বাঁধিব হৃদয়ে তোমায় পর্ব-০৩+০৪

0
336

#বাঁধিব হৃদয়ে তোমায়
#পর্ব-০৩+০৪
#সুমাইয়া_মনি

‘আম্মু আমার ব্লু রঙের টিশার্ট কোথায়?’ আবির চিল্লিয়ে আইরিন বেগমের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল।
রুম থেকে তিনি হাঁকিয়ে বলেন,
‘ময়নার মা’কে বলেছি। ইস্ত্রি করে নিয়ে যাচ্ছে, একটু ওয়েট কর।’
‘ধ্যাত! এখনো ইস্ত্রি করা হয়নি।’ বিরক্তি নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা আঁচড়াতে লাগলো আবির৷ হঠাৎ-ই আয়নার ভেতরে বিভার এক ঝলক প্রতিবিম্ব দেখতে পায়। বিভা এক প্রকার দৌঁড়ে তার রুমের সামনে থেকে গিয়েছে এমনটা মনে হচ্ছে আবিরের। উন্মুক্ত গায়ে বাহিরে বের হয়ে কাউকে দেখতে পায় না। মনের ভুল মনে করে আবির। তবে হঠাৎ বিভাকে দেখার কারণ সে আদৌও বুঝতে পারছে না। হতে পারে এটা তার হ্যালোসিনেশন! কিছুক্ষণ বাদে ময়নার মা টিশার্ট দিয়ে গেলে সেটি পড়ে তার ওপর জ্যাকেট পড়ে। বাহিরের আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা। জানুয়ারি মাস বলে কথা। সিঁড়ি বেয়ে হল রুমে আসে। হল রুমের পাশের একটি গেস্ট রুমে আফিন ছেলে-মেয়ে মিলিয়ে কিছু স্টুডেন্টদের পড়ায়।
কলেজ ছুটির পর পড়ার টাইম ফিক্সড করেছে। কিছু একটা মনে করে আবির এগিয়ে যায় সেই রুমের দিকে। ভেতরে প্রবেশ করতেই আফিন অঙ্ক বুঝানো থামিয়ে দেয়। বাকিদের নজরও আবিরের উপর পড়ে। আবির বিভাকে দেখতে পায় সেখানে। সে বুঝে যায় একটু আগে সত্যি বিভাকে দেখেছিল। হ্যালোসিনেশন ছিল না। বিভা আবিরকে দেখেও না তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। রাগ হয় আবিরের। এই মেয়েটা কিসের এহ দাম দেখায় বুঝতে পারে না সে।

‘কিছু বলবি আবির?’ আফিন প্রশ্ন করে।
‘নাহ! ভাইয়া।’ বলে আবির বেরিয়ে আসে রুম থেকে।

হল রুমের সোফায় বসে। আপাতত বিভার কথা মস্তিষ্ক জুড়ে বিচরণ করছে। বন্ধুদের মাধ্যমে খোঁজ লাগিয়ে বিভার সম্পর্কে সব জানতে পারে। বাবা নেই। বড়ো বোন, মা আর বিভা। মধ্যবিত্ত পরিবারের বলা চলে। তবে বিভার ভাব, স্বভাব দেখে তার মোটেও ভালো লাগে না। সে কি শুধু তার সামনেই এমন ভাবের মধ্যে থাকে নাকি সবার সামনেও একই রূপে থাকে দেখায়। এতটুকু ভাবার পর সামিমের ফোন আসে। আবির বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে।

