বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে পর্ব-১২+১৩

0
623

#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_১২
#Esrat_Ety

পাখির কিচিরমিচির নতুন সকালের আহবান জানিয়ে দিয়েছে। জানালার থাই-গ্লাস ভেদ করে কড়া মিষ্টি রোদ এসেছে আলোর গালে আদর দিয়ে যাচ্ছে। মেঝেতে বসে বিছানার উপরে মাথা ঠেকিয়ে,ডান পাশে কাত হয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো আলো। বাম গালে রোদের উষ্ণতা তার দীর্ঘ ক্লান্তিময় ঘুমের ইতি টানে। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায় সে। ছোটো বেলা থেকে আলো অচেনা কোনো নতুন পরিবেশে ঘুমাতে পারে না, কিন্তু এই দুই রাত যে মানসিক ধকল আলো সামলেছে তাতে এরকম গভীর ঘুম হওয়া স্বাভাবিক। মাথা এখনো ভারি হয়ে আছে যন্ত্রনায়। হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরে এদিকে ওদিকে তাকায় সে। তারপর নিজেকে দেখে,গায়ের শাড়ীটা ঠিকঠাক ভাবেই আছে। বিছানায় এক হাত রেখে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। এই অচেনা ঘরটিতে সে ছাড়া আর কেউ নেই। ওই পি’শা’চ টা উধাও। ঘরের দরজা খোলা। আলো এই সুযোগে দ্রুত পায়ে বের হয় ঘর থেকে। সে জানে এই কারাগার থেকে তার পালানোর পথ রাখেনি ওই চতুর শিয়াল টা। তবুও একবার চেষ্টা করলে তো ক্ষতি নেই। ঘরের বাইরে এসে সে নিচতলার সিঁড়ি দেখতে পায়। সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত পায়ে নামতে গিয়ে থমকে যায় সে। নিচতলার লিভিং রুমে পি’শা’চ টার দুজন লোক বসে আছে। এদেরকে নিশ্চয়ই ঐ পি’শা’চ টা তার উপর নজরদারি করতে এখানে বসিয়ে রেখেছে। আলো দুমিনিট সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে হতাশ হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়ায়। ঘুরে দাঁড়িয়ে সে রিতুকে দেখে। রিতু আলোর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,”পালাচ্ছিলেন নাকি ভাবী!”

আলো প্রায় দৌড়ে রিতুর কাছে যায়। রিতুর দুই বাহু ধরে আকুতির সুরে বলে,”না পালাচ্ছিলাম না। আপনি আমার একটা উপকার করবেন? একটু দয়া করবেন আমায়?”

রিতু চোখ বড় বড় করে ফেলে। সে কি উপকার করতে পারে আলোর। এদিক ওদিক তাকিয়ে নিচু স্বরে বলে,”কি ভাবী?”

_আমাকে আপনার ফোনটা দেবেন? আব্বু আম্মুর সাথে একটু কথা বলবো। দয়া করে ফোনটা দিন। আমি আপনার পায়ে পড়ছি!

রিতু আলোর দুটো হাত মুঠি করে ধরে। এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,”আসুন আমার সাথে।”

***
সরকার দলীয় প্রার্থী সামিন ইয়াসার মির্জা নিজ এলাকা ১৯ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ভোটদান সম্পন্ন করে বেরিয়ে এসেছেন। ভোটকেন্দ্রের বাইরে গণমানুষের ভীর। রাহাত এগিয়ে গিয়ে একটা ছাতা ধরে সামিনের মাথার উপরে। সামিন হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,”হাজার বার বারণ করেছি,আমার সাথে এসব করবি না। তোরা আমার চাকর?”

রাহাত লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসে। তারপর বলে,”না,আপনি আমাদের নেতা।”
সামিন এদিকে ওদিকে তাকিয়ে বলে,”বাকি কেন্দ্রগুলোতে খবর নিয়েছিস? ওদিকের অবস্থা কি?”

এমন সময় রাহাতের ফোন বেজে ওঠে। রাহাত পকেট থেকে ফোনটা বের করে সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”সবুজের ফোন। ও তো পনেরো নম্বর ওয়ার্ডে আছে, নতুন কুঁড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শমশের ভুঁইয়ার এলাকা।”

সামিন বলে,”জলদি ফোন রিসিভ কর।”
রাহাত সামিনের কথামতোই ফোনটা রিসিভ করে লাউড স্পিকার অন করে দেয় , ওপাশ থেকে চেঁচিয়ে ওঠে সবুজ,”রাহাত আমাদের এজেন্টদের কাজে ব্যাঘাত ঘটানো হচ্ছে। দুই দলের মধ্যে হাতাহাতি হয়েছে একপর্যায়ে।”
_পুলিশ কি করছে? ঘাস খাচ্ছে? সরকারি পার্টির এজেন্টদের সাথে গাইগুই করে। বুকের পাটা দেখ!
_শমশেরের ধামড়া ছেলেটা করছে এসব। কি করবো? ভাইকে বল ওসিকে ফোন দিতে।

সামিন রাহাতের হাত থেকে ফোন নিয়ে বলে,”ওসিকে ফোন করার দরকার নেই। আমি আসছি, তুই শু’য়ো’র গুলোকে চিহ্নিত করে রাখ।”

***
আতাউর আলম ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই আলো কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠে,”আব্বু!”

আতাউর আলম দু’চোখ বন্ধ করে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। তার মুখে কোনো কথা আসছে না। আলো বলতে থাকে,”কার জ্বর আব্বু?”
_তোর আম্মুর। জ্বর উঠেছে, প্রেশার বেড়ে গিয়েছে।

আলো চুপ করে থাকে। আতাউর আলম বলে,”তোকে মেরেছে আম্মু? খেতে দিয়েছে তোকে?”

আলোর চোখ বেয়ে দুফোঁটা তরল গড়িয়ে পরে। কন্ঠনালীতে জমে থাকা কান্না জোর করে দমিয়ে রেখে কন্ঠ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বলে,”ঠিক আছি আব্বু। কেউ আঘাত করেনি। খেতে দিয়েছে আমায়।”

আতাউর আলম আর্তনাদ করে ওঠে,”মা…..আমার মা, তুই তোর অপদার্থ বাবাকে মাফ কর মা। ক্ষমা কর আমায়।”

আলো ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। আলোকে দেখে রিতুর চোখে পানি এসে যায়। কয়েক মুহূর্ত কেঁদে কান্না থামিয়ে বলে,”আজান আয়াত কোথায়।”
ওপাশ থেকে আজান আয়াতের ভাঙা গলার আওয়াজ শোনা যায়,”এইতো আপু। আমরা এইতো।”

আলো ধরা গলায় বলে,”ভাই দুটোকে সামলে রেখো আব্বু। ওরা আমার কলিজা। পি’শা’চ টা ওদের উপর নজর রাখছে।”

আতাউর আলম কাঁদতে থাকে। আলো বলে,”আমার সুপার হিরো এভাবে কাঁদতে পারে না। তুমি কেঁদো না আব্বু। ইয়াসার আমাকে আর যাই করুক জানে মা’র’বে না। তোমার মেয়ে হয়তো বেঁচে থাকবে!”

_আমি কি পাপ করেছি আম্মু!

