বঁধুয়া কেমনে বাঁধিবো হিয়া পর্ব-০৬

0
328

#বঁধুয়া_কেমনে_বাঁধিবো_হিয়া
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব — ছয়

কার্টেসিসহ কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ!

গাড়ি এসে বাড়ির মূল গেটের সামনে পৌঁছাতেই প্রাচীরের উপরের অংশে চোখ পড়ল বেগম সায়রা করীমের। খুব সুন্দর করে সেখানে লেখা, ‘কুঞ্জকানন’। তার নিচে নিজের নাম ও দুই ছেলের নাম দেখে চোখে জল নিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিলেন তিনি। গাড়িটাকে ওখানেই থামাতে বললেন। শাদাব সায় জানাল। গেটের কাছেই গাড়ি পার্কিং-এ রেখে ডোর খুলে দু’হাতে যত্ন করে মাকে নামাল। দু’পা হেঁটে তিনি প্রাচীরের সামনে আসলেন। আলগোছে ছুঁয়ে দিলেন নেমপ্লেটের লেখাগুলো। অশ্রুগুলো সুখ হয়ে ঝরে পড়ল গাল বেয়ে। শাদাব মাকে কাঁদতে দিল। কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে সুখভরা কণ্ঠে বলল,

-‘কেমন হয়েছে মা? পছন্দ হয়েছে তোমার? এই বাড়িটা তোমার মা। এখানকার সব নিয়ম তৈরী করবে তুমি। আগের মতো কিছু না থাকুক, আমরা দুইভাই চিরদিন তোমার পাশে থাকব। তোমাকে আঁকড়ে থাকব। কেউ কোত্থাও যাব না, মা।’

পিছনে এসে দাঁড়াল শিহাব। হাতে তার পছন্দের চিপস্। জার্নির পুরো সময়টা সে একগাদা চিপস্ জুস খেয়েছে। অতি আদরের ভাই বলে, স্ন্যাকস্ থেকে তাকে দূরেও রাখতে পারে না শাদাব। কখনও লিমিট মেপে দেয়। আবার কখনও শিহাব জেদ ধরে বেশি চেয়ে নেয়। এখনও চিপস্ খেতে খেতে ভাইয়ের কথা শোনে পিছন থেকে বলল,

-‘এমন সুন্দর বাড়ি ছেড়ে কেউ শখ করে কোথাও যাবে না-কি? আমি তো স্কুল ফাঁকি দিয়ে হলেও দিনরাত এখানেই বসে থাকব। তবে একটা কথা, আমার ঝগড়ার সাথী চাই। রোজ রোজ নায়রাপু এখানে আসতে পারবে না। পারমানেন্ট একজনকে খুব তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো।’

শিহাব মোটেও স্কুল ফাঁকি দেয়ার মতো ছেলে নয়, তবুও এই কথা কেন বলল, সেটাই ভাবনার হয়ে দাঁড়াল। তবে ওসব কথা মুখ বেশি গায়ে মাখল না। শাদাব মাকে জড়িয়ে রেখেই কৌতুকের সুরে বলল,

-‘দ্যাখেছ মা? ছোটোন দিনদিন বাঁদরামি বাড়াচ্ছে।’

-‘সেটা তো তোর জন্যই হচ্ছে। তুই ও’কে ঠিকমতো শাসন করছিস না।’

মায়াভরা চোখে ভাইয়ের দিকে তাকাল শাদাব। এই ছেলেটাকে তার বকতে ইচ্ছে করে না। শুধু আদর দিয়ে সারাক্ষণ মাথায় তুলে রাখতে ইচ্ছে করে। এমন একটা চঞ্চল বাচ্চাকে কেউ কীভাবে অস্বীকার করল? শিহাব যদি কোনোদিন এসব সত্যের মুখোমুখি হয়, ব্যাপারটা কেমন হবে তার জন্য? খুব বেশি খুশির না-কি যন্ত্রণার? অবশ্য, যে মানুষ খু নী, তাকে জীবনে পেলে কিংবা তার সম্পর্কে জানলে দুঃখ বৈ সুখ উপলব্ধি হবে না কখনও। ওইটুকু মনে কঠিন সেই আঘাতটা সে কখনওই দিতে পারবে না। এই ভাই যে তার কলিজার টুকরো। তার সারাদিনের খুশি। ক্লান্ত শরীরের একটুখানি প্রশান্তি-ই শিহাবের চঞ্চল হাতের জড়িয়ে ধরা। চুমু খাওয়া। খুঁনসুটি করা। কীভাবে তাকে বকবে সে? অতিরিক্ত শাসন হবে না তার দ্বারা। শাসনের কথা শোনে হাত বাড়িয়ে শিহাবকে কাছে টেনে আনল শাদাব। হাসিমুখে তাকে জড়িয়ে ধরে মাথার ওপর চুমু খেল। বলল,

