বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে পর্ব-১৫+১৬+১৭

0
631

#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_১৫
#Esrat_Ety

ইশমাম আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আলোর চোখ মুখ তীব্র ক্ষো’ভে ফে’টে পরতে চাইছে। ইশমাম এক কদম সামনে এগোতেই আলো দুই কদম পিছিয়ে গিয়ে রাগে ফুঁ’স’তে থাকে। ইশমাম আলোর পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে নরম সুরে বলে,”এসব কিভাবে হলো অদ্রিতা?”

_বেড়িয়ে যাও তুমি। বেড়িয়ে যাও।
_অদ্রিতা…

আলো ইশমামের দিকে তে’ড়ে যায়, চেঁচিয়ে বলতে থাকে,”লজ্জা করে না? লজ্জা করে না ভাইয়ের বৌয়ের ঘরে পারমিশন না নিয়ে ঢুকতে?”
আলোর কথায় ইশমাম চোখ নামিয়ে নেয়। আলো একবার দেয়ালে টাঙ্গানো ছবিটার দিকে তাকিয়ে ইশমামের দিকে তাকায়। বিড়বিড় করে বলতে থাকে,”সেজন্যই এতো মিল। সেজন্যই সামিন ইয়াসার মির্জার নামে কোনো বা’জে কথা শুনতে পারতে না তুমি। আমারই ভুল। আমিই বোকা। আমিই বুঝতে পারিনি।”
ঝরঝর করে কেঁ’দে দেয় আলো।

_ঘৃ’ণা করো না আমাকে অদ্রিতা। তোমাকে হারাতে চাইনি আমি। তাই বলিনি সত্যিটা।

ইশমামের এই কথায় আলো দুচোখে পানি নিয়েও তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে,তেজী কন্ঠে বলে ওঠে,”হারাতে চাওনি? হারিয়ে তো ফেলেছো! বেশ হয়েছে। বেশ হয়েছে। এটাই তোমার উচিত শিক্ষা।”

ইশমাম আহত চোখে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো বলতে থাকে,”বাবা টিচার, মা গৃহিণী। বাবা মা সম্পর্কে মিথ্যা বলতে বাঁধলো না একটুও? তুমি তো সামিন ইয়াসার মির্জার চেয়েও নি’কৃ’ষ্ট। ছ’ল’না করে পেতে চেয়েছিলে আমায়। নাকি কখনো চাওনি। ভেবেছিলে কিছুদিন টাইম পাস করে ছেড়ে দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যাবে। অদ্রিতা নামের বোকা মেয়েটা টেরই পাবেনা।”

_অদ্রিতা।
ইশমাম আর কিছু শুনতে চাইছে না আলোর মুখে। আলো বলতে থাকে,”ধিক্কার জানাই তোমাকে। তোমার থেকে তো সামিন ইয়াসার ঢের ভালো। যা করেছে সামনাসামনি করেছে, তোমার মতো প্রতারনা করে…..”
আর কিছু বলতে পারে না আলো। পুরো শরীর ভেঙ্গে কান্না আসছে। কাঁ’দ’তে কাঁ’দ’তে মেঝেতে বসে পরে। ইশমাম আলোর দিকে অসহায়ের মতো দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকে। কয়েক মুহূর্ত পরে কান্নাটা দ’মি’য়ে আলো বলে ওঠে,”একেবারে সামিন ইয়াসার মির্জার হাতে গড়া পা’ষ’ণ্ড তুমি। একবারও ভাবলে না একটা মেয়ের ইমোশন নিয়ে এভাবে খেলা ঠিক না। কি উদ্দেশ্যে ছিলো বলো? তুমি ভালো করেই জানতে তুমি মির্জা বাড়ির ছেলে জানতে পারলে আমি তোমাকে বরদাস্ত করবো না তবুও কোন উদ্দেশ্য,কোন আশায় তুমি রিলেশন কনটিনিউ করেছিলে? বলো!”

ইশমাম কিছু বলে না। আলো চেঁচাতে থাকে,”বেড়িয়ে যাও, বেড়িয়ে যাও এখান থেকে। ওই মুখ আমি দেখতে চাই না। বেড়িয়ে যাও প্র’তা’র’ক।”

শেষের কথাটা অত্যন্ত উচ্চস্বরে বলে আলো। নিচতলা থেকে আলোর চি’ৎ’কা’র শোনা যাচ্ছে। ইশিতা রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”কাকে বেড়িয়ে যেতে বলছে?”

রিতু চিন্তিত ভঙ্গিতে সামিনের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ইশমাম ধীরপায়ে ঘর থেকে বের হয়। রিতু অবাক হয়ে ইশমামের দিকে তাকিয়ে আছে। ইশমাম রিতুর দৃষ্টি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।

***

লিভিং রুমে ঢুকে সামিন দাঁড়িয়ে পরে। ইশিতা আর রিতু তার দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে,”জ্ঞান ফিরেছে? ডাক্তার কি বলেছে?”
_ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন হয়নি। জ্ঞান তার আগেই ফিরেছে। একটু আগে গিয়ে দেখি জ্বর এসেছে হঠাৎ।

“ও”
শুকনো মুখে বলে সামিন সিঁড়ির দিকে যায়। তারপর দাঁড়িয়ে রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”ইশমাম কিছু খেয়েছে?”

_কি আর খাবে ভাইজান। বড় ভাবী যে ব্যাবহার টা করলো তারপর আর খাবার পেটে যায়?

“মানে?”
গম্ভীর কন্ঠে শব্দটি উচ্চারণ করে সামিন,ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ফুলির মায়ের দিকে।
ফুলির মা বলতে থাকে,”জ্ঞান ফেরার পরে মে’জা’জ দেখাইয়া আমাদের সবাইরে ঘর থিকা বাহির কইরা দিলো। ইশমাম ভাইয়া ভাবীরে দেখতে গেছিলো ঘরে,ভাবী খুব বাজে ব্যবহার কইরা ইশমাম ভাইয়ারে ঘর থেকে বের কইরা দিছে। ইশমাম ভাইয়া সেই যে ঘরের দরজা বন্ধ করছে এখনো খোলে নাই। কেউ ডাকলেও সাড়া দিতেছে না ভাইজান।”

সামিনের রাগ উঠে যায়। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে চলে যায়। ইশিতা ফুলির মাকে ধ’ম’ক দিয়ে বলে,”বেশি কথা বলো তুমি!”

দরজা খোলা। সামিন একবার উঁকি দিয়ে আলোকে দেখে নেয়। গুটিসুটি মেরে মাথা নিচু করে বিছানায় বসে আছে চুপচাপ। ঘরে না ঢুকে সামিন সোজা ইশমামের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দরজায় টোকা দিয়ে বলে,”ছোটো।”
ইশমাম কোনো সাড়া দেয়না। সামিন জোরে ডাকতে থাকে,”ছোটো দরজা খোল।”

কিছুক্ষণ পর ইশমাম দরজা খুলে দেয়। সামিন তার ভাইকে দেখে। কেমন বিধ্বস্ত রূপ ধারণ করেছে ইশমামের মুখ। সামিন বলে ওঠে,”কি বলেছে ও তোকে? গা’লা’গা’ল করেছে?”

ইশমাম ধীরে ধীরে চোখ তুলে ভাইয়ের দিকে তাকায়। সামিন বলে,”তুই নিচে চল। খাবি।”

_ভাইয়া তুমি যাও। আমি খাবো না এখন।
নিস্তেজ কন্ঠে জবাব দেয় ইশমাম। সামিন ধমকের সুরে বলে,”খাবি না মানে? তুই কেনো খাবি না। ও অন্যায় করেছে। ওকে শাস্তি পেতে হবে। তুই নিচে চল। চল বলছি।”
সামিন ইশমামকে জোর করে নিচে পাঠিয়ে দেয়‌‌। ইশমাম রোবটের মতো হাটছে, জগতের কোনো কিছুর দিকে তার কোনো হুস নেই যেন।

ঘরের ভেতরে ঢুকে দরজা চাপিয়ে দিয়ে আলোর দিকে রা’গী দৃষ্টিতে তাকায় সামিন। আলো সামিনের অস্তিত্ব টের পায় কিন্তু মাথা তুলে তাকায় না। সামিন আলোর দিকে এগিয়ে গিয়ে তার শক্ত হাতে আলোর থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে আলোর চোখের দিকে তাকায়। আলোর চোখ দু’টো দেখে সামিন থ’ম’কে যায়। দেখেই মনে হচ্ছে কাঁদছিল এতক্ষণ। সামিনের হুট করে রা’গ পরে যায়। আলোর থুতনি থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বিছানায় একপাশে বসে পরে। ভেবেছিলো ধ’ম’কে নিয়ে যাবে কিন্তু আলোকে দেখে আর ধ’ম’কা’তে ইচ্ছে করছে না। নিচু স্বরে বলে,”আমার সাথে জড়িত সব মানুষকে তুমি ঘৃণা করো ঠিকাছে, ইশমাম নতুন মানুষ। আমার কোনো অন্যায়ের আগে পিছে ও নেই। একটু ভদ্রতা বজায় রাখা যেত না?”

আলো চুপ করে থাকে। সামিন নিজেকে নিজে বলে,”কাকে কি বলছি। সোজা আঙ্গুলে এই ঘি কখনোই উঠবে না। জানা কথা।”

বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। সামিন উঠে দাঁড়িয়ে আলোর হাত ধরে। আলো সামিনের দিকে তাকায়। সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে,”চলো আমার সাথে।”
***
“আজ হঠাৎ এলি যে!”
পরী পেছন থেকে বাবার ডাক শুনে দাঁড়িয়ে পরে। ছাতাটা একটু উঁচুতে তুলে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,”ইশিতা আপু ডেকেছে। আর ক্লাসও ছিলো না আজ।”

পোনা বলে,”ও।”
পরী ধীরপায়ে হেটে সদর দরজার দিকে যায়। ছাতাটা পোর্চের নিচে পানি ঝরার জন্য রেখে দেয়। গায়ের ওড়নাটা ঠিক ঠাক করে ভেতরে ঢোকে। করিডোর পেরিয়ে লিভিং রুমে ঢুকতেই দেখতে পায় সিঁড়ি বেয়ে নামছে ইশমাম। পরী থ’ম’কে দাঁড়িয়ে পরে। চার বছর আগের দেখা ইশমাম ভাইয়ের সাথে এই লোকটার বিস্তর ফারাক। স্বাস্থ্যও কিছুটা ভালো হয়েছে। পরীর ভাষ্যমতে আগে খ্যাংরা কাঠির মতো দেখতে ছিলো। আগে গালে মাংস ছিলো না বলে চোখ দুটো বড় বড় লাগতো। এখন গাল দুটো বেশ ভরাট তাই চোখ দুটোকে ছোটো লাগছে। অবশ্য একটা জিনিস বদলায় নি। ইশমামের মুখের বিধ্বস্ত অবস্থা। এই লোকটা সবসময় মুখ এমন করেই রাখে। দেখলে মনে হয় সকাল থেকে বাথরুম আটকে রেখেছে সিরিয়াল পায়নি বলে,আর পাঁচ মিনিট দেরী হলে বিরাট বড় কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। সেই টেনশনে সে অস্থির!
ইশমাম নিচে নামতেই পরী অনেকটা জড়তা নিয়ে বলে,”কেমন আছেন ইশমাম ভাইয়া।”

