বঁধুয়া কেমনে বাঁধিবো হিয়া পর্ব-০৩

0
365

#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — তিন

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

-‘টোটোন, আগে হসপিটালের দিকে রওনা দে বাবা। কয়েকটা টেস্ট করাতে হবে। তোর বাবা জোর করে মিসকেরেজের ঔষধ খাইয়ে দিতে চেয়েছিল। ভাগ্যিস, ওটা গেলবার আগেই বমির সাথে বেরিয়ে এসেছে। ইমার্জেন্সি ডক্টর না দেখালে বিপদ হতে পারে!’

সেদিন গাড়িতে উঠে সংকুচিত চোখমুখ নিয়ে তীব্র পেটব্যথাকে সহ্য করে শাদাবের উদ্দেশ্যে এইটুকুই বলেছিলেন বেগম সায়রা করীম। অসহায় শাদাব মায়ের এমন অসহনীয় যন্ত্রণা দেখে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল। কী করবে, কার কাছে সাহায্য চাইবে, কোনো পথই দেখছিল না সে। পকেট হাতড়ে তখন শুধু সামান্য টাকা-ই পেয়েছিল। ওই টাকা দিয়ে কেবল যাতায়াত খরচটাই সে সামলে নিতে পারবে। কিন্তু চিকিৎসার যাবতীয় খরচ, টেস্ট, ভিজিট সবটাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। উপায় খুঁজে না পেয়ে আগে নিজের খালাকে ফোন করে সবকিছু বলল। তিনি বোনের বিপদ দেখে আধঘণ্টার মধ্যেই টাকা নিয়ে হাজির হোন। এরপর শাদাবকে অপেক্ষায় রেখে তিনি নিজেই বোনকে নিয়ে ইমার্জেন্সি ডাক্তার দেখাতে ছুটলেন। সব ধরনের টেস্ট, ও প্রয়োজনীয় ট্রিটমেন্টের জন্য দুটোদিন হসপিটালে থাকতে হয় থাকে। বোন পাশে থাকায় সেদিন তিনি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিলেন। সবচেয়ে আনন্দের সংবাদ ছিল এটাই যে, এতকিছুর পরও তাঁর শেষ বয়সের ভ্রুণটা জীবিত ও সুস্থ ছিল। কোনোপ্রকার বিপদ থাকে স্পর্শ করার আগেই করুণাময়ের দয়াতে সে বেঁচে গিয়েছিল। তবে ডাক্তার একটা সমস্যার কথা শেয়ার করেছিলেন। বলেছিলেন, সামান্য যা এ্যাফেক্ট পড়েছে তাতে পরবর্তীতে বাচ্চাটার মানসিক কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। তবে সমস্যাটা খুব বেশি গুরুতর হবে না। কেবল একটুই। জন্মের পর পর যদি পর্যাপ্ত ট্রিটমেন্ট শুরু হয়, তাহলে সমস্যাটা কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে।

যখনই চৌদ্দ বছরের ভাই শিহাবের দিকে তাকায়, তখনই স্মৃতির পাতায় কঠিন দিনের যন্ত্রণাদায়ক দৃশ্যগুলো আপনা হতেই ভেসে উঠে। প্রথম প্রথম কয়েক বছর শিহাবের গ্রোথে বেশকিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিল। অন্যান্য বাচ্চাদের তুলনায় সে কথা বলত কম, হাসত কম, মানসিক উন্নতিও ছিল কম। একটু বোকা বোকা আচরণ ছিল তারমধ্যে। কোনোকিছু বুঝালেও বুঝত দেরীতে। তবে পড়াশোনার দিক দিয়ে তার ব্রেইন ছিল অনেক বেশি ফার্স্ট। পড়তে বসলে ভালো স্টুডেন্ট হয়ে যেত। যার কারণে সায়রা করীম ছোটো ছেলেকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করতেন কম। তবে শাদাবের চিন্তা ফুরাত না। সে দিনরাত ভাইকে সময় দিত, তাকে খাওয়াত, ঘুম পাড়াত, আগলে রাখত। পরিবারের সবার সাপোর্ট ও পর্যাপ্ত ট্রিটমেন্টের জোরে সব জটিলতা কেটে গিয়েছিল তার। পুরোপুরি না কাটলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে সে। তবে এখনও মাঝেমধ্যে একটু-আধটু অবুঝপনা করে বসে। শিহাবের জন্মের সময় সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিল শাদাব নিজে। দু’হাতে ছোট্ট প্রাণকে যখন আঁকড়ে ধরেছিল, সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এই ভাইকে সে আগলে রাখবেই। আজও সে একইভাবে ভাইয়ের পাশে আছে। তাকে আঁকড়ে ধরেই আছে। ভাইয়ের সামান্য অসুস্থতাতে তার এমন অবস্থা হয়, যেন অসুস্থ শিহাব নয়, শাদাব। তার মনের ওপর দিয়ে যত ঝড়তুফান যায়, তত ঝড়তুফান তাকে ছাড়া আর কাউকে বেশি কষ্ট দেয় না।

