বঁধুয়া কেমনে বাঁধিবো হিয়া পর্ব-০৫

0
328

#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — পাঁচ

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

-‘দিয়া, ওঠ। এত বেলা অবধি কেউ ঘুমোয়? সারারাত জেগে জেগে কোন গোয়ালের গোরু পাহারা দিয়েছিস? একটু পর আমি রওনা দিচ্ছি। ওঠে নাশতা শেষ করে আমাকে বিদায় দে। তোকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে কীভাবে যাই! ওঠ না মা। দেরী হচ্ছে তো আমার।’

গোলায়ের গোরু নয়, সারারাত শাদাবের রুম তন্নতন্ন করে খুঁজেও কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা সে হাতের নাগালে পায়নি। তার ধারণা ছিল, ওখানেই থাকবে। থাকার কথা। কিন্তু ছিল না। উলটে পুরো আলমারি জুড়ে শাদাবের কৈশোর বয়সের প্যান্ট-শার্ট থরে থরে সাজানো ছিল। সবগুলো কাপড়চোপড় কেমন জমাট বেঁধে গিয়েছিল। দীর্ঘদিন একইভাবে থাকায় কেমন একটা গন্ধ বেরোচ্ছিল। সেসব গন্ধকে উপেক্ষা করেও ধৈর্য্য নিয়ে খুঁজেছে, তবুও পায়নি। ঘরে একগাদা পুরনো কাপড়চোপড় অথচ যার জিনিস, সে-ই নেই। খুঁজতে খুঁজতে সে শুধু পুরনো এ্যালবাম পেয়েছে। সেই এ্যালবামটাই নিজের কাছে এনে প্রত্যেকটা ছবি দেখেছে। পুরো এ্যালবাম জুড়ে ঘরভরা মানুষের কত-শত ছবি। তাদের দু’জনার বিয়ের ছবি। কী অদ্ভুত! উপযুক্ত হওয়ার আগেই দুটো মানুষকে একই সুত্রে বেঁধে দিয়েছিলেন সবাই, অথচ উপযুক্ত হওয়ার পর বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। যদি আলাদা করাটাই উদ্দেশ্য ছিল, তবে এক করতে চেয়েছিলেন কেন? পুরো রাতজুড়ে অতীতের দিনগুলোকে হাতড়ে বেরিয়েছে মাহদিয়া। স্মৃতিতে সব ছিল। হাসি, আনন্দ, সুখ। এখন এসব কিছুই নেই। মানুষগুলোই তো নেই। সুখ থাকবে কোথা থেকে? মায়ের ডাক শুনলেও বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে হলো না মাহদিয়ার। এ্যালবামের ওপরেই মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে আছে সে। এলোমেলো কোঁকড়ানো চুলগুলো সারাপিঠে ছড়িয়ে পড়েছে। চুলের ফাঁকেই হাত নাড়াচ্ছেন শায়লা সুলতানা। আদুরে স্বরে মেয়েকে ডাকছেন। মাহদিয়া সাড়া দিচ্ছে না। ইচ্ছে করেই দিচ্ছে না। মায়ের ডাক সে শুনতে পাচ্ছে, কিন্তু অতীতের টুকরো টুকরো স্মৃতি তার পিছু ছাড়ছে না। সে এখনও টের পাচ্ছে, তার কোঁকড়ানো চুলগুলো কেউ টেনে টেনে ছিঁড়ছে। বার বার বলছে,

-‘মাথায় কেউ পাখির বাসা বানায়? এখানে তো বাবুইপাখি বাসা বাঁধবে এসে। ভ্রমর, তুমি ওড়াউড়ি করো অসুবিধা নেই। কিন্তু তোমার চুলগুলোকে পরিপাটি করে রাখো। কেমন ফুলে থাকে সারাক্ষণ। দ্যাখতে বড্ড বিশ্রী লাগে।’

উত্তরে গাল ফুলাত মাহদিয়া। রাগী চোখে তাকাত। তার চুল পাখির বাসা হোক অন্যকিছু, তা নিয়ে অন্যকারও মাথাব্যথা হবে কেন? সে নিজের চুল নিয়ে খুশি আছে, আনন্দে আছে, এটাই তো শান্তির। শাদাবের এসব কথা তার মোটেও পছন্দ হোতো না। সে-ও রাগ দেখিয়ে বলত,

