ফেইরিটেল পর্ব-৩০+৩১+৩২

0
660
ফেইরিটেল
গল্পেরমহল ধারাবাহিক গল্প

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–30

ইমান বেশ চিন্তিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে৷ আবদার পূরণ করতে চাইলেই তো হলো না! তাকে ভাতের ব্যবস্থাও করা লাগবে৷নিউইয়র্কে ভাত পাওয়া যায় কিন্তু খুঁজে বের করতে হবে। কোন দোকানে পাওয়া যায় সে বিষয়ে তার কোন আইডিয়া নেই৷ গ্লোসারি শপিং সে কোনদিন করেছে কিনা নিজেরই মনে নেই। কোথা থেকে ভাতের চাল আনবে? কার কাছে সাহায্য চাইবে? তখনই প্রথমেই যার নামটা ব্রেইনে ভেসে আসলো সে হলো জুই। জুইয়ের এসব সম্পর্কে জ্ঞান থাকার কথা৷ সে রান্না করতে ভালোবাসে৷ কোন সময় অপচয় না করে সে জুইকে কল লাগালো৷ ওপাশ থেকে জুই ফোন রিসিভ করে বলে উঠে, ” মিষ্টার খান, তুমি হুটহাট অফিস থেকে চলে এলে কেন?”

ইমান একদণ্ড খামোশ থেকে বলে, ” আমার বাসার কাছাকাছি কোন গ্লোসারি শপে রাইস পাওয়া যাবে?”

জুই ওপাশ থেকে অবাক হওয়ার অনুভূতি প্রকাশ করে বলে, ” তুমি রাইসের খোঁজ নিয়ে কী করবে? নিজের বাসার কিচেন চিনো তুমি? ”

ইমান গলার স্বর ভরাট করে বলে, “একজন খুব করে ভাত খেতে চাইছি। হেল্প মি প্লিজ।”

জুই চটজলদি ঠিকানা বলে দিল। সে যে বিষ্ময়ে ইয়া বড় একটা হা করেছিল এটা ইমান ফোনের প্রান্ত থেকেই বুঝে যায়। জুই জানিয়ে দিলন, সেই দোকানে ইন্ডিয়ান সবরকমের প্রোডাক্ট পাওয়া যায়৷ তবে রাত আটটার মধ্যে দোকান সাট আউট হয়ে যাবে৷ আটটার পর সেল করে না৷

ইমান তার সঙ্গে কথা বলা শেষ করে ঘড়ি দেখল। শিট সাতটা পনের বাজছে। সে জলদি ক্রেডিট কার্ড বের করে নিচে নেমে গেল৷

সাদ তখন হলরুমে পপকর্ণ খাচ্ছিল তার নেটফ্লিক্সে ফ্রেন্ডসের এপিসোড দেখছিল। সাদ আএ ইমান দুইজনেরই “ফ্রেন্ডস” সিরিজ খুব পছন্দের। এই নিয়ে সে দুইবার সম্পূর্ণ সিরিজ দেখেছে৷ তাকে বেরুতে দেখে সাদ প্রশ্ন করে, “এই বৃষ্টির মধ্যে বের হবে তুমি?”

ইমান ব্যস্ততা দেখিয়ে বলে, “যেতে হবে৷ আসছি।”

ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে তাকে বেরিয়ে যেতে দেখে হাসনাহেনা নিজের ছেলেকে বলে উঠে, “ওই মেয়ে আসার পর তোমার ভাইয়ের ভাব-হাব ভালো লাগছে না৷”

সাদ পপকর্ণ মুখে পুড়ে বলে, ” বাংলাদেশ থেকে আসা মেয়েটাকে একবারও দেখলাম না। ফিলিং স্যাড ফর মি। ”

হাসনাহেনা বলে, “মেয়েটা দেখতে ভারী সুন্দর। ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ। চুলগুলো ও সুন্দর। ”

সাদ বলে, ” তুমি ওর প্রশংসা করলা! ক্যান্ট বিলিভ।”

হাসনাহেনা রাগ দেখিয়ে বলে, ” যার রুপ আছে তার রুপের প্রশংসা তো করবই।”

–” ওর সাথে তাহলে মিট করতেই হয় এবার।”

ইমানের পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় আটটা বেজে গেল। মাঝে হুট করে একটা ইমার্জেন্সি কল এসেছিল ক্লায়েন্ট থেকে৷ কল রিসিভ করে কথা না বললেও চলছিল না। সে যখন “খুবসুরত ফুড এন্ড বেকিং” নামক ছোট ঘুপচি এই দোকানের সামনে আসল, তখন দোকানী তার চোখের সামনে ওপেন সাইনবোর্ডটা ঘুরিয়ে ক্লোজ করে দিল৷ মেইন মার্কেট থেকে দু’মিনিট হেটে বাম পাশে এই দোকান। এতো ছোট একটা দোকানের নাম জুই সাজেস্ট করবে তা কল্পনাও করেনি ইমান৷ সে দোকানের দরজা খুলে প্রবেশ করতে ধরলে, বৃদ্ধ দোকানী রাগী গলায় ইংলিশে বলে উঠে, এই যে ছেলে, ঢোকার আগে চোখ দিয়ে ক্লোজ লেখাটা দেখোনি?”

ইমান নরম গলায় বলে, “সো সর‍্যি স্যার। আমি দেখেছি৷ কিন্তু শপিং করা আমার জন্য দরকার। আমার চাল কিনতে হবে৷ আশেপাশে ভারতীয় কোন শপ নেই।”

দোকানী বিরক্ত হয়ে বলে, ” কাল এসো। দ্যা শপ ইজ ক্লোজড নাও।”

ইমান অনুরোধের কণ্ঠে বলে, “আমি যখন আসি তখনই শপ ক্লোজ হলো৷এক মিনিট লেইটকে ক্ষমা চোখে দেখুন । একটু দরকার জন্য এই বৃষ্টির মধ্যে এসেছি।”

দোকানী বলে, “কত বছর ধরে নিউইয়র্কে আছো?”