আলো চুপ করে থাকে, তারপর বলে,”নির্বাচন বর্জন করেছো আব্বু?”
_দরকার নেই, দরকার নেই। আমার আর কিছুর দরকার নেই।

আলো মুখে হাত চেপে কিছুক্ষণ কেঁদে নেয়। তারপর কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,”রাখছি আব্বু। আম্মুকে দেখবে। এই নাম্বারে আর ফোন করবে না। একজন বিপদে পরে যাবে তাহলে।”

ফোন কেটে আলো ধপ করে মেঝেতে বসে পরে। রিতু নিচু হয়ে বসে নরম গলায় বলে,”ভাবী কাঁদবেন না।”

_ডাকবে না আমায় ভাবী,আমি কারো ভাবী নই, না আমি কারো বৌ। ডাকবে না ভাবী আমায়, ডাকবে না। ডাকবে না।

গলা ছেড়ে চিৎকার করতে থাকে আলো।

***
“কিরে ভাইকে দেখে তোর সব হাওয়া বেরিয়ে গিয়েছে?”

কথাটি বলেই সবুজ সাগরকে কুৎসিত একটা গালি দেয়। সাগর তাতে ভ্রুক্ষেপ না করে ইয়াসারের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকে। ইয়াসার তার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরে নীরবতা ভেঙে সাগর হেসে বলে,”অনেক দিন পর তোর সাথে দেখা ইয়াসার। দেখে খুব ভালো লাগছে। আমি আনন্দিত।”

_কিন্তু আমার ভালো লাগছে না। ইচ্ছে করছে তোর গলাটা চেপে ধরে জা’ন’টা বের করে দিতে।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় ইয়াসার। সাগর উচ্চশব্দে হাসতে থাকে। হাসি থামিয়ে বলে,”ধীরে নেতা ধীরে। ভোটকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে জনগণের জা’ন নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। কেউ ভোট দেবে আপনাকে?”

_একসময় তুই আমার অনেক ভালো বন্ধু ছিলি,তাই তোকে বরদাস্ত করে গিয়েছি সাগর। নিজের অওকাদের মধ্যে থাকবি। নয়তো খুব খারাপ হবে।

সাগর দাঁতে দাঁত চেপে শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বলে,”কি করবি তুই? কি করবি? শা’লা কাপুরুষ। আতাউরের মতো একটা চামচিকা যার দলের লোক মেরে দেয় সে কি করবে আমাকে?”

_তুই কিভাবে জানলি আতাউর করেছে সব?

সামিনের এমন সরাসরি প্রশ্নে সাগর থতমত খায়। আমতা আমতা করে বলে,”জানি। সব খবর আসে আমার কাছে। আচ্ছা তুই আতাউরের সাথে কি করেছিস বলতো। শা’লা বসে গিয়েছে কেনো? গলায় রামদা ধরেছিলি নাকি?”

সামিন বলে,”বেশি চালাকি করবি না সাগর। এখানে কোনো ঝামেলা করবি না। সত্যিই যদি মায়ের বুকের দুধ খেয়ে থাকিস তাহলে নির্বাচনের ফলাফল পর্যন্ত অপেক্ষা কর। তখন মুখোমুখি হ।”

_আচ্ছা? তাই নাকি? খুব আত্মবিশ্বাস না তোর? তুই তো মেয়েদের হাতে চ’ড় খাস শা’লা। তোকে কে ভোট দেবে?

সামিন দাতে দাত চেপে দাঁড়িয়ে থাকে। এখানে সে মারামারি করতে চায় না। নয়তো আজ সাগরের খুব খারাপ অবস্থা করে ফেলতো।

***
রিতু একটা প্লেটে অল্প ভাত এবং একটু মাংসের তরকারি নিয়ে ইয়াসারের ঘরে ঢোকে। আলো মেঝেতে বসে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে রেখেছে। তার দৃষ্টি মেঝের দিকে। ঘরে রিতুর অস্তিত্ব টের পেয়ে
তার দিকে তাকায়। আলোর মুখোমুখি হয়ে মেঝেতে বসে রিতু প্লেট টা তার দিকে বাড়িয়ে ধরে।
“নিন ভাবী। ভাত টা খেয়ে নিন। অল্প এনেছি।”

_বললাম না আমাকে ভাবী ডাকবে না!
রিতু ম্লান হেসে বলে,” আচ্ছা ডাকবো না। আপনি খেয়ে নিন না প্লিজ। দয়া করে খেয়ে নিন।”

আলো প্লেটে হাত দেয়। কিছুক্ষণ প্লেটের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,”এই খাবার কোথা থেকে আসে জানো? তোমার শশুর বাড়ির পাপের টাকায়।”

রিতু চুপ করে থাকে। এমন সময় ইশিতা ঘরে ঢোকে। সে দরজার বাইরে থেকে আলোর কথা শুনে ফেলেছে। ঘরে ঢুকে আলোকে বলে,”খাবার টা যেভাবে-ই আসুক,ওটা তোমার রিজিকে ছিলো। এখন খেয়ে নাও, কালকের মতো শুরু করো না। ভাইয়া সন্ধ্যায় বাড়িতে আসলে সিনক্রিয়েট হবে। চুপচাপ থাকো,শান্ত থাকো। আমি ভাইয়াকে বোঝাচ্ছি যাতে সে তোমার প্রতি নরম হয়।”

রিতু মাথা তুলে ইশিতাকে বলে,”ভোট দিয়েছো আপা?”

_হ্যা ভাবী। তুমি যাও,মেজো ভাইয়া অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।

রিতু উঠে চলে যায়। ইশিতা আলোর কাছে এগিয়ে এসে বিছানায় বসে। আলোর দিকে দৃষ্টি দিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,”খেয়ে নাও। আমি এখানে বসে আছি আলো। খেয়ে খালি প্লেট টা আমার কাছে দাও।”

***
অপজিশন পার্টির সভাপতি শমশের ভুঁইয়া পেয়েছে আটচল্লিশ হাজার তিনশ ছয় ভোট। অপরদিকে সরকারী দলের মনোনীত প্রার্থী সামিন ইয়াসার মির্জা পেয়েছে এক লক্ষ বারো হাজার সাতশো একান্ন ভোট। পঞ্চাশ হাজার ভোটার ভোট প্রদান করেনি। আতাউর আলম নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলে তারাও সরে দাঁড়ায়।
২৪ টি ওয়ার্ডে ১১০ টি কেন্দ্রের ৭৩০ টি বুথের ভোট গণনা সম্পন্ন হয়েছে। ১৯ নাম্বার ওয়ার্ডের সরকারি বয়েজ কলেজের মাঠে উল্লাসে ফেটে পরছে সামিন ইয়াসারের ছেলেরা।

কলেজের বারান্দায় প্রিজাইডিং অফিসাররা সামিন কে অভিনন্দন জানায়। ম্লান হেসে সামিন ধীরপায়ে মাঠে নেমে আসে। তাকে দেখে তার দলের ছেলেরা দৌড়ে গিয়ে তাকে জাপটে ধরে। সামিন ঠান্ডা গলায় বলে,”শান্ত হ সবাই,শান্ত হ!”

