বধূ_কোন আলো_লাগলো_চোখে পর্ব-৯+১০+১১

0
561

#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_৯
#Esrat_Ety

স্ত্রীর মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে গালে হাত রেখে ধরা গলায় ডাকতে থাকে আতাউর আলম।
“ও রেহেনা। ওঠো। রেহেনা।”

রেহেনা সাড়া দেয় না। দীর্ঘসময় ধরে সে অচেতন হয়ে পরে আছে। আজান আয়াত মায়ের পায়ের কাছে বসে আছে। ভেতরের ঘর থেকে আতাউর আলমের মা রিনরিনে গলায় চেঁচিয়ে যাচ্ছে,”আতাউর। এতো চিল্লাচিল্লি কে করে? ও আতাউর,তোর পোলাপান এতো চিল্লাচিল্লি ক্যান করে। ওগোরে ধমক দে।”

রনি ছু’ড়ি টা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে আতাউর আলমকে বলে,”জামিল ভাইয়ের যায়গায় আইসিইউতে যদি আজ ইয়াসার ভাই থাকতো তাহলে এখানে আজ পাঁচটা লা’শ পরে থাকতো।”

আতাউর আলমের কানে সেকথা পৌঁছায় না। সে স্ত্রীর জ্ঞান ফেরাতে ব্যস্ত।
রনি তৌফ নামের ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,”শাওন কই? সামান্য মিষ্টি আনতে এতো দেরি?”

শাওন একটা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢোকে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,”মুসলিম পাড়ায় গিয়ে একটা দোকান খোলা পেলাম। সব শা*লা বন্ধ।”

_হু,তারা তো আর জানে না আমাদের ভাই আজ বিয়ে করবে। তাহলে খোলা থাকতো।

তৌফ নামের ছেলেটা দাঁত বের করে বলে,”ভাই এই আতাউর আলম আর তার বৌ আজ থেকে আমাদের তাঐ-মাঐ।”

রনি পকেট থেকে সিগারেট বের করতে করতে বলে,”হু,আর ওই ফ’ট’কা চালাক মেয়েটা আমাদের ভাবী। আমার তো ভাবতেই রা’গ উঠে যাচ্ছে গায়ে। ভেবেছি ভাই কত মিষ্টি দেখে একটা ভাবী এনে দেবে আমাদের।”

_সুন্দর আছে তো ভাই। খারাপ না। মিষ্টিই তো দেখতে।
তৌফ হাসতে হাসতে বলে।

রনি বলে,”হু, দেখতে মিষ্টি কিন্তু ভয়ানক ঝা’ল। ভাই একে কিভাবে সামলাবে কে জানে।”

সিগারেটে এক টান দিয়ে একটা চেয়ার টেনে নিচু হয়ে ঝুঁকে বসে রনি, আতাউরের চোখে চোখ রেখে বলে,”থানা পুলিশ করবেন না তা জানি তবুও বলছি। থানা পুলিশ করার চিন্তাও করেছেন তো ওখানে আপনার মেয়েকে ইয়াসার ভাই এমন যায়গায় পু*তে দেবে,মেয়ের লা’শ-ও খুঁজে পাবেন না। আর চাচা…সরি…তাঐ, আপনার ছেলে দুটো অনেক ব্রিলিয়ান্ট। ওদের ডাক্তার বানাবেন। ওরা এতো অল্প বয়সে প্রা’ন হারালে এই দেশের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।”
আতাউর আলম আতঙ্কিত মুখ নিয়ে রনির দিকে তাকায়, ফিসফিসিয়ে বলে,”বলবো না। কাউকে কিছু বলবো না।”

দু’চোখ বেয়ে তরল গড়িয়ে পরে আতাউর আলমের। আজ সে ভয়ানক অসহায়। একজন অসহায় বাবা।

“গুড। এবার তাহলে উঠি তাঐ? ওদিকে ভাই আর ভাবীর বাসর সাজাতে হবে গিয়ে। হাতে মেলা কাজ।”

রনি শার্টের হাতা গুটিয়ে নিয়ে সবাইকে বলে,”চল।”

তারপর আতাউর আলমের দিকে তাকিয়ে বলে,”মাঐ মা-এর জন্য একজন ডাক্তার পাঠিয়ে দিচ্ছি। ইয়াসার ভাইয়ের শাশুড়ি এভাবে অজ্ঞান হয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পরে আছে,শুনলে ইয়াসার ভাই খুব রেগে যাবে। আসছি তাঐ। আসসালামুয়ালাইকুম।”

রনির পিছু পিছু দলের সবাই দাঁত বের করে ঘর থেকে বের হয়। আতাউর আলম তার স্ত্রীর মাথায় হাত দিয়ে সদর দরজার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বসে আছে পাথরের মতো।
***
কাজী-কে ফুয়াদ বিদায় দিয়ে পুনরায় ঘরে ঢুকে সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”হয়েছে শান্তি?”

সামিন ইয়াসার থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছে। আড়চোখে আলোর দিকে তাকিয়ে আলোকে দেখে। মেয়েটাকে কেমন বিধ্বস্ত লাগছে। মেঝের দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে।

রাহাত এবং আরাফ শুকনো মুখে তাদের নেতাকে দেখছে। তাদের পুরো ব্যাপারটা হজম করতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। ইয়াসার উঠে দাঁড়িয়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,”রাত সাড়ে তিনটা বেজে গিয়েছে। ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ। নয়তো জামিলের কাছে যেতাম। ওর কি অবস্থা এখন? ডাক্তার কি বলেছে?”

আরাফ বলে,”সেই একই কথা। বাহাত্তর ঘন্টার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।”

সামিন ইয়াসার চোখ মুখ শক্ত করে আলোর দিকে তাকিয়ে ধমকের সাথে বলে,”এইযে নিষ্পাপ বাপের নিষ্পাপ কন্যা। এদিকে তাকাও।”

আলো তাকায় না। সামিন ধমক দিয়ে বলে,”তাকাও বলছি।”

আলো এবার ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকায়। তার সামনে সাক্ষাৎ একজন পি’শা’চ দাঁড়িয়ে। সামিনের দিকে ঘৃণার দৃষ্টি দিয়ে আলো তাকিয়ে থাকে। সামিন ফিচেল হেসে বলে,”বাড়ির মহিলাদের পাঠিয়ে দিচ্ছি। যেকোনো ধরনের অসুবিধা তাদের সাথে বলবে। তবে কোনো তিড়িং বিড়িং করবে না। কাউকে অসম্মান করে কথা বলবে না। বেয়াদবি করবে না। যদি আমার কানে আসে তাহলে কিন্তু!”

_কি করবি তুই? ক্রি’মি’না’ল একটা!

আলো কান্না মিশ্রিত কন্ঠে কথাটি বলে তেড়ে এসে সামিনকে চ’ড় মারতে চায়। সামিন হাত ধরে ফেলে আলোর। সবাই ওদের দেখছে। সামিন ঠান্ডা গলায় বলে,”এতো শক্তি অপচয় করো না।”

তারপর রাহাতের দিকে তাকিয়ে বলে,”আয় আমার সাথে।”
রাহাত, ইলহাম এবং আরাফ সামিনের পিছু পিছু ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
ফুয়াদ আলোর দিকে তাকিয়ে আছে,আমতা আমতা করে বলে,”আলো। দেখো মেয়ে,তুমি এভাবে কেঁদো না। সামিন কিন্তু খারাপ ছেলে না।”

“তুই এখান থেকে যা কু’ত্তা”

আলো চেঁচিয়ে ওঠে। ফুয়াদ একটা ঢোক গিলে ফেলে। সামিন হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে আসে আবারো। চেঁচিয়ে বলে,”কি হচ্ছে ফুয়াদ? ও তোকে কু’ত্তা বললো?”

ফুয়াদ সামিনকে আটকায়,”বাদ দে। চল এখান থেকে।”

সামিন দাঁত খিচিয়ে আলোর মুখোমুখি দাঁড়ায়, পেশীবহুল শক্তিশালী হাতে আলোর থুতনি ধরে নাড়া দিয়ে বলে,”একেবারে জবান কম চালাবে। এটাই প্রথম,এটাই লাস্ট। মনে থাকে যেন।”

কথাটি বলে সামিন চলে যায়। ফুয়াদ তার পিছু পিছু বেড়িয়ে যায়।
আলো আবারো মেঝেতে বসে পরে। তার চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। চোখের সামনে তার আব্বু,আম্মু,আয়াত,আজান, দাদী এবং ইশমামের ছবি ভেসে উঠছে। ইশমামের কথা মনে পরতেই আলো ডুকরে কেঁদে ওঠে। কিছুক্ষণ পরে সে অনুভব করলো সে শ্বাস নিতে পারছে না। গলা থেকে অনেক কষ্টে ফিসফিসিয়ে একটি শব্দ বের হলো। আর সেটা হলো,”ইশমাম।”

***
লিভিং রুমে বাড়ির সব মেয়েরা দাঁড়িয়ে। সামিনকে গেস্টরুম থেকে বের হতে দেখে ইশিতা দৌড়ে যায়,ভাইয়ের দুই বাহু ধরে ঝাকুনি দিয়ে বলে,”কেনো করলে ভাইয়া? ছিঃ। তুমি আমার বড় ভাইয়া? যাকে আমি এতো ভালোবাসি? এ তোমার কোন রূপ ভাইয়া।”
ইলহাম বিরক্ত হয়ে বলে,”ভ্যাজর ভ্যাজর করিস না। ভাইয়াকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দাও কেউ।”