কলেজ ছুটির পর বিভা, মোহনা সঙ্গে আরো কিছু স্টুডেন্ট রা আফিনের কাছে পড়তে আসে। বাড়ির সামনে এসে বিভা কিছুক্ষণের জন্য থ হয়ে যায়। রাজ প্রাসাদের চেয়ে কম নয় বাড়িটি। আফিন আসার আগে বাড়িটি ঘুরে দেখার জন্য মোহনাকে সঙ্গে নিয়ে ওপরে যায়। ওপরে পাঁচটি কামরা আছে। ডান পায়ে এডজাস্ট বড়ো বারান্দায়ও রয়েছে। মোহনা বারান্দায় যায় না। সিঁড়ির বগলে দাঁড়িয়ে থাকে। বিভা একাই যায়। এতবড়ো বারান্দা দেখে বিভা মুগ্ধ হয়। পাশে ছোট ছোট টপে ফুলের গাছও রয়েছে। তখনই আবিরের কণ্ঠের স্বর শুনতে পায়। বাহিরে বের হয়ে পা টিপে আবিরের কামরার দিকে উঁকি দিতেই সরে যায় ওঁকে দেখে। প্রথমে তো ভাবে আবির এখানে কেন? পরক্ষণে আইরিন ম্যামের কণ্ঠ শুনে পায়। এক প্রকার দৌঁড়িয়ে মোহনার হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায় বিভা। আর তখনই আবির বিভার প্রতিবিম্ব দেখতে পায় আয়নাতে। সেখানের স্টুডেন্টদের কাছে জিজ্ঞেস করার পর জানতে পারে। আবির, আফিন দুই আপন ভাই। আফিন বড়ো, আবির ছোট। বোন নেই তাদের৷ শুনে বিভার মাথায় যেন বাজ পড়ার অবস্থা হয়।

‘আগে যদি জানতাম আবির পাঠা আফিন স্যারের ছোট ভাই, তার কাছে পড়তে আসতাম না। স্যার, আর ম্যাম কতটা ভালো বিনয়ী মানুষ। আর এট পাঠা তো চরম বেয়াদবের হাড্ডি। তাদের মতো যে কেন হলো না।’ মনে মনে কথা গুলো বলে আফিনের দিকে তাকায় বিভা। দুই ভাইয়ের চেহারায় একটুআধটু মিল খুঁজে পায় সে। দেখতে ফর্সা, লম্বাচওড়া। চোখে চশমা পড়ে আফিন। শোভন আচরণে যে কেউ মুগ্ধ হবে। মায়ের মতো সেও একজন টিচার। তাও একই কলেজে।
________
সেলাই মেশিন চালানোর সময় হঠাৎ একটি মেয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। ধরাধরি করে ববি সহ আরো কিছু মেয়েরা তাকে নিয়ে গার্মেন্টসের মেডিক্যালে আসে। সেখানের ডক্টর মেয়েটির পরিবারের সদস্যকে আসতে বলে। ততক্ষণে ববি মেয়েটির কাছে থেকে যায়। এক স্থানে পাশাপাশি কাজ করার সুবাধে অনেক আগেই মেয়েটিকে ববি চিনতো। নাম সাথী। ববির চেয়ে বয়সে ছোট । সাথীর মা আছে, বাবা নেই। মা কিছুক্ষণ বাদে সেখানে হাজির হলে ডক্টর আলাদা ভাবে তাকে চেম্বারে ডাকে। ববিও যায় সাথীর মায়ের সঙ্গে।
ডক্টর সাথীর মায়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
‘আপনার মেয়ের একটি কিডনি ড্যামেজ হয়ে গেছে। দ্রুত অপারেশন করাতে হবে।’
সাথীর মা যেন কথাটা শুনে হতভম্ব হয়ে যায়। সে কেঁদে ফেলে। ববির মনও খারাপ হয়ে যায়। তাকে শান্তনা দেয়।
ডক্টর আবার বললেন,
‘আপনি এত টেনশনে করছেন কেন? এটা তো নতুন কিছু নয়। এখানে অনেক বিবাহিত, অবিবাহিত মেয়েদের চিকিৎসা জন্য কোম্পানি থেকে সাহায্য পায়। আপনার মেয়ের অপারেশনের দায়িত্ব পুরো কোম্পানির। আপনাকে এক টাকাও দিতে হবে না।’
সাথীর মায়ের চোখ যেন চিকচিক করে উঠলো খুশিতে। তিনি হাত জোর করে বললেন,
‘বাঁচাইয়া রাখুক তাগো। আমার মাইয়াডা নতুন জীবন পাইবো।’
‘কার রাতে অপারেশন হবে।’
‘আইচ্ছা।’