রাহাত প্রায় ছুটে আসে। সামিন কে জরিয়ে ধরে চেঁচাতে থাকে,”ভাই আপনি করে দেখিয়েছেন।”
সামিন ম্লান হেসে বলে,”আমরা করে দেখিয়েছি রাহাত।”

আরাফ বলে,”ভাই। ছেলেরা আনন্দ মিছিল বের করতে চাচ্ছে শহরে।”
সামিন ঠান্ডা গলায় বলে,”না।”

আরাফ শুকনো মুখে বলে,”কেনো ভাই?”
_জামিল সুস্থ হোক আগে।

রাহাত একটা শুকনো হাসি দিয়ে আক্ষেপের সুরে সামিনকে বলে,”জামিল ভাই থাকলে এখন উন্মাদের মতো চেচাতো ভাই।”

***
“বিপুল ভোটের ব্যবধানে জিতে এই শহরের নব নির্বাচিত মেয়র, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতা এবং সুপরিচিত জননেতা সামিন ইয়াসার মির্জা।”

চ্যানেল চব্বিশ ঘন্টায় ব্রেকিং নিউজ। হেডলাইনের দিকে তাকিয়ে আতাউর আলম একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। তার স্ত্রী রেহেনা বিছানায় শুয়ে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

লিভিং রুম থেকে শোরগোলের আওয়াজ পেয়ে আলো ধীরে ধীরে সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়ায়। সবাইকে এতো আনন্দিত লাগছে কেনো! দুমিনিট সেভাবে দাঁড়িয়ে থেকে দ্রুত পায়ে ইয়াসারের ঘরে ঢুকে সে টিভি অন করে।
“শহরের নব নির্বাচিত মেয়র সামিন ইয়াসার মির্জা। আজ দীর্ঘ বারো বছর পরে স্থানীয় সরকার পরিচালনা করবে একজন তরুণ নেতা। জনগণ আশাবাদী এই শহরকে তিনি নতুন রূপে গড়ে তুলবেন।”

সংবাদ পাঠিকার মুখে কথাটি শুনে আলো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে কয়েক মূহুর্ত। তারপর চেঁচিয়ে ওঠে,”ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে ঐ পি’শা’চ টা তোদের শহরে‌। তোরা বুঝলি না বোকার দল!”

রিমোট টিপে টিভি অফ করে মেঝেতে বসে থাকে সে। শরীরটা একটু একটু কাঁপছে। চোখে পানি এসে গিয়েছে। পরাজয়, অসহায়ত্ব এবং লাঞ্ছনার পানি। খানিক বাদে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে, অস্ফুট স্বরে বলে,”কেনো আল্লাহ! ওই শ’য়’তা’নকে কেনো জিতিয়ে দিলে!”
***
রাত প্রায় সাড়ে দশটা বেজে গিয়েছে। নির্বাচনী ঝামেলা সামলে জয়ী মুখ নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে সামিন। সন্ধ্যার পরে, নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর থেকে একটার পর একটা ফোন তুলতে হচ্ছে তার। সবাই তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। সংসদ সদস্য কবীর আলমগীর তাকে নিজে এসে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। দলের ছেলেরা তাদের ইয়াসার ভাইয়ের সাথে ছবি তুলে সামাজিক গণমাধ্যমে আপলোড করে সামিনকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। সবাইকে মিষ্টি খাইয়ে,সব সৌজন্যতা শেষ করে হাসপাতালে গিয়ে জামিলকে দেখে এসেছে একবার।

গাড়ি থেকে নামতেই পোনা চাচা দৌড়ে এসে সামিনকে জরিয়ে ধরে অভিনন্দন জানায়। সামিন হেসে ফেলে। তারপর বলে,”বাড়ির কি অবস্থা?”
_সব ঠিকঠাক। শুধু ইলহামের সাথে তর্কাতর্কি হয়েছে বড় বৌমার। ইলহামকে বলেছে চরিত্রহীন।

সামিন বলে,”এসব কি করে হলো?”
_ইলহাম বড় বৌমাকে তোমার জেতার কথা জানাতে গিয়েছিলো। বৌমা রেগে গিয়ে বলে,”দূরে গিয়ে মর, ধর্ষণ মামলার আসামি, চরিত্রহীন কোথাকার!”

সামিন একটা বড় নিশ্বাস ফেলে ঘরের ভেতর চলে যায়।
***
দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে আলো কপাল কুঁচকে ফেলে। তার মনে তীব্র যন্ত্রনা হতে শুরু করে। ভেতরে ঢুকে সামিন আলোর দিকে একবার তাকিয়ে দেখে। আলো মেঝেতে বসে আছে। সামিন দরজার সিটকিনি তুলে দিয়ে আলমারি থেকে একটা ট্রাউজার এবং টি-শার্ট বের করে ওয়াশ-রুমে ঢুকে পাল্টে নেয়। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে গম্ভীর কন্ঠে বলে,”তোমার তো কোনো লস হলো না। বাপ হয়নি তো কি হয়েছে। তোমার স্বামী তো মেয়র হয়েছে।”

আলো দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে। সামিন আলোর দিকে এগিয়ে গিয়ে আলোর মুখোমুখি হয়ে মেঝেতে বসে‌‌। আলোর ইচ্ছে করছে পি’শা’চ’টার গলায় ছুরি বসিয়ে দিতে। সামিন আলোর কপালের দিকে তাকিয়ে বলে,”ভেবেছি আজ আমার অনুপস্থিতিতে তুমি পালানোর চেষ্টা করবে। তা করোনি দেখে আমি খুশি হয়েছি। তুমি বুঝদার মেয়ে আলো।”

আলো মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। সামনের মানুষটাকে দেখলেই যে তার ঘৃণা হয়।
সামিন হাতের তোয়ালেটা আলোর হাতের উপর রেখে বলে,”যাও এটা ঐ চেয়ারের উপর রেখে এসো।”

আলো সামিনের দিকে তাকায়। সামিন কন্ঠে বিদ্রুপ মিশিয়ে বলে,”তোমার স্বামী তোমাকে আদেশ দিচ্ছে।”

কথাটি শুনে ঘৃনায় আলোর গা গুলিয়ে ওঠে। তোয়ালেটা এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে সামিনের দিকে থুতু ছুড়ে মারে। আলোর ছুড়ে দেয়া থুতু সামিনের টি-শার্টের বুকের কাছে লাগে। সামিন কয়েক মুহূর্ত আলোর দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে টি-শার্ট টা পাল্টে নেয়। পুনরায় এসে আলোর সামনে বসে বলে,”এতো থুতু কোথা থেকে আসে তোমার? পেটে কৃমি হয়েছে? কৃমির ওষুধ খাওনা কতদিন হয়েছে?”

তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে কন্ঠস্বর গম্ভীর করে বলে,”ওই টি-শার্ট টা কাল সকালে তুমি ধুয়ে দেবে।”

কথাটি বলে সামিন উঠে দাঁড়ায়। আলো হাত দিয়ে শাড়ির আঁচল চেপে ধরে বসে আছে। সামিন একবার ঘুরে তাকিয়ে বলে,”মেঝেতে ঘুমাতে হবে না। পুরো বিছানা তোমাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে ।”

_আমি একটা পি’শা’চ ,জাহিল, ফে’রা’উ’ন , প’শু ,যাকে নিজের স্বামী বলে মানি না তার ঘামের গন্ধ লেপ্টে থাকা বিছানায় শোবো না। বুঝেছিস তুই?

চেঁচিয়ে বলে আলো। সামিন আলোকে কয়েক মুহূর্ত দেখে চেঁচিয়ে ওঠে,”ফুলির মা!”

