#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–54
রিকশা যখন অফিসের সামনে থামলো, তখন বৃষ্টিও থেমে গেল। ইমানের মনে হলো, বৃষ্টি জেনে-বুঝেই তাদের দুজনের জন্য ধরণী কাঁপিয়ে নেমেছিল। এই বৃষ্টির জন্য তার রিকশা সফর এতো আনন্দময় হলো৷ অফিসের স্টাফরদের অনেকেই বাইরে অবস্থান করছে তাকে রিসিভ করার জন্য। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল, মিরা রিকশা থেকে ইতিমধ্যে নেমে পড়েছে৷ মাথার উপর হুট আর বৃষ্টি থেকে গা রক্ষা করার জন্য পলিথিন থাকলেও বৃষ্টির ছাঁটে মিরার শাড়ির আচল, মুখমণ্ডল আর চুলের সামনের অংশ ভিজে গেছে। ভেজা মুখে তাকে যেন আরোও অধিকতর সুন্দর লাগছে। চোখের কাজল লেপ্টে আছে৷ ভেজা চুলগুলো কপালে পড়ে আছে। মেয়েটার মুখে বুঝি মায়া আছে, বারংবার সেই মায়ায় আটকা পড়তে মন চায়৷
ন্যান্সি ম্যাডামের কথায় তার ঘোর কাটলো। উনি বলে উঠে, ” এই যে সিইও বস, আপনি গাড়ি রেখে রিকশায় কেন এলেন? এনি ওয়েস, ওয়েলকাম টু আওর অফিস৷”
ইমান মৃদ্যু হেসে বলে, ” থ্যাংক ইউ ম্যাম। রিকশা জার্নিটা আমার লাইফের বেস্ট জার্নি ছিল।”
কথাটা শেষ করেই আড়চোখে মিরার দিকে তাকালো সে। মিরা তাকে উপেক্ষা করে অফিসের ভেতর ঢুকে পড়ে। ইমানকে নিয়ে অফিসের ভেতর আসা হয়। সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। এরপর লাঞ্চ করার জন্য ক্যান্টিনে নিয়ে যাওয়া হয়। তার আগমনের জন্য অফিসের মেন্যু আজকে অনেক ভালো। ওইসময় মিরাও খাওয়ার জন্য ক্যান্টিনে অবস্থান করে৷ ইমানের আসতে দেরি হওয়ায় বাকিরা আগেই দুপুরে খেয়ে নিয়েছে৷ ক্যান্টিন ফাঁকা। বিকেলের জন্য কফি তৈরির কাজ চলছে৷ কেবল মিরা লাঞ্চ করার জন্য বসেছিল। ইমান ইচ্ছা করেই তার টেবিলে এসে বিপরীতে, মুখোমুখি বসলো। ন্যান্সি ম্যাডাম দাঁড়িয়ে থেকে খাবারের তদারকি করছিলেন। এবং সে ইমানের পাশে বসে বললো, ” খাবার গরম করতে বলেছি। গরম হলে সার্ভ করবে। তোমার দুজন একটু বস। আচ্ছা ভালো কথা, ইমান ও হচ্ছে মিরা৷ আমাদের এখানে ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে কাজ করছে৷ ওর কাজ খুব চমৎকার। প্রতিটা ডিজাইন আমার খুব পছন্দ হয়। আর পাবলিক পছন্দও করে ওর ডিজাইন করা ড্রেস। অনেক ট্যালেন্টেড একটা মেয়ে ও।”
ইমান বলে, ” মাশাল্লাহ।”
মিরা নিজের প্রশংসা শুনে খুব লজ্জা পায়৷ তখনই খাবার আসলো। কিন্তু ইমান নাকী এসব খাবে না। সে কেবল এক প্লেট সালাদ খাবে। তার জন্য ন্যান্সি ম্যাডাম আবারো সেফের কাছে গেলেন।
ম্যাম যাওয়ার পর মিরা খাওয়ায় মনোযোগ দিল৷ ভাতের সঙ্গে ডাল মিক্স করে মুখে তুলবে তার আগেই ইমান তার পায়ে পা দিয়ে ঘঁষা দিল৷ প্রথমবার মিরা আমলে নিল না। হয়তো ভুলবশত করে ফেলেছে। দ্বিতীয়বারও ইমান তার পায়ে পা দিয়ে সুরসুরি দিয়ে এমন ভান ধরে যেন কিছুই হয়নি৷
মিরা কঠিন সুরে বলে, ” এটা কী করলেন আপনি? ”
–” কী করলাম আমি?”
মিরা বলতে পারল না সে কী করেছে কাজেই প্রসঙ্গ পালটে বলে, ” সমস্যা কী?”
–” তুমি দুপুরের খাবার এতো দেরিতে কেন খাচ্ছো? এখানেই আমার সমস্যা। ”
–” এটাই আপনি সমস্যা?”
–” হ্যাঁ।”
–” এয়ারপোর্টে ছিলাম। এজন্য খেতে পারি নি। জানেন না বুঝি!”