-‘তুমি আমাকে একদম ভ্রমর ডাকবে না। আমি মানুষ, ভ্রমর নই।’

-‘তুমি ভ্রমরই। তোমার বেশভূষাতে তোমাকে মানুষ মনে হয় না। মানুষেরা পরিপাটি থাকে। এলোমেলো কোঁকড়ানো চুলে থাকে না। ফুলের মধু সংগ্রহ করতে কারও সাজানো-গোছানো যত্নেগড়া ফুলের গাছ ভেঙে দেয় না।’

শাদাবের কণ্ঠ সেদিন বড্ড করুণ ছিল। মায়ের ফুলগাছ ভাঙাতে সে কষ্ট পেয়েছে। তাই শাস্তি দিতে মাহদিয়ার চুল ধরে টানছে। মেয়েটা চুলে ব্যথা পাচ্ছে, তা-ও ছাড়তে নারাজ শাদাব। উল্টে কোঁকড়াচুলের কাঁকড়া ক্লিপগুলো টেনে টেনে খুলে ফেলছে। তার এই কাজে মাহদিয়া ভীষণ ক্ষ্যাপে গিয়েছিল। মাথা নুইয়ে খেলছিল সে। চুলে ব্যথা পাওয়াতে খেলনাবাটির একটা খেলনা তার মুখের ওপর ছুঁড়ে মারল। বলল,

-‘একদম চুল টানাটানি করবে না। আমি মামিকে বলে দেব।’

সায়রা করীমকে সে মামি-ই ডাকত। কিন্তু এবার দেশে ফিরেই আন্টি ডাকছে। এখনও সে ডাক নিয়ে কনফিউজড। তাই কী বলে সম্বোধন করা উচিত ভেবে না পেয়েই আন্টি ডেকে এমদাদ কায়ছারের কাছ থেকে জবাবদিহি চাইছিল। তিনি তো কিছু বললেন-ই না। উল্টে গোলকধাঁধায় ছেড়ে দিলেন। মাহদিয়ার মুখে অমন অভিযোগের কথা শোনে শাদাব বলেছিল,

-‘আমিও বলব তুমি ফুলের গাছ ভেঙেছ।’

-‘আমি ইচ্ছে করে ভাঙিনি। প্রজাপতি ধরতে গিয়েই বেখেয়ালিতে পা পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে।’

-‘এজন্যই তো বলি, তুমি মানুষ নও। মানুষ হলে এই ভুল করতে না। তুমি হচ্ছ ভ্রমর। তোমার কাজই ফুলগাছ নষ্ট করা। আমি তোমাকে ভ্রমর বলেই ডাকব।’

মাহদিয়ার রাগ বাড়ল। সে ফুলেফেঁপে গর্জে উঠল। বলল,

-‘তোমার পেটটাও দিনদিন পানির টাংকি হয়ে যাচ্ছে। মোটকু। তুলোর বস্তা। আর একবার আমাকে ভ্রমর বললে, সুঁই এনে পেট ফুটো করে দেব একদম।’

-‘কী বললে তুমি? আমার মতো একটা গুলুমুলু নাদুস-নুদুস চেহারার মানুষের সাথে এরূপ বিচ্ছিরি কাজ তুমি কেন করবে? আমি কি তোমার শত্রু?’

-‘আমি কি তোমার শত্রু? তুমি আমার চুল নিয়ে বকাবকি কোরো কেন? কেন আমি মানুষ হওয়ার সত্ত্বেও ভ্রমর বলে ডাকছ। থাকুক আমার চুল পাখির বাসা, ওখানে পাখিকেই জায়গা দেব। তোমার কেন এত সমস্যা হবে?’