ইশমাম পরীর দিকে একপলক তাকিয়ে শুকনো গলায় বলে,”ভালো‌।”
এতোটুকু বলে সে ডাইনিং-এর দিকে চলে যায়। পরী ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। সব কিছু বদলে গেলেও এই মহাশয়ের ব্যাবহার একটুও বদলায় নি। কেউ কেমন আছেন জিজ্ঞেস করলে তাকেও যে জিজ্ঞেস করতে হয় সেটা এই লোকটা এখনো শেখেনি। কিংবা যতটুকু জানতো আমেরিকায় গিয়ে সব খেয়ে বসে আছে। পরী কপাল কুঁচকে দোতলায় ইশিতার ঘরের দিকে যায়। সে থোরাই কেয়ার করে এসব রামগরুরের ছানাদের।

***
আলোর হাত ধরে টানতে টানতে সামিন ডাইনিং টেবিলের সামনে এনে দাড় করায়। ইশমাম মাথা নিচু করে বসে আছে। সামিন একটা চেয়ার টেনে ইশমামের পাশে বসে আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”আমার ভাই এখন ভাত খাবে। তুমি ওর বড় ভাবী। ওর প্লেটে মাংস তুলে দাও।”

ইশমাম ভাইয়ের দিকে তাকায়। তার দৃষ্টি এলোমেলো। আলো শুকনো মুখে সামিনের দিকে একবার তাকিয়ে ইশমামের দিকে তাকায়। সামিন বলে,”হা করে দেখছো কি? এ বাড়ির বৌ তুমি, তোমার দেবর খেতে বসেছে। তার প্লেটে মাংস তুলে দাও।”

আলো হাত বাড়িয়ে মাংসের বাটি ধরে। আবারো চোখ তুলে একবার ইশমাম, একবার সামিনকে দেখে। ঘৃণায় একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায় তার ভেতর থেকে। সামিনকে হতবাক করে দিয়ে আলো মাংসের বাটি উল্টে দেয় ইশমামের প্লেটে। তারপর মাছ ভাজার বাটি, তারপর রোস্টের বাটি, তারপর দইয়ের বাটি। সবকিছু ঢেলে দেয় ইশমামের প্লেটের উপর।

ইশমাম নিজের প্লেটের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, হতভম্ব ভাব কাটিয়ে কিছু বলার আগেই আলো চলে যায় সেখান থেকে।

রিতু দৌড়ে এসে সামিনকে শান্ত করে বলে,”ও ভাইয়া। ভাবীর শরীর ভালো নেই। জ্বর গায়ে। খামোখা তাকে জোর করবেন না প্লিজ। আমি দিচ্ছি ইশমাম ভাইয়াকে খাবার বেড়ে।”

ইশমামের সামনে থেকে সবকিছু পরিষ্কার করে রিতু নতুন করে খাবার বাড়তে শুরু করে। ইশমাম পাথরের মতো বসে আছে। সামিন বলে,”তুই খা।”
ভাইয়ের কথায় বাধ্য ছেলের মতো ইশমাম কিছুটা খেয়ে হাত ধুয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,”আমি ঘরে যাই ভাইয়া? খুব ঘুম পাচ্ছে! বড্ড ক্লান্ত আমি!”

***
ঘরে ঢুকে দরজার সিটকিনি তুলে দিয়ে সামিন আলোর দিকে তাকায়। আলো তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে গায়ে জ্বর বেড়েছে। আলোর দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে,”আমি ভুলে গিয়েছিলাম তুমি ভরা জনসভায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতার গালে চ’ড় মেরে দেওয়া মেয়ে,তোমাকে এতো সহজে পোষ মানানো যাবে না।”

_পোষ মানিয়ে কি করবেন? আপনার বাড়ি, আপনার ঘর, আপনার রাজত্ব, আপনার পোষা লোক সব, আপনার ক্ষমতা,আপনার গায়ের জোর। পোষ মানার ধার ধারেন কেনো?

আলোর কন্ঠে কিছু একটা ছিলো। সামিন আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আলোর পুরো শরীর জ্ব’লে যাচ্ছে। নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে বলে,”কেনো বিয়ে করেছেন? চেহারা দেখার জন্য নয় নিশ্চই। কিসের অপেক্ষা করছেন আপনি। কেনো নিজের স্বার্থ হাসিল করে আমাকে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছেন না? তাহলেই তো পুরোপুরি প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে যায়। আমিও মুক্তি পাই। আমি আপনার এই কা’রা’গা’র থেকে মুক্তি চাই ইয়াসার মির্জা। না আমি আপনাকে কখনো স্বামি হিসেবে মানবো,না আপনি আমায় কখনো স্ত্রী হিসেবে পাবেন। যদি আমাকে লা’ঞ্চি’ত করার ইচ্ছে থাকে,করে আমাকে মুক্তি দিন‌। আমি আপনার কাছে অনুরোধ করছি ইয়াসার মির্জা। আলো আপনার কাছে হার স্বীকার করে নিলো আজ ‌। আমি শুধু মুক্তি চাই। আপনি, আপনার বাড়ির প্রত্যেকটা লোকের মুখ আমি দেখতে চাই না। দয়া করে মুক্তি দিন আমায়। কথা দিচ্ছি আমার পরিবার নিয়ে আমি খুলনা চলে যাবো আজীবনের জন্য। আর কখনো আপনার সাথে লাগতে আসবো না। কখনোই না।”

উন্মাদের মত ঘোর লাগা কন্ঠে আলো বলে কথা গুলো। জ্বরে তার গা পু’ড়ে যেতে চাইছে। সামিন আলোর চোখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে হুট করে আলোর কপালে হাত দেয়। প্রচন্ড গরম আলোর শরীর। চোখ টকটকে লাল হয়ে গিয়েছে। আলো সামিনের হাত সরিয়ে দেয় নিজের কপাল থেকে। সামিন বলে,”এখন হাত সরিয়ে দিচ্ছো কেনো? এই মাত্র কতকিছু বললে। আমি যেন আমার যা ইচ্ছা করে তোমাকে ছু’ড়ে ফেলে দেই।”

আলো শাড়ির আঁচল খামচে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। অস্ফুট স্বরে বলে,”আপনি খারাপ,আপনারা সবাই খারাপ। জঘন্য আপনারা।”

_নতুন কথা না এটা। তোমার গায়ে ভীষণ জ্বর। চুপ করে বসে থাকো। আমি ওষুধ নিয়ে আসছি।

_চাই না আপনার দয়া। উপহাস করবেন না আর আমার সাথে। আল্লাহ কে ভয় করুন ইয়াসার মির্জা।

সামিন চুপ করে থাকে। আলো ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে চায়। সামিন হাত দিয়ে আলোর পথ আটকে বলে,”বিছানায় শুয়ে রেস্ট নাও‌। বাইরে তোমার কোনো কাজ নেই।”

আলো ঘৃণার চোখে সামিনের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জে’দ দেখিয়ে ছুটে বারান্দায় চলে যায়। বাইরে প্রচুর বৃষ্টি পরছে। নিমিষেই ভিজে যায় আলো। সামিন আলোর পিঠের দিকে তাকিয়ে আছে। আলো একটু পর পর কেঁ’পে কেঁ’পে উঠছে, হয়তো প্রচন্ড জ্বরে, হয়তোবা কান্না করছে। কিছু সময় যেতে সামিন একটা ছাতা নিয়ে বারান্দায় যায়। গিয়ে আলোর পাশে দাঁড়িয়ে আড়চোখে আলোকে দেখে। বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে আলো। সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে,”ভেতরে চলো আলো। তোমার গায়ে জ্বর।”

আলোর নীরবতা সামিনের রাগ উঠিয়ে দেয়। সামিন ধমকে ওঠে,”আলো আমার জেদ সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই। কিছুই দেখাইনি তোমায় এখনো। চুপচাপ ভেতরে চলো।”

আলো নিশ্চুপ। সামিন দাঁতে দাঁত চেপে ছাতাটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। ঝড়ো হাওয়া ছাতাটাকে উড়িয়ে নিয়ে বাগানে ফেলে দেয়। নিজেও ভিজে যায় সামিন।

তারপর আলোকে টানতে থাকে। আলো সামিনকে ধা’ক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। ক্ষেপে গিয়ে সামিন আলোকে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয়। আলো পুরুষালি শক্তির সাথে পেরে ওঠে না। সামিনের বুকে অনবরত কি/ল ঘু/ষি মা’র’তে মা’র’তে ডুকরে কেঁ’দে ওঠে সে। সামিনের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ঘরে নিয়ে গিয়ে নামিয়ে দেয় আলোকে সামিন। তারপর আলমারি থেকে একটা শাড়ি বের করে এনে আলোর হাতে দিয়ে বলে, “আমি ওষুধ আনতে যাচ্ছি। দশমিনিট পরে এসে দেখি যেন শাড়িটা পাল্টানো হয়ে গিয়েছে নাহলে আমি কি করবো আমি নিজেও জানি না আলো‌।”

তেজী কন্ঠে কথাটি বলে সামিন ঘরের বাইরে চলে যায়। আলো অসহায়ের মতো কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে হাতের শাড়িটার দিকে তাকায়।

***
জ্বর বেড়ে গিয়েছে। নিঃশ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে তার। কাঁপা কাঁপা হাতে শাড়ীর কুচি ঠিক করে আঁচল তুলে দেয় শরীরে। পেছন থেকে আঁচলের অগ্রভাগ ডান কাঁধে টেনে নেয়। প্রচন্ড শীত লাগতে শুরু করেছে। ওয়াশ রুম থেকে বের হয় বিছানায় গিয়ে কিছুক্ষণ গুটিসুটি মেরে বসে থাকে। একটু পরে আর বসে থাকতে না পেরে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। কিছু সময় চলে যেতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় আলো।

ওষুধ নিয়ে এসে সামিন দেখে আলো ঘুমিয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ওষুধের বক্সটা বিছানার সাথে লাগোয়া টেবিলে রাখে। তারপর আবারো আলোর মুখের দিকে তাকায়। জ্বরে চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। সামিন মনে মনে নিজেকেই নিজে বলে ওঠে,”কি চাচ্ছো তুমি সামিন ইয়াসার! এই মেয়েটার তেজ কমিয়ে দিতে তোমার দুমিনিট সময় লাগবে না। অথচ তুমি তার সাথে এতো সভ্যতা দেখাচ্ছো। মেয়েটার কাছে নিজেকে ক্লিন রাখার এতো কেনো দায় তোমার। ও তো তোমার স্ত্রী, তোমার সম্পত্তি! জোর করে বিয়ে করেছো, তাহলে এখন কেন এতো ভদ্রতা দেখাচ্ছো!”

***
বন্ধ করে রাখা সিলিং ফ্যানের দিকে অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ইশমাম। তারপর উঠে বসে ল্যাপটপে হাত দেয়। আমেরিকাতে তার বেস্ট ফ্রেন্ড এ্যালেক্স কে একটা মেসেজ লিখতে থাকে সে। ইংরেজীতে লেখা মেসেজটির অর্থ হলো,”ছোটো বেলা থেকে আমি সবসময় ভাইয়ার দামী টি-শার্ট,দামী জুতা,দামী ঘড়ি ভাইয়ার থেকে কেড়ে নিয়েছি এ্যালেক্স, কখনো কখনো বলার প্রয়োজনও বোধ করিনি। ভাইয়ার পছন্দের সব জিনিস আমি পছন্দ করে ফেলতাম। ভাইয়াকে না জানিয়ে সেগুলো নিয়ে নিতাম। ভাইয়া কখনো প্রতিবাদ করতো না এ্যালেক্স। ভাইয়া আমাকে ভালোবাসে তাই প্রতিবাদ করতো না। আমিও ভাইয়াকে ভালোবাসি। আজ ভাইয়া সেই সবকিছুর শোধ একসাথে তুলেছে এ্যালেক্স। আমার পছন্দের মানুষটাকে আমায় না জানিয়ে নিয়ে নিয়েছে ভাইয়া। আমার কি প্রতিবাদ জানানো উচিত এ্যালেক্স?”