ইমান হেসে বলে, ” ওসব কিছু না। অযুহাত শুধুমাত্র। আসলে জামাইকে ছাড়া খেতে বুকে কষ্ট হয় জন্য না খেয়ে ছিলে।”
মিরা এসব কথা শুনেও চুপ থাকল। নিজের খাওয়ায় মনোযোগ দিল। কচকচ করে একটা সবুজ মরিচে কামড় বসালো। আগের মিরা হলে একচোট ঝগড়া বাঁধিয়ে দিত৷ কিন্তু সে এখন যথেষ্ট ম্যাচিউর হয়েছে৷ এসব বাচ্চামো তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যায় না৷ কাচা মরিচে ঝাল ছিল খুব। কামড় দেওয়ার সাথে সাথে জিহ্বা , ঠোঁট আর গলা ঝালে জ্বলে গেল। ঠোঁট লাল হয়ে আসলো তার। ইমান পানি এগিয়ে দিল। সে ঢকঢক করে পানি গেল। ইমান বলে, ” সাদা ভাত খাও। ঝাল লাগা কমে যাবে৷”
মিরা কয়েক লোকমা সাদা ভাত খেল। আসলেই ঝাল এখন কম লাগছে তার৷ ইমান বলে, ” তুমি আকাশ হলে, আমি জমিন। তুমি বৃষ্টি হলে, আমি হবো মেঘ। তুমি মরিচ হলে, আমি হবো সাদা ভাত৷”
— ” সাহিত্যিকগিরি বন্ধ করুন৷”
ন্যান্সি ম্যাডাম এগিয়ে আসছেন। ইমান আরেকবার তার পায়ে গুঁতো মেরে বলে, ” তোমার ঐ ঝাল লাল ঠোঁ-টে-র আ’দু’রে ছোঁ/য়া নি-তে মন চাইছে খুব করে৷”
মিরা বিষ্মিত চোখে তাকালো। কিন্তু কিছু বলা হলো না৷ ম্যাডাম সালাদের প্লেট নিয়ে এসে দাঁড়ালেন৷
ইমানের জন্য সালাদ আনা হলো। সে সালাদটাও ঠিকঠাক খেল না। তিন চামচ খেয়ে রেখে দিল। খাওয়ার পর্ব শেষ করে, ন্যান্সি ম্যাডাম এনাউন্সমেন্ট করল, নতুন সিইও আসায় অফিসে গ্রান্ড ওয়েলকামিং পার্টি হবে আগামী শুক্রবার। পার্টি-প্রোগ্রামের কথা শুনলেই অফিসের সব এমপ্লয়ি খুশি হয়৷ সকাল দশটা টু পাঁচটা অফিস করে কারোই বিনোদনের বা আনন্দ উপভোগ করার সময় থাকে না। কিন্তু মন দিয়ে কাজ করার জন্য রিফ্রেশমেন্টও প্রয়োজন। এ’কারণে অফিসে পার্টি হলে একটু সবার সঙ্গে আনন্দ করা যায়৷ সেদিন ইমান বেশিক্ষণ থাকল না অফিসে। একটু পর বেরিয়ে গেল। মিরা জানে না সে কোথায় গেল। এদিকে তাকে একটা মিটিংয়ে থাকতে বলেছে। কাজেই আরো দেড়ঘন্টা পর সে অফিস থেকে বের হবে৷ মিটিং শেষে ক্লান্ত হয়ে যখন মিরা বাসায় ফেরে তখন তার কাছে বাসার পরিবেশকে ঈদ মনে করে বিভ্রম হলো। মানে বাসার মেইন গেইট খোলা। ভেতর থেকে হাসাহাসির আওয়াজ আসছে৷ ইমাদের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। খাবারের গন্ধ বাসার বাইরেও মো মো করছে। বাসায় ঢুকে আজ তার জন্য ইমাদ অপেক্ষারত ছিল না। টিভিতে টম এন্ড জেরিও চলছে না৷ অথচ এই সময় ইমাদ নিচ থেকে খেলে এসে কার্টুন দেখে আর নানুমনির হাতে বিকেলের নাস্তা খায়৷ বসার রুম থেকেই পর্দার আড়ালে সে খাওয়ার রুমে উঁকি মারলো। ইমান বসে আছে টেবিলে। মা তাকে এটা-সেটা খাওয়াচ্ছে। তার চোখ বড় হয়ে গেল। তার মানে মায়ের কাছের প্রিয় মেহমান ইমান-ই। শিট! এটা তো একবারও মাথায় আসেনি। আসলে ইমানকে অফিসের বস রুপে দেখে সে বিশাল এক শক খেয়েছে৷ শক খাওয়ার পর ব্রেইন কাজ করছে না। আজকের মিটিংয়েও সে বেশ অমনোযোগী ছিল৷
মিরার কানে আসলো, ” মা, আমাকে আরেক বাটি সেমাই দিন। যেটা মিরা রান্না করে গেছে৷”
সুপ্তি বেগম বলে উঠে, ” আর কিছু দিব বাবা?”
–” মিরার বানানো রোস্টটা দিয়েন৷ এতো কষ্ট করে ও সকালে উঠে বানিয়ে গেছে৷ ওগুলো আগে খাই৷ ওর বানানো খাবার খাবো জন্য দুপুরেও আমি তেমন কিছু খাইনি।”
–” শুধু রোস্ট না সঙ্গে মায়ের হাতের পোলাও খাও বাবা৷।”
ইরা তাল মিলিয়ে হেসে বলে, ” ভাইয়া তো দেখছি বউয়ের হাতের রান্না খাওয়ার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছে।”
মিরাকে তখনও কেউ খেয়াল করেনি৷ ইমানের বলা কথা গুলো শুনে তার গা বেয়ে এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল। ইমাদ বুঝি তার মাকে দেখে ফেলে। সে চেচিয়ে বলে, ” আম্মু এসে গেছে৷”
তার চেচামেচিতে সকলে চুপ বনে গেল এবং ড্রয়িংরুমের দিকে তাকালো। মিরা এমনভাবে অভিনয় করল যেন সে মাত্র ঢুকেছে৷ কাউকে বুঝতে দিল না, সে আগে থেকে উপস্থিত ছিল৷ ইমাদ লাফিয়ে এসে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বলে, ” আজকেও লেইটে কেন আসলে আম্মু?”
–” সর্যি বাবাই৷”
— ” আম্মু সারপ্রাইজ দেখো। বাবা এসেছে তোমাকে সার…. ”
ইরা তখনই ইমাদকে থামিয়ে বলে, ” আপু, দুলাভাই এসেছে। একটু আগেই এলো বাসায়৷ তোমাকে ফোন দিয়ে জানানো হয়নি৷”
মিরা একবার তাদের সকলকে দেখে ভেতরে গেল। আবারো গল্প করার শব্দ আসতে লাগলো৷ সে গোসল সেড়ে যখন রুমের বাইরে আসল, তখন দেখা গেল ইমাদের মধ্যে দারুণ অস্থিরতা। সে একা একাই রেডি হচ্ছে৷ প্যান্টের চেইন লাগাতে পারছে না। আম্মুকে দেখে বলে উঠে, ” আম্মু চেইন লাগায় দাও।”
মিরা তার কাছে এসে বলে, ” বিচ্ছু বাচ্চা, কাজের সময় আম্মু, আর গল্প করার সময় আব্বু তাই না?”
ইমাদ হাসল। এটুকু বয়সে সে বুঝে গেছে কখন চুপ থাকতে হবে!
মিরা প্রশ্ন করে, ” রেডি হচ্ছো কেন? ”
–” আমরা চাচ্চুকে আনতে যাচ্ছি। চাচ্চু স্লো। এজন্য চাচ্চুর প্লেনও দেরিতে রওনা দিয়েছে। বাবা তো সুপারম্যান। এজন্য আগে আগে চলে আসছে৷”
–” ওহ আচ্ছা। বাবা সুপারম্যান? তাহলে তুমি কী?”
–” আমি স্পাইডার ম্যান, আম্মু৷”
মিরা হেসে বলে, ” তাহলে আমি কী স্পাইডার ম্যানের আম্মু?”
ইমাদ একটু ভেবে জবাব দেয়, ” আম্মু তুমি সুপারম্যানের বউ৷”
মিরা ছেলের উত্তরে অবাক হলো। এই টুকুন বাচ্চা! এখনই বউ কী, জামাই কী বুঝে গেছে। ইমাদ কি বুঝে বলেছে নাকী না বুঝে বললো?