–” ছোট থেকেই।”

— তাহলে তো ভাতের জন্য এতো ক্রেভিংস হওয়ার কথা না। আমেরিকান কালচার তোমার রক্তে মিশে গেছে এতাদিনে। সামনেই ইটালিয়ান ফুডকোর্ট। ওখান থেকে পিজ্জা, ম*দ কিনে খাও৷ আমি আটটার পর সেল করিনা।”

ইমান দোকানীর কাছে পুনরায় অনুরোধ করে বলে, ” ওর আচানক জ্বর আসলো। পিজ্জা-হটডগের নাম শুনলেই বমি পাচ্ছে। খালি পেটে এন্টিবায়োটিক দিতে পারছিনা। কিছু মুখে দিবে না সে। শেষে বলল, ভাত খাবে। আপনার এখানে চাল না পেলে দু কিলোমিটারের বেশি ড্রাইভ করে চাল কিনে আনতে হবে ইন্ডিয়ান মার্কেট থেকে।”

দোকানী রাগী গলায় বলে, ” ও টা কে হয় তোমার? ”

ইমান মাথা চুলকে বলে, ” ওয়াইফ।”

বৃদ্ধের রাগী চেহারা মুহুর্তে হারিয়ে গেল। আপাতত তার চোখে ইমানের জন্য শ্রদ্ধা দেখা যাচ্ছে। সে মুখে গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলে,” কয় কেজি নিবে?”

— চার কেজি দেন৷

দোকানীর বয়স সত্তরের কাছাকাছি। কাজ করে ধীর গতিতে। উনি সময় নিয়ে চাল প্যাকেট করে। এরপর বলে, ” বউকে অনেক ভালোবাসো? ”

ইমান বলে উঠে, ” ভালোবাসি কীনা সিউর বলতে পারছি না৷ কিন্তু আজকে ও না খেলে, আমারও খাওয়া হবে না৷”

বৃদ্ধ হাসল৷ প্যাকেট বুঝিয়ে দিয়ে বলে, “এটার নামই ভালোবাসা। তুমি আজকের দিনের লাস্ট এন্ড বেস্ট কাস্টমার এজন্য তোমার জন্য ফিফটি পারসেন্ট ডিসকাউন্ট।”

________________

মিরার আজ নিউইয়র্কে প্রথম সকাল। কিন্তু আজকের সকালটার মধ্যে কোন এক জায়গায় ঘাটতি রয়েছে। প্রকৃতি ইচ্ছে করেই আজকের সকালটাকে সুন্দর করে উপস্থাপন করেনি৷ আজকের সকালটা ভারী মেঘলা। মনমরা একটা ভাব। ধূসর ও ছাই রাঙা মেঘকুঞ্জ গুলো শুভ্র সাদাটে আকাশের দিগন্ত জুড়ে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে আছে। ঠাণ্ডা ভাব কালকের চেয়েও বেড়েছে। জ্বরের ঘোরে মিরার কিচ্ছুটি মনে নেই৷ তার মনটাও ভালো নেই। ভেতরকার মনটা একদম মরে গেছে যেন৷ এই তিনটে মাসে সে অনেক কিছু সয়েছে। বাবা-মার দ্বন্দে, বোঝাপড়ার মধ্যে তাদের দু’বোনকে অনেককিছুই সহ্য করতে হলো৷ ইরার তো এসএসসি পরীক্ষার প্রিপারেশনও ঠিকমতো নেওয়া হলো না। সে নিজেও এক প্রকার লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে নিজের ঘরে চুপটি মেরে বসে থাকলো! সবকিছু অসহ্য লাগত। ভাড়া বাসায় মন টিকত না। বারবার পুরনো বাসার জন্য মন কাদতো। দাদীর কথা মনে পড়ত। বড় আব্বুর শাসন সবকিছু স্মৃতির মানসপটে ঘুরে বেড়াত৷ ছোট্ট দুই কামড়ার বাসায় নিজেকে বন্দী বন্দী লাগত। মিরা বুঝে পায় না এতো ছোট বাসায় মানুষ কীভাবে বাস করে! তারপরও শান্তি ছিল সেই বাসায়। কিছুদিনের মধ্যে শান্তিও পালিয়ে গেল। রেখে গেল কেবল হাহাকার! বাবার কর্মে সে শোকাহত!

সে বিছানা থেকে উঠে আশেপাশে তাকালো। রুমে সে একা। নিচ থেকে ঘেরঘের শব্দ ভেসে আসছে। জানালা দিয়ে নিউইয়র্কের সৌন্দর্য স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সে মুগ্ধ না হয়ে পারল না৷ নাম না জানা গাছগুলো কী অপূর্ব। আকাশটাও কতো স্বচ্ছ। সবকিছু ঝকঝকে করছে। আগ্রহ নিয়ে সে নিচে নেমে আসে৷ ঘুম ঘুম চোখে হলরুমের দিকে পা বাড়ালো। সাক্ষাত হলো ইমানের সৎ মায়ের সঙ্গে। নিজের পরিচয় অবশ্য মিরা কাউকে জানায়নি৷

সে হাসনাহেনাকে বিনীত গলায় সালাম দিল৷ উনি সালামের জবাব নিয়ে বলে, “তোমার নাম মিরা তাই না?”

–“হ্যাঁ।”

—” ইমান তোমাকে নাস্তা খাওয়ার পর মেডিসিন নিতে বলেছে। তুমি সাডেনলি সিক হলে। ইমানের কী অস্থিরতা! একবার কফি বানালো, ওকে এই প্রথম আমি রান্না করতে দেখলাম। সবসময় অর্ডার দিয়ে খায় ও। আবার বৃষ্টির রাতে তোমার জন্য বাইরে গেল। রাতে আমাকে ফোন দিয়ে ভাত রান্না করে দিতে বললো৷ কোনদিন আমার সঙ্গে কথা বলে না। কাল রাতে ফোন দিল৷”

মিরার আবছা মনে পড়ে যায় রাতের কথা৷ ইমান সম্ভবত তাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছিল৷ তার শরীর সত্যি অনেক খারাপ ছিল নাহলে কোনদিন সে ইমানের হাতে খেত না৷

সে হাসনাহেনাকে উদ্দেশ্য করে বলে, “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আন্টি। আসলে বাংলাদেশে আমরা দু’বেলা ভাত খাই। জ্বরের ঘোরে রিচ ফুড দেখলেই বমি পাচ্ছিল৷”

হাসনাহেনা নাস্তার টেবিল গোছাতে গোছাতে বলে, “আমেরিকা এসেছো, এখানকার লোকাল ফুড টেস্ট করো৷ ভাত তো দেশে গিয়ে খেতেই পারবে৷ পাউরুটি খাও তো?”