এইটুকুনি একটা মেয়ে তাকে কথা শোনাচ্ছে। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিল। একেই তো বাগানের ফুলগাছ ভেঙেছে, আবার কাদামাটিতে মাখামাখি করার জন্য মার বকা সব খাইয়েছে। এখন আবার স্বাস্থ্য নিয়ে খোঁচাখুঁচি করছে। কী পাজি এই মেয়ে! ভাবতেই রাগ তার শিরায় শিরায় বেড়ে উঠল। সে-ও বিদ্রুপ কণ্ঠে বলল,

-‘তোমাকে দ্যাখতে বিশ্রী লাগে। একদম পেত্নীর মতো। চুলগুলো স্ট্রেইট করে রাখলে দ্যাখতে এতটাও বিশ্রী লাগত না। তুমি নিজেকে যতটা সুন্দরী ভাবো, আসলে তুমি তার এক’আনাও সুন্দর না। তুমি একটা জংলী ভূত।’

-‘তুমিও স্বাস্থ্যটা কমালে, তোমাকে এত মোটকু লাগত না। দিনরাত খাই খাই। খাওয়া কমাতে পারো না? তোমাকেও তো দ্যাখতে বিচ্ছিরি লাগে। আগে নিজের দিক দ্যাখো, পরে এসে আমার চুল নিয়ে গবেষণা কোরো। খেয়েদেয়ে কাজ পায় না তো। আমার পিছনে লাগতে আসছে। মোটকু কোথাকার।’

শাদাবের সহ্য হলো না। সবাই তার স্বাস্থ্য নিয়ে খোঁচাখুঁচি করে। হোলো সে একটু মোটা, মানুষের কী? তার মিষ্টিজাতীয় খাবার খেতে ভালো লাগে। এসব অতিরিক্ত খাওয়ার ফলেই সে ফ্যাটি হয়ে গেছে। তবুও খাবারের লোভ সামলাতে পারত না। লিমিট মেপে খেতে চাইলে দেখা গেল, পেটে ক্ষিধে থেকে যাচ্ছে। তাই সময়ে, অসময়ে মুখে আর খাবারে লাগিয়ে রাগত সে। নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে, খাওয়া নিয়ে এসব কথা সহ্য করতে পারল না, দাঁত কটমট করে ছোট্ট মাহদিয়ার দিকে তাকাল একবার। মেয়েটা বকেটকে আবার একমনে খেলনাবাটি দিয়ে খেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। শাদাবের মাথায় দুষ্টুমি চাপল। সে সমস্ত খেলনাবাটি পা দিয়ে চ্যাপ্টা করে দিয়ে দৌড় দিল। মাহদিয়া প্রথমে হতভম্ব হয়ে তাকাল, পরক্ষণেই গলা ফাটিয়ে কান্না জুড়ে দিল। ব্যস, সেদিনও শাদাবের পিঠে মায়ের ধুমধাম শাসন, বকা পড়ল। একগাদা বকা খেয়েও পিছু হটতে নারাজ সে। কেউ তার স্বাস্থ্য নিয়ে খোটা দিবে কেন? খাবার নিয়ে বকাবকি করবে কেন? তার পেটে ক্ষিধে থেকে যায়, এটা কি তার নিজের দোষ?

-‘দিয়া ওঠ। আর কতক্ষণ ঘুমাবি?’

ওহহো! চমৎকার স্মৃতিতে বাঁধা পড়ল। মাহদিয়া বারকয়েক হাই তুলে সোজা হয়ে বসল। মায়ের দিকে হাসিমুখে তাকাল। বলল,

-‘গুড মর্নিং মা।’

-‘এতবেলা অবধি ঘুমোচ্ছিস কেন? শরীর খারাপ?’

মেয়ের মুখের ভাবভঙ্গি ভালোমতো খেয়াল করলেন শায়লা সুলতানা। মাহদিয়া দু’দিকে মাথা নেড়ে সবটা স্বাভাবিক বুঝাল। পরমুহূর্তেই এ্যালবামের দিকে তাকিয়ে ভাবুক নয়নে মায়ের কাছে জানতে চাইল,

-‘টোটোন কি আগের মতো আছে মা? পালটে যায়নি তো? চিনব কী করে আমি? কোথায় খুঁজব দুটো মানুষকে?’

