বউপাখি পর্ব-০৭ এবং শেষ পর্ব

0
115

#বউপাখি
#অন্তিম_পর্ব
#লেখনিতে_সিনথিয়া
-“ও আর উঠবে না মামণি।”
মেয়ের দিকে তাকিয়ে তুচ্ছ হাসলেন সাবেক এমপি হাসান খন্দকার। তারপর আরাফের নিথর দেহটার দিকে দুকদম এগিয়ে এসে বললেন-
-“আরাফ চৌধুরী- ইউর গেম ইজ ওভার!”

আরাফের দেহটা এখনো জড়িয়ে ধরে আছে তিতির। রিভলবার হাতে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তিতিরের বাবা। বিজয়ীর হাসি তার চোখে মুখে। তার পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে পনেরো জনের মতো তার পোষা গুন্ডারা। রাস্তা পাহারা দিচ্ছে তারা। যাতে কোনো কাক পক্ষিতেও আজ ওদের সাহায্য করতে না পারে।

-” অনেক ধুলো-ময়লা মেখেছো, এখন ওঠো মামণি! বাড়ি যাবে না? আর এই লাশটা কেউ একটা আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়ে আয়! পঁচে গলে পরে পরিবেশ দূষণ করবে তো! ”

নিজের কানে তিতির বিশ্বাস করতে পারলো না ওর বাবার বলা কথাগুলো। এতোটা নিষ্ঠুর, এতোটা পাষাণ ওর বাবা? যার কিনা মানুষ খুন করতেও দু’দন্ড হাত কাঁপলোনা? কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ক্রমান্বয়ে তিতিরের দৃষ্টি শীতল হয়। আর সেই হিমশীতল দৃষ্টি জোড়াই নিক্ষেপ করে ওর বাবার দিকে।

-” কেনো করলে বাবা তুমি এমন? কি দোষ করেছিলো আমার আরাফ?”

রাগত স্বরে বলে উঠলো তিতির। মেয়ের কথা শুনে হেসে উঠলো হাসান খন্দকার। তারপর খপ করে তিতিরের এক হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে উঠিয়ে দাঁড় করালো মেয়েকে। বললেন-

-” তুমি হয়তো জানো না মামণি, কিন্তু তোমার এই আরাফ আমার অনেক ক্ষতি করেছে, অনেক। ঐ টুকু ছেলে আমার থেকে আমার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে, আমার মেয়েকে কেড়ে নিয়েছে। তুমি কি করে ভাবলে তোমার বাবা তারপরও এই ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখবে?”

এতুটুকু বলে পিচিক শব্দ করে পানের পিক ফেললেন রাস্তায়। তারপর আবার তিতিরের দিকে তাকিয়ে বললেন-

“যাক গে সেসব পুরোনো কথা। এখন বাড়ি ফিরবে চলো। তোমার সাথে সেদিন সোহেলের বিয়ে না হওয়ায় কিন্তু আমার খুব মন খারাপ হয়েছিলে। বন্ধুর ছেলে বলে কথা। এবার বাড়ি ফিরে তোমার আর সোহেলের আবার বিয়ের আয়োজন করবো আমি।”

নিমেষেই চোয়াল শক্ত হলো তিতিরের।

-“যাবো না আমি। আরাফকে রেখে এক পাও নড়বো না আমি এখান থেকে”

তিতিরের কথা শুনে আবারও একগাল হাসলেন হাসান খন্দকার। তারপর বললেন-

-“আর তুমি যদি এখন আমার সাথে বাড়িতে না আসো মামণি, তাহলে তো জানোই আমি তোমার মায়ের সাথে ঠিক কি কি করবো!”

নিজের বাবার মুখে এই কথাগুলো শুনে হাঁটু ভেঙে বসে পড়লো তিতির। আরাফকে বুকে জড়িয়ে ধরে আবারো ডুকরে কেঁদে উঠলো ও। চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসলো ওর। নিজেকে অসহায় লাগলো ভীষণ। হাসান খন্দকার মেয়ের এমন করুন পরিণতি দেখে যেনো ভীষণ মজা পেলেন। অদ্ভুত শব্দ করে হাসলেন সজোরে। হাসির দমকে থেমে থেমে কেঁপে উঠলো তার পৌঢ় গতর। তারপর নিজের পোষা গুন্ডাদের মধ্য থেকে দু’জনকে ইশারা দিলেন তিতিরকে গাড়িতে তোলার জন্য।

তিতিরকে আরাফের থেকে ছাড়িয়ে নিতে বেগ পেতো হলো ওদের। তবুও টেনে হিঁচরে কোনো মতে তিতিরকে আরাফের থেকে ছাড়ালো ওরা। তারপর গাড়িতে যখন তুলতে যাবে তখনই ওদের কানের গেলো একজনের অট্টহাসির শব্দ।