— ” জি খাই।”

— ” জেলি, মেওনিজ, নোসিলা, নিউট্রেলা সব আছে৷ যেটা দিয়ে খেতে মন চায় খাও৷”

মিরা বহু কষ্টে শুধু একটা পাউরুটি খেল। তার খাওয়ার রুচি নেই। মুখ তেতো হয়ে আছে৷ খাওয়া শেষ করেও সে দোতকায় গেল না। নিচেই হাসনাহেনার সঙ্গে থাকল। বেলা একটায় এ বাসার ছোট ছেলে ভার্সিটির ক্লাস মিস দিয়ে বাসায় ফিরল৷ মিরার সঙ্গে তার প্রথম মিট এন্ড গ্রিট। সম্পর্কে ছেলেটা তার দেবর হয়৷

সাদ তাকে দেখামাত্র উত্তেজিত হয়ে বলে, ” ওহ মাই গড, তুমি তো দেখি একদম একটা রাজকন্যার মতো সুন্দরী। মনে হচ্ছে কোম ফেইরিটেল থেকে লাফ দিয়ে আমাদের বাসায় ঢুকে পড়েছো।”

মিরা তার কথায় সামান্য লজ্জা পায়। সাদ ছেলেটা খুব ভালো। প্রানবন্ত। সহজেই তাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্ব হয়ে যায়। তারা সমবয়সী। এজন্য খুব ইজিলি তাদের মধ্যে কথাবার্তা হলো৷

সাদ বলে উঠে, ” এখন তো তুমি সুস্থ । চল তোমাকে আমার ভার্সিটি ঘুরিয়ে আনি।”

মিরা তার সঙ্গে ভার্সিটি ভিজিটে যেতে রাজী হয়ে যায়৷ সাদ তাকে নিয়ে নিজের ক্যাম্পাসে যায়।

মিরা এতোবড় ভার্সিটি দেখে টাস্কি খেল। কী সুন্দর প্রকৃতিতে ঘেরা আশপাশ। মিহি বাতাস। হলদে গাছের পাতায় ভার্সিটি প্রাঙ্গন ভরে গেছে। মাঠটা কী বিশাল। বিপত্তি ঘটে যায়। সাদকে তার প্রোফেসর দেখে ফেলে এবং ক্লাসে জয়েন করার আদেশ দেয়। সাদ নিরুপায়। ক্লাস না করলে স্যার রেগে যাবে। কিন্তু নতুন অতিথিকে একা ফেলেও তো যাওয়া যায় না৷ পাশেই ভাইয়ার অফিস। সে ভাবল ওকে ভাইয়ার কাছে রেখে ক্লাসে আসবে।

চলবে।

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–31

সাদ মুখ কাচুমাচু করে বলে, “হেই প্রিটি লেডি, আমার ভার্সিটি কেমন লাগলো?”

মিরা তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলে, “তোমাদের ইউভার্সিটি অনেক সুন্দর। আমার মতো ফাকিবাজও এতো সুন্দর ক্যাম্পাস দেখে এখন এখানে পড়তে মন চাচ্ছে।”

সাদ সামান্য হেসে মাথা চুলকে বলে, ” সামনে আরেকটা ভবন আছে। অনেক সুন্দর। চল ঘুরে আসি৷”

মিরার অবশ্য ভার্সিটির সৌন্দর্য রেখে চলে যেতে মন চাচ্ছে না। এতো সুন্দর পরিবেশে আরো কিছুক্ষণ থাকতে ইচ্ছা করছিল তার৷ কিন্তু সাদ অন্যকোথাও ঘুরিয়ে আনতে চাইছে। তাকে মানাও করা যায় না৷ সে বলে, “কোথায় যাব এখন?”

–” সামনেই। আসো।”

মিরা তার সাথে হাঁটা ধরে৷ এতোবড় ভার্সিটির এরিয়া কিন্তু লোকশূণ্য। বেশ কিছুক্ষণ পরপর এক-দুইজনকে দেখা যাচ্ছে৷ সত্য বলতে পুরান ঢাকায় একসঙ্গে এত্তো এত্তো মানুষ দেখে সে অভ্যস্ত। এখন এমন ফাকা স্থান দেখলে তার মনে শনি ডাকে৷ মনে হয় প্রবেশ নিষিদ্ধ জায়গায় ঠিকানা হারিয়ে ঢুকে পড়েছে সে।

ভার্সিটির বিশাল গেইট দিয়ে বের হয়ে তারা রাস্তার ধারে আসলো। বিশাল বড় রাস্তা৷ প্রশস্ত, পিচঢালা। সাই সাই করে এক-দুইটা গাড়ি চলে যাচ্ছে। চোখ যতোদূর যায় ঠিক ততোদূরই এই পিচঢালা রাস্তা দেখতে পাচ্ছে সে। না জানি এ রাস্তার শেষ কোথায়? সাদ ফুটপাতে এসে দাড়ালো৷ ফুটপাতে মানুষ দেখা গেল। তিনজন সাদা ধবধবে ফর্সা মেয়ে টপ-জিন্স পরে দ্রুত গতিতে হেটে যাচ্ছে। তাদের দুইজনকে দেখে হাসি দিল। মিরাও ওদের দেখে হাসল৷ ওদের মধ্যে থেকে একটা মেয়ের সঙ্গে হাল্কা ঘিয়ে রঙের এবং লেজ থেকে বক্ষ অব্দি কমলা রঙের চার্লি কুকুর। কুকুর দেখে মিরা সামান্য ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল। এতে কুকুরের মনিব যেন বিরক্ত ও অফেন্ডেড হলো। সে তার কুকুর নিয়ে এগিয়ে গেল। সাদ সব দেখে বলে উঠে, “তুমি ডগ দেখে ভয় কেন পাচ্ছো? ওরা তো পেট ডগ। কিছু করবে না। এখানে ডগিকে ভয় পেলে মানুষ ভালো চোখে দেখে না৷”