কথপোকথন শেষ করে ববি সাথীর মা’কে নিয়ে সাথীর কেবিনে আসে। সাথীর সবে মাত্র জ্ঞান ফিরেছে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলে সাথীর মা সত্যিটা বলে দেয়। সাথী কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। ববি ওঁকে আশ্বাস দেয়। ভয় পেতে নিষেধ করে। সাথীর বয়স সতেরো। এতটুকু বয়সে অপারেশন কথা ভেবে ববি নিজেও আশংকার মধ্যে থাকে।
.
বিভা বই পড়ছে। বিলকিস বানু হাতে কাঁথা সেলাই করছে। সন্ধ্যার দিকে ববি ওভার টাইম সেরে তবেই বাড়িতে ফিরে।
সঙ্গে কিছু কাঁচা তরকারিও কিনে নিয়ে আসে। একটু জিরিয়ে তারপর গোসল করতে যায়। গোসল সেরে তিন মা মেয়ে এক সঙ্গে গল্পগুজব করে। তাদের খুনসুটি দেখে বোঝার উপায় নেই যে সংসারে অভাব-অনটন আছে। যেমন আছে, যেই পরিস্থিতিতে আছে সবসময় শুকরিয়া আদায় করে বিলকিস বানু।
______
সকালে যথাসময়ে কলেজে আসে বিভা। ক্লাস শুরু হতে আরো পাঁচ মিনিট বাকি। মোহনার সঙ্গে মাঠের একটি গাছের নিচে বসে আড্ডা দিচ্ছে। মোহনা বার বার ফোন দেখার কারণে বিরক্ত হয়ে বিভা ফোনটি কেঁড়ে নেয়। মোহনা ফোনটি নেওয়ার জন্য জোরাজোরি করছে। ফোন নিয়ে টানাটানির এক পর্যায় সামিম এসে দাঁড়ায়। গলা খাঁকারি দিয়ে তার উপস্থিতি বোঝায়। থেমে গিয়ে দু’জনে দৃষ্টি ফেলে তার দিকে । সামিম বিভার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘পাঁচতলা ভবনে এগারো নাম্বার রুমে আবির তোমাকে ডেকেছে।’
কথাটি শুনে বিভার মুখ বেঁকে আসে। বলল,
‘তার যদি আমাকে দরকার হয়, তাকে গিয়ে বলুন পাঁচতলা ভবনের এগারো নাম্বার রুম থেকে যেন আমার কাছে আসে।’
‘মানে তুমি যাবে না?’
‘নাহ!’
‘ভেবে দেখো?’
‘ভাবছি, এখন আপনি আসতে পারেন।’
সামিম অপমান বোধ করে। ফিরে যায় সেখান থেকে।
সময় ফুরিয়ে যায়। ছুটির পর এক সঙ্গে দুই বান্ধবী হেঁটে হেঁটে প্রাইভেটের জন্য যাচ্ছিল। মেইন রাস্তা ছাড়িয়ে আসার পর রিকশা নিয়ে আফিনের বাড়িতে আসে। আজ হল রুমে আবিরকে দেখতে পায় তারা। বিভা, মোহনা ইনগোর করে।
মাথা ঠান্ডা রাখে আবির। সে নিজেও চায় বিভাকে ইগনোর করতে। কিন্তু বিভার আচার-আচরণ, চালচলন দেখে কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারে না তাকে। বিষয়টি এমন হয়, যেন গরম তেলে কেউ ইচ্ছাকৃত পানির ছিটা দিচ্ছে। একে একে আরো স্টুডেন্টরা সেখানে উপস্থিত হয়। আফিনও রীতিমত চলে আসে। পড়ানো আরম্ভ করে সে। হঠাৎ আফিন বাহিরে বেরিয়ে আসে। আবিরকে হল রুমে ফোন টিপতে দেখে সে এগিয়ে এসে বলল,
‘আবির আমাকে একটু বাহিরে যেতে হবে। তুই ওদের বাকি পড়া গুলো পড়িয়ে দে।’
আবির কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর বলে,
‘আচ্ছা দিচ্ছি, তুমি যাও।’