ফুলির মাকে ডাকতে ডাকতে সামিন দরজার সিটকিনি খুলে দেয়। ফুলির মা নিচ তলা থেকে দৌড়ে গিয়ে সামিনের ঘরের সামনে দাঁড়ায়। সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে,”এই বিছানায় একটা নতুন চাদর বিছিয়ে দাও। যেটার স্টিকার এখনো তোলা হয়নি।”

ফুলির মা মাথা নাড়িয়ে বিছানার চাদর পালটাতে থাকে। মাঝখানে সে একবার আলোকে দেখে আবারও নিজের কাজে মন দেয়। সামিন বলে,” সুগন্ধি স্প্রে করে দাও।”

আলো থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছে মেঝেতে।
ফুলির মা পুরো ঘরে সুগন্ধি স্প্রে করে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
সামিন দরজার সিটকিনি লাগিয়ে দিয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”এবার আর কোনো পি’শা’চে’র গায়ের গন্ধ নেই। এবার ঘুমাও।”
কথাটি বলে সামিন বালিশ নিয়ে ডিভানের দিকে এগিয়ে যায়।

ফুলির মাকে রিতু পথে আটকায়।
“কি হয়েছে ফুলির মা? ভাইয়া কেনো ডেকেছিলো?”

ফুলির মা মুচকি হেসে বলে,”ঘর সাজাইতে ভাবী। আচ্ছা ভাবী! বাগান থেকে কিছু ফুল তুলে দিয়ে আসবো?”

রিতু একটা ধমক দিয়ে বলে,”ভাইয়ার থেকে বেশি বোঝো তুমি? যাও গিয়ে ঘুমাও।”

আলো আগের মতই মেঝেতে বসে থাকে। ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে হঠাৎ। সামিন উঠে বসে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে ইশমামের নাম্বার। তার ঠোঁট প্রশস্ত হয়ে যায় হাসিতে। ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে যায় সে। ফোনটা রিসিভ করে বলে,”ছোটো তোকে কতবার ফোন দিয়েছি। খবর শুনেছিস তুই?”
_হ্যা ভাইয়া। নিউজ দেখেছি সামাজিক গণমাধ্যমে ‌। অভিনন্দন তোমাকে।

সামিন কপাল কুঁচকে ফেলে। বলে,”কি ব্যাপার ছোটো! তোর কন্ঠস্বর এমন লাগছে কেনো!”

_ঠান্ডা লেগেছে ভাইয়া।
দু’জনেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর ইশমাম বলে ওঠে,”ভাইয়া! আমি দেশে ফিরছি। আগামীকাল আমার ফ্লাইট।”

সামিন আনন্দে প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে,”সত্যি নাকি!”
_হু ভাইয়া। ভাইয়া একটা কথা বলবো?
_হ্যা বল‌।
_আমি যদি তোমার কাছে কোনো আবদার করি তা মেনে নেবে তুমি? তোমার পছন্দ না হলেও।

সামিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”যে ভাইটা কখনো আমার কাছে কোনো আবদার করেনি তার প্রথম আবদার আমি ফিরিয়ে দেবো? কখনোই না। তুই শুধু আয় ছোটো। আর,এখানে তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”

ইশমাম শুকনো গলায় বলে,”কি ভাইয়া?”
_সেটা এলেই দেখতে পাবি!

চলমান……….

#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_১৩
#Esrat_Ety

বিছানা ছাড়তে একেবারেই ইচ্ছে করছে না তার। ঘুম ভাঙ্গার পরেও কিছুক্ষণ ম’ট’কা মেরে পরে থাকে সামিন। হুট করে আলোর কথা মাথায় আসতেই সে চোখ খুলে তাকায়। ধ’র’ফ’রি’য়ে উঠে বসে বিছানার দিকে তাকায়। কেউ নেই সেখানে। মেঝেতে পা রেখে ঘরে পরার চটি জোড়া পায়ে দেয়। ঘরের দরজা খোলা। সামিন একবার হাই তুলে ঘরের বাইরে এসে রিতুকে ডাকতে থাকে।
রিতু নিচতলা থেকে নিচু স্বরে জবাব দেয়,”জ্বি ভাইয়া!”
_আলো কোথায়?

রিতু অবাক হয়ে বলে,”জানি না তো ভাইয়া।‌ ঘরে নেই? ভাবীকে তো নিচে নামতে দেখিনি আমি।”

সামিন চোখ মুখ শক্ত করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে সোজা সদর দরজার দিকে যায়। বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা বাড়ির দারোয়ান রিয়াজকে ডাকতে থাকে। রিয়াজ প্রায় ছু’টে আসে।
“আলোকে দেখেছিস? বাইরে গিয়েছে?”
_বড় ভাবীকে? নাতো ভাইজান! দেখিনি।
_সকাল থেকে এখানেই ছিলি?
_হু ভাইজান। সকালের বাথরুম আটকে রেখে দাঁড়িয়ে আছি। একটা মাছিও গ’ল’তে দেইনি । পোনা চাচা আসলে বাথরুমে যাবো।

বাইরের কটেজ থেকে পোনা বের হয়। সামিনকে দেখে বলে,”কি হয়েছে?”
_আলোকে পাওয়া যাচ্ছে না।

গম্ভীর কন্ঠে বলে সামিন ফোনে রনির নাম্বার ডায়াল করে ফোন লাগায়।

পোনা কপাল কুঁ’চ’কে এদিক ওদিক তাকাতেই চাঁপা স্বরে চেঁ’চি’য়ে বলে,”ওই তো বড় বৌমা। বাগানে!”

সামিন ফোন কেটে দিয়ে অবাক হয়ে ঘুরে তাকায়। আলোর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। তার ফুলের বাগানের কাছে দাঁড়িয়ে আছে আলো। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পরনে তার লাল রঙের একটা শাড়ি। তাকে একটা ফুলের থেকে কম কিছু লাগছে না। রাতে সামিন এসব কিছু খেয়াল করেনি, কিংবা খেয়াল করতে চায়ও নি সে। কিন্তু সকালের সূর্য তার চোখে আঙুল দিয়ে ওই নারী কায়ার সৌন্দর্য দেখিয়ে দিতে চাইছে।
পোনা এগিয়ে যেতে থাকে আলোর দিকে। সামিন ধীরপায়ে পোনার পিছু পিছু যায়। আলো ওদিক ফিরে দাঁড়িয়ে একটা ফুল ছোঁ’য়।

_বড় বৌমা।
নমনীয় অচেনা পুরুষ কন্ঠ শুনে আলো চ’ম’কে উঠে পোনার দিকে তাকায়। পোনা হাসি হাসি মুখ করে বলে,”আমি পোনা। এই বাড়ির আজীবন মেয়াদী কেয়ার টেকার। ভ’য় পেয়ো না মা।”

আলো একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে পোনার দিকে। সে কি বলবে!
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আলো পোনার থেকে চোখ সরিয়ে আবারো ফুল গাছ গুলোর দিকে তাকায়। পোনা বলে,”এই গাছ গুলো তোমার স্বামী নিজের হাতে লাগিয়েছে। তার ফুল গাছের খুব শখ। সেই ছোট থেকে। এ বাড়ির প্রত্যেকটা বাগান সে নিজের হাতে করেছে।”

আলো ঘুরে দাঁড়ায় পোনার দিকে। ঘুরে দাড়াতেই তার চোখ যায় সামিনের দিকে। সামিনকে দেখেই সে চোখ মুখ শক্ত করে ফেলে। তারপর ফুলগাছের দিকে তাকিয়ে পোনা চাচাকে বলে,”এগুলো সব উ’প্রে ফেলুন। ”
পোনা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আলোর দিকে। সামিনের কোনো ভাবান্তর নেই। সে জানে,আলো তাকে অপমান করে কিছু একটা বলবে এখন।
সামিনের ধারণা সত্যি। আলো তার দিকে আঙুল তুলে পোনা চাচাকে বলে,”এই অ’স’ভ্য লোকটার সাথে ফুল মানায় না। এর সাথে কাঁ’টা মানায়। এই ফুল গাছ গুলো উপ্রে ফেলে এখানে কিছু কাঁ’টা মান্দার গাছ এনে লাগিয়ে দিন। তারপর সেই গাছে দড়ি বেঁধে গলায় পেঁচিয়ে ঝুলে পরতে বলুন এই কু’লা’ঙ্গা’র টাকে।”

