বঁধুয়া কেমনে বাঁধিবো হিয়া পর্ব-০৪

0
342

#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — চার

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

-‘আরেহ্, নাহার খালা। তুমি! এত রাতে? একা আসতে গেলে কেন? আমাকে ফোন করলেই পারতে। গাড়ি পাঠিয়ে দিতাম।’

দেবর-ভাবীর গুরুগম্ভীর আলাপের মাঝখানে বেজে ওঠে কলিংবেল। নাবহান আসার টাইম এটাই। য়্যু’নিভার্সিটি ছাড়াও এই ছেলেটা কয়েকটা টিউশন সামলায়। হলরুমে একগাদা ছাত্রছাত্রীদের একসাথে পড়াতে ঝামেলা, বুঝাতেও ঝামেলা হওয়ার কারণে আলাদাভাবে এই ফ্রি কোচিংয়ের দায়িত্ব নেয়া। এখানে একেক শিফটে ত্রিশ-চল্লিশ জনের মতো ছেলেমেয়েদের ক্লাস নেয় সে। তার ধারণা, সরকারি ভার্সিটি। মাসশেষে মোটা অংকের একটা অ্যামাউন্ট পাচ্ছি। তাতেই তো দিব্যি আছি, কোচিংয়ের বিনিময়ে টাকা নিব কেন? হতদরিদ্র ছেলেমেয়েদের ফ্রিতে শিক্ষাদান করাই তার মূল উদ্দেশ্য। এখানে আবার বড়োলোকের ছেলেপেলেরা আসে না। তাদের ধারণা, ফ্রিতে যেহেতু পড়ায়, ভালো পড়াবে না। বসবে, উঠবে, গল্প করবে, শেষ ক্লাস। অথচ যারা নাবহানকে কাছ থেকে চিনেছে, তারা জানে নিজের দিক থেকে কতটা সৎ ও অমায়িক এই ছেলে। এই কারণে খালাতো ভাইকে নিয়ে খুব বেশি গর্ববোধ হয় শাদাবের। মাঝেমধ্যে ভাইকে বকাবকি করে বুঝায়,

-‘সবসময় কেন পরের কথা ভাবতে হবে? নিজের ভবিষ্যৎ নেই? সবকিছু ফেলে রেখে নিজের কথা ভাবা উচিত।’

কিন্তু নাবহান ওসব কানে নেয় না। হেসে উড়িয়ে দেয়। বলে,
-‘নিজের জন্যই তো ভাবছি। আমি যাদের ভালোবাসি, যাদের জন্য ভাবি, তারাও আমায় জন্যে ভাবে। হোক না ফ্রি, তাতে কী? বিনিময়ে যে দোয়া আমি পাচ্ছি, সেটাই তো আমার ইহকাল-পরকালকে সুন্দর করে দিবে।’

এসবের পর আর বলার কিছু থাকে না। শাদাব হার মানে। থেমে যায়। হাসিমুখে আলাপ চালিয়ে যায়। কাল যেহেতু চলে যাবে, তাই আজকের রাতটাই ভাইকে খুব করে কাছে পাচ্ছে সে। এই কারণে উৎফুল্ল মেজাজেই ডোর খুলেছিল। ওপাশে নাবহানের বদলে নূরুন্ নাহারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রথমে অবাক হলো শাদাব। পরক্ষণেই হাসিমুখে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করল। তিনি অমায়িক হেসে ভেতরে পা রাখলেন। শাদাবের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

-‘খুব পেরেশান না? ঝুটঝামেলা শেষ হচ্ছে না?’