-‘তুমি জানো আমি ও’কে বকতে পারি না। এজন্যই বার বার শাসনের কথা টেনে আনো।’

তিনি প্রশস্ত হাসিতে নতুন বাড়ির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বললেন,
-‘না আনলে হয়? ও দিনদিন নিজের মধ্যে জেদ, বায়না বাড়াচ্ছে। তুইও সবকিছুকে প্রশ্রয় দিচ্ছিস। এই কারণে সারাক্ষণ মাথায় উঠে নাচে।’

-‘বাচ্চা মানুষ। নাচুক না। অতিরিক্ত শাসন কেন করতে হবে?’

-‘শাসন না করলে ভুল পথে যাবে।’

শাদাব আরও শক্ত করে ভাইকে জড়িয়ে ধরল। বলল,
-‘যাবে না। আমি আছি তো। ভুল পথে এক’পা এগোনোর আগেই দু’পা পিছিয়ে আসবে। পিছন থেকে ওর পা’টা আটকে দেব আমি।’

-‘এজন্য শাসন করতে হবে। শাসন না করলে ভুল থেকে ফেরানো যায় না।’

-‘সবাইকে শাসন করে ভুল থেকে ফেরাতে হয় না। কাউকে কাউকে আদর-ভালোবাসা ও সাপোর্ট দিয়ে ভুল থেকে ফেরাতে হয়। ছোটোন ভুলের পথে যাবে না ইন-শা-আল্লাহ্! আমি ওর ছায়া হব সবসময়।’

সায়রা করীম আনন্দভরা চোখে দুই ছেলের দিকে তাকালেন। ঠোঁটে ফুটালেন অমায়িক হাসি। দীর্ঘবছর পর মনটা তার শান্ত হলো। কঠিন পরিস্থিতিতে ছেলে যেভাবে মাকে সাহস দিয়েছে, এখনও ঠিক একইভাবে ভাইকে ভরসা দিয়ে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। স্বামীর বাড়ি থেকে যে অপমান, লাঞ্চনা তিনি গায়ে মেখে বেরিয়ে এসেছিলেন, তা এখন আর নেই। পুরোপুরি না মুছলেও দুই সন্তানকে পাশে পেয়ে সমস্ত অতীত তিনি মন থেকে মুছে ফেলেছেন। পারছেন না শুধু সেদিনের সেই পাষণ্ড ব্যক্তিটাকে ভুলতে। যতবার তিনি শিহাবকে দেখেন, ততবার মনে হয়, কাছের মানুষ হয়ে তিনি চাবুকটা এইভাবে না চালালেও তো পারতেন। শুধু সম্মানের জন্যই এমনটা করলেন! যতটুকু ভালোবাসা সবটুকু আজ ঘৃণা হয়ে বুকের ব্যথা বাড়ায়। তবুও তিনি দুই ছেলের সামনে হাসিখুশি থাকেন। ওরা পাশে আছে, সাথে আছে। আর কী চাই তার?

-‘দাঁড়িয়ে আছ কেন মা? ভেতরে প্রবেশ কোরো।’