মেসেজটা পাঠানোর পাঁচ মিনিটের মধ্যে এ্যালেক্সের নাম্বার থেকে অনবরত ফোন আসতে শুরু করে। ইশমাম ফোনটা রিসিভ করে না। তার ফোন,ল্যাপটপ থেকে অদ্রিতা আলো নামের মেয়েটির সমস্ত স্মৃতি পরম যত্নে মুছে ফেলতে থাকে।

***
রাত তখন সাড়ে নয়টা। আলোর জ্বর কিছুটা কমেছে। সে বিছানায় চুপচাপ বসে আছে।

নিচে হাসাহাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। অনেকদিন পরে ভাই-বোন সব এক হয়ে খাবার টেবিলে বসে খাচ্ছে। ইশমাম চুপচাপ মাথা নিচু করে খাবার নাড়াচাড়া করছে। ইলহাম ইশমামের দিকে তাকিয়ে বলে,”পাখির মতো খুটছিস কেনো? সমস্যা কোথায়? সারাদিন রুমে ম’ট’কা মেরে পরেছিলি। বাংলাদেশ ভালো লাগছে না?”

ইশমাম কিছু বলে না। সামিন কিছুক্ষণ পরে বলে ওঠে,”ঠিকাছে। খেতে না চাইলে ঘরে গিয়ে ঘুম দে। রাতের গভীর ঘুমটা এখন প্রয়োজন তোর।”

ইশমাম সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায়। তারপর দোতলায় উঠে যায়। সামিনের খাওয়া হয়ে গেলে সিতারার দিকে তাকিয়ে আলোর কথা জিজ্ঞেস করে,”খেয়েছে? ”
সিতারা শুকনো মুখে বলে,”না খাবার,না ওষুধ। কিছু ছুঁয়ে দেখেনি ভাইজান।”

সামিন উঠে দাঁড়ায়।

আলো বিছানা থেকে নেমে ঘর থেকে বের হয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে যায়। ইশমাম নিজের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মুখোমুখি দুটো ঘর। আলো ইশমামের দিকে তাকায়। ইশমামের দৃষ্টি সে পড়তে পারছে না আজ‌ । তার মুখ ভাবলেশহীন।

“এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো!”
পি’শা’চ কন্ঠ শুনে আলো ইয়াসারের দিকে তাকায়। সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে,”খাবার খাওনি, ওষুধ খাওনি কেনো?”

আলো কিছু বলে না। সামিন তখনো ইশমামকে দেখতে পায়নি,তার সম্পূর্ণ মনোযোগ আলোর দিকে ছিলো। আলোর নীরবতা দেখে সামিন আলোর হাত ধরে ঘরে ঢুকায়। তারপর ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। ইশমাম একদৃষ্টে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।

ল্যাপটপের সামনে বসে এ্যালেক্সকে একটি মেসেজ লেখে,”ভাইয়ার ওপর রাগ করার আগে আমি মরতে চাই এ্যালেক্স। আমি ঐ মানুষটার ওপর রাগ করতে পারবো না কিছুতেই।”

মেসেজটি দেখতে পেয়ে এ্যালেক্স আবারো ভিডিও কনফারেন্সে ফোন দিতে শুরু করে। ইশমাম মেসেজটি ডিলিট করে ল্যাপটপটা বন্ধ করে দেয়।
***
খাবারের প্লেটটা আলোর সামনে রেখে ধমকের সুরে বলে,”খাও। খাও বলছি।”

আলো মেঝের দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। সামিন বলে,”সব কিছু জোর না করলে হবে না দেখছি!”

_ওই একটা জিনিসই তো আপনি করতে জানেন। জো’র। কা’পু’রু’ষ কোথাকার।

আলোর মুখে কা’পু’রু’ষ শব্দটা শুনে সামিন আলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর খাবারের প্লেট টা টেবিলে রেখে ঢাকা দিয়ে ডিভানে গিয়ে শুয়ে পরে। না খেলে না খাক। কেউ যদি স্বেচ্ছায় নিজের মন্দ করতে চায় তাহলে তার কি। যথেষ্ট মানবিকতা দেখিয়েছে সামিন। এখন কি পা ধরে খাওয়াবে নাকি!
আলো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বিছানায় গিয়ে বসে পরে। দীর্ঘসময় অতিবাহিত হয়। সামিন তখনো ঘুমায়নি। সে ওদিকে ফিরে আলোর কর্মকাণ্ড বোঝার চেষ্টা করছে। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে একবার ঘুরে তাকায় সে। আলো চুপচাপ বসে আছে। সামিন কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক তখনই দরজায় ধাক্কা দেয় ইশিতা। জোরে জোরে চেঁচাতে থাকে সে। সামিন উঠে দরজা খুলে দেয়। ইশিতা কাঁপা কাঁপা গলায় আর্তনাদ করে বলে ওঠে,”ইশমাম স্লিপিং পিলস খেয়ে নিয়েছে ভাইয়া !”

#চলমান…..

#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_১৬
#Esrat_Ety

ইশিতার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সামিন। বোনের আ’ত’ঙ্কি’ত মুখ দেখে তার ভেতরটা কেঁ’পে উঠলো যেন! রুদ্ধশ্বাসে ছুটে গেলো ইশমামের ঘরে। ইশিতা ভাইয়ের পিছু পিছু ছুটে গেলো। আলো বিছানার উপর পাথর হয়ে বসে আছে। তার দৃষ্টি দরজার বাইরে।
ইশমাম বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। বিড়বিড় করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। ইলহাম ওকে ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করছে। রিতু ভীত চোখে তাকিয়ে আছে ইশমামের দিকে।

সামিন গিয়ে চেঁচিয়ে বলে ওঠে,”কি হয়েছে! ছোটোর কি হয়েছে!”
ইলহাম আ’ত’ঙ্কি’ত কন্ঠে বলে বারোটা পিলের বারোটাই খেয়ে নিয়েছে ভাইয়া।”
সামিন গিয়ে ইশমামকে ধরে ফেলে। পিটপিট করে ভাইয়ের দিকে তাকানোর চেষ্টা করছে ইশমাম,চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে,তাই পারছে না তাকাতে। সামিন আঁ’ত’কে ওঠে,”এ্যা’ম্বু’লে’ন্স ডাক। কুইক।”
_আমি ঠিক আছি ভাইয়া,আই এ্যাম টোটালি ফাইন!
ঘোরের মধ্যে বিড়বিড় করতে থাকে ইশমাম।

ইশিতা চেঁচাতে থাকে,”কোন দুঃখে এটা করলি গ’র্দ’ভ! জবাব দে!”

_শাট আপ ইশু! চারটা খেয়েছি মাত্র। এক চ’ড় মারবো তোকে….

ইশমাম কথাটি শেষ করতে না করতেই সামিন সজোরে একটা চ’ড় মারে ইশমামের গালে। তাল সামলাতে না পেরে বিছানার ওপর গিয়ে পরে সে। সামিন রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”ওকে বমি করাতে হবে।লবণ গোলা পানি নিয়ে এসো রিতু। তাড়াতাড়ি।”

_ভাইয়া স্টপ। প্লিজ যাও তোমরা।
বিড়বিড় করতে থাকে ইশমাম।

রিতু নিচে ছুটে যায়। ইলহাম ঘুমের ঔষধের পাতাটা সামিনের হাতে দিয়ে বলে,”দেখো। হাই পাওয়ারের। বারোটার বারোটাই গিলেছে।”

_সত্যি বলছি ভাইয়া, চারটা খেয়েছি।
বিছানায় উপুড় হয়ে পরে থাকা ইশমাম অস্ফুট স্বরে বলে।

রিতু লবণ গোলা পানি এনে সামিনের হাতে দেয়। সামিন ইলহামের দিকে তাকিয়ে বলে,”ওকে ধর শক্ত করে তোরা।”

ইশিতা আর ইলহাম ইশমামকে শক্ত করে ধরে রাখে। ইশমাম পিটপিট করে তাকাচ্ছে সামিনের দিকে। সামিন ইশমামের থুতনি ধরে জোরপূর্বক লবণ গোলা পানিটা ইশমামকে গেলাতে থাকে। কিছুক্ষণ যেতেই হড় হড় করে বমি করে দেয় ইশমাম। সামিন একটু সময় নিয়ে আবারো লবণ পানি খাইয়ে দেয় ইশমামকে। বমি করে ইশমাম পেটে যা ছিলো সব বের করে দেয়। ইশিতা আর ইলহাম ভাইকে শক্ত করে ধরে রেখেছে।
পুরোটা উগরে দিয়ে ইশমাম পুরোপুরি ভাবে নিস্তেজ হয়ে পরে। রিতু পানি এনে সামিনের হাতে দেয়। সামিন ইশমামের চোখে মুখে পানি ছেটাতে থাকে।

আলো ধীরপায়ে হেটে ইশমামের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
সামিন একটা চেয়ার টেনে ইশমামের সামনে বসে, ভাইয়ের দুই বাহু ধরে ঝাকুনি দিয়ে বলে,”কয়টা খেয়েছিস! বল !”
_কসম ভাইয়া। চারটাই খেয়েছি।

এখনো ঘোর কাটেনি ইশমামের। সামিন ধমক দিয়ে বলে,”পুরো পাতা খালি কেনো? বল।”
_এগুলো আমি রেগুলার নেই ভাইয়া,ডাক্তারের পরামর্শে। আগেই খেয়েছি বাকি আটটা। সত্যি বলছি ভাইয়া!

_চারটা কেনো খেতে গেলি? চারটা খাওয়ার কি প্রয়োজন ? বল। কোন মেয়ের জন্য খেয়েছিস!

ইশমাম বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে বলে,”কি শুরু করেছো ভাইয়া। প্লিজ যাও এখান থেকে ভাইয়া। ঘুম আসছিলো না তাই খেয়েছি। এবার যাও।”

সামিন দ্বিতীয় বারের মতো ভাইয়ের গালে এক চ’ড় বসিয়ে দেয়।
ইশমাম গালে হাত দিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকায়। সামিন গর্জে ওঠে,”আমাকে বোকা পেয়েছিস? আমি কিছু বুঝি না তাইনা? সারাদিন আমি তোকে লক্ষ্য করেছি। দেবদাস হয়েছিস তুই! দেবদাস! অ’প’দা’র্থ কোথাকার!”

_ভাইয়া প্লিজ স্টপ। এসব কিছুই না!

সামিন চেঁচিয়ে বলে ওঠে,”হুট করে দেশে আসা, সারাদিন মনমরা হয়ে থাকা, ঘুমের ঔষধ নেওয়া। আবার বলছিস কোনো মেয়ের জন্য না এসব? আমি ব’ল’দ? ব’ল’দ তোর ভাই?”

ইশমাম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন নরম হয়ে যায়। কাতর কন্ঠে বলে ওঠে,”সামান্য একটা মেয়ের জন্য এরকম একটা স্টেপ নিয়েছিস। একবারও আমাদের কথা ভাবলি না তুই? কোন মেয়ে বল! কোথাকার মেয়ে! বিদেশী নাকি এদেশীয়? তুই আমায় নাম ঠিকানা দে। আমি ঐ মেয়েকে তোর পায়ের কাছে এনে রাখবো। তুই এক্ষুনি নাম বল।”

আলো দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সামিনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁট জোড়া তার তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে ঐ পি’শা’চ’টা’র কথা শুনে। ইশমাম ভাইয়ের চোখের দিকে তাকায়, মনে মনে বলে ওঠে,”কাকে পায়ের কাছে এনে রাখবে তুমি ভাইয়া। তুমি তো তাকে নিজে বুকে টেনে নিয়েছো!”