কায়ছার সাহেবের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও এই মহিলার চোখ ফাঁকি দেয়া যায়নি। প্রয়োজনীয় একটা কাজে চেনা শহরে যেতে হয়েছিল একদিন। কাজী অফিসে গিয়ে একটা কাগজ এনেছিলেন বেগম সায়রা করীম। সেদিনই রাস্তায় দেখা হয়ে যায় নূরুন্ নাহানের সাথে। দেখা মাত্রই চোখের পানি ফেলে দেন তিনি। শক্ত করে আঁকড়ে ধরেন সায়রা করীমের হাত। জানতে চান,

-‘কত্ত খুঁজেছি আপনাকে। কোত্থাও পাইনি। এখন থাকেন কোথায়? ঠিকানাটা দিয়ে যান আমায়। আমি কাউকে কিচ্ছু বলব না। সাহেবকে কোনোদিন জানতে দেব না, আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। আপনাকে ছাড়া ঘরটা পুরো ফাঁকা হয়ে গ্যাছে বেগম সাহেবা। ওই ঘরে আর ভালো লাগে না।’

সায়রা করীম লুকাতে পারেননি কিছু। সবকথা শেয়ার করেছিলেন। শিহাবের জন্ম, তার চিকিৎসা, তাদের একাকীত্বের সময়ে এগিয়ে আসা মানুষগুলোর কথা। নিজের মনের গোপন ঘরের সবটুকু যন্ত্রণা শেয়ার করেছেন। ঠিকানা দিয়েছেন। এরপর থেকেই মাসে একবার হলেও শাদাব ও শিহাবকে দেখতে এই বাড়িতে ছুটে আসেন তিনি। আসার আগে জানিয়ে আসেন। তবে আজকের আসাটা ছিল একেবারেই পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া। তাই শাদাব চমকেছে। তারপর কথা শোনেই ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে ফেলেছে। নূরুন্ নাহার এই কাজটাই বেশি করেন। এসেই বলবেন, ‘খুব পেরেশান না? ঝুটঝামেলা শেষ হচ্ছে না?’ প্রথম প্রথম অসহায়ের মতো দু’দিকে মাথা নাড়ত শাদাব। কিন্তু এখন আর তা করে না। হাসিমুখে বলে,

-‘কোথায় কী ঝামেলা? কোনো ঝামেলা-টামেলা নেই। তুমি শুধু শুধু দুঃশ্চিন্তা কোরো। আসো ভেতরে।’

এখনও ঠিক একইভাবে ঝামেলা-টামেলার গান দূরে সরিয়ে দিল শাদাব। নূরুন্ নাহার ভেতরে প্রবেশ করলেন। বললেন,

-‘বেগম সাহেবা কোথায়? জরুরী কথা ছিল। বেশিক্ষণ বসব না। আমাকে আবার রাতের মধ্যেই ফিরতে হবে।’

ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই ‘খালামনি’ বলে শিহাব এসে জাপটে ধরল তাঁকে। সে জানে, নূরুন্ নাহার তার আরও এক খালা। তা-ই খালামনি-ই ডাকে। ইনি যে তার বাবার বাড়ির পরম বিশ্বস্ত নারী, সেটা সে জানে না। তাকে বলাও হয়নি। সে খালা জেনেই খুশি হয়, খালা ডেকেই শান্তি পায়। শান্তির আশ্রয়ে মুখ গুঁজে ভাইয়ের নামে একগাদা নালিশ, আবদার শোনায়। তিনিও সবটা হাসিমুখে শোনেন। দুই ভাইকে নিয়ে সোফায় বসতেই ধীরপায়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলেন সায়রা করীম। নূরুন্ নাহারকে দেখে চমকে গিয়ে বললেন,

-‘ওকী নাহার! তুমি? একবার বলে আসবে না। কাল নতুন বাসায় যাচ্ছি। ঠিকানাটা নিও। তোমাকে বলেছিলাম, একজন বিশ্বস্ত কাজের মেয়ে এনে দিতে। পেয়েছ?’

প্রতিবারের নিয়মে প্রথমেই সায়রা করীমকে সালাম দিলেন তিনি। তারপর বললেন,
-‘নিলুফাকে বলে রেখেছি। কাল সকালবেলাই কাজের মেয়েটা পৌঁছে যাবে। আপনি বের হবেন কখন?’