পিছনের অধ্যায় পিছনেই থাক। ওতে যদি ভুল থাকে, সেই ভুল কভু ফুল না হোক আর। জীবন এগিয়ে যায়। সময় পেরিয়ে যায়। শুধু কিছু ধূসর স্মৃতি মানুষকে দিনরাত পোড়ায়। তাকেও পোড়াচ্ছে। তবু তিনি শক্ত থাকতে চাইছেন। একটা নিজের বাড়ি, একটা নিজের ঘর চোখের সামনে পেয়েও এখনও তার স্মৃতির গভীরে ফেলে আসা সেই ‘সুখনীড়’—এর দৃশ্য ভাসছে। অদ্ভুত। এই বাড়িটাও শাদাব সেই বাড়ির মতোই সাজিয়েছে। সব স্মৃতি সব দুঃখ পিছনে ফেলে তিনি ছেলের কথায় মাথা নেড়ে দু’জনের হাত ধরে ভেতরে প্রবেশ করলেন। দারোয়ান স্বশব্দে সালাম ঠুকল। তিনি জবাব দিয়ে চারপাশে চোখ ঘুরিয়েই চমকে গেলেন পুরোটাই। আস্তো এক ফুলের গালিছা বিছানো যেন। চারপাশে এত এত রঙবেরঙের ফুল দেখে চোখেমুখে ফুটে ওটা অতীতের সবটুকু বেদনা মুছে গেল। তিনি মাঝখানের রাস্তা দিয়ে পা ফেলে ‘কুঞ্জকানন’—এর দিকে এগিয়ে গেলেন। ফুলের বাগানের পাশেই বিশ্রাম নেয়ার জন্য দুটো ছাউনির মতো ঘর তৈরী করেছে শাদাব। সেখানে অনায়াসে দশ-বারোজন ব্যক্তি বিশ্রাম নিতে পারবে। বাড়ির একপাশে থাকা মোটা কড়ই গাছের ডালের ফাঁকে ঝুলছে ছোট্ট একটা কাঠের ঘর। কতদিন পর তিনি এমন চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য দেখে তৃপ্তি পেয়েছেন, তা বোধহয় পাশে দাঁড়িয়ে শাদাবও বুঝতে পারল। বলল,

-‘এই গাছটার জন্যই জায়গাটা ভীষণ পছন্দ হয়েছিল। ভাবলাম, ঠিক আগের মতো একটা ঘর বানাব। তোমাকে তোমার শান্তির নীড়ে ফিরিয়ে আনতে একটু দেরী হয়ে গেল মা।’

সায়রা করীম স্তব্ধ চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মাকে একটা বাড়ি বানিয়ে দিতে কত ছুটেছে এই ছেলে। দিনরাত ছুটে নিজেকে শক্ত করে, পরিশ্রম করে আজ এই স্থানে এসেছে। কত ধৈর্য্য, কত আকুতি-মিনতি ও আহাজারির জীবন ছিল তাদের। মনোবল না থাকলে, সাহস না থাকলে এই স্থানটায় নিজের সন্তানকে তিনি আজ দেখতে পারতেন না। মায়ের জন্য এত দৌড়ঝাঁপ করে অল্প সময়ের মধ্যে এমন চমৎকার একটা বাড়ি তৈরী করেও বলছে, একটু দেরী হয়ে গেল! কোথায় আর দেরী। তিনি তো নীড় পেয়েছেন। ছেলে তাকে বুঝেছে, পাশে থেকেছে, সাহস দিয়েছে, এরপর আর চাওয়ার কী থাকে! কিছুই না। তবুও মায়ের মুখের হাসির জন্য এই ছেলে ছুটছে তো ছুটছেই। তিনি শাদাবের এমন কাতর গলার অভিব্যক্তি শোনে ছেলের মাথায় হাত রাখলেন। বললেন,

-‘একদম দেরী হয়নি। এসবের কোনো প্রয়োজন ছিল না। তবুও তুই দিনরাত এক করে যা করছিস, তার জন্য আমি নির্ভার শ্বাস টানতে পারি। তোরা দুইভাই বাকিজীবন একসাথে থাকলে আমার আর কোনো দুঃখ থাকবে না।’

ভরসার চোখে মায়ের দিকে তাকাল শাদাব। শব্দহীন হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিল, ‘তুমি চিন্তা কোরো না মা। আমি আছি তো। বাকিজীবন এইভাবেই তোমাদের পাশে থাকব।’

