নিজের রুমে মিরাকে নিয়ে আসলো সে। একসাইডে ল্যাগেজ দুটো রেখে দিল সে।
মিরা বলে উঠে, ” আমি কিন্তু কাউকে কিছু জানিয়ে আসিনি৷”
ইমান যেন আকাশ থেকে পড়ল মিরার কথা শুনে৷ দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ” আগে ফ্রেশ হও। এরপর কথা বলি৷ ওদিকে বাথরুম। ”
মিরা একবার বাথরুমের দিকে তাকালো। ইমান তার দিকেই চেয়ে আছে৷ সে পরপর দুটো হাঁচি দিল।
ইমান বলে, ” ভেজা কাপড়ে থাকার জন্য ঠাণ্ডা লেগে আছে। আমি কফি আনছি৷”
ইমান মুহুর্তের মধ্যে নিচে নেমে যায়। গরম কিছু খেলে ওর ভালো লাগবে। আজকের ওয়েদার কিছুটা ঠাণ্ডাই বলা চলে৷ আর কয়েকদিনের মধ্যে স্নো পরা শুরু করবে। সেই হিসাব করলে এটাকে শীত বলা যায় না। কিন্তু আবহাওয়ায় উষ্ণতা বা উত্তাপ নেই। কিচেন থেকে কফি বানিয়ে বের হওয়ার সময় রান্নাঘরের সম্মুখে হাসনাহেনার সঙ্গে পুনরায় দেখা হলো৷
উনি বলে উঠলেন,” মেয়েটার আক্কেল-জ্ঞান বলে কিছু নাই। ভেজা শরীরে ড্রয়িংরুমে বসে পুরা ড্রয়িংরুম নোংরা করেছে৷ ওর ল্যাজেগ ময়লা, সেই ময়লা ল্যাগেজ ম্যাটের উপর রেখে ম্যাটটা নোংরা করে দিল।”
ইমান মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়ে বলে, “ড্রয়িংরুম আমি ক্লিন করে দিচ্ছি আর কালকে একটা ম্যাট কিনে আনব।”
হাসনাহেনা চলে গেলেন। সেও উপরে উঠে যায়৷ রুমে প্রবেশ করে সে থমথমে খেয়ে যায়৷ মেয়েটা ডিভানে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়েছে। ভেজা কাপড়ও বদলায়নি। ফ্রেশও হয়নি। ওভাবেই ঘুমিয়ে গেছে। ক্লান্ত বোধহয় খুব! ও ওলরেডি হাঁচি দেওয়া শুরু করেছে৷ এখন ভেজা কাপড়ে থাকলে জ্বর বাঁধাবে নিশ্চয়ই!
সে কফির মগ টেবিলে রেখে মিরাকে ডাকল। ঘুম ভাংগানোর চেষ্টা করল। কিন্তু এই দু-তিন মিনিটের ব্যবধানে মিরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে৷ ডেকেও খুব একটা সুবিধা ইমান করতে পারলো না৷
মিরার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল সে। এরপর তার গায়ে হাত দিল। সারা শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। সে ব্ল্যাংকেট এনে তার গায়ে মুড়িয়ে দিল। এসি অন ছিল। এসিও অফ করে ফ্যান চালানোর পর তার মনে হলো হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে দিলে আর ঠাণ্ডা বাঁধবে না৷ নিজের আলমারির ড্রয়ার থেকে হেয়ার ড্রায়ার বের করে এনে আস্তে করে মিরার মাথায় দিকে হেয়ার ড্রায়ার ধরে রাখল। গরম বাতাস নির্গত হতে থাকল। চুলের পানি ক্রমে ক্রমে গরম তাপে বাষ্পায়িত হয়ে গেল। চুল শুকিয়ে দেওয়ার পর বেড থেকে বালিশ এনে মাথায় নিচে রেখে আলতো করে তার কপাল ছুয়ে দিল। আশ্চর্য ব্যাপার! কিছুক্ষণ আগেও শরীর ঠাণ্ডা ছিল। এখন হাল্কা গরম করছে৷ জ্বর আসলো নাকী?