সে বলে উঠে, ” বাবু তুমি আর কখনো জামাই-বউ এসব কথা বলবে না। এগুলো বড়দের কথা। ঠিক আছে? মনে থাকবে?”
ইমাদ গম্ভীরমুখে বলে, ” আচ্ছা আমি বড়দের কথা আর বলব না৷ কিন্তু সৃজা, ওতো সবসময়ই বলে ও বিয়ে করবে৷ ওর বর বাজার করবে৷ ও রান্না করবে। ওকে কেউ মানা করে না কেন?”
মিরা ছেলের চুল আছড়ে দিল। ইমানকে তখন দেখা গেল রুমের ভেতর প্রবেশ করতে৷ মিরা তাকে আসতে দেখে বারান্দার উদ্দেশ্য হাঁটা ধরলে ইমান সাদা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বলে, ” সাদকে আনতে যাচ্ছি আমরা। রাত আটটার মতো হবে ফিরতে। ইরাও যাচ্ছে সঙ্গে। বাই।”
ইমান ইমাদকে ঘাড়ে উঠিয়ে হাঁটা ধরল। নিচে গাড়ি অপেক্ষা করছে৷ ওরা তিনজন বেশ আনন্দের সঙ্গে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তারা বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিরা রান্নাঘরে গিয়ে রান্না বসায়৷ কৈ মাছ ভাজী, বেগুন ভাজী আর শুকটি মাছ রান্না করে রাখবে। তার জানামতে, এগুলো ওর পছন্দের খাবার। হুট করে একটা কথার মাধ্যমে তার মনে তৈরি শক্ত পিলারে গড়া অভিমানের ঘরটা থেকে একটা ইট খসে পড়েছে আজ৷ সুপ্তি বেগম রান্নাঘরে এসে বললো, ” এতকিছু থাকতে তুই আবার কী বানাচ্ছিস? ”
–” রান্না করতে ইচ্ছা করলো তাই বানাচ্ছি। আচ্ছা মা শুন, আমার একটা কথা রাখবে?”
–” তোমর দশটা কথা রাখব। বল, কী বলতে চাস৷”
–” তুমি কিন্তু কাউকে বলবে না এই কৈ মাছ ভাজী, শুটকি মাছ আমি বানিয়েছি।”
সুপ্তি বেগম হাসলেন এরপর বলে, ” পাগলী৷ আচ্ছা যা বলব না৷”
_______________________
সাদকে রিসিভ করে ফিরতে ফিরতে তাদের সাড়ে আটটার বেশি সময় লাগলো। ইমাদ বাসায় এসে চাচ্চু আর বাবার সঙ্গে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ইরা ওদের সঙ্গে বসে থাকলো। সাদ খানিকক্ষণ বাদে তার দিকে তাকাচ্ছে আর মিটমিট হাসছে। ইরা ততোবারই চোখ রাঙ্গানি দিচ্ছে। মিরা তাদের দিকে এগিয়ে এসে বলে, ” খেতে আসো সবাই৷”
ইতিমধ্যে সৌজন্যতা স্বরুপ সাদের সঙ্গে তার কুশল বিনিময় ঘটেছে। সাদ আসা থেকে তাকে ভাবী ডাকছে। শুধু তাই না,সে খেয়াল করেছে ইরাও ইমানকে ভাইয়ার বদলে দুলাভাই ডাকছে। ডিনার টেবিলে ইমান ভাত শুটকি মাছের তরকারি, কৈ মাছ ভাজি আর বেগুন দিয়ে খেয়ে উঠে। পোলাও-মাংস কিছু খেল না। খাওয়ার পর দু’চামচ সেমাই খেল। সে যে ডায়েট কন্ট্রোল করে ফিট আছে তা দিব্যি বোঝা যাচ্ছে৷ খাওয়ার পর সবাই একদফা গল্প করল। ঠিক হলো, সাদ আপাতত ইরার রুমে থাকবে। আর ইরা সুপ্তি বেগমের সঙ্গে রুম শেয়ার করবে৷ ইমান ইমাদকে কোলে নিয়ে মিরার বেডরুমে ঢুকল। ইমাদ সাধারণত দশটা অব্দি জাগে না। আজ সে সাড়ে দশটা পর্যন্ত জেগে আছে। বেচারার চোখ ঘুমে কাদা। সে টলছে ঘুমের ভারে৷ কিন্তু তবুও তার বাবাকে ছাড়বে না। আরোও গল্প করবে। মিরাও বাবা-ছেলের পেছনে বেডরুমে ঢুকল। ওরা গল্পের আসর মাত্র জমাচ্ছে৷
মিরা ধমক দিয়ে বলে, ” এখন কোন গল্প হবে না। ঘুমাবে। ইমাদ ব্রাশ করে এসে সোজা চোখ বন্ধ করবে৷ যাও বাথরুমে৷”
ইমাদ মায়ের বাধ্য ছেলে। আম্মুর সব কথাই সে শোনে। তাই ব্রাশ করতে চলে গেল। ব্রাশ করে এসে বলে, ” আম্মু বাবাকে ব্রাশ করতে বললে না কেন?”
মিরা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে৷ তার ছেলের স্বভাব জানা আছে৷ ইমাদ যাদের খুব পছন্দ করে, সে চায় তার পছন্দের ব্যক্তিরাও সে যেসব এক্টিভিটি করছে সেগুলো অনুসরণ করুক। এখন বাবা তার পছন্দের ব্যক্তি। সে রাতের শোয়ার আগে ব্রাশ করে। সুতরাং সে চাইবে তার বাবাও করুক। যদি না করে পরবর্তীতে সেও আর করতে চাইবে না। কারণ তার পছন্দের মানুষ সেটা করেনি।
সে বলে উঠে, ” ইমাদের আব্বু, যান ব্রাশ করে আসেন৷”
ইমান মোটেও এমন কোন আদেশের জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে বলে, “সর্যি?”
— ” ব্রাশ করবেন, যান৷ দিনে-রাতে দু’বার ব্রাশ করতে হয়৷ জানেন না?”
ইমান একটু ধাতস্থ হয়ে হেসে বলে, ” যাচ্ছি, ইমাদের একমাত্র আম্মু।”
মিরা দাঁতে দাঁত চেপে তার দিকে তাকিয়ে রইল। ইমান ওয়াশরুম থেকে ফিরে আসলে মিরা প্রশ্ন করে, ” রাতে কোন রুমে থাকবেন?”