সিঁড়িতে পা রাখতেই কাজের মেয়ে রেহনুমা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো। ঝটপট পা ছুঁয়ে সালাম করে দৌড় দিল লাগেজ আনতে। শাদাব মা ও ভাইকে নিয়ে বাড়ির বারান্দা দিয়ে একেকটা রুম, ড্রয়িংরুম, রান্নাঘর সবকিছুর সাথে মায়ের পরিচয় করিয়ে দিতে লাগল। শিহাদ ফাঁক দিয়ে দৌড় দিয়ে কড়ই গাছের সামনে এসে ভাবুক নয়নে তাকিয়ে রইল কাঠের ছোট্ট ঘরটার দিকে। চোখেমুখে বিস্ময় নিয়ে, একসিঁড়ি, দু’সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠতে লাগল। এমন ঘর সে অনেক দেখেছে, কিন্তু নিজেদের বাড়িতে এটাই তার প্রথম দেখা কোনো চমৎকার একটা ঘর। যেখানে এসে দাঁড়ালে নির্ভয়ে আকাশ ও বাতাসকে ছুঁয়ে দেখার আনন্দ উপলব্ধি করা যায়।

***

-‘বড়ো মামা, আমাকে কাজী সাহেবের ফোন নম্বর আর ওনার অ্যাড্রেসটা দাও।’

ঘুম ভাঙতে দেরী হয়েছে বলে দুপুরের শেষভাগে খাবার খেতে বসেছে মাহদিয়া। এলোমেলো রুমটা গুছিয়ে, গোসল শেষ করে তারপরই ডাইনিং-এ এসেছে। নূরুন্ নাহার যত্ন করে তার প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছেন। সে খেতে খেতেই এমদাদ কায়ছারের উদ্দেশ্যে কথাখানি ছুঁড়ে দিল। শায়লা সুলতানা বেশ খানিকক্ষণ আগেই গ্রামের বাড়ির পথে রওনা দিয়েছেন। আরফান হায়দার মাদরাসায় চলে গেছেন। বাড়িতে এখন শুধু তিনজন মানুষ। আচানক এমন কথায়, কায়ছার সাহেব মারাত্মক বিষম খেয়ে বসলেন। মাহদিয়া পানির গ্লাস এগিয়ে দিল। উঠে দাঁড়িয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিল। বলল,

-‘সামান্য একটা ঠিকানা চাইতেই বিষম খেয়ে বসলে। যদি টোটোনকে চাই, কী করবে? কাশতে কাশতে কথা বন্ধ হয়ে যাবে দ্যাখছি।’

মাহদিয়া যে কেন এসেছে, এখনও সেই হিসাব অস্পষ্ট তার কাছে। সায়রা করীম ও শাদাব বাড়ি ছাড়ার পর তিনি চাননি, এই মেয়েটা কোনোদিন দেশে ফিরুক। লাজলজ্জার সেই দিনগুলো না তিনি ফিরে পেতে চান, আর না কারও সামনে এসব নিয়ে জবাবদিহি করতে চান। পিছনের অধ্যায়কে তিনি যত পারবেন দামাচাপা দিয়ে রাখবেন। কিন্তু হচ্ছে না। মাহদিয়া সব ওলট-পালট করে দিচ্ছে। প্রথমে এসে টোটোনকে খুঁজতে চাইল, এখন কাজী সাহেবের ফোন নম্বর চাইছে। এত বছর পর কাজীকে দিয়ে কাজ কী এই মেয়ের? সবকিছু ভুলে গেলেই তো সমাধান হয়ে যায়। সাময়িক ভাবাবেগে ভেসে গিয়ে দুটো অবুঝ বাচ্চাকে এক করার সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি ভুল করেছেন। সেই ভুলের মাশুল কেন এত বছর পর দিতে হবে? তিনি ডগডগ করে পানি পান করে রিল্যাক্স হওয়ার চেষ্টা করলেন। মাহদিয়া নিজের চেয়ারে বসল। আগ্রহী মেজাজে তাকিয়ে রইল কায়ছার সাহেবের দিকে। তাঁকে নিশ্চুপ দেখে বলল,

-‘এত ভাবছ কী? দাও ঠিকানা। আজ সারাদিন ওই কাজী সাহেবকে খুঁজব। কাল থেকে টোটোন ও আন্টিকে খোঁজার মিশনে নামব। যতদিন না দু’জনকে খুঁজে পাচ্ছি, ততদিন আমি এই বাড়ি থেকে যাব না।’