-‘বলছি না একবার? এখন ভাত খাব না। তা-ও জোর করছ। এত খেলে মোটা হয়ে যাব না? মানুষ আমাকে মোটকু বলে ডাকবে।’

মাত্রই হসপিটাল থেকে ফিরেছে শাদাব। একটানা রোগী দেখে একটা সার্জারী শেষ করে রাত আটটার দিকে বাড়ি ফিরেছে। কাল আবার নতুন বাড়ি গোছানোর ঝামেলা। যার কারণে সারারাত ধরে সবকিছু প্যাকিং করতে হবে ঠিকমতো। বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ হবে না আজ। তা-ই হসপিটাল থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা। ঘরে পা ফেলতে দেরী হলো, ভাইয়ের পিছনে লুকিয়ে পড়তে দেরী হলো না শিহাবের। একছুটে তার পিছনে এসে কোমর জাপটে ধরে লাফঝাঁপ শুরু করল। ব্যাঙাচির মতো তার এই লাফ দেয়ার কারণ একটাই। সায়রা করীম ছুটছেন খাবারের প্লেট নিয়ে আর সে খাবে না, খাবে না বলেই জেদ ধরে বসে আছে। খাবে না মানে খাবে না। তাকে জোর করেও এখন খাওয়ানো যাবে না। অষ্টম শ্রেণীতে পড়েও এই ছেলে পাঁচ বছরের বাচ্চার মতো জেদ ধরে বসে থাকে। এতে সায়রা করীম বিরক্ত হলেও, দু’চারটে বকা দিলেও, শাদাব কখনও বিরক্ত হয় না। তার এই প্রশ্রয় পেয়েই শিহাব দিনদিন বাচ্চামো আবদার করছে বেশি। ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে মায়ের হাতের বকুনি ও মারের হাত থেকে বাঁচাতে ভাইকে আগলে ধরে দাঁড়িয়ে রইল সে। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘খামোখা জোর করছ। ছেড়ে দাও না। খেতে না চাইলে এত কেন জোর করতে হবে? এটা ব্যাড হ্যাবিট মা।’

ঠাস করে টেবিলের ওপর খাবারের প্লেট রাখলেন সায়রা করীম। দাঁত কটমট করে ছেলের দিকে তাকালেন। বললেন,
-‘টোটোন, একদম উল্টাপাল্টা বুঝাতে আসবি না। তুই এখন আমাকে হ্যাবিট শেখাবি? তোর জন্যই ও দিনদিন বাঁদর হচ্ছে। ছোটোবেলা তুই-ও এরকম করেছিস। তোর-ই ভাই তো। তা-ই তোকেই অনুসরণ করে এগোচ্ছে। মোটা হয়ে যাচ্ছি, মোটা হয়ে যাচ্ছি। কেন, একটু মোটা হলে কী ক্ষতি হয়? এই মোটার গান গাইতে গাইতে তুই তো পাটখড়ি হয়ে বসে আছিস। এখন ওকেও পাটখড়ি তৈরী কর। দুটোতে একসাথে বসে বসে দোল খা। অসহ্য।’

