বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে পর্ব-৬+৭+৮

0
621

#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_৬
#Esrat_Ety

রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে গিয়ে ডিপার্টমেন্টের হেড প্রফেসর তৌফিকুল ইসলামের কক্ষে ঢুকে পরে আলো। তৌফিকুল ইসলাম পানির গ্লাস হাত থেকে নামিয়ে রেখে আলোর দিকে তাকায়।
“আলো? কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?”

আলো একটা ঢোক গিলে তার শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালে জমে থাকা ঘাম মুছে বলে,”স্যার অতিথি হিসেবে কে কে আসছে?”

_প্রধান অতিথি মাননীয় এমপি মহোদয় কবির আলমগীর, বিশেষ অতিথি জননেতা সামিন ইয়াসার, আইজি সাহেব, বয়েজ কলেজের প্রিন্সিপাল রয়েছে।‌ এছাড়াও আরো অনেকে। কেনো?

আলো হতভম্ব হয়ে তৌফিকুল ইসলামের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। সামিন ইয়াসার আসবে? তার মানে ওই জানোয়ার টাকে হোস্ট করতে হবে আলোর! কি সাংঘাতিক কথা। এর চেয়ে অপমান এবং অসম্মানের ব্যাপার আলোর জন্য কিছু হতে পারে না।

আলো একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে তৌফিকুল ইসলামের দিকে তাকিয়ে বলে,”স্যার। আমি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে পারবো না।‌দুঃখিত।”

তৌফিকুল ইসলাম অবাক হয়ে যায়। আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”মানে? আর বিশ মিনিটে অনুষ্ঠান শুরু হতে যাচ্ছে আর তুমি এখন এই কথা বলতে এসেছো? কি হচ্ছে কি এসব আলো?”

_স্যার।
আলো আমতা আমতা করতে থাকে।

তৌফিকুল ইসলাম বলে,”সামিন ইয়াসার কে নিয়ে সমস্যা? কিন্তু আলো ওটা তো তোমার পার্সোনাল প্রবলেম। কলেজের অনুষ্ঠানে কেনো ব্যাঘাত ঘটাতে চাইছো?”

আলো তার উত্তর না দিয়ে বলে,”স্যার সামিন ইয়াসার অতিথি হবার যোগ্য?”
_তার যোগ্যতা সম্পর্কে কতটুকু ধারণা আছে তোমার? তুমি জানো ও কত বড় মাপের একজন জননেতা?

_পুরোটাই ভণ্ডামি।

তৌফিকুল ইসলাম শীতল চোখে তাকায়, তারপর বলে,”যাও গিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করার প্রস্তুতি নাও। গলা ঠিক করো। ভলান্টিয়ারদের ডাকো। ফুলের তোড়া এসেছে?”

আলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
তৌফিকুল ইসলাম ধমক দিয়ে বলে,”কথা শোনো আলো।”

_স্যার আগে কেনো জানানো হয়নি সামিন ইয়াসার আসবে?

তৌফিকুল ইসলাম রেগে গিয়ে বলে,”মানে? প্রিন্সিপাল কাকে অতিথি করবেন সেটা কি তোমাকে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে আলো?”

আলো ঘাবড়ে গিয়ে বলে,”না স্যার।”

_যাও আলো। বোকামি করো না। অলরেডি দুজন আসেনি ভলান্টিয়ার। অসুস্থ তারা। এখন তুমি এমন করলে প্রিন্সিপাল দারুন ক্ষেপে যাবে। যাও!

***
“এই চা-টা যে বানায়,মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে তাকে নিজের বাড়িতে পারমানেন্ট চা বানানোর লোক হিসেবে নিয়োগ দেই। একেবারে বেহেস্তী চা।”

প্রিন্সিপাল শওকত হাসান কথাটি বলে চায়ে চুমুক দেয়। সামিন ইয়াসার নিজেও আগ্রহ নিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে,”তা বেহেস্তী চা কিভাবে বুঝলেন স্যার? বেহেস্তে কি আপনার নিয়মিত যাতায়াত হয়? আমাকেও একদিন সাথে করে নিয়ে যাবেন। ওখানে গিয়ে চা খেয়ে আসবো।”

শওকত হাসান হো হো করে হেসে ওঠে সামিন ইয়াসারের কথায়। সামিন ফোনের দিকে তাকায়। ইশমাম ফোন দিচ্ছে। সে প্রিন্সিপালের কক্ষে থাকা সকলকে উদ্দেশ্য করে বলে,”এক্সকিউজ মি!”
তারপর ফোন নিয়ে বাইরে চলে আসে। তার কাছে এদের সাথে বেহুদা আলাপের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো ইশমামের সাথে কথা বলা।
ফোনটা রিসিভ করতেই ইশমাম বলে,”ভাইয়া।”
_বল ছোটো।
_আজকের সেমিনার টা ক্যানসেল হয়েছে। হাতে প্রচুর ফ্রি টাইম। ভাবলাম তোমাকে ফোন দেই।
_ফ্রি টাইম তো গার্লফ্রেন্ড-কে ফোন দিয়ে কথা বল, সময়টাকে কাজে লাগা।

ইশমাম হেসে ফেলে ভাইয়ের কথায়। মনে মনে বলে,”আমার প্রেমিকার নাম জানতে পারলে আমাকে তুমি গুলি করে দেবে ভাইয়া।”

মুখে বলে,”কোথায় তুমি?”
_একটা প্রোগ্রামে এসেছি, অতিথি হয়ে।
_ওহহ আচ্ছা। তাহলে তো খুব ব্যস্ত।
_না। সবার আগে তুই। তুই বলতে থাক।
_না ভাইয়া। এখন রাখছি। আবার পরে ফোন দেবো। ঠিকাছে?

সামিন ইয়াসার হেসে বলে,”ঠিকাছে।”

আলো আতংকিত মুখ নিয়ে তৌফিকুল ইসলামের কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে। মেজাজ মাত্রাতিরিক্ত খারাপ হয়ে আছে। ধীরপায়ে হেটে কলাভবনের দিকে যেতে থাকে। কলেজের গেইট দিয়ে অতিথিদের গাড়ি এক এক করে ঢুকছে। আলো সেদিকে তাকিয়ে দেখতে পায় সামিন ইয়াসারের লাল রঙের গাড়িটা পার্ক করা। তার মানে এসে গিয়েছে অসভ্য লোকটা। বিরক্তিতে আলোর মুখ তেতো হয়ে যায়। হঠাৎ করে তার ফোন বেজে ওঠে। স্ক্রিনে ইশমামের নাম্বার দেখে সে কিছুটা অবাক হয়। এই সময়ে ইশমামের ব্যস্ত থাকার কথা ‌ । সে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে। ইশমাম বলে,”কি করছেন ম্যাডাম?”
_হাটছি। তুমি?
_আমি ফ্রি টাইমে আমার দুজন প্রিয় মানুষের সাথে কথা বলছি। একজনের সাথে কথা বলা শেষ করে আরেকজনকে ফোন দিলাম।
আলো অবাক হবার ভান করে বলে,”তাই? তা আপনার অন্য প্রিয় মানুষটি কে? যাকে আপনি আমাকে ফোন দেওয়ার আগে ফোন দিয়েছেন? সে কি আমার থেকেও দামী?”

_হুম কিছুটা।
_তোমার মা?

ইশমাম চুপ হয়ে যায়। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে,”হু।”

আলো বলে,”আজ না সেমিনার ছিলো তোমার?”
_ক্যানসেল। হাতে অফুরন্ত সময় পরে আছে।

আলো হেসে বলে, “দুঃখিত জনাব। আপনার ফ্রি-টাইম টাকে নষ্ট করার জন্য। আমার অনুষ্ঠান এখন শুরু হবে। এখন তবে রাখি?

ইশমাম হেসে ফোন কেটে দেয়। আলো হাত দিয়ে কপালের এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে দ্রুতপায়ে হেটে কলাভবনের বিশালাকার কক্ষটিতে ঢুকে পরে। এদিক ওদিক না তাকিয়ে ভলান্টিয়ারদের কাছে গিয়ে তাদের ফুলের তোড়া এবং অতিথিদের জন্য ব্যাজ আনবার নির্দেশ দিয়ে নিজে মাইক্রোফোনের কাছে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। সে একটু একটু ঘামছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। কমলা রঙের একটি জামদানি শাড়ি পরেছে আজ আলো। সাজের মধ্যে হালকা পাউডার লাগিয়েছিলো মুখে আজ। তা ঘামের সাথে গলে গলে নামছে মুখমণ্ডল থেকে। আলো চোখ তুলে একবার অতিথি আসনের দিকে তাকায়। কেউ এখনো এসে আসন গ্রহণ করেনি। নিশ্চয়ই প্রিন্সিপালের কক্ষে বসে জামাই আদর খাচ্ছে সবকটা।

দীর্ঘসময় অতিবাহিত হয়ে যায়। আলো মাইক্রোফোন অন করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে অনুষ্ঠানের আরম্ভ ঘোষণা করে দেয়। খেয়াল করলো তার গলা অস্বাভাবিক কাঁপছে। নিজের প্রতি নিজেই বেশ বিরক্ত হয় আলো। আসুক ঐ লোকটা,তাতে তার কি! ওই লোকটা বাঘ না ভাল্লুক যে তাকে ভয় পেতে হবে। তবে আলো ঠিক ভয় পাচ্ছে না। নিজের মুখে ঐ লোকটার নাম উচ্চারণ করতে হবে ভেবে এখন-ই অপমানিত বোধ করছে সে।

অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রতিযোগীরা সবাই এসে গিয়েছে। কলাভবনের বিশাল কক্ষ মানুষের পদচারণায় গমগম করছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রিন্সিপাল শওকত হাসান নিমন্ত্রিত সব অতিথিদের নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে। সবাইকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে আসছে বিভিন্ন বিভাগের প্রফেসর-রা। আলো তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। নিজেরা উচ্চশিক্ষিত প্রথমশ্রেনীর কর্মকর্তা হয়ে কতগুলো অর্ধশিক্ষিত নেতাশ্রেনীর মানুষকে তেল দেওয়ার চেষ্টা করছে। কি অদ্ভুত শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে এই সমাজ। ক্ষমতা আছে তার মানে দুনিয়া তাকে তোয়াজ করে চলতে বাধ্য!

মাননীয় সংসদ সদস্য মহোদয় নিজের আসন গ্রহণ করে বসেছেন। ঠিক তার পাশের চেয়ারটিতে এসে বসে পরেছে সামিন ইয়াসার মির্জা। শুভ্র পাঞ্জাবি পরনে তার, পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে রেখেছে, ক্লিন শেভ করেছে সে। আলো তার সবথেকে অপছন্দের মানুষটির মুখদর্শন করে চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকে। ইয়াসার মির্জার চারজন চামচা তার সাথেই এসেছে। এরা বডিগার্ডের মতো ইয়াসার মির্জাকে ঘিরে থাকে সবসময়। আলো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তার হাতের কাগজটা একবার দেখে। লেখা আছে বিশিষ্ট সমাজসেবক এবং গণমানুষের নেতা সামিন ইয়াসার মির্জা। আলো লেখাটি পড়ে চোখ বড় বড় করে ফেলে,এখন তাকে ঐই অসভ্য মানুষটাকে “বিশিষ্ট” বলে সম্বোধন করতে হবে নাকি!