সামিন নরম গলায় বলে,”আমার ভাই, সামিন ইয়াসারের ভাই এতো সহজে হার মেনে নিয়েছে? বাবা ঠিকই বলে,তুই একটা অ’প’দা’র্থ।”

ইশমাম ম্লান হাসে। নিচু স্বরে বলে,”ঠিকই বলেছো ভাইয়া। আমি তাই।”

সামিন ইশিতার দিকে তাকিয়ে বলে,”কিভাবে টের পেলি ও এই অকাজ করেছে?”
_ওর ফোনটা খাবার টেবিলে ফেলে রেখে এসেছিলো। আমেরিকা থেকে এ্যালেক্স নামের ওর কোনো বন্ধু অনবরত ফোন দিচ্ছিলো। ফোনটা রিসিভ করতেই সে বলে ইশমাম নাকি সু’ই’সা’ই’ড করার চেষ্টা করছে, ওকে আটকাতে হবে। আমি আর মেজো ভাইয়া ছুটে এলাম। দেরী না করে ডুপ্লিকেইট চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেখি ম’রা’র মতো পরে আছে গাধাটা।”
সামিন ইশমামের দিকে তাকায়, দাঁতে দাঁত চেপে বলে,”এতো দূর? এতো দূর? কোথাকার কোন এ্যালেক্স টের পেলো তোর কষ্ট আর আমরা ভেসে এসেছি? আমাদের বলা যেতো না?”
ইশমাম মাথা নিচু করে রাখে। সামিন গম্ভীর কন্ঠে ইশিতাকে বলে,
“ওর ব্যাগ, জিনিস পত্র সার্চ কর‌ । আরো স্লিপিং পিলস আছে নাকি দেখ। বাজেয়াপ্ত কর সব।”

ইশিতা মাথা নাড়িয়ে ইশমামের লাগেজ খোলে। ইশমাম বলে,”স্টপ ভাইয়া। অনেক গোয়েন্দাগিরি করেছো। ট্রাস্ট মি, আমি সু’ই’সা’ই’ড করতে চাইনি, এ্যালেক্স একটু পাগল। আর ওষুধ নিয়ে গেলে কি হবে? সুইসাইড করতে চাইলে তো সিলিংয়ের সাথে ঝুলে পরতে পারি। হাতের শি’রা কা’ট’তে পারি।”

সামিন ইশমামের দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করে ইশমামের চোখে পরে যায় আলো। আলো নিজেকে গুটিয়ে নেয়। ইশমাম ঠান্ডা গলায় তার ভাইকে বলে,”এখন প্লিজ তোমরা যাও। তুমি যাও ভাইয়া। বড় ভাবী বিরক্ত হচ্ছে। ভাবীকে নিয়ে ঘরে যাও। আই এ্যাম টোটালি ফাইন।”

সামিন মাথা ঘুরিয়ে আলোকে দেখে। তারপর ইশমামের দিকে তাকিয়ে বলে,”মেয়েটা কে বলবি না তো?”

ইশমাম কঠিন গলায় বলে,”না।”
_বেশ। আমি বের করে নেবো। তারপর ঘা’র ধরে আমার ভাইয়ের পায়ে এনে ফেলবো। কতবড় সাহস! আমার ভাইকে কষ্ট দেয়!

ইশমাম মাথা নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসে‌ । ইশিতা আরো দুই পাতা ঘুমের ঔষধ খুঁজে বের করে এনে সামিনের হাতে দেয়। সামিন ওষুধ গুলো নিতে নিতে ঠান্ডা গলায় বলে,”এগুলো আমি নিয়ে যাচ্ছি। ঘুম না পেলে না ঘুমিয়ে থাক। দরকার নেই ঘুমের।”

সামিন হনহন করে বেরিয়ে যেতে নেয়। আলোর সামনে এসে থ’ম’কে দাঁড়িয়ে আলোর দিকে তাকায়। আলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে। ইশিতা এসে বলে,”জ্বর সেরেছে আলো? শরীর ঠিক আছে তোমার?”
আলো মাথা নাড়িয়ে সামিনের ঘরের দিকে যায়। সামিন ইশমামের দিকে আরো একবার তাকিয়ে বলে,”ফ্রেশ হয়ে চুপচাপ শুয়ে থাক। সকালে কথা হবে।”

***
ঘরে ঢুকে সোজা গিয়ে ডিভানে গা এলিয়ে দেয় সামিন। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। কাল কিছু ইম্পরট্যান্ট কাজ রয়েছে। এখন একটু ঘুমিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। দু’চোখ বন্ধ করার আগে আলোর দিকে একবার তাকায় সে। থমথমে মুখ নিয়ে বিছানায় বসে আছে চুপচাপ। সামিন আনমনে হেসে ফেলে, গুটিসুটি মেরে বসে থাকার কোনো প্রতিযোগিতা হলে এই মেয়ে ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করতো। মায়ের গর্ভে শিশুরা যেভাবে হাত পা গুটিয়ে রাখে। এই মেয়েটাও সেভাবেই বসে থাকে। সামিন বেশ অবাক হয়, সাইজে ছোটো খাটো একটা মেয়ে। তুলে একটা আছাড় মারা যায়, কোলে তুললে মনে হয় একটা শিমুল তুলার বালিশের সমান ওজন, সেই মেয়ের তেজ কত ! আবার সেই মেয়ে সামিনকে প্রানে মারারও হুমকি দেয়। কারন সে কারাতে জানে, তাই সে বিশ্বাস করে নিজে একটা বালিশ হয়ে ছিয়াত্তর কেজি ওজনের ইয়াসার মির্জাকে ঘায়েল করবে। কতটা আত্মবিশ্বাসী এই মেয়ে!
***
ইট পাথরের শহরের শেষ রাত জাগা পাখিটাও যখন ঘুম ঘুম চোখে ঢুলছে। তখন আলো জেগে। এতক্ষণ শুয়ে ছিলো,এখন উঠে বসে আছে সে। মাথা ঘুরিয়ে ডিভানে ঘুমিয়ে থাকা সামিনের দিকে তাকাতেই কপাল কুঁচকে ফেলে। এবার দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে পেরেছে সে। যে লোকটা নিজে একটা ক্রি’মি’না’ল,যার মেজো ভাই শ্লীলতাহানির মামলার আ’সা’মী তাদের ছোটো ভাই তো ঠ’ক , ধান্দাবাজ হবেই!
একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায় আলোর ভেতর থেকে! সারাজীবন ছেলেদের এক হাত দেখে নেওয়া চালাক চতুর উপাধি পাওয়া মেয়েটা কি না পরেছিলো একটা ঠকবাজের পাল্লায়! দেখে নেবে, সব ক’টাকে আলো দেখে নেবে!
আগুন জ্বলে ওঠে আলোর চোখে মুখে। আবার নিমিষেই তা নিভে গিয়ে মুখ মলিন হয়ে যায়। পেটে হাত চেপে বসে থাকে সে ‌। প্রচন্ড খিদেয় তার পেটে ব্যাথা হতে শুরু করেছে। চোখে ঝাপসা দেখছে। জ্বর নেই আপাতত গায়ে,তাই খিদেটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বেশ‌। আলো কিছুক্ষণ বসে থেকে আর টিকতে পারলো না। মাথা ঘুরিয়ে দেখে টেবিলের উপর প্লেটটা এখনো ঢাকা দিয়ে রাখা আছে। হাত বাড়িয়ে প্লেট টা নিয়ে ঢাকনাটা সরাতেই একটা বাজে গন্ধ আলোর নাকে লাগে ‌‌। প্লেটে ভাত, মাংস এবং পাতলা ডাল দেয়া হয়েছিলো। দীর্ঘসময় অতিবাহিত হওয়ায় সেটা বাসি হতে শুরু করেছে। প্লেট টা ঢেকে আবারো টেবিলের উপরে রাখে। হঠাৎ করে মায়ের কথা মনে পরে আলোর। মা কখনোই আলোকে না খেয়ে রাতে ঘুমাতে দিতো না। কখনোই না। চোখ দিয়ে দুফোঁটা তরল গড়িয়ে পরতেই আলো সাথে সাথে তা মুছে সামিনের দিকে তাকায়। অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”দা’ন’ব একটা।”
গা থেকে চাদর সরিয়ে নেমে পরে আলো। পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে সন্তর্পণে দরজার সিটকিনি খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ধীরপায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে লিভিং রুম পেরিয়ে ডাইনিং রুমের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরে। এদিক ওদিক তাকিয়ে ফ্রিজের কাছে এগিয়ে গিয়ে ফ্রিজের দরজা খোলে। তেমন কোনো খাবার নেই ফ্রিজে। আছে কিছু শুকনো ভাত এবং কিছু ফল। এই মুহূর্তে আলোর ভাতের খিদে পেয়েছে তাই ভাতের বাটিটা ফ্রিজ থেকে বের করে নেয় সে। জীবনে কখনো আলো তরকারি ছাড়া শুধু ভাত খেয়ে দেখেনি, সামিন ইয়াসারের জন্য আজ সেই সৌভাগ্য তার হয়েছে। ভাত টা ঠান্ডা হয়ে আছে। কিন্তু কি আর করা,এটাই গিলতে হবে।

এদিক ওদিক না তাকিয়ে বাটিটা টেবিলে রেখে একটা চেয়ার টেনে বসে পরে সে। লবন মেখে ভাতের লোকমা তুলে মুখে দিতেই কপাল কুঁচকে ফেলে আলো। ঠান্ডা, শুকনো ভাত, পেটের ভেতর যেতে চাইছে না তবুও অনেক কষ্টে গিলে ফেলে। শুকনো ভাত তাই দ্রুত খেতে গিয়ে গলায় আটকে যায় হঠাৎ, কাশতে কাশতে আলো টেবিলের উপর দেখতে থাকে, গ্লাসের পানি শেষ। কোথাও পানির জগ দেখতে পাচ্ছে না সে। হঠাৎ করে কেউ তার সামনে একটা পানির গ্লাস রাখলো। আলো চ’ম’কে উঠে পেছনে তাকায়। সামিন তার দিকে তাকিয়ে আছে। আলো উঠে দাঁড়িয়ে যায়। সামিন ঠান্ডা গলায় বলে,”খেতে বসার আগে সাথে পর্যাপ্ত পানি নিতে হয়।”

সামিনকে এভাবে দেখেই আলোর কাশি থেমে গিয়েছে। সামিন আলোর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে ভাতের বাটিটার দিকে তাকায়। মৃদু স্বরে বলে,”সরাসরি বাটিতেই খাওয়া শুরু করে দিয়েছো! একটা প্লেটে তুলে নিতে!”