তিতির থামলো, বিক্ষিপ্ত চোখজোড়া পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলো আরাফের অবয়ব। গাড়ির হেডলাইটের আলোতে ওর মুখ অস্পষ্ট। যেনো এক কালো ছায়ামূর্তি।

হাসান খন্দকারের মুখ শুকিয়ে গেলো নিমিষেই। এটা কি করে সম্ভব। ওনার স্পষ্ট মনে আছে যে উনি আরাফকে ঠিক বুক বরাবরই গুলিটা করেছেন, তাহলে এই ছেলে উঠে দাঁড়ালো কি করে। নাহ্ একবার যখন খুন করতে হাত কাঁপেনি তখন এবারও কাঁপবেনা। তাই তো মূহুর্তেই রিভলবারটা শক্ত করে ধরে তাক করলো আরাফের দিকে।

আরাফ বাঁকা হাসলো। তারপর ডান পায়ের এক লাথিতে কৌশলে ফেলে দিলো সেই রিভলবার হাসান খন্দকারের হাত থেকে। আরাফের পায়ের কাছে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগলো সেটা। মুখ থেকে চ সূচক শব্দ করে আরাফ রিভলবারটা তুলে হাতে নিলো। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো ভালো করে। তারপর বললো-

-” পুরোনো মডেল। কলকব্জায় জং ধরে গেছে, তারপরও কি তেজ। ঠিক আপনার মতো। তাই না শশুর মশাই?”

মুখে বিস্তর হাসি টেনে খুব নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল আরাফ। মূহুর্তেই ফুঁসে উঠলো হাসান খন্দকার। তার পোষা গুন্ডাগুলো এগিয়ে আসতে চাইলেও হাত জাগিয়ে থামিয়ে দিলেন। তারপর থমথমে কন্ঠে বললেন-

-” তুমিহ্?”

-” হ্যা! আমি! খুব অবাক হোলেন না বেঁচে আছি দেখে। আগেরবারের মতো এবারও আপনার এই জং ধরা রিভলবারের গুলি আরাফ চৌধুরীকে মারতে ব্যর্থ। ইশশ্!”

আরাফ মুখ থেকে চুকচুক শব্দ করলো। তারপর ও দৃষ্টি ফেরালো গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকা তিতিরের দিকে। তিতিরকে দেখে ওর শীতল চোখজোড়া যেনো উষ্মতা খুঁজে পেলো। কিন্তু ওর বউপাখিকে অমন বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে কিঞ্চিত কেঁপে উঠলো কালো ঠোঁটজোড়া।

মূহুর্তেই আরাফের চোখ গেলো তিতিরকে ধরে থাকা গুন্ডা দুটোর দিকে। রাগে মাথার রগগুলো দপদপ করে উঠলো ওর। কত্ত বড় সাহস ওর বউপাখিকে ছোঁয়ার স্পর্ধা করেছে ওরা।

আরাফের অগ্নিদৃষ্টি দেখেই পিলে চমকে উঠলো গুন্ডাগুলোর। কিন্তু সতর্ক হওয়ার আগেই আরাফের এক এক ঘুষিতে মাটিতেই লুটিয়ে পড়লো ওরা। ছাড়া পেয়ে তিতির দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো আরাফকে। তিতিরের অশ্রুভেজা মুখখানা জায়গা করে নিলো আরাফের বুকে। আরাফ তিতিরের মাথায় হাত বুলিয়ে তাকালো হাসান খন্দকারের দিকে। বেচারার এতক্ষণে হাঁটু কাঁপা শুরু হয়ে গেছে। আরাফ সেদিকে পাত্তা না দিয়েই চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল-

-” আপনি কি বলুন তো শশুর মশাই? কোথায় এই বয়সে জামাইয়ের কাছে নাতি-নাতনির জন্য আবদার করবেন, তা না করে সোজা জামাইকেই উপরে পাঠিয়ে দিচ্ছিলেন।”

দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে জিভ কাঁটলো আরাফ।তারপর বাঁকা হেসে বলল-

-” ভেরি ব্যাড ম্যানারস্ শশুর মশাই। ভেরি ব্যাড!”

হাসান খন্দকার পেছাতে লাগলেন। বাকি যে দশ বারোজন গুন্ডা রয়েছে তারা আরাফের কাছে যে কোনো ব্যাপারই নয়, ভালোই বুঝতে পারছেন তিনি। তাই এখন পালানোই হলো বাঁচার একমাত্র রাস্তা। কিন্তু পেছন ফিরে পালাতে গিয়েও দেখলেন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে তার পিছনে। বিস্ময়ে তার চক্ষু কোটর
থেকে বেড়িয়ে পড়ার জোগাড়। ওরা যে এখানে আছে তা তো কাকপক্ষীতেও জানার কথা নয়, তাহলে পুলিশ আসলো কি করে এখানে।

-” কি অবাক হচ্ছেন তো শশুর মশাই! ভাবছেন চোরের উপর বাটপারি টা কে করলো তাই তো?”