সায়রা করীম সোফায় বসলেন। ইভানাকে ডেকে বললেন, শাদাবের কফি ও দু’কাপ চা একসাথে দিয়ে দেয়ার জন্য। নূরুন্ নাহারকে কিছুটা অপ্রস্তুত অবস্থায় বসে থাকতে দেখে ঘাবড়ালেন। বললেন,

-‘দুপুরের মধ্যেই চলে যাব। খরচ আছে না ওখানে? ও’কে বলে দিও, রান্নাবান্না সামলে রাখতে। এই বয়সে হেঁশেল ঠ্যালা কষ্ট হয়ে যাবে।’

নূরুন্ নাহার চিন্তিত মনেই ঘাড় কাত করে সায় জানালেন। কিছু একটা বলতে গিয়েও তিনি বার বার আটকে যাচ্ছেন। গভীরচোখে শাদাবকে খেয়াল করছেন। যা বলতে এসেছেন তা শোনে ছেলেটার রি’অ্যাক্ট কেমন হবে সেটা বুঝতে গিয়েই বেগ পেতে হচ্ছে তাকে। হাড়েহাড়ে চিনেন শাদাবকে। কখন রাগে, কখন হাসে, কখন মেজাজ দেখায় এ-ও মুখস্থ। তাই একটুবেশি-ই ভাবতে হচ্ছে তাঁকে। তাঁর এই চিন্তিত মুখ ভাবিয়ে তুলল সায়রা করীমকে। তিনি কিছুটা নরম গলায় জানতে চাইলেন,

-‘কিছু কি সমস্যা হয়েছে? তোমাকে ভীষণ চিন্তিত দ্যাখাচ্ছে নিলুফার মা।’

-‘চিন্তার কি শ্যাষ আছে বেগম সাহেবা? দিনরাত কত চিন্তায় অস্থির হয়ে সময় কাটাতে হয়, সেটা তো আমি জানি।’

-‘কী হয়েছে বোলো আমাকে?’

শিহাব তাঁর বুকের কাছে জড়িয়ে ছিল একদম। তিনি তার মাথায় চুমু খেয়ে বললেন,
-‘তুমি একটু যাবে? তোমার মায়ের সাথে জরুরী কথা আছে।’

শিহাব মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল। বলল,
-‘এক্ষুণি যাবে না। যাওয়ার আগে আমার সাথে দ্যাখা করে যাবে।’

শিহাব চলে যাওয়ার পর তিনি শাদাবকে আবার খেয়াল করলেন। সে হয়তো বুঝতে পেরেছে, তিনি ওই বাড়ির বিষয়ে জরুরী কিছু বলতে চান, তাই শিহাবকে সরিয়ে দিয়েছেন। যেন ওর কানে কোনো কথা না যায়। এই এড়িয়ে যাওয়া, লুকোচুরি বিষয়টা তিনিও জানেন। তা-ই সময়, সুযোগে স্পেসটা নেন। কনুইয়ের সাহায্যে হাঁটুতে ভর দিয়ে কিছু একটা ভাবছিল শাদাব। তার মুখ দেখে ভাবনার দৌড় বোঝা যাচ্ছে না। তবুও তিনি ভয় সরাতে পারছেন না। উশখুশ ভাব নিয়েই সায়রা করীমের হাতটা শক্ত করে ধরলেন। বললেন,

-‘দিয়া মা ক’দিনের জন্য বাড়িতে এসেছে। ও টোটোনের সাথে দ্যাখা করতে চাইছে। কিন্তু কিছু জানে না বলে, খোঁজও পাচ্ছে না। বড়ো ভাইজান তাকে কিছু বলছেনও না। আমি আপনার কাছে ওয়াদাবদ্ধ। তাই এই ঠিকানার কথা তাকে বলতে পারছি না। মেয়েটা ছটফট করছে।’

সায়রা করীমের জন্য এটা অতি সাধারণ ও খুশির একটা খবর হলেও শাদাবের জন্য বড়োসড়ো একটা ঘূর্ণঝড়ের সমান। মাহদিয়ার নামটা কানে পৌঁছা মাত্রই সোফা ছাড়ল সে। কোনো আওয়াজ ছাড়াই নিজের রুমের দিকে পা ফেলল। ইভানা তাকে ছুটে যেতে দেখে তড়িঘড়ি হাতের মাঝে গরম কপি ধরিয়ে দিল। শাদাবের চোখের দিকে তাকিয়ে ভরকে গেল। ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিল সে। শাদাব চায় না, মাহদিয়াকে ফেইস করতে। কোনোভাবেই চায় না। সেদিনের ঘটনাকে সে ভুলই জানে। কোনোদিন তা সঠিক হিসেবে মেনে নিবেও না। নীরবতা দিয়েই নিজের উত্তর বুঝিয়ে দেয়। কফির কাপ নিয়ে চলে যায় রুমে। সায়রা করীম ছেলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন,