আলো কি বলবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। এভাবে এই লোকটার হাতে ধরা পরে তার লজ্জায় মাটির ভেতরে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে।

_আমি ভেবেছিলাম পালাচ্ছো। দ্রতপায়ে সিঁড়ি ভেঙে দেখি তুমি এখানে উদরপূর্তি করছো।

আলো চলে যাওয়া ধরলে সামিন তার হাত টেনে ধরে। আলো এক ঝটকায় সামিনের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। সামিন বলে ওঠে,”শুধু ভাত খাচ্ছিলে কেনো? কাউকে ডেকে তুলতে।”

আলো কোনো কথা বলে না। সামিন বলতে থাকে,”সামিন ইয়াসার মির্জা প্রতি মাসে অসংখ্য দুঃস্থ পরিবারের বাজার করে দেয় । আর এখানে তার স্ত্রী জে’দ দেখিয়ে না খেয়ে পরে এসে চুরি করে শুকনো ভাত খায়। তরকারি ফ্রিজেই রাখা। একটু খুঁজলেই পেয়ে যেতে।”

_একদম আমাকে স্ত্রী বলবেন না। অবৈধ বিয়ে ওটা। আমি আপনার স্ত্রী নই।
আলো তেতে ওঠে। সামিন আলোর দিকে এক কদম এগিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”বলবো আমি। কি করবে তুমি? কি ক্ষমতা তোমার? শোনো তাহলে বলছি, তুমি আমার স্ত্রী, তুমি আমার স্ত্রী,তুমি আমার স্ত্রী, তোমার বাপ আমার শশুর,তোমার মা আমার শাশুড়ি, তোমার ভাইয়েরা আমার শা’লা। তুমি আমার স্ত্রী।”

কথাগুলো উচ্চারণ করে সামিন এক মুহুর্ত থামে। তারপর কন্ঠে বিদ্রুপ নিয়ে বলে,”এই যে বললাম। কি করবে তুমি? করো তো দেখি! কারাতে করবে? কুংফু কারাতে?”

আলো হুট করে একদলা থুতু ছুড়ে মারে সামিনে গায়ে। সামিনের গলার কাছটায় লেগেছে । সামিন সাথে সাথে কপাল কুঁচকে ফেলে। আলো তার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে। সামিন দাঁতে দাঁত চেপে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে আলোকে হতভম্ব করে দিয়ে তার শাড়ীর আঁচল ধরে। আলো শি’উ’রে ওঠে। সামিন আলোর আঁচল দিয়ে নিজের গলার কাছটা পরিষ্কার করতে করতে বলে,”তুমি একটা উন্মাদ মেয়ে আলো।”

আলো নিজের আঁচল সামিনের থেকে টেনে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,”আর আপনি একটা জা’নো’য়া’র।”

সামিন আলোর দিকে তাকায়। তেজী কন্ঠে বলে,”জ্বর চলে গিয়েছে? তোমার জ্বর তোমার তেজের মতো আলো। হুট করে আসে আবার হুট করে মিইয়ে যায়।”

আলো কিছু বলে না। সামিন বলতে থাকে,”উদরপূর্তি হয়ে গেলে ঘরে চলো। আমি রাত জেগে তোমাকে এখানে বসে পাহারা দিতে পারবো না।”

***
শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়েছিলো আলো। তাই আজ অনেকটা দেরী করে উঠেছে। পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে বেশ কাহিল লাগছে নিজেকে। শরীর এখনো খুব ক্লান্ত। ধীরে ধীরে উঠে বসে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে পি’শা’চ’টা ঘরে নেই। জানালা থেকে তেজী রোদ আলোর নরম ত্বক পু’ড়ি’য়ে দিতে চাইছে। দুহাতে গাল ঢেকে কপাল কুঁচকে আলো বসে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বিছানা থেকে নেমে সোজা ওয়াশ রুমে চলে যায়। মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে ওয়াশরুমের আয়নায় নিজের চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকে সে‌। আলোর গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা। কিন্তু আজ তাকে আরো অনেকটা বেশী উজ্জ্বল লাগছে। সারাদিন বন্দীশালায় আ’ট’কে থাকে সে,তাকে সূর্যের বেগুনী রশ্মি ছুতে পারে কই! মাত্র ক’দিনেই গায়ের রং এতোটা বদলে গিয়েছে! হাত বাড়িয়ে তার টুথব্রাশ তুলে নিতেই চোখে পরে সামিন ইয়াসারের টুথব্রাশ। নিজে যেমন দানব আকৃতির তেমনি তার টুথব্রাশ টাও দানব আকৃতির। আলোর ইচ্ছে করছে টুথব্রাশ টাকে ওয়াশ রুমের কমোডের মধ্যে চুবিয়ে রেখে দিতে। ঐ লোকটার জন্য এর চেয়ে ভালো আপ্যায়ন আলোর জানা নেই। নিজের ইচ্ছেকে দমিয়ে ফেলে হাত মুখ ধুয়ে আলো বের হয়ে যায় ওয়াশ রুম থেকে। হেটে সোজা ঘর থেকে বের হয়ে দোতলার লিভিং রুমের কাছে যেতেই দাঁড়িয়ে পরে আলো। ইশমাম দাঁড়িয়ে আছে। আলো নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ইশমামকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে ইশমাম মৃদু স্বরে বলে,”অদ্রিতা।”

***
সামিনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আতাউর আলম দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়। সামিন ভেতরে ঢোকে। সামিনের পিছু পিছু কয়েকজন লোক ব্যাগ হাতে ঢোকে। বসার ঘরের একপাশে ব্যাগ গুলো রেখে তারা চলে যায়। রেহেনা ধীরপায়ে বসার ঘরের দিকে এসে থমকে দাঁড়ায়। চোখ মুখ আ’ত’ঙ্কে ছেয়ে যায় তার।

আতাউর আলম নিচু স্বরে কিন্তু কন্ঠে ঘৃণা নিয়ে বলে,”এগুলো কি!”

সামিন সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে বলে,”প্রথম বার শশুর বাড়িতে এসেছি। খালি হাতে তো আসা যায় না। আমি সামিন ইয়াসার মির্জা!”

রেহেনা ব্যাকুল কন্ঠে বলে,”বাবা আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দাও। আমরা কোনো থানাপুলিশ করিনি। কাউকে কিছু বলিনি। তুমি নির্বাচনেও জিতে গিয়েছো। এবার অন্তত আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দাও। কথা দিচ্ছি আমরা সব ছেড়ে ছুড়ে অনেক দূরে চলে যাবো ‌”

সামিন রেহেনার দিকে তাকিয়ে বলে,”কাউকে কিছু বলেন নি ভালো করেছেন, আমার বাবা চেন্নাই থেকে আসলে বড় সর রিসিপশন অনুষ্ঠান করে আমিই সবাইকে জানিয়ে দেবো আমি বিয়ে করেছি। আর আপনার মেয়েকে ছেড়ে দেওয়ার কথা যদি বলেন তাহলে বলবো,সামিন ইয়াসার একবার যে জিনিসটা নিজের নামে করে নেয় সেটা সে হাত ছাড়া করে না।”

রেহেনা ভেজা চোখে তাকিয়ে আছে সামিনের দিকে। আতাউর আলম বলে,”কি চাইছো তুমি ইয়াসার। আর কি চাইছো? মেয়েটাকে অন্তত একটু কথা বলতে দাও আমাদের সাথে।”

_দেবো। জামিলের জ্ঞান ফিরুক। একেবারে নেমন্তন্ন করে নিয়ে যাবো আপনাদের আমার বাড়িতে। মেয়েকে প্রান ভরে দেখে আসবেন।

আতাউর আলম অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ইয়াসারের দিকে, বলে,”জামিলের সাথে আমার কি সম্পর্ক?”
_কু’পি’য়ে’ছে’ন আবার বলছেন কি সম্পর্ক!

_কেন এক কথা বারবার বলছো ইয়াসার। আমি তো বলেছি এসবে আমি জরিত নই। থানায় হুমকি টা আমি এমনিই দিয়েছিলাম,রাগের মাথায়। কোনো উদ্দেশ্য ছিলো না আমার!

ইয়াসার তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে, তারপর বলে,”হেনা। জামিলের স্ত্রী। আপনার মেয়ের বয়সী। সাত মাসের গর্ভবতী। আপনার লোক তার সামনেই তার স্বামিকে কু’পি’য়ে’ছে। আচ্ছা এতো ভং ধরে থাকেন কিভাবে আপনি? মানুষের সামনে ইনোসেন্ট ফেইস নিয়ে ঘুরে বেড়ান,সিম্প্যাথি নেন তাদের!”

আতাউর থমথমে মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে ইয়াসারের দিকে। ইয়াসার বলে,”আজ উঠি। মেয়ের জন্য চিন্তা করবেন না। সে ভালো আছে। অবশ্য তার ভালো থাকা আপনাদের উপর নির্ভর করছে। চুপচাপ থাকুন এবং জামিলের জন্য দোয়া করতে থাকুন,যদি মেয়ের সাথে কথা বলতে চান তো!”

***
আলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ইশমাম নিচুস্বরে বলে,”সামনা সামনি তুমি বেশি সুন্দর অদ্রিতা!”
আলো অগ্নি দৃষ্টি দিয়ে ইশমামের দিকে তাকায়,কন্ঠে ঝাঁঝ নিয়ে বলে,”আমি তোমার ভাইয়ের স্ত্রী ইশমাম। তোমার ভাবী হই।”

ইশমাম হেসে ফেলে, ঠান্ডা গলায় বলে,”আমি ভাবীকেই বলেছি কথাটা। ছোটো দেবর তোমার। একটু মশকরা করলাম!”

আলো কপাল কুঁচকে চলে যেতে নেয়। ইশমাম বলে,”ভাইয়া তোমাকে তুলে এনে বিয়ে করেছে?”

আলো দাঁড়িয়ে পরে। ইশমাম বলে,” ভাইয়াকে আমি ছোটো থেকে দেখছি। এতোটা প্রতিশোধ পরায়ণ ছিলো না সে। তোমার ঐ একটা চ’ড় তাকে এলোমেলো করে দিয়েছিলো।”

আলো শীতল চোখে ইশমামের দিকে তাকায়। কন্ঠে বিদ্রুপ নিয়ে বলে,”কাল রাতে কি নাটক করেছিলে ওটা? কেনো বলে দিচ্ছো না নিজের ভাইয়াকে সব। সাহস নেই তাই না? বলে দাও সবটা, তারপর দুই ভাই সাপ আর বেজি হয়ে কা’ম’ড়া কা’ম’ড়ি করে ম’রে যাও। এটাই আমি চাই।”

ইশমাম ম্লান হাসে, নরম সুরে বলে,”সেটা কখনো হবে না অদ্রিতা। আমি ভাইয়ার জন্য নিজের জীবন দিতে পারি। তুমি তো আমার জীবনের মাত্র একটা অংশ ছিলে। ভাইয়া যখন ধরে নিয়েছে তুমি তার। তার মানে তুমি তার।”

আলো দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে থাকে। ইশমাম বলে,”মায়ের পরে পৃথিবীতে আমি ভাইয়াকে বেশি ভালোবাসি। সেই ভালোবাসার কাছে সবকিছু তুচ্ছ।”

_তোমরা সবাই এক। সবাই জ’ঘ’ন্য। তোমরা ই’ব’লি’শের বিশেষায়িত বংশ। তোমাদের নাম রাখা ভুল হয়েছে। তোমাদের নামের পাশে ই’ব’লি’শ শব্দটা এফিডেভিট করে বসিয়ে নেবে।

“ইন্তেখাব ই’ব’লি’শ”
“ইমতিয়াজ ই’ব’লি’শ”
“ইশতিয়াক ই’ব’লি’শ”
“ইয়াসার ই’ব’লি’শ”
“ইলহাম ই’ব’লি’শ”
“ইশমাম ই’ব’লি’শ”

আলো কন্ঠে তেজ নিয়ে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করে শব্দগুলো। ইশমাম আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে আলোর চোখে তাদের পরিবারের প্রতি ঘৃণার পরিমাণ দেখতে থাকে।

#চলমান….