আফিন চলে যায়। আবির ঘাড় ডানে-বামে কাত করে উঠে দাঁড়ায়। সেই কক্ষে প্রবেশ করে টেবিলের ওপর উঠে বসে। সকলে ওঁকে দেখে একটু অবাক হয়। আবির চেয়ার টেনে পা রেখে বলল,
‘ভাইয়া একটা কাজে গিয়েছে। বাকি পড়ার দায়িত্ব আমাকে দিয়ে গেছে।’

কথাটা শুনে বিষয়টি সকলে স্বাভাবিক ভাবে নিল। কিন্তু বিভা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছে না। চোখমুখ ঘুচে আসে তার। বিভা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘তাহলে বাকিটা কালই পড়বো।’
‘বোসো চুপচাপ। কোনো কথা হবে না। আমি পড়াবো তোমরা মনোযোগ দিবে।’
বিভা দাঁত কিড়মিড়িয়ে বসে যায়। আবির বইটি হাতে নিয়ে ঘেটেঘুটে বন্ধ করে পুনোরায় পাশে রেখে দেয়। একটু ঝুঁকে বলল,
‘একটা প্রশ্ন বলছি। উত্তর তোমরা দিবে। শোনো তাহলে। একটি ঘরে একটিমাত্র বিড়াল বসবাস করে। বিড়ালটি এক গ্লাস দুধ টেবিলের ওপর রেখে বাহিরে গিয়েছে আরো কিছু খাবার জোগাড় করতে। খাবার জোগাড় করে সে যখন ফিরে আসে, তখন টেবিলের উপর গ্লাস দেখতে পায়, তবে তার মধ্যে দুধ ছিল না। গ্লাসটি পুরো খালি ছিল। এখন প্রশ্ন হলো বিড়ালের দুধ কে চুরি করে খেয়েছে? ঘরে তো বিড়াল ব্যতীত আর কেউ থাকে না। বলো বিভা?’
সকলে বিভার দিকে তাকায়। মেজাজ তুঙ্গে উঠে যায় বিভার। একে তো পড়া বাদ দিয়ে ফালতু প্রশ্ন করেছে। তার উপর ওর কাছে উত্তর চাইছে। বিভা দাঁড়িয়ে চটজলদি উত্তর দেয়,
‘আমি জানি না।’
‘আচ্ছা তুমি ইচ্ছে করে ঢেকুর তুলতে পারো নিশ্চয়?’
‘পারি। তো?’
‘একটা ঢেকুর তুলে দেখাও তো।’
‘কেন?’
‘তার মধ্যেই উত্তর লুকিয়ে আছে।’
‘কীভাবে?’
‘আগে দেখাও না।’
না চাইতেও বিভার ঢেকুর তুলে। আবির চেঁচিয়ে বলে উঠে,
‘এই যে বিড়ালেরর দুধ চোর। চুরি করে দুধ খেয়ে ঢেকুর তুলছে, দেখো সবাই বিড়ালনীকে।’

সকল স্টুডেন্ট বিভার দিকে তাকিয়ে হেসে দেয়। মোহনা মুখে হাত রেখে হাসছে। বিভার মুখ হা হয়ে যায়। আবির যে বুদ্ধি খাঁটিয়ে শেষ পর্যন্ত তাকেই চোর বানাবে সে ভাবে নি। আবির হেসে নিচের ঠোঁট হালকা কামড়ে বাঁ দিকের ভ্রু উঁচু করে বিভার দিকে তাকায়। মানে এটা ছোট প্রতিশোধ ছিল সেটি আঁকার ইঙ্গিতে বুঝায় তাকে। সকলের সামনে হাসির পাত্রী বানিয়ে দিল। বিভা রেগে চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে রয় আবিরের দিকে। নিজেও প্রতিশোধ নিবে ভেবে নেয়।
.
.
.
#চলবে?

