বউপাখি পর্ব-০৫

0
102

#বউপাখি
#পর্ব_৫
#লেখনিতে_সিনথিয়া
“অ্যা? আপনি এই রুমে ঘুমোবেন আজকে?”
“না তো! আমি ফুটবল খেলবো। তুমি চাইলে ফুটবল টিমও বানাতে পারি?”

ভ্রু নাঁচিয়ে বললো আরাফ। ওর চোখে মুখে দুষ্টমির ছাপ স্পষ্ট। গায়ে সাদা রঙের শার্ট আর ধূসর রঙের ট্রাউজার পরনের আরাফ শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলতে খুলতে এগিয়ে আসে তিতিরের দিকে। ঘুমানোর আগে শাওয়ার নেয়ার অভ্যাস ওর। আজকেও তার ব্যাতিক্রম ঘটেনি। ভিজা চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে মোছার পরও তা দিয়ে ক্রমাগত পানি ঝরে ভিজিয়ে দিচ্ছে ওর বলিষ্ঠ কাঁধ দুটো।

তিতির আরাফের এইরূপ দেখে ঢোক গিলল বেশ কয়েকবার। তারপর পেছাতে পেছাতে ওর পিঠ গিয়ে ঠেকলো ধূসর রঙা দেয়ালে। যে দেয়ালটার অনেকটা অংশ জুড়ে আছে এম পি আরাফ চৌধুরীর একটা পোট্রের্ট। সামনেও এই পাগল পিছনেও এই পাগল। নিজের মনেই কেঁদে ফেললো তিতির। ততক্ষণে আরাফ ওর নাক বরাবর চলে এসেছে। তারপর তিতিরের এক পাশে ওর এক হাত রেখে আরেক হাত দিয়ে ওর চিবুক স্পর্শ করলো আরাফ।

দুজনের দৃষ্টি একে অপরের ওপর নিবদ্ধ। তিতির হাসফাস করছে আরাফের বাহুডোরে। যেনো থেমে থেমে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ওর। তিতিরের এমন বেহাল দশা দেখে অধর কামড়ে হাসলো আরাফ। তারপর আচমকাই মাথা ঝাঁকিয়ে চুলের পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিলো তিতিরের লাল টুকটুকে মুখশ্রী।

আরাফের চুলের ফোঁটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ছে তিতিরের চোখ, নাক, আর গাল বেয়ে। ভিজে গেছে ওর ঈষৎ গোলাপি ওষ্ঠ জোড়াও। দু’ফোটা পানিও যেনো গড়িয়ে পড়লো সেখান থেকে। ঘটনার আকস্মিকতায় দ্রূত ওঠানামা করছে বক্ষস্থল। এতক্ষণ অধর কামড়ে হাসলেও এই দৃশ্য দেখে চুপ হয়ে গেলো আরাফ। দুপুরের মতোই অস্থিরতা বাড়লো ওর বুকের। অবস্থা বেগতিক দেখে এক ঝটকায় সড়িয়ে ফেললো নিজেকে তিতিরের সামনে থেকে।

আরাফের এমন আচরণ মাথার ওপর দিয়ে গেলো তিতিরের। দ্যা গ্রেট আরাফ চৌধুরীর মতো একজন শেইম লেস ফ্লার্ট কি না লজ্জা পাচ্ছে। লজ্জাতেই কি তার দুকান ওমন লাল হয়ে গেছে?

