#বউপাখি
#পর্ব_৬
#লেখনিতে_সিনথিয়া
গিটারের টুংটাং শব্দ তিতিরেরও কানে গেলো। তারপর ড্রয়িং রুম থেকে ভেসে এলো আরাফের ভারিক্কি গলায় গাওয়া তিতিরের সবচেয়ে পছন্দের গান-
“কাভি জো বাদাল বারসে,
মে দেখু তুঝে আখে ভারকে,
তু লাগে মুঝে পেহলি
বারিস কি দুয়া।
তেরে পেহলু মে রেহলু,
মে খুদকো পাগাল কেহলু,
তু গাম দেয়া খুশিয়া সেহলু
সাথিয়া..”
গানের এ পর্যায়ে নিচে নেমে এলো মিষ্টি তিতির দুজনেই। মিষ্টি কাউকে একটা খুঁজছে আর তিতিরের চোখ এক আরাফেই যেনো নিবদ্ধ। মুগ্ধ হয়ে তিতির শুনছে আরাফের গান। তিতিরকে একপলক দেখে আরাফ খেই হারালো। মুগ্ধ হলো প্রিয়দর্শিনীর এমন রূপ দেখে। অধর কামড়ে হেসেও নিলো খানিকটা সবার অকপটে। তারপর আবার সুর ধরলো গানের বাকি অংশের-
কো-য়ি নেহি
তেরে সিভা মে রা ইয়াহা,
মাঞ্জিলে তু হে
মেরি তো সাব ইয়াহা,
মিটা দে সাভি আজা ফাসলে,
মে চাহু মুঝে মুঝসে বাটলে,
জারাসা মুঝমে তু ঝাকলে,
মে হু কেয়া!
কাভি জো বাদাল বারসে…”
বাকরুদ্ধ তিতির। এতো সুন্দর করে গান গাইতে পারে পাগলটা। গান শেষ করে আরাফ গিটারটা টেবিলে রাখলো। তারপর ধীরপায়ে এগিয়ে এসে আগে বোনকে উইশ করলো। মিষ্টি খুশিতে আটখানা হয়ে জিজ্ঞেস করলো-
-“ভাইয়া আমার গিফট?”
আরাফ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল-
-” কি চাই তোর? তুই শুধু একবার মুখ ফুটে বল!”
মিষ্টি লাজুক হেসে উত্তর দিলো-
-” সত্যি বলছো? যা চাইবো তা-ই দিবা?”
-” এনিথিং ফর ইউ মাই প্রিন্সেস ”
মিষ্টি একবার তিতিরের দিকে তাকালো তারপর আরাফের দিকে। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে জোরে বলল-
-” আমি চাই তুমি ভাবিপাকে আবার বিয়ে করো। তোমাদের বিয়ে আমি কাছ থেকে দেখতে পারিনি, তখন ইউ এস এ ছিলাম বলে, কিন্তু এবার আমি দেখতে চাই।”
আরাফ বোনের কথা শুনে অবাক হলো না খুব। তারই তো বোন। ভাইয়ের কষ্ট একটু হলেও বোঝে। মিষ্টির কথা শুনে তিতিরের চোখ গোল গোল হয়ে গেলো। হায় হায় মেয়েটা কি বলে এইসব। আরাফের প্রতি একটু নরম হলেও, বিয়ে কিভাবে করবে এই
মানুষটাকে। পুরোনো কোনো স্মৃতিও তো ওর এখনো মনে পড়েনি।
-” ভাবিপা তোমার কাছেও কিন্তু আমার একই আবদার রইলো। কি হলো? রাখবে না আমার এই আবদারটুকু।”
তিতির দোটানায় পড়ে গেলো ভীষণ। আরাফ তা দেখে তিতিরের কাছ ঘেঁষে দাড়ালো। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল-
-” আর কত দূরে দূরে থাকবেন ম্যাডাম। এই অধমেরও তো কষ্ট হয় বলুন, এতো হ্যান্ডসাম হয়েও যদি বউয়ের কাছে যেতে না পারি, বউ কাছে থাকা সত্বেও যদি রাতে বউকে আদর করতে না পারি, বউকে নিয়ে হানিমুনে যেতে না পারি, মা-বাবাকে নাতি-নাতনি গিফট করতে না পা-
-” ব্যাস। করবো বিয়ে আমি আপনাকে। এবার অন্তত মুখটা বন্ধ করুন! প্লিজ! ”
অতিষ্ঠ হয়ে বলল তিতির। কিন্তু মনে মনে লজ্জায় লালও হলো ভীষণ। খুশিতে লাফিয়ে উঠলো মিষ্টি। আরাফের দাদি আর মা দু’জনই এসে তিতিরকে মন ভরে দোয়া করে দিলেন। মুখে বিস্তর হাসি ফুটলো আরাফেরও। শুধু খুশি হতে পারলেন না আরাফের বাবা। কারণ উনি জানেন, এই বিয়ে মানেই আরেকটা ঝড় ওঠা। তিতিরের বাবা এতো সহজে ছেড়ে দেবে না আরাফকে।
***
মিষ্টির অনুষ্ঠান শেষ করে রুমে আসলো তিতির। শাড়ি খুলে নরম একটা কামিজ পড়ে যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো ও। আর এর মধ্যেই ওর ফোনটা তীব্র শব্দে বেজে উঠলো। ফোনটা অবশ্য আরাফই কিনে এনে দিয়েছিলো ওকে শুধু আরাফের সাথে কথা বলার জন্য। তাই ফোন বেজে ওঠার সাথে সাথেই তিতির বুঝে গেলো কে ফোন করেছে ওকে।
-” হ্যালো?”