এক পা সামনে এগিয়ে পকেটে হাত গুজে বলতে লাগলো আরাফ-

-” আমি জানতাম আমার এই কিউট শশুর মশাইটা আমাকে মারার পরিকল্পনা করবেই। তাই তো আগেভাগে তার দেহরক্ষী সাজিয়ে তার কাছেই পাঠিয়ে দিলাম আমার বিশ্বস্ত লোককে। আজকে আমাদের ঘুরতে বের হওয়া আর সে কথা শশুরমশাইকে আমারই লোক দিয়ে জানিয়ে দেয়া, সবটাই ছিলো আমার প্লানের একটা ছোট্ট অংশ।”

আরাফ কথাগুলো বলার ফাঁকেই ডিবি পুলিশ খপ করে ধরে ফেললো হাসান খন্দকারের এক বাহু। যেনো পালাতে না পারে।

-” শশুর মশাইয়ের আসল পিস্তলের বদলে নকল পিস্তল রাখার ব্যাবস্থা করলাম কিন্তু শশুর মশাই কি না সেটা ধরতেই পারলেন না? সেই নকল পিস্তল তুলেই যখন আমাকে ফাঁকা গুলি করলেন তখন আমার ঠিক করা লোকও সিনেমার কায়দায় আমাকে গুলি করলো আর আমার বুক থেকে বেরিয়ে এলো তাজা লাল রং। ভাগ্যিস আগে থেকে সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম, নয়তো আপনার এই পৈচাশিক রূপটা আমার বউপাখি কোনোদিন জানতেই পারতো না। শিট!”

মুখ দিয়ে চ সূচক শব্দ করে হাসান খন্দকারের চোয়াল চেপে ধরলো আরাফ। ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলেন তিনি। তারপর আরাফ তারদিকে কিছুটা ঝুঁকে হিসহিসিয়ে বলল-
-” নাও ইউর গেম ইজ ওভার হাসান খন্দকার।”

পুলিশের লোকজন হাসান চৌধূরীসহ বাকিদের টেনে নিয়ে ওঠালো পুলিশের গাড়িতে। শেষমেশ হাতে হ্যান্ডকাফ পরিহিত সাবেক এমপি হাসান খন্দকারের শেষ গন্তব্য হলো কয়েদখানায়।

যাওয়ার আগে পুলিশ সুপার এসে আরাফকে ধন্যবাদ জানালো এতো বড় একজন ক্রিমিনালকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য। আরাফের বুদ্ধির জোড়েই প্রমান সমেত হাসান খন্দকারের মতো এতো দাপুটে একজন ক্রিমিনালকে ধরা সম্ভব হয়েছে। তারপর আরাফ আর তিতিরকে ওদের বিয়ের জন্য শুভকামনা জানিয়ে বিদায় নিলেন উনিও।

পুলিশ সুপার যেতেই তিতিরকে কোল তুলে নিলো আরাফ। তিতিরও তড়িৎ জড়িয়ে ধরলো আরাফের গলা। আরাফের কাঁধ ভিজিয়ে দিলো তিতিরের উষ্ণ অশ্রুকণায়। ওর নাজুক শরীর মোমের পুতুলের নেয় মিশে গেলো আরাফের শক্তপোক্ত দেহটার সাথে।

-” ভয় পেয়েছিলে?”
নিচু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো আরাফ-
-” খুউউব”
আরাফের ঘাড়ে মাথা গুঁজেই জবাব দিলো তিতির।
-” ভালোবাসো আমাকে বউপাখি? আর কোনোদিন ছেড়ে যাবে না তো আমায়?”

আরাফের প্রশ্নে তিতির মাথা জাগালো। তারপর সম্মহোনী কন্ঠে বলল-
-” তোমাকে এতোটা ভালোবাসি যে দুনিয়া এফোড় ওফোড় হয়ে গেলেও তোমাকে ছেড়ে থাকার কথা কোনোদিন স্বপনেও ভাবতে পারবো না!”

ব্যাস! আরাফকে আর পায় কে। তিতিরের পদ্মপাতার ন্যায় ঠোঁটজোড়া মূহুর্তেই দখলে নিয়ে নিলো নিজের। হাজার বছরের তৃষ্ণার্ত পথিকের ন্যায় পান করতে লাগলো তিতিরের ঠোঁটের অমৃত সুধা। তিতিরও সায় দিলো তাতে। ক্ষাণিক বাদে যখন দু’জনেরই শ্বাস ফুঁড়িয়ে এলো তখন হাঁপাতে হাঁপাতে আরাফ বললো-

-” বিয়ে তো আগে হয়েই গেছে, কাল তো শুধু অনুষ্ঠান। প্রথম বাসরটা সাড়ার জন্য গাড়িটা মন্দ হয় না! কি বলো বউপাখি?”

(সমাপ্ত)