শায়লা সুলতানা অসহায় চোখে মেয়েকে দেখলেন। ভাবেননি জীবনের সব তাল, সব সুর এইভাবে কেটে যাবে। কী চমৎকার মুহূর্ত ছিল এই বাড়ির সবাইকে ঘিরে! আজ যেন সবটাই একটা দুঃস্বপ্ন! কেন যে সেদিন শাদাবের হাতে মাহদিয়ার হাত বেঁধে দিলেন! যদি না দিতেন, তবে আজ এই দিনের মুখোমুখি দাঁড়াতে হোতো না। আফসোসও জন্মাত না মনে। ভালো পাত্র দেখে ইতালিতেই মেয়েকে সেটেল্ড করে দিতে পারতেন। সামান্য একটুকরো কাগজ, ছোট্ট একটা সিগনেচার, বয়স অল্প হোক বেশি, বৈবাহিক সম্পর্কের সেই সিলমোহরটা দিনরাত অবুঝ মেয়েটাকে পোড়ায়। নিজেকে নিয়ে কোনোকিছু ভাবতেই পারে না সে। কাউকে ভালোবাসতেও পারে না, কারও ভালোবাসা গ্রহণ করতেও পারে না। কোনো প্রস্তাব আসলেই ফিরিয়ে দিতে হয়, ‘স্যরি! আ’ম অ্যানগেজড’ এইটুকু বলে। যার সাথে বাঁধা পড়েছে, তার সাথে সম্পর্ক তৈরী না হলেও এই ছোট্ট একটা বাক্য দিয়ে মাহদিয়া নিজের জীবনের সবসুখকে তুচ্ছ করে দিচ্ছে। তিনি মা হয়ে স্পষ্ট দেখতে পান, মেয়ের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। উত্তর খুঁজেন। পান না। দিশেহারা লাগে তার। মেয়ের জন্য বুক কাঁপে। মন পুড়ে। হতাশার সাগরে তলিয়ে যেতে যেতে একটুকরো আশার আলো খুঁজে পেতে চান। তা-ও হয় না। মনের ভেতর চাপা ব্যথা নিয়ে বলেন,

-‘কেন ভাবছিস এসব? তুই নিজেকে নিয়ে ভাব না মা। এভাবে ওদের খোঁজ পাওয়া অসম্ভব। ভুলে যা ওসব দিনের কথা।’

-‘ভুলতে গ্যালেও টোটোনকে আমার দরকার মা। বুঝাতে পারব না তোমায়। ওটা শুধু একটা সিলমোহর ছিল, না-কি অন্যকিছু? এইটুকু না জেনে আমি সম্পর্কটাকে তুচ্ছ ভাবতে পারছি না মা। আইন, আদালতের কাছে তখন ওই বিয়েটা বাধা না হলেও এইযুগে এটা বিরাট বাঁধা। আমি ম্যারেজ সার্টিফিকেট খুঁজছিলাম। কিন্তু পাইনি। ওটা কি তৈরী হয়নি? সেদিনের সেই কাজী সাহেবের নাম-ঠিকানা আছে তোমার কাছে?’

শায়লা সুলতানা বড্ড অস্বস্তিতে পড়লেন। কত বছর আগের ঘটনা, সব কি আর মনে থাকে? সেদিন কোন কাজী, কোথাকার কাজী এসেছিলেন সেটাও তো তিনি জানতেন না। সবকিছুর আয়োজন তো এমদাদ কায়ছার নিজ হাতে করেছিলেন। কাজী সাহেবের খবর একমাত্র তিনি-ই জানেন। জানা নেই বিধায়, মেয়েকে কিছু বলতে পারলেন না তিনি। শুধু অসহায়ের মতো তাকিয়ে বললেন,

-‘তোর মামার কাছে প্রশ্নটা রেখে দ্যাখতে পারিস। সেদিন বিয়ে কমপ্লিটের পর ম্যারেজ সার্টিফিকেট তোলা হয়েছিল কি-না সেসব তিনি-ই ভালো জানবেন।’