তিতিরের কন্ঠ শুনে আরাফ চোখ বন্ধ করলো। তারপর এক সম্মহোনী কন্ঠে শুধালো
-” একটু নিচে আসবে প্লিজ বউপাখি ! তোমার জন্য গাড়িতে ওয়েট করছি আমি, আজ তোমাকে নিয়ে পুরো শহর ঘুরবো!”
তিতির আরাফের আবদার শুনে মনে মনে হাসলো, তারপর আসছি বলে ফোন কেটে দিলো। আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিয়ে ওড়না গায়ে জড়িয়ে বেড়িয়ে গেলো ঘর থেকে ও। ওর মনটাও আজ ভীষণ খুশি। বুঝতে অসুবিধা হলো না যে ভালোবাসে ফেলেছে ও আরাফকে।
আরাফ গাড়ি নিয়ে বাড়ির সামনেই ছিলো। তিতির আসতেই গাড়ির দরজা খুলে দিলো আরাফ। তিতিরও মুখে হাসি ফুটিয়ে চটপট উঠে পড়লো গাড়িতে।
গাড়ি স্টার্ট দিতেই তিতির অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো আরাফকে-
-” কালকেই তো বিয়ে আমাদের, তাহলে আজকে এতো রাতে বউকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে জাগলো কেনো মিস্টার বরফের?”
তিতিরের মুখে মিস্টার বরফ নামটা শুনে মুচকি হাসলো আরাফ। তারপর সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতেই বলল-
-” বউকে নিয়ে ঘোরার ইচ্ছে রাতেই জাগে ম্যাডাম, আর এই মিস্টার বরফটা কে?”
-“কেনো আপনি!”
তিতির হাসলো সাথে আরাফও। ওদের সম্পর্কটা আবার আগের মতো হবে ভাবতেও স্বপ্নের মতো লাগলো আরাফের কাছে। স্মৃতি না ফেরার সত্বেও যে তিতির আরাফকে এতো সহজভাবে মেনে নেবে ভাবতে পারেনি আরাফ।
-“গাড়ি থামান প্লিজ! আমি আইসক্রিম খাবো”
বাচ্চাদের মতো করে বলে উঠলো তিতির। অধর কামড়ে হেসে গাড়ি থামালো আরাফ। গাড়ি থামাতেই তিতির এক দৌড়ে চলে গেলো আইসক্রিমের গাড়ির কাছে। পিছন পিছন ধীর পায়ে ওর কাছে আসলো আরাফ। তিতির আইসক্রিম কিনে সামনে ঘুরতেই দেখলো আরাফ বুকে হাত বেধে দাঁড়িয়ে ওর সামনে।
আরাফের ঠোঁটের কোনে প্রশান্তির হাসি। তিতির কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই ওর চোখ গুলো ভয়ে বড় বড় হয়ে গেলো। হাত থেকে আইসক্রিমটাও পড়ে গেলো নিচে। মুখ থেকে অস্ফুটত স্বরে বের হলো-
-“বাবা!”
আর হঠাৎ একটা গুলির শব্দ হতেই তিতিরের সামনে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো আরাফ। ওর বুকের তাজা র ক্ত এসে লাগলো তিতিরের পায়ে। এক চিৎকার দিয়ে তিতির বসে জড়িয়ে ধরলো আরাফকে। বুঝতে বাকি রইলো না যে আরাফকে গুলি করা হয়েছে। আর গুলিটা করেছে ওর বাবা।
-” এই আরাফ আপনি চোখ বন্ধ করে আছেন কেনো? কথা বলছেন না কেনো আপনি? সবসময় এতো বকবক করেন তাহলে এখন এভাবে শুয়ে আছেন কেনো? উঠুন বলছি! উঠুন! আমি বাড়ি যাবো! ”
কাঁদতে কাঁদতে বলল তিতির৷ ওর হাত ভিজে যাচ্ছে আরাফের বুক থেকে বের হওয়া র ক্তে। চাইলে থামাতে পারছে না ও সেই র ক্ত। তারপরই শুনতে পেলো ওদের সামনে এসে দাঁড়ানো ওর বাবার কন্ঠ।
-“ও আর উঠবে না মামণি। আরাফ চৌধুরী- ইউর গেম ইজ ওভার!”
(চলবে)…