সামিন ইয়াসার আসন গ্রহণ করেই এদিকে ওদিকে তাকায়। তার দৃষ্টি কাউকে খুঁজছে। হঠাৎ করে স্টেজের এক কোণে দৃষ্টি যেতেই তার চোখ আটকে যায়। কিছুক্ষণ সে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে। তার চিন্তাশক্তি কয়েক মুহূর্তের জন্য লোপ পেয়ে যায়। মাইক্রোফোনে হাত রেখে চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে যে তরুণী, এই তরুণী টিকে অন্যরকম লাগছে আজ। শাড়ি পরে আছে বলেই কি এমন লাগছে? সামিন চোখ ফেরাচ্ছে না। কমলা রঙ-টা সামিন ইয়াসারের বরাবর অপছন্দের একটি রঙ। এই রঙের শাড়িতে কোনো শ্যাম-তরুনীকে এতোটা মোহনীয় লাগতে পারে তা সামিনের জানা ছিলো না। স্পিকারের শব্দে সামিনের ঘোর কাটে। মুহুর্তে-ই কপাল কুঁচকে ফেলে সে। ওই অদ্রিতা আলো মেয়েটা তার দিকে তাকাচ্ছে না। সামিন ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। ইগনোর করে তো আজ বাঁচতে পারবে না। দেখা যাক কতদূর পারে চেষ্টা করে!

আলো মাইক্রোফোনের সামনে মুখ রেখে স্পষ্ট গলায় বলতে শুরু করে,”ইতিমধ্যে আমাদের মধ্যে উপস্থিত হয়ে আসন গ্রহণ করেছেন সম্মানীয় সংসদ সদস্য মহোদয়,আমাদের আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। উপস্থিত আছেন বিশেষ অতিথি পুলিশ সুপার মহোদয়,শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহা এবং উপস্থিত আছেন বিশিষ্ট সমাজসেবক…….”

এই পর্যন্ত বলে আলো কয়েক মূহুর্ত থামে। সামিন ইয়াসার তার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রিন্সিপাল শওকত হাসান আলোর দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আলো চোখ মুখ শক্ত করে বলতে শুরু করে,”বিশিষ্ট সমাজসেবক ও গণমানুষের নেতা সামিন ইয়াসার মির্জা। সবাই করতালির মাধ্যমে ওনাদের অভ্যর্থনা জানাই।”

সবাই হাততালি দিতে শুরু করে। সামিন ইয়াসারের মুখে হাসি ফোটে আলো নামের মেয়েটির মুখে তার নামের আগে “বিশিষ্ট” সম্বোধন শুনে।

পেছনে বসে জামিল ফুয়াদের কানে কানে বলে,”ফান্দে পরিয়া বগা কান্দেরে ভাই! না পারছে কিছু বলতে,না পারছে কিছু সহ্য করতে মেয়েটা।”

আলো মাইক্রোফোনে বলতে থাকে,”অতিথিদের ফুল দিয়ে বরণ করবে অত্র কলেজের প্রিন্সিপাল স্যার, মোহাম্মদ শওকত হাসান।”

ভলান্টিয়াররা ফুলের তোড়া নিয়ে এগিয়ে যায় প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে। দুজন ভলান্টিয়ার কম বিধায় দুটো তোড়া টেবিলে-ই পরে থাকে। ইসলামের ইতিহাসের প্রফেসর জামান মাহবুব চাপা স্বরে চেঁচিয়ে আলোকে বলে,”নিয়ে যাও।”

আলো অবাক হয়ে বলে,”আমি?”

_হ্যা,তুমি। কুইক।

নিরুপায় হয়ে আলো ফুলের তোড়া দু’টো হাতে তুলে নিয়ে অতিথি আসনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সামিন ইয়াসার তার দিকে তাকিয়ে আছে । আলো একটি বার-ও তার দিকে না তাকিয়ে ফুলের তোড়া দুটো প্রিন্সিপালের হাতে দিয়ে এসে পুনরায় মাইক্রোফোনের কাছে এসে দাঁড়ায়।
সামিন ইয়াসারের মুখ কাঠিন্যতায় ছেয়ে যায়। এই মেয়েটির অবজ্ঞা সে হজম করে নিতে নারাজ। দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে আছে সে।

আলো তার হাতের কাগজটার দিকে একবার তাকিয়ে বলতে থাকে,”এবারে অতিথিদের ব্যাজ পরিয়ে দেবে প্রথম বর্ষের তিনজন শিক্ষার্থী। নুহা,প্রভা,রাবেয়া। তোমরা অতিথিদের আসনের সামনে এসো।”

তিনজনের মধ্যে থেকে দুজন চলে এসেছে। বাকি একজনকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। প্রিন্সিপাল স্যার রেগে আলোর দিকে তাকায়। প্রফেসর তৌফিকুল ইসলাম বলে,” শুরুতেই ঝামেলা।”

আলো আমতা আমতা করে বলে,”আমি কি করবো স্যার? প্রিন্সিপাল স্যার আমাকে কেনো চোখ রাঙাচ্ছে?”

_তোমাকে চোখ দিয়ে যেতে ইশারা করছে বেকুব মেয়ে। যাও, অতিথিদের ব্যাচ পরিয়ে দাও। কুইক।

আলো হতভম্ব হয়ে যায়। বিড়বিড় করে বলে,”ভলান্টিয়ার-রা আছে তো।”
_ভলান্টিয়াররা শাড়ি পরেছে কেউ?

_শাড়ি পরার সাথে ব্যাজ পরানোর কি সম্পর্ক স্যার? আর স্যার, শাড়ি পরা অনেক মেয়ে আছে। অন্য কাউকে ডেকে দেবো?

তৌফিকুল ইসলাম রাগী দৃষ্টিতে তাকায়। আলো একটা ঢোক গিলে বলে,”যাচ্ছি স্যার।”

একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বলে,”যা আলো। ঐ পিশাচ টাকে ব্যাজ পরিয়ে দিলে মরে যাবি না তুই। পরে না হয় হাত ধুয়ে নিবি।”

“কি হলো যাচ্ছো না কেনো।”
পেছন থেকে প্রফেসরের ধমক শুনে আলো দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায়। ডালা থেকে একটি ব্যাজ তুলে নিয়ে প্রথমে পুলিশ সুপারকে পরিয়ে দেয়। সামিন ইয়াসার আলোকে আড়চোখে দেখছে। তার মুখে পৈশাচিক হাসি। মনে মনে বলে,”এটাকে-ই বলে ক্ষমতা অদ্রিতা আলো।”
আলো পুনরায় আরেকটি ব্যাজ তুলে নিয়ে থমথমে মুখে সামিনের সামনে দাঁড়ায়। তারপর ধীরে ধীরে সামিনের দিকে একবার তাকায়।

পেছনে জামিল এবং অন্যরা চাপা হাসিতে ফেটে পরছে।

আলোর দৃষ্টিতে কি ছিলো সামিন জানে না। সে থমকে গিয়েছে। অপলক দৃষ্টিতে দেখছে একজন শ্যামবতীকে। আলো কপাল কুঁচকে ব্যাজ-টা সামিনকে পরিয়ে দিতে উদ্যত হয়। মনে মনে বলতে থাকে,”ওয়েট! পরাচ্ছি তোকে ব্যাজ !”

সামিন আলোর দিক থেকে চোখ ফেরাচ্ছে না। ক্ষণিকের জন্য সে ভুলে বসে আছে অদ্রিতা আলো নামের মেয়েটি তার শত্রু।

“আহহহ।”

সামিন নিজের আর্তনাদ শুনে নিজেই বেশ অবাক হয়। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেকে চোখ ছানাবড়া করে তাকিয়ে থাকে সামিনের দিকে। আলো সামিন ইয়াসারের দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে প্রতিশোধ নিতে পারার আনন্দ। সামিন বুকের বা পাশে হাত দিয়ে আলোর দিকে অবাক চোখে তাকায়।
প্রিন্সিপাল দাঁত কিড়মিড় করে বলে,”করলে টা কি! দিলে তো সেইফটি পিন-টা ফুটিয়ে।‌ অদ্ভুত!”

আলো ভয় পাওয়া মুখ করে প্রিন্সিপালকে বলে,”দুঃখিত স্যার। দেখতে পাইনি।”

সামিন আলোর দিকেই তাকিয়ে আছে। আলো যে ইচ্ছাকৃত এটা করেছে তা বুঝতে বাকি নেই আর। যত দিন যাচ্ছে এই মেয়েটার কর্মকান্ড তাকে অবাক নয় হতবাক করে দিচ্ছে। আলোর মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে মনে মনে বলে ওঠে,”এটার শোধও আমি তুলবো অদ্রিতা আলো।”

শুভ্র পাঞ্জাবিটার বুকের বা পাশটায় একফোঁটা লাল রক্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রিন্সিপাল ইয়াসারের দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমাকে মেডিসিন বা…”

ইয়াসার হাত উঠিয়ে থামিয়ে দেয় প্রিন্সিপালকে, আলোর দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় প্রিন্সিপালকে বলে,”এসবে ইয়াসারের কিচ্ছুটি হয়না। আপনি অনুষ্ঠান কনটিনিউ করুন।”

শওকত হাসান আলোকে ধমক দিয়ে বলে,”দেখছো কি দাঁড়িয়ে! যাও মাইক্রোফোনের কাছে।”

আলো মাথা নাড়িয়ে মাইক্রোফোনের কাছে যায়, মনে মনে বলতে থাকে,”সেইফটি পিন তো খুবই নগণ্য জিনিস। তোর ওই বুকে কুড়াল বসানো উচিত ভণ্ড নেতা।”

“অতিথিদের ফুলের তোড়া এবং ব্যাজ পরানোর মধ্যে দিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শুভারম্ভ হয়েছে। এখন আমি প্রতিযোগীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি। মঞ্চে ডাকতে চাই গ্রুপ “ক” এর প্রতিযোগীদের। গ্রুপ “ক” থেকে এখন এসে নজরুল সঙ্গীত গাইবে মারুফা শাম্মী,প্রথম বর্ষ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ।”

আলো মাইক্রোফোনের কাছ থেকে সরে গিয়ে একটা চেয়ারে বসে। প্রতিযোগী মঞ্চে উঠে নজরুল সঙ্গীত গাইতে থাকে। অত্যন্ত শ্রুতিমধুর পরিবেশনা। সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছে, শুধুমাত্র সামিন ইয়াসারের দৃষ্টি আলোর দিকে। তার অবচেতন মন বারবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে ওই মেয়েটিকে দেখতে থাকে, যে মেয়েটি বারবার সামিন ইয়াসারকে টেক্কা দিচ্ছে। অঘোষিত নিরব যুদ্ধ করছে সামিন ইয়াসার মির্জার সাথে।
আলোর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে একবার সে নিজের দিকে তাকায়। রক্তের ফোঁটা-টা ফুলের মতো লাগছে। একটা ক্ষুদ্র গোলাপ ফুল।

একের পর এক প্রতিযোগীরা তাদের পারফরম্যান্স দেখিয়ে যাচ্ছে। আলোর অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে,কখন শেষ হবে এই অনুষ্ঠান ! তার ভীষণ মাথা ব্যথা করছে।

দর্শকদের প্রথম সারিতে বসে জামিল ফুয়াদকে বলে,”সাহস দেখেছেন? এমপি মহোদয়ের সামনে সুকৌশলে ভাইকে যন্ত্রনা দিয়েছে। অবাক হবার কিছু নেই। এই মেয়ে কারাতে জানে। ক্লাস সেভেনে থাকতে একবার এক ছেলে হাত ধরেছিলো জোর করে। বাড়িতে এসে কান্নায় লুটিয়ে পরতেই আতাউর আলম সাথে সাথে মেয়েকে নিয়ে কারাতে ট্রেইনিং সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দেয়।”

_সাহস তো দেখার মতো-ই, নয়তো সামিন ইয়াসারের গালে চড় মারে নাকি!
_বাপকে ভীষণ ভালোবাসে। সব কিছু করতে পারে বাবার জন্য।

দু’জনেই কথা থামিয়ে আলোকে দেখতে থাকে।

অনুষ্ঠান প্রায় শেষ হয়েছে। প্রতিযোগীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করছেন অতিথিরা। একটু পরেই মাগরীবের আজান দেবে। সবাই বাড়ি ফেরার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছে। আলো নিজের ব্যাগ উঠিয়ে তৌফিকুল ইসলামের কাছে গিয়ে আমতা আমতা করে বলে,”স্যার এবার তো অনুমতি দিন। কাজ যা বাকি আছে ভলান্টিয়ার-রা দেখে নেবে।”

তৌফিকুল ইসলাম কিছুক্ষণ ভেবে বলে,”আচ্ছা যাও। বাকিটা আমিই সামলে নিচ্ছি।”
***

“ভাই! ভাই দেখিতো কি হয়েছে!”