***

নতুন বাড়িতে যাওয়ার জন্য ভীষণ এ্যাক্সাইটেড শিহাব। এতদিন ধরে, এতগুলো বছর ধরে খালার বাড়িতে ছিল। মাঝে মাঝে সে ভাবত, তাদের নিজের বাড়ি নেই কেন? তারা অন্যের বাড়িতে থাকে কেন? তার বাবা কোথায়? তিনি মারা গেলে তার কবর আশেপাশে নেই কেন? কেন কোনোদিন বাবার কবরের কাছে যেতে পারেনি সে? মাঝেমধ্যে কত-শত ভাবনা মনে উদয় হোতো, ভাইকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েও সাহসে কুলোতে না। শুধু দেখত, বাবার প্রসঙ্গ আসলেই শাদাব সেটা ইগনোর করে। তবে এই ইগনোরের কারণ সে বুঝে না। এখনও বুঝতে পারেনি। মনে আজ আনন্দ তার, সুখও। নিজেদের একটা বাড়ি গড়ে উঠতে উঠতে এতগুলো বছর লাগল। শাদাব মেডিকেল অ্যাডমিশন নিল। ভালো রেজাল্ট করল। এমবিবিএস শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য কানাডায় গেল। সেখান থেকে ফিরে আসলো স্কিন স্পেশালিষ্ট সার্জন হয়ে। চর্ম, এলার্জি ও কসমেটিক সার্জন হওয়ার পর, উপশহরের বড়ো হসপিটালের দায়িত্বে জয়েন করল সে। সপ্তাহে ছয়দিন রোগীদের সময় দেয়, আর একদিন আসে শ্রীমঙ্গলে। প্রতি শুক্রবার। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পরপরই মায়ের নামে জায়গা কিনেছিল। মাকে কথা দিয়েছিল, সাজানো-গোছানো একটা বাড়ি তাকে উপহার দিবে। সেই বাড়িটা তৈরী হতে দীর্ঘ ছ’মাস লাগল। বাড়ির কাজ কমপ্লিট হওয়ার পর সামনের দিকে অনেকগুলো ফুলের গাছ লাগিয়েছে সে। যা শুধু তার মায়ের জন্য। মায়ের চোখেমুখে সুখ দেখার জন্য। আজ সেই কাঙ্ক্ষিত জায়গায় যাওয়ার দিন। তাই শিহাবের পাশাপাশি শাদাব নিজেও কিছুটা এ্যাক্সাইটেড। বাড়িটা মায়ের পছন্দ হবে তো? এই একটা কথাই ভেবে, ভেবে অস্থির হয়ে যাচ্ছে সে। তাছাড়া আজ শুক্রবার। বাড়িতে পৌঁছে তাকে আবার রওনা দিতে হবে উল্টোপথে। নয়তো, রোগীদের সিরিয়াল লেগে যাবে যে!

আসবাবপত্র কিনে বাড়িটা পুরোপুরি সাজিয়ে নিয়েছে শাদাব। আজ শুধু তাতে পা রাখার বন্দোবস্ত হবে। তাই নিজেদের লাগেজ প্যাক শেষে সবার থেকে বিদায় নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। নায়রা ভার্সিটিতে থাকায় তার থেকে বিদায় নেয়া হলো না। অবশ্য সকালে তাকে বলেছিল, ‘তুই যখনই সময় পাবি, মাকে দ্যাখতে যাবি।’ নায়রা মাথা দুলিয়ে সায় দিয়ে কলেজে দৌড় দিয়েছে। সবকিছু চেক করে গাড়িতে ঢুকিয়ে নিজের খালা ও মামা সোহরাব বিন ফজলে করীমের সামনে আসলো শাদাব। সায়রা করীম নিজের আপন ভাইকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। যে ভাই একদিন তার মায়ের ভালোবাসার সম্পর্ক মেনে নেননি, কোনোদিন তাকে বাড়িতে উঠতে দেননি, সেই ভাই-ই বোনকে বিপদে দেখে এগিয়ে এসেছিলেন। বোনকে অসহায় অবস্থায় দেখে তিনি তো কায়ছার সাহেবের ওপর মারাত্মক রেগে গিয়েছিলেন। চিৎকার করে বলেছিলেন,

-‘ওই অসভ্যটাকে আমি খু ন করে ফেলব। আমার বোনের গায়ে হাত তোলার সাহস পায় কোথায় ও? বাবা-মা কেউ নেই দ্যাখে সাহস বেড়ে গেছে। অ মানুষ, জানো য়ার। শুধু নিজের স্বার্থের কথাই ভাবল। মাছুম বাচ্চাটার কথা ভাবল না। এমন জানো য়ারের জন্য ঘর ছেড়েছিলি তুই?’