বকতে বকতে নিজের রুমের দিকে ছুটলেন তিনি। বয়স হয়েছে। ঝগড়া করে, চিৎকার, চেঁচামেচি করে কুলিয়ে উঠতে পারেন না। সামান্য একটু কথা বললেই হাঁপিয়ে উঠেন। তারমধ্যে অসুস্থতা তো লেগেই রয়েছে। ছেলেটাকে ডাক্তার না বানালে কী যে হোতো কে জানে! এই বয়সেই বিছানায় পড়ে থাকতেন বোধহয়। যা একটু হাঁটাচলা করেন, তা তো ট্রিটমেন্ট, ঔষধ ও সৃষ্টিকর্তার অপার দয়ায়। মাকে ক্লান্ত হয়ে ফিরে যেতে দেখে ঠোঁট চেপে হাসল শাদাব। পিছনে হাত ঘুরিয়ে ভাইকে সামনে টেনে আনল শাদাব। মাথার চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিয়ে কপালে চুমু খেল। বলল,

-‘খেতে ইচ্ছে করছে না?’

-‘সন্ধ্যায় নাশতা খেয়েছি না? এখন কী করে খাই? ভুড়ি বেড়ে যাচ্ছে দ্যাখো!’

গালমুখ ফুলিয়ে জবাব দিল শিহাব। শাদাব হেসে ফেলল। বলল,
-‘আচ্ছা। এখন খেতে হবে না। আমার কিছু কাজ আছে। ফ্রেশ হই, কাজ শেষ করি, তারপর ঠিক দশটায় ডাইনিং-এ বসব। ততক্ষণ নায়রাকে উরাধুরা নাচিয়ে এসো। ওকে?’

সাওদা করীমের দুই সন্তান। এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে নাবহান নওয়াজ ভার্সিটির লেকচারার ও মেয়ে মুনজারিন নায়রা ইন্টারমিডিয়েট পড়ছে। তাদের বাবা নওয়াজ হাসান মারা গেছেন এক বছর আগে। ভদ্রলোকের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই শাদাবের। তিনি ছিলেন বলেই আজ সে প্রতিষ্ঠিত। সেইসাথে নাবহান ও সাওদা করীমের সহযোগিতা, সাপোর্ট তো ছিলই। এই পরিবারের মানুষগুলো পাশে না দাঁড়ালে, অথৈজলে ভেসে যাওয়ার জোগাড় হতো তার। তখন না সে থাকত, না তার ভাই শিহাব বাঁচত। প্রত্যেকেই পাশে এসে ভরসা দিয়ে, আজকের এই আহমাদ শাদাবকে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছেন। এই মানুষগুলো না থাকলে সে ডাক্তার হতে পারত না, মাকে বাঁচাতে পারত না, রবের নিকট থেকে শিহাবকে উপহারও হিসেবে পেত না। এই ভাইটাই এখন তার হাসির অন্যতম মাধ্যম। সারাদিন ভাইকে কাছে পায় না বলেই, রাতটুকু জ্বালাতে আসে। ভাইয়ের পর ওই নায়রা নামক মানুষকে সে দিনরাত জ্বালায়। না জ্বালালে শান্তি-ই আসে না। সারাসন্ধ্যা পড়ালেখা করেছে তাই নায়রাকে জ্বালানোর সুযোগ পায়নি আজ। মনে পড়াতে চোখমুখে দুষ্টামির আভাস ফুটে উঠল তার। আঙুল নাড়িয়ে বলল,

-‘ইয়েস! ওকে।’

ছুটে চলে গেল শিহাব। কিছুপথ গিয়ে আবার দৌড়ে এলো। শাদাব নিজের রুমে পা রাখতে পারল না। তার শার্টের পিছনে খামচি দিয়ে ধরে উঁকি মেরে ঝটপট চুমু খেল গালে। বলল,

-‘আই লাভ য়্যু, ভাইয়া।’

বড়ো ভাইকে আর কিছু বলার সুযোগ দিল না। হাওয়ার বেগে নায়রার রুমের সামনে এসে থামল। দরজায় সমানে আঘাত করল। আগামীকাল পরীক্ষা আছে। পড়তে হবে প্রচুর। বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডা শেষ করে নায়রা সবে পড়তে বসেছে। তারমধ্যেই শিহাবের এই ধুমধাম শব্দ শোনে রুমের দরজা ফাঁক করে তাকাল সে। শিহাবকে দেখে চোখ পাকিয়ে বলল,

-‘ছোটোন! তুই দিনদিন আরও বেশি দুষ্টু হচ্ছিস। এটা কিন্তু খুব খারাপ একটা অভ্যাস।’