–” ইমাদ আর ইমাদের একমাত্র আম্মুর রুমে থাকব।”
মিরা বেডে শুয়ে পড়ল। মাঝে ইমাদ আগেই শুয়ে আছে। সে বাবাকে ডেকে বলল, ” বাবা, আমাকে আরেকবার সিন্ড্রেলার গল্পটা শুনাও।”
মিরা বলে উঠে, ” এসব ফেইরিটেল শুনে কী হবে? তার চেয়ে বাবার কাছ থেকে অংক শিখো।”
ইমান বেডে শুয়ে ইমাদকে গল্প শুনাতে লাগে। একটা সময় মিরা ঘুমিয়ে যায়। ঘুমানোর আগে শুনতে পেল, একদেশে এক রাজা ছিল। তার একটা রাণী ছিল৷
ঘুমের মধ্যে শীতল স্পষ্ট পেল সে। কেউ ধীর গলায় বলছে, ” শুভ জন্মদিন, শেহজাদী। ”
সে সাথে সাথে চোখ খুলল। ঘর অন্ধকার হলেও সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ঘরে চারপাশে ফেইরিলাইটস দেওয়া। সেগুলো জ্বলছে-নিভছে। ক্যান্ডেলও আছে। আবছা আলোয় ইমানের হাস্যজ্বল মুখটা দেখা গেল৷ পাশেই ইমাদ হাততালি দিচ্ছে। এমন না যে মিরা তার জন্মদিন ভুলে গেছে। তার মাদার’স ডেয়ের দিনই মনে পড়েছিল নিজের জন্মদিনের কথা। কিন্তু তাদের বাসায় তো জন্মদিন সেলিব্রেশনের কোন কালচার নাই। শুধু ইমাদের বার্থডেতে ঘুরতে যাওয়া হয়৷ গিফট দেওয়া হয় ওকে। ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসতেই সবাই চেচিয়ে বলে উঠে, ” শুভ জন্মদিন। ”
মা, ইরা, সাদ ছাড়াও সোনালী আপু তার মেয়েকে নিয়ে এসেছে৷ মিরা অপলক নয়নে চেয়ে থাকলো। ফুল আর কেক ও কার্ড টেবিলে রাখা৷ দুটো কেক রাখা। একটা কেকের উপর ইমানের বলা কথাটাই লেখা৷
” শুভ জন্মদিন, শেহজাদী।” এবং আরেকটায় লেখা, ” ওয়ার্ল্ড বেস্ট মাদার, আই লাভ ইউ।”
সে ইমাদকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়ে বলে, ” থ্যাংক ইউ, আমার সোনা বাচ্চা৷”
ইমাদ সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠে, ” আমাকে না। বাবাকে থ্যাংক ইউ বলো আম্মু। এসব বাবার প্লান ছিল।”
মিরা একবার ইমানের দিকে তাকালো কিন্তু থ্যাঙ্কিউ বললো না৷ ইমান হাসলো শুধু।
সবাই আরেকবার হ্যাপি বার্থডে বললো। ঘড়ির কাটায় তখন বারোটা বাজে বিশ মিনিট ৷ সে ইমাদ আর সোনালী আপুর মেয়েকে নিয়ে কেক কাটে৷ সবাইকে সে নিজ হাতে কেক খাওয়ালো। বাদ থাকে কেবল ইমান আর সাদ। সাদ অবশ্য ছবি তুলছে তার ক্যামেরায়। সাইকোলজি নিয়ে স্ট্যাডি শেষ করে সে এখন ফটোগ্রাফার হওয়ার ভুত মাথায় চেপেছে৷
ইমাদ হচ্ছে এক নাম্বারের পাকনা। সব খেয়াল করবে সে। মিরা যে ইমানকে কেক খাওয়ায়নি এটা সে খেয়াল করে এবং বলে উঠে, ” আম্মু, বাবাকে কেন কেক খাওয়ালে না?”
মিরা ইমানের দিকে তাকালো। ইমান তার দিকে এগিয়ে আসলে কেবল ইমাদের জন্য সে কেক খাইয়ে দিল। এরপর সবাই ড্রয়িংরুমে চলে গেল৷ মিরাও আসলো সবার সঙ্গে। কেবল ইরা ইমাদ আর সোনালী আপুর মেয়েকে নিয়ে শুয়ে পড়ল৷
ইমান সবার সামনে আবারো বলে, ” মিরা, সব ভুল বুঝাবুঝি দূর করে আবার একসঙ্গে থাকা যায় না? মানলাম আমার ভুল হয়েছে৷ এই এতো সুন্দর পরিবার আমাদের, শুধুমাত্র আমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর সমস্যার জন্য সবাই ভুগছি। আমি আরেকটা বার সুযোগের জন্য চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় আছি। তুমিও ভুল বুঝেছিলে আমাকে, আমিও তোমাকে ভুল বুঝেছি৷ আমি যদি তোমাকে ক্ষমা করতে পারি, তুমি কেন পারছো না?”
সুপ্তি বেগম বলে উঠে, ” মারে, আমার আর এসব সহ্য হয় না। আর ভালো লাগে না৷”
সোনালী আপু বলে, ” ইমান সত্যি তোর কাছে আরেকটা সুযোগ চায়৷ প্লিজ মানা করিস না৷”
সাদও বলে উঠে, ” প্লিজ মিরা ভাবী, আমাদের ইমাদের জন্য হলেও ভাইয়াকে একসেপ্ট করো আরেকবার। আমরা সবাই তোমাদের তিনজনকে একসঙ্গে দেখতে চাই। আলাদাভাবে না৷”
মিরা বুঝতে পারছে ওরা সবাই একজোট বেঁধে নেমেছে তাকে রাজী করানোর জন্য। সেও কম না। এতো সহজে দমবার পাত্রী না। ইমান তাকে পরপর দু’বার হার্ট করেছে৷ এবার তার পালা।
মিরা বললো, ” আপনি সত্যি আরেকবার চান্স চান?”
–” এটা আবার জিজ্ঞাসা করা লাগে?”
–” আমি চান্স দিব কিন্তু এক শর্তে।”
–” সব শর্তে রাজী।”
–” না শুনেই কেন রাজী হচ্ছে?”
–” তোমার জন্য সব শর্তেই রাজী।”
মিরা বাঁকা হাসলো। এরপর বলে উঠে, ” আমি একমাস সময় নিব। এই একমাসে আমি দেখব আপনি আমাকে পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন কীনা। এর আগের বার অযোগ্য পাত্র হয়েও আমাকে পেয়ে গিয়েছিলেন জন্য মূল্যায়ন করেননি। এবার যোগ্যতা প্রমান করতে হবে৷”
–” আমি শর্তে রাজী। একশ বার রাজী। ”
–” এটা তো শর্ত নয়। ”
–” তাহলে কী শর্ত?”