মিরা সামান্য মাথা নাড়ালো। তার মারাত্মক কুকুর ভীতি আছে৷ এখন সেটা রাস্তারই হোক বা কিউট পাপ্পিই হোক না কেন! তার কাছে সব কুকুরই সমান। সব ক’টাকেই সে সমান তালে ভয় পায়৷ সাদ নিউইয়র্ক নিয়ে আরো অনেক কথা বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছে। তার পিছনে মিরা আসছে। সে আশপাশ অবাক নয়নে দেখছে৷ মাথা বরাবর সূর্য কিন্তু সূর্যের আলোয় তেমন তেজ নেই। বরং মিষ্টি একটা রোদে গা ওম পাচ্ছে৷ চারপাশে অদ্ভুত রকমের নীরবতা। বাংলাদেশে এমন নীরব রাস্তা পাওয়া যেন স্বপ্ব। হর্ণে বিরক্তিকর ধ্বনি নেই। সিএনজি, বাসের কালো ধোয়া নেই। কোথাও একটা খাবারের প্যাকেট পরে নাই৷ হাওয়া-বাতাস দূষণমুক্ত ও বিশুদ্ধ। গাছে গাছে পাখি, প্রজাপতি, মৌমাছি উড়ছে৷ যে যার মতো৷ কারো দিকে কেউ তাকায়। আর চোখাচোখি হয়ে গেলেও একগাল হেসে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে৷

সাদ অবশেষে বিশাল সুউচ্চ একটা বিল্ডিংয়ের সামনে এসে থামলো৷ গেইটের সামনেই ফ্লোয়ারা। ফ্লোয়ারায় একবার পানি উপরে উঠছে তো পরমুহূর্তেই পানি নেমে যাচ্ছে৷ দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে। সাদকে দেখে সে হাত নাড়লো। বিল্ডিংয়ের পরিবেশ দেখে মিরার মনে হচ্ছে এটা কোন অফিস। সাদ তাকে অফিস ঘুরাতে কেন নিয়ে আসলো? বিল্ডিংটা নিঃসন্দেহে সুন্দর কিন্তু এখানকার বেশিরভাগ বিল্ডিংই এমন স্ট্রাগচারে বানানো। সম্পূর্ণটা কাঁচের ঘেরাও করা৷

সাদ বলে উঠে, ” কাম উইথ মি।”

দারোয়ান এগিয়ে আসলো। কিন্তু দরজা খুলে দিতে হলো না। অটোম্যাটিক্যালি দরজা খুলে গেল। তারা ভিতরে প্রবেশ করে। সাদ ব্যস্ত হয়ে কাউকে কল দিচ্ছে। মিরা অবশ্য সেদিকে খেয়াল রাখল না। সে আনমনে চারপাশটা চোখ বুলিয়ে দেখে নিল। সাদ ফোনে কথা বলা শেষ করে তার সামনে এসে বলে, ” আমরা এগারো তলায় যাব এখন।”

মিরা এবারে প্রশ্ন করে বসে, ” এখানে কী তোমার কোন কাজ আছে সাদ?”

সাদ বিনীত হেসে লিফট কল করলন।সঙ্গে সঙ্গে লিফট ওপেন হলো। তারা লিফটের ভেতরে প্রবেশ করল। লিফট ঘড়ি ধরে চার সেকেন্ডর মধ্যে এগারো তলায় পৌঁছে দিল। তারা যখন এগারোতলার ফ্লোরে প্রবেশ করে হীম শীতল এসির বাতাসে গা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। ফ্লোরের বাম পাশ থেকে একটানা দশ ডেস্ক। সেখানে সবাই গভীর মনোযোগ দিয়ে কম্পিউটার স্ক্রিনে কাজ করছে। তার পাশে সারি সারি ছয়টা কফি মেশিন রাখা। আরো একটুদূরে বিশাল অডিটোরিয়াম রুমের মতো একটা হলরুম।অস্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ভেতরে অনেকেই আছে। নিশ্চয়ই ওখানে কোন জরুরি কাজ চলছে৷

সাদ আবারো কাকে যেন কল দিল। মিনিট একের মধ্যে ঐ বিশাল অডিটোরিয়ামের মতো রুমটার দরজা ক্যাচ শব্দ করে খুলে গেল। মিরার কেমন যেন ভয় লাগলো। যেমনটা কলেজে প্রিন্সিপাল স্যারের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে দুষ্টুমি করার সময় হতো!

সে মাথা নিচু করে ফেলে৷ কেউ একজন বেরিয়ে আসে। যার পরনে দামী ঘড়ি আর দামী সু। নিচু হয়ে থাকায় সে চেহারা দেখতে পারলো না৷ আচমকা তার কণ্ঠস্বরে সে চমকে উঠে৷

সে বলে উঠে, ” সাদ কোন প্রবলেম? ”

মিরা তড়িৎগতিতে মাথা তুলে তাকায়। এ কাকে দেখলো সে! এটা তো ইমান। তার মাথায় একবারও ইমানের চিন্তা আসেনি৷ এই প্রথমবার কর্মরত অবস্থায় ইমানকে দেখল সে। চুলগুলো সুন্দর করে গুছিয়ে আছড়ানো। পরনে পরিষ্কার ইস্ত্রী করা নেভী ব্লু রঙের শার্ট৷ চেহারায় একটা জ্ঞানী ভাব ফুটে আছে৷ মিরা আরেকটা ব্যাপার দেখল সে ভেতর থেকে আসতেই বাম পাশের ডেস্ক থেকে একটা লোক দাঁড়িয়ে তাকে রেসপেক্ট দেখালো। ইমান হাত নেড়ে হাসি দিয়ে তাকে বসতে বলে৷

তাদের দু’জনের দৃষ্টিবিলাস ঘটে ক্ষণের মধ্যে। এক পলের অন্তর মিরা চোখ নামিয়ে নেয়। বিষ্ময়ের তোড়ে তার বাকের রা হারিয়ে গেছে। সাদ ভাইয়ের কাছে গিয়ে কানে কানে কিসব বলল। ইমান এমনভাবে মাথা নাড়লো যেন সে সব বুঝে গেছে৷ কথা শেষ করেই সাদ যেন দৌড় দিল হোসাইন বোল্টের গতিতে৷ মিরা অবাক হয়ে তার দিকে একবার তাকালো। আরেকবার তাকালো ইমানের দিকে। ইমান টাই লুজ করে বলে, ” আসো আমার সঙ্গে। ওর ক্লাস আছে। ওকে যেতে হবে৷”