অবাক হচ্ছেন কায়ছার সাহেব। এইটুকুন মেয়ে বড়ো হয়ে কীভাবে উঁচুগলায় কথা বলে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে, এটা ভেবেই তিনি চুপসে যাচ্ছেন। অথচ এই মেয়েকে ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই। কিন্তু তিনি ভয় পাচ্ছেন। পাচ্ছে লজ্জা এসে ঘিরে ধরে, সেই ভয়ে কণ্ঠ নামিয়ে বললেন,

-‘খুঁজাখুঁজি করে লাভ নেই। পাবে না।’

-‘তুমি শুধু কাজী সাহেবের ফোন নম্বর ও অ্যাড্রেস দাও। বাকিটা আমি একাই ম্যানেজ করে নেব।’

-‘পনেরো বছর পর দেশে এসেছ। রাস্তাঘাট কিছুই চিনো না। দুর্ঘটনা ঘটবে। হায়দার ফিরুক, জাহান্নামের রাস্তায় একসাথে যেও।’

স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে মনে কত তিক্ততা কায়ছার সাহেবের। মাহদিয়া শোনে হতবাক হয়ে গেল। আনমনা স্বরে বলল,
-‘দুটো মানুষ কেন এত তাড়াতাড়ি তোমার মন থেকে দূরে সরে গেল মামা? কেন আজ তাদের নামটাও সহ্য করতে পারো না তুমি? বোলো আমাকে!’

সব জানলেও কোনোভাবেই সেসব ঘটনার দিকে টার্ন করতে চাইল না মাহদিয়া। তাই ইনিয়েবিনিয়ে জানার আগ্রহ দেখাল। কায়ছার সাহেব গম্ভীরমুখে বসে রইলেন। মাহদিয়ার একটা কথারও কোনো জবাব দিলেন না। তবে সে-ও দমে গেল না। শান্তচোখে চেয়ে চেয়ে বলল,

-‘যে মানুষ ঘর আগলে রেখেছিল, তোমাকে ও বাড়ির সবাইকে নিয়ে হাসিখুশি ও সুখী জীবন কাটাচ্ছিল, জেনেশুনে তাকে তুমি কীভাবে একা ছেড়ে দিলে মামা? কষ্ট হয়নি একটুও? মনে হয়নি, একবার ওই নারীর মন বুঝা উচিত? একবার টোটোনের কথা ভাবা উচিত!’

এত কথার জবাব তিনি কোনোকালেই দিবেন না। প্রয়োজনও নেই। এবারও চুপ রইলেন। পকেট থেকে ফোন বের করে খুঁজে খুঁজে কাজী সাহেবের নম্বর বের করে সেটা মাহদিয়ার সামনে রেখে দিলেন। বিড়বিড়িয়ে অ্যাড্রেস বললেন। মাহদিয়া নীরবে নম্বর নিজের ফোনে তুলল, তারপর ঠিকানাটা নোট করে নিল। মোবাইল বাড়িয়ে দিল কায়ছার সাহেবের দিকে। বলল,

-‘থ্যাংক য়্যু, আমার কাজটা সহজ করে দেয়ার জন্য।’

ছুটে গিয়েও কোনো লাভ হবে না, এটা কায়ছার সাহেব জানেন। এজন্য তর্কাতর্কির কোনো টপিকে তিনি যাননি। নিশ্চুপে নম্বর ও ঠিকানা দিয়ে চেয়ার ছাড়লেন। ধন্যবাদের বিপরীতে বললেন,

-‘একা যেতে না পারলে নাহারকে নিয়ে যাও। রাস্তাঘাট চিনবে না। কখন কী দুর্ঘটনা ঘটে ঠিক নেই! আমাকে এখন একবার কোর্টে যেতে হবে, কিছু ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে। কোর্ট উলটো রাস্তায়, নয়তো তোমার সাথে যেতাম।’

মাহদিয়া ঝটপট দু’দিকে মাথা নাড়ল। তড়িৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
-‘না না, তুমি চিন্তা কোরো না। আমি একাই যেতে পারব। শুধু গাড়ির চাবিটা দিয়ে দাও।’

কথা বাড়াতে ভালো লাগে না ভদ্রলোকের। স্ত্রী-সন্তানদের ঘিরে যত আলোচনা সব তিনি এড়িয়ে চলতে চান। এমন করেই বাঁচেন। এসব কথার ভীড়ে বার বার অতীত টেনে আনতে ভালো লাগে না। বিদ্রুপ দৃশ্য, সময়টা তিনি ভুলে থাকতে চান। অযথা বকাবকি না করে মাহদিয়ার দিকে গাড়ির চাবি বাড়িয়ে দিলেন। বললেন,

-‘চিনবে কী করে?’

