বাঁধনহীন সেই বাঁধন অকারণ পর্ব-০৫

0
336

#বাঁধনহীন_সেই_বাঁধন_অকারণ|৫|
#শার্লিন_হাসান

ভার্সিটি থেকে এসে আলিশা ফ্রেশ হয়ে বেলকনিতে গেলো। কিছু একটার চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তাদের খান ফ্যামিলি!রিচ ফ্যামিলি সেখানে রুদ্রদের ফ্যামিলি তাদের সাথে গেলে ও রুদ্রর স্ট্যাটাস তাদের স্ট্যাটাসের সাথে যাবে না। আকাশ-পাতাল তফাৎ। এই তফাৎটা আগে বুঝেনি আলিশা। ধীরে,ধীরে বুঝতে পারছে। নিজের এট্টিটিউড, ইগো সব জেনো এখন জেগে উঠছে। তখন সামান্য রুদ্রর জন্য কত না সেক্রিফাইস।
“ধুর! রুদ্র আমার ভালবাসা। ওর জন্য সবই করতে পারি আমি।”

রুদ্রকে কল দিয়ে কিছুক্ষণ কথা বললো আলিশা। মনের যতসব আজা ইরা চিন্তা-ভাবনা বাদ দিয়ে খেতে বসলো।
তখন তার মা আফিয়া ইসলাম আসলেন। মেয়েকে দেখে তিনি বললেন,

“আলিশা তোমার তো অনার্স কমপ্লিট হয়ে যাবে। আর রোশানের দেশে ফিরতে মাস দেড় এক লেট হবে। আমি আর তোমার বাবা ভাবছি রোশান ফিরলে বিয়েটা দেবো। তোমার কোন মত থাকলে আমাদের জানাতে পারো।”

“আমি যদি বলি রোশানকেই বিয়ে করবো না। তখন কী তোমরা আমার এই মতটাকে মেনে নিবে?”

“রোশানকে বিয়ে না করার কারণটা তো বলো?”

“তাকে আমার ভালো লাগে না। আমার পছন্দ না।”

“তোমার নিজের পছন্দের কেউ আছে আলিশা?”

“আমাকে সময় দাও আম্মু! আমি জানাবো। এক মাস সময় লাগবে আমার।”

“হ্যাঁ বা না বলো। পরে নাহয় সব জানবো।”

আফিয়া ইসলামের কথার জবাবে আলিশা মাথা নাড়ালো। আফিয়া ইসলাম আর কথা বাড়ায়নি। বেশী বলতে গেলে মেয়ে আবার তার খাওয়া ছেড়ে রুমে গিয়ে দরজা যে বন্ধ করবে দুই-তিন দিনের জন্য। একমাত্র আদরের মেয়ে। তাকে ঘিরে সবকিছু আফিয়া ইসলামের।

****

রাইহান চৌধুরী বাড়ীতে প্রবেশ করছে আর চিৎকার চেঁচামেচি করে ডাকছে তার স্ত্রী সাদিয়াকে।
তার ডাক শুনে তার স্ত্রী, কন্যা বেড়িয়ে আসলো। রাইহান চৌধুরীকে এতো চিৎকার করতে দেখে সাদিয়া কপাট রাগ দেখিয়ে বললো,

“এতো ষাঁড়ের মতো চিল্লাচ্ছো কেন?”

“তুমি চুপ থাকো। তোমার গুণধর ছেলে কী করেছে তুমি জানো?”

“আয়মান আবার কী করলো?”

“মালদ্বীপ থেকে এসেছে ভালো কথা! আমার টাকায়-ই তো ট্যুরে গিয়েছে এখন আবার তার একলাখ টাকা কিসের জন্য চাই? অফিসে গিয়ে আমাকে হুমকি ধমকি। এসব কী? এই শিক্ষা দিয়েছ তুমি তোমার ছেলেকে?”

“ও তো এমনই।”

“ও তো এমনই! হাহা! তার চেয়ে আমার জারিফ ভালো। কখনো কোনদিন আমার দিকে চোখ তুলে তাকায়নি। আর না কখনো চোখ রাঙিয়ে কথা বলেছে। আমি তার পড়াশোনার খরচের সব টাকা মাসে-মাসে পাঠিয়ে দিতাম। আমার ছেলে তা গ্রহণ করতো না। টিউশনি করতো। আমার জারিফ নিজের খরচ নিজে চালাতো। কখনো পরনির্ভরশীল হয়নি। আর তোমার ছেলে? মনে হচ্ছে আমার পা’পের শাস্তি এটা।”

“আমার ছেলে ভালোই আছে। তোমার জারিফ কম না! এখন কী আর বলবে নাকী?”