হাত দিয়ে জামিল সামিন ইয়াসারের পাঞ্জাবি ধরে দেখতে থাকে। রাহাত চেঁচিয়ে ওঠে,”করছে টা কি! ভাই এই মেয়েতো রক্তচোষা বাদুড়। বেয়াদ্দপ মেয়ে।”

সামিন জামিলের হাত সরিয়ে বলে,”গাড়ি স্টার্ট কর। কিচ্ছু হয়নি।”

ফুয়াদ মুচকি মুচকি হাসছে। ইয়াসার গম্ভীর কন্ঠে বলে,”সমস্যা কি? হাসছিস কেনো?”

_রক্তচোষা বাদুড় আসছে। ওই দেখ।

সামিন ইয়াসার মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। আলো ধীরপায়ে গেইটের কাছে এগিয়ে আসছে। কলেজের পাশের মসজিদে আজান দিয়ে দিয়েছে। ল্যাম্পোস্টের বাতি গুলো সব জ্বেলে ওঠে এক সাথে। আলো আজান শুনে শাড়ির আঁচল টেনে মাথায় তুলে দেয়। দৃশ্যটি সামিন ইয়াসারের অবচেতন মনকে মুগ্ধ করে। কিন্তু সে বুঝতে পারে না।

রাহাত চাপা স্বরে বলে,”ভাই এখন ধরে কানের নিচে দুটো চড় লাগিয়ে দিন। কেউ দেখবে না।”

সামিন রেগে গিয়ে রাহাতের দিকে তাকায়। ঠান্ডা গলায় বলে,”ওরা এমনিতেই দুর্বল জাতি। গায়ের জোর দেখিয়ে কি হবে? ওকে চড় তো অবশ্যই মারবো। তবে অন্যভাবে।”

সেই অন্যভাবে-টা ঠিক কিভাবে তা জানতে সবাই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সামিন কিছু বলে না, এক দৃষ্টে আলোকে দেখে।

আলো সামিন ইয়াসারের গাড়ির কাছে ওদের দলবল দেখতে পেয়ে থমকে যায়। মেইন গেইটের কাছে না গিয়ে সে পকেট গেইটের দিকে যায়।
দলের তিন-চারজন চেঁচিয়ে ওঠে,”ভয় পাইছে ভাই,ভয় পাইছে!”

আলো দাঁড়িয়ে পরে। জামিল চেঁচিয়ে বলে,” শিড়ায় শিড়ায় রক্ত, আমরা ইয়াসার ভাইয়ের ভক্ত।”

বাকি ছেলেগুলোও চেঁচিয়ে ওঠে,”শিড়ায় শিড়ায় রক্ত,আমরা ইয়াসার ভাইয়ের ভক্ত।”

আলো এক মুহুর্ত দেরী না করে দৌড়ে পকেট গেইট থেকে বেরিয়ে যায়। একটা রিকশায় উঠে শাড়ির আঁচল টেনে কান চেপে ধরে। সামিন ইয়াসারের দলবল তখনো চেঁচিয়ে যাচ্ছে,”শিড়ায় শিড়ায় রক্ত,আমরা ইয়াসার ভাইয়ের ভক্ত।”

চলমান……

#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_৭
#Esrat_Ety

“স্যার প্রশ্নপত্র কোথায়? আমরা পরিক্ষা কিভাবে দেবো?”

_প্রশ্নপত্র কি? প্রশ্নপত্র কাকে বলে? সেটা দিয়ে কি করে?

তৌফিকুল ইসলামের এমন কথায় পুরো শ্রেনীকক্ষ আলোড়িত হয়। সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। আলো দাঁড়িয়ে প্রতিবাদের সুরে বলে,”হচ্ছে কি এসব স্যার? আজকে আমাদের ফার্স্ট ইনকোর্স এক্সামের ফার্স্ট ডে। আমাদের প্রশ্নপত্র না দিলে লিখবো কি?”

_আচ্ছা আচ্ছা। প্রশ্ন আমি বলে দিচ্ছি। তোমরা সবাই লেখো। তোমাদের প্রশ্ন হচ্ছে “আমরা কারা?”

আলো বিরক্ত হয়ে যায়। রেগে গিয়ে বলে,”স্যার আমরা ইংলিশ লিটারেচারের স্টুডেন্ট। এসব কি ধরনের প্রশ্ন দিচ্ছেন আমাদেরকে?”

তৌফিকুল ইসলাম রেগে যায়। আলোকে ধমক দিয়ে বলে,”চুপ। যা বলছি তাই করো। লেখো, তোমরা কারা লেখো।”

আলো দাঁত কিড়মিড় করে বলে ,”এর উত্তর আমাদের জানা নেই।”

_ঠিকাছে। আমি বোর্ডে লিখে দিচ্ছি। তোমরা সবাই খাতায় কপি করে ফেলো।

সবাই “জ্বি” বলে মাথা নাড়ায়। আলো হতবাক হয়ে চারপাশে তাকায়। এসব হচ্ছে টা কি আসলে!

তৌফিকুল ইসলাম বোর্ডে লিখতে থাকে,
“প্রশ্ন : আমরা কারা?”
উত্তর: শিরায় শিরায় রক্ত। আমরা ইয়াসার ভাইয়ের ভক্ত।”

আলো হতভম্ব হয়ে উঠে দাঁড়ায়। ক্লাসের সবাই তড়িঘড়ি করে লিখতে থাকে। মুখে বিড়বিড় করতে থাকে,”শিরায় শিরায় রক্ত। আমরা ইয়াসার ভাইয়ের ভক্ত। শিরায় শিরায় রক্ত, আমরা ইয়াসার ভাইয়ের ভক্ত, শিরায় শিরায় রক্ত,আমরা ইয়াসার ভাইয়ের ভক্ত।”

আওয়াজ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। আলো চেঁচিয়ে ওঠে,”চুপ করো তোমরা।”
কেউ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না। বিড়বিড় করতে থাকে,”শিরায় শিরায় রক্ত,আমরা ইয়াসার ভাইয়ের ভক্ত।”

আলো বেঞ্চের উপরে জোরে চাপড় মেরে প্রচন্ড শব্দে চেঁচিয়ে বলে,”চুপ করো তোমরা চুপ করো। দোহাই তোমাদের,চুপ করো!”

হঠাৎ করে আলোর চোখ খুলে যায়। একলাফে উঠে বসে সে হাঁফাতে থাকে। দু’মিনিট সময় নিয়ে সে পরিস্থিতি অনুধাবনের চেষ্টা করে। সে কোথায়? এরকম ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে আছে কেনো ক্লাসরুম। কয়েক মুহূর্ত যেতে-ই ধীরে ধীরে সে টের পায় সে এতক্ষন স্বপ্ন দেখছিলো। হাত দিয়ে ফোন খুঁজতে থাকে সে। বালিশের নিচ থেকে ফোনটা বের করে ফ্লাশ লাইট অন করে। পুরো গা ঘামে ভিজে গিয়েছে। এখনো তার শরীর একটু একটু করে কাঁপছে। এর চেয়ে ভয়ংকর কোনো দুঃস্বপ্ন বোধ হয় সে তার পুরো জীবনে দেখেনি। বিছানা থেকে ধীরে ধীরে নেমে লাইট জ্বেলে দেয়। টেবিলের ওপরে রাখা গ্লাসের ঢাকনা সরিয়ে গ্লাসের পানি ঢকঢক করে পুরোটা পান করে। ওয়াশ রুমে ঢুকে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে ওড়না দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বের হয়। ধপ করে বিছানার উপর বসে পরে। কিছুক্ষণ থম মেরে থেকে হাত বাড়িয়ে ফোনটা হাতে নেয়। ইশমামের নাম্বারে ফোন দিতেই সাথে সাথে ইশমাম ফোনটা রিসিভ করে বলে,”আমার হঠাৎ করে মনে হচ্ছিলো তুমি ফোন দিবে।”

“ভালো।”

ইশমাম আলোর কন্ঠস্বর শুনে বিচলিত হয়ে বলে,”কি হয়েছে অদ্রিতা ? কন্ঠস্বর এমন লাগছে কেনো?”

_হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে। তাই।
_দুঃস্বপ্ন দেখেছো নাকি কোনো?
_হুম।
_কি? একজন কুচকুচে কালো দেখতে, টাক মাথার বিসিএস ক্যাডারের সাথে বিয়ে হয়ে গিয়েছে তোমার?
কথাটি বলে ইশমাম হো হো করে হাসতে থাকে। আলো ধীরে ধীরে বলে,”তার চেয়ে বেশি ভয়ংকর।”

_তাই? আচ্ছা বলো তো শুনি! আমিও একটু ভয় পেতে চাই।

আলো ধীরে ধীরে তার দুঃস্বপ্নের কথা ইশমামকে বলে। সবটা শুনে ইশমাম কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। তারপর উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করে। আলো বিরক্ত হয়ে বলে,”হাসছো কেনো তুমি?”

ইশমাম হাসি থামিয়ে বলে,”তুমি পাগল হয়ে যাচ্ছো অদ্রিতা। ইয়াসার মির্জাকে কেনো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলছো না? অদ্ভুত। সারাদিন ওই লোকটার কথা ভাবতে হবে?”

_আমি কেনো সারাদিন ওই লোকটার কথা ভাবতে যাবো? ওই লোকটাই তো আমাকে প্রত্যেকটা দিন বিরক্ত করতে চলে আসে!

ইশমাম চুপ হয়ে যায়। তারপর মৃদু স্বরে বলে,”বিরক্ত করতে চলে আসে মানে? আর কিছু করেছিলো উনি?”

আলো থতমত খেয়ে যায়। নিজের কথা ফিরিয়ে নিয়ে বলে,”না মানে সারাদিন বাড়ির সামনের রাস্তায় ওর নামে মিছিল হয়। শহরের আনাচে কানাচে যেখানেই যাই ,” শিরায় শিরায় রক্ত, আমরা ইয়াসার ভাইয়ের ভক্ত।”

ইশমাম মৃদু হেসে বলে,”বাদ দাও,এসবে জড়িও না আর। তুমি শুধু লেখাপড়ায় মন দাও।”

_কাল আব্বুর সাথে ক্যাম্পেইন করতে যাবো। একদিনই যাবো।

_না। এসবের দরকার নেই। নিজের বয়স অনুযায়ী কাজ করো অদ্রিতা। সব ব্যাপারে বেশি কৌতুহল তোমার। এসবে কেন জড়াতে হবে?
_অভিজ্ঞতার জন্য। ভবিষ্যতে আমিও রাজনীতিতে নামবো।
হাসতে হাসতে আলো বলে।

_না অদ্রিতা।
ধমকের সুরে বলে ইশমাম।

আলো হাসি থামিয়ে বলে,”মজা করছি। একদিনই যাবো। প্রমিজ। আর কখনো যাবো না। কখনো না।”

***
ইহানের মুখের কাছে ভাতের লোকমা তুলে ধরতেই ইহান মুখ সরিয়ে নেয়। বাবার ফোনে কার্টুন দেখছিলো সে। রিতু একটা ধমক দিতে গিয়েও দেয়না। ইলহামের দিকে একবার তাকিয়ে অসহায়ের মতো ইশিতার দিকে তাকায়। ইশিতা চোখ দিয়ে ইশারা করে রিতুকে প্লেট সরিয়ে ফেলতে বলে। ইলহাম এবং সামিন ইয়াসার খাবার টেবিলে নিজেদের বাড়ির ব্যবসা সংক্রান্ত আলোচনা করছিলো। রিতু প্লেট সরিয়ে রেখে সামিন ইয়াসারের প্লেটে মাংসের টুকরো তুলে দেয়। সামিন বলে,”লাগবে না রিতু।”

রিতু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”ভাইয়া আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো।”

সামিন তাকায়। ইলহাম বলে,”দেখছো না এখন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করছি?”