-‘এখুনি ঠিকানা দেয়ার দরকার নেই। আমি টোটোনকে ম্যানেজ করি আগে। তারপর তোমাকে জানাব। যদি প্রয়োজন হয়, দিয়াকে আসতে বলব।’

ভারমুক্ত হলেন নূরুন্ নাহার। কিন্তু মন খচখচ ভাবটা দূরে সরাতে পারলেন না। বিয়ের দিন শাদাব বার বার বলছিল, সে বিয়েটা করবে না। বয়স কম। বুদ্ধি-বিবেচনা সবটাই কম। তখন বাল্যবিবাহ ঝামেলা না হলেও কেউ-ই বিয়ের জন্য উপযুক্ত ছিল না। যার কারণে জোরপূর্বক বেঁধে দেয়া এই সম্পর্ক তার কাছে কৈ মাছের কাঁটার মতোই অসহ্য যন্ত্রণার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মাহদিয়া নিজেও হাত-পা ছড়িয়ে কেঁদেকেটে ভাসিয়ে দিয়েছিল গাল। বয়সটা তার পুতুলখেলার। সংসার পাতার নয়। কিন্তু কেউ-ই যেন তাদের দু’জনকে বুঝতে বড্ড নারাজ ছিলেন সেদিন। এমদাদ কায়ছার তো মাহদিয়াকে কতকথা বলেকয়ে ম্যানেজ করে নিয়েছিলেন। বুঝিয়েছিলেন, সে ওই ঘরের মেয়ে। ওখানেই থাকবে চিরকাল। যেহেতু সে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে, যাওয়ার আগেই নিজেদের মধ্যে থাকা বন্ধনটাকে পাকাপোক্ত করতে অবুঝ দুটো বাচ্চাকে হ্যানত্যান বুঝিয়ে হাতকড়া পরিয়ে দেন। ভিনদেশে যাওয়ার পরও যেন সে নিজেকে এই বাড়ির একজনই ভাবতে পারে, তাই তার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন একটা দামী লকেট। সেই লকেটের মাঝখানে শাদাব ও মাহদিয়া দু’জনের হাতের ছবি বসানো। অল্প বয়সের এই বিয়ে, সেদিন দু’জনার মনে খুব বেশি প্রভাব না ফেললেও বড়ো হওয়ার পর, দু’প্রান্তের দুটো মানুষ আবিষ্কার করেছে, সম্পর্ক এভাবে গড়ে উঠে না। কাউকে চিরকাল আটকানোর জন্য বিয়েটাই গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিশেষ করে, ভরসা, বিশ্বাস, ভালোবাসা ছাড়া সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখা কঠিন। মাত্র সাতদিন একই বাড়িতে ছিল দু’জনে। খুঁনসুটি, দুষ্টামি, বাঁদরামি, ঝগড়া, একে-অন্যের চুল টানাটানি, খোঁচাখুঁচি এসবই হয়েছে বেশি। কেউ কাউকে চেনার জন্য, বুঝার জন্য পর্যাপ্ত সময়টাও পায়নি, বয়সটাও সেসব বিষয় নিয়ে ভাবাভাবির মতো এতটাও গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে ছিল না। সাতদিনের পরিচয়ের পর বিবাহ, এরপর দূরত্ব। টানা একবছর ঝগড়ুটে কিছু আলাপ, এরপর আবারও দীর্ঘ বছরের বিচ্ছেদ। সম্পর্ক যেমনই হোক। কোনো সম্পর্ককে এত দীর্ঘস্থায়ী বিচ্ছেদের মুখ দেখাতে নেই। গোড়া থেকে যে সম্পর্ক মজবুত হয়নি, তা যদি আচমকা ঝড়ে ছিঁটকে গিয়ে এলোমেলো হয়ে যায় দুটো মানুষ, তাহলে সম্পর্কটাকে কীভাবে টিকিয়ে রাখবে, কীভাবে তাকে বাঁচিয়ে রাখবে, সেই সম্পর্কে কোনো জ্ঞান ও ধারণা কিছুই নেই দু’জনের। শাদাবের মতে, ওই সম্পর্কটা ছিল তার বাবার নেয়া ভুল সিদ্ধান্তের একটা। যে ভুল সিদ্ধান্ত তিনি পনেরো বছর আগে দ্বিতীয়বার নিয়েছিলেন। নিজের স্ত্রী-সন্তানকে অস্বীকার করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেই ভুলের শাস্তি কি-না তাকে পেতে হবে! এমন শাস্তি গ্রহণ করার আগে মরে যাক সে, তবুও বিয়ে, সংসার, ভালোবাসা এসব নিয়ে আর কোনো ভাবনাকে মনে ঠাঁই দিবে না।