সে আবার নিচে নেমে গিয়ে ড্রয়িংরুম ক্লিন করল। এর ফাঁকে খাবার অর্ডার দিল। যেন মিরার ঘুম ভাঙ্গলে ক্ষুধার্ত থাকতে নাহয়। খাবারও চলে আসল। কিন্তু মিরা তখনো ঘুমে। ইমান ইচ্ছা করেই ডাকছে না। ঘুমাক। চব্বিশ ঘন্টার বেশি প্রথমবার জার্নি করে বেচারি ক্লান্ত।
সে রুমে ফিরে আসল৷ তার রুমটা বিশাল বড়ই বলা যায়। জানালার সাইড ঘেঁষে কিং সাইজের বেড। দেয়ালের সঙ্গে লাগানো কাবার্ড৷ এবং বেডের বিপরীতে ডিভান। এরপর ডানদিকে লো-টেবিল রাখা আছে কাপড় আয়রন করার জন্য। এর পাশেই বড় একটা বুকশেলফ। বুকশেলফের সঙ্গে হেলান দিয়ে গিটার রাখা। বারান্দায় দুটো চেয়ার আর একটা টি-টেবিল এবং উইন্ড চার্ম লাগানো আছে। বাতাস হলেই উইন্ড চার্ম আওয়াজ করছে। রুমে কোন আয়না বা ড্রেসিং টেবিল নেই। ওয়াশরুমের আয়নাতেই তার কাজ হয়ে যায়৷ সে বেডে এসে বসল। এরপর বড় মামার নাম্বারে কল দিল৷ উনি কল ধরলেন না। তার দুশ্চিন্তা হচ্ছে। মিরা হুট করে এখানে আসার মতো মেয়ে না। যেহেতু এতোদূর এসেছে, বড় কোন রিজন আছেই। বাসায় কাউকে না জানিয়ে এসেছে। এটা আরও চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে তাকে৷ এদিকে অফিস থেকে কন্টিনিউসলি কল আসছেই। তার বড় বিরক্ত লাগলো। সে ফোন রিসিভ করে বলে, “আজকে আর আসব না অফিসে। আমার পারসোনাল সময় দরকার। এরপর ফোন বন্ধ করে রেখে দিল৷
চলবে।
#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–29
তখন মাত্র গোধূলিলগ্ন। ইতিমধ্যেই ঘর অন্ধকার হয়ে গেছে৷ নিকষকৃষ্ণ আঁধার অতিক্রম করে আজ সূর্যের কিরণের কোন তেজ নেই। আবহাওয়া হুট করেই খারাপ হচ্ছে। বিকেলে আরেকদফায় বৃষ্টি হয়েছে৷ এখন শহর কালো করে মেঘ নেমেছে। আজ বুঝি সারারাত বর্ষণ হবে। সঙ্গে পাগলা, খেপাটে হাওয়া তো আছেই। দূরে বাজ পড়ার শব্দে বিকট আওয়াজ সৃষ্টি হচ্ছে৷ নিজের শরীরের উপর নরম তুলতুলে ব্ল্যাংকেটের উপস্থিতি টের পেল মিরা। ঘুমের মধ্যেই সে আরামবোধ করে। হাল্কা বাতাসের জন্য ঘুম আরো প্রগাঢ় হচ্ছে৷ কিন্তু অচেতন মন বারবার জেগে উঠতে চাইছে। ঘুমের মধ্যে কারো দৃষ্টির মধ্যমনি হওয়ার ইন্টিউশন পাচ্ছে সে। ব্ল্যাংকেট সরিয়ে ফেলে সে নড়াচড়া শুরু করল। আচমকা নিজের কোমড়ে শীতল এক হাতের স্পর্শ পেতেই