হাত দিয়ে তাকে ধাক্কা মারল শিহাব। দ্রুত ঢুকল রুমের ভেতরে। রগরগে মেজাজে বলল,
-‘তুমি আমাকে অভ্যাস শেখাবে না। ভাইয়ার কাজ আছে, তাই আমাকে তোমার কাছে আসতে বলেছে। আমি শুধু শুধু কারও পিছনে লাগি না।’

কপালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল নায়রা। দরজার দিকে তাকাল। শাদাবের আর নড়চড় নেই। এই ছেলেটা এমনই। নিজের ব্যক্তিগত কাজের সময়ে কাউকে ব্যাগড়া দিতে দিবে না। শিহাব একটু বেশি চঞ্চল হওয়ার কারণে সরাসরি ভাইকে বকতে পারে না, তাই হ্যান্ডেল করতে না পারলে নায়রার পিছনে লাগিয়ে দেয়। অসহায় মুখ করে শিহাবের বাঁদরামি দেখল সে। এরমধ্যেই ছেলেটা বিছানা দখল করে নিয়েছে। পায়ের ওপর পা তুলে ট্যাবে ভিডিওগেম খেলতে শুরু করেছে। সে একবার বিছানায় তাকাল, আরেকবার বইয়ের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ ভেবে একটু আহ্লাদী স্বরে বলল,

-‘যা না ভাই। তুই মায়ের কাছে যা। নয়তো ভাবীর কাছে যা। আমার আগামীকাল এ্যাক্সাম আছে। তুই বুঝছিস না। তোর পরীক্ষার সময় কেউ তোকে বিরক্ত করে?’

-‘কেউ না করলেও তুমি কোরো। তা-ই আমি এখন তোমাকে বিরক্ত করব। সহ্য করতে না পারলে রুম ছেড়ে চলে যাও। তবু বেশি বকবক কোরো না। নয়তো খালামনির কাছে গিয়ে বলব, ‘ফোনের ওপাশে দশ-বারোটা বয়ফ্রেন্ড ঝুলিয়ে রেখে গোসসা মেটাও আমার ওপর।’ তখন দ্যাখব, মোটাসোটা বেলুন চুপসে যায় কীভাবে!’

-‘এই ঘরে কি মানুষের অভাব? তুই শুধু শুধু আমার পিছনে লাগিস। তোর ভাইয়েরও খেয়েদেয়ে কাজ নেই। নিজে বাঁচতে আমার ঘাড়ে ঝামেলা দিয়ে দেয়। যা তো, সর। নয়তো আমি…!’

কথা শেষ করার আগেই বাঁশি বেজে উঠল। চেঁচিয়ে, কেঁদে ঘরশুদ্ধ মানুষকে এক করে ফেলল। শিহাবের চিৎকারে বেগম সাওদা করীম ছুটে আসলেন। রুমে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। আদরের বাচ্চাকাচ্চা চিৎকার দিয়ে ডাকলে কোনোদিকে হুঁশ থাকে না। গগনবিদারী চিৎকার সবার কানেই পৌঁছাল। রান্নাঘর থেকে খুন্তি হাতে ছুটে আসলো ইভানা। এসেই দেখল, নায়রা মাথায় হাত রেখে একাধারে বকবক করছে। বিছানায় বসে চিৎকার দিচ্ছে শিহাব। তার শাশুড়ি নাদান বাচ্চাটাকে বুঝাচ্ছেন, আদর করছেন, তা-ও শিহাবের চিৎকার থামছে না। তার উদ্দেশ্যই বুঝা যায়, সে আজ নায়রাকে ইচ্ছামতো বকা খাওয়াবে। তখন দরজায় এসে দাঁড়ালেন সায়রা করীম নিজেও। ছেলের কাণ্ড দেখে বলবেন,

-‘ঘরটা দিনদিন সার্কাসহাউজ হয়ে যাচ্ছে। ছোটোন, বাঁদরামি না থামালে পড়াশোনা বন্ধ করে দেব।’