রুমে এসে মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল শাদাব। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। একেই তো যন্ত্রণা হচ্ছে, তারমধ্যে মাহদিয়ার আগমনী বার্তা, সবমিলিয়ে মনের ভেতর তুফান বয়ে যাওয়ার জোগাড়। তার মাথায় কেবল একটাই চিন্তা। দূরে থাকতে হবে তাকে। খুব বেশি দূরে। এতটাই দূরে যে, মাহদিয়া যেন কোনোদিনও তার নাগাল না পায়। সামনা-সামনি দেখা হওয়া তো দূর, ওর নাম, চেহারা সবকিছুকেই ভুলে যাবে সে। যা ভুল, তা ভুল-ই। এই ভুলকে সে কখনওই ঠিক বলে গ্রহণ করতে পারবে না। টেনশন দূর করতে কফিতে চুমুক দিল শাদাব। নিজের মন-মেজাজের উঠানামাকে কন্ট্রোল করতে মনের ভেতর অন্য ভাবনা বসাতে চাইল। কফি রেখে ভাবল নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো গুছিয়ে নিবে। এতে যদি মনোযোগটা অন্যদিকে আসে, মন হালকা হয়, তবে স্থির হয়ে দু’খণ্ড বসে থাকতে পারবে। কিন্তু তা আর হলো না। আলমারি থেকে কাপড়-চোপড় বের করতে গিয়েই একগাদা কাপড়ের ফাঁক থেকে হালকা গোলাপি রঙের একটা ফাইল বের হলো। ঠিক কীসের ফাইল সেটা দেখতেই কাপড়চোপড় বিছানার ওপর রেখে ফাইলটা খুলে ভেতরে থাকা কাগজ বের করল। সেই সময়ের ম্যারেজ সার্টিফিকেট, পরপর দুটো সাইন। এটা তো তার কাছে ছিল না। এখানে আসলো কী করে? মা রেখেছেন? হতেও পারে। তিনি তো মাহদিয়াকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন। ফাইলের ভেতরে থাকা পেপারে একটা ঝকঝকে, ফকফকে নাম, ইংরেজিতে লেখা। অন্যটাও ইংরেজি হলেও হাতের লেখাটা বড্ড অগোছালো, এলোমেলো। পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রীর হ্যান্ড রাইটিং আর কতটুকু স্পষ্ট হয়? তবুও ওই অস্পষ্ট দুটো নাম দেখে মেজাজের গতিবিধি পুরোটাই পরিবর্তন হয়ে গেল তার। ঠোঁটমুখ শক্ত করে ‘আহমাদ শাদাব ও মাহদিয়া আজাদ’ এতটুকু দেখে পুরো কাগজটা দু’হাত দিয়ে টেনে ছিঁড়তে চেষ্টা করল। টানটা লাগার আগেই সায়রা করীম ছেলের হাত থেকে পেপারটা কেড়ে নিলেন। মেজাজ দেখিয়ে বললেন,

-‘এটার ওপর রাগ মিটিয়ে লাভ আছে? দোষটা কি দিয়ার? যে দোষী সে শাস্তি পাক। ও কেন শাস্তি পাবে? তুই কি অবুঝ? রাগ দেখিয়ে কাগজ ছিঁড়ে ফেললে সম্পর্ক ভেঙে যায় না। মুখ দিয়ে ‘কবুল’ বলেছিলি, ভুলে গিয়েছিস সেসব কথা?’

দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে রইল শাদাব। স্মৃতিগুলো যেন আজও টনটনে ব্যথা হয়ে বুকের ভেতরটাকে ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছে। মাহদিয়া কেন আসবে দেশে? কী দরকার তার কাছে? পনেরো বছর আগে ফোনালাপ হয়েছিল তো দু’জনার। অবুঝ বয়সের একটু-আধটু কথাবার্তা। ওসবেও তো দু’জনে সবসময়ই বুঝিয়েছে সম্পর্ক নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। ওসব এতটাও গুরুত্বপূর্ণ না। সবার আগে ইম্পর্ট্যান্ট ক্যারিয়ার। মাহদিয়া তখন অবুঝ হলেও শাদাব তো ছিল যথেষ্ট ম্যাচিওরড। সে তো বুঝত, সম্পর্কের মূল্য। মায়ের কথার বিপরীতে বলার মতো কোনো শব্দ নেই তার কাছে। শুধু অতীত হাতড়ে হাতড়ে নিজের মনটাকে সামলানোর চেষ্টা করল। সায়রা করীম ছেলের মনের অবস্থা বুঝে তার পাশে বসে কাঁধে হাত রাখলেন। বললেন,

-‘একটু সময় নিয়ে ভাব। কেউ তোকে জোর করবে না। ও কেন এসেছে সেটা আগে জেনে তারপর দু’জনে মিলে সিদ্ধান্ত নে। কেউ এই বিষয়ে মাথা ঘামাবে না। কোনোপ্রকার ফোর্স করা হবে না। শুধু নিজের মন যা চাইবে তাই করবি।’

-‘ওই পেপারটা এক্ষুণি এখান থেকে নিয়ে যাও। এটা আর আমার সামনে আনবে না। কোনো সম্পর্ক নেই ওর সাথে আমার। কোনো সম্পর্ক নেই। যখন যা মন চাইল, তা-ই করলে। দূরে চলে যাওয়ার ভয়ে হাত-পা বেঁধে দিলে তোমরা। কিন্তু কারও মনের খবর জানার চেষ্টা করলে না। একটা মানুষ নিজেকে পুরোপুরি চেনবার আগে তার ঘাড়ে আরেকজনকে চেনার দায়িত্ব চাপিয়ে দিলে! এভাবে সম্পর্ক হয় মা? তুমিও তো সংসার করেছ, নিজের পছন্দ করা ছেলেকে। তবে চিরচেনা মানুষটা পালটে যায় কী করে? যাকে আমি চিনলামই না, যে আমাকে জানল না, কেউ কাউকে বুঝবার বয়সটাই তৈরী হলো না, তার আগেই ধরেবেঁধে বিয়ের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্কের সিলমোহর লাগিয়ে দিলে? এভাবে জীবন চলে মা? চালানো যায়? এরচেয়ে একা থাকাটাই কি যুক্তিযুক্ত নয়?’

অনেকদিন। দীর্ঘবছর। এতসব কথা নিজের ভেতর আটকে রাখতে রাখতে কেমন প্রাণহীন হয়ে গিয়েছে শাদাব। সে নিজেই তো নিজেকে চিনতে পারেনি, তবে মাহদিয়াকে কীভাবে চিনবে? বুঝবে? কাউকে পুরোটা না চিনে সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখা যায়? তার মা তো চিনেছিলেন। দীর্ঘবছর সংসারও করেছেন। তবে এত চেনাজানা, বোঝাপড়া থাকার পর দুটো চিরচেনা মানুষ আজ দূরে কেন? অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ কিংবা লাভ ম্যারেজ। কারও কারও সুখ বোধহয় কোনোটাতেই নেই। নয়তো সম্পর্কে এত ভালোবাসা থাকার পর, শেষ বয়সের সন্তান কেন বিচ্ছেদের কারণ হয়ে দাঁড়াল? ভালোবাসা এত ফেলনা হয়ে যায় কী করে? কী করে যেকোনো সম্পর্ক এত তুচ্ছ হয়ে যায়? আদতে এসব সম্পর্কে সঠিক কোনো উত্তর তার নিজের কাছেই নেই। যদি এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাতে মাহদিয়া দেশে এসে থাকে তবে তার দূরে থাকাই শ্রেয়। যেসব প্রশ্নের উত্তর সে জানে না, সেসব নিয়ে অন্যকে ভুল বুঝানোর মতো ইচ্ছে, আগ্রহ কোনোটাই নেই তার। এতদিন ধরে, চেপে রাখা, বলতে না পারা কথাগুলো নিজের মায়ের সামনে তুলে ধরে কিছুটা হালকা হলো শাদাব। তবে সায়রা করীম আহত চোখে ছেলের দিকে তাকালেন। নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বললেন,