সামিন ইলহামকে থামিয়ে দিয়ে বলে,”বলো। কোনো সমস্যা?”

রিতু মাথা নাড়িয়ে নিচু স্বরে বলে,”ভাইয়া ইহানের জন্য একটা টিচার ঠিক করে দিলে ভালো হয়।”
“হুম দেবো। আর কিছু বলবে?”
রিতু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”ওর জন্য একজন হুজুর ঠিক করে দিবেন? আরবি শেখাতে চাই। বাড়িতে এসে পড়িয়ে যাবে।”

_আরবি শিক্ষা দিতে চাও মানে? এতটুকু বয়সে এতো চাপ কেনো দিতে হবে?

রিতু ইলহামের কথার জবাব না দিয়ে সামিন ইয়াসারকে বলে,”গত রাতে আমার শাশুড়ি মাকে স্বপ্নে দেখেছি। নাতী কে নিয়ে বসে আছেন। আমাকে হঠাৎ বললেন,আমার নাতীকে আলেম বানাবে।”

তারপর কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থেকে বলে,”আলেম না হোক, কোরআন শরীফ পাঠ করাটা শিখে যাক অন্তত!”

ইলহাম এবং সামিন ইয়াসার দু’জনেই রিতুর মুখে মায়ের কথা শুনে তাকায়।
রিতু বলে কাল কিছু এতিম বাচ্চাদের খাওয়াতে চাই ভাইয়া। ব্যবস্থা করে দিলে ভালো হয়।

“সংসারের পুরো দায়িত্ব তোমার হাতে রিতু। ইশিতা নাক গলায় না। তুমি যা ভালো মনে করো।”
ঠান্ডা গলায় বলে ইয়াসার। কিছুক্ষণ পরে আবারো বলে ওঠে,”একজন আরবি টিচার-ও ঠিক করে দেবো। কালকের মধ্যে।”

রিতুর মুখে হাসি ফোটে।

ইশিতা ব্যাগ হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সামিন আর ইলহামকে উদ্দেশ্য করে বলে,”আমি আসছি ভাইয়া। ভার্সিটিতে যাচ্ছি।”

_গাড়ি নিয়ে যা।
_না রিকশা করে যাবো।

ইলহাম ভ্রু কুঁচকে বলে,”নিজেদের গাড়ি থাকতে রিকশা কেনো?”

_গাড়ির ভেতরে দমবন্ধ লাগে। সারাদিন তোমাদের এই বদ্ধ পরিবেশে থাকি। বাইরে গিয়েও পরিবেশ-টা একটু চেইঞ্জ করবো না?

ইশিতা চলে যায়। ইলহাম সামিন ইয়াসারকে বলে,”ইশিতা আর ইশমাম যে যমজ তা ওদের হাবভাব দেখলেই বুঝে ফেলা যায় ভাইয়া।”
সামিন ইয়াসার কিছু বলে না। চুপচাপ খেতে থাকে। ইলহাম বলে,”মা মারা যাওয়ার পরে এই সংসারটা কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছে। তুমি যদি অনুমতি দাও তাহলে তোমার জন্য মেয়ে দেখতে পারি ভাইয়া। বাবাও চায় তুমি এখন বিয়ে করো।”

সামিন খেতে খেতে বলে,”হু দেখ। তবে আমার জন্য না। ছোটোর জন্য। ওকে বিয়ে করিয়ে দেবো দেশে ফিরিয়ে এনে। সুন্দরী এবং নম্র ভদ্র দেখে একটা মেয়ে দেখবি। রিতুর মতো। এ বাড়িতে কোনো উড়নচন্ডী টাইপ মেয়ে বৌ হয়ে আসবে না। আমার মায়ের প্রতিচ্ছবি হতে হবে, তার মতো করে নিপুণ হাতে সংসার সামলানোর দক্ষতা থাকতে হবে। দেখলে যেনো মনে হয় আমি আমার মা কেই দেখছি।”

***
“তোমাকে এমন ভাবে যত্ন করছে আব্বু মনে হচ্ছে তুমি এই শহরের মেয়র কনফার্ম।”

আতাউর আলম মেয়ের কথায় মুচকি হাসে। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”এরা আমাকে খুব ভালোবাসে।”

আতাউর আলমের চাচাতো ভাই খোরশেদ পেছন থেকে বলে ওঠে,”এইসব বস্তির লোকদের ভরসা নেই ভাইজান। এরা গিরগিটির চেয়েও দ্রুত রং বদলায়। যেদিকে ঝোঁক বেশি সেদিকে ঝুঁকে থাকতে পছন্দ করে। আপনাকে বুঝতেই দেবে না এরা আপনার বিরোধী। কিন্তু তলে তলে ঠিকই যে টাকা দিয়ে কিনতে পারবে সিলটা তার নামের ওপরেই লাগাবে।”

আলো তার চাচার বিরোধীতা করেই বলে,”মোটেই না। এদের চোখ বলে দিচ্ছে এরা কতটা স্বচ্ছ।”

খোরশেদ বলে,”তুই সেদিনের মেয়ে। তুই কি মানুষ চিনিস?”

_আপনার থেকেও বেশি চিনি চাচ্চু।

খোরশেদ থতমত খায়। এই আলো অনেক চালাক মেয়ে। এর সাথে তর্কে গেলে পয়েন্টে পয়েন্টে ধরা খেতে হয়। প্রসঙ্গ পালটে খোরশেদ বলে,”এই রোদ গরমে তুই কেন আসতে গেলি। এতো বড় মেয়ে, দৃষ্টিকটু লাগছে ব্যাপারটা। আমরা তো সবাই আছি ভাইজানের সাথে ‌”

_বড় সেজন্যই তো এসেছি। ছোটো হলে তো আসতাম না।

খোরশেদ চুপ হয়ে যায়। আলো বলতে থাকে,”কি জানেন তো চাচ্চু? আমার ভালোমানুষ আব্বুর নতুন নতুন কিছু অদৃশ্য শত্রু হয়েছে। তাদেরকে আব্বু ডিটেক্ট করতে পারছে না। বয়সের ভারে আব্বুর দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে গিয়েছে। আমার দৃষ্টি পরিষ্কার। খুব সহজেই ডিটেক্ট করতে পারবো। তাই আব্বুর বডিগার্ড হিসেবে এসেছি।”

আতাউর আলম মেয়ের কথায় হেসে ফেলে। নিজের হাতে মেয়েকে গড়েছেন তিনি। মেয়েটা তার মতোই দুঃসাহসী। কথাবার্তাও তার মতো করেই বলে। শুনলে চমকে যেতে হয়।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আতাউর আলম বলে,”এবার রেডিও কলোনির দিকে যেতে চাচ্ছি।”
আতাউর আলমের কর্মীরা সবাই উঠে দাঁড়ায়। আলো উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”আজ বরং থাকুক বাবা। চাচারা যাক। তুমি তো হাঁটতেই পারছো না।”
_আরে ধূর! এখনি যদি নিজে গিয়ে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের থেকে ভোট চাইতে না পারি তাহলে লোকজন আমাকে কতটুকু ভরসা করবে বলতো?

আলো বলে,”ঠিকাছে। তবে আমিও যাবো তোমার সাথে।”

***
মুখোমুখি দুটো দল। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল থেকে মনোনীত প্রার্থী সামিন ইয়াসার মির্জা, এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী আতাউর আলম। রেডিও কলোনির মোড়ে এসে দুটো দল মুখোমুখি হয়।

রাস্তা পুরোটা আটকে দাঁড়িয়ে পরেছে তারা। আলো সামিন ইয়াসারকে দেখে কোন এক অজানা কারনে আতাউর আলমের পেছনে দাঁড়ায়। সামিন ইয়াসার তা খেয়াল করেছে। আতাউর আলমের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে,”অনেকদিন পরে দেখা হলো আপনার সাথে! ”

আতাউর আলম তাচ্ছিল্য মাখা হাসি দিয়ে বলে,”দেখে খুশি হওনি নিশ্চয়ই? তাও আবার এভাবে?”

সামিন ইয়াসার শুকনো হাসি হাসে।‌ তার পেছন থেকে জামিল বলে ওঠে,”আমরা আগে এসেছি। কলোনীতে আমরা প্রথমে ঢুকবো।”

_মামার বাড়ির আবদার? এখানে আব্বুর কর্মীরা আগে এসেছে। আমরা আগে ঢুকবো।

আতাউর আলমের পেছন থেকে ক্ষীণ কিন্তু তেজী কন্ঠে বলে আলো। সামিন চোখ সরিয়ে আলোকে দেখে, আতাউর আলমের দিকে তাকিয়ে বলে,”মেয়েকে কেন এসব রাজনীতি শেখাচ্ছেন? পড়াশোনা করতে মন না চাইলে ওকে বিয়ে দিয়ে দিন। রাজনীতি মেয়েদের বিষয় না।”

_আমার মেয়ে কি করবে আর কি করবে না তা আমি আর আমার মেয়ে বুঝবো।

একটু থেমে আতাউর আলম বলে,”আমি বুঝতেই পারিনি তোমার মতো সেদিনের একটা ছেলেকে পার্টি নমিনেশন দেবে।”

_হুম। বারবার বলতেন আমি দিবাস্বপ্ন দেখছি।
_এখনো বলবো তুমি দিবাস্বপ্ন দেখছো। পার্টি নমিনেশন দিয়েছে শুধু,এবার ভোটে জিতে দেখাও।

_দিবাস্বপ্ন আপনি দেখছেন। আপনার মতো দুই টাকার রিপোর্টার, অতীতে দুই একটা সাহসী কাজ করে জনগনকে খুশি করেছেন, সেজন্য ভাববেন না জনগণ আপনাকে শহর দেখভালের দায়িত্ব দেবে।

_দুই টাকার রিপোর্টার মানে? কোন সাহসে আপনি আমার আব্বুকে দুইটাকার রিপোর্টার বলছেন‌। বেহায়া বেশরম লোক, নির্লজ্জ কোথাকার। ছেলের নারী কেলেঙ্কারির জের ধরে বাপকে সংসদ সদস্যের পদ হারাতে হয়েছে,ভুলে গেছেন সেসব কথা? সরকারের টাকা মেরে কালো টাকার পাহাড় বানিয়ে একজন সৎ লোককে দুই টাকার রিপোর্টার বলছেন?