সিতারা দৌড়ে রান্নাঘরে চলে যায়। সামিন ইশিতার দিকে তাকায়। ইশিতা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”বাবা চেন্নাই থেকে ফিরলে কি বলবে তুমি? বলো!”
সামিন ম্লান হেসে বলে,”বাবা খুশি হয়ে যাবে। মেয়ে তুলে এনে বিয়ে করা, উঠিয়ে নিয়ে আসা, এসব এবাড়ির ঐতিহ্য। আমি আমার বাড়ির ঐতিহ্য রক্ষা করেছি। ভুলে গেছিস নাকি? শুনিসনি আমার বাপ-চাচারা সবাই তুলে এনে বিয়ে করেছিলো? বাবা মাকে তুলে এনে বিয়ে করেছিলো, আমাদের দাদা ইন্তেখাব মির্জাও তো দাদীকে তুলে এনেছিলো। এ প্রজন্ম থেকে আমি না হয় এই ঐতিহ্য-টা চর্চা করলাম। ”
ইশিতা আহত চোখে ভাইয়ের দিকে তাকায়। ইয়াসার ইশিতার দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”রিতু।”

রিতু ভয়ার্ত কন্ঠে বলে,”জ্বি ভাইয়া।”

_তুমি এ বাড়ির কি?
_মেজো বৌ ভাইয়া।
_ঐ ঘরের ভেতরে যে আছে সে তোমার বড় জা। এ বাড়ির বড় বউ। আমার মা জীবিত থাকলে এ বাড়ির বড় বউকে বরন করে নেওয়ার জন্য যা যা করতো সে দায়িত্ব আমি তোমার কাঁধে দিলাম। আশাকরি তুমি তোমার দায়িত্ব খুব সুন্দর ভাবে পালন করবে।

রিতু বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ায়। ইশিতার মতো প্রতিবাদ জানানোর সাহস, অধিকার,ক্ষমতা কোনটিই যে তার নেই।

_আর,ওকে কিছু খাবার দাও আগে। খেতে না চাইলে আমাকে ডাকবে। কোনো ধরনের বাজে ব্যবহার কিংবা গালাগাল দিলে দেরি না করে আমাকে ডাকবে।

রিতু আবারো মাথা নাড়ায় ভাসুরের কথায়।

ইশিতা ভাইয়ের দিকে একঝলক রাগী দৃষ্টিতে চেয়ে কপাল কুঁচকে দোতলায় চলে যায়। দোতলায় উঠে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকে সে।

ইলহাম হেসে সামিনকে বলে,”ওর বান্ধবী রিদিকে পছন্দ করে রেখেছিলো তোমার জন্য। সেজন্য রাগ হচ্ছে ওর তোমার উপর।”

ইতিমধ্যে হেনা এসে লিভিং রুমে দাঁড়ায়। শরীরটা অসহনীয় যন্ত্রণায় বিষিয়ে উঠেছে তার। ইয়াসারের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,”ভাইয়া! এটা কি করলেন আপনি। একটা মেয়ের জীবন এভাবে নষ্ট করে দিলেন। জামিল সুস্থ হবে এতে?”
সামিন নরম গলায় বলে,”ঘরে গিয়ে রেস্ট নাও। এতসব চিন্তা মাথায় নিও না। জামিলের বাচ্চার ক্ষতি হবে।”

সিতারা এসে সামিনের সামনে পানির গ্লাস হাতে দাঁড়ায়। সামিন গ্লাসের দিকে একবার তাকিয়ে হনহন করে নিচতলার বারান্দায় চলে যায়।
রিতু চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ইলহাম ধমক দিয়ে বলে,”ভাইয়া কি বললো শুনতে পাওনি? খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছো যে! ”

রিতু আমতা আমতা করে বলে,”কি করবো!”
_কি করবে মানে? ওকে সাজাবে। সাজিয়ে ভাইয়ার ঘরে দিয়ে এসো।
রিতু কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে,”মেয়েটা ভয় পেয়ে আছে‌ । একটু ঠিক হোক।”
ইলহাম চোখ রাঙিয়ে রিতুর দিকে তাকায়। রিতু একটা ঢোক গিলে বলে,”যাচ্ছি।”

***
দরজার নব ঘোরার সাথে সাথে আলো মাথা তুলে তাকায়। তার দৃষ্টি ঘোলাটে। শরীরে বিন্দু পরিমাণ শক্তি অবশিষ্ট নেই। দরজা ঠেলে রিতু এবং বাড়ির দু’জন হেল্পিং হ্যান্ড ( সিতারা এবং ফুলির মা ) ভেতরে ঢোকে। রিতুর হাতে একটা প্যাকেট। সিতারার হাতে একটা প্লেটে কিছু খাবার। ফুলির মা ঘরের এসি অন করে দিয়ে রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”হেরে কি ডাকবো ভাবী?”

_কি ডাকবে আবার। বড় ভাবী ডাকো।

ফুলির মা আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,”মাশাআল্লাহ। চেহারা সুরত তো খুবই চমৎকার। গায়ের রং টা একটু চাপা। তয় বড় ভাইজানের পাশে খুব মানাইবো।”

আলো নড়েচড়ে বসে। রিতুর দিকে তাকায়। রিতু আলোর সামনে এসে হাতের প্যাকেট-টা আলোর পাশে রেখে নিজেও মেঝেতে বসে পরে আলোর মুখোমুখি।
কিছুক্ষণ আলোর দিকে তাকিয়ে থেকে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে হাত বাড়িয়ে সিতারার হাত থেকে খাবারের প্লেট টা নেয়।
আলো চোখ নামিয়ে প্লেটের দিকে তাকিয়ে রিতুর মুখের দিকে তাকায়। ফ্রিজে কাস্টার্ড রাখা ছিলো। সেখান থেকে খানিকটা নিয়ে এসেছে আলোর জন্য। এক চামচ উঠিয়ে আলোর মুখের কাছে ধরে বলে,”খেয়ে নিন‌।”

আলো মুখ সরিয়ে নিয়ে কঠিন গলায় বলে,”খাবো না। নিয়ে যান এসব।”

_ভাইয়া রেগে যাবে। খেয়ে নিন।

আলো এক ঝটকায় রিতুর হাত থেকে চামচ ফেলে দিয়ে কাস্টার্ডের বাটি উল্টে ফেলে।
সিতারা এবং ফুলির মা চাপা স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে,”মেজো ভাবী,বড় ভাইজানরে ডাকবো?”

রিতু ওদের থামিয়ে দিয়ে বলে,”না।”
তারপর আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”ঠিকাছে। খেতে হবে না।তাহলে এই শাড়িটা পরে নিন। আপনার ফিগার মনে হলো আমার মতোই। ব্লাউজ আর পেটিকোট ফিট হয়ে যাবে।”

আলো কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”কেনো পরবো আমি শাড়ি?”

_কারন আপনি নতুন বৌ তাই। এটা আপাতত পরে নিন। এগুলো একেবারেই নতুন,যদিও আমার। কাল আপনার জন্য শপিং করা হবে।

আলো শপিং ব্যাগটা উঠিয়ে দূরে ছুড়ে মেরে রিতুর দিকে তাকায়। কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে,”আপনি না একটা মেয়ে? আমাকে আপনি বুঝতে পারছেন না?”

_পারছি। আপনাকেও পরিস্থিতি বুঝতে হবে। বোকা বোকা জেদ করে কিছু হবে না। শাড়িটা পরে নিন। আপনাকে ভাইয়ার ঘরে দিয়ে আসবো।

আলো তেজী কন্ঠে বলে ওঠে,”অসম্ভব। আমি ম’রে গেলেও ঐ জা’নো’য়া’রের ঘরে যাবো না। ম’রে গেলেও না।

রিতু আলোর দিকে তাকায়। তারপর ঠান্ডা গলায় বলে,”ম’রে গিয়ে লা’শ হয়ে গেলেও ঐ ঘরে আপনাকে যেতে হবে। এ বাড়ির বৌ হয়েছেন, এ বাড়ির নিয়ম জেনে নিন‌। ম’রে যান অথব বেঁচে থাকুন। স্বামীর শোবার ঘরে আপনাকে যেতেই হবে।

আলো ছলোছলো চোখে তাকিয়ে আছে রিতুর দিকে। রিতু উঠে শপিং ব্যাগটা তুলে নিয়ে এসে একটা গোলাপী রঙের সুতির শাড়ি বের করে। আলোর গলা থেকে ওড়নাটা টেনে নিয়ে নিচে ফেলে দিয়ে বলে,”আমি শাড়িটা পরিয়ে দিচ্ছি। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুন। আমি চাইনা আপনি মা’র খান। তাই বলছি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুন।

***
ফজরের আজানের সময় হয়ে এসেছে। আতাউর আলম রেহেনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আজান আয়াত মায়ের পায়ের তালুতে ম্যাসাজ করে দিচ্ছে। রেহেনা কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ডুকরে কেঁদে ওঠে। আতাউর আলম স্ত্রীর মাথাটা নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”শান্ত হও রেহেনা। সব ঠিক হয়ে যাবে। সব কিছু।”

রেহেনা ফোপাতে থাকে,”কি ঠিক হবে? আমার মা’টা আমার বুকে ফিরবে? আমার প্রানটা বুঝি বেরিয়ে গেলো আলোর আব্বু। আমাকে শক্ত করে ধরো।”

মায়ের কথায় আজান-আয়াত ফুঁপিয়ে ওঠে। রেহেনা মাথা তুলে স্বামীর দিকে তাকায়,হঠাৎ করে স্বামীর বুকে কি/ল ঘু/ষি মারতে মারতে বলতে থাকে,”সবকিছুর জন্য তুমি দায়ী। এতো বার বলেছি রাজনীতি নামের ম’র’ন খেলায় নেমো না,নেমো না। তোমার ক্ষমতার লোভে আমি আমার মেয়েটাকে হারালাম। তুমি দায়ী আলোর বাবা। তুমি আমার মেয়েটাকে এনে দাও।”
রেহেনা হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দেয়। আতাউর আলম স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে। আসলেই কি সবকিছুর জন্য সে দায়ী?