“ঐ সময় তো খুব আমার গলা জড়িয়ে ধরলে আর এখন একসাথে ঘুমাতে ভয় পাচ্ছো ? ”

রুমের পিন পতন নিরবতা ভেঙে বলে উঠলো আরাফ। তারপর বিছানায় লাফিয়ে উঠতে উঠতে বলল-

“চিন্তা নেই বউপাখি ! তোমাকে ঘুমের মধ্যেও জড়িয়ে ধরবো না! আই প্রমিজ! ”

বিস্তর হাসলো আরাফ। তারপর কপালের উপর এক হাত রেখে চোখ বুঝলো পরম সুখে। যেনো এক যুগ পর আরামের এক ঘুম দিবে আজকে সে।

তিতির খুব একটা ভরসা করতে পারলো না এই আরাফ চৌধুরীকে। তারপরও ধীর পায়ে বিছানায় উঠে মাঝখানে কোল বালিশ রাখলো ও। বালিশে মাথা লাগাতেই তিতিরের সারাদিনের ক্লান্ত শরীরটাও তলিয়ে গভীর ঘুমে।

তিতিরের ঘুম ভাঙলো ফজরের আজানের সময়। চোখ মেলেই নিজের বুকের ওপর ভারি কিছু অনুভব করলো ও। নিমিষেই চক্ষু ফুটবল তিতিরের। আরাফ চৌধুরী ওর বুকের ওপর ঘুমিয়ে আছে। ওর বলিষ্ঠ হাতজোড়া কোলবালিশের মতো জড়িয়ে ধরে আছে তিতিরকে।

এবার আর হাসফাস করলো না তিতির। নিষ্পলক চেয়ে দেখতে থাকলো আরাফের ঘুমন্ত মুখ।
“ কি নিষ্পাপ আর বাচ্চা বাচ্চা লাগে দেখতে আপনাকে ঘুমের মধ্যে। আচ্ছা আমি কি সত্যিই আপনার বউপাখি? যদি কোনোদিন আমার স্মৃতি ফিরে না আসে? তবুও কি আপনি আমাকে এভাবেই আগলে রাখবেন নিজের সাথে? ”

আরাফের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল তিতির। তিতিরের স্পর্শ পেয়েই বোধ হয় ঘুম ভাঙতে লাগলো আরাফের। আরাফের নড়াচড়া টের পেতেই মাথায় হাত বুলানো থামিয়ে দিয়ে ঘুমের ভান ধরে চোখ বন্ধ করে ফেললো তিতির।
আরাফ চোখ মেলে নিজেকে তিতিরের উপর দেখেই সড়ে গেলো এক পাশে। অনুতপ্ত হলো ভীষণ। ভাবলো আহারে বাচ্চা মেয়েটা মনে হয় ওর শরীরের ভারে সারারাত ভালো করে ঘুমোতেই পারেনি। তাই আর জাগালো না ও তিতিরকে। ঘুমন্ত তিতিরের কপালে ঠোঁট ছোয়াতে গিয়েও আটকে নিলো নিজের আবেগকে। যদি তিতির ভাবে আরাফ ওর ঘুমের সুযোগ নিয়েছে।

তাই তো ওজু করে সোজা বেরিয়ে গেলো ও নামাজ পড়তে। আর এতক্ষণ যেনো নিশ্বাস আটকে ছিলো তিতির। আরাফ রুম থেকে বেড়িয়ে যেতেই হাফ ছেড়ে বাঁচলো ও।
_______________________________________

আজ মিষ্টির জন্মদিন। সকাল থেকেই চৌধুরী বাড়িতে বিরাট আয়োজন চলছে। মিষ্টির কিছু বন্ধু-বান্ধব আর কাছের কিছু আত্মীয় স্বজনদেরই দাওয়াত দিয়েছেন আহনাফ চৌধুরী।
সকাল থেকে আরাফও ভীষণ ব্যস্ত। বেশ অনেকদিন পার্টির কোনো কাজে হাত লাগানো হয়নি ওর। তাই তো সকাল থেকেই মিটিং এর পর মিটিং ফেঁসে যাচ্ছে আরাফ। যেনো ফুরসৎই পাচ্ছে নিজের বউয়ের কাছে যাওয়ার। এদিকে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে তিতিরও। পাগলটা সকাল থেকে একবারও দেখতে আসলো না তিতিরকে। সারারাত ওমন ভারি শরীর দিয়ে পিষে চ্যাপ্টা করার পর সকাল হতে না হতেই এমন অবহেলা মেনে নিতে পারলো না তিতির। আর তখনই তিতিরের রুমে আসলো মিষ্টি। ওর হাতে একটা ম্যাজেন্টা কালারের কাতান শাড়ি।