কান্না থামিয়ে দিল সে। তবে এবার গাল ফুলাল। অভিমানী চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বুঝাল, সে ভীষণ রেগে গেছে। দুষ্টামি, বাঁদরামি বাদে পড়াশোনা তার অতি আপন বন্ধু। মা সেই বন্ধুর সাথে বিচ্ছেদ ঘটাবেন? মানবে না সে। প্রয়োজনে তৃতীয় বিশ্বযু//দ্ধ ঘোষণা করে বসবে, তা-ও পড়াশোনার সাথে বিচ্ছেদ ঘটতে দিবে না। এখন একটু-আধটু অভিমানী অভিনয় চালিয়ে যেতে পারলেই, মায়ের মত পাল্টাতে পারে। তাই গাল ফুলিয়ে বসে থাকার অভিনয় চালিয়ে গেল সে। নায়রা রিল্যাক্স হয়ে চেয়ারে বসল। আর একটু হলেই তার জান বেরিয়ে যাচ্ছিল। বাপরে বাপ। এত জোরে কেউ চেঁচায়? ধরলও না, ছুঁলোও না। তার আগেই চিৎকার দিয়ে মানুষ জড়ো করে ফেলল। একটা ভোলাভালা বাচ্চামানুষ এত ফাজিল কীভাবে হয়? এ-কে দেখলে বুঝা যাবে না, শৈশব তার কত বিপদকে কেন্দ্র করে কেটেছে। মাই গড! বাজ তার কানের পাশ দিয়ে গেছে। আরেকটু হলে মাথা ফে//টে খণ্ডখণ্ড হয়ে যেত নিশ্চিত।

-‘টুপ করে ভাবীর কাছে চলে আসো তো। এখানে সুনামি বয়ে গেলেও আর আসবে না। নায়রা পড়ুক নাহয় দশ-বারোটা বয়ফ্রেন্ড নিয়ে বসে থাকুক, আমরা ওদিকে তাকাবই না। আমাদের কাজ হচ্ছে, আগামীকালের জন্য প্রিপারেশন নেয়া। তুমি কি ভুলে গেলে, কাল তোমাদের নতুন বাড়ি যাচ্ছ?’

ইভানা তার আবদারের আরও একটা জায়গা। বকাবকি ছাড়া এই মেয়ে তাকে এত বেশি বুঝে, সামলাতে পারে, যা একমাত্র তার ভাই শাদাব পারে। এই দুটো মানুষ ছাড়া তাকে আর কেউ বুঝেই না। তা-ই ইভানা কোনো কথা সে ফেলতে পারে না। যা বলে, যা বুঝায় সবটাই মাথা নেড়ে মেনে নেয়। এখনও সবার বকাঝকার হাত থেকে বাঁচতে বিছানা ছাড়ল সে। নায়রার রুম ত্যাগ করার আগে পিছনে দাঁড়িয়ে তার চুল ধরে বার দু’য়েক ঝাঁকুনি দিয়ে দিল। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

-‘কাল চলে যাচ্ছি তো, তা-ই আজ ইচ্ছামতো জ্বালিয়ে যাব তোমাকে।’

নায়রা মারাত্মক ব্যথা পেল, কিন্তু শব্দ করল না। এখন আর বকে লাভ নেই। শুধু শুধু কেঁদে ঘর মাথায় তুলে ফেলবে। শুধু যে বাঁদর হয়েছে তা নয়, মাঝেমধ্যে তার মস্তিষ্ক তাকে যা করতে বলে সে তা-ই করে। এই ছেলেটাকে শাদাব ছাড়া আর কেউ ঠিকঠাক বুঝতে পারে না। কখন যে বেহুঁশের মতো আচরণ করে! শিহাবের এমন আচরণে একেক সময় দীর্ঘশ্বাস ফেলেন সায়রা করীম। ভাবেন, কী হোতো সেদিন যদি মিসকেরেজ হয়ে যেত! হয়তো এমন অবুঝ, অতিমাত্রার পাগলাটে স্বভাবের ছেলে জন্ম নিত না। তাকেও দুঃশ্চিন্তায় দিন কাটাতে হোতো না। তিনি যতই দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, বাড়ির সবাই বিষয়টাকে আরও সহজভাবে গ্রহণ করেন। থাক না এমন। বাচ্চা মানুষ। সুস্থ থাকলেই হোলো। একটু-আধটু দুষ্টামি না করলে, ঘর প্রাণহীন হয়ে যায়। তবে তার একটু-আধটু দুষ্টামিকে বড্ড ভয় পান সায়রা করীম। কখন কোন বিপদ আসে কে জানে!