শাদাব দাঁড়িয়ে থেকে সব শুনেছিল। বলতে পারছিল না, ‘বাবাকে বকো না।’ উলটে তার ভেতরেও রাগ বাসা বেঁধেছিল। বাবার ওপর একটু একটু করে ঘৃণা জন্মাচ্ছিল। সেই ঘৃণার মাত্রা এখন এক পৃথিবী সমান ওজনের হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওজনটা যে বড্ড ভারী, সহ্য করার মতো ধৈর্য্যশক্তি তার নেই। যখনই মনে পড়ে, গর্ভবতী মায়ের যন্ত্রণায় কাতরানো সেই দৃশ্য, আহাজারি ও আর্তনাদ তখনই বাবা নামক মানুষটার প্রতি তীব্র রাগ, ঘৃণা জমে দুটো চোখকে নোনাজলে ভাসিয়ে দেয়। আজও মায়ের চোখের পানি তাকে কাঁদাল। ভাই-বোনের এমন অশ্রুমাখা আবেগী দৃশ্য দেখে আলগোছে কিছুটা সরে দাঁড়াল। ইভানা তার ভেতরের কষ্টটা হয়তো উপলব্ধি করল। পাশে এসে ভরসা দিয়ে বলল,

-‘চিন্তা কোরো না। আমি মাকে নিয়ে প্রতি সপ্তাহে একবার যাব। নায়রাও সময় পেলে যাবে। দূরে গেলেও তোমরা কেউ-ই একা নও, এটা মনে রেখো। আমরা সবাই, সবসময় পাশে আছি, থাকব।’

শাদাব নীরবে মাথা নাড়ল। পকেট থেকে একটা চেক বের করে ইভানার হাতে ধরিয়ে দিল। বলল,
-‘এটা খালামনির হাতে দেয়ার সাহস আমার নেই। দিলেও তিনি নিবেন না। অ্যামাউন্ট যতই হোক, এটা রেখে দাও। একসময় কাজে লাগবে। ভেবো না, ঋণ শোধ করছি। আমি যে ঋণ তৈরী করেছি, তা এই জন্মে শোধ করে দেয়া সম্ভব নয়। পারবও না। আমি সেসব ঋণ শোধ করতে চাইছিও না। কিছু ঋণ থাকা ভালো। এর বোঝা বইতেও অনেক আনন্দ লাগে। আমি এই আনন্দটুকু হারাতে চাই না, শুধু চাই খালামনির পাশে থাকতে। আগে খালু ছিলেন, তাই সাপোর্ট ছিল বেশি। এখন ভাইয়ার একার ওপর চাপ যাচ্ছে। যদিও ভাইয়া মুখে এসব স্বীকার করে না, কিন্তু তার মুখ দ্যাখলে বুঝতে পারি। তুমি এক্ষুণি এটার কথা বলবে না। বললে, কলার ধরে টান মারবে। জানোই তো, এরকম একটা বাজে অভ্যাস আছে ভাইয়ার। মার খাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখো। যখনই টাকাটার প্রয়োজন হবে, হাতে দিবে। বলবে, টোটোন রেখে গেছে।’

নাবহানের টাকার দরকার, কিন্তু সে মায়ের কাছেও চায়নি। তার বাবা একজন ব্যাংকার ছিলেন। পরিবারে অভাব-অনটন ছিল না। এখনও যেমন চলছে ভালোই, কিন্তু তবুও মাসশেষে কিছু কিছু ঋণ হয়ে যাচ্ছে। শাদাব চাইলেও সংসারের পিছনে খরচ করতে পারত না। এখনও পারে না। সাওদা করীম বার বার বলতেন,

-‘তোকে কোনো দায়িত্ব নিতে হবে না। তুই তোর মা-ভাইকে নিয়ে ভাব। সংসার সামলানোর জন্য খোকা আছে। ও পারবে সব গুছিয়ে নিতে।’

নাবহান সবটাই গুছিয়ে নিচ্ছিল। কিন্তু বেশ কয়েক মাস আগে সাওদা করীমের একটা সার্জারীর জন্য তাকে অনেক ঋণের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে। আড়ালে-আবডালে সেই ঋণের খোঁজ রাখছিল শাদাব। সামনা-সামনি যতই টাকা দিয়ে সাহায্য করতে যাবে, নাবহান ত্যাড়াব্যাকা আচরণ করবেন। একদিন কলার ধরে টানও মেরেছিল। বলেছিল,

-‘বড়ো হয়ে গেছিস না? খুব বড়ো হয়ে গেছিস? টাকা হয়ে গেছে এখন? তাই বড়ো ভাইয়ের ওপর ভরসা করতে পারছিস না?’