মাহদিয়া নিজের ফোনের স্ক্রিনে থাকা গুগল ম্যাপ দেখাল। বলল,
-‘এটাতেই চলবে। আসছি।’

মাহদিয়া দৌড় দিল। কায়ছার সাহেবও প্রস্থান করলেন। নূরুন্ নাহার অবুঝ মেয়েটার আগ্রহ, তার এগিয়ে যাওয়া দেখে খুশি হলেও দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। জানেন, ওখানে গিয়ে মেয়েটা কিছুই পাবে না। উলটে খালি হাতে ফেরত আসবে।

***

রাস্তায় নেমে মাহদিয়া টের পেল, এভাবে একা আসা উচিত হয়নি। যদিও গুগল দেখে দেখে এগোচ্ছে, তবুও মনে হচ্ছে পাশে কেউ থাকলে ভালো হতো। সে ড্রাইভে মনোযোগ রেখে হায়দার সাহেবকে কল করল। তিনি রিসিভ করার পর বলল,

-‘ছোটো মামা, তুমি একটু শমসের আলমের কাজী অফিসে আসতে পারবে? ওনাকে ম্যারেজ সার্টিফিকেটের ব্যাপারে কিছু কথা জিজ্ঞেস করার ছিল।’

‘আধঘণ্টার মধ্যেই আসছেন’, এইবলে ফোন রেখে দিলেন হায়দার সাহেব। মাহদিয়া ড্রাইভ সামলে আগ্রহী মেজাজে ইতিউতি চোখ বুলাল। যদি চেনা-পরিচিত চেহারার খোঁজ পাওয়া যায়, সেই আশায়। যত দেখে, যত এগোয় তার দু’চোখে কেবল শূণ্যতাই ভেসে উঠে। কতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে, মানুষগুলোর চেহারা হয়তো আর আগের মতো নেই। সায়রা করীমের চেহারায় নাহয় বার্ধ্যকের ছাপ পড়বে, শাদাব দেখতে কেমন হয়েছে, সেই ভাবনাই তাকে ভেতর থেকে শূণ্য করে দিল। এই শহরে তারা আছেন, না-কি নেই, সেটাও জানা নেই। শুধু ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে তাদেরকে খুঁজতে বের হওয়া। ভাগ্য কি আর এত সহায় হবে তার?

লো ভলিউমে একটা গান ছাড়ল মাহদিয়া। গুগল ম্যাপ দেখে দেখে রাস্তা চিহ্নিত করে এগোতে লাগল। এইটুকু রাস্তা এগোতেই তাকে বেশ ঝাক্কি পোহাতে হলো। টার্নিং পয়েন্টের কাছে এসে আটকা পড়ল জ্যামে। মানুষ আর মানুষ। গাড়ি আর গাড়ি। উপচেপড়া ভীড়। ঠ্যালাঠ্যালি। এই হলো বাংলাদেশের রাস্তা। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে এলো তার। পিছন থেকে অনবরত হর্ণের আওয়াজ আসছে। এবার আরও বিরক্ত হলো। ভাবল ফাঁকফোকর দিয়ে গাড়ি সামনে এগিয়ে নিবে। ব্রেক সামলে কিছুদূর এগোতেই সামনের দিক থেকে আসা একটা কারের সাথে সজোড়ে ধাক্কা লাগল। অমনি স্টিয়ারিংয়ের সাথে কপালটা ঠুকে গেল তার। এলোমেলো কোঁকড়ানো চুলগুলোতে পুরো মুখমণ্ডল ঢাকা পড়ল। মুহূর্তেই ওখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইল সে।

-‘সবুজ, কী সমস্যা? এখানে ব্রেক করলে কেন? দ্রুত এগোও। একঘণ্টার মধ্যে আমাকে চেম্বারে যেতে হবে।’