পোনার মুখ হা হয়ে যায় আলোর কথা শুনে। আলোর চোখ মুখ জ্ব’ল’ছে রোদে এবং রাগে। সামিন কয়েক মুহূর্ত পরে ঠান্ডা গলায় পোনাকে বলে ওঠে,”ওকে দাড় করিয়ে রেখেই ,ওর চোখের সামনে গাছ গুলো উ’প্রে ফেলে দিন পোনা চাচা। তারপর ওকে বাড়ির ভেতরে পাঠিয়ে দিন।”

সামিন চলে যায় বাড়ির ভেতরে। আলো বিড়বিড় করে বলে,”ফে’রা’উ’ন।”

পোনা আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”এমন কথা বলো না মা,এমন কথা বলে না স্বামীকে!”

আলো তেতে ওঠে,”স্বামী? কিসের স্বামী? ঐ ক্রি’মি’না’ল’টাকে আমি স্বামী বলে মানি না।”
_সামিন ইয়াসার কোনো ক্রি’মি’না’ল না মা।

আলো দাঁত খিচিয়ে বলে,”স্বেচ্ছায় অ’ন্ধ আপনারা। চো’খে পট্টি বেঁ’ধে রেখে কিভাবে দেখবেন সব। আমার সাথে যা হয়েছে তার পরেও বলবেন ও ক্রি’মি’না’ল না ?”

পোনা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”দেখো মা, তোমার আর সামিনের বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাইনা। সামিন ছোটো বেলা থেকেই একটু জে’দী। জে’দের বশে করে ফেলেছে। কিন্তু মা,ও খা’রা’প ছেলে না। ওকে আমি এইটুকু বয়স থেকে চিনি। ও কয়টা এতিমখানা চালায় তুমি জানো? ও সবসময় মানুষের উপকার করে। ওর কাছে কেউ সাহায্য চাইলে বিনা প্রশ্নে ও সাহায্য করে। এমন মানুষ আর যাই হোক, ক্রি’মি’না’ল না মা। এই আমাকে দেখো। আমার মতো গরীব লোকের মেয়েকে সামিন ডাক্তারি পড়ায়। ওই যে রিয়াজকে দেখছো,ওর মায়ের হার্ট অপারেশন করিয়ে দিয়েছে সেদিন। প্রত্যেক বছর পারিবারিক ব্যবসা থেকে কত টাকা অসহায়দের মাঝে দান করে জানো?”

আলো একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। তারপর বলে,”আপনাদের কাছে ও মহৎ কারন ও আপনাদের কিছু না কিছু দিয়েছে চাচা। কিন্তু আমার কাছ থেকে তো আমার সব নিয়েছে ওই জা’নো’য়া’রটা, আমার পরিবার,আমার খুশি,আমার ভালোলাগা, আমার গোছালো একটা সুন্দর জীবন…..সব। নিঃ’স্ব করে ছেড়েছে আমায়। ওকে ক্রি’মি’না’ল বললেও তো কম হয়ে যায় চাচা!”

***
“কোথায় যাচ্ছো!”

সিঁড়ির প্রথম ধাপে এক পা দিতেই পি’শা’চ কন্ঠ শুনে আলো থমকে দাঁড়ায়। সামিন রুটি ছিঁড়ে ডালের বাটিতে ডুবিয়ে আলোকে প্রশ্নটি করে। আলো উত্তর দিবে না দিবে না করেও বলে ওঠে,”ন’র’কে।”

_খেয়ে তারপর যাও।
ঠান্ডা গলায় বলে সামিন ইয়াসার। লিভিং রুমের সাথে লাগোয়া ডাইনিং টেবিলে বাড়ির সবাই সকালের খাবার খেতে বসেছে। রিতু নরম গলায় ডাকে,”খেয়ে যান ভাবী।”

আলো তেতে ওঠে,”একদম আমার সাথে সম্পর্ক পাতাবে না বলে দিলাম। বলেছি না আমাকে ভাবী ডাকবে না? বলেছি না?”

রিতু শুকনো হাসি হেসে বলে,”আচ্ছা ডাকবো না। এই শেষ বার। আপনি খেতে বসেন ভাবী। কাল রাতের খাবার খাননি।”

আলো রিতুর কথার উত্তর না দিয়ে ঘুরে আবার সিঁড়ির দিকে যেতে নেয়। সামিন বলে ওঠে,”এ বাড়ির কেউ তোমার চা’ক’রা’নী না। আমার বোন,আমার ভাইয়ের স্ত্রী, কেউ তোমার চা’ক’রা’নী না যে প্রত্যেক বেলা তোমার খাবার ঘরে নিয়ে গিয়ে মুখে তুলে খাইয়ে দেবে।”

_আমি তাদের বলি? আপনার বাড়ির খাবার আমার শরীরে বি’ষে’র থেকে কম প্রভাব ফেলে না।

_চুপচাপ মুখ না চালিয়ে খেতে এসো।

আলো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। টেবিলের উপর রাখা রুটির বাটি থেকে একটা রুটি উঠিয়ে নিয়ে সেটা থেকে এক টুকরো ছিঁড়ে মুখে দিয়ে এক গ্লাস পানি হাতে নেয়। তারপর রুটির টুকরো টা পানি দিয়ে গিলে হনহন করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়।

আলো ন’র’কে ঢুকে দরজা চাপিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। হ্যা,ইয়াসারের এই ঘরটা তার কাছে ন’র’কের থেকে কম কিছু না। শূন্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সে। হঠাৎ তার চোখে পরে দেয়ালে টাঙ্গানো একটা ছবি। ছবিটা আগে চোখে পরেনি তার।তিনজন ছেলে এবং একজন মেয়ে বাচ্চার ছবি। বড় ছেলেটি ওই পি’শা’চ টা তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ‌। চেহারায় পৈ’শা’চি’ক ছাপ স্পষ্ট। তার পরের জন ইলহাম নামের চ’রি’ত্র’হী’ন লোকটা, মেয়েটি ইশিতা নামের মেয়েটি। চেহারায় বেশ মিল পাওয়া যাচ্ছে। ছোটো এই ছেলেটি তবে কে? আলো কিছুক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। ছেলেটাকে আলোর কাছে খুব চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে কোথাও দেখেছে সে।

“তোমার বৌ কিন্তু বেশ বাড়াবাড়ি করছে ভাইয়া। ভাইয়ের বৌ তাই আমি কিছু বলছি না।”
_কি করেছে?
ঠান্ডা গলায় বলে সামিন ইয়াসার। ইলহাম বিরক্ত হয়ে বলে,”কি করেছে মানে? আমাকে মুখের উপর রে’ই’প কেইসের আ’সা’মি বললো।”

_মিথ্যে তো কিছু বলেনি। প্রতি মাসে হাজিরা দিস এখনো।
কফির কাপে চুমুক দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলে ইয়াসার। ইলহাম বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,”তুমি জানো সব মিথ্যা ভাইয়া। ওড়না ধরে টে’নে’ছি’লা’ম শুধু।”
_তোর ওই এক টানে আমাদের পরিবারের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে ডাউনফল শুরু হয়েছিলো। জেলে প’চে ম’র’তি। ভালোর মধ্যে ভালো হয়েছে রিতুর মতো একটা মেয়েকে বৌ হিসেবে পেয়েছিস।

ইলহাম নাক চোখ কুঁচকে ফেলে। কি ভালো? একটা গ্রামের মেয়ে। নেহাত ইলহামের সন্তান পেটে ধ’রে’ছে,নয়তো কবে বাড়ি থেকে নামিয়ে দিতো!