এতসব কথার পর আর কিছু বলতে পারত না শাদাব। ঘাড় কাত করে শুধু সব শুনত। সময় গুনত। কবে আসবে কাঙ্ক্ষিত দিন? যেদিন এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে পারবে! ঋণের বোঝা একটু হলেও হালকা করতে পারবে। কিন্তু বিধাতা বোধহয় চান না, এই ঋণ শোধ হোক। তাই কাঙ্ক্ষিত সময়টাও আর আসে না। অপেক্ষাও ফুরোয় না। আজ যাওয়ার বেলা এইটুকু হাত না বাড়ালেই যেন নয়! তাই ভাইয়ের চোখের আড়ালেই ইভানার হাতে চেকটা ধরিয়ে দিল সে। প্রতুত্তরে ইভানা বলল,

-‘অসম্ভব। এটা আমি রাখব না। পারলে তোমার ভাইয়ের হাতে দাও।’

-‘ভাবী প্লিজ। রাখো এটা। জানোই তো, ভাইয়ার হাতে দিলে বকাঝকা শুরু করবে। আমি বলছি তো, এটা কোনো শোধবোধ না। শুধু আমার দায়িত্বটুকু পালন করছি। আমাকে এইটুকু থেকে বঞ্চিত কোরো না। আমি ওখানে দু’দণ্ড বসতে পারব না। বার বার মনে হবে, কেন কিছু করতে পারলাম না? এত বড়ো ব্যর্থতা আমার নামের সাথে জড়িয়ে যেতে দিও না। যাদের জন্য আজকের এই আমি, তাদের জন্য কিছু করতে না পারায় যন্ত্রণায় সারাজীবন পুড়ব। তুমি কি চাও বিবেকের কাঠগড়ায় আমি যাবজ্জীবনের কারাদণ্ড নিয়ে বাঁচি?’

ইভানা আর কিছু বলল না। পরিস্থিতি সবসময় ভালো যায় না। থাক না এই টাকা। কাজে আসবে একদিন। বিপদ তো সবারই হয়। কখন কোনদিক দিয়ে আসে মানুষ কি তা আগে থেকে বুঝতে পারে? পূর্বপ্রস্তুতি থাকলে যেকোনো বিপদ কুলিয়ে ওঠা সম্ভব। ওসব ভেবেই শাদাব চেকটা বাড়িয়েছে এটা বুঝতে পেরেই দেবরের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল মন। তবু সে শাদাবকে একটু জ্বালাতে বলল,

-‘এটা আমাদেরকে না দিয়ে নিজের কাছের কাউকে দিতে, ভালো হোতো।’

-‘তোমরাই আমার আপন, তোমরাই আমার কাছের।’

-‘আমি আমাদের কথা বলিনি। অন্য একজনের কথা বলেছি।’

শাদাব চোখ তুলে তাকাল। ইভানার চোখের ইশারাই এবার বুঝিয়ে দিল, সে মাহদিয়ার দিক ইঙ্গিত করেছে। বড্ড মন খারাপ হলো তার। অসহায় মুখ নিয়ে বলল,

-‘টাকাটা ফিরিয়ে দিতে চাও, দাও। অনর্থক ঝামেলা টেনে আনছ কেন?’

-‘সম্পর্কটা অনর্থক ঝামেলা?’

-‘অবশ্যই।’

শক্তমেজাজে বলল শাদাব। ইভানা মুচকি হাসল। বলল,

-‘সব সম্পর্কই দামী। যথাসময়ে যদি তাকে মূল্য দিয়ে আগলে রাখতে না পারো, তখন সেটা অনর্থক সম্পর্ক মনে হবেই। আমার বিশ্বাস, তুমি যেকোনো সম্পর্ককে মূল্যবান ভাব।’