সামিন চোখ রাঙিয়ে আলোর দিকে তাকায়। আলো বলতে থাকে,”এই কলোনিতে এখন আতাউর আলমের কর্মীরা ঢুকবে। দেখি কে আটকায়।”

জামিল দাঁত খিচিয়ে বলে,”সামিন ইয়াসার মির্জার লোক ঢুকবে। দেখা যাবে কাদের কত দম।”

সামিন জামিলকে থামিয়ে দিয়ে বলে,”ঢুকতে দে ওদের।”

_কিন্তু ভাই…

_কথা কম। ঢুকতে দে।

আলো তাচ্ছিল্যের সাথে বলে ওঠে,”এমনিতেও আপনারা আগে ঢুকলে ঝাটার বারি খেয়ে বের হতেন, অপজিশন পার্টির সামনে মুখ লুকানোর যায়গা পেতেন না তখন।”

আতাউর আলম আলোকে থামিয়ে দিয়ে বলে,”চল আম্মু।”

সামিন ইয়াসারের লোকজন রাস্তা থেকে সরে দাঁড়ায়, স্বতন্ত্র প্রার্থী আতাউর আলমের কর্মীরা সবাই কলোনিতে প্রবেশ করে।

যাওয়ার আগে আলো এক মুহুর্তের জন্য সামিন ইয়াসারের দিকে তাকায়। সামিন ইয়াসার তার দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে।

“ভাই এই মেয়েটাকে আর নেওয়া যাচ্ছে না। অতিরিক্ত। অসহ্যকর।”
রেগেমেগে বলে জামিল।

সামিন ইয়াসার চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সে কি ভাবছে?

***
“একটা গল্প বলি শোনো। একবার এক শকুনের বাচ্চা তার শকুন মায়ের কাছে বললো মা আমার মানুষের মাংস খেতে ইচ্ছে করছে। শকুন মা তখন এক বুদ্ধি বের করলো। এক টুকরো গরুর মাংস নিয়ে গিয়ে হিন্দু পাড়ায় ফেলে দিয়ে আসলো এবং এক টুকরো শূকরের মাংস নিয়ে এসে মুসলমানদের মহল্লায় ফেলে দিয়ে আসলো। তারপর চুপ করে নিজের ছানা নিয়ে ঘাপটি মেরে থাকলো। কিছু সময় পরে গরু আর শূকরের মাংসের‌ জের ধরে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা শুরু হলো। সেই দাঙ্গায় গোটা কয়েক লোক মরে লাশ হয়ে পরে থাকলো। শকুন তখন তার ছানাকে বলে,”যা বাবা। এখন ইচ্ছামতো মানুষের মাংস খা তুই।”

জায়েদ আলী শমশের ভুঁইয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,”আপনি কি পরোক্ষভাবে নিজেকে ওই শকুনের সাথে তুলনা করলেন?”

শমসের ভুঁইয়া থতমত খেয়ে বলে,”না বেকুব। আমি আসলে উদাহরণ দিচ্ছি। কিভাবে ইয়াসার মির্জা আর আতাউর আলমের মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টি করবে তার হিন্ট দিচ্ছি।”

_কিন্তু এটা তো কোনো সাম্প্রদায়িক ইস্যু না। রাজনীতি। মাংস ছড়াছড়ি করে কি হবে।

শমসের ভুঁইয়া প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে মুখে “চ” কারন্ত শব্দ করে বলে,”তুমি এতো মাথামোটা হলে কবে থেকে জায়েদ। এখন কি হাতে কলমে শিখিয়ে দিতে হবে কিভাবে কি করবে?”

জায়েদ আলী আমতা আমতা করে বলে,”না। আমাদের ছেলেদের কাজে লাগিয়ে দিচ্ছি।”

“গুড। এখন যাও। আর ইয়াসারের ডান হাত জামিলের ব্যাপারে কি করলে?”
_সুযোগ পেলেই সরিয়ে দেবো।

***
“ভাই একটা খারাপ খবর আছে।”

সকাল সকাল পার্টি অফিসে এসে জামিলের মুখে কথাটি শুনেই ইয়াসারের কপাল কুঁচকে যায়। জামিলের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় সে। জামিল বলে,”উত্তরের এলাকা গুলো থেকে আতাউরের লোকজন আপনার সব সাইনবোর্ড খুলে ফেলেছে। সব নষ্ট করে ফেলেছে। আমাদের ছেলেরা ক্ষেপে গিয়ে ওদের একটাকে ধরেছে। মারামারি হয়েছে খুব। পুলিশ এসে দুই পক্ষের ছেলেদের ধরে নিয়ে গিয়েছে। ”

সামিন ইয়াসার প্রচন্ড রেগে যায়। দাঁত খিচিয়ে বলে,”তোরা কি করছিলি? ঘাস কাটছিলি?”
_ভাই ভোরের আলো ফোটার আগে এই কাজ হয়েছে। লোকজন বলছে সব আতাউরের লোকজনের কাজ। আর মারামারির সময়ে আমি ছিলাম না। বৌয়ের শরীরটা হঠাৎ করে খারাপ হয়ে গিয়েছিলো।

সামিন উঠে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে বলে,” মারামারি করার পারমিশন দিয়েছে কে ওদের? ইলেকশনের আগে আমায় কেস খাইয়ে ছাড়বে দেখছি। আমি আসছি।”
_ভাই মাথা ঠান্ডা করেন। ছেলেপুলেরা দেখছে সবটা।
_আমি দেখতে চাই জামিল। ওদের থানা থেকে ছাড়িয়ে আনতে হবে। উকিলকে ফোন কর।
_বাইরে বৃষ্টি পরছে ভাই। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন!
_এক্ষুনি যাবো। তুই বাড়ি যা। তোর বৌকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যা।

জামিল কিছু বলে না। সামিন ইয়াসার ক্ষেপে গিয়েছে। তাকে এই মুহূর্তে বাঁধা দিলে সে শুনবে না,তা জামিল জানে।

ইয়াসার রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে,”সেদিন ভরা জনসভায় আমাকে থাপ্পর মেরে বলেছিলো আমি নাকি কাপুরুষের মতো ওর বাবাকে পেছন থেকে ছুরি মেরেছি। সামনাসামনি লড়ার ক্ষমতা আমার নেই। আর ওর বাবা এখন রাতের অন্ধকারে বিরোধী পার্টির সাইনবোর্ড খুলে ফেলছে। এর শেষ দেখে ছাড়বো আমি।”

***
গায়ের সাথে ভেজা পাঞ্জাবি লেপ্টে আছে। টেবিলের উপর এক কাপ ধোঁয়া ওঠা গরম চা। হাতে গাড়ির চাবি। সামিন চাবিটা দিয়ে টেবিলের ওপর ঠকঠক আওয়াজ করছে। আতাউর আলম সেদিকে একবার তাকিয়ে ওসি সালামের কথায় কান দেয়। ওসি সালাম বলতে থাকে,”আপনাদের দুজনের ছেলেরাই সমানে সমান। নিজেদের ছেলেদের সামলানোর দায়িত্ব আপনাদের। এখনি এতো দায়িত্বহীনের মতো কাজ করলে মেয়র হয়ে কি করবেন?”

সামিন চায়ের কাপ উঠিয়ে চুমুক দেয়। ওসি বলতে থাকে,”এবারের মতো ছেড়ে দিচ্ছি। দুদিন পরে নির্বাচন। ছেলেদের সামলে রাখুন। ফের আমার খপ্পরে পরলে একটাকেও ছাড়বো না।”

আতাউর আলম বলে,”সরকারি দলের ছেলে গুলোর দোষ সব। সব ইয়াসারের পোষা কুকুর। তারা আগে আমার ছেলেদের উপরে হাত তুলেছে।”

_আর আপনি চোরের মতো আমার সাইনবোর্ড, পোস্টার খুলে ফেলেছেন নিজের এলাকা থেকে। এতো ভয় সামিন ইয়াসারকে? ভয়ের চোটে সব শুকিয়ে গিয়েছে তাই না?

_মুখ সামলে কথা বলো। বেয়াদব ছেলে।

_আপনিও মুখ সামলে কথা বলুন।

“আরে আরে কি হচ্ছে কি এসব! এটা থানা। ভুলে গেছেন?”

আতাউর আলম বলে,”না ভুলিনি ওসি সাহেব। আমি আমার ছেলেদের নিয়ে গ্যারান্টি দিচ্ছি। ভবিষ্যতে এমন কিছু হবে না। আপনিও ইয়াসারকে বলে দিন ও যাতে ওর কুকুর গুলোকে সামলে রাখে।”

আতাউর আলম হুমকির মতো করে কথাটি বলে চলে যায়। সামিন ইয়াসার রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাখে। কিছুক্ষণ বাদে সেও থানা থেকে বের হয়ে গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট করে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পরছে বাইরে। থানা থেকে বের হতে হতে রাত হয়ে গিয়েছে। ইমতিয়াজ মির্জা অনেকবার ছেলেকে ফোন দিয়েছে,সামিন ফোনটা রিসিভ না করে রেখে দিয়েছে। এক মনে ড্রাইভিং করছে সে। থানাপাড়া রোড পাড় হয়ে মোড় নিতেই আচমকা দূর থেকে কেউ তার গাড়ি লক্ষ্য করে একটা মাঝারি সাইজের পাথর ছুড়ে মারে। সামিনের গাড়ির সামনের কাঁচে লেগে তাতে ফাটল ধরে যায়। হুট করে ব্রেক কষে সামিন। দাঁত খিচিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,”বা’স্টা’র্ড!”

গাড়ি থেকে নেমে আশেপাশে তাকায়। বৃষ্টির কারনে রাস্তা শুনশান হয়ে আছে। ল্যাম্পোস্টের বাতি টা পিট পিট করে জ্বলছে । সামিন বিকট শব্দে চেঁচিয়ে ওঠে,”সাহস থাকলে সামনে আয়। একেবারে পুতে দেবো। সামনে আয় বলছি।”

“মাঘের শীত বাঘের গায়,সামিন ইয়াসার মেয়ে মানুষের চড় খায়।”

তিন চারজন কমবয়সী ছেলের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সবাই একসাথে চেঁচিয়ে কথাটি বলে। সামিন আওয়াজটা কোন দিক থেকে আসছে সেদিকে লক্ষ্য করে ছুটে যায়। কিন্তু সে গিয়ে কাউকে খুঁজে পায়না সেখানে। সামিন চেঁচিয়ে বলে,”মায়ের বুকের দুধ খেয়ে থাকলে এদিকে আয় শু’য়ো’রে’রা।”

এমন সময় সামিনের ফোন বেজে ওঠে। ভেজা হাতে ফোনটা রিসিভ করতে বেশ বেগ পেতে হয়। কোনোমতে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে রাহাত বলে,”ভাই। জামিল ভাইকে কেউ কু’পি’য়ে’ছে !”

চলমান…..

#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_৮
#Esrat_Ety

আইসিইউ-র সামনে দাঁড়িয়ে আছে দলের বাকি সদস্যরা। প্রত্যেকের মুখে প্রবল উৎকণ্ঠার ছাপ। রাহাত দাঁড়িয়ে কাঁদছে। সামিন একপ্রকার দৌড়ে যায়। গিয়ে রাহাতকে ধরে বলে,”কেমন আছে ও? বল! কেমন আছে!”

কথাগুলো জিজ্ঞেস করতে গিয়ে সামিনের গলা কেঁপে ওঠে। রাহাত হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। গলা থেকে কথা বের হচ্ছে না তার। সামিন মাথায় হাত দিয়ে বেঞ্চিতে বসে পরে। তার সমস্ত শরীর কাঁপছে। জামিল শুধু মাত্র তার ডান হাত ছিলো না,জামিলের জন্য সামিনের অন্যরকম মায়া। প্রচন্ড স্নেহ করে সে এতিম ছেলেটাকে।

“ভালো আছে ভাইয়া। জামিল খুশি। আপনার জন্য জান দিতে পেরে। চিন্তা করবেন না।”

নারীকন্ঠ শুনতে পেয়ে সামিন মাথা তুলে তাকায়। তার সামনে জামিলের গর্ভবতী স্ত্রী হেনা দাঁড়িয়ে।

সবুজ এসে বলে,”হেনা ভাবী। আপনি বসুন। কেন আসলেন এখানে?”