তার নিশ্বাস গাঢ় হলো। সে চোখ বুজেই ভ্রু কুচকে ফেলে। এরপর আস্তে করে চোখ খুলল। নেত্র পল্লব মেলে তাকাতেই দৃশ্যমান হলো ইমানের মুখমণ্ডল। সে সম্ভবত হাঁটু গেড়ে বসে আছে৷ নিজের কোমড়ে ওনার হাতের শীতল উপস্থিতি যেন মিরার সহ্য হলো না। সে তড়িৎ বেগে কোমড় থেকে এক ঝটকায় তার সরিয়ে দিল৷
তখনই ইমান বলে উঠে, ” পড়ে যাবে তুমি। আরো সরে ওদিকে চাপো। এটা বেড না।”
মিরা এতোক্ষণ পর নিজের অবস্থান সম্পর্কে খেয়াল হলো। সে বেমালুম ভুলে বসেছিল৷ নিজ রুমে ভাবছিল সে নিজেকে। কিন্তু সে তো ভীনদেশে পাড়ি জমিয়েছে৷ নিউইয়র্ক আসতে কম কাঠখোট্টা পেরোতে হয়নি নাকি! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে উঠে বসল। উঠে বসতেই অনুভব করল, তার মাথা ভীষণ ভারী হয়ে আছে। শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। ক্লান্তি ভাব যায়নি। খোলা চুলগুলো উড়াউড়ি করছে জন্য বিরক্ত হলো সে। জানালার থাই সামান্য খোলা বিধায় বাতাস ভেতরে প্রবেশ করছে৷ খুবই আস্তে সিলিং ফ্যান ঘুরছে মাথার উপরে৷ সে চুল গোছাতে গিয়ে চমকে উঠে। তার গলা আর কপাল ভেজা৷ কিন্তু ভিজে যাওয়ার তো কারণ নেই কোন। গরম ভাব তো একদম নেই। সে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে সামনের দিকে তাকালো। কিন্তু সারারুম জুড়ে ভয়াবহ অন্ধকার। ঘুটঘুটে অন্ধকার৷ দু মিনিট আগেও ফোনের ফ্লাশ লাইট অন ছিল৷ ইমান সেটা অফ করে দিয়েছে৷
সে বলে উঠলো, ” লাইট বন্ধ করে রেখেছেন কেন?”
মুহূর্তে একটা হাল্কা কিরণ দেওয়া ঝাড়বাতি জ্বলে উঠে। ঝাড়বাতির আলোয় চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠল। মিরা অভিভূত হলো। রুমটা খুব সুন্দর করে সাজানো। এমন ধরনের রুম যে টিভি-সিনেমায় দেখে এসেছে। বাস্তবেও যে এধরণের রুমে মানুষ বাস করব তা আজ নিজ চোখে দেখল। চোখ ঘুরিয়ে সেন্টার টেবিলে দৃষ্টি নিবন্ধ করতেই সে বিষ্মিত হলো। টেবিলের উপর একটা মগে পানি৷ মগের উপর রুমাল পরে আছে৷
সে জিজ্ঞাসু চোখে ইমানের পানে তাকালো। ইমান বলে উঠে, “বিকেলের দিকে তোমার প্রচন্ড জ্বর আসলো। উপায় না পেয়ে জলপট্টি দিলাম৷ কিছুক্ষণ আগেই জ্বর সেরেছে তোমার।”
মিরা নাক ফুলিয়ে বলে উঠে, ” আপনি আমাকে ছুয়েছিলেন কোন সাহসে?”