****
“ভাই!”

রাহাতের ডাকে সামিন পেছন ফিরে তাকায়। হাতের সিগারেট টা ফেলে দিয়ে পা দিয়ে পি’ষে দেয়। স্বাভাবিক গলায় বলে,”রনি এসেছে?”
_হু ভাই।
_খবর কি ওদিকের?
_আতাউরের স্ত্রী অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। রনি ডাক্তার পাঠিয়ে দিয়েছে।
_গুড, একেবারে আমার ছেলেদের মতো কাজ করেছে। এই রনিকে পুরষ্কার দিতে হবে।

রাহাত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। আরাফ এবং ফুয়াদ চলে আসে। সামিন ইয়াসার বলে,”তোরা এখন এখানে থেকে যা,নিচতলায় রেস্ট নে। ভোর হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ পরে এখান থেকে সোজা হসপিটাল যাবো। ক্যাম্পেইন করতে হবে না আর। নির্বাচনে আমিই জিতবো।”

রাহাত অনেকটা জড়তা নিয়ে বলে,”ভাই বিয়ে তো করে নিলেন এখন কি করবেন?”

_সংসার।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় সামিন ইয়াসার। ফুয়াদ বলে,”তোকে যত দেখছি তত অবাক হচ্ছি। তুই একটা অমিমাংসিত রহস্য।”

সামিন ফিচেল হাসে। ফুয়াদ বলতে থাকে,”আজ কত বড় একটা অন্যায় করলি তুই জানিস? কোনো ক্ষ/মা নেই এর।”

_তোরাও আমাকে সাহায্য করেছিস। তোদের ও কোনো ক্ষ/মা নেই।

ফুয়াদ চুপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে বলে ওঠে,”আমার জীবনের চরম দুর্ভাগ্য তোর মতো বন্ধু পাওয়া।”

সামিন শুকনো হাসি হাসে, তারপর ওদের সবার দিকে তাকিয়ে বলে,”আর আমার জীবনের পরম সৌভাগ্য তোর মতো বন্ধু আর ওদের মতো কিছু ছোট ভাই পাওয়া। এখন পকপক না করে দুঘন্টা রেস্ট নে। শরীরে শক্তি যোগান দে। আমি মেয়র হলে খুশিতে নাচতে হবে তো!”

রাহাত,আরাফ এবং ফুয়াদ চলে যায়। সামিন নিচতলার বারান্দার রেলিং ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তার দৃষ্টি বাইরের বাগানের দিকে। এই বাগানটা সামিনের নিজের হাতে করা,নিজেই সবসময় যত্ন করে বাগানের। ফুলের গন্ধে ছেয়ে গেছে আশপাশ টা। সামিন একটা গভীর নিঃশ্বাস নেয়। পেছন থেকে রিতু নিচু স্বরে ডাকে,”ভাইয়া।”

সামিন বাগানের দিকে দৃষ্টি রেখে বলে,”বলো রিতু। কিছু বলেছে? গালাগাল করেছে তোমাকে?”
_না ভাইয়া।
_খেয়েছে? কি খেতে দিয়েছিলে?
_কাস্টার্ড। খায়নি।
_আচ্ছা না খাক, ঘরে কিছু খাবার রেখে এসো। খিদে পেলে খেয়ে নেবে।

রিতু কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে,”আপনার ঘরে যেতে চাচ্ছে না।”

সামিন রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”কে?”
_ওই মেয়েটা……মানে ভাবী।

সামিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”তুমি যাও। ইহান হয়তো এখন উঠে যাবে। ঘরে যাও। আমি দেখছি!”

***
দরজা ঠেলে সামিন ভেতরে ঢোকে। পুরো ঘর অন্ধকার হয়ে আছে।আলো হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে ঘরের এক কোনায় বসে আছে। সামিন সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দেয়। আলো মাথা তুলে তাকিয়ে সামিনকে দেখে।
সামিন নরম গলায় বলে,”খাওনি কেনো? সামিন ইয়াসার আর ২৪ ঘন্টা পেরোলেই এই শহরের মেয়র হবে,তার শহরে কেউ অভুক্ত থাকুক তা সামিন ইয়াসার মির্জা চায় না।”

কথাটি বলেই সামিন হাসে। তার সে হাসিতে ছিলো আলোর প্রতি বিদ্রুপ। আলো উঠে দাঁড়ায়। তার পরনে শাড়িটা এলোমেলো হয়ে আছে। রিতু কোনোমতে পরিয়ে দিয়ে গিয়েছে। আলো সরাসরি সামিনের চোখে চোখ রেখে বলে,”তুই একটা জা’নো’য়া’র।‌ পি’শা’চ তুই একটা।”

_গলাবাজি ভালোই করতে পারো তুমি। তোমার বাবার থেকে শিখেছো। আমি তোমার বাবার কান্ডজ্ঞান দেখে অবাক হচ্ছি। নিজের পরিবারের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ অথচ সে চললো জনগনের নিরাপত্তা দিতে। মেয়রের দায়িত্ব শুধু বর্ষাকালে সিটি কর্পোরেশনের অলিতে গলিতে মশার ওষুধ স্প্রে করা অথবা শীতকালে কম্বল বিতরণ করা না। আর তার বোকা বোকা কাজ দেখে আরো অবাক হতে হয়। আমাকে না কু’পি’য়ে নিরপরাধ ছেলেটাকে কু’পি’য়ে’ছে।

_আমার বাবা কিচ্ছু করে নি। আমার বাবা কিচ্ছু করেনি।

চেঁচাতে থাকে আলো। সামিন ম্লান হেসে বলে,”ক্ষমতার লোভ কাউকে জেকে ধরলে সে কতদূর নিচে নামতে পারে তা আমি জানি। শোনো সৎ বাবার সৎ কন্যা। তুমি ঠিকই বলেছ,আমি একটা পি’শা’চ। এই পি’শা’চের আরো পৈশাচিক রূপ দেখতে চাও? জানি চাও না। ভালোয় ভালোয় বলছি ওখানে যে খাবারটা রাখা আছে চুপচাপ খেয়ে নাও,নয়তো সেই রূপটাও দেখাবো।”

আলো চুপ করে সামিনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন বলে,”চোখ নামাও। মেয়ে মানুষের চোখ সবসময় নিচু হয়ে থাকবে।”

তারপর কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে,”মাথা মোটা বাবার মাথা মোটা কন্যা। কোন সাহসে তুমি আমার গায়ে হাত তুলেছিলে জানা নেই। তবে তুমি নিজেই সেদিন নিজের জন্য খাল কেটে রেখেছো ‌। প্রত্যেকটা দিন আমাকে অপমান জনক কথা বলে সেই খালে একটু একটু করে পানি দিয়েছো, আজ কুমির তোমার খালে প্রবেশ করেছে।”

_আপনি একটা জা’হি’ল।
নিস্তেজ কন্ঠে বলে আলো।

_খাবার টা খেয়ে নাও।
_খাবো না।
_খেয়ে নাও।
_খাবো না।
_খেয়ে নাও।
_বললাম তো খাবো না।

সামিনের রাগ উঠে যায়। আলোর দিকে এগিয়ে যায় সে। আলো তেজী কন্ঠে বলে,”এদিকে এগোলে কিন্তু!”

_কি করবে তুমি?

সামিনকে কিছুটা অবাক করে দিয়ে আলো সামিনের মুখের উপর থুতু ছুড়ে মারে। ক্ষোভে সামিন হাত উঠায় আলোকে চ*ড় মারবে বলে। তৎক্ষণাৎ আলো নিজের গালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে ফেলে। সামিন থেমে যায়। চ*ড় না মেরে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে সে। আলো গালে হাত দিয়ে,চোখ বন্ধ করে রেখেছে।

চলমান……..

#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_১০
#Esrat_Ety

নয় ঘন্টা আগে শেষ অনলাইনে এসেছিলো অদ্রিতা। দশমিনিট পরপর ইশমাম ফোন হাতে নিয়ে চেক করে দেখেছে অদ্রিতা অনলাইনে এসেছে কিনা। কিন্তু প্রত্যেকবার ফোন হাতে নিয়ে হতাশ হয়েছে সে। ফোনটা একটা ডিভানের উপরে ছুঁড়ে মেরে ইশমাম বসে থাকে চুপচাপ। আলোর প্রতি প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার। রাতে বাড়িতে এসে একটা বার ফোন দিয়ে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি সে। নিশ্চয়ই এসেই ঘুমিয়ে গিয়েছে। বড্ড ঘুমকাতুরে মেয়েটা। ইশমামের সারাটা দিন কেটেছে অস্থিরতায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ইশমাম সময় দেখে, সন্ধ্যা ছয়টা। তারমানে বাংলাদেশে এখন সময় সকাল পাঁচটা। এতো সকালে অদ্রিতা ঘুম থেকে ওঠার মেয়ে নয়। কি জানি কখন ঘুম ভাঙবে মহারানীর, কি জানি কখন মনে পরবে তার যে তার একটা ফোনের জন্য কেউ অপেক্ষা করে বসে আছে।
***
সামিন আলোর মুখের দিকে দীর্ঘসময় তাকিয়ে থাকে। আলো নিজের গালে কোনো চ*ড়ের অস্তিত্ব টের না পেয়ে ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকায়। তাকিয়ে দেখে পি’শা’চ টা তার দিকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে তাকে দেখছে। ঘেন্নায় আলোর গা গুলিয়ে ওঠে। নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে দুই কদম পিছিয়ে দাঁড়ায়। সামিনের চোখে আলোর অস্বস্তি ধরা পরে। সে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,”চার ঘন্টা আগে আমাদের বিয়ে হয়েছে। জোর করে হোক, জুলুম করে হোক, যেভাবেই হোক, বিয়েটা হয়েছে। তুমি আমার স্ত্রী। আমার অধীনস্থ তুমি। বারবার থুতু দেওয়া,চ’ড় মারা আমি বরদাস্ত করবো না। ভদ্র হয়ে থাকতে বলেছি, ভদ্র হয়ে থাকো। তোমার এবং তোমার পরিবারের জন্য সেটাই ভালো হবে।”

কথাটি বলে সামিন ইয়াসার ঘর থেকে হনহনিয়ে বের হয়। তার শরীরের ধাক্কা লেগে দরজার কপাট বিকট শব্দে কাঁপতে থাকে। আলো ধপ করে মেঝেতে বসে পরে। আশ্চর্য ব্যাপার,তার চোখে এখন পানিও আসছে না!