–” আপনাকে এই একমাস হাউজ হ্যাসবেন্ড হয়ে থাকতে হবে৷ আপনি কী এই চ্যালেঞ্জ নিতে পারবেন?”
উপস্থিত সবাই হতভম্ব হলো। সাদ প্রশ্ন করে, ” হাউজ হ্যাসবেন্ড এটা আবার কী?”
মিরা হেসে উত্তর দিল, ” হাউজ ওয়াইফের মেইল ভার্সন। তোমার ভাই এই একমাস বাসার সমস্ত কাজ সামলাবে৷”
সুপ্তি বেগম ঝারি মেরে বলে, ” পাগল তুই। চুপ কর। এসব কী বলছিস নিজেও জানিস না।”
ইমান সুপ্তি বেগমকে থামিয়ে মিরার চোখে চোখ রেখে বলে, ” আমি হাউজ হ্যাসবেন্ড হয়ে থাকতে রাজী। এতে যদি ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করা যায় মন্দ হবে না। তুমি আমাকে আরেকবার সুযোগ দিচ্ছো এটা আমার সাত রাজার গুপ্ত ধন পাওয়ার মতো ভাগ্য।”
মিরা বলে উঠে, ” যতো সহজ ভাবছেন এটা মোটেও ওতো সহজ কোন চ্যালেঞ্জ না৷”
— তোমাদের আরেকবার কাছে পাওয়ার জন্য আমি সব ধরনের চ্যালেঞ্জ নিতে ইচ্ছুক।”
–” এস ইউর উইশ৷”
সুপ্তি বেগম বেজায় ক্ষেপলেন মিরার উপর। কিন্তু মিরা তার সিদ্ধান্তে অনড়। অপর দিকে ইমান চ্যালেঞ্জ একসেপ্ট করেছে। এবার দেখার পালা, ইমান কী পারবে চ্যালেঞ্জ ফুলফিল করতে?
চলবে৷
#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–55
সেদিন একটানা খানিকক্ষণ বাদে বাদে ধরণী ঝাঁকিয়ে বৃষ্টি নামছিল। সোয়া ছয়টা থেকে একাধারে বৃষ্টি নামায় ইমাদের আজকেও স্কুল যাওয়া হলো না৷ এতে অবশ্য ওর বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। সে বৃষ্টির দিকে কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে তাকিয়ে থেকে নিজ থেকে তোতাপাখি কণ্ঠে বলে, ” বৃষ্টি তুমি প্রতিদিন আসো না কেন?”
তার কথায় আম্মু-আব্বু দুইজনই হাসলো। সে কখনো তার মা-বাবাকে একসাথে দেখেনি৷ আজকে এই প্রথম দেখছে৷ তার কী যে আনন্দ লাগছে৷ নিজের সবচেয়ে প্রিয় দুটো মানুষ একসঙ্গে আছে তার কাছে৷ সে মা-বাবায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, ” আই লাভ ইউ আম্মু-আব্বু।”
মিরা ছেলের দিকে তাকালো। আহারে তার ছেলে যখন তাকে এমন আদুরে কথা বলে তার বুক শান্তিতে ভরে উঠে। সে ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বলে, ” স্কুলে পাঠাই নি জন্য আই লাভ ইউ বলা হচ্ছে দুষ্টু বাচ্চা আমার।”
ইমাদ মুখ গম্ভীর করে বলে, ” আমি এজন্য মোটেও বলি নি।”
ইমাদের এই মুখখানা দেখলে অবাক হয় মিরা। যেন ভাবখানা এমন যে উনি বড় কোন অফিসের বস। বিশাল বড় দায়িত্বে আছেন উনি। সিরিয়াল মুড যাকে বলে।
ইমান তার দিকে এগিয়ে এসে ওকে চুমু দিয়ে বলে, ” লাভ ইউ টু৷”
মা-বাবার আদর একসঙ্গে ক্ষুদ্র জীবন এই প্রথমবার ছোট্ট ইমাদ পেল। সে খুশিমনে আবারো শুয়ে পড়ে৷ বাবা পাশে বসে আছে। এবং আম্মু মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে৷
সাতটার দিকে যেন আরো বৃষ্টির প্রকোপ বাড়লো৷ মিরপুরে একটু বৃষ্টি নামলেই রাস্তায় পানি জমে। অতিমাত্রায় জ্যাম সৃষ্টি হয়৷ মিরা একটু পর পর বারান্দায় গিয়ে বৃষ্টি পড়ার গতিবেগ পর্যবেক্ষণ করছে৷
ইমান রুম থেকে বলে, ” আজকে ছুটি নিলেই পারো। বৃষ্টি আজকে সারাদিন হবে৷”
মিরা ভাবলো কিছুক্ষণ। তার গাড়ি আছে। সে চাইলে বের হতে পারবে৷ কিন্তু কথা হলো বৃষ্টির অযুহাত দিয়ে আজকে অনেকেই অফিস করবে না৷ তাদের অবর্তমানে দেখা গেল ন্যান্সি ম্যাডাম তাকে ভর্তুকি দিতে বলবে। এর চেয়ে না যাওয়াই ভালো৷ এম্নিতে সে গত পড়শু কাজ বুঝিয়ে দিয়েছে৷ আপাতত চাপ কম।
সে রুমে এসে ফোন দিল ন্যান্সি ম্যাডামকে। ইমান বিছানায় শুয়ে সবটা দেখছে৷ ইমাদ ততোক্ষণে ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছে৷
ন্যান্সি ম্যাডাম তার ফোন দেখেই ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলে উঠে, ” আজকে ছুটি নিতে চাও নাকী?”
–” হ্যাঁ, ম্যাম।”
–” আমাকে কল না করে, নতুন সিইও স্যারকে মেইল কর। উনি ছুটি দিলে ছুটি কাটাও।”
মিরার মুখ কালো হয়ে আসলো। এইজন্য বুঝি ইমান আগ বাড়িয়ে ছুটি নেওয়ার বুদ্ধি দিল! মানে কত ফাজিল হলে এমন করে একটা মানুষ!
ইমান তার দিকে বারবার দেখছে আর ফোন হাতে নিয়ে কী যেন করছে। সে ড্রেসিং টেবিলের সামনের চেয়ারে বসে মেইল পাঠালো৷ দু’সেকেন্ডের ব্যবধানে ইমান হোহো করে হেসে উঠলো। মিরার এতো রাগ হলো। আশ্চর্য!তার ই-মেইল দেখে এতো হাসার কী হলো?