রান্নার কাজ দ্রুতহাতে সামলে নিল ইভানা। শিহাবকে সাথে নিয়ে তার রুমে এলো। দেবরের হাতে একটা চকলেট ধরিয়ে দিয়ে লাগেজ বের করে তাতে শিহাবের প্রয়োজনীয় জিনিস ঢুকাতে বলল। বই-খাতা, যা কিছু দরকারী তা অন্য একটা লাগেজে গুছিয়ে রাখতে সাহায্য করল। শিহাব চকলেট খেতে খেতে বলল,

-‘তুমি কিন্তু রোজ আমাকে দ্যাখতে যাবে।’

-‘তাই? রোজ না গেলে হবে না?’

-‘এ্যা। না গেলে আমি মানব কেন? না খেয়ে বসে থাকব।’

-‘কেন? টোটোন আছে, ও মুখে তুলে খাইয়ে দিবে।’

-‘দূর। তোমার টোটোন সারাদিন হসপিটালে বসে থাকে। কে বলেছে, ভাইয়াকে ডাক্তার হতে? আর কিছু হতে পারল না? দিনরাত বাইরে থাকে। ঘরে যে আমি অপেক্ষায় থাকি সেটা দ্যাখেই না। কতদিন বললাম, ট্যুরে যাব, ট্যুরে যাব। ফ্রি হও। তার কাজই শেষ হয় না।’

গাল ফুলিয়ে ভাইয়ের নামে একগাদা নালিশ শোনাল শিহাব। শাদাব দরজায় দাঁড়িয়ে শুনল। ফ্রেশ হয়ে কফি খেতে এসেছিল। যন্ত্রণায় মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভাইয়ের নালিশ শোনে দাঁড়িয়ে পড়ল। শিহাব থেমে যেতেই সে ভ্রু নাচিয়ে বলল,

-‘শ্যাষ? থামলে কেন? আরও কিছু বোলো! অল্পতেই নালিশ শ্যাষ হয় বুঝি?’

শিহাব কানে তুলো গুঁজল। আর কোনো কথা-ই সে বলবে না। ভাইটা দিনদিন ব্যস্ততা বাড়াচ্ছে। দেশের বাইরে যাওয়ার সময় বলেছিল, ফিরে এসে ট্যুর দিবে। সে-ই একবার সময় পাওয়াতে দার্জিলিং নিয়ে গেল। এরপর আর তার ছুটি নেই। ডাক্তারি পেশায় ঢুকে সে রোবট হয়ে গেছে। দুই ভাইয়ের এই মান-অভিমানের পর্ব দেখে মুচকি হাসল ইভানা। শাদাবকে বলল,

-‘তোমার কিছু লাগবে?’

-‘কফি চাইতে এসেছিলাম। এতগুলো অভিযোগ শোনে, ট্যুর দিব না-কি রোগীদের পিছনে ছুটব, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেটাই ভাবছি।’

-‘তুমি ডাক্তার মানুষ। তোমার কাজ যা, তুমি তো সেটাই করবে। আমি বরং খালামনিকে বুঝিয়ে দ্যাখব, যদি ও’কে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যেতে পারেন।’

-‘মা একা সামলাতে পারবে না। নয়তো মায়ের সাথে কোথাও ঘুর‍তে পাঠিয়ে দিতাম। নায়রাও ব্যস্ত। ভাইয়াও ফ্রি হতে পারবে না। তুমি সংসার সামমাচ্ছ। কারও ছুটি নেই। ওর অভিযোগটা ভুল না ভাবী।’

বড্ড ভার শোনাল শাদাবের কথাটা। ইভানা ম্লানমুখে হাসল। বলল,
-‘এবার নিজের কথা ভাবো। বয়স থেমে আছে? এখন যদি নিজেকে নিয়ে না ভাবো, তবে কবে ভাববে?’