***
“পেশেন্টের অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল। হাত পায়ের রগ কেটে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিলো। মারাত্মক ভাবে আহত সে। বারবার একই কথা জিজ্ঞেস করবেন না। শুধু আল্লাহকে ডাকুন।”

সামিন ইয়াসার ডাক্তারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নরম গলায় বলে,”বাঁচবে তো?”

_আশা করা যায়। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা অন্যরকম হলে আমাদের তো কিছু করার নেই।

ডাক্তার চলে যেতেই সবুজ ইয়াসারের দিকে তাকিয়ে বলে,”ভাই! কতটা নি’র্দ’য় হলে কেউ হাত পায়ের রগ কে’টে জা’ন নেওয়ার কথা ভাবতে পারে!”

ইয়াসার চুপ করে থাকে। রনি বলে,”শা’লা পুরোটাই ভণ্ড! আগে তো ক্রা’ই’ম রিপোর্টার ছিলো। ক্রা’ই’ম নিয়ে রিপোর্ট করতে করতে শিখে গিয়েছে সব।”

সামিন একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,”আতাউর আলমের আপডেট কি?”

_বাড়ি থেকে কেউ বের হয়নি। কেউ বাড়িতে ঢোকেনি।

সামিন আর কিছু না বলে হাঁটতে শুরু করে। রাহাত বলে,”কই যাচ্ছেন ভাই?”
_বাড়িতে। তোরা এখানে থাক। কোনো সমস্যা হলে আমায় ফোন দিবি। ফুয়াদ এবং আরাফ আমার সাথে আয়।

রাহাত এবং রনি মাথা নাড়ায়। ফুয়াদ এবং আরাফ সামিনের সাথে চলে যায়।

তৌফ রাহাতের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,”ঘরে নতুন বৌ রাইখা অন্য কোথাও মন টিকবে এখন?”

রাহাত চোখ রাঙানি দিয়ে বলে,”ফাজলামির কথা বলিস না। আমাদের মন মেজাজ ঠিক নেই। কাল সারারাত কেউ ঘুমাইনি।”

রনি রাহাতের দিকে তাকিয়ে বলে,”কাল কিছু হয়েছিলো? ভাইয়ের বাসর?”
_কি একটা বিয়ে,তার আবার বাসর। থাপ্রা থাপ্রি আর থুতু ছোড়াছুড়ি হয়েছিল শুধু। এই মেয়ের তেজ কমে এতো সহজে? ভাইয়ের মাথায় কি চলতেছে কে জানে! বিয়ে কোন ধরনের প্রতিশোধ বলতে পারিস? এটা কি স্টার জলসা? হুদাই…. ভাইয়ের মাথায় সমস্যা দেখা দিয়েছে ‌‌। আলো যেদিন ভাইকে চ’ড় মে’রে’ছি’লো সেদিন থেকেই সমস্যা ভাইয়ের মাথায়। ভাই তো আগে এরকম ছিলো না।

তৌফ হাসতে হাসতে বলে,”ভাই আমার মনে হয় ইয়াসার ভাই এই মেয়েটাকে পছন্দ করতো। দেখেন নি? যখনই বলতেন ভাই মেয়েটাকে কিছু করেন, মেয়েটাকে কিছু করেন তখনই ভাই বলতো বাদ দে শুধু নজর রাখ,বাদ দে শুধু নজর রাখ। আর একটু গভীর ভাবে চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন,যে মানুষটা বিয়ে-ই করতে আগ্রহ দেখাতো না সে বিয়ে করে নিলো হুট করে,তাও আবার শত্রুর মেয়েকে। আশ্চর্য না বিষয়টা!”

***
ইশমামের অস্থিরতা বাড়তে থাকে। পনেরো ঘন্টার বেশি হয়ে গিয়েছে অথচ অদ্রিতা তার সাথে কোনো যোগাযোগ করছে না। আচ্ছা,অদ্রিতার ফোনটা নষ্ট হয়ে যায়নি তো! অদ্রিতা তো প্রায়ই বলতো তার ফোনটা কাজ করছে না। কিন্তু সেটা হলেও তো অদ্রিতা কোনো না কোনোভাবে তাকে ইনফর্ম করে দিতো। যত সময় যাচ্ছে, অস্থিরতা বেড়ে চলেছে ইশমামের। বারবার ফোন হাতে নিয়ে চেক করা ছাড়া আর কিছুতেই মন দিতে পারছে না সে।

ফুয়াদ গাড়িতে উঠে ড্রাইভিং সিটে বসে। সামিন তার পাশে বসে। আরাফ পেছনের সিটে। ফুয়াদ গাড়ি স্টার্ট করার আগে সামিনের দিকে একবার তাকায়।

“সত্যিই বাড়িতে যাবি? পার্টি অফিসে যাবি না? মিটিং ডেকেছিলি তো।”
_না। আগামীকাল ভোটকেন্দ্র গুলোতে যাবো সোজা। লোক লাগিয়ে দিয়েছি,তারা সবটা দেখবে।

ফুয়াদ গাড়ি স্টার্ট করে। সামিন সামনের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বসে আছে। কিছুদূর যাওয়ার পরে ফুয়াদ বলে,”একটা কথা বলতো? তুই তো একটা শিক্ষিত ছেলে। তাও এরকম একটা বোকামি কেনো করলি? এভাবে বিয়ে হয়?”
_হয়েছে তো, ও কবুল বলেছে,আমি কবুল বলেছি। তিন লক্ষ টাকা কাবিন ধরে বিয়ে করেছি। কিছুদিন পরে কাবিনের কপি বের হবে।

ফুয়াদ ড্রাইভ করতে করতে বলে,”সেটা বলিনি আমি। না ও তোকে ভালোবাসে,না তুই ওকে ভালোবাসিস। এই বিয়ের পরিণতি কি হবে?”

সামিন চুপ করে থাকে। ফুয়াদ বলে,”জেদ করে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করলি। ওর বাবা যদি দোষী হতো তাহলে থানায় যেতি। পুলিশে ধরিয়ে দিতি। তুই কেনো আইন নিজের হাতে তুলে নিলি?”

_ওর বাবাকে অন্য কেউ মেরেছিলো,ও কেনো থানাপুলিশ না করে, অপরাধী শনাক্ত না করে সরাসরি আমায় থাপ্পর মেরেছিলো?

_বাবার প্রতি মেয়ের ইমোশন টা বোঝার চেষ্টা কর। আলো একটু অন্যরকম মেয়ে।

_গাড়ি থামা।

গম্ভীর কন্ঠে বলে সামিন ইয়াসার। ফুয়াদ হুট করে ব্রেক কষে। সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমাকে এই মাঝ রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে যাবি? অন্তত বাড়িতে দিয়ে আয় আমাকে। একটু ঘুমাবো আমি।”

সামিন ম্লান হেসে বলে,”আমার সাথে ভেতরে চল। কেনাকাটা করতে হবে।”

ফুয়াদ মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। একটা শপিং মলের সামনে তাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। একবার সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”কি কিনবি? কার জন্য কিনবি?”

_আমার বৌয়ের জন্য। সামিন ইয়াসারের বৌয়ের জন্য।
তাচ্ছিল্যের সাথে বলে সামিন‌। তার মুখে বিদ্রুপের হাসি।
***
মাম্মার বারন স্বত্তেও ইহান বারবার এসে নিচ তলার গেস্টরুমে উঁকি দিচ্ছে। মাম্মা বলেছে বাড়িতে নাকি কেউ এসেছে। সে নাকি ইহানের বড় মা হয়। বড় বাবার বৌ। ইহান খুবই উৎসুক হয়ে আছে তার বড় মাকে দেখবে বলে। কিন্তু মাম্মা বারবার ধমক দিচ্ছে। ঘরের ভেতর যেতেই দিচ্ছে না ইহানকে। চুপচাপ লিভিং রুমে কিছুক্ষণ পায়চারি করে আশেপাশে তাকায় ইহান। রিতু এখন রান্নাঘরে। বাড়ির সবাই দোতলায় আছে,কেউ নিচে নামেনি। ইহান সুযোগ পেয়ে গুটি গুটি পায়ে গেস্টরুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ছোটো ছোটো দুটি হাত দিয়ে গেস্ট রুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে দরজা খোলে।

ঘরে ঢুকে ইহান আশেপাশে তাকায়। কোথাও কাউকে দেখতে না পেয়ে ইহান বের হয়ে যেতে নেয় ঠিক তখনই ইহানের চোখ চলে যায় মেঝের দিকে। কেউ একজন মেঝেতে শুয়ে আছে।

ইহান গুটি গুটি পায়ে আলোর কাছে যায়। প্রচন্ড খিদে এবং ক্লান্তিতে চোখ বুজে, হাত দিয়ে পেট চেপে ধরে মেঝেতে পরে ছিলো আলো। কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে আলো হকচকিয়ে উঠে বসে। সে ভেবেছিলো আবার বোধ হয় সামিন ইয়াসার নামের পি’শা’চ টা এসেছে। মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখে একটা ফুটফুটে বাচ্চা ছেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আলো ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থাকে। ইহান বলে,”তুমি কি বড় মা?”