হেনা ধীরে ধীরে বেঞ্চিতে সামিনের পাশে বসে পরে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুবই অসুস্থ। সামিন কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”তুমি ঠিক হও হেনা। কিচ্ছু হবে না ওর। আমি হতে দেবো না।”

_হু। আমি ঠিক আছি ভাইয়া। চা’ম’চা’দে’র বৌদের ঠিক থাকতে হয়। এসব পরিস্থিতি অহরহই আসে এদের জীবনে।

সামিন হেনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। হেনা বলে,”সামিন ভাইয়ের জন্য জান দিয়ে দেবো। কথাটা ও সব সময় বলতো ভাইয়া। আজ সত্যি হতে চলেছে।”

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”আপনাদের আর কি ভাইয়া! একজন চা’ম’চা চলে গেলে দশজন চা’ম’চা প্রস্তুত আপনাদের সেবার জন্য।”

“ভাবী। সামিন ভাইয়ের সাথে এভাবে কেনো কথা বলছেন? সামিন ভাইয়ের কি দোষ?”

আরাফের দিকে তাকিয়ে হেনা ম্লান হেসে বলে,
_আমি তো তাকে দোষ দিইনি। কাউকে দোষ দিইনি আমি। শুধু কষ্ট হচ্ছে আরাফ। আমার সন্তান জন্মের আগেই এতিম হয়ে গেলো।

ঝরঝর করে কেঁদে দেয় হেনা। তার কান্না থামছেই না। কিছুক্ষণ শব্দ করে কেঁদে বলে,”কত বার করে বললাম। ছেড়ে দিন আমার স্বামীকে। ছেড়ে দিন। আমাকে এই অবস্থায় দেখেও একটু মায়া হলো না আতাউর আলমের লোকদের। ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিয়ে কো’প বসায় ওর গায়ে।”

সামিন হেনার দিকে তাকায়। তার চোখে মুখে বিস্ময়। বাকরুদ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। দলের ছেলে গুলো সব মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে।

সামিন তেজী কন্ঠে বলে ওঠে,”আতাউর আলমের লোক করেছে এসব?”

হেনা কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়ায়। অস্ফুট স্বরে বলে,”চারজন ছিলো। বলেছে ‌আগে তোকে শেষ করবো, তারপর তোর সামিন ভাইকে। এই শহরের মেয়র হবে আমাদের আতাউর সাহেব। অন্য কেউ না।”

ফুয়াদ ইতিমধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে ওদের মাঝে। সবুজ ক্ষেপে গিয়ে শার্টের হাতা গুটিয়ে নিয়ে বলে,”ভাই চলেন। থানায় চলেন।”

সামিন কঠিন গলায় বলে,”না।”

_যাবেন না? তাহলে চলেন ল’ট’কে দিয়ে আসি।

সামিন তেজী কন্ঠে বলে,”না।”

হেনা কান্না থামিয়ে বলে,”আমায় একটা কথা দিবেন ভাইয়া? ও যদি কখনো সুস্থ হয়ে ওঠে। আপনি প্লিজ ওকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দেবেন। ও কখনো আপনাকে ছাড়তে চাইবে না ভাইয়া। আপনি ওকে প্লিজ নিজে থেকে ঘার ধাক্কা দিয়ে দল থেকে বের করে দেবেন।

সামিন হেনার কথার জবাব না দিয়ে রাহাতকে বলে,”রাহাত।”

_জ্বি ভাই।

_চল আমার সাথে।

ফুয়াদ বলে,”কোথায়? কোথায় যাবি তুই?”

সামিন ফুয়াদের দিকে তাকায়। সামিনের দৃষ্টি দেখে ফুয়াদ ভয় পেয়ে যায়। চোখ দুটো রাগে,ক্ষোভে লাল হয়ে গিয়েছে। তেজী কন্ঠে বলে ওঠে,”জামিল আমার শরীরের একটা অঙ্গ ফুয়াদ। আমার ছোট ভাইয়ের মতো। ও না থাকলে আমি অনেকটাই অচল। এটা সবাই জানে। তাই ওকে রাস্তা থেকে সরিয়ে আমাকে নাড়িয়ে দিয়ে ইলেকশনে জিততে চেয়েছিলো আতাউর। জামিলকে সরিয়ে দেয়া মানে আমার এক পা পঙ্গু করে দেয়া। ওই আতাউর এটাই চেয়েছে ফুয়াদ। আমি ওকে বোঝাবো পঙ্গু কিভাবে করতে হয়। ওর দুই পা আমি পঙ্গু করে দেবো।”

_তুই কি পাগল হয়ে গেলি? মাথা ঠান্ডা কর। আইন আছে দেশে। যদি ও অপরাধ করে থাকে আইন ওকে শাস্তি দেবে।

সামিন ফুয়াদের কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে হেনার দিকে একবার তাকায়। দৃঢ়ভাবে বলে ওঠে,”তোমার স্বামীর জ্ঞান ফেরার আগে আমি আমার শোধ তুলবো।”

তারপর আরাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”হেনাকে বাড়িতে নিয়ে যা। রিতু আর ইশিতাকে বলবি সামিন ভাই ওর চূড়ান্ত যত্ন নিতে বলেছে।”

হেনা কিছু বুঝতে পারছে না সামিনের কথা। আরাফ বলে,”ভাবী ওঠেন। আরে ওঠেন তো। আমার ভাস্তিকে কেনো কষ্ট দিচ্ছেন। চলেন, জামিল ভাই কাল সকালের মধ্যে ভালো হয়ে যাবে।”

সবাই একপ্রকার জোর করে হেনাকে পাঠিয়ে দেয় আরাফের সাথে।
সামিন উঠে দাঁড়ায়। সবুজের দিকে তাকিয়ে বলে,”তুই জামিলের কাছে থাকবি।”

সবুজ মাথা নাড়ায়। রাহাত বলে,”কি করবো ভাই এখন?”

_আতাউরের গুষ্টি উদ্ধার।

ফুয়াদ বলে,”তুই কি করতে চাইছিস।”

সামিন ইয়াসার রাহাতের দিকে তাকিয়ে বলে,”আতাউরের মেয়ে সানশাইন কোচিং সেন্টারে পড়ায় না? ”

রাহাত মাথা নাড়ায়।
ইয়াসার বলে,”এখন রাত সাড়ে আটটা বাজে। ন’টায় কোচিং থেকে বের হয় ওই মেয়েটা। সাড়ে নয়টা নাগাদ ওই মেয়েকে আমাদের পার্টি অফিসে নিয়ে আসবি।”

সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সামিনের দিকে। ফুয়াদ চাপা স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে,”পাগল হয়েছিস তুই? আ’গু’ন নিয়ে খেলতে চাইছিস।”

সামিন ফুয়াদের কথার উত্তর না দিয়ে রাহাত এবং দলের আরো দুজন ছেলেকে বলে,”কাজটা কিভাবে করবি তোরা ভাব। কিন্তু আমি এক ঘন্টার মধ্যে আতাউরের মেয়েকে আমার চোখের সামনে দেখতে চাই।”

রাহাত কিছুটা হতভম্ব হয়ে গিয়েছে তার নেতার কথায়। কিন্তু কাজটা তাকে করতেই হবে।

ফুয়াদ রেগে গিয়ে সামিনকে বলে,”তোকে থেমে যেতে বলছি আমি সামিন।”

_সামিন থামবে না ফুয়াদ। সেদিন চ*ড় মারার পর থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত প্রত্যেকটা দিন ওই মেয়ে তার ঔদ্ধত্য দেখিয়ে এসেছে ‌
। মেয়ে মানুষ বলে নজর-আন্দাজ করে গিয়েছি। বেশি কিছু বলিনি। দুয়েকবার ভয় পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি মাত্র। কিন্তু আজ যেটা হলো তার জন্য আতাউরকে অনেক বড় খেসারত দিতে হবে। মেয়র হবার স্বপ্ন ধুলিসাৎ করে দেবো আমি। ওর থেকে অনেক বড় দাম নিয়ে ছাড়বো। তুই যদি আমার সাথে থাকতে না চাস তাহলে বাড়ি চলে যা। নয়তো আমার সাথে পার্টি অফিসে চল।

***
“ম্যাম আসসালামুয়ালাইকুম। আসি। ‌”

“ওয়ালাইকুমুস সালাম। সবাই হোমওয়ার্ক করে নিয়ে আসবে কাল। ঠিকাছে?”

_ঠিকাছে ম্যাম।

আলো হেসে তার পঞ্চমশ্রেনীর ছাত্র ছাত্রীদের বিদায় জানায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত আট-টা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। দশমিনিট আগেই ছুটি দিয়ে দিয়েছে আজ। কোচিংয়ের হেড ম্যাম মিনতি দেবী এসে বলে,”ছুটি দিয়ে দিয়েছো? বেশ নিচ তলায় এসে তবে,আমার সাথে চা খেয়ে যাও।”

আলো হেসে বলে,”না ম্যাম। আমি আসছি। আমার সামনে পরিক্ষা। পড়তে বসতে হবে বাড়িতে গিয়ে।”

মিনতি দেবীকে বিদায় জানিয়ে ব্যাগ থেকে ফোন বের করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে আলো। ইশমাম চৌদ্দবার ফোন দিয়েছে। আলো আনমনে হাসে। এই ছেলেটা এতো অদ্ভুত কেনো।

কলব্যাক করে কানে ধরতেই ইশমাম রিসিভ করে বলে,”কি করছিলে?”
আলো হেসে বলে,”তুমি তো জানো আমি কি করছিলাম ইশমাম। এতোবার ফোন দাও কেনো? দুইবার দিয়ে বসে থাকতে পারো না?”

ইশমাম হেসে বলে,”খুব অস্থির হয়ে যাই আমি। আসলে দূরে থাকি তো। তাই মনে হয় এই বুঝি আমাকে ঠকিয়ে কোনো বিসিএস ক্যাডার বিয়ে করে নিলে।”

আলো বলে,”ঢং দেখলে আর বাঁচি না।”

ইশমাম হেসে ফেলে। বলে,”ঠিকাছে। আর ঢং করলাম না। তুমি বাড়িতে যাও, সাবধানে যেও।”

“ইশমাম শোনো।”
ইশমাম ফোনটা কেটে দিতে যাচ্ছিলো। আলোর কথায় থেমে যায়।
“হ্যা বলো অদ্রিতা।”

_লাভ ইউ।

ইশমামের ঠোঁট প্রশস্ত হয়ে যায় হাসিতে। মৃদু স্বরে বলে,”লাভ ইউ টু।”

ফোন কেটে দিয়ে আলো এদিকে ওদিকে তাকায়। ব্যস্ত রাস্তাটাও আজ কেমন শুনশান হয়ে আছে। দুদিন ধরে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পরছে। গা না ভিজলেও বেশ অস্বস্তিকর। আলো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে রিকশার জন্য। রাস্তা দিয়ে দুই একজন লোক যাওয়া আসা করছে। আলো কিছু না ভেবেই হাটা শুরু করে। হঠাৎ করে তার সামনে একটা বাইক এসে থামে।

আলো দাঁড়িয়ে পরে। হেলমেট সরিয়ে বাইক থেকে নেমে পরে রাহাত এবং রনি। আলো চমকে ওঠে। খানিকটা ঘাবড়ে গিয়ে বলে,”আপনারা!”

“হু আমরা।”
স্বাভাবিক কন্ঠে রাহাত বলে। আলো রেগে গিয়ে বলে,”কি চাই? পথ আটকে দাঁড়িয়েছেন কেনো?”

রনি বলে,”আমাদের কিছু চাই না। ভাই আপনার সাথে একটু সাক্ষাৎ করতে চায়।”

_ভাই মানে! কোন ভাই?