#বাঁধিব_হৃদয়ে_তোমায়
#পর্ব_০৪
#সুমাইয়া মনি।

কুয়াশা ঢেকে আছে পথঘাট। পূর্বদিগন্ত থেকে সূর্যের রশ্মি উদিত হতেই ধীরে ধীরে কুয়াশার রেশ বিলিন হয়ে যায়।
ক্ষণে ক্ষণে সূর্যের তাপমাত্রা তীব্র হতে থাকে। রৌদ পোয়াতে অনেকেই ছাদে কিংবা বারান্দায় উপস্থিত হয়েছে।
বিভা ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে। সকাল সকাল কলেজে যাওয়ার ফলে গোসল করতে হয় তাকে। শরীর হাত-পা উষ্ণ গরম করার জন্য খাটে বসে গায়ে কাঁথা জড়িয়ে নেয়। কাঁপা-কাঁপি করার মুহূর্তে আবিরদের বারান্দার কথা মনে পড়ে। একবার নিজের ঘরের দিকে নজর বুলিয়ে নেয়। চার কোণাচে টিন দিয়ে তৈরি একটি ঘরে তারা বসবাস করে। ঘরটি এতটাও বড়ো নয়। সঙ্গে এডজাস্ট বাথরুম ও ছোট্ট একটা রান্নাঘর। গরমের দিনে যেমন তীব্র গরম অনুভব হয়, শীতের সময়ও তেমনি ঠান্ডা দ্বিগুণ লাগে। এইটুকু ঘরের ভাড়া চার হাজার টাকা। যদি কোনো বড়োলোক ঘরে জন্ম হতো। এতক্ষণ বিছানার মধ্যে থেকে গরম কফির মজা নিতো। তবে বিভা আফসোস করে না।
কাঁথা সরিয়ে তৈরি হয়ে নেয় কলেজে যাওয়ার জন্য।

হেঁটেই তাকে কলেজে যেতে হয়। ববির কাছ থেকে রোজ বিশ টাকা নেয়। সেটা রেখে দেয় রিকশা দিয়ে প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার জন্য। কারণ এখান থেকে আফিনদের বাড়ি দুই কিলোমিটারের কাছাকাছি। কলেজে এসে মোহনার সঙ্গে দেখা হয়। ক্লাসরুমে একদম লাস্টের বেঞ্চে উদাস মনে বসেছিল। যখন থেকে পরিচয় হয়েছে এভাবে উদাস হতে দেখেনি মোহনাকে। বিভা পাশে বসে। উপস্থিতি টের পেয়েও মোহনা একই ভাবে বসে আছে, অদ্ভুত! বিভা কাঁধে হাত রেখে ‘মন খারাপ.. ‘ বাক্যটি শেষ করার আগেই মোহনা ওঁকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। বিভা অবাক হয়ে যায়। এক নজরে পর্যবেক্ষণ করে নেয় সকলের দিকে। আপাতত কেউ বিষয়টি খেয়াল করেনি। বিভা মোহনার পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,
‘কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে বল?’

কান্নার গতিবেগ যেন আরো বেড়ে যায় মোহনার। বিভা কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়ে,
‘এভাবে কাঁদিস না। সবাই দেখলে প্রশ্ন তুলবে। চুপ কর। বাহিরে চল। কি হয়েছে মাঠে গিয়ে শুনবো।’

মোহনা কান্না থামায় না। বিভা এক প্রকার টেনে বাহিরে নিয়ে আসে। গাছের নিচে বসে চোখ মুছিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে পুনোরায়। মোহনা হেঁচকি তুলে বলে,
‘সাকিব আমার সঙ্গে ব্রেকআপ করেছে।’