আলো তার ঘোলাটে দৃষ্টি দিয়ে ইহানকে দেখে। ইহান বলতে থাকে,” তুমি বড় বাবার বৌ?”

ঘনঘন নিশ্বাস ফেলতে থাকে আলো। ইহান ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আলোর দিকে। আদুরে গলায় বলে,”তুমি কি বড় মা? বলো।”

_চলে যাও এখান থেকে।

তেজী কন্ঠে বলে আলো। ইহান ভয় পেয়ে যায় আলোর কন্ঠস্বর শুনে। আলো চেঁচিয়ে ওঠে,”বললাম না চলে যাও এখান থেকে। যাও বলছি! চলে যাও,চলে যাও।”

ইহান “মাম্মা” বলে একটা বিকট চিৎকার দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায় আলোর ঘর থেকে।

***
বেলা দেড়টা নাগাদ ইয়াসারের গাড়ি শান্তিনীড়ের গেইট দিয়ে ঢোকে। গাড়ি থামিয়ে নেমে পরে সে। পোনা এসে দাঁড়ায় পোর্চের সামনে। ইয়াসার গাড়ি থেকে নেমে পোনা চাচাকে বলে,”চাচা রিয়াজকে বলো গাড়ি থেকে প্যাকেট গুলো নামাতে। বাড়ির ভেতরে দিয়ে আসতে বলো।”

তারপর কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করে,” বাড়িতে সব ঠিক ঠাক? কোনো ঝামেলা হয়নি তো?”

পোনা মাথা নাড়ায়। মুখে বলে,”কোনো ঝামেলা হয়নি তবে,”

_তবে কি?
_বড় মা ইহান বাবুকে ধমক দিয়েছে। বকেছে।
_বড় মা? কে বড় মা?
পোনা চাচার কথা বুঝতে না পেরে সামিন অবাক হয়ে জানতে চায়। পোনা থতমত খেয়ে বলে,”বড় বৌমা। তোমার বৌ।”

সামিন হতভম্ব হয়ে সদর দরজার দিকে তাকায়। ধমক দিয়েছে মানে। কি দুঃসাহস! সামিন ইয়াসার হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির ভেতরে যায়। ভেতরে ঢুকে রিতুকে ডাকতে থাকে। রিতু এসে সামনে দাঁড়ায়।

“আলো ইহানকে বকেছে?
কঠিন গলায় জানতে চায় ইয়াসার। রিতু আমতা আমতা করে বলে,”ভাইয়া জানেনই তো ইহান অচেনা লোক দেখলে তাদের কিভাবে বিরক্ত করে। ভাবীকে কিছু বলবেন না।”

রিয়াজ এসে প্যাকেট গুলো লিভিং রুমে রেখে চলে যায়।
রিতু সেদিকে তাকিয়ে বলে,”এগুলো কি ভাইয়া?”

ইশিতা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে। সামিন বলে,”শাড়ি আছে এখানে। নতুন বৌয়ের জন্য।”
রিতু কিছুক্ষণ সামিনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,”শুধু শাড়ি?”

_হ্যা, বাইশটা আছে। কম হয়ে গিয়েছে?
রিতু আমতা আমতা করে বলে,”ভাইয়া বাইশ টা শাড়ি দিয়ে কি হবে। আর নতুন বৌয়ের জন্য শুধু শাড়ি কেনা হয় না। শাড়ির সাথে আনুষঙ্গিক অনেক কিছু কিনতে হয়।”

সামিন রিতুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমি তো জানি না। তুমি বললে শাড়ির কথা। তাই নিয়ে এলাম।”

তারপর আবার চুপ করে থেকে বলে,”ঠিকাছে। যা যা লাগবে তুমি আর ইশিতা গিয়ে নিয়ে এসো বিকেলে।

রিতু মাথা নাড়ায়। ইশিতা কঠিন গলায় বলে,”আমি পারবো না।”

সামিন বোনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রিতুকে বলে,”ওকে নিয়ে এসো।”
_আসবে না ভাইয়া। অভুক্ত থাকায় অবস্থা কাহিল হয়ে গিয়েছে তবুও জেদ করে কিছু খাচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করেছি।”

সামিন রিতুর কথা শুনে গেস্টরুমের দিকে যায়,রিতু নিচু স্বরে বলে,”ভাইয়া প্লিজ গায়ে হাত তুলবেন না।”

“ভাইয়া ভাইয়ার বৌয়ের সাথে কি করবে সেটা তুমি বলে দেবে?”

পেছন থেকে ধমক দেয় ইলহাম। রিতু মুখ অন্ধকার করে দাঁড়িয়ে থাকে। আলো নামের অচেনা মেয়েটির জন্য তার খুব মায়া হচ্ছে। তারা একই রকমের কপাল নিয়ে জন্মেছে যে।

দরজা ঠেলে সামিন ভেতরে ঢুকে দরজা চাপিয়ে দেয়। আলো হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে বসে ছিলো মেঝেতে। মাথা তুলে তাকায় সামিনের দিকে। আলোর বিধ্বস্ত মুখটা দেখে হঠাৎ করে সামিনের অদ্ভুত অনুভূতি হয়। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”ইহান ছোট মানুষ। ও তো আর আমার মতো পি’শা’চ না। ওকে কেনো ধ’ম’কা’লে। ও একটা পাঁচ বছরের বাচ্চা।”

_এখন না হলেও একদিন ঠিকই আপনার মতো পি’শা’চ হবে ও। ওর শরীরে এই বংশের রক্ত।

সামিন একটা চেয়ার টেনে বসে বলে,”ষোল ঘন্টা না খেয়ে আছো। তারপরও গলায় কি জোর তোমার।”

_হাতেও অনেক জোর। দেখাবো?
ঠান্ডা গলায় বলে আলো। সামিন আলোর কথা শুনে বাঁকা করে হাসে। তারপর বলে,”শুনেছি তুমি কারাতে জানো। জাতীয় পর্যায়ে তৃতীয় হয়েছো। তবে এতেই নিজেকে অনেক কিছু ভেবে বসো না। যাদের সাথে ল’ড়ে’ছো তারা সবাই মেয়ে। দুর্বল প্রজাতি। আমি পুরুষ মানুষ। সিংহ পুরুষ। একটা মোটামুটি ধরনের চড় দিলে এখানে তিনদিন পরে থাকবে। ”

আলো সামিনের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন বলে,”শোনো আত্মবিশ্বাসী বাবার আত্মবিশ্বাসী কন্যা ‌। তোমাকে একটা সুখবর দেই। তোমার মা সুস্থ আছে। অবশ্য তার সুস্থতা তোমার উপর নির্ভর করবে। যদি এখানে বাঁদরামি করেছো তাহলে ওখানে…..”

সামিন থেমে আলোর দিকে তাকায়। আলোর চোখে উৎকণ্ঠা। সামিন বলে,”আমার সাথে চলো।”

_কোথাও যাবো না। আমি শুধু আব্বু আম্মুর কাছে যাবো। আমাকে যেতে দিন।

_কেনো যাবে? তুমি এখন আমার স্ত্রী।
_এই বিয়ে আমি মানি না।
তেজী কন্ঠে বলে ওঠে আলো তারপর উঠে দাঁড়ায়। শরীরের দুর্বলতার জন্য ঠিকভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেও পারছে না সে। সামিন একবার আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”চলো।”
_যাবোনা।
দাঁত খিচিয়ে বলতে চায় আলো। সামিন শীতল চোখে আলোর দিকে তাকায়। তারপর আলোর হাত ধরে টানতে টানতে গেস্টরুম থেকে বের করে আনে। আলো নিজের হাতটাকে সামিনের হাত থেকে ছাড়ানোর প্রানপন চেষ্টা করে। কিন্তু সে অপারগ।

***
রেহেনা স্বামীর মাথায় হাত রাখে। চোখ বুজে ইজি চেয়ারে আধশোয়া হয়ে বসে আছে আতাউর আলম। স্ত্রীর হাতের স্পর্শে চোখ খুলে তাকায় সে। রেহেনার মুখের দিকে তাকিয়ে অস্বাভাবিক ঠান্ডা গলায় বলে,”মেয়েটার মন টা এখন কেমন করছে রেহেনা! নিশ্চয়ই গলা কা’টা মুরগির মতো ত’ড়’পা’চ্ছে।”

রেহেনা কান্না আটকে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আতাউর বলে,”তুমি ঠিক বলেছিলে রেহেনা। আমার মতো মানুষদের জন্য রাজনীতি মানায় না। রাজনীতি মানায় ইয়াসারের মতো জা’নো’য়া’র’দের যারা টাকা দিয়ে কিছু মানুষ রুপী পশু পোষে। আমার যদি আজ ওরকম কিছু পশু থাকতো তাহলে আজ দিনটা অন্যরকম হতো।”

_চলো না, পুলিশের কাছে যাই। একবার ধরিয়ে দিলে কিচ্ছু করতে পারবে না ওরা।
রেহেনা ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে। আতাউর বলে,”তুমি জানো না রেহেনা। ওরা কি করতে পারে! তোমার কোনো ধারণা নেই। ইশতিয়াকের কাহিনী মনে আছে তোমার? মারুফার সাথে কি হয়েছিলো ভুলে গেলে? আমি আমার মেয়েটাকে হারাতে পারবো না।”

_আতাউর আলম ভয় পাচ্ছে? এতো সহজে হার মেনে নিলো আতাউর আলম?
_না। একজন বাবা ভয় পাচ্ছে রেহেনা।

এমন সময় ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। আতাউর আলম চমকে উঠে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে। ওপাশ থেকে কন্ঠে বিদ্রুপ নিয়ে তার চাচাতো ভাই খোরশেদ বলে ওঠে,”আগামীকাল নির্বাচন আর আজ স্বতন্ত্র প্রার্থী আতাউর আলম নির্বাচন বর্জন করছে? খবরটা কি সত্যি?”