সামিন কফি শেষ করে বলে,”ইশমামের জন্য দোতলার উত্তর পাশের ঘরটা পরিষ্কার করে রাখবি ওদের দিয়ে। আমি এখন বের হবো,আজ সংবর্ধনা সভা।”
ইলহাম মাথা নাড়ায়। সামিন বলে,”বাবা আসবে কবে?”
_সামনের সপ্তাহে।

সামিন উঠে দাঁড়ায়। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে তার ঘরের দরজার কাছে এসে সে থ’ম’কে যায়। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।

সামিন মৃদু স্বরে ডাকে,”আলো।”

বারবার ঐ পি’শা’চ’টার মুখে নিজের নাম উচ্চারিত হতে শুনলেই আলোর গা রিরি করে ওঠে।

সামিন কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে আবারো বলে,”দরজা খোলো। শুধুমাত্র বিছানাটা তোমাকে ছেড়ে দিয়েছি। এই ঘরটা না। এই ঘরটা আমার আলো। দরজা খোলো।”

আলো দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। সরে গিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন ভেতরে ঢুকে একবার আলোর দিকে তাকায়। তারপর আলমারি থেকে তার পোশাক বের করে ওয়াশ-রুমে ঢুকে পাল্টে নেয়। শুভ্র সুতির পাঞ্জাবি আর তার উপরে মুজিব কোট চাপিয়েছে আজ সে। পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে নিতে নিতে সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নিজের চুল ঠিক করে আয়নার মধ্যে আলোর প্রতিবিম্বের দিকে এক পলক তাকিয়ে বলে,”তোমার মায়ের জ্ব’র সে’রে’ছে। ভাইয়েরা আজ কলেজে গিয়েছে।”

আলো চ’ম’কে ওঠে। সামিনের দিকে তাকিয়ে নিস্তেজ কন্ঠে বলে,”পেয়ে গিয়েছেন তো আমায়। হয়ে গিয়েছে না প্র’তি’শো’ধ নেওয়া? এখনো কেনো ওদের পি’ছু পরে আছেন? ছেরে দিন ওদের।”

সামিন আলোর দিকে এগিয়ে এসে শুকনো হাসি হাসে, তারপর বলে,”বাহ! এই তো! এভাবে কথা বলবে আলো। মেয়ে মানুষ ঠিক এভাবে কথা বলে, নমনীয় হয়ে। তাহলে যদি পুরুষের মন গ’লে, জে’দ দেখিয়ে কিছু বললে পুরুষ শুনবে কেনো?”

সামিনের এই কথাটিতে সামিনের প্রতি আলোর ঘৃ’ণা আরো একধাপ বেড়ে যায়। সে কিছু না বলে চোখ নামিয়ে নেয়। বলতে বলতে সে ক্লান্ত। সামিন বলে,”নজর রাখছি না ওদের উপর। দেখভাল করছি। তোমার ভাই দু’টো একেবারে যা তা লেভেলের ভী’তু। ওদের দেখভাল করতে হবে প্রচুর। যত যাই হোক,আমি ওদের দুলাভাই।”

“দুলাভাই” শব্দটা শুনে আলো দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন আলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আলোর হাত ধরে। আলো এক ঝ’ট’কা’য় হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। সামিন আবারো ধরে আলোর হাত তারপর আলোর কনুইয়ের দিকটা দেখে। আলোর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,”এতটা কেটেছে কিভাবে?”
আলো হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে বারান্দায় চলে যায়।

সামিন এক মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে ড্রয়ার থেকে একটা মলম আর তার তিনটা পাঞ্জাবি বিছানার উপরে রেখে বলে,”মলমটা লাগিয়ে নিও।আর আমার বাড়ির প্রাচীর খুব উঁচু আলো। এই প্রাচীর ট’প’কে পালাতে পারবে না তুমি। শুধু শুধু তা’র’কা’টা’য় লেগে নরম তক ক্ষ’ত’বি’ক্ষ’ত হবে। আজ প্রথম এবং শেষ। এরপর কখনো যদি দেখি তুমি বাগানে গিয়েছো তাহলে খুব খা’রা’প হবে। আজকে এই চমৎকার পা’ক’না’মি’র জন্য তোমাকে শাস্তি হিসেবে এই পাঞ্জাবি তিনটা দিয়ে গেলাম। বোতাম গুলো লাগিয়ে রাখবে।

সামিন চলে যায়। আলো চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। চালাক শি’য়া’লটা ঠিক বুঝে গিয়েছে আলো বাগানে কেনো গিয়েছিলো!

***
“আমাদের সময়ানুবর্তী ভাই আজ লেইট করছে,এই ব্যাপারে তোমাদের মতামত কি ভাইলোগ?”

রাহাতের এমন প্রশ্নে সবাই ওর মুখের দিকে তাকায়। ফুয়াদ চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে,”কাল সারাদিন ধ’ক’ল গিয়েছে। তাই ঘুমটা একটু গভীর হয়েছে বোধ হয়।”

ফুয়াদের এমন উত্তরের বিরোধীতা করে তৌফ বলে,”না ভাই। ভাই তো এই প্রথম এতো ধকল সামলায় না। এসবে ভাইয়ের অভ্যেস আছে। আসলে নতুন বৌ রেখে বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে হয় না পুরুষ মানুষের। আমাকে দেখেন,আমি তো আসতেই চাইনি এতো তাড়াতাড়ি, রনি ভাই ঘা’র ধ’রে নিয়ে আসছে।”

সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। আরাফ ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বলে,”ভাই ওই মেয়েটাকে নিয়ে কিভাবে সংসার করবে সেটাই তো বুঝতে পারছি না। ওই মেয়েকে তো ভাই ভালোবাসে না।”

_ভালো আজ বাসে না, কাল তো বাসতেই পারে।

তৌফের এমন কথায় রাহাত বলে,”ভাই অমন মেয়েকে কখনোই ভালো বাসবে না। ওই মেয়ে আজীবন একটা জে’দ হয়ে থাকবে ভাইয়ের কাছে।”
_না ভাই, মিলিয়ে নিয়েন আমার কথা। মেয়ে মানুষ জাদু জানে ভাই। দেখবেন একদিন ঠিকই ভাই ওই মেয়েকে বু’কে টে’নে নিয়ে বলবে,”ভে’ঙে’ছো কলসির কানা, তা বলে কি প্রেম দেবো না?”