মিরা বলে, ” এই যে শুনছেন? এতো হাসির কী দেখলেন? আগে কোনদিন মেইল দেখেন নি? কেউ কখনো ফর্মাল মেইল সেন্ড করেনি আপনাকে? এরপর একদণ্ড থেমে বলে, ” আপনাকে তো মেইল পাঠায় না কেউ। সব মেয়েরা তো আপনার কাছে লাইন দিয়ে ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ এ কথা বলে।”
ইমান ভ্রু কুচকে তাকালো তার দিকে এরপর ফোন ঘেঁটে বলে, ” ওহ আচ্ছা, তুমি একদিনের ছুটি চেয়ে মেইল দিয়েছো৷ আমি মাত্র দেখলাম। ওকে তোমার ছুটি মঞ্জুর।”
মিরা তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বিছানার অপরপ্রান্তে গিয়ে শুয়ে পড়ে৷ বৃষ্টি হতে থাকায় পরিবেশ শীতল। ইমান উঠে গিয়ে ফ্যানের স্পিড কমালো। এরপর ইমাদ আর মিরার গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দিতে গেলে মিরা চোখ খুলে ফেলে৷ ইমান প্রশ্ন করলো, ” ব্রেকফাস্ট এ কী খাবে?”
মিরা এহেন প্রশ্নে সামান্য হচকচিয়ে যায়। পরবর্তীতে মনে পড়ে মিষ্টার খানের তো আজ থেকে হাউজ হ্যাসবেন্ড হওয়ার ডিউটি শুরু। সে বলে উঠে, ” রুটি আর আলুভাজি।”
–” আর কিছু? ”
–” ডিম পোজ আর এক কাপ চা।”
–” আমি সারাজীবনের জন্য তোমার বেড-টি বানানোর দায়িত্ব নিতে চাই।”
মিরা পাশ ঘুরে ইমাদের দিকে ফিরে শুলো।
______________________________
মিরা যখন ঘুম থেকে উঠে তখন কানে ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর শুনতে পেল৷ ব্যাপার কী? ইমাদ তো ওয়ান-টু এসব শিখে ফেলেছে। সে ঘুম থেকে উঠে আশেপাশে তাকাচ্ছে। রুম সম্পূর্ণ ফাঁকা কিন্তু বারান্দা থেকে শব্দ আসছে। সে শব্দ উৎসের দিকে হেঁটে গেল৷ বারান্দায় পাটি বিছিয়ে দুই বাপ-বেটা পুশ আপ দিচ্ছে৷ ইমাদ অবশ্য পারছে না। বাবাকে নকল করার চেষ্টা করছে। আবার টায়ার্ড হলে থেমে গিয়ে বসে বসে বাবার পুশ আপ দেওয়ার সংখ্যা গননা করছে৷
–” এইট, নাইন, টেন……. ” বলেই ইমাদ হাতে তালি দিল।
ইমান পুশ আপ করতে করতে মিরার দিকে তাকালো। এরপর বলে উঠে, ” গুড মর্নিং। ”
মিরা হাই তুলে বলে, ” কি হচ্ছে এসব?”
–” বাবা পুশ আপ দিচ্ছে আম্মু৷ কিন্তু আমি দিতে পারি না ঠিকঠাক মতো। বাবা আমাকে শেখাবে।তুমি শিখবে পুশ আপ দেওয়া? ”
শেষের কথাগুলো ইমাদ ভারী দুঃখ নিয়ে বললো। মিরা ইমানের দিকে তাকালো। সে আপাতত উঠে বসে বোতলে মুখ লাগিয়ে পানি খাচ্ছে। এটা মিরার সবচেয়ে অপছন্দের কাজ। কেউ বোতলে মুখ লাগিয়ে খেলে মিরা সেই বোতলের পানি খেতে চায় না একদম।
ইমান তাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” সকালের নাস্তা টেবিলে আছে। আমি নিজ হাতে বানিয়েছি। তো হার হাইনেজ, আপনাকে খাইয়ে দিব নাকি নিজে খাবেন?”
মিরা বলে উঠে, ” আমি নিজে খেতে জানি। ইমাদ আসো তোমাকে নাস্তা খাওয়াব৷ আসো জলদি।”
ইমান বিড়বিড় করে বলে, ” হাউজ হ্যাসবেন্ডরা বউদের খাইয়ে দেয় তো!”
ইমাদকে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বোঝা গেল, সে বাদে সবাই খেয়ে নিয়েছে। কাল রাতে সোনালী আপু থেকে গিয়েছিল৷ আপু, ইরা আর সাদ ড্রয়িংরুমে গল্প করছে।
সে ইমাদকে রুটি আর আলুভাজি খাইয়ে দিল। তখনই ইমান আসল। সেও ব্রেকফাস্ট করেনি৷ মিরার সঙ্গে খাবে বলে৷ সে টেবিলে বসতেই ইমাদ ওর আম্মুকে বলে উঠে, ” আম্মু তুমি বাবাকে খাইয়ে দাও। যেভাবে আমাকে খাইয়ে দিলে।”
ইমান তখন গ্লাসে জুস ঢালছিল। ছেলের কথা শুনে সে নড়েচড়ে দাঁড়ালো। কথা হলো, ছেলেটা তার মনের কথা কেমনে বুঝে গেল? বাপ রে! কিন্তু পোড়া কপাল! ছেলে তো আর জানে না তার মা-জননী কতো হৃদয়হীনা।
মিরা বলে উঠে, ” তোমার বাবা তো বাচ্চা না। সে একা একা খেতে পারে। তাছাড়া তুমিই তো বলো তোমার বাবা সুপারম্যান। সুপারম্যান কখনো কারো হাতে খায় না।”
ইমাদ মুখ ঘুরিয়ে বলে, ” তাহলে আমিও তোমার হাতে খাব না। আমি স্পাইডার ম্যান। স্পাইডার ম্যানও আম্মুর হাতে খায় না৷”
মিরা ভারী ঝামেলায় পড়ে গেল। ইমাদ পটরপটর করে তোতাপাখির মতো সব কথা বললোও, নিজে নিজে ঠিকমতো খেতে পারে না। একলা রুটি ছিঁড়ে ও কোনদিন নাস্তা খেয়েছে কীনা সন্দেহ।
মিরা বলে, ” তুমি বাবু স্পাইডার ম্যান। বাবুদের হিসাব আলাদা।”
ইমানও সায় দিয়ে বলে, ” হ্যাঁ বাবাই। আম্মুর কথা শোন।”
কিন্তু নাছোড়বান্দা ইমাদ জেদ ধরলো। বাবাকেও খাইয়ে দিতে হবে। একসময় সোনালী আপু এসে বললো, ” ইমাদের কথা শুন। ছোট মানুষ আবদার করেছে। ”
পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো যে ইমাদ কিছুতেই মুখ খুলছে না। মুখে খাবার নিচ্ছে না। অগত্যা বাধ্য হয়ে ছেলের জন্য মিরা ইশারায় ইমানকে এদিকে আসতে বললো। ইমান তার কাছে আসলে, এক লোকমা খাবার তার মুখে তুলে দিল৷ ইমাদ খুশি হয়ে সারাবাসা প্রচার করে বেড়ালো এ খবর। ইমান মিরার হাত থেকে খাবার খেয়ে উঠে সোজা বেডরুমে চলে যায়। বোধহয় লজ্জা পেয়েছে। মিরার হাসি পেল ভারী।
দুপুরের পর ইমাদের জ্বর আসলো। ওর একদম মুখ-চোখ শুকিয়ে গেল। ক্লান্ত দেখালো ওকে। দুষ্টুমি সব বন্ধ হয়ে গেল ওর। সে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে রইল৷ ইমানের সে কী চিন্তা। এক মুহূর্তের জন্য ছেলের কাছ থেকে উঠছে না। আজকে বিকেলে ইমাদকে নিয়ে ঘুরার পরিকল্পনা ছিল। তাই ভীষণ মন খারাপ হচ্ছে ইমানের৷