“সবাই জানে আমার জারিফ কেমন! জারিফের তো চাকরী হয়েছে তোমার ছেলেকে চাকরী তো দূরে থাক কেউ চাকর হিসাবে রাখে কী না দেখো। যেই না কর্মীক! হাহা! ”

রাইহান চৌধুরী প্রস্থান করে নিজের রুমে চলে গেলেন। সাদিয়া সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন। রাগে তার হাত মুষ্টি বদ্ধ করে নিলো।

” এই জারিফ আনান রুদ্র! আমার সতীন মরেছে তো, নো! মে’রেছি তো তাতে কী দিয়ে গেছে আরেক জ্বালা। এই রুদ্রকে ও মনে হয় তার মায়ের কাছে পাঠাতে হবে।”

*****

সন্ধ্যার দিকে মেহরাব বাজার থেকে চিকেন চাপ আনলো। মেঘের ভাই,ভাবী পরিবারের সাথে আড্ডা-মাস্তিতে খেলো তা। চঞ্চল মেয়ে মুখে বিষাদের ছায়া পড়া বারণ।
” কিশোরী মন এতো বেহায়া হয় কেনো? আবেগ কন্ট্রোল হচ্ছে না কেন?”
চুপচাপ উঠে রুমে চলে আসলো মেঘ। পড়াশোনা জমে পাহাড় অথচ মন নেই তার। রুদ্রকে নিয়ে সাজানো ডায়েরিটা হাতে নিলো মেঘ। প্রত্যেক সপ্তাহ জুড়ে হাজারো ব্যস্ততার মাঝে এক কলম করে ফুটিয়ে তুলে তাকে নিয়ে। রুদ্রকে লুকিয়ে দেখা! তাকে নিয়ে সারাক্ষণ দুষ্টুমিতে মেতে থাকা। অথচ রুদ্রর একান্ত একজন আছে। তার ভালবাসাটা এক তরফা থেকে যাবে। কোনদিন রুদ্র জানবে না। একদিন সে নিজের জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। একজনকে এক তরফা ভালবাসতো যা ডায়েরিতে লিখা অথচ ডায়েরিটা পড়ার ও সময় থাকবে না। কোথাও অবহেলায় পড়ে থাকবে ডায়েরিটা। রুদ্র তখন নিজের জীবনে ব্যস্ত থাকবে। দেওয়ালে এপার ওপারে দু’জন ব্যক্তি ভিন্ন দু’টি জীবন কাটাবে। ভালবাসাটা আজীবন এক তরফা থেকে যাবে।
ভালবাসাটা বিষাদ কেনো এতো? একদিন নিজের এসব পাগলামীর জন্য হাসবে মেঘ! তবে বুকভরা দীর্ঘ শ্বাস ও থাকবে।

মেহেরাব রাখি বসে কথা বলছে। মূলত রুদ্রকে নিয়ে। তখন মেহরাব বললো,
“রুদ্র বিয়েটা কেনো করছে না? খাওয়া-দাওয়া সবকিছুতে সমস্যা হচ্ছে।”

“ভাইয়াকে বললে সে শুধু বলে সময় হোক। জানি না কবে সময় হবে তার।”

“আলিশার পরিবারের কাছে ফ্যামিলি থেকে কাউকে পাঠাও।”

“ভাইয়ার সাথে কথা বলে দেখি।”

****

কেটে গেছে বিশদিন। চৈত্র মাস শেষের দিকে বৈশাখ মাস শুরুর দিলে। চারপাশ উত্তাপ আবার আকাশে মেঘ ধরলে সব শান্ত।
মেঘ আগের থেকে নিজেকে কিছুটা গুছানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু রুদ্রর সামনে গুছানো শক্ত মানুষটার মনে আবার ও আবেগময় অনুভূতি জেগে উঠে।
এক ধ্যাণে ব্যাগ গুছাচ্ছে মেঘ। যা গরম পড়েছে।