#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_১৭
#Esrat_Ety

“টিচার আপনার চশমাটা আমি একটু পরি?”
শান্ত ইহানকে কোলে নিয়ে বসে আছে। প্রায় আধাঘণ্টা ধরে সে ইহানকে “Z ফর Zebra” শেখানোর চেষ্টা করছে কিন্তু ইহান পড়া রেখে দু’ষ্টু’মি’তে মেতে আছে। কখনো শান্তর চশমা ধরে টা’ন’ছে, কখনো মোবাইল ধরে। শান্তর ধৈর্য্যর সী’মা পেরিয়ে যাচ্ছে। এতো ছোটো বাচ্চাকে ব’শে আনা মু’শ’কি’ল। সে এই ক’দিনেই হি’ম’শি’ম খাচ্ছে।
দরজা ঠেলে ইশিতা মাথা বাড়িয়ে বলে,”আসতে পারি!”

শান্ত গ’ম্ভী’র কন্ঠে বলে,”আসুন।”
ইশিতা ঘরে ঢুকে ইহানের দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি তোমার টিচারের কোলে উঠে বসে আছো কেনো!”

ইহান কোনো কথা বলে না। শান্ত বলে,”আমি বসিয়েছি। হাতে ধরে লিখিয়ে দিতে হয়।”

_ও।
একশব্দে শান্তকে বলে ইশিতা ইহানের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমার ঘর থেকে আমার হেডফোন নিয়েছো তুমি?”
ইহান মাথা নাড়ায়।
_কোথায় রেখেছো?
_পাপার ল্যাপটপের কাছে।

ইশিতা ঘুরে দাঁড়ায়। শান্ত আদুরে কন্ঠে ইহানকে বলতে থাকে,”প্লিজ ইহান বাবু। এবার একটু লেখো!”
ইশিতা দাঁড়িয়ে পরে, শান্তর দিকে তাকায়। তারপর বলে,”পাব্লিক ভার্সিটির এক্স স্টুডেন্ট। কিন্ডারগার্টেনের বাচ্চা কেনো পড়াচ্ছেন?”

_চাকরির বাজার মন্দা। আপাতত কিছু টিউশনি দরকার ছিলো। ভাগ্যক্রমে আপনাদের বাড়িতে জুটে গেলো। ছোটো বাচ্চা,চাপ কম। আমি চাকরির পড়া পড়ারও সময় পাচ্ছি। আপনারা বড়লোক, মাস শেষে টাকা দেওয়া নিয়ে গাইগুই করবেন না আর তাছাড়া বেশ ভালো এমাউন্ট দিচ্ছেন। তাই পড়াচ্ছি। এই মুহূর্তে টাকার খুব প্রয়োজন আমার।

সোজাসাপ্টা উত্তর দেয় শান্ত। ইশিতা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঠান্ডা গলায় বলে,”বাব্বাহ! এতো বেনিফিট? আর আমাদের বাড়িতে প্রতিদিন খুব ভালো ভালো নাস্তা দেওয়া হয় আপনাকে‌। এটা বললেন না? এটাও বলুন।”

শান্ত ইশিতার চোখের দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে বলে,”হ্যা। সেটাও।”

ইশিতা বলে,”আচ্ছা। বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত ‌। আপনি আপনার ছাত্রকে পড়ান।”

***
কাজ শেষ করে হসপিটালে গিয়েছিলো,সেখান থেকে সামিন সোজা বাড়িতে আসে। গাড়ি থেকে নেমে কিছুক্ষণ বাগানের দিকে তাকিয়ে থেকে বাড়ির ভেতর চলে যায়। সূর্যের তাপটা প্রখর আজ। পাঞ্জাবির বুকের কাছটা ভিজে গিয়েছে ঘেমে। ইহান বড় বাবাকে দেখে ছুটে এলে ইহানকে কোলে তুলে নেয়না সামিন। আদুরে কন্ঠে বলে,”হসপিটাল থেকে এসেছি। জী’বা’ণু গায়ে বাবা। এখন না।”

ইহান দাঁড়িয়ে পরে। সামিন বলে,”আমি ফ্রেশ হয়ে নেই আগে? তারপর আমরা খেলবো। তুমি চলো আমার ঘরে।”

ইহান মাথা নাড়ায়। সে যাবে না। সামিন বলে,”কেনো? যাবে না কেনো?”

_তোমার ঘরে ঐ মেয়েটা থাকে, রাগী মেয়েটা, পঁ’চা মেয়েটা।

রিতু ধ’ম’ক দিয়ে বলে,”ইহান। এসব কি বলছো? বড় মা বলো।”
_আমি বলবো না বড় মা। ওই মেয়েটা পঁচা।

সামিন মৃদু হেসে বলে,”ঠিক বলেছো ইহান। ওই মেয়েটা পঁচা। আর আমি কি?”
_তুমি ভালো। আমার সুপার ম্যান।

সামিন হাসতে হাসতে সিঁড়ির দিকে যায়। তারপর ঘুরে রিতুকে জিজ্ঞেস করে,”ইশমাম কোথায়?”
_ভাইয়া নিজের ঘরে।

দোতলায় উঠে সামিন সোজা ইশমামের ঘরে যায়। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বলে,”আসবো ছোটো।”
ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে ইশমাম ভাইয়ের দিকে তাকায়। তারপর বলে,”এসো ভাইয়া। পারমিশন কেনো নিচ্ছো?”

সামিন ম্লান হাসে। বলে,”ভুত নেমেছে ঘার থেকে?”

ইশমাম তার কোনো উত্তর না দিয়ে ল্যাপটপ বন্ধ করতে করতে বলে,”তোমার সাথে আমারো কিছু কথা ছিলো। আমি আমেরিকা ফিরে যেতে চাচ্ছি ভাইয়া। ”
_এসেছিলি কেনো?
_তোমাদের দেখতে। দেখা হয়েছে। আমার ওখানে একটা আলাদা জীবন রয়েছে ভাইয়া।”
_কিসের জীবন? নয়টা-পাচটা অর্গানাইজেশনের পেছনে দৌ’ড় ঝাঁ’প। যায়গায় যায়গায় ঘুরে প্রতিবেদন লেখা। সমাজ সেবা করতে চাইলে তো দেশে বসেই করতে পারিস। এখানে কোনো সংস্থা খোল। আমি আছি।

ইশমাম মৃদু হাসে। সামিন বলে,”তোর জন্য মেয়ে দেখছি। বিয়ে করবি।”
_স্টপ ইট ভাইয়া। তুমি বাড়াবাড়ি করছো।
_আমি কিছু বাড়াবাড়ি করছি না। তুই বাড়াবাড়ি করছিস। একটা মেয়ের জন্য হে’দি’য়ে মরছিস। বারবার বলছি ঠিকানা দে,আমিও দেখতে চাই কোথাকার কোন হুর পরী।

চুপ করে থাকে ইশমাম। সামিন উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”ফুয়াদের সাথে আমি আলোচনা করছি। বাবা দেশে ফিরলেই কথাবার্তা বলবো। ইশুর জন্যও ছেলে দেখছি। আর কোনো কথা শুনতে চাই না আমি।”

ইশমাম বাঁধ সা’ধ’তে চাইলেও সামিন পাত্তা না দিয়ে চলে যায়, ভাইয়া চলে যেতেই ইশমাম একটা গভীর নিঃশ্বাস নেয়।

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে আগে পরিস্থিতি অনুধাবনের চেষ্টা করছে সামিন। কাউকে দেখতে না পেয়ে হাত ঘড়ি টা খুলে আয়নার সামনে রাখতে গিয়ে দেখলো তার ড্রেসিং টেবিলে মেয়েদের সব প্রসাধনী। এগুলো রিতুর কাজ। ঐ মেয়েটার জন্য রেখে গিয়েছে, অবশ্য ঐ তেজী মেয়েটা এসব ছুঁয়েও দেখবে না। সামিন একমনে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর পাঞ্জাবি পাল্টে ফ্রেশ হয়ে টি-শার্ট গায়ে চাপিয়ে বারান্দার দরজার কাছে যেতেই থ’ম’কে দাঁড়ায়। অদ্রিতা আলো নামের মেয়েটা বারান্দায় রেলিং ধরে ওদিকে ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দায় একপাশে তার ভেজা শাড়িটা শুকাতে দিয়েছে। সম্ভবত এই মাত্র গোসল সেরেছে সে। ভেজা চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে রেখেছে। সামিন দীর্ঘসময় আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। অদ্ভুত এক অনুভূতিতে তার মস্তিষ্ক আ’লো’ড়ি’ত হচ্ছে। যে রহস্য সামিন ইয়াসারের কাছে অমিমাংসিত।
তার অবচেতন মন যে হুট করে অদ্রিতা আলো নামের মেয়েটির প্রেমে পরে যেতে চাইলো তা ঘুনাক্ষরেও টের পেলো না পি’শা’চ সামিন ইয়াসার মির্জা।

ফোনের ভাইব্রেশনের শব্দে ফোনের দিকে তাকায় সে। স্ক্রিনে ফুয়াদের নাম্বার দেখে ফোনটা রিসিভ করে। তার দৃষ্টি এখনো আলোর পিঠের দিকে। ওপাশ থেকে ফুয়াদ বলে,”কি করছিস?”

ঘোরের মধ্যে বিড়বিড় করে সামিন বলে ওঠে,”লুকিয়ে লুকিয়ে নিজের বৌকে দেখছি।”

ফুয়াদ কিছু শুনতে না পেয়ে জোরে বলতে থাকে,”হ্যা হ্যালো! কি করছিস।”

সামিনের ঘোর কেটে যায়। গলা খাঁকারি দিয়ে ফুয়াদকে বলে,”কিছু না। বল। কি ব্যাপার।”

সামিনের কন্ঠস্বর শুনে আলো ঘুরে তাকায়।

_জামিলের জ্ঞান ফিরেছে। তুই হসপিটালে আয় তো।

ফুয়াদ ফোন কেটে দিলেও সামিন কানে ফোনটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে আলোর দিকে তাকিয়ে। আলো সামিনকে দেখে কপাল কুঁচকে এগিয়ে আসে। সামিন টের পেলো ঐ মেয়েটা যত এগিয়ে আসছে তার অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। কেমন আলাদা এই অনুভূতি। এতো বছরের জীবনে কোনো মেয়েকে দেখে এতো অস্থিরতা কখনো কাজ করেনি তার ভেতরে। আলো সামিনকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। সামিন কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে কান থেকে ফোনটা নামায়। জামিলের কথা মনে পরতেই তাড়াহুড়ো করে টি-শার্ট বদলে একটা ব্লু-শার্ট চাপিয়ে বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে।

***
“রাগ তো ইয়াসারের উপর দেখানো উচিত। রাগটা আমাদের উপর দেখাচ্ছিস কেনো?”

শমশের ভুঁইয়ার এমন কথায় সাগর তার বাবার দিকে তাকায়। টেবিলের ওপর সজোরে চা’প’ড় মে’রে বলে,”কতবার? কতবার ওর কাছে আমি হারবো বলতে পারেন আব্বা? কতবার? রাজনীতির মাঠে, নির্বাচনে, বিজনেসে। কতবার হারবো? সবকিছু আপনার জন্য হয়েছে। ওকে রাস্তা থেকে সরাতে পারবেন না আমার কাছে বলতেন‌। আমি ব্যাবস্থা নিতাম। এখন লাভটা কি হলো? ভালো লাগছে? ছেলের হেরে যাওয়া মুখ দেখতে ভালো লাগছে?

পাশ থেকে জায়েদ আলী বলে,”ইয়াসারকে মা’র’লে শহর গরম হয়ে যেতো বাবা তাই শমশের ভাই চেষ্টা করেছে অন্য চাল চালতে…..”

সাগর হিংস্র বাঘের মতো জায়েদ আলীর দিকে তাকায়। তারপর হুংকার দিয়ে বলে,”চাল? ওর ওই ডান হাত জামিলের জ্ঞান ফিরলে পিঠে বস্তা বেঁধে তৈয়ার থাকুন আপনারা। আর আব্বা আপনাকে বলছি। ঘোষণা দিয়ে পদ থেকে সরে দাঁড়ান। আগামী পাঁচ বছর দল আমার বুদ্ধি নিয়ে চলবে ‌। ইয়াসারের খুব খারাপ অবস্থা করে ছাড়বো আমি।”

***
করিডোরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। অনেকদিন পরে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। সামিন দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে,”আমি লেইট।”

_হু ভাই, আপনিই তো এখন লেইট থাকবেন। কারন এখন আপনার দিন।

তৌফের কথার মানে বুঝতে পারলো না সামিন‌। তার মস্তিষ্ক জামিলের জ্ঞান ফেরার খুশিতে উত্তেজিত হয়ে আছে। রাহাত তৌফকে খোঁচা মেরে চুপ করিয়ে দেয়। সবুজের দিকে ফিরে সামিন বলে,”কি বলেছে ডাক্তার?”

_জ্ঞান ফিরেছে। কথা বলতে পারছে না এখনো। সেরে উঠবে দ্রুতই। ভেতরে হেনা ভাবী।

কিছু সময় পরে হেনা বের হয়। সামিনের দিকে তাকিয়ে একটা শুকনো হাসি দিয়ে বলে,”কথা বলছে না ভাইয়া।”

_বলবে। অনেক ধৈর্য্য ধরেছো তুমি। আরেকটু ধরো।

সামিন জামিলের কেবিনে ঢোকে। সারা গায়ে ব্যা’ন্ডে’জ জামিলের। মুখে তখনো অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। জামিলের দিকে এগিয়ে যায় সামিন। জামিল পিটপিট করে তাকাচ্ছে।
সামিন বলে,”তোকে তো পুরো মিশরীয় মমিদের মতো লাগছেরে জামিল। চল তোকে পিরামিডের ভেতর রেখে দিয়ে আসি।”

জামিল তার ইয়াসার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁট দিয়ে না পারলেও চোখ দিয়ে হাসতে চাইলো যেন। ইয়াসার এগিয়ে জামিলের মাথায় হাত রাখে। নরম গলায় বলে,”আমার সব ঝামেলা নিজের মাথায় নিতি, এবার সব য’ন্ত্র’না নিজের শরীরে নিলি তুই ভাই।”

কিছুক্ষণ পরে আবারো বলে ওঠে,”আগের বার ডাক্তার ভুলভাল বলেছে। এবার বলছে তোর নাকি ছেলে হবে। মটরবাইক টা তো তুই পেয়ে গেলি রে জামিল।”
জামিল অপলক তাকিয়ে ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছে। সামিন বলতে থাকে,”সুস্থ হ তুই। তোকে আমি আর দলে রাখবো না জামিল। তোকে সিমেন্টের ব্যাবসায় বসিয়ে দেবো আমার। বৌ বাচ্চা নিয়ে ভালো থাকবি। আর আমার ঝামেলা নিজের কাধে নিতে হবে না ভাই!”

***
ইশমামকে দেখে পরী উঠে যাবে বলে দাড়িয়ে যায়। ইশিতা হাতে টান দিয়ে পরীকে বসিয়ে দিয়ে বলে,”বারবার দাঁড়িয়ে যাচ্ছিস কেনো খেতে খেতে!”
পরী দ্বিধায় ভুগতে থাকে। ইশমাম ভাইয়া কেমন মানুষ কে জানে ! এভাবে কেয়ার টেকারের মেয়েকে নিজেদের খাবার টেবিলে দেখে রিয়েক্ট করতেই পারে। ইশিতাকে বিড়বিড় করে বলে,”আমার খাওয়া হয়ে গিয়েছে আপু।”

ইশমাম এসে টেবিলের ওপর থেকে পানির গ্লাস তুলে নিয়ে পানি খায়। ইশিতা বলে,”একে চিনেছিস? কে বলতো।”

ইশমাম পরীর দিকে একপলক তাকিয়ে বলে,”পরী। চিনেছি। পোনা চাচার মেয়ে।”

কথাটি বলে ইশমাম চলে যায়। পরী ফিসফিসিয়ে ইশিতাকে বলে,”তোমার এই ভাইয়ের কি কোনো অ’সু’খ আছে আপু? কোষ্ঠকাঠিন্য টাইপ?”
ইশিতা চোখ বড়বড় করে পরীর দিকে তাকিয়ে বলে,”না তো। কেনো বলতো।”

_না মানে মুখ টা কেমন করে রাখে। কেমন খি’চ মে’রে থাকে।

ইশিতা চাপা স্বরে হেসে ফেলে। পরী চুপচাপ খাচ্ছে। ইশিতা বলে,”হতেও পারে। ওকে প্রতিদিন সকালে এক বাটি পাকা পেঁপে খাইয়ে দেবো।”

ফুলির মা খাবার টেবিল থেকে সব পরিষ্কার করতে করতে বলে,”খোজ খবর রাইখেন ইশু আপা। আজকাল কত বিদেশি পার্টি কত ধান্ধা পার্টির খ’প্প’রে পরে। ইশমাম ভাইয়ার সাথে এমন কিছু হয়নাই তো!”
ইশিতা ফুলির মায়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। ফুলির মা বিড়বিড় করে বলতে থাকে,”আমার এক ভাইস্তা ইতালি গেছিলো‌। বেশ ভালো টাকা পয়সা কামাইতেছিলো। হঠাৎ হের লগে এইদেশী এক মেয়ের ফেসবুকে পরিচয় হয়। ছবি না দেইখা,মেয়ের কন্ঠ শুইনাই পিরিতে মজে গেছিলো। টাকা পয়সা প্রচুর উড়াইছে মাইয়াটার পিছে। যখন যখন চাইতো তখন দিয়া দিতো। তারপর একদিন দেখে মাইয়াটার কোনো খোজ খবর নাই। এদিকে পোলা তো পাগল হয়ে দেশে চলে আসছে মেয়ের খোজ নিতে। আইসা বহু কষ্টে খোজ খবর নিয়ে দেখে……”

_কি দেখে? মেয়ের চেহারা ভালো না? বয়স বেশি?

পরী কথাটি জিজ্ঞেস ফুলির মায়ের দিকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে। ফুলির মা বলে,”আরে না। তাইলে তো হতোই। গিয়া দেখে ওটা কোনো মেয়েই ছিলো না। ওটা একটা ব্যাটা ছেলে।”

পরী শব্দ করে হেসে ফেলে। ফুলির মা ইশিতার দিকে তাকিয়ে বলে,”খোজ নিয়া দেখেন আপা, ইশমাম ভাইয়ের সাথে এমনটা হয়নাই তো আবার? নয়তো হুট করে দেশে আইবো ক্যান।”

পরী হেসেই যাচ্ছে। ইশিতা কপাল কুঁচকে ফুলির মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি তোমার কাজ করো। আর এভাবে শুদ্ধ আর আঞ্চলিক ভাষা মিশিয়ে কথা বলা বন্ধ করো‌‌ । ইশমাম শুনলে একটা ধ’ম’ক খাবে তুমি।”

***
ঘরে ঢুকে সোজা আলোর মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,”তোমার বাবা। কথা বলো।”

আলো সামিনের হাতের ফোনটার দিকে একবার তাকিয়ে সামিনের মুখের দিকে বোকার মত তাকিয়ে থাকে। সামিন আলোর ডান হাত টেনে তুলে হাতে তার ফোনটা রেখে হনহন করে চলে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় আলো কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। সে সামিনের যাওয়া দেখে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই চোখ দুটো ভিজে ওঠে। স্ক্রিনে তার বাবা আতাউর আলমের নাম্বার। ফোনটা কানে ধরে চুপ করে থাকে আলো। আতাউর আলম ওপাশ থেকে নরম গলায় ডাকে,”আম্মু!”
আলো একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে কান্নাভেজা কন্ঠে বলে,”আব্বু।”

রেহেনা এসে স্বামীর হাত থেকে ফোনটা কে’ড়ে নিয়ে কানে ধরে। চেঁচিয়ে বলতে থাকে,”মা। মা তুই কেমন আছিস মা।”

আলো চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে। নিজেকে সামলে নিয়ে কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে বলে,”আমি খুব ভালো আছি আম্মু। তুমি কেমন আছো? কন্ঠ এমন লাগছে কেনো?”
_আমি ভালো নেই। একটুও ভালো নেই। তোকে ওরা মারধোর করে না তো মা?

_আমাকে কেউ কিছু করে না আম্মু। তুমি একটু ঠিক হও। তোমার বুকে ব্যাথা হবে তো।

_তুই সত্যি বল তুই কেমন আছিস।

_আমি ভালো আছি। আমাকে দেখবে? দেখবে তুমি?

আলো ফোন কেটে দিয়ে ভিডিও কল করে । রেহেনা ফোনটা রিসিভ করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে ভেজা চোখে। আলো কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”এই দেখো। আমার গায়ের শাড়ীটা দেখো। কম করে হলে হাজার পাঁচেক দাম হবে, আমার গায়ের গয়না দেখো। এগুলো দেখেছো তুমি কখনো?”

সামিন ঘরে ঢুকে আলোকে কাঁ’দ’তে দেখে। রেহেনা ওদিকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁ’দ’ছে। আলো রেহেনাকে বলতে থাকে,”আমি খুব ভালো আছি আম্মু। আজান আয়াত কোথায়? কলেজ যায় তো? বাবাকে বলো নিয়ম করে ওষুধ নিতে। তুমিও তোমার ওষুধ গুলো নিও। দাদীকে দেখো। রাখছি আম্মু।”

হুট করে ফোনটা কেটে দিয়ে আলো বিছানায় বসে কাঁদতে থাকে। শরীর ভেঙ্গে কান্না আসছে তার। সামিন এক দৃষ্টে আলোকে দেখে তার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নেয়। আলো ভেজা চোখ তুলে সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”শান্তি পেয়েছেন তো? অনেক শান্তি হচ্ছে তাই না আপনার মনে?”
_হ্যা হচ্ছে। জামিলের জ্ঞান ফিরেছে তাই শান্তি হচ্ছে।

আলো উঠে দাঁড়ায়।
“জ্ঞান ফিরেছে? বলেনি সত্যিটা? আমার বাবা যে কিছু করেইনি সেটা বলেনি?”
_কথা বলতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে।

_জানি কি বলবে। আমার বাবা নির্দোষ সেটাই বলবে। কেউ কাউকে মুখ ঢেকে কু’পি’য়ে তার পরিচয় কেনো দেবে ইয়াসার মির্জা? আমার বাবার নাম ভাঙানো হয়েছে সেটা বুঝতে পারছেন না? আপনি নাকি বিচক্ষণ! এতো টুকু বুঝতে পারলেন না বুদ্ধি খাটিয়ে? থানা পুলিশ করে বের করতেন সত্যি টা। তা করেন নি কেনো?

_এতো কথা আমি বলতে চাচ্ছি না। কথা ছিলো জামিলের জ্ঞান ফিরলে তোমাকে তোমার বাবা মায়ের সাথে কথা বলিয়ে দেবো। আমি আমার কথা রেখেছি।

_এতো কথা রাখেন আপনি? এতো ভালো মানুষ? তাহলে একটা কথা দিন আমায়। জামিলের মুখ থেকে যদি জানতে পারেন লোক গুলো আমার বাবার কেউ না বরং কোনো তৃতীয় পক্ষ ছিলো তাহলে আমাকে ছেড়ে দেবেন আপনি। কথা দিন, পারবেন? আছে দম?

সামিন কিছুক্ষণ আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে চুপচাপ। তারপর ফোন নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

***
শান্তিনীড়ের দোতলার এই লাইব্রেরীটা এ বাড়িতে ইশমামের সবথেকে প্রিয় যায়গা। বলা যেতে পারে ইশমামের জীবনের বেশ অনেকটা সময় সে এই লাইব্রেরীতে ব্যায় করেছে। লাইব্রেরীর ভেতরে ঢুকলে একটা অদ্ভুত প্রশান্তিতে তার মন ছেয়ে যায়। পুরনো বইয়ের গন্ধ ইশমামের বরাবর খুব পছন্দের। আগে লাইব্রেরীতে বিভিন্ন প্রবন্ধ ও গল্পের বই থাকলেও ইশিতার কল্যানে পুরো লাইব্রেরীটা হুমায়ূন আহমেদ এবং সমরেশ মজুমদারের উপন্যাসে ভর্তি হয়ে গিয়েছে।
লাইব্রেরীর সামনে দাঁড়িয়ে ইশমাম এদিক ওদিক তাকায়। ঘরটা খোলা কেনো! কিছুক্ষণ আগেও তো লক করে দিয়ে গিয়েছিলো। ভেতরে ঢুকে পুরো লাইব্রেরীতে চোখ বুলিয়ে ইশমাম তার প্রিয় শেলফের কাছে যায়। সেখান থেকে আরণ্যক উপন্যাস টা তুলে নেয়। এটা এখন সে নিজের ঘরে, বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে পড়বে। বই টা নিয়ে বের হয়ে দরজাটা লক করবে বলে হাত বাড়ায় সে।

“আটকাবেন না প্লিজ। আমি ভেতরে আছি।”

ইশমাম অবাক চোখে লাইব্রেরী ঘরের ভেতরে তাকিয়ে থাকে। নয় নাম্বার শেলফের পেছন থেকে মাথা বের করে উঁকি দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে পরী। ইশমাম চোখ বড়বড় করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,”তুমি! তুমি এখানে কি করছো!”

পরীর ফরসা মুখটা লাল বানিয়ে লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে,”বই নিতে এসেছিলাম। রাতে পড়বো বলে।”

_যখন লাইব্রেরীতে ঢুকলাম তখন সাড়াশব্দ করলে না কেনো? যদি আটকে রেখে চলে যেতাম?

পরী ইতস্তত করতে থাকে। ইশমাম প্রায় ধ’ম’কের সুরে প্রশ্নটি করেছে পরীকে।
কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে পরী জবাব দেয়,”ভেবেছি আপনি রেগে যাবেন আমাকে এখানে দেখলে। তাই চুপ করে ছিলাম।”

ইশমামের উত্তর টা পছন্দ হয় না। এটা কোন ধরনের অদ্ভুত আচরণ! রেগে যাবে ভেবে চোরের মতো লুকিয়ে থাকবে! এই মেয়ে নাকি আবার ডাক্তারি পড়ে!

ইশমাম গম্ভীর কন্ঠে বলে,”বই নিলে কেনো রাগ করবো? বই চুরি করলে রাগ করার কথা। তুমি তো আর বই চুরি করতে আসো নি।”

পরী চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ইশমাম এতক্ষণে মেয়েটিকে খেয়াল করে, অতিরিক্ত ফরসা, ঘন কালো চুল, বড় বড় দুটি চোখ। এক কথায় সুন্দরী তরুণী। চার বছর আগে দেখতে কিশোরী টাইপ ছিলো, তখন সম্ভবত ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়তো, মাথায় দুই লিটার তেল দিয়ে চুল দুই পাশে বেনী করে পোনা চাচার সাথে এ বাড়িতে আসতো।

ইশমাম গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,”তা ডাক্তারি পড়া মেয়ের হাতে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস কেনো? হুমায়ূন আহমেদের রোমান্টিক থিওরি দিয়ে রোগী সুস্থ করবে?”

পরী চুপ করে থাকে। ইশমাম গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”এই বয়সটাতে বাংলাদেশী মেয়েরা হুমায়ূন আহমেদকে এড়িয়ে থাকতে পারে না। কি আশ্চর্য!”
কথাটি বলে পরীর দিকে একপলক তাকিয়ে থেকে বলে,”বই নেওয়া হয়ে গেলে দরজা লক করে যেও‌। আর যেটা যে স্থান থেকে তুলবে,সেটা সেখানে রেখে দেবে, বুঝেছো? আমি বই অগোছালো করে রাখা পছন্দ করি না।”

পরী মাথা নাড়ায়। ইশমাম চলে যেতেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বলে ওঠে,”রামগরুরের ছানা!”

***
বাড়ির সবাই সম্ভবত ঘুমিয়ে গিয়েছে। দোতলার লিভিং রুমের বাতি নিভিয়ে রাখা। আলো একবার দরজা খুলে দেখে ইশমামের ঘরে বাতি জ্বলছে। আলো সাথে সাথে ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। ঐ পি’শা’চ টা এখনো ফেরেনি। বিষয়টি আলোর কাছে খুব স্বস্তির। যতক্ষন দূরে থাকে এই বন্দীশালার ভেতরেও আলোর নিজেকে খানিকটা মুক্ত , স্বাধীন মনে হয়। কিছুক্ষণ বিছানায় বসে থেকে বারান্দায় চলে যায় সে। ইয়াসারের বাড়িতে কোনো এক অদ্ভুত কারনে এই খোলা বারান্দাটাকে আলোর পছন্দ হয়েছে। আলোদের বাড়িতে আলোর ঘরেও একটা খোলা বারান্দা রয়েছে। তবে সেটা এতোটা বড় নয়। এই বারান্দাটা বিভিন্ন দেশীয় ফুলের গাছে সজ্জিত। একপাশে কিছু ক্যাকটাসের টব। আলো ডানে তাকিয়ে দেখতে পায় তার শুকাতে দেয়া শাড়িটা এখনো বারান্দায় দড়িতে ঝুলছে। আলোর দাদী দেখতে পেলে এতক্ষনে আলোকে দশটা ধমক দিয়ে মাথায় গাট্টা মা’র’তো, বলতো,”মাইয়া মাইনষের গায়ের পোশাক রাইতে বাইরে রাখতে নাই। এইটাও ভুইলা যাস হতচ্ছাড়ি!”
আলো শাড়িটা তুলে নিয়ে ঘুরে দাড়াতেই থমকে যায়। বাড়ির পেছন দিক থেকে ধুপ-ধাপ শব্দ আসছে। মনে হচ্ছে মাটিতে গর্ত খোঁ’ড়া’র জন্য কোদাল চালানো হচ্ছে। শাড়িটা পুনরায় দড়িতে রেখে ধীরপায়ে হেটে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায় সে। নিচু হয়ে তাকাতেই চ’ম’কে ওঠে। সামিন ইয়াসার মির্জা টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে পোনা চাচা বলে লোকটা। আরেকটা অচেনা লোক মাটি খুঁ’ড়’তে ব্যাস্ত। পাশেই একটা বস্তা,মুখ বন্ধ করে রাখা। গর্তটার দিকে তাকাতেই আলো হতভম্ব হয়ে যায় । এতো বড় গর্ত দিয়ে কি হবে! আর ঐ বস্তায় কি আছে! আলো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একটা গভীর নিঃশ্বাস নেয়। তারপর দুমিনিট সময় নিয়ে কিছু একটা ভাবে। তার চোখ মুখ আ’ত’ঙ্কে ছেয়ে যায়। রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে ঘরের সিটকিনি খুলে নিচে নামে। ফুলির মা আর সিতারা তখনো জেগে। আলোকে দেখে ফুলির মা চেঁচিয়ে ওঠে,”আরে বড় ভাবী! দৌড়ায়া কই যান‌।”

আলো দৌড়ে সদর দরজার দিকে যায়। সিতারা ঘা’ব’ড়ে গিয়ে বলে,”পালাচ্ছে নাকি!”

দরজা খুলে আলো সোজা বাড়ির পেছনের দিকটাতে যায়।

“কি করছেন এখানে আপনারা?”

আলোর কন্ঠস্বর শুনে সামিন ঘুরে তাকায়। তার চোখে মুখে হতভম্ব ভাব। পোনা চাচাও অবাক হয়ে যায়। আলো বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে ইয়াসারের দিকে তাকিয়ে। ইয়াসার কপাল কুঁচকে ফেলে, গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”তুমি! তুমি এখানে এসেছো কেনো?”

_বস্তায় কি আছে?
তেজী কন্ঠে জানতে চায় আলো।

সামিন একবার বস্তার দিকে তাকিয়ে আলোর চোখের দিকে তাকায়, তারপর বলে,”তোমার কাজ কি জেনে? ভেতরে যাও আলো।”

_কার লা’শ বস্তায়? কোন মায়ের কোল খালি করেছেন আপনি?

কোদাল হাতে নিয়ে অচেনা লোকটা মুখ হা করে দাঁড়িয়ে আছে। পোনা চাচা মিনমিন করে বলে,”ভেতরে যাও বৌ মা। ইয়াসার বাবা রেগে যাচ্ছে।”

আলো পোনার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে,”চাচা আপনিও? আপনাকে আমি সহজ সরল লোক ভেবেছিলাম। শেষমেশ আপনিও টাকার জন্য এই অ’মা’নু’ষ টার সাথ দিচ্ছেন?”

_বৌমা কি বলছো এসব তুমি!

সামিন পোনাকে থামিয়ে দিয়ে আলোকে বলে,”ভালোয় ভালোয় বলছি, ভেতরে যাও আলো। পাড়া প্রতিবেশী জেগে যাবে। এতো জোরে চেচিও না। সিনক্রিয়েট করো না।”

_জেগে যাক। সবাই দেখুক এখানে কি হচ্ছে। আপনার আসল রূপ টা দেখুক।

চেঁচামেচিতে এতক্ষনে বাড়ির সবাই এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে। ইশমাম, ইলহাম,ইশিতা,রিতু, ফুলির মা,সিতারা, পরী,ইহান। সবাই এসেছে।

সামিন ইয়াসার দাঁতে দাঁত চেপে বলে,”অবাধ্য হয়ো না আলো আমার। তুমি ঘরে যাও।”

_বস্তায় কি আছে?
আলো ইয়াসারের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে। সামিন ইয়াসার কয়েক মুহূর্ত আলোর দিকে তাকিয়ে থেকে পোনা চাচার দিকে তাকায়। পোনা চাচা গিয়ে বস্তার মুখ খুলে সবটা ঢেলে দেয় মাটিতে।

আলো হা হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। বস্তায় শুকনো পাতা এবং কচুরিপানা ছিলো। আলো পোনার মুখের দিকে তাকায়। পোনা নিচু স্বরে বলে,”গাছের জন্য কম্পোস্ট বানানোর স্থান প্রস্তুত করছিলাম বৌমা! ”

আলো মাথা ঘুরিয়ে চোখ তুলে ধীরে ধীরে সামিন ইয়াসারের দিকে তাকায়। সামিন ক’ট’ম’ট দৃষ্টি দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাগে তার হাত সে মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে।

আলো একটা ঢোক গিলে ফেলে, মনে মনে বলে ওঠে,”সিংহের নাকে সু’ড়’সু’ড়ি দিয়েছিস আলো। আজ তোর খবর আছে!”

ইশমাম আলোর দিকে তাকিয়ে সামিন কে বলে ওঠে,”কি হচ্ছে এখানে ভাইয়া? কোনো সমস্যা?”

সামিন ইশমামের কথার উত্তর না দিয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”বেশি বেশি করতে আমি নিষেধ করেছি আলো। ঘরে চলো। আজ তোমাকে এমন শি’ক্ষা দেবো তুমি আজীবন মনে রাখবে ফ’ট’কা চালাক মেয়ে!”

চলমান……