বাক্যটা শুনতেই মিরার সাদের উপর রাগ হলো। সাদ তাকে বললেই পারত তার ক্লাস আছে। সেও আরো কিছুক্ষণ ভার্সিটি এরিয়াতে থাকত৷ ঘুরত সেখানে। কেন সাদ তাকে এই খানে নিয়ে আসলো? এই বাড়তি উপকারটা তো মিরা তাকে করতে বলেনি। তবে সে নিশ্চুপ থেকে সরাসরি ইমানের দিকে তাকালো। ইমান হাতের ইশারায় তাকে ভেতরে যেতে বলে।

মিরা গুটিগুটি পায়ে তার সঙ্গে ভেতরে ঢুকে। ভেতরে ঢুকতেই সবাই একবার করে তাদের দিকে তাকালো। এখানে সম্ভবত দশ জনের মতো আছে৷ পরিবেশ দেখে মনে হলো খুব গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছিল। ইমান তাকে পাশ কাটিয়ে সামনে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে তাকে বসতে আহ্বান জানালো। মিরা আস্তে করে সেখানে বসল৷

এরপর ইমান সামনে গিয়ে দাড়ালো। প্রজেক্টের অন করা ছিল। সে বলে উঠে, “ডিস্টার্বের জন্য সর‍্যি। আমি কাজে ফিরে যেতে পারি৷”

অতঃপর সে ইংলিশে ননস্টপ ভাষণ দিতে লাগলো। মিরার একবার মনে হচ্ছে সে প্রেজেন্টেশন দিচ্ছে, আরেকবার মনে হলো সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে৷ বেশ বোর হতে থাকে সে। এতো এতো অচেনা মানুষের ভীড়ে নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল তার। অবশেষে মিটিং শেষ হলো৷ একে একে সবাই উঠে যেতে লাগলো। ইমান তখনো ল্যাবটপের স্ক্রিনে মুখ ডুবে কাজে ব্যস্ত৷ রুমটা ফাঁকা হতেই মিরাও উঠে দাঁড়ালো।

এবং সঙ্গে সঙ্গে ইমান প্রশ্ন করে, ” কী হলো?”

মিরা দাঁতে দাত চেপে বলে, “পায়ে ঝিনঝি লেগেছে।তাই ঝিনঝি লাগা সারানোর জন্য দাঁড়ালাম।”

ইমান অবশ্য পায়ে ঝিনঝি লাগার বিষয়টা বুঝল না। কিন্তু কোন প্রশ্নও করল না বরঙ বলে উঠে, “কফি খাবে? ”

ঝাঁঝালো কন্ঠে উত্তর ধেয়ে আসে না বোধক।
ইমান ল্যাপটপ বন্ধ করে বলে, “আমার কেবিনে আসো।”

তারা যখন রুম থেকে বের হলো। তখন অনেকের দৃষ্টিই তাদের দিকে ছিল। এতে ভারী অস্বস্তি হয় মিরার৷ ইমান তাকে একটা গোছানো রুমে এনে গেইট লাগিয়ে দিল। এই কেবিনটা ইমানের একার। নিজস্ব। সে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বসে, আরাম এক গ্লাস পানি খেল। এরপর মিরার পানে তাকিয়ে বলে উঠে, ” তোমার শরীর কেমন এখন? সকালে মেডিসিন নিয়েছিলে?”

ইমান কথা বলছে খুবই স্বাভাবিক গতিতে। যেন তাদের মাঝে কোনদিন কোন ফাটল তৈরি হয়নি৷ সে তার বিপরীত দাঁড়িয়ে আছে। সে বসল না৷ ইমান টেলিফোনে কাকে যেন খাবার আনতে বলল। দু’মিনিটের ব্যবধানে দু’মগ কফি, এবং আমেরিকার জাতীয় খাদ্য বার্গার সঙ্গে এক স্লাইস ব্রাউনিও রয়েছে। বার্গারটা বেশ ড্রাই। ভেতরে মেবি বীফের পেটি এবং সস দেওয়া আছে৷ আজকে এসব ফাস্টফুড দেখে তার বমি পাচ্ছে না।

ইমান কফির মগ হাতে তুলে নিয়ে বলে, ” বিকেলে কোথাও যাওয়ার প্লান আছে?”

মিরা নাবোধক মত প্রকাশ করে৷ ইমান বলে উঠে, আমাদের বাসা থেকে দশ মিনিট দূরত্বে একটা লেক আছে। লেকের পাশে পার্কও আছে। চাইলে সেখানে যেতে পারো৷

–” ইচ্ছা নাই।”

–” বার্গারটা খাও। এটা ম্যাকডোনাল্ডের। খুব ফেমাস এখানকার বার্গার-ফ্রাইস।”

মিরা অবশ্য আগেই ম্যাকডোনাল্ডের লোগো দেখে চিনে ফেলেছিল৷ খেতে ইচ্ছে করছে না। ইরার খুব শখ ছিল এই দোকানের খাবার খাওয়ার। প্রতিটা সেলেব্রিটি একবার করে হলেও ম্যাকডোনাল্ডে এসে চেইক ইন দিয়েছে৷ ওর জন্য খারাপ লাগছে৷ ইমান আবারও তাকে খাওয়ার জন্য সাধলো৷ কিন্তু এতো সুস্বাদু খাবার তার গলা দিয়ে নামবে না৷ ওমন সময় দরজায় নক হলো। সে “কাম ইন” বলতেই ছয়-সাত জনের একটা দল এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ওরা সবাই ভীনদেশী। পোশাক-আশাকে ভিন্ন সংস্কৃতি প্রকাশ পাচ্ছে। কেউ বাংলাদেশী নয়।তবে ওদের মধ্যে একজনের চেহারাহ বাঙ্গালীয়ানা ভাব পাচ্ছে৷ কিন্তু আচরণ, চাল-চলনে মনে হলো না সে বাঙ্গালী। ওদের মধ্যে একজন কৃষাজ্ঞও আছে।

ইমান দাঁড়িয়ে তাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে কথা বলা শুরু করল। মিরার চুপচাপ দাড়িয়ে থাকতে কেমন যেন লাগছিল। তাই সে কফির মগ হাতে নেওয়ার জন্য হাত বাড়ালো৷ কফি হাতে নিতেই উত্তাপে তার হাত থেকে ঝনঝন শব্দ করে কফির মগ পড়ে যায়৷ সবাই আরেকদফা তার দিকে তাকালো। ওইসময় মিরার নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে আনস্মার্ট মেয়ে বলে মনে হচ্ছিল। লজ্জা ও অপমানে মুখ লাল হয়ে আসল৷

ক্ষণেই ইমান তার দিকে এগিয়ে এসে তার বাহু ধরে টেনে সরিয়ে দাড় করিয়ে ব্যতিব্যস্ততা দেখিয়ে বলে, ” আর ইউ ওকে? কফি গায়ে পড়েনি তো?”