আতাউর আলম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”সত্যি।”
শব্দটি মুখ থেকে উচ্চারণ করেই ফোন কেটে দেয় সে।

***
সামিন ইয়াসার আলোকে টানতে টানতে এনে লিভিং রুমে দাড় করায়। আলো কিছুটা টলছে। সামিন রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”ওকে কিছু খাওয়াও।”

_আমি খাবো না। এই বাড়ির কিছু আমি মুখে দেবো না। বললাম তো।

চেঁচিয়ে বলতে থাকে আলো। সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”কতক্ষন থাকবে না খেয়ে? আচ্ছা ঠিকাছে। আমিও দেখতে চাই তুমি কতক্ষন না খেয়ে থাকো।”

আলো সামিনের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সিতারা এসে রিতুর হাতে একটা গ্লাস দিয়ে বলে,”বড় ভাইজানের মিন্ট লেমন ভাবী!”
রিতু গ্লাসটা সামিনের হাতে তুলে দিতে যাবে তখনি ইলহাম ধমকের সুরে বলে,”তুমি কেনো দিচ্ছো? ভাইয়ার বৌ দেবে। ওর হাতে গ্লাস দাও।”
সামিন আলোর দিকে তাকায়। রিতু আমতা আমতা করতে থাকে। ইশিতা আলোকে দেখে। আলো সবাইকে অবাক করে দিয়ে রিতুর হাত থেকে গ্লাসটা নেয়। তারপর সামিনের চোখের দিকে একবার তাকিয়ে গ্লাসের পানীয় টুকু সামিনের মুখে ছুড়ে মারে।

ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই চমকে ওঠে। আলো গেস্টরুমের দিকে ছুটে যায়। তার দুর্বল শরীর নিয়ে ছুটতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি সে নিচে পরে যাবে!

সামিন ভেজা মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আলোকে দেখে। সবাই তাকে দেখছে। কিছুক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে নিয়ে সে নিজের ঘরে চলে যায়।

***
মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে মুখটা পরিষ্কার করে ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে আসে সামিন। গায়ের পাঞ্জাবিটা একটানে খুলে রকিং চেয়ারের উপরে ছুঁড়ে মেরে বিছানায় এসে বসে। হাত বাড়িয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে সময় দেখে সে। বেলা তিনটা প্রায়। হঠাৎ ইশমামের কথা মনে পরে তার। ইশমামকে তো এসবের কিছুই জানানো হয়নি। এসব জানতে পারলে নিশ্চয়ই খুব রিয়াক্ট করবে। সামিনের ভালো মানুষ ভাই বলে কথা। সামিন আনমনে হাসে, ইশমাম একেবারেই মায়ের মতো হয়েছে ,স্বচ্ছ। ফোনটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ইশমামকে ফোন দেওয়ার মনস্থির করেও ফোন দেয়না। এখন নিশ্চয়ই ঘুমোচ্ছে। শুধু শুধু বিরক্ত করে কি লাভ। এমন সময় ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে,”ফোনের স্ক্রিনে যার নাম্বার টা ভেসে উঠেছে তার নাম হলো আতাউর আলম। এখন ফোন ধরলেই “ইয়াসার আমার মেয়েটাকে একটু দেখবো,ইয়াসার আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দাও,ইয়াসার আমি তোমার পা ধরবো” এসব বলে বলে কাঁদবে , ইয়াসার তা জানে। সে রিসিভ করে না ফোনটা। তড়পাতে থাকুক, যতক্ষন জামিল আইসিইউতে থাকবে, ততক্ষন আতাউর আলম-ও মেয়ের সাথে কথা বলতে না পারার যন্ত্রনায় তড়পাতে থাকুক।

ফোনটা সুইচ অফ করে রেখে সামিন উঠে দাঁড়িয়ে খালি গায়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলে,”পি’শা’চ সামিন ইয়াসার মির্জা।”

এমন সময় দরজায় টোকা পরে ইয়াসারের। গম্ভীর কন্ঠে জানতে চায়,”কে?”

ফুলির মা চেঁচিয়ে বলে ওঠে,”নতুন ভাবী জ্ঞান হারাইছে ভাইজান।”

চলমান……..

#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_১১
#Esrat_Ety

গায়ে একটি নেভি ব্লু রঙের পলো টি-শার্ট চাপিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে নিচ তলার গেস্টরুমের দিকে যায় ইয়াসার। আলো অ’চে’ত’ন হয়ে মেঝেতে পরে আছে। তাকে ঘিরে বসে আছে রিতু,ইশিতা,হেনা ও ফুলির মা। সামিন কে দেখে রিতু উঠে দাঁড়ায়। আতঙ্কিত মুখ নিয়ে বলে,”ভাইয়া অবস্থা খুব খা’রা’প মনে হচ্ছে। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দেই?”
_পানি ছিটানোর থেকেও পানি খাওয়ানোটা জরুরি রিতু। ওকে উঠিয়ে বিছানায় শুইয়ে দাও।

সবাই ধরাধরি করে আলোকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেয়। ইশিতা ভাইয়ের দিকে রাগী দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। সামিন ইয়াসার তার দিকে তাকিয়ে বলে, “পরীকে ফোন করে ডাক। এসে দেখুক।”

ইশিতা কপাল কুঁচকে বলে,”পরী কি ডাক্তার? ও স্টুডেন্ট। আর পরীকে-ই কেনো ডাকবো? ডাক্তার এলে তোমার অপকর্ম সব ফাঁস হয়ে যাবে সেই ভয়ে?”

_হ্যা তাই!
তেজী কন্ঠে বলে ওঠে ইয়াসার। ইশিতা আহত চোখে ভাইকে কিছুক্ষণ দেখে। তারপর পরী নামের মেয়েটাকে ফোন করে আসতে বলে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে,”তোমার কি হয়েছে ভাইয়া? কেনো করছো এমন তুমি?”

_বললাম না বংশের ঐতিহ্য চর্চা করছি!

ইশিতা দৃঢ়ভাবে বলে,”জোর করে বিয়ে হয়? এই বিয়েটাই হয়নি। তুমি ওকে ওর পরিবারের হাতে তুলে দাও ভাইয়া। শত্রুতার জের ধরে তুমি মেয়েটার গোটা জীবন টা এভাবে নষ্ট করো না। মনে রেখো তোমারো বোন আছে।”

_আমার বোনের জন্য আমি আছি। ভয় পাচ্ছি না তোর কথায়।

ভাইয়াকে কিছু বলা বৃথা। ইশিতা করুণ দৃষ্টিতে বিছানায় অচেতন হয়ে পরে থাকা আলো নামের মেয়েটিকে দেখে। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের মায়াবী মুখটা কিরকম মলিন হয়ে আছে। ভাইয়া কিভাবে পারছে এমনটা করতে। তার কেনো একটুও মায়া হচ্ছে না!
***
রেহেনার হাতের পানির গ্লাস টা হাত থেকে মেঝেতে পরে ভেঙে গিয়ে তীব্র আওয়াজ হয়। কাঁচের টুকরো গুলো গোটা মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। স্ত্রী পুনরায় অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরেছে ভেবে আতাউর আলম ছুটে আসে। এসে রেহেনার দিকে তাকিয়ে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে । রেহেনা থমথমে মুখ নিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,”আলোর আব্বু, মেয়েটার কি হলো আলোর আব্বু!”