ইমান সাবলীলভাবে বলে, ” যেই সাহস নিয়ে বিয়েএ পীড়িতে বসেছিলাম।”
মিরা অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো। সেই দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে ইমান ভ্রু নাচালো৷ মিরার গা জ্বালা দিয়ে উঠে।
ইমান বলে, ” আমি ছুঁয়ে দিলে তো ক্ষতি নেই।”
সে উঠে দাঁড়িয়ে গায়ে ওড়না জড়ালো৷ কিচ্ছু বললো না৷
ইমান বাকা হেসে বলে,”যতোটুকু দেখার সেটা আগেই দেখে ফেলেছি৷ সুযোগের সঠিক ব্যবহার করেছি।”
মিরা বিষ্ফোরিত চোখে তাকালো একবার এরপর উঠে বাথরুমে চলে গেল। তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে ইমানের সামান্য মন খারাপ হলো। অন্যকোন দিন হলে, একমুহূর্তে মিরা তুলকালাম বাধাতব।এমন কী তাকে বেয়াদব বলতে এক সেকেন্ড সময় নিত না। সেই মেয়েটার আজ কী হলো? এতো শান্ত স্বভাব তার সঙ্গে যাচ্ছে না। ইচ্ছা করে রাগিয়ে দিলেও রাগছে না। বিকেলে জ্বরের ঘোরে সে কাদছিল। ইমান তখন ল্যাপটপে কাজ করছিল। কাদার শব্দে সে দৌড়ে আসে। মিরাকে জ্বরে কাহিল হতে দেখে সে বড্ড অসহায়বোধ করছিল। মেয়েটার অসুস্থতা কিভাবে দূরীকরণ করবে? সে সারাটা বিকেল জলপট্টি দিচ্ছিল মিরার কপালে। সেই যে বসেছিল মাটিতে হাটু গেড়ে, আর অন্যত্র যায়নি।তার ঘুম ভাঙ্গার পর দাঁড়িয়েছে। এখন ভীষণ পা ব্যথা করছে তার৷
সে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো মিরার৷ কিছুক্ষণের ব্যবধানে মিরা ফিরে আসল। চোখে মুখে তার পানির ফোঁটা লেগে আছে।
ইমান স্নান হেসে বলে, ” টেবিলের উপর খাবার রাখা আছে। তুই খাও। আমি আসছি৷ ”
সে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। যদি তার উপস্থিতিতে মিরা অস্বস্তিবোধ করে খেতে!
মিরার ক্ষুধা পেয়েছিল বেশ। প্লেনে সে তেমন কিছু খায়নি। বরং বার কয়েক বমি করেছে৷ এজন্য এতো কাহিল হয়ে পড়েছে৷ খাবারের প্যাকেট খুলতেই তার মন বিষিয়ে আসল। হটডগ আর ব্রেড। এসব খাবার খেতে ইচ্ছে করছে না তার একবিন্দু৷ কিন্তু এতো খিদে পেয়েছে যে না খেয়েও উপায় নেই। অগত্যা এক বাইট মুখে পুড়তেই তার নাড়ি-ভূড়ি প্যাচিয়ে সব বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম৷ সে হড়বড় করে বমি করে ফেলে। বমি করার পর আরোও নিস্তেজ লাগা শুরু হলো। মনে হচ্ছে এক্ষুনি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবে সে। এই অচেনা জায়গায় তার শরীর আরো খারাপ হয়ে পড়ছে। সে আরেকদফা বমি করতেই ইমান প্রায় দৌড়ে আসলো তার নিকটে৷
মিরা একবার তার দিকে তাকালো এরপর মাথা নিচু করে বলে, সর্যি! আমার জন্য আপনার এতো সুন্দর রুম নোংরা হলো।”
ইমানের কথাটা শোনামাত্র মেজাজ বিগড়ে গেল। সে নিজেকে ধাতস্থ করল। একজন অসুস্থ রোগীর সঙ্গে নরম ব্যবহার করতে হয়। কাজেই সে বলে উঠে, “তুমি ঠিক আছো? ওয়াশরুমে যাবে?”
মিরা উঠে দাড়ালো। ইমান তাকে সাহায্য করতে চাইলে সে সাহায্য নিতে অনীহা প্রকাশ করে বাথরুমের দিকে রওনা হলো৷ বাথরুমের ভেতর প্রবেশ করা মাত্র তার মাথা ঘুরাতে লাগে। পা টলতে থাকে। সে চাপা আর্তনাদ করে ডাকে, “ইমান”
ইমান পিলে চমকে উঠে। মিরা তাকে মনে হয় অনেক দিন পর এভাবে ডাকল৷ সে ওয়াশরুমের দিকে আগালো। সে দেখতে পায় মির দেয়ালে ঠেস মেরে দাঁড়িয়ে আছে৷
ইমান প্রশ্ন করে, ” আমি হেল্প করি?”