মিরা শুধু “উহু” বলল। তার কান্না পাচ্ছে। ভীষণ কান্না পাচ্ছে৷

–” পায়ে লেগেছে?”

— “না।”

ইমান তবুও চিন্তিত ভঙ্গিতে তার দিকে তাকালো। তার আংগুলে কাঁচের টুকরো লেগে রক্ত বের হওয়াটা ইমানের চোখ এড়ালো না। ততোক্ষণে বাকিরা প্রস্থান করেছে। তাদের মধ্যে নাক গলালো না৷ আমেরিকানরা এদিক দিয়ে খুব সভ্য। বলার আগেই স্পেস দিবে আপনাকে৷

মিরাকে চেয়ারে বসালো সে। এরপর ড্রয়ারে হাতড়িয়ে কিছু খুজলো৷ কিন্তু পেল না৷ অগত্যা টিস্যু পেপার দিয়ে তার আংগুলে টিস্যু চেপে ধরে বলে, ” ভাগ্য ভালো ছোট কাঁচের টুকরো লেগেছে। বড় টুকরো গায়ে গেঁথে গেলে এতোক্ষণ রক্তক্ষণের মাত্রা বেড়ে যেত।”

মিরা তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, ” আমার জন্য এতো চিন্তিত হতে হবে নাহ।”

–” চিন্তিত হচ্ছি না।”

কথা শোনামাত্র মিরার মন বিষিয়ে গেল। সে মলিন চেহারা করে তাকালো। ইমান তখন উঠে দাঁড়ালো।

তখনই বিনা অনুমতিতে রুমে প্রবেশ করে সেই বাঙ্গালীর মতো দেখতে মেয়েটি। মেয়েটার নাম সে জানে না৷

মেয়েটা রুমে প্রবেশ করে হাসিমুখে বলে, “মিষ্টার খান, দশ মিনিট পর কনফারেন্স শুরু হবে। সবাই আপনার অপেক্ষায় আছে৷ ”

ইমান বলে, ” আমি জানি, জুই। তবুও জানিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।”

তাদের দু’জনের কথোপকথনের মাধ্যমে মিরা জানতে পারল মেয়েটার নাম জুই৷ ও বড্ড হাসিখুশি। সেই থেকে হেসে হেসেই কথা বলছে। তাকে দেখে দু’বার হাসিও দিয়েছে ন

আচমকা জুইয়ের প্রশ্নে তারা দুইজনই পিলে চমকে উঠে একে অপরের দিকে তাকালো।

জুই প্রশ্ন করে, “মিষ্টার খান, মিরা তোমার কে হয়?”

ইমান নীরব থাকল৷ মৌনতা ভেঙে মিরাই আগে উত্তর দিল, “কাজিন হই।”

ইমানের অবাকের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেল। সে মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিল জুইকে সত্যটা বলে দেওয়ার। কথা গুছিয়ে নিতে টাইম নিচ্ছিল এর আগেই মিরা উদ্ভট একটা উত্তর দিয়ে দিল৷ মেয়েটাকে আচ্ছা মতো বকে দিতে মন চাইছে৷

জুই বলে উঠে, “আমাদের তো কনফারেন্স আছে। তুমি চাইলে অফিস ঘুরে বেড়াতে পারো। নিচে খুব সুন্দর একটা বাগান আছে। লাইব্রেরি আছে৷ কফি হাউজ আছে। যেখানে ইচ্ছা ঘুরো। চাইলে মিষ্টার খানের কেবিনে বসে মুভি দেখতে পারো৷ ফিল ফ্রি।

মিরা স্নান হেসে ইমানের দিকে তাকিয়ে বলে, ” আমি বরঙ নিচে যাই।”

ইমান কিছু বলল না। সে পাশ কাটিয়ে কেবিনের বাইরে চলে যায়৷ একটু পর জুই আর মিরা বেরিয়ে এলো। মিরা লিফটের দিকে এগিয়ে গেল এবং তারা ফ্লোরের শেষ প্রান্তে হাঁটা দেয়৷

কনফারেন্স রুমে ঢোকামাত্র হুট করে কারেন্ট গেল এবং সেকেন্ডের মধ্যে কারেন্ট আসল৷ কনফারেন্স রুমে সব ক্লাইট বসে আছে। লিফটম্যানিকে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখে ইমান চিৎকার দিয়ে বলে, “কী হয়েছে?”

লিফটম্যান বলে উঠে, ” জেনারেটরে ইরর দেখা দিয়েছে। লিফট অপারেটর কাজ করছে৷ লিফট মাঝপথে আটকে গেছে স্যার। দুইজন আটকা পড়েছে৷ ইটস এন ইমার্জেন্সি।”

ইমানের বুক ধুক করে উঠে। মিরাও তো লিফটস ঢুকেছে। সে কী আটকা পড়েছে? আল্লাহ! নাহ! এমন যেন নাহয়! মিরার যেন কিছু না হয়।

চলবে৷

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–32

কনফারেন্স রুম থেকে প্রায় দৌঁড়ে বের হয় ইমান। তার পথ আটকিয়ে জুই প্রশ্ন করল, ” বাইরে কেন যাচ্ছো? কনফারেন্স শুরু হয়ে গেছে তো। এটা একটা জরুরি মিটিং। এখন বাইরে যাওয়া কী উচিত? ”

ইমান বিড়বিড় করে বলে, ” মিরার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার চেয়ে আর কিছুই আমার জন্য এখন জরুরি নয়। ঠিক বা বেঠিক বুঝি না! দরকার হলে চাকরি ছেড়ে দিব।”

জুই অবশ্য কোন কথাই শুনতে পেল না৷ এমনকি সে লিফটম্যানের বলা কথাগুলোও শুনে নি৷ অন্যদিকে ছিল সে। লাস্টবারের মতো সবকিছু রিচেইক দিচ্ছিল সে।

ইমান চলে যাওয়ার পর কনফারেন্স রুমে উপস্থিতি এক ক্লাইট বলে উঠে, “আই থিংক লিফটে কেউ আটকে গেছে। তোমার ওখানে যাওয়া দরকার। কারো জীবন ঝুঁকিতে আছে।”

জুই কথাটা শোনামাত্র প্রশ্ন করে, ” আর ইউ সিউর?”