-‘এই কারণে তুই আমাকে দোষী ভাবছিস?’

আঁৎকে উঠল শাদাব। মা তাকে ভুল বুঝুন এটা সে কোনোভাবেই চায় না। অসংখ্য যন্ত্রণাকে বুকে আগলে ঝটপট মাকে জড়িয়ে ধরল সে। বলল,

-‘ভুল করেও না, মা। তোমাকে ভুল বুঝব এতবড়ো স্পর্ধা আমার হয়ে যায়নি। আমি এখনও তোমাদের চারজনের সিদ্ধান্তকে মূল্যায়ন করি। কিন্তু…!’

-‘কী?’

-‘এভাবে হয় না মা। প্লিজ জোর কোরো না। আমি ওর সামনে দাঁড়াতে পারব না। কোনোদিনও না।’

-‘কেন? ও অন্যায় করেছে কিছু? তোকে অসম্মান করেছে, গালি দিয়েছে? যদি সেরকম কিছু না-ই হয়ে থাকে, তবে সামনে দাঁড়ানোর এত ভয় কীসের তোর? কাপুরষ তুই? সৎ সাহস নেই বুকে?’

-‘সম্পর্কের দোহাই দিয়ে কাউকে যদি চিরকাল বেঁধে রাখতে না-ই পারি, তবে সম্পর্কটার কী মূল্য থাকে মা? যেখানে মানুষ হয়ে যায় ছন্নছাড়া, স্বজনহারা, সেখানে সম্পর্কটা কতটুকু গ্রহণযোগ্যতা পায়, বলবে?’

সায়রা করীম হতাশ হলেন। প্রয়োজনীয় শব্দ, বাক্যের বড্ড অভাব পড়ল। তিনি চুপ হয়ে গেলেন। অতীতটাই ছেলেকে পোড়াচ্ছে বেশি। তবে সম্পর্ক নিয়ে দু’জনেরই ভাবা উচিত। একসাথে না থাকুক, বিচ্ছেদ চাইতে হলেও দু’জনের দেখা হওয়া জরুরী। রাগ করে নয়, মাথা ঠাণ্ডা রেখে শাদাবকে বোঝাবেন তিনি। আপাতত নতুন বাড়িতে যাওয়ার ঝামেলা শেষ হয়ে যাক। তারপর নূরুন্ নাহারের মাধ্যমে মাহদিয়াকে এখানে আসবার জন্য দাওয়াত রাখবেন তিনি। যা করবেন, ঠাণ্ডা মাথায় করবেন। কোনো জোরজবরদস্তি ছাড়া। নিঃশব্দে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে গেলেন তিনি। বেশ খানিকক্ষণ কেটে যাওয়ার পর স্বাভাবিক হলো শাদাব। সোজা হয়ে বসে অপরাধী গলায় বলল,

-‘খুব দুঃখিত মা। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। চাই না ছোটোন বাবা সম্পর্কে নেগেটিভ কিছু জানুক। এত বছর ধরে, ওর থেকে বাবাকে হাইড করে রেখেছি আমরা, প্রয়োজনে বাকিজীবন রাখব। তবু কোনোদিন ও জানবে না, আমাদের বাবা আট-দশজন সাধারণ বাবার মতো এতটা উদার মানসিকতার নন। বরং, তিনি একজন স্বার্থপর মানুষ। যার কাছে স্ত্রী-সন্তানের চেয়ে নিজের সম্মানটাই বেশি মূল্যবান!’

***

চলবে…