_ভাই তো একটাই! সামিন ইয়াসার ভাই। শিরায় শিরায় রক্ত,আমরা ইয়াসার ভাইয়ের ভক্ত।

আলো গর্জে ওঠে,”ফাজলামি হচ্ছে? সরে দাঁড়ান পথ থেকে নয়তো এক্ষুনি ট্রিপল নাইনে ফোন দেবো আমি।”

রাহাত একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। ইতিমধ্যে সামিন ইয়াসারের গাড়ি এসে থামে। গাড়ি থেকে সামিন ইয়াসার নেমে আলোর মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ায়। আলো সামিনকে দেখেই ক্ষেপে যায়। চেঁচিয়ে বলে,” অ’স’ভ্য লোক, কি চাই আপনার?”

সামিন কিছুক্ষণ আলোর দিকে তাকিয়ে রনিকে চোখ দিয়ে ইশারা করে। রনি আলোকে বলে,”চোখ বন্ধ করেন তো আপা।”

আলো চেঁচিয়ে বলে,”মানে?”

আরাফ মুখে ‘চ’ কারন্ত শব্দ করে পকেট থেকে একটা ছোট বোতল বের করে । আলো কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্প্রে করে দেয় আলোর মুখে। অচেতন হয়ে আলো লুটিয়ে পরে যেতে নেয় মাটিতে। রাহাত ধরে ফেলে।

“সাবধানে ধর ওকে। মেয়ে মানুষ।”
গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে ইয়াসার।

রাহাত মাথা নেড়ে আলোকে ধরে ধরে সামিনের গাড়ির ড্রাইভিং সিটের পাশের সিট-টাতে বসিয়ে দেয়। অচেতন আলো কাত হয়ে পরে থাকে। আরাফ বলে,”ভাই এই মাত্র কি আমরা কি’ড’ন্যা’প করলাম?”

সামিন কোনো কথা না বলে গাড়িতে উঠে বসে। রাহাত রনির কাছে বাইকের চাবি দিয়ে নিজেও গিয়ে সামিনের গাড়িতে ওঠে। সামিন আলোর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট করে। রাহাত বলে,”ভাই? আপনি না বলেছেন ওকে নিয়ে আপনার পার্টি অফিসে যেতে। আপনি নিজেই চলে এলেন যে।”

“সিদ্ধান্ত পাল্টেছি। এখন আমাদের বাড়িতে যাচ্ছি।”

রাহাত অবাক হয়,”বাড়িতে গিয়ে কি হবে ভাই? তাছাড়া ওকে নিয়ে কি করবেন আপনি? না মানে আপনার খারাপ কোনো উদ্দেশ্য নেই তা আমি জানি কিন্তু একটা মেয়েকে এভাবে কি’ড’ন্যা’প করে,ভাই এটা তো ঘোর অপরাধ। ধরা পরলে জামিন নেই।”

সামিন কোনো কথা বলছে না। একমনে ড্রাইভ করতে থাকে। সে নিজেও জানে সে আগুন নিয়ে খেলছে কিন্তু খেলাটা তাকে শেষ করতেই হবে। ড্রাইভিং করতে করতে একবার সে আলোর মুখের দিকে তাকায়। কপালের কাছের চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে মেয়েটার। অচেতন অবস্থায় একেবারেই নিষ্পাপ বাচ্চাদের মতো লাগছে অথচ মেয়েটা কি প্রচন্ড তেজী, যেই তেজ ইয়াসারের অপছন্দ, ইয়াসার হজম করতে পারে না।

রাহাত পেছন থেকে বলে,”ইচ্ছা করছে দুই গালে দুইটা চ*ড় বসাই ভাই। ওর বাপ যে এতো বড় একটা শ’য়’তা’ন । কখনো বুঝতে পারিনি। ”

আরাফ বলে,”ভাই কি করে জানি না। তবে আমি হলে অবশ্যই ওকে থা’প্প’ড় মারতে মারতে সব দাঁত বের করে নিতাম।”

রাহাত বলে,”ওকে আটকে রেখে আতাউরের কাছে টাকা চাইবেন ভাই? কিন্তু আপনার তো টাকার অভাব নেই।”

আরাফ বলে,”আরে ধূর। ওকে ভাই ভয় দেখাবে। ঠিক হবে, একেবারে ঠিক হবে। ওর বাপ উচিত শিক্ষা পাবে।”

রাহাত সামিনকে বলে,”কিন্তু ভাই ওকে ছেড়ে দিতেই তো পুলিশের কাছে বলে দেবে সব,আর ওর বাবা তো বসে থাকবে না।”

_কিচ্ছু করতে পারবে না।
গম্ভীর এবং তেজী কন্ঠে বলে ওঠে সামিন।

রাহাত এবং আরাফ কিছু না বুঝে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে।

আলোর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে সামিন রাহাতকে বলে,”ওর ফোনটা বের কর ব্যাগ থেকে। আতাউরকে মেসেজ দিয়ে দে। দুই ঘণ্টা অন্তত নিশ্চিন্তে থাকুক। মেয়ের জন্য দুশ্চিন্তা না করুক।”

_আর দুই ঘন্টা পরে? তখন কি হবে?

সামিন ইয়াসার পৈশাচিক হাসি হাসে। তারপর ড্রাইভিং-এ মন দেয়।

***
পানির গ্লাস হাতে স্বামীর পেছনে এসে দাঁড়ায় রেহেনা। আতাউর আলম স্টাডি রুমে বসে কিছু কাগজপত্র দেখছিলো। রেহেনার পায়ের শব্দ পেয়ে মাথা তুলে তাকায়। রেহেনা বলে,”শুনছো। মেয়েটা তো এখনো এলো না। আমার খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে।”

“দুশ্চিন্তার কিছু নেই। মেসেজে বলেছে ফিরতে রাত হবে। একটু ব্যস্ত সে। তুমি আবার অযথা ফোন দিয়ে বিরক্ত করো না। রেগে যাবে।”

_তুমি সবসময় মেয়েটাকে এভাবে লাই দাও। একটা বিপদ ঘটে গেলে তখন বুঝবে। এই পৃথিবী মেয়েদের জন্য কতটা খারাপ তা জানো না?

_জানি। তবে আমার মেয়ে তো সাধারণ কোনো মেয়ে নয়। ওকে আমি সাধারণ অন্য সব মেয়েদের মতো বড় করিনি।

রেহেনা বলে,”কি কাজ? জিজ্ঞেস করো মেসেজ দিয়ে। আর তেমন হলে আয়াত-আজানকে পাঠিয়ে দাও। ওরা নিয়ে আসবে আলোকে।

“তুমি যাও তো। একটু পরে আমিই গিয়ে নিয়ে আসবো ওকে। যাও তুমি।”

রেহেনা বেগম ঘরে থেকে চিন্তিত মুখ নিয়ে বের হয়। তার শরীরটা একটু একটু কাঁপছে। বুকটা কেমন খাঁ খাঁ করছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা অঘটন ঘটতে চলেছে।
***
বাড়ির নাম “শান্তিনীড়”। আগে ছিলো “মির্জা ম্যানশন”। সামিনের মা ‘হোসনে আরা শান্তির’ মৃত্যুর পরে সামিন এই নাম রেখেছে। সামিনের গাড়ির শব্দ পেয়ে বাড়ির কেয়ার টেকার পোনা এসে গেইট খুলে দেয়। পোর্চের কাছে এসে গাড়ি থামিয়ে সামিন নেমে পরে গাড়ি থেকে। পোনার দিকে তাকিয়ে বলে,”পোনা চাচা,ইশিতা আর রিতুকে ডেকে আনুন।”

পোনা মাথা নাড়িয়ে একছুটে দৌড়ে যায় ভেতরে। রাহাত এবং আরাফ নেমে দাঁড়ায়। তারা উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে সামিন ইয়াসারের দিকে। ঠিক কি ঘটাতে চলেছে তাদের ভাই তারা সেটাই বুঝতে পারছে না।

ইশিতা আর রিতু বাইরে চলে এসেছে। ইশিতা কিছুক্ষণ আগে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো। সে চোখ ডলতে থাকে। রিতু বলে,”ভাইয়া কিছু হয়েছে?”

সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”দরজা খুলে ওকে ভেতরে নিয়ে যাও‌।”

_কাকে?
ইশিতা অবাক হয়ে জানতে চায়।

_ভেতরে যে আছে তাকে।

ইশিতা আর রিতু হতভম্ব হয়ে গাড়ির দরজা খুলে চমকে ওঠে। ইশিতা একপ্রকার চেঁচিয়ে ওঠে,”মাই গড! এসব হচ্ছে কি ভাইয়া? এই মেয়েটা তো সে মেয়েটা। তোমাকে চ*ড় মেরেছিলো। আতাউর আলমের মেয়ে।”

সামিন চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকে। ইশিতা বলে,”এ এখানে কেনো? আর এভাবে ঘুমাচ্ছে কেনো। ভাইয়া প্লিজ পরিষ্কার করে বলো তো‌।”

ইলহাম এবং বাড়ির দু’জন মহিলা সার্ভেন্ট এসে দাঁড়িয়েছে পোর্চের নিচে। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।

সামিন ধমকের সুরে বলে ওঠে,”ও ঘুমাচ্ছে না। অচেতন হয়ে আছে। এতো কথার জবাব দিতে পারবো না। একে গেস্টরুমে নিয়ে যা নিচতলার। মুখে পানির ছাট মার, হুঁশ ফিরে পাবে।”

রিতু ভাসুরের ধমকে ভয় পেয়ে ইশিতাকে বলে,”আপু আগে ওনাকে ধরো। নিয়ে যাই ঘরে।”

তারপর মহিলা সার্ভেন্টদের দিকে ফিরে বলে,”তোমরাও আসো খালা।”

সবাই ধরাধরি করে আলোকে ঘরে নিয়ে যায়। ইলহাম হতভম্ব হয়ে বলে,”হচ্ছে টা কি ভাইয়া আসলে।”

_কিছু-ই হচ্ছে না। তবে হতে চলেছে।

ইলহাম কিছু বুঝতে পারছে না ভাইয়ের কথায়। সামিন আরাফের দিকে তাকিয়ে বলে ,”রনিকে ফোন দে। ওদিকের কি অবস্থা জেনে নে।”

***

কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে রেহেনা ছুটে এসে দরজা খোলে। দরজা খুলেই সে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার সামনে ছয় থেকে সাতজন অচেনা ছেলে। আতাউর আলম বসার ঘরের দিকে আসতে আসতে বলতে থাকে,”কি? আলো এসে গিয়েছে? তুমি শুধু শুধু টেনশন…..”

কথা থামিয়ে দিয়ে আতাউর আলম রনির দিকে তাকায়। রনি একটা মুচকি হাসি দিয়ে দলবল নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। আতাউর আলম চেঁচিয়ে বলে,”তোরা? তোদের সাহস তো কম না!”

_সাহসের তো কিছুই দেখেননি চাচা। আমরা ইয়াসার ভাইয়ের ভক্ত। আমাদের শিরায় শিরায় রক্ত, গরম রক্ত।

কথাটি বলেই রনি বাকি ছেলেদের বলে,”ওই নেংটি ইঁদুর দু’টোকে ধরে আন আগে।”

আজান আর আয়াত চেঁচামেচির আওয়াজ পেয়ে বসার ঘরের দিকেই আসছিলো। দলের দু’জন গিয়ে ওদের দু’জনকে ধরে ফেলে।

আতাউর আলম ঘাবড়ে গিয়ে বলে,”ছাড় ওদের। ছাড় আমার ছেলেদের।”

রনি হেসে বলে,”ছেলেদের একটু ধরেছি বলে বি*চি একেবারে শুকিয়ে গিয়েছে তাই না চাচা? তাহলে শুনুন চাচা। আপনার মেয়েকে কিছুক্ষণ আগে ইয়াসার ভাই তুলে নিয়ে গিয়েছে তার বাড়িতে।”

রেহেনা আর্তনাদ করে উঠে অচেতন হয়ে লুটিয়ে পরে মাটিতে। আতাউর আলম রনির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আজান আয়াত চেঁচিয়ে উঠে বলে,”বাবা আমাদের আপু!”