–” লিফটম্যান তো তাই বললো৷”

— “ওহ নো! গড হেল্পস আস।”

সে খানিকক্ষণের জন্য কনফারেন্স বন্ধ রেখে হলরুমের বাইরে আসল৷ ততোক্ষণে মোটামুটি একটা শোরগোল পড়ে গেছে৷ দুইজন রেস্কিউ টীমের সদস্য পৌঁছে গেছে৷ ইমানকেও তাদের সঙ্গে দেখা গেল৷

জুই এগিয়ে এসে বলে, ” তোমার কাজিন কী আটকে গেছে লিফটে? ”

ইমান তখন দুশ্চিন্তায় ঘেমে-নেয়ে একাকার। সে মলিন মুখে বলে, “সম্ভবত। লিফট কোন ফ্লোরে আটকে গেছে বোঝা যাচ্ছে না৷”

একজন রেস্কিউ টীমের সদস্য বলে উঠে, ” নিচে গিয়ে লিফটের মেইন সুইচ অফ করে আসেন কেউ একজন।”

ইমান বলে উঠে, ” আমি যাচ্ছি।” বলে সিড়ির দিকে ছুটতে লাগলো। তার কোনদিকে হুশ নেই। এগারো তলা থেকে যতোদ্রুত নিচে নামবে ততো দ্রুত মিরাকে উদ্ধার করা যাবে। এছাড়া সে মনে মনে আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করছে যেন নিচের ফ্লোরে গিয়ে দেখে মিরা নিচে দাঁড়িয়ে আছে। সে এগারো মিনিট অপচয় করে নিচে নেমে যায়৷ কিন্তু তার তৃষাতুর চোখ মিরাকে দেখতে পায় না। সে নিচে কোথাও নেই৷ অগত্যা ইমান সিউর হয় মিরা লিফটেই বন্দী আছে। কেমন অবস্থায় আছে মেয়েটা? ভয় পাচ্ছে? কান্না করে দিয়েছে? অতিরিক্ত অন্ধকারে মাথা ঘুরে পরে যায়নি তো? শ্বাস নিতে পারছে তো? দমবন্ধ লাগছে কী? এতো এতো চিন্তায় তার পাগল দশা। শার্ট এমনভাবে ভিজে আছে যেন সে সদ্য কাকভেজা হয়েছে৷ হাপাচ্ছে সে। পিপাসায় গলা চৌচির। সে একটা দম ফেলে জেনারেটর কন্ট্রোল রুমে গেল৷ জেনারেটর কন্ট্রোল রুমে সব ইলেকট্রনিক ডিভাইস, ইলেকট্রিক তারের সংযোগের একসেস রয়েছে৷ লিফটের সুইচ এখান থেকে অফ করে দিল সে। এরপর সিসিটিভি ফুটেজ অন করল। বিশ মিনিট আগের এগারো তলার ফুটেজ অন করে৷ মিরার সঙ্গে তার আরেক কলিগ হেনরি বিনও লিফটে উঠেছে৷ এরপর দশ তলার ফুটেজ অন করে৷ সেখান থেকে এক সেকেন্ডের ব্যবধানে লিফট নয়তলায় গিয়ে থামে। হেনরি নেমে যায়। এরপর লিফটের গেইট বন্ধ হলো। এবং ঠিক ওই টাইমেই কারেন্ট গেল। দ্যাটস মিন, মিরা নয়তলা থেকে আটতলার মধ্যে আটকা পড়ে আছে৷ ইমানের বুকটা ছ্যাত করে উঠে৷ সে লিফটম্যানকে কল করে নয়তলায় আসতে বলে৷

লিফটের চাবী জেনারেটর কন্ট্রোল রুম থেকে খুঁজে যখন নয়তলায় সিড়ি বেয়ে উঠে তখন সম্ভবত মিরার লিফটে আটকে যাওয়ার আধঘন্টা পাড় হওয়ার উপক্রম৷ টেকনোলজির অবগতির ফলে চাবী ব্যবহার করে লিফট বা দরজা খোলা হয়না আজকাল।সবকিছু অটো সিস্টেমের আওতায় অন্তর্ভুক্ত। নয়তলায় লিফটের সামনে চাবি দিয়ে গুতাগুতি করে লিফটের দরজা খোলা হলো৷ কিন্তু লিফট নয়তলা এবং আটতলার মাঝামাঝিতে আটকে গেছে। রেস্কিউ টীম থেকে একজন চিৎকার দিয়ে বলে, ” ইউ দেয়ার?”

কোন শব্দ হলো না৷ ইমানের সেসময় প্রাণ যায়-যায় অবস্থা। উনি আবারো মাইক হাতে নিয়ে বলে, “ইউ দেয়ার?”

ইমান মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করছিল যেন মিরা আওয়াজ দেয়৷ অন্তত একবার হলেও। তাহলে কিছুটা স্বস্তি পাবে সে। অবশেষে, আল্লাহর অশেষ রহমতে ভাঙ্গা গলায় আওয়াজ ভেসে আসে, ” আই এম স্টাক। প্লিজ হেল্প।”

ইমান স্বস্তির একটা নিশ্বাস ফেলে৷ যাক অন্তত সেইভ আছে।এখন এক্সপার্ট রেস্কিউ টীম মেম্বাররা নিশ্চয়ই কোন উপায়ে মিরাকে বের করবেই৷ প্রথমেই তারা দঁড়িতে বেঁধে পানি আর টর্চ পাঠিয়ে দিল মিরার কাছে। মিরা সেগুলো দড়ি থেকে খুলে নিল৷ পরবর্তীতে টান দিয়ে দড়ি বের করে আনে। তাদের কাছে অক্সিজেন সিলিন্ডার ও আছে। সব ব্যবস্থাই আছে৷ কিন্তু লিফটের বিরাট এক সমস্য হয়েছে। যেকোনো মুহুর্তে লিফট ছিঁড়ে পড়ে যেতে পারে৷ খুবই সর্তকতার সঙ্গে তারা কাজ করছে৷ শেষে সিদ্ধান্ত নিল সম্পূর্ণ লিফটটার তাঁর কেটে ফেলে উপরে টেনে আনবে।