মিরা বলে, ” বাচ্চারা প্রায়ই অসুস্থ হয়। এতে এতো বিচলিত হওয়ার কিছু নেই।মেডিসিন খেয়েছে৷ সেরে যাবে৷ ”
তবুও ইমান বিকেল অব্দি মাথায় জলপট্টি দিল৷ পাশে বসে থাকল। কিন্তু বিকেলের দিকে সুপ্তি বেগম বললেন, ” মিরার দাদীকে হাসপাতালে গিয়ে দেখে আসতে হবে।”
ইমানকে সে রিকুয়েষ্ট করল যাওয়ার জন্য। কিন্তু মিরা জানিয়ে দিল সে যাবে না। তাকে রেখে সবাই গেল। আশ্চর্যজনক ভাবে সুপ্তি বেগমও গেলেন সবার সঙ্গে। সাদ যদিও তাদের কাছের কেউ না, তাও ভাইয়ের ফ্যামিলি মেম্বার মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। এজন্য মানবিকতার খাতিরে সেও গেল। বাসায় রইল কেবল মিরা আর ইমাদ। ইমাদের কিছুটা সুস্থবোধ হচ্ছে জন্য সে টিভির রুমে ডোরেমন দেখছিল। মিরা তার জন্য স্যুপ বানাতে বানাতে অতীতে বিচরণ করে।
দাদী নামক ব্যক্তি তার খুব প্রিয় ছিলেন একসময়। যদিও দাদীর চিন্তাভাবনা সেকালের। সে নাতি-নাতনিদের খুব ভালোবাসেন। কিন্তু কেন যেন তার ছেলের বৌদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক কোনকালেই ছিল না। বড়আম্মুর সঙ্গেও তার ঝামেলা বাঁধত। মিরা যখন ফোরে পড়ে তখন সোনালী আপুর আম্মু মারা গেলেন। বড় আম্মু মিরা-ইরা দুজনকেই খুব আদর করত৷ ওনার গত হওয়ার পর সমস্ত দুর্ব্যবহারের শিকার সুপ্তি বেগম হয়ে এসেছেন। পুত্রের দোষ তার চোখে ধরা দিবে না৷ কাজেই যাবতীয় সকল দোষ সুপ্তি বেগমের। এসব পুরাতন কথা। সব জানার পরও যৌথ পরিবারে তারা থেকে এসেছে৷ একসঙ্গে থাকলে টুকটাক ঝামেলা হবে জন্য মা মানিয়ে চলত। এতোকাল এটাই ভেবে এসেছিল মিরা৷ কিন্তু ইমানের ঐ বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেওয়ার পর একক বাসা গঠন করার পর মিরা তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর সত্য জানতে পারল। ওই সময় বাবা অকারণেই খুব বাজে ব্যবহার করতেন। এমনকি তার আদরের মেয়েদেরকে উপর চিল্লাতেন। ইরাকে একদিন থাপ্পড়ও মেরেছিল। দুই ভাই এতোকাল একসঙ্গে ছিল জন্য সম্পত্তির বন্টন হয়নি এতোদিন৷ কিন্তু আলাদা হতেই বোঝা গেল আজিজ তালুকদার সাহেবের নামে তাদের বাবা তেমন কিছু লিখে যান নি। এদিকে আজিজ সাহেব ভাইয়ের ব্যবসায় জড়িত ছিল। নিজের বলতে তেমন কিছু নেই। ভাইয়ে ভাই ঝগড়া বাধল৷ আজমল সাহেব তার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে ব্যবসা গুটান ফলে অর্থনৈতিক ভাবে আজিজ সাহেব দুর্বল হয়ে পড়লেন। মাথা ঠিক থাকত না তার৷ এমনই একদিন সুপ্তি বেগমের সঙ্গে তার কী নিয়ে লাগলো যেন। তিনি মেজাজ ধরে না রাখতে পেরে প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের সামনেই স্ত্রীদের গা’য়ে হা’ত তু’লে’ন। মায়ের গাল লাল হয়ে যায়। সে আঘাত প্রাপ্ত শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েন। জ্বর আসে তার৷ মিরা সেরাতে মায়ের কাছে যায়। কারণ মায়ের কষ্ট সে উপলব্ধি করতে পারছিল। সেও তো বিবাহিত। ওই রাতে মায়ের কাছে গেলে, মা নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। জ্বরের ঘোরে সে মিরাকে তার বাবার সমস্ত অতীত বলে দেয়। নিজের বাবা অতীত মিরা মানতে পারেনি। এদিকে ঘরে প্রতিদিন অশান্তি। উড়ো খবর আসল আজিজ সাহবে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। সুখ সে যেন মরিচীকা। বাসাটা নরকে পরিনত হলো যেন৷
এরপর কিছু দিন পর, সুপ্তি বেগম মিরাকে সিদ্ধান্ত জানালো যে ওদের নানাবাড়ি চলে যাবেন। তিনি-ই মিরাকে আমেরিকা যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন৷ মা তো জানত না, ইমানের সঙ্গে মিরার সম্পর্ক স্বাভাবিক নেই। সে চাইছিল মিরা নিউইয়র্ক গিয়ে সেটেল হলে ইরাকে গতি করে দিবে৷ দু’মেয়ের চিন্তা থেকে সে মুক্তি পাবে৷ মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারেনি। অশান্তি হাত থেকে বাঁচার জন্য সে নিউইয়র্কে চলে আসে। কাউকে কিছু না জানিয়ে। বড় আব্বু তার জন্য পাসপোর্ট আর ভিসা বানিয়ে ফেলেছিল। টাকা জোগাড় করে নিউইয়র্ক আসতে তার অবশ্য ক’দিন সময় লেগেছিল৷ বাবার লজ্জাজনক কৃতকর্মের দায় থেকে সে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। এজন্য মূলত নিউইয়র্কে আসা৷ মানসিক শান্তির জন্য সে বাংলাদেশ ছাড়ে৷ কিন্তু নিউইয়র্কে তার জন্য আরো ক্ষতিকর সত্য অপেক্ষা করছিল। নিজের সৎবোনের সন্ধান মিললো সেখানে। শ্বশুড়ের অপমান, স্বামীর জন্য নিজের বোনের ভালোবাসা মিরা ওই বিশ বছর বয়সে সহ্য করতে পারেনি। বুকে ব্যথা নিয়ে মাকে হতাশ করে ফিরে আসে। কিন্তু মা তাকে দূরে ঠেলে দেয়নি। বুকে আগলে রাখলো। তার কাছ থেকে সব সত্য শুনে সে নীরব থেকেছে৷ তবে মেয়ের জন্য সে ঢাল হয়ে থাকল৷ ঐ সময় দাদী তাকে এবং তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” দুই মা-মেয়ে স্বামী-সংসার ফেলে কী বে/শ্যা গিরি শুরু করতে চাস?”