আতাউর আলম এগিয়ে আসে স্ত্রীর কাছে। রেহেনা হাউমাউ করে কেঁদে দিয়ে বলে,”মেয়েটার গায়ে হা’ত তুলছে, নিশ্চয়ই মেয়েটাকে মা’র’ছে খুব।”

মায়ের চি’ৎ’কা’র শুনে আজান আর আয়াত ছুটে এসে দাঁড়ায়। রেহেনার শরীরটা হঠাৎ কেঁপে ওঠে। আতাউর আলম এসে স্ত্রীকে ধরে। রেহেনা অস্ফুট স্বরে বলে,”মেয়েটাকে দেখবো,কথা বলবো মেয়েটার সাথে। তুমি ঐ প’শু টাকে ফোন করে বলো আমরা সবাই মিলে ওর পা’য়ে পরবো। ও শুধু মেয়েটার সাথে একটু কথা বলিয়ে দিক। আতাউর আলম দুচোখ বন্ধ করে একটা নিরব আর্তনাদ করে ওঠে। সে তো সেই কখন থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছে আলোর সাথে একটু কথা বলবে বলে। নির্দয়,প’শু, পাষণ্ড ইয়াসারের মন গলেনি।

আজান আয়াত একে অপরের মুখের দিকে তাকায়। ছোটো থেকে বন্ধু মহলে সবাই তাদের ক্ষেপিয়ে এসেছে “লুজার্স টুইন” বলে। জীবনের এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে তাদের এটাই মনে হচ্ছে,তারা আসলেই লুজার্স।

হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজ হয়। আতাউর আলম স্ত্রীকে ছেড়ে দিয়ে গিয়ে দরজা খোলে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে রনি। হাতে একটা প্যাকেট তার। মুচকি হেসে আতাউর আলমের দিকে প্যাকেট টা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,”মাঐ মা-এর ব্লাড প্রেশারের ওষুধ।”

***
ধীর পায়ে গেস্ট রুমে ঢুকে পরী প্রথমে সামিনের দিকে তাকায়। সামিনের দিকে তাকিয়ে একটা ঢোক গিলে সে চোখ নামিয়ে নেয়। শ্রদ্ধা করলেও সামিন ভাইয়াকে সে ভীষণ ভয় পায়, সজ্ঞানে কখনো সামিনের সামনে পরে না সে। পরীর পিছু পিছু ঘরে ঢোকে পোনা। পরী পোনার মেয়ে। দুধে আলতা গায়ের রং নিয়ে জন্মেছিল বলে পোনা খুব শখ করে মেয়েটির নাম রেখেছিলো পরী। পরী আসলেই পরীর মতো দেখতে। ঘরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকিয়ে পরী পোনার দিকে তাকায়। পোনা চোখ দিয়ে ইশারা করে পরীকে বিছানার দিকে তাকাতে বলে।

সে বিছানায় শুয়ে থাকা আলোকে একবার দেখে পুনরায় নিজের বাবার দিকে তাকায়। পোনা মৃদু স্বরে বলে,”বড় ভাবী তোর।”

আলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কিছুক্ষণ দেখে সে। মায়াবী মুখশ্রী। তাকালে সহজে চোখ ফেরানো যায়না। ধীরপায়ে হেটে গিয়ে বিছানার পাশটাতে বসে। আলোর পালস রেট চেক করে,ব্লাড প্রেশার চেক করে সামিনের মুখের দিকে তাকায়। সামিন তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
_শরীর অত্যন্ত দুর্বল ভাইয়া। কিছু খাওয়াতেই হবে। কতক্ষন না খেয়ে ছিলো?

_উনিশ ঘন্টা।
_উনিশ ঘন্টা না খেয়ে দিব্যি থাকা যায়। পানি না খেলে সমস্যা হবার কথা।
_পানিও খায়নি।

পরী আলোর দিকে তাকায়। সে কিছুই বুঝতে পারছে না এখানে কি হচ্ছে। কাউকে জিজ্ঞেস করবে সেই সাহস পরীর নেই। নিচু স্বরে, দৃষ্টি আলোর মুখের দিকে রেখে বলে,”পানি শূন্যতার জন্য হয়েছে। একটা চামচ দিয়ে খানিকটা পানি খাইয়ে দাও ইশিতা আপু।”

তারপর বলে,”এর হাত পায়ে ম্যাসাজ করে দাও। ধীরে ধীরে হুস ফিরে পাবে।”

সামিন পরীর কথা শুনে আলোর মুখের দিকে তাকায়। ঠোঁট বাঁকিয়ে ম্লান হাসে,মনে মনে বলে,” বোকা বাবার ফ’ট’কা চালাক মেয়ে! এই রকমের যা তা স্টামিনা নিয়ে এতো তেজ দেখাও তুমি!”

ইশিতা একটা গ্লাস আর একটা চামচ এনে আলোর মাথার কাছে বসে। রিতু এবং সিতারা আলোর হাতে পায়ে ম্যাসাজ করে দিচ্ছে। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়। ফুলির মা হঠাৎ করে বলে ওঠে,”আসতে না আসতেই তোমারে দিয়া নিজের সেবা করাইয়া নিতেছে তোমার বড় জা।”

রিতু মাথা তুলে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। ফুলির মা প্রায় ভুলে গিয়েছিলো এই ঘরে ইয়াসার রয়েছে। মনে পরতেই সে থমথমে মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ইয়াসার কিছু বলে না। তার দৃষ্টি আলোর দিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে সে আলোকে পর্যবেক্ষণ করছে। গুনে গুনে সাত সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে সে চোখ সরিয়ে নেয়।
ইশিতা আলোর মাথায় হাত রেখে নরম গলায় ডাকে,”আলো।”

আলোর জ্ঞান ফিরেছে কিন্তু চোখ খুলে তাকানোর শক্তি সে পায়না। নারী কন্ঠ কানে যেতেই সে কপাল কুঁচকে ফেলে খানিকটা। ইশিতা সাহস পায়। চা-চামচের এক চামচ পানি অবচেতন আলোকে জোর করে খাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। খড়খড়ে কন্ঠনালীতে দুফোঁটা পানির অস্তিত্ব পেয়ে আলোর অবচেতন মন স্বস্তি পায় ঠিকই কিন্তু তার চোখ দুটো বন্ধ।
রিতু এগিয়ে বসে আলোর গালে হাত রেখে ডাকতে থাকে,”আলো…আলো…!”
দুইবার ডেকে সে থেমে যায় তারপর সামিনের দিকে একবার তাকিয়ে আবারো ডাকতে থাকে,”ভাবী….ভাবী..!”

আলো ধীরে ধীরে চোখ খুলে পিটপিট করে তাকায়। সবকিছু ঝাপসা লাগছে। সবাই জানে সে উনিশ ঘন্টা খায়নি।‌ কিন্তু সবাই জানে না আলো গতো সাতাশ ঘন্টা ধরে কিচ্ছু খায়নি। গতকাল বেলা এগারোটার দিকে কলেজের ক্যান্টিনে একটা সিঙাড়া খেয়েছিলো, এবং ওটাই শেষ খাবার।
আলোকে চোখ মেলে তাকাতে দেখে অদ্ভুত ভাবে, নিজের অজান্তেই ইয়াসার একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এবং সাথে সাথে সে ভীষণ অবাক হয়ে যায়। আশ্চর্য,সে এমন অদ্ভুত কাজটা কেনো করলো!

রিতু ম্লান হেসে বলে,”ভাবীর জ্ঞান ফিরেছে।”
ইশিতা একবার ইয়াসারের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে রিতুকে বলে,” মেজো ভাবী। এক বাটি স্যুপ নিয়ে এসো। আর তোমরা সবাই এখান থেকে যাও। তিন সেকেন্ডের মধ্যে।”

ইয়াসার বোনের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে অকারণ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। পরীর দিকে তাকিয়ে বলে,”কি রে তোর ভিজিটের টাকা নিবি না হবু ডাক্তার!”
পরী মুচকি হাসে। অনেকটা সাহস নিয়ে বলে,”বিয়ের মিষ্টিও কিন্তু বাকি আছে ভাইয়া। ওটা আগে খাওয়াবেন।”

***
“আপনি আসলে করতে চাইছেন কি একটু পরিষ্কার করে বলবেন আব্বা? সারাদিন এই প্ল্যান করছেন,সেই প্ল্যান করছেন অথচ কাজের কাজ তো কিছুই হচ্ছে না।”

শমশের ভুঁইয়া নিজের ছেলে সাগর ভুঁইয়ার দিকে তাকায়। ছেলে তার রীতিমতো বাপকে ধ’ম’কা’তে শিখে গিয়েছে।

সাগর জায়েদ আলীর দিকে আঙুল তুলে আবারো বলতে থাকে,”ওনার সাথে একচেটিয়া আলোচনা করে এতদিন পণ্ডশ্রম করে গিয়েছেন শুধু। আপনার বুদ্ধি দেখে আমি অবাক হই আব্বা। কোথায় ইয়াসারকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেবেন তা না করে ওর চ্যা’লা’টাকে মারলেন। ইয়াসারের তো টিকিও নাড়ানো গেলো না। দিব্যি তার দলের লোক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।”

_আতাউর আলম তো সরে দাঁড়িয়েছে।

বাবার কথায় তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে সাগর বলে,” ইয়াসারকে মেরে দিলে আতাউরকে সামলানো কোনো ব্যাপার-ই ছিলো না আমাদের কাছে। আর আতাউরকে ফাঁসানোর যে প্ল্যান করেছিলেন,লাভ কি হলো? ইয়াসারের তো কোনো শীত গরম দেখছি না। ও তো এতো সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র না। ও কেনো আতাউরের পিণ্ডি চটকাচ্ছে না? একটা ধুন্ধুমার লেগে গেলেও কিছুটা সুবিধা করা যেতো।”

শমসের ভুঁইয়া ছেলের কথায় চিন্তিত হয়ে পরে। তাইতো,ইয়াসার এতো চুপচাপ বসে আছে কি করে।‌ বিষয় টা বেশ গোলমেলে।

সাগর বাবার দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বলে,”এইবার যদি কোনো অঘটন ঘটে না আব্বা ! তাহলে আপনি ধরে নিন দলের সভাপতি পদ থেকে আপনাকে সরে দাঁড়াতে হবে।”
***
“এই স্যুপ টা এখন তুমি মুখে দেবে আলো।”

ইশিতার কথা শুনে-ই আলো মুখ সরিয়ে নেয়। ইশিতা একটু কঠিন হবার ভান ধরে আলোর থুতনি ধরে জোর করে এক চামচ স্যুপ খাইয়ে দেয়। আলো বাঁধা দিতে গেলে তার গায়ে খানিকটা পরে যায় স্যুপ। ইশিতা ধমক দিতে চেয়েও দেয়না। মায়াবী মুখশ্রীর দিকে তাকালেই মায়া লাগে তার। সে নরম গলায় আলোর মাথায় হাত রেখে বলে,”তোমার বাবা মাকে দেখতে চাও? তার চান্স কিন্তু এখনো ফিফটি ফিফটি আছে আলো। তুমি যদি এভাবে না খেয়ে মরে পরে থাকো তাহলে তো কোনো লাভ হবে না,তাই না?”