মিরা এর উত্তর দেয় না৷ মৌনতা সম্মনির লক্ষণ ভেবে সে বেসিনের কল চালু করে তার হাত-মুখ ধুইয়ে দিয়ে ওয়াশরুম থেকে সোজা বেডে আনে। এরপর বালিশের নিচে মাথা রেখে তাকে শুইয়ে দিলে, মিরা উঠে বসে বলে, ” আমি বিছানায় শুব না।”
ইমান চোখ গরম করে তার দিকে তাকালো। এতেও কাজ হলো না। বাধ্য হয়ে ইমান বলে, “সুস্থ হও আগে।”
মিরাকে শুইয়ে দিয়ে সে বারান্দায় গেল। হুহু বাতাসে তার ঠাণ্ডা লাগতে লাগে। বেশিক্ষণ এই বাতাসের মধ্যে থাকা যাবে না। বৃষ্টি থেমে গেছে৷ সে ডক্টর হ্যারির সঙ্গে আধঘন্টা আগে ফোনে কথা বলেছে। উনি জানিয়েছেন আবার জ্বর না আসলে মেডিসিন দেওয়ার দরকার নাই। দু-তিন দিন বেড রেস্ট এবং হেলদি ফুড খেতে হবে পেশেন্টকে। ডক্ট্র হ্যারির এই জিনিসটা খুব ভালো। উনি অযথা মেডিসিন প্রেশক্রাইব করে না৷ প্রতিকারে বেশি ফোকাস দেন। ডক্টর হ্যারি এমন একজন ডাক্তার যার সঙ্গে কথা বললে রোগী অর্ধেক সুস্থ হয়ে যায়৷কিন্তু মিরার আবারো জ্বর এসেছে। বাথরুমে হাত ধরার সময় সে বুঝেছে। এখন নিশ্চয়ই মিরাকে ঔষধ দিতে হবে৷
এমনই সময় রুম থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে৷ তার বুঝতে সময় লাগলো না যে কণ্ঠটা মিরার৷ সে দ্রুত বেগে বারান্দা ছেড়ে রুমে আসল এবং মিরার কাছে এসে বসে বলে, ” কাঁদছো কেন? কষ্ট হচ্ছে?”
মিরা উত্তর দিল না৷ ইমান তাকে আলতো করে ধরে উঠে বসালো। কান্না করতে করতে মিরার চোখ লাল হয়ে গেছে। জ্বরের কারণে ঠোঁট, গাল লাল হয়ে আছে৷ মনে হয় ঠোঁটে জ্বরঠোসা উঠেছে৷ মিরার গাল বেয়ে টপটপ করে অশ্রু ঝরছে। সে গালে হাত রেখে সমস্ত চোখের পানি মুছে দিল৷
সে পুনরায় বলে উঠে, “তুমি খুব মানসিক চাপে আছো তাই না?”
প্রতিবারের মতো এবারও উত্তর পেল না৷
মিরা হিচকি তুলে কেঁদে বলে উঠে, ” আম্মুর কথা খুব মনে পড়ছে৷ আমি আম্মুর কাছে যেতে চাই।”
কথাগুলো আটকে আটকে আসছে৷ জ্বরের ঘোরে কথা বলছে সে। ইমান তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকে ঠায় দিল৷ কাপুনি দিয়ে জ্বর এসেছে।
সে বলে উঠে, “মেডিসিন নিতে হবে। পিজ্জা খাবে?”
–” না।”
— ” বার্গার?
মিরা বলে উঠে, ” না। আমি এসব খেলেই বমি করে দিব।”
–” তাহলে কী খাবে?”
মিরা ঠোঁট বাকিয়ে বলে, “ভাত খাব আমি।”
ইমান শত চিন্তার মধ্যেও হাসল। দ্যাখো মেয়ের কথা! এই মেয়েকে নাকি সুপ্তি বেগম আগে ধরে-বেধে ভাত খাওয়াত! আর এখন জ্বর মুখে ভাত খেতে চাচ্ছে৷
হাজার হোক, ইমানের একমাত্র বউ, এবং প্রথম কোন মেহমান, সেই সাথে অসুস্থ মেয়েটা মুখ ফুটে কোন আবদার করল, তার আবদার না রেখে পারা যায় না।
চলবে।