রুমে ঢোকার আগে মিষ্টি দরজায় নক করতেই ধ্যান ভাঙলো তিতিরের। কি একটা অবস্থা। সারাক্ষণ শুধু আরাফের কথাই মাথায় আসছে এখন তিতিরের। আর ঐ লোকটা? ঐ লোকটা তো একবারও ভাবে না তিতিরের কথা। এতই যদি বউপাখি বউপাখি করবে, তাহলে সকাল থেকে একবারও আসলো না কেনো তিতিরের সামনে।

“ভাবিপা! কি গো আমি যা বললাম কিছু শুনতে পেলে!”

হকচকিয়ে উঠলো তিতির। মিষ্টি তিতিরের এমন অন্যমনস্ক থাকার কারণ ধরে ফেলল মুহূর্তের মধ্যেই। কিন্তু মুখে কিছু বলল না, যদি আবার মেয়েটা লজ্জা পায়। এমনিতেই ওর ভাই যা করে সারাদিন, তাতেই মেয়েটা যথেষ্ট বিরক্ত। এখন যদি ননদ হয়ে মিষ্টিও একই কাজ করে তাহলে তো কথাই নেই।

“ভাবিপা এই শাড়িটা ভাইয়া তোমাকে পড়তে বলেছে আজ সন্ধ্যায়।”

তিতির অবাক হলো ভীষণ। কি ভেবেছে ঐ পাগলটা। বউয়ের জন্য শাড়ি পাঠাবে অথচ নিজে এসে একটু দেখা করবে না।

“ভাবিপা প্লিজ তুমি শাড়িটা পড়ো। আজকে সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে যেনো আমার ভাবিপাকে দেখে মানুষ তাক লেগে যায়।”

মিষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তিতির বলল-
“হ্যাপি বার্থডে মিষ্টি”

মিষ্টি লাজুক হেসে উত্তর দিলো-

“থ্যাংকু ভাবিপা।”
______________________________________

সন্ধ্যায় খুব সুন্দর করে মিষ্টিকে সাজিয়ে দিলো তিতির। ছোট চুল আর হালকা গোলাপি রঙা গাউনে পরীর মতো লাগছে মেয়েটাকে।

মিষ্টিকে সাজানো শেষ হলে তিতিরও পড়ে নিলো আরাফের দেয়া কাতান শাড়িটা। মাথার চুলগুলো খোপা করে সেখানে গুজলো বেলীফুলের মালা। অলংকারের মধ্যে শুধু পড়লো কানের ঝুমকো। চোখে দিলো গাড় কালো কাজল আর ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপবাম। তিতিরকে দেখে মিষ্টি যেনো চোখই ফেরাতে পারলো না। তারপর হেসে বলল-

“এজন্যই বলি আমার ভাইয়ের মতো অমন রসকষহীন একটা মানুষ কি করে এমন গভীর প্রেমে পড়লো। মানতেই হবে আমার ভাবি হলো লাখে এক পিস। তার প্রেমে হাবুডুবু খাবে না তো ভাই আর কার প্রেমে হাবুডুবু খাবে শুনি?”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো তিতির। তারপর বিড়বিড় করে বলল-

“এজন্যই তো সকাল থেকে একবারও আসলো না আমার সামনে।”

“ভাইয়া তো আজকে আসলে-

কথা শেষ করতে পারলো না মিষ্টি। শুনতে পেলো ড্রয়িং রুম থেকে আসা গিটারের টুংটাং ধ্বনি। নিমিষেই চকচক করে উঠলো ওর চোখ-

“ভাইয়া গিটার বাজাচ্ছে! ভাবিপা তুমি শুনতে পাচ্ছো?”

(চলবে)..