জ্যামের মধ্যে গাড়ি এগোনো কঠিন। শাদাবের তাড়া দেখে সামান্য স্পেস পাওয়াতে তড়িঘড়ি গাড়ির স্পীড বাড়িয়ে টার্নিং পয়েন্ট ক্রস করতে চাইছিল তার বিশ্বস্ত ড্রাইভার সবুজ। শাদাব মাথা ঝুঁকিয়ে পত্রিকা পড়ছিল, তাই সামনের দুর্ঘটনা তার চোখে পড়েনি। কিন্তু কোথা থেকে হুড়মুড়িয়ে অন্য একটা গাড়ি এসে সামনে পড়ে গেল। ফলস্বরূপ কাঁচ ও সামনের লাইট ভেঙে ছোটোখাটো দুর্ঘটনা ঘটে গেল। সে শাদাবের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর শোনে অসহায় মুখ নিয়ে বলল,

-‘দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, স্যার। সামনে একটা গাড়ি…!’

কথা শেষ করার আগেই ডোর খুলে বাইরে বের হলো শাদাব। পুরো কথা না শোনে দু’পা এগিয়ে এসে দেখল, সত্যি সত্যি একটা প্রাইভেট কারের কাঁচ ভেঙেছে। ভেতরে কেউ আছে কি-না, তার ক্ষতি হলো কি-না সেটা দেখতেই ভাঙা কাঁচের ফাঁক দিয়ে গাড়িটার ভেতরটা চেক করল শাদাব। স্টিয়ারিংয়ের সাথে একটা মেয়ের মাথা ঝুঁকে থাকতে দেখে ভরকে গেল। বেঁচে না-কি মারা গেছে সেটা যাচাই করতেই ডাকল,

-‘এ্যাক্সকিউজ মি! ক্যান য়্যু হেয়ার মি?’

কোনো আওয়াজ আসলো না। শাদাব হাতের ঘড়ির দিকে তাকাল। এখনও অনেকটা রাস্তা এগোনো বাকি। দুর্ঘটনা বলেকয়ে আসে না। কিন্তু যখন আসে, তখন তাকে উপেক্ষা করে নিজের দিক ভেবে কাউকে বিপদে ফেলে চলে যাওয়া স্বার্থপর মানুষের কাজ। ক্ষতি কতটুকু হলো সেটা নিশ্চিত না হয়ে যেতেও পারছে না। বেঁচে আছে না-কি মারা গেছে এ-ও প্রশ্ন। কোনো জবাব না পেয়ে সে ভাঙা সাইড দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ডোর খুলে স্টিয়ারিংয়ের সাথে ঝুঁকে থাকা নারীমূর্তিকে সোজা করে সিটে হেলান দিয়ে বসাল। মাহদিয়ার মাথাটা কিঞ্চিৎ হেলে পড়ল একসাইডে। শাদাব একবার তাকাল। বার বার তাকাল। বাদামী চুলের সেই চিরচেনা ডিজাইন, কাঁকড়া ক্লিপ, গলায় সায়রা করীমের দেয়া সেদিনের সেই লকেট, পুতুল পুতুল চেহারা দেখেই হাত-পা, মনসহ পুরো শরীরের টালমাটাল, বেহাল দশা হলো। এত বছরে একটুও পাল্টায়নি মাহদিয়া। আগের মতোই আছে। আলগোছে বিনুনি করা চুল সরাতে গিয়ে খেয়াল করল, কপালে বেশ খানিকটা জায়গা ফেটে রক্ত বের হয়েছে। সেই রক্ত কপাল চুইয়ে চোখ বেয়ে গালে এসে পড়ছে। প্যান্টের পকেটে হাত রেখে টিস্যু বের করে হাতের আলতো চাপে সবটুকু রক্ত পরিষ্কার করে নিল। মৃদুস্বরে ডাকল,

-‘ভ্রমর, আর য়্যু ওকে?’

কোনো সাড়াশব্দ নেই। কপাল বেয়ে ঘাম ছুটল শাদাবের। অজানা কারণেই সে ভয় পেতে শুরু করল। আলতো হাতে চিবুক ছুঁয়ে ডাকল,

-‘এ্যাই ভ্রমর! চোখ তো খুলো। সামান্য একটা ধাক্কা খেয়ে এইভাবে বেহুঁশ হয় কেউ!’