-‘সম্পর্ক, মানুষ সবই মূল্যবান। কিন্তু কোনো নিকৃষ্ট ব্যক্তি যখন সাতরাজার ধন হাতে পেয়ে যায়, তখন সে নিজের ক্ষমতা জাহির করতে কিছু অযৌক্তিক চিন্তাভাবনা সাজিয়ে যেকোনো সম্পর্ককে গোড়া থেকে নড়বড়ে করে দেয়। এমদাদ কায়ছারও সেটাই করেছিলেন। নিজের ক্ষমতা ও ইচ্ছার প্রকাশ ঘটাতে, অবুঝ দুটো বাচ্চার ঘাড়ের সম্পর্কের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছেন। এই সম্পর্কটা আমার কাছে সবসময়ই অনর্থক।’

-‘দিয়ার ওপর রাগ দ্যাখাচ্ছ কেন? ওর তো দোষ নেই। ও’কেই বা বোঝা কেন ভাবছ? স্রষ্টা হয়তো চান, তোমাদের দ্যাখা হোক। তোমরা এক হও।’

-‘আমি ও’কে কখনওই বোঝা ভাবি না। কিন্তু আমি চাই না এই সম্পর্কের সুতোয় আটকে থাকা দুটো মানুষের কোনোদিন আর দেখা-সাক্ষাৎ হোক। যে সম্পর্কটা কোনো পাকাপোক্ত খুটি ছাড়া তৈরী হয়েছে, তাকে সারাজীবন কীভাবে আটকে রাখি বোলো তো? নাম লিখলাম, কবুল বললাম, হয়ে গেলাম স্বামী-স্ত্রী? সম্পর্কের ভিত্তি কি এ-ই? আর কিছু নেই? না বয়স হলো, আর না হলো জ্ঞান! যদি ওই মানুষটা সম্পর্কটাকে মূল্যায়ন করতে জানতেন, তবে সেদিন অবুঝ দুটো বাচ্চাকে এইভাবে বেঁধে দিতেন না। নিজের স্ত্রীকে তাড়িয়ে দেয়ার মতো দুঃসাহস দ্যাখাতেন না। উনি আসলে সম্পর্ক কী, তা কেমন, কীভাবে আগলে রাখতে হয়, এসব কিছুই জানেন না। জানেন শুধু নিরীহ মানুষের ওপর অন্যায়-অত্যাচার করতে।’

-‘আংকেলের ওপর রাগ জমিয়ে রেখেছ, রাখো। কিন্তু দিয়ার সাথে একবার দ্যাখা কোরো। জানতে চাও, ও কেন এসেছে! কী চায়! সম্পর্ক জুড়তে চায়, না-কি ভাঙতে চায়? প্রশ্ন কোরো। হ্যাঁ দু’জনেই অবুঝ ছিলে। কিন্তু এখন তো ম্যাচিউর হয়েছ। এখন ভেবে সিদ্ধান্ত নাও। একসাথে থাকতে চাও, না-কি আলাদা হতে চাও? যা-ই কোরো, সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য ওর সাথে দ্যাখা করা উচিত তোমার। নয়তো সারাজীবন মেয়েটার কাছে অপরাধী হয়ে থাকবে। ও কিন্তু তোমার সাথে দ্যাখা করতেই এসেছে। কোনো রাগ, অভিযোগ, ক্ষোভ থেকে ওর ওপর অবিচার কোরো না। ও একটা মেয়ে! ওর অবস্থাটা বোঝো।’

একটা শব্দও উচ্চারণ করল না শাদাব। অতি সুক্ষ্ণভাবে মামা, খালা ও মায়ের কান্নাকাটির দৃশ্য দেখার অজুহাতে ইভানার কথাটাই এড়িয়ে গেল। দোষ মাহদিয়ার নেই! তারও তো নেই। তবে সে কেন একটা ভিত্তিহীন সম্পর্কের বোঝা মাথায় নিয়ে ছিল এতদিন? একটা সম্পর্ক হতে পারত তার সুখের কারণ, কিন্তু হয়ে গেল সারাজীবনের আফসোসের কারণ! এটা কীভাবে বুঝাবে সবাইকে? কীভাবে বলবে, তার আর কোনো সম্পর্ক চাই না, আর কোনো মানুষকে চাই না। ভরসার হোক, কিংবা সুখ-দুঃখের সঙ্গী। নিজের জন্য এখন সে নিজেই যথেষ্ট!

***

চলবে।