বিভা সরু চোখে তাকায়। এর আগে সাকিবের কথা ওঁকে বলেনি। হঠাৎ বলাতে বিভা মেকি রাগ দেখায়। মোহনা কান্না কণ্ঠে বলে উঠে,
‘স্যরি! সাকিবের কথা আমি তোকে বলিনি।’
‘তাহলে এখনো বলার দরকার নেই।’ বলে বিভা প্রস্থান করে।
মোহনা আরো জোরে জোরে কাঁদতে থাকে। কিছুটা পথ গিয়েও থেমে যায় বিভা। ফিরে এসে মোহনার হাত ধরে টেনে তুলে সান্ত্বনা দেয়। বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।
মনঃক্ষুণ্ন রেখে তো আর ক্লাসে মন দেওয়া যায় না।

ছুটির পর একা একা প্রাইভেটে আসতে হয় তাকে। পড়ার কক্ষে এসে কাউকে না দেখতে পেয়ে বারান্দায় যাওয়ার কথা ভাবে। কিন্তু আইরিন ম্যামও বাসায় ছিল না বিধায় যায় না। বই বিয়ে পড়তে আরম্ভ করে। কিছুক্ষণ বাদে একজন, দু জন করে স্টুডেন্ট হাজির হয়। তখন আফিনও চলে আসে।
ম্যাথ করাতে থাকে। পড়ার মাঝে বিভার কালকের কথা মনে পড়ে। আবিরের যন্ত্রণায় বিভা না পড়েই বাড়িতে চলে এসেছিল। দিনটাই যেন মাটি করে দিল এমনটা মনে হতে থাকে তার।

‘বিভা..’
আফিনের ডাক শুনে বিভার ভাবনা কেঁটে যায়। তড়িঘড়ি করে উঠি দাঁড়িয়ে বলল,
‘বলুন স্যার।’
‘তুমি কি আম্মুর রুম থেকে সাইনপেন নিয়ে আসবে? এটির কালি শেষ হয়ে গেছে। আম্মু কলেজ থেকে এসেছে। চাইলেই দিবে।’
‘জি আনছি স্যার।’ বলে বিভা বের হতে নিলে আফিন পিছন থেকে আবার বলল,
‘আম্মুর রুম তুমি তো চিনো?’
‘হ্যাঁ!’
‘তাহলে যাও।’
বিভা ওপরে আসে। আবিরের রুমের পাশের রুমটি আইরিন বেগমের। বিভা সরাসরি সেই রুমে নক করে প্রবেশ করে। আইরিন বেগম তখন শাড়ির পিন খুলছিল। বিভাকে দেখে মিষ্টি করে হেসে জিজ্ঞেস করে,
‘নিশ্চয় আফিন পাঠিয়েছে তোমাকে সাইনপেন বা কলমের জন্য?’
বিভা কিছুটা অবাক হয়ে চুপ করে রয়। আইরিন বেগম ঠোঁটের হাসি চওড়া করে বলল,
‘আফিন প্রায় স্টুডেন্টদের সাইনপেন, কলমের জন্য আমার কাছে পাঠায়। একটু ওয়েট করো দিচ্ছি।’ বলে তিনি তার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন। ঢয়ার খুলে দেখলেন সাইনপেনের প্যাকেট নেই। তিনি ফিরে এসে বললেন,
‘বোধহয় আবির নিয়েছে। ওর রুমে গিয়ে চাও দিয়ে দিবে।’
কথাটা শুনে বিভা বিরক্ত হলো। কিন্তু সেটা তার সামনে প্রকাশ করল না। নেতিবাচক মাথা নাচিয়ে বের হয়ে এলো।
‘এখন আবির পাঠার রুমে যেতে হবে ভেবেই রাগ লাগছে বাল।’ আবিরের রুমের সামনে দৃষ্টি নত রেখে দাঁড়ায়। সে আরো ভাবে তাকেই কেন পাঠানো হলো। অন্য কেউকে তো পাঠাতে পারতো। সব সময় তাকেই কেন বাঁশের চিপায় পড়তে হয়। এখন রাগ হয় আফিনের ওপর।
আপাতত এসব সাইডে রেখে পর্দা সরিয়ে দরজায় নক করে।
‘আসতে পারি?’
‘মোটেও না।’ ভেতর থেকে জবাব আসে আবিরের।
‘আফিন স