শাদাব কথাটা আমলেই নিল না। এড়িয়ে যাওয়ার বাহানায় বলল,
-‘কড়া করে এক কাপ ব্ল্যাক কফি দাও। নয়তো মাথা ছিঁড়ে যাবে।’

ইভানা অবুঝ? কিছুই বুঝবে না? সে শাদাবের কথার ধরন দেখেই বুঝল, বিয়েশাদী বিষয়ক কোনো আলাপেই সে যেতে চাইছে না। তাই কিছুটা শক্ত গলায় বলল,

-‘ছিঁড়ে যাক মাথা। এতেও যদি মনে হয় যে, এক কাপ কফি তৈরী করে দেয়ার জন্য ব্যক্তিগত একজন মানুষ দরকার।’

-‘খুব বেশি বিরক্ত করে ফেলি, তাই না ভাবী?’

-‘বিরক্ত নয় শাদাব। তোমার নিজেকে নিয়ে ভাবা জরুরী। এটা কি তোমাকে হাতে-কলমে বুঝিয়ে দিতে হবে এখন?’

শাদাব এবারও কথার মোড় ঘুরিয়ে দিল। বলল,
-‘পনেরো বছর! খাচ্ছি-দাচ্ছি, ঘাড়ে উঠে নাচছি। কত জ্বালিয়েছি এই ঘরের মানুষদের। কত ঋণ জমা করেছি। এসব ঋণ আমি শোধ করব কীভাবে ভাবী? সব ঋণ নাহয় শোধ করে দিলাম, টাকার বিনিময়ে। কিন্তু পাশে থাকা, ভরসা দেয়া, ভালোবাসার যে ঋণ তৈরী হয়েছে, সেটা কীভাবে শোধ করব, বোলো? মাঝেমধ্যে হাঁপিয়ে উঠি। মনে হয়, ব্রেক দরকার। একটু রিল্যাক্স হওয়া দরকার। অথচ সেই সুযোগটা আসে না।’

-‘শাদাব, ব্রেক দরকার এটা ঠিকই বুঝেছ, কিন্তু একজনকে পাশে দরকার, এটা কেন বুঝো না?’

মাথানিচু রেখে কিছু একটা ভাবল শাদাব। সামান্য হাসলও। বলল,
-‘ওসব বুঝতে গেলে ফের একটা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। আমি ঠিক আছি ভাবী। একদম ফিট ও স্ট্রং আছি। বেঁচে থাকার জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবটাই আমার কাছে আছে। তা-ই বাড়তি কাউকে প্রয়োজন নেই। একদমই নেই।’

-‘জীবনটাকে এত জটিল করে কেন ভাবো তুমি? একটু সহজ করে ভাবতে পারো না?’

জীবন সহজ? আসলেই? তবে এই সহজ জীবনে তার মা কেন এত কষ্ট পেলেন? ভয়ানক সেইসব দৃশ্য কোনোদিন ভুলবে না সে। পনেরো বছর কেটে গেছে। জীবনে সে অনেকদূর এগিয়ে এসেছে। এখন যদি পিছনের অধ্যায় নিয়ে টানাটানি করে, তাহলে খামোখাই সময় নষ্ট হবে। পিছনে যা হয়েছে, যা ঘটেছে, সবটাই ভুল। কিচ্ছু ঠিক ছিল না সেদিন। কিচ্ছু ঠিক হয়নি। কায়ছার সাহেব মানুষটাই ভুলে ভরা। তা-ই তিনি যা-ই করেন, ভুল করেন। সেসব ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে তার মা’কে। ভাইকে। আজ অবধি শিহাব জানে, বাবা নামক মানুষটা মৃত। সে পিছনের সময়টার সামনা-সামনি পড়তে চায় না। কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে চায় না। শিহাব যা জেনে বড়ো হয়েছে, সেটা জেনেই বাঁচুক। কখনও এমদাদ কায়ছার নামক এক স্বার্থপর পিতার সামনা-সামনি দাঁড়ানোর পরিস্থিতি তৈরী না হোক তার। প্রয়োজনে সে মা-ভাইকে নিয়ে আরও দূরে চলে যাবে, তবু কোনোদিন ওই কাপুরুষের মুখোমুখি হবে না। এরজন্য যদি কঠিন সত্যকেও অস্বীকার করতে হয়, তবে সে অবলীলায় তা করে যাবে। সবকিছুকে অস্বীকার করবে। সব সম্পর্ক ও বন্ধনকে। তার জীবনে শুধু মা ও ভাই আছে, এরাই থাকুক। আর কেউ না আসুক কখনও, কোনোদিন।

***

চলবে।