আলোর ঠোঁট কাঁপছে। ইশিতার নমনীয় ব্যবহারে তার মধ্যে জমে থাকা কান্না সব বেরিয়ে আসতে চাইছে । বেশ কয়েক মুহূর্ত চেষ্টা করেও সে আটকাতে পারে না। ঝরঝর করে কেঁদে দিয়ে বলে,”কেনো আপু? একটা সামান্য চ’ড়ের দাম আমাকে নিজের সর্বস্ব খুইয়ে দিতে হলো কেনো?”

ইশিতা কোনো উত্তর দেয়না। সে তো জানে না এর উত্তর। আলো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কিছুক্ষণ পরে কান্না থামিয়ে কঠিন গলায় বলে ওঠে,”ওই জা’নো’য়া’রটাকে কখনো ক্ষমা করবো না আমি, কোনোদিনও না।”

***
শেষ বারের মতো ফোন টা চেক করে ইশমাম ফোনটাকে দূরে ছুড়ে মেরে হাত দিয়ে দেয়ালে সজোরে ঘুষি মেরে দেয়। তারপর এসে নিজের বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মাথা কাজ করছে না তার। এতোটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছে কেনো! কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে থেকে আবারো উঠে বসে। অর্গানাইজেশন থেকে বারবার ফোন দেওয়া হচ্ছে। ইশমাম কেনো তার কাজে যাচ্ছে না তাই। ভার্সিটি থেকে ক্লাসমেট-রা ফোন দিচ্ছে। কারো ফোন ধরতে স্বস্তি পাচ্ছেনা সে। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকার পরে সে উঠে দাঁড়ায়। স্টাডি টেবিলের কাছে গিয়ে ড্রয়ার খুলে তার পাসপোর্ট বের করে কয়েক মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর গিয়ে মেঝে থেকে ফোনটা উঠিয়ে নেয়। মেঝেতে পরে গিয়ে ফোনটা সুইচ অফ হয়ে গিয়েছিলো। সে ফোনটা অন করে এ্যাম্বাসিতে ফোন লাগায়।

***
“ক্যাচক্যাচ” শব্দে দরজার নব ঘোরে। রাত প্রায় দশটা বেজে গিয়েছে। সামিন দরজা ঠেলে দুই সেকেন্ড সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। তার কপাল কুঁচকে থাকলেও চোখে অস্বস্তির ছাপ স্পষ্ট। নিজের ওপর নিজে প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে যায়। এখন এতো অস্বস্তি লাগবে কেনো! এতো কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেও তো অস্বস্তি হয়নি একটুও। একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে ঘরের ভেতরে এক পা ফেলে। আড়চোখে পুরো ঘরের দিকে দৃষ্টি দেয়। আলোকে কোথাও দেখতে না পেয়ে আরেক পা ঘরের ভেতরে রাখতেই সে তার ঘাড়ের উপর কোনো ভারী বস্তুর আঘাত অনুভব করে। তৎক্ষণাৎ ডানপাশে তাকাতেই দেখে আলো একটা মোটা বই হাতে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে, প্রচন্ড শক্তি খাটিয়ে সামিনকে আঘাত টা করেছে তাই হাপাচ্ছে সে। আলোর প্রচণ্ড শক্তি খাটিয়ে করা আঘাতেও সামিনকে বিচলিত দেখা যায় না। বরং গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলে,”এক বাটি স্যুপ খেয়ে শক্তি ফিরে পেয়েছো?”

আলো দাঁতে দাঁত চেপে আরেকটা বারি মারতে যাবে তখন সামিন তার হাত দুটো ধরে ফেলে। হাত থেকে বইটা কেড়ে নিয়ে দরজার পাশের আলমারিতে রেখে দেয়। দরজার সিটকিনি তুলে দিয়ে মৃদু হেসে বলে,”তুমি নাকি কারাতে জানো। অথচ এখানে আসার পর থেকে দেখছি চ’ড় মারছো, থুতু ছুড়ে দিচ্ছো, মিন্ট লেমন ছুড়ছো, বই দিয়ে আঘাত করছো। এসব কোন ধরনের বাচ্চামো? মানুষ যখন ঘোর বিপদে পরে তখন তার মস্তিষ্ক কাজ করে না জানি, কিন্তু তোমার তো পুরো মেমোরি ডিলিট হয়ে গিয়েছে। তুমি আদৌও কারাতে জানো তো নাকি তোমার সৎ এবং মহৎ বাবা আতাউর আলম টাকা দিয়ে মেডেল কিনে দিয়েছে।”

_আমার বাবার নাম মুখেও আনবি না কু’ত্তা।
আলো তেতে ওঠে।

সামিন স্বাভাবিক গলায় বলে,”কু’ত্তা বলছো কেনো বারবার? আমি তোমাকে কামড়েছি? আঁচড় কেটেছি তোমার গায়ে?”

আলো অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সামিন বলে,”বাবার নামে কিছু শুনতেই পারো না দেখছি। অন্ধের মতো বিশ্বাস করো বাবাকে। তোমার ওই গুণধর পিতা কি করেছে জানো? একজনের জান নেওয়ার চেষ্টা করেছে।”

আলো চমকে ওঠে, চেঁচিয়ে বলে,” মিথ্যা কথা। সবকিছু মিথ্যা কথা।”

_হ্যা , হ্যা। দুনিয়ার সবকিছু মিথ্যা। তুমি আর তোমার বাবা সত্যবাদী যুধিষ্ঠির। তা সত্যবাদী বাপের সত্যবাদী কন্যা, তোমার নামটা তোমার বাবা শুধু আলো রাখলো কেনো? তোমার নাম রাখা উচিত ছিলো সত্যের আলো।

আলো বিদ্রুপ গাঁয়ে না মেখে, গলায় ঝাঁঝ বজায় রেখে চেঁচিয়ে বলে, ” ভয় দেখিয়ে বিয়ে, কতগুলো মানুষকে জিম্মি করে রাখা,তাদের ব্লাকমেইল করা। জোর করে একটা মেয়ের সর্বনাশ করা। তুই তো কাফিরের থেকেও একধাপ উপরে। তোর কোনো ক্ষমা নেই পৃথিবীতে। যেদিন ধরা পরবি না, জান নিয়ে বাঁচতে পারবি না জানোয়ার।”

সামিন আলোর দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে। আলো বলতে থাকে,”নিজের ঘরে এনে ভাবছিস স্বামীর অধিকার ফলাবি? তার আগে আমি প্রান ত্যাগ করবো।”

_আমি তো তোমাকে কিছুই বলিনি। তুমি আগ বাড়িয়ে এতো কিছু বলছো কেনো?
_কেনো জোর করে এই রুমে এনেছিস আমায়!

হাঁপাতে থাকে আলো। সামিন মৃদু হেসে বলে,”আমি তো জোর করিনি। শুধু বলেছি তোমার কোন ভাই এখন কি করছে, একজন দোকানে গিয়ে থার্মোমিটার কিনেছে,অন্যজন গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে,ব্যস। আর তুমি তাতেই ভয় পেয়ে চলে এলে রিতুর সাথে আমার শোবার ঘরে।”

আলো ছুটে এসে সামিনের কলার ধরে চেঁচিয়ে বলে,”পিশাচ, নমরূদ।”

সামিন আলোর হাত ছাড়িয়ে বলে,”আমার তিনটা পাঞ্জাবির বোতাম ছিড়েছো তুমি। এগুলো কিন্তু তোমাকে দিয়েই ঠিক করানো হবে।”

আলো ফোঁস ফোঁস করতে থাকে। গলা থেকে আর কোনো কথা বের হচ্ছে না তার। সামিন মৃদু স্বরে বলে,”কি? একবাটি স্যুপের শক্তি ফুরর হয়ে গিয়েছে?”

_ফে’রা’উ’ন
আলো হাঁপাতে হাঁপাতে বলে।

সামিন হেসে বলে,”তাই নাকি? তাহলে তো তুমি আছিয়া হলে।”

ডান হাত দিয়ে পকেট থেকে একটা চেক বের করে আলোর হাতের কব্জি শক্ত করে ধরে ফেলে সামিন। চেকটা আলোর হাতের মুঠোয় পুরে গম্ভীর কন্ঠে বলে,”বিয়ের কাবিনের টাকা।”

আলো হাত ছাড়িয়ে চেকটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে সামিনের দিকে ছুড়ে মারে।
সামিন বলে,”ঠিকাছে। নগদ ক্যাশ দিচ্ছি।”

_তুই মরবি। মরবি তুই খুব শিগগিরই ফে’রা’উ’ন।

_তাই নাকি! তা নীলনদ কোথায়? বাংলাদেশে তো কোন নীলনদ নেই।

আলো অহেতুক তাকিয়ে থাকে সামিনের দিকে। সামিন আলোকে উপেক্ষা করে বিছানা থেকে একটা বালিশ নিয়ে ডিভানে রাখে। পায়ের চটি খুলে ডিভানে উঠে ওদিক ফিরে শুয়ে পরে সে, গম্ভীর কন্ঠে আলোকে বলে,”ঘুমিয়ে পরো। আমি আঁচড়াবো না,কামরাবোও না।”

চলমান……..