এই একটা বাক্যের জন্য মিরা দাদীর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করল। তখন ইমাদ পেটে ছিল। এতোবড় সুখবর পেয়েও তারা আনন্দ করতে পারে না। খুব হিসেব করে চলতে হত৷ ইমান দেশে আসে। তার কাছে ক্ষমা চায়। মিরা তখনো ট্রমা থেকে বের হতে পারছিল না কাজেই সে সময় চায়৷ ইমাদ হওয়া অব্দি ইমান দেশে ছিল। সমস্ত খরচ সে বহন করেছে। ইমাদের যখন তেরদিন ওই সময় ইমানকে নিউইয়র্ক যেতে হলো। পিটার নাকী তার উপর লিগ্যাল একশন নিচ্ছিল। ঝামেলা করছিল। ইমান নিউইয়র্ক যাওয়ার পর তাদের যোগাযোগ কমে আসলো। ইমাদ আরেকটু বড় হলে মিরা পড়াশোনা কন্টিনিউ করে। ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়া শুরু করল। কেননা ততোদিনে সে আর সুপ্তি বেগম অলনাইনে ব্যবসা শুরু করে। ব্যবসা শুরু করার জন্য মূলধন বড় আব্বু দিয়েছিল৷ সহযোগিতাও করেছেন উনি। ওনার প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞতা থাকবে মিরার৷ ভার্সিটির প্রাঙ্গনে হুট করে রাকিবের দেখা মিলল। রাকিব যে এক সময় তাকে প্রেম নিবেদন করেছিল৷ রাকিব ওর সিনিয়র ছিল৷ প্রথম দিকে মিরা রাকিবের সঙ্গে কথা বলত না। কিন্তু রাকিব তার সঙ্গে কথা বলার জন্য মরিয়া। মিরা বিবাহিত জানার পরও ফ্রেন্ড হতে চাইল। কিন্তু ও ফ্রেন্ডশিপ করল না। তবুও রাকিব তার সাথে নাইসলি বিহেইভ করা শুরু করল। মিরা ভেবেছিল রাকিব হয়তোবা ভালো মানুষ। তাকে সম্মান করে মন থেকে। কিন্তু সে আসলে মুখোশধারী মানুষ চিনতে শিখেনি। দু’মাসের মাথায় ভার্সিটিতে রাকিব রটিয়ে দিল তাদের মধ্যে প্রনয়ের সম্পর্ক আছে। এই কথা কীভাবে যেন দাদীর কানে যায়। দাদী তখন মিরার উপর বেজায় ক্ষিপ্ত। তিনি ইমানের কানে বিষ ঢালে। ইমান সরাসরি মিরাকে সন্দেহ করে প্রশ্ন করে বসে। এতেই মিরার ইগো হার্ট হলো। ছোট্ট ইমাদকে সামলে, পড়াশোনা, ব্যবসায় কাজ করতে করতে হাপিয়ে যাওয়া সংগ্রামী মিরা নিজের চরিত্রে দাগ সহ্য করতে পারলো না। ইমানের সঙ্গে ডিভোর্স নিতে চাইলো। সময় আর নিবে না। কিন্তু তাদের তালাক হলো না। দুটো কারণে, প্রথমত ইমান রিয়েলাইজ করে যে সে ভুল করেছে। আর দ্বিতীয়ত, তালাক হলেও ইমান ইমাদকে নিজের কাছে রাখবে বলে কাস্টাডি চাইছিল। ইমান ক্ষমা চাইছিল বারবার জন্য বড় আব্বু আর মা দু’জনই তাকে আরো ভাবতে বললো।
এছাড়াও সমাজে ডিভোর্সি মেয়েদের অস্বস্তিকর পরিবেশে পড়তে হবে ভেবে সুপ্তি বেগম সিদ্ধান্ত বদলাতে বলেন। ওনার ভাষ্যমতে, ওদের দু’জনের দোষ সমান। মিরাও সন্দেহ করেছিল৷ ইমানও করেছে। বরং ইমান ক্ষমা চায়। কিন্তু মিরা ক্ষমা চায়নি একবারও৷ এ ঘটনা যখন ঘটলো তখন ইমাদের বয়স আট মাস৷
তাদের সম্পর্ক শুরু থেকেই খাপছাড়া। ছন্নছাড়া। কোন কমিটমেন্ট নেই৷ ইমান প্রথম থেকেই কেমন দায়িত্বহীন৷ এজন্য হাইজ হ্যাসবেন্ড হিসেবে একমাস মিরা তার এক্টিভিটি চেক করবে। কেমন সাংসারিক সে! বাবা হওয়া সহজ কথা না। তাকে ঘর-সংসারের উপর মনোযোগী হতে হবে৷
মিরা অতীতের ভাবনা থেকে ফিরে আসলো। সে স্যুপ বাটিতে সার্ভ টিভির রুমে যেতেই হাত থেকে বাটি পড়ে গেল। ছোট্ট ইমাদ কেমন জানি করছে৷ বাচ্চার মুখ নীল হয়ে এসেছে। হাত-পা কাঁপছে ওর। মনে হচ্ছে শ্বাস নিতেও কষ্ট পাচ্ছে। সোফার এককোনায় পড়ে আছে। মিরা দৌঁড়ে গেল তার বাচ্চার কাছে। সে যেন চোখে আঁধার দেখছে।
চলবে