সবাই চাপা স্বরে হেসে ওঠে তৌফের কথায়। তৌফ মুখ হাসি হাসি করে বলে,”স্ত্রীকে বি’ছা’না’র সৌন্দর্য উপাধি দেওয়া ভাই একদিন ওই মেয়েকে মাথায় তুলে নাচবে। এইটা যদি না হয়,তাহলে আমার নাম উল্টে ফেলবেন।”

রাহাত বলে,”আমি এখনি তোর নাম উল্টে ফেলছি, তোর নাম আজ থেকে ফতৌ।”

এমন সময় সামিন এসে দাঁড়ায় সেখানে। সামিনকে দেখে তৌফ চুপ হয়ে যায়। ফুয়াদ উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”দেরী হলো কেনো? প্রথম দিনেই এতো দেরী? জনগণ তো আ’শা’হ’ত হবে নেতা।”

সামিন চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে,”ইশমাম আসবে কাল। ওর জন্য বাড়িটা একটু গোছগাছ করিয়েছি। লোককে বুঝিয়ে দিয়ে এলাম সবটা।”

তৌফ সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”ভাই আপনাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে। মুজিব কোট গায়ে আপনাকে পুরো শেখ মুজিবরের মতো লাগছে। শুধু গোঁফ এবং হাতে পাইপটা নেই।”

আরাফ পানি খেতে নিচ্ছিলো,তৌফের কথা শুনে কাশি উঠে যায় আরাফের। ফুয়াদ সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”এখন চল! বসে পরলি কেনো? আজ তোর সংবর্ধনা অনুষ্ঠান , তোর কোনো শীত গরম দেখছি না।”

সামিন উঠে দাঁড়ায়। সত্যিই,কোনো এক অজানা কারনে সে আগ্রহ পাচ্ছে না কোনো কিছুতে। মন পরে আছে বাড়িতে। এর কারন কী!

***
“এই দাড়া!”

আজান আয়াত হাঁটতে থাকে। পেছন থেকে কলেজের কিছু সিনিয়র ছেলে ডাকে ওদের।
“এই তোদের দাঁড়াতে বলেছি না?”

দু’জনে দাঁড়িয়ে পরে। ছেলেগুলো ওদের সামনে এসে দাঁড়ায়। এদের মধ্যে একটা খুব লম্বা দেখে ছেলে ধ’ম’কে’র সুরে বলে,”নাম কি তোদের?”

আজান নমনীয় হয়ে বলে,”আমি আজান, ও আয়াত।”
_কোন ক্লাস?
_ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার।

_বড় ভাইদের দেখলে সালাম দিতে হয় জানিস না?
আজান আর আয়াত একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। ছেলে গুলোর মধ্যে থেকে একটা ছেলে লম্বা ছেলেটাকে বলে,”দীপু ভাই। এখনো সালাম দিচ্ছে না। এদের মাথায় কি ঘি’লু নেই?”

দীপু কপাল কুঁ’চ’কে বলে,”হু,তাই তো দেখছি।”
তারপর আজান আয়াতের দিকে তাকিয়ে বলে,”এই কলেজের নিয়ম জানিস?”
আজান আয়াত মাথা নাড়ায়। দীপু বলে,”কলেজে ঢুকে বড় ভাইদের সালাম দিতে হয়।”

একটা ছেলে আজানের চো’খ থেকে চশমা খুলে নেয়। চশমা নিজের চো’খে লাগিয়ে বলে,”এতো পাওয়ার তোর চশমায়। কা’না নাকি রে তুই।”

_ওর চশমাটা দিয়ে দিন। চশমা ছাড়া ওর অসুবিধে হয়।

কঠিন গলায় বলে আয়াত। দীপু কপাল কুঁচকে আয়াতের দিকে তাকিয়ে বলে,”বাবা, বিড়াল তো মিউ মিউ করতে জানে দেখছি। আচ্ছা চশমা ফেরত পাবি, আগে একটু নেচে দেখা। নাচে যদি দশে দশ পাস তাহলে চশমা ফেরত পাবি।”

পাশ থেকে একটা ছেলে দাঁত বের করে বলে,”ভাই আমার পছন্দের গানে নাচবে ওরা।”
কথাটি বলেই ছেলেটা ফোনে একটা হিন্দি গান ছে’ড়ে দেয়।
আজান আয়াত ঘা’ব’ড়ে গিয়ে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে।

রনির নাম্বার দেখে সামিন ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে। ওপাশ থেকে রনি বলে,”আপনার “দু’দু’ভা’তু” শ্যালক দু’টোকে র‌্যাগ দিচ্ছে অনার্সের কিছু রাম-ছাগল। কি করবো?”

_তুই ভালো করে জানিস তুই কি করবি। শুধু শুধু আমাকে ফোন দিয়েছিস কেনো?

ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় সামিন। তারপর বলে ওঠে,”দাঁত গুলো নাড়িয়ে দে। একেবারে ফেলে দিস না।”

রনি ফোন কেটে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। ভাইয়ের বিয়ের চক্করে রাজনীতি ছেড়ে কখনো সেলসম্যান, কখনো ওষুধের ডিলার কখনো গু’ন্ডা’গি’রি করতে হচ্ছে। কি দিন এলো তার!

***
“আলোকে কোথাও দেখছি না ভাবী। কোথাও গিয়েছে নাকি ও?”

রেহেনা মাথা ঘুরিয়ে খোরশেদের দিকে আ’ত’ঙ্কি’ত মুখ নিয়ে তাকায়। আমতা আমতা করে বলে,”ওর মেজো মামার কাছে গিয়েছে।”

_বজলুর কাছে? খুলনা গিয়েছে? ওর তো শুনেছি সামনের সপ্তাহে ইনকোর্স এক্সাম।

রেহেনা ম্লান হেসে বলে,”ওর নানী একটু অসুস্থ। দেখতে চেয়েছে। চলে আসবে।”

খোরশেদ যেন বিশ্বাস করতে চাইছে না সবটা। বিষয়টা তার কাছে খুব গোলমেলে লাগছে। আতাউর আলম হুট করে নির্বাচন বর্জন করে গর্তে ঢুকে গিয়েছে এদিকে তার মেয়ে বাড়ি থেকে উধাও। বিষয়টি খুবই গোলমেলে।

দীপুর পেছনে দাঁড়িয়ে রনি বলে ওঠে,”নাচ দেখতে ইচ্ছে করছে তোদের?”

আজান আয়াত রনির কন্ঠস্বর শুনে একটা ঢোক গিলে ফেলে। এ তো সেই লোকটা, যে সেদিন রাতে তাদের গলায় ছুরি ধরেছিল। এ এখানেও চলে এসেছে!

দীপু রনিকে দেখে ঘাবড়ে যায়। সামিন ইয়াসারের খাস চ্যা’লা রনি। এ কেনো এখানে এসেছে!

রনি এগিয়ে যায় দীপুর দিকে। কঠিন গলায় বলে,”নাচ দেখবি?”