দেরী করতে পারল না শাদাব। মাহদিয়াকে ওইভাবে হেলান দেয়া অবস্থাতে রেখে পা চালিয়ে ছুটে আসলো নিজের গাড়িতে। ডোর খুলে নিজের হ্যান্ডব্যাগটা বের করে প্রয়োজনীয় জিনিস এনে পূণরায় ছুটে আসলো মাহদিয়ার কাছে। তখনও তার জ্ঞান ফিরেনি। এদিকে রাস্তার পাবলিক অধৈর্য। উপায়ন্তর না পেয়ে অন্যপাশের ডোর খুলে পাশের সিটে বসল শাদাব। চাবি ঘুরিয়ে দেখল, ব্রেক কাজ করছে কি-না। সব ঠিকঠাক দেখে রাস্তা ক্লিয়ার করার জন্য একহাতেই স্টিয়ারিং সামলে একটা ফার্মেসীর সামনে থাকা ফুটপাতের সাইডে গাড়ি পার্ক করে রাখল। ব্যাগ থেকে তুলো, স্যাবলন বের করে কপালের রক্তাক্ত অংশটুকু ভালোমতো পরিষ্কার করল আগে। ভেজা টিস্যুর সাহায্যে সারামুখে লেপটে থাকা রক্ত মুছে কপালের ফেটে যাওয়া অংশে সামান্য তুলো বসিয়ে গজ বেঁধে দিল। তখনও মাহদিয়ার কোনো সাড়া নেই। তাকে এভাবে নিঃশব্দে পড়ে তাকে থাকতে দেখে বড্ড খারাপ লাগার জন্ম নিল মনে। গাড়ির সামনে রাখা বোতল থেকে মাহদিয়ার চোখেমুখে সামান্য পানির ঝাপটা দিল। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে অপেক্ষায় রইল, কখন তার জ্ঞান ফিরে আসে।

কয়েক মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পর এদিক-ওদিক মাথা নাড়িয়ে অস্ফুটস্বরে ‘উহ্’ উচ্চারণ করল মাহদিয়া। তাতেই সতর্ক হয়ে গেল শাদাব। বিড়বিড়িয়ে খোদার দরবারে শুকরিয়া জানিয়ে ছোট্ট একটা চিরকুটে পেইনকিলারের নাম ও খাওয়ার নিয়ম লিখে ঝটপট ডোর আটকে বেরিয়ে পড়ল। নিজের গাড়িতে উঠে আর একমিনিটও অপেক্ষা করল না। চোখের পলকেই ওই স্থান ত্যাগ করল। বার দু’য়েক মাথা নাড়িয়ে স্বাভাবিক হয়ে বসার চেষ্টা করল মাহদিয়া। কপালে কিঞ্চিৎ ব্যথা অনুভব হওয়াতে হাত রাখল। অমনি চমকে উঠল সে। ধড়ফড়িয়ে সোজা হয়ে বসে চারপাশে সন্দিহান মন নিয়ে চোখ বুলাল। অনেক মানুষ থাকলেও কাউকে দেখতে পেল না যাকে মনে হবে, পরোপকারী। হাতে ব্যান্ডেজের স্পর্শ পেয়ে লুকিং মিররে নিজের মুখ দেখল। পুরো মাথায় ব্যান্ডেজ প্যাঁচানো দেখে থমকে গেল দৃষ্টি। চারপাশে চোখ বুলিয়ে চিরকুটটা দেখে সেটা হাতে নিয়ে ঔষধের নাম দেখে বিস্ময় ফুটে উঠল তার পুরো চেহারায়। ঔষধের নাম ছাড়াও শেষের বাক্যটা তার কৌতূহল বাড়িয়ে দিল। বিড়বিড়িয়ে উচ্চারণ করল,

-‘আপনার গাড়িটা আমার গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়েছে। যদিও আপনার ক্ষতিটা খুব সামান্যই হয়েছে, তবুও পুষিয়ে দিয়েছি ফ্রিতে ট্রিটমেন্ট করে। এখানে কয়েকটা ঔষধের নাম লেখা আছে। দু’দিন খান, বিশ্রাম নিন। সুস্থ হয়ে যাবেন।’

***

চলবে…