মিনিট দুইয়ের মধ্যে লিফটের উপর বিপরীত এবং সমান পরিমাণ বল প্রয়োগ করে উপরে টেনে আনা হলো। মিরাকে লিফট থেকে উদ্ধার করে যেই না ফ্লোরে আনা হলো। সঙ্গে সঙ্গে লিফট ধসে নিচে পড়ে গেল। কী ভীষণ বিকট শব্দ। বুক কেঁপে উঠে ইমানের। তার হাত কাঁপছে৷ মিরার চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে। ফ্যাকাশে, ঘমার্ক্ত সে। চোখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে৷ ইমান গিয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে এবং সবার সামনে তার কপালে বেশকিছু ক্ষণ ধরে নিজের অধরজোড়া চেপে রেখে, মরা কণ্ঠে, খুব আস্তে করে বলে, ” তুমি ঠিক আছো?”

মিরা উত্তর না দিয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়৷ অনেক বড় একটা বিপদ থেকে সে বেঁচে ফিরে এসেছে৷জনম ভর সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে সে। আর এক সেকেন্ডও দেরি হলে লিফট ছিঁড়ে নিচে পড়ে যেত৷ মাটির সঙ্গে সংঘর্ষে তার দেহ পিষে যেত। ভাবতেই লোম খাড়া হয়ে আসছে তার।

ইমান তাকে বুকের মধ্যে আবদ্ধ করে বলে, “আজকে তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি পাগল হয়ে যেতাম।”

মিরা কথাটা শোনামাত্র তার দিকে মাথা উচিয়ে একবার তাকালো। চোখে চোখ রাখলো সে। টলমল চোখ থেকে মাত্র অশ্রু গালে গড়িয়ে যেতেই, তার টসটসে নোনাজল খানি ইমান মুছে দিয়ে বলে, “কান্না করো না প্লিজ। সব ঠিক আছে৷”

রেস্কিউ টীমের সদস্যরা এসে মিরার প্রাথমিক মেডিকেল চেক আপ করলো। ওর শুধু কপালে সামান্য কেটে গেছে। সেখানে ব্যান্ডেজ দিয়ে বলে উঠে, “উনি মানসিকভাবে একটু শকে থাকতে পারে৷ ভয় পেয়ে গেছে। ওনাকে কমফোর্ট জোনে নিয়ে যান। একটু সময় দেন ওনাকে৷”

মিরাকে নিয়ে ইমান সিড়ি দিয়েই নিচে নেমে আসে। দুইজনের মধ্যে কোন কথা হয়নি আর। তবে ইমান বেশ আতংকগ্রস্থ ছিল তা ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে বোঝা যাচ্ছে৷ অস্থিরতা এখনো কাটেনি ওর। বারবার মিরার হাত ধরে কাছে টেনে নিচ্ছে তাকে।

একসময় মিরা বলে উঠে, ” আমি ঠিক আছি।”

–” ঠিক নাই তুমি। আমি বুঝতে পারছি।”

মিরা আর কিছু বলল না। ইমান তাকে নিয়ে সোজা বাসার উদ্দেশ্য রওনা হওয়ার জন্য গাড়িতে উঠে বসে। ড্রাইভিং সীটের পাশেই মিরার অবস্থান হলো৷ ইমান নিজ থেকে তার চুল সরিয়ে দিয়ে খোপা করে দিল৷ এসি বাড়িয়ে দিল। সীট বেল্ট পড়িয়ে দিয়ে আরেকবার কপালে চু*মু দিতেই মিরা বিরক্তিতে চ বর্ণ উচ্চারণ করে। ইমান সেই বিরক্তির ধার ধরলো না। তার এমন পাগলামোতে মিরা অবাক। হুট করে তার প্রতি এতো কেয়ার! শুধু মরে যাচ্ছিল বলেই এই আধিখ্যেতা! মানুষ ঠিকই বলে মরলেই কদর বাড়ে৷

ইমান প্রথমেই বাসায় গেল না। একটা আইসক্রিম পার্লারে এসে গাড়ি পার্ক করল। মিরা ভ্রু কুচকে উৎসাহের সঙ্গে তার দিকে তাকালো।

ইমান বলে, ” নিউইয়র্ক এসে তোমার এতো বাজে ও ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হবে আমি কল্পনাও করিনি।তুমি নিশ্চয়ই নিউইয়র্ককে খুব খারাপ একটা শহর ভাবছ। যেখানে পদে পদে বিপদ। আসলে তা নয়৷ আমার শহরটা খারাপ না। এই শহরটা খুব চমৎকার। আনন্দ দিয়ে ঘেরা এর প্রাচীর৷ মায়াভর এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ।”

–” আপনার শহরকে আমি খারাপ ভাবি নি একবারও।”

–” বেশ৷ চল নামি।”

মিরা আইসক্রিমের দোকানের দিকে তাকিয়ে বলে, ” আমি আইসক্রিম খাব না।”

ইমান হতাশ হয়ে বলে, ” মিরা প্লিজ বি নরমাল। আগের মতো চঞ্চল হয়ে যাও। তোমার এমন শান্ত আচরণ সহ্য হয়। তুমি পাখির মতো চঞ্চল, তোমাকে পানির মতো শান্ত রুপে মানায় না৷ বিপদ তো হবেই, তাই না? সকল প্রতিকূলতা রোধ করেই বাঁচতে হবে।”

মিরার যেন কী হলো। সে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। এরপর হিচকি তুলে বলে, ” আমার সবকিছু অসহ্য লাগে। আপনার জন্য আমার সব সুখ কর্পূরের মতো নাই হয়ে গেছে৷ আপনি আমার জীবনে না আসলে খুব ভালো হত। আপনাকে ভালোবাসা আমার জীবনে সবচেয়ে বড় অপরাধ।এই অবাধ্য ভালোবাসাটা গলার কাটার মতো লাগে। না পারি গিলতে, না পারি সইতে। ”

চলবে।