দীপু একটু সাহসী সাজতে চায় নিজের দলের কাছে। বুক ফুলিয়ে বলে,”এটা আমাদের কলেজের মামলা।”
_কিন্তু ওরা তো আমার লোক।

_আপনার লোক মানে?
_মানে আমাদের সামিন ভাইয়ের একটা নাচের গ্রুপ আছে বুঝলি। ওরা সেই দলের লোক। আমাদের লোক এভাবে কোনো পারিশ্রমিক ছাড়া নাচে না,তার জন্য অনেক বড় দাম দিতে হয়।

_দাম মানে?
_হু, দাম। আপাতত তোর দাঁত গুলো দে।

দীপু কিছু বুঝে ওঠার আগে স্ব-শব্দে দীপুর ডান গালে একটা চ’ড় বসিয়ে দেয় রনি। ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেকে আঁ’ত’কে ওঠে।
রনি আজান-আয়াতের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”ক্লাসে যাও।”

***
সারাটা দিন সামিন বাইরে কাটিয়ে সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ি ফিরেছে। গাড়ির পেছনের সিট দু’টো ফুলের মালায় ভর্তি হয়ে গিয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে অলস ভঙ্গিতে হেঁটে বাড়ির ভেতরে যায়। ইহান তার বড় বাবাকে দেখে ছু’টে আসে। ইহানকে কোলে উঠিয়ে গালে চুমু খায় সামিন। লিভিং রুমে এসে দাঁড়ায় ইহানের নতুন টিচার শান্ত। ফরসা এবং সুদর্শন একজন যুবক। কাঁধে ব্যাগ উঠিয়ে নিয়ে সামিনের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে সালাম দেয়। সামিন সালামের উত্তর দিয়ে বলে,”নাস্তা করেছো।”
_জ্বি ভাইয়া।
নিচু স্বরে বলে শান্ত। তারপর চলে যায়। সামিনের কাছে ছেলেটিকে বাড়াবাড়ি রকমের বোকা বোকা মনে হয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে,ইশমামের বয়সী। কেমন মাথা নিচু করে হাঁটাচলা করে। মাথায় একটা ঘোমটা দিলেই পুরোপুরি মেয়ে মানুষ লাগতো। সামিনের কাছে ছেলেটির আচার আচরণ হাস্যকর লাগে। এভাবে মাথা নিচু করে হাঁটবে মেয়ে মানুষ, পুরুষ হাঁটবে বুক ফু’লি’য়ে। সিংহের মতো।

রিতু একগ্লাস লেমন ওয়াটার এনে সামিনের দিকে এগিয়ে দেয়। সামিন হাসি দিয়ে গ্লাসটা নিয়ে চুমুক দিতে দিতে বলে,”সব ঠিক ঠাক?”
_না ভাইয়া। একটু সমস্যা আছে।

সামিন চুমুক দিতে গিয়েও দেয়না। রিতু বলে,”ঘরে গিয়ে দেখুন।”

সামিন গ্লাস টা রিতুর হাতে দিয়ে হনহন করে চলে যায় নিজের ঘরে। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই তার চোখ ক’পা’লে উঠে যায়। পুরো ঘরে টুকরো কাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে আছে। আলোর তার শখের দামী পাঞ্জাবি তিনটা খুব যত্ন করে কাচি দিয়ে কু’চি কু’চি করে কে’টে ফেলেছে।
আলোর এমন শিশুসুলভ আচরণে সামিনের খানিকটা রাগ উঠলেও সে তার অনুভূতি ব্যক্ত করেনা। বরং ঠান্ডা গলায় বলে,”বড্ড পরিশ্রমী মেয়ে তুমি আলো। পাঞ্জাবি তিনটা মাঝ বরাবর একটুখানি কেটে ফেললেই সেগুলো পরার অযোগ্য হয়ে যেতো। কিন্তু তুমি কত ধৈর্য দেখালে।”
আলো মেঝেতে চুপচাপ বসে ছিলো। সামিনের দিকে না তাকিয়ে বলে,”সুযোগ পেলে আপনার শরীর টাও এভাবে টু’ক’রো করবো আমি।”

সামিন বাঁকা হাসি হেসে আলমারি থেকে তার একটি ট্রাউজার আর টি-শার্ট বের করে আলোর দিকে না তাকিয়ে বলে,”খালি কলসি বা’জে বেশি। প্রবাদটার পারফেক্ট উদাহরণ তুমি আলো।”

কথাটি বলে ওয়াশ রুমে ঢুকে জামাকাপড় পাল্টে নিয়ে বের হয়ে সিতারা কে ডেকে ঘরটা পরিষ্কার করে দিতে বলে সামিন। সিতারা ঘর পরিষ্কার করে দিয়ে চলে যায়। সামিন আলোর দিকে একবার তাকিয়ে বলে,”মেঝেতে বসে থাকো কেনো এভাবে?”

আলো তার উত্তর দেয় না। সামিন আলোকে ভালো করে লক্ষ্য করে বলে ,”ওষুধ লাগাওনি কেন হাতে?”

আলো চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। সামিন বিছানার উপর থেকে মলমটা উঠিয়ে নিয়ে এসে আলোর সামনে বসে। আলোর হাত টা ধরে কিছুক্ষণ ক্ষতটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,”এরকম একটা গভীর ক্ষ’ত এভাবে খোলা রেখে ঘুরে বেরাচ্ছো। ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে, এতটুকু কমন সেন্স নেই তোমার সচেতন বাবার সচেতন কন্যা?”

_হোক ইনফেকশন, আপনার থেকে ভ’য়ং’ক’র কিছু না সেটা।

ঠান্ডা গলায় বলে আলো। সামিন কিছু না বলে আলোর হাত ধরে ওষুধ লাগিয়ে দেয়ার জন্য। আলো এ ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,”এভাবে কথায় কথায় আমাকে ছোঁ’য়া’র অযুহাত বের করবেন না। জা’নো’য়া’র , জা’লি’ম কোথাকার।

সামিন ম্লান হেসে আলোর দিকে তাকায়। তারপর আলোর হাতটা তার শক্তিশালী হাতে শক্ত করে ধরে। আলো সামিনের শক্তির সাথে পেরে ওঠে না। সামিন ওষুধ টা আলোর হাতে লাগিয়ে দিতে দিতে বলে,”তোমাকে ছুঁ’তে আমার কোনো অজুহাত কিংবা নাটক করতে হবে না আলো। ভুলে যাচ্ছো তুমি আমার স্ত্রী। তোমাকে ছোঁ’য়া’র ইচ্ছে হলে আমি কোনো অজুহাত খুঁজতে যাবো না।”

আলোর নিজের অসহায়ত্বের কথা সামিনের মুখে আরো একবার উচ্চারিত হতে শুনে ঠোঁট কাঁ’প’তে থাকে। সামিন আলোর ক্ষ’ত তে ওষুধ টা লেপ্টে দিয়ে আলোর দিকে তাকায়। আলোর চোখে পানি দেখে তার হঠাৎ করে মনে হলো এরকম একটা কথা বলা তার ঠিক হয়নি। ভয় পেয়েছে মেয়েটা। পরক্ষনেই মনে পরলো,ভয় দেখানোর জন্যই তো বলেছে সে কথাটা।

সামিন উঠে দাঁড়ায়। আলো অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”জা’নো’য়া’র, পি’শা’চ।”

সামিন আলোর দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে,”আচ্ছা তোমার মুখ ব্যাথা করে না? এক কাজ করবে, বারবার কষ্ট করে আমাকে এসব না ডেকে একটা টেপ রেকর্ডারে গা’লা’গা’ল গুলো রেকর্ড করে রাখবে। তারপর আমি বাড়িতে ফিরলেই আমার কানের কাছে রেখে অন করে দিয়ে বসে থাকবে। তোমার কষ্ট হবে না।‌”

আলো মুখ ঘুরিয়ে নেয়। সামিন বলে,”কাল সকালে আমার ছোটো ভাই আসবে আমেরিকা থেকে। তুমি এ বাড়ির বৌ তাই ভাবলাম তোমাকেও বলে রাখি কথাটা। তার সামনে কোনোরকম ঔদ্ধত্য দেখাবে না তুমি। সে খুব ভালো একটা ছেলে, তাকে অপমান করে,গা’লি দিয়ে কোনো কথা তুমি বলবে না। আমি বরদাস্ত করবো না আলো।”

চলমান……..