***
মুখে পানির ঝাপটা পরতে-ই আলো কপাল কুঁচকে ফেলে খানিকটা। বাড়ির কাজের খালা সিতারা রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”জ্ঞান ফিরতেছে মেজো ভাবি।”

রিতু অসহায়ের মতো আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার ভীষণ মায়া হচ্ছে অচেনা এই মেয়েটার জন্য। কিছুটা হতভম্ব হয়ে গিয়েছে সে পুরো ব্যপারটায়। তার ভাসুরকে সে যতটুকু চেনে তাতে সে জানে সামিন ইয়াসারের নারীর দোষ নেই। তাহলে এই মেয়েটিকে কেনো এনেছে তুলে। তবে কি রিতুর ধারণা ভুল! এই বাড়ির সব ছেলেরা-ই কি এক!

আলো ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকায়। ঘোলাটে দৃষ্টি দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে শূন্যে। কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে পরিস্থিতি অনুধাবন করে সে লাফিয়ে উঠে বসে। শরীরে কোনো শক্তি খুজে পাচ্ছে না সে ‌। তার সামনে কতগুলো অচেনা মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। আলো সবার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”আমি কোথায়?”

“আমার বাড়িতে।”

দরজার পর্দা ঠেলে ইয়াসার মির্জা ভেতরে ঢোকে। আলো ঘৃন্য কন্ঠস্বর শুনে চমকে উঠে তাকায়। কিছুক্ষণ আগের সবকিছু তার মনে পরতেই একলাফে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। তার গায়ে কোনো জোর সে পায়না। সামনে পা বাড়াতেই মাথা ঘুরে পরে যেতে নেয়,ইশিতা গিয়ে ধরে ফেলে। আলো তেজী কন্ঠে বলে ওঠে,”জা’নো’য়া’র ! তোর মতলব কি! আমাকে যেতে দে কু**** বা**।”

সামিন হেসে ফেলে। আলোর চিৎকার তার কাছে কিছুটা বাঁশির আওয়াজের মতো লাগছে শুনতে। রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমরা বাইরে যাও। ওর সাথে আমার কথা আছে।”

ইশিতা চেঁচিয়ে ওঠে,”ভাইয়া। তুমি করতে চাইছো কি। বাবা কিন্তু রেগে যাবে খুব। তুমি এবার থামো। ওকে ওর বাড়িতে পাঠিয়ে দাও‌।”

সামিন কঠিন গলায় বলে,”তোদের বাইরে যেতে বলেছি। তিন সেকেন্ডের মধ্যে।”

আলো ইশিতার হাত ধরে ঝরঝর করে কেঁদে দিয়ে বলে,”আপনারা প্লিজ যাবেন না। ওই লোকটা প্রচন্ড খারাপ। প্লিজ যাবেন না আপনারা।”

ইশিতা নিরুপায়। আলোর থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রিতুর সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আলো কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পরে। সামিন আলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা চেয়ার টেনে আলোর মুখোমুখি বসে।

তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,”আমার বাবা সৎ,আমার বাবা মহৎ। এমন টা-ই বলো না তুমি সবসময়? তোমার এই অবস্থার জন্য ফিফটি পার্সেন্ট তোমার ওই সুপার হিরো দায়ী আর বাকি ফিফটি পার্সেন্ট তুমি নিজে।”

আলো কান্না থামিয়ে বলে,”চাস কি তুই?”

সামিন ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে‌। তখনি ফুয়াদ এবং রাহাত এসে ঘরে ঢোকে। তাদের পিছু পিছু ঢোকে ইলহাম এবং আরাফ।

আলো সেদিকে তাকায়। সামিন ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে বলে,”কাজী এসে গিয়েছে?”
ফুয়াদ একবার আলোর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়। আলো হতভম্ব হয়ে সামিনের দিকে তাকায়। রাহাত আরাফ অবাক হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। ইলহাম বলে,”ভাইয়া কাজী এসেছে কেনো? কাজী কি করবে?”

_বিয়ে পড়াবে।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় সামিন। ইলহাম হতভম্ব হয়ে বলে,”বিয়ে পড়াবে মানে? কার বিয়ে?”

আলোর দিকে নিজের তর্জনী আঙ্গুল তুলে তেজী কন্ঠে সামিন ইয়াসার মির্জা বলে,”ওর আর আমার।”

ফুয়াদ বাদে সবাই হতবাক হয়ে সামিনের মুখের দিকে তাকায়। আলো আতঙ্কিত হয়ে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ায়। বিকট শব্দে চেঁচিয়ে বলে,” জা’নো’য়া’রে’র বাচ্চা। তোর সাহস কিভাবে হয়….”

সবাইকে পুনরায় অবাক করে দিয়ে সামিন আলোকে একটা চ*ড় মারে। চ*রের ধাক্কা সামলাতে না পেরে আলো লুটিয়ে পরে যায় মাটিতে। গালে হাত দিয়ে, মাথা তুলে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে দেখে সামিনকে।

রাহাত কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”ভাই! এটা কেমন ধরনের প্রতিশোধ। বিয়ে করবেন কেনো?”

সামিন শুকনো হাসি হাসে। আলো তেজী কন্ঠে বলে ওঠে,”কখনোই না। তোর মতো পশুকে বিয়ে করবো না আমি।”

সামিন ইয়াসার আলোর দিকে খানিকটা ঝুকে বলে,”চ*ড় খেয়েও তেজ কমেনি দেখছি। ফুয়াদ,কাজীকে ভেতরে আসতে বল।”

ইলহাম এতক্ষনে সবটা বুঝতে পেরে আনন্দিত গলায় বলে,”এক্সিলেন্ট ভাইয়া। এই না হলে আমার ভাই! সাত বছর আগে ওর বাপ আমাদের পরিবারের সাথে যা করেছে তার উপযুক্ত শাস্তি এটা। ভেরি গুড ভাইয়া।”

ইলহাম খুশি হলেও,খুশি হয়না রাহাত এবং আরাফ। তারা তাদের নেতার বৌ হিসেবে আলো নামের ওই মেয়েটিকে মানতেই পারবে না। রাহাত বলে,”ভাই । এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। বিয়ে কোনো ছেলে খেলা?”
_তোদের তো খুশি হবার কথা রাহাত, বিয়ে করেন বিয়ে করেন বলে কানের পোকা বের করে দিতি আমার।

_ভাই তাই বলে এই মেয়ে? আতাউরের মেয়ে?

সামিন গম্ভীর গলায় বলে,”হ্যা আতাউরের মেয়ে।”

আলো উঠে গিয়ে সামিনের কলার ধরে। ঝরঝর করে কেঁদে দিয়ে বলে,”এক্ষুনি যেতে দে আমাকে। এক্ষুনি।”
কথাটি বলে অনবরত কিল ঘুষি মারতে থাকে সামিনের বুকে। কিন্তু তাতে সামিনের বলিষ্ঠ শরীরে কোনো প্রভাব পরে না। সটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে।
ফুয়াদ কাজীকে নিয়ে ঘরে ঢোকে। কাজী ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চারপাশে তাকায়। এখানে কি হচ্ছে তার বোঝার দরকার নেই। কোনোমতে বিয়েটা পরিয়ে কেটে পরবে সে। এই বাঘের গুহায় বেশিক্ষণ থাকলেই বিপদ।

কাজী বিয়ে পরাতে শুরু করে। আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”কবুল বলতে বললে কবুল বলবে মা।”
_আমি কবুল বলবো না।
চেঁচাতে থাকে আলো। সামিন আলোর চোয়াল চেপে ধরে বলে,”কবুল বলবে তুমি,দেরী করলে তোমার ক্ষতি।”

আলো নিস্তেজ হয়ে পরে, অস্ফুট স্বরে বলে,”আমায় বিয়ে করে লাভ টা কি হবে আপনার?”

_সেটা পরে বুঝতে পারবে।
আলোর চোয়াল ছেড়ে দিয়ে আরাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”রনিকে ভিডিও কল দে। বিয়ের আগে বাপ-বেটিতে মোলাকাত করে নিক। তারপর কখনো দেখা হয় কি না কে জানে।
আরাফ মাথা নাড়িয়ে রনিকে ফোন দেয়। রনি রিসিভ করে আতাউর আলমের সামনে রেখে দেয় ফোনটা। আলো চেঁচিয়ে ওঠে,”আব্বু।”

আতাউর আলম কাঁদছে। তার মুখ থেকে কোনো কথা বেরোচ্ছে না।

আলো কাঁদতে কাঁদতে বলে,”আব্বু,ওরা আমাকে।”

_তুমি কবুল বলে দাও আম্মু।

আলো আহত চোখে বাবার দিকে তাকায়। আতাউর আলম চোখ মুছে বলে,”নয়তো আজান-আয়াতকে মেরে মিউনিসিপ্যালিটির ড্রেনে ফেলে রাখবে ওরা। তুমি কবুল বলো।”

সামিন উঠে এসে ফোন কেড়ে নিয়ে আতাউর আলমকে বলে,
” সবসময় কি যেনো বলতে? আমরা সরকারি দল। আমরা ক্ষমতার অপব্যবহার করি। ক্ষমতার অপব্যবহার এটাকে বলে আতাউর আলম। চুপচাপ ওখানে বসে তোমার মেয়ে আর আমার বিয়ে দেখবে। চোখ সরিয়েছো কি তোমার ওই ছেলে দুটোকে মেরে বড় বাজারের ব্রিজের কচুরিপানার নিচে ফেলে দিয়ে আসবো।”

আলোর শরীরটা যেনো অসাড় হয়ে যাচ্ছে। সামিন ইয়াসার আলোর দিকে একবার তাকিয়ে কাজীকে ধমকে বলে,”থামলেন কেনো? বিয়ে পড়ান। পাত্র সামিন ইয়াসার মির্জা,পিতা ইমতিয়াজ মির্জা। পাত্রী অদ্রিতা আলো,পিতা আতাউর আলম।”

কাজী একটা ঢোক গিলে মাথা নাড়ায়। পুনরায় বিয়ে পড়াতে থাকে। আতাউর আলম ওপাশে বসে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তার ইচ্ছে করছে গলায় ফাঁস নিতে। আলো শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

কাজী ইয়াসারের দিকে তাকিয়ে বলে,”কবুল বলো বাবা।”
ইয়াসার আলোর দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলে,”কবুল।”

কাজী এবার আলোকে বলে,”মা কবুল বলো।”

আতাউর আলম চেঁচিয়ে ওঠে,”কেনো করছো ইয়াসার! আমি তো বলেছি আমি নির্বাচন বর্জন করবো ইয়াসার। প্রয়োজনে আমি তোমার পা ধরে মাফ চাইবো ইয়াসার। আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দাও। ও আমার খুব আদরের।”

ইয়াসার শুকনো হাসি হেসে বলে,”জানি তো। সেজন্যই তো বিয়ে করছি। আপনার আদরের জামাই হবো বলে।”

আতাউর আলম কান্নায় ভেঙে পরে।

কাজী বলতে থাকে,”এই মেয়ে তো কবুল বলছে না বাবা।”

ইয়াসার ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রনিকে বলে,”রনি। ওর দু’টো ভাইয়ের মধ্যে একটাকে রেখে আরেকটার গ’লা’য় ছু*রি বসিয়ে দে তো।”

আলো কেঁপে ওঠে। ঝরঝর করে কেঁদে দিয়ে বলে,”কবুল।”

চলমান…….