কলেজ ড্রেস পড়ে বাইরে আসলো। চুপচাপ নাস্তা করে বেড়িয়ে পড়লো। রাখি সব দিক সামলায় আফরোজা ইসলাম ও তাকে সাহায্য করে তবে রাখি সবটার দেখ ভাল করে।

পত্রিকার কাগজ পড়ছিলেন আর চায়ে চুমুক দিচ্ছিলেন মহীউদ্দীন তালুকদার । মেহরাব তখন তৈরী হয়ে এসেছে নাস্তার জন্য। সে একটা হাইস্কুলে জব করে।

চায়ের কাপ হাতে নিতে,নিতে বললো,

“মেঘ চলে গেছে?”

তার কথার জাববে আফরোজা ইসলাম বললেন,
“এই কিছুক্ষণ আগে চলে গেছে।”

“মেঘ আগের থেকে কেমন হয়ে গেলো না? চঞ্চল মেয়েটা একবারে নিরব। আগের মতো আমার সাথে ঝগড়া ও করে না। বায়না ধরে না। রুমের মধ্যে সারাক্ষণ কী করে আল্লাহ ভালো জানে।”

“হয়ত ও কোন কিছু নিয়ে চিন্তায় আছে। আর এমন চেন্জ হওয়াটা স্বাভাবিক। ইমম্যাচিওর থেকে ম্যাচিওর হচ্ছে। দ্যাটস!
চায়ের কাপ নিতে,নিতে কথাটা বললো রাখি।

তার কথার জবাবে মেহরাব বললো,

” হয়ত!”

নাস্তা শেষ করে মেহরাব বেড়িয়ে গেলো। রাখি রান্নার জোগান দিলো।

রুদ্র কফি বানিয়ে সেটা পান করতে,করতে ডিম ভাজি করলো। মনটা আজকাল ভালো নেই তার। আলিশাকে মাঝে-মাঝে বড্ড অদ্ভুত লাগে। আদৌ তাকে ভালবাসে? নাকী তার চেয়ে বেটার কাউকে পেলে হাতটা ছেড়ে দিতে দু’বার ও ভাববে না। সম্পর্কে টানাপোড়ন।

কলেজে প্রবেশ করতে চোখ গেলো সামনে। সবসময় নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটে রুদ্র। আজকে হুটহাট সামনে চোখ যেতে মেঘকে দেখলো। মেয়েটার মুখ আগের থেকে শুকিয়ে গেছে। হাসির মাঝে বিষাদ দেখা যাচ্ছে। রুদ্রর জানামতে মেয়েটা বেশ চঞ্চল। হুট হাট চেন্জ হয়ে যাচ্ছে।

মেঘ রুদ্রকে দেখে ভদ্রতার সহিত সালাম দিলো। রুদ্র সালামের জবাব দিয়ে ভেতরে চলে গেলো। লিমা মেঘকে প্রশ্ন করলো,

“স্যারের মনে হয় মুড অফ।”

লিমার কথায় হাসলো মেঘ। পিঠে চাপড় মেরে বললো,

“তার মুড কবেই বা অন ছিলো? তাকে সবসময় আমি এমন মুখ কালো করে রাখতে দেখি। কী জানি জীবনে তার গার্লফ্রেন্ডের সামনে হেসেছে কী না। আমার খুব ইচ্ছে করে উনার হাসি মুখ দেখতে।”

“তোর ইচ্ছের আর শেষ হলো না।”

***
বিকেলের দিকে রুদ্র আসলো তালুকদার বাড়ীতে। মূলত রাখির রিকুয়েষ্টে এসেছে। তারা একটা ট্যুর দিবে। সন্ধ্যার দিকে রুদ্রর জন্য নাস্তা নিয়ে হাজির হলো মেঘ। সে নিজেই কিচেনে গিয়ে ট্রে এনেছে। তার কাজে রাখি, আফরোজা ইসলাম হতবাক। তবে কিছু বলেনি।

সোফায় বসে রুদ্র ফোন ঘাটছিলো।মেহরাব সবে বসেছে রুদ্রর সাথে। তখন মেঘ ট্রে এনে তার সামনে টেবিলে রাখে।

“আপনার নাস্তা।”

রুদ্র ফোন থেকে নজর সরালো। মেঘের দিকে একবার তাকালো। মেয়েটার চোখে-মুখে হাসির জলক।
রুদ্র বেশী পাত্তা দিলো না চুপচাপ কফির মগ নিয়ে তাতে মগ্ন হলো।

মেঘ নিজের কফির মগ আনতে কিচেনে প্রবেশ করতে রাখি বললো,

“কী ব্যপার মেঘ! প্রেমে টেমে পড়লে নাকী?”

“ধুর কী যে বলো না। দুনিয়াতে এতো কিছু থাকতে প্রেমে পড়বো কেন? তার চেয়ে উ’ষ্ঠা খেয়ে পড়বো। প্রেমে পড়া মানে জীবন তছনছ। তার কথা চিন্তা করা! তাকে দেখার জন্য মনে ব্যকুলতা।”

“এতো কিছু জানো যেহেতু। নিশ্চিত প্রেমে পড়েছ।”

“লিমার থেকে শুনেছি ভাবী।”

“বলতে হবে না মেঘ। আমি বুঝে গেছি। শোনো মেয়ে, প্রেম ভালো তবে মানুষটা সঠিক হলে। ভুল মানুষের প্রতি অনুভূতি প্রকাশ করে নিজের সত্তাকে হারিয়ো না। আর আমার ভাইয়ের প্রেমে পড়ে লাভ নেই।কষ্ট পাবে!”

মেঘ কোন উত্তর দিলো না। চুপচাপ প্রস্থান করলো।

রুদ্র, মেহরাব প্লানিং করছে কক্সবাজার ট্যুরে যাবে। সেজন্য পাঁচদিনের ছুটি নিবে দু’জন। মেহরাব,রাখি,রুদ্র, আলিশা,মেঘ,আরোহী,অর্ণব,আরিশ তারা এই কয়জন যাবে। অর্ণব,আরিশেরটা ঠিক নেই। তাঁদের ব্যস্ততা।

গল্প গুজব করে এগারোটা বেজে গেলো। মেঘ আসেনি আর। মহীউদ্দিন তালুকদারের সাথে ও বসে কথা বলেছে রুদ্র। রাখি,আফরোজা ইসলাম খাবার টেবিলে আনছে।
মেহরাব গিয়ে মেঘকে ডাকছে।কিছুক্ষণ পর মেঘ এসে মেহরাবের পাশের চেয়ারটা দখল করে বসলো। রুদ্র চুপচাপ খাচ্ছে। আবার কখনো মেহরাবের সাথে কথা বলছে। মেঘ খাচ্ছে আর রুদ্রকে একটু পর,পর দেখছে।

******

এর মাঝে কেটে গেছে তিনদিন। রুদ্র,মেহরাব ছুটি নিয়েছে। অর্ণব যাবে আরিশ কাজের চাপ আছে সে যেতে পারবে না। মেহরাব,রুদ্র,আলিশা,মেঘ,রাখি,অর্ণব,আরোহী এই কয়জনই যাবে। রুদ্রর ইচ্ছে ছিলো না আলিশাকে নেওয়ার। মূলত রাখি,মেহরাবের জন্য ওকে নিচ্ছে রুদ্র।
আলিশা তার বাবা-মাকে বলে দিয়েছে ট্যুরে যাবে সে।
আশরাফ খান আর দ্বিমত করেনি।
আলিশা নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। আগামী কাল তারা রওনা হবে।

আলিশা বেলকনিতে বসে কারোর সাথে কলে কথা বলছে। মূলত আগামী কালকে যাও নিয়ে। কিছুক্ষণ পর রুদ্রর কল আসে। তড়িঘড়ি কল রিসিভ করে। বিরক্ত হয় আলিশা। সিরিয়াস কিছু কথা বলছিলো এরই মাঝে রুদ্রর কল।
কিছুক্ষণ কথা বলে কল রেখে দেয় আলিশা। ফোনের ওয়েলপেপারের দিকে তাকিয়ে আছে। যেটা বেশ কয়েকদিন আগের তোলা। তার ফাস্ট ডেট ছিলো। সাথে হাতের ফোনটার দিকে একবার তাকায়। এটা ফাস্ট ডেটে তার দেওয়া গিফ্ট ছিলো। গিফ্টদাতার কথা মনে পড়তে মুচকি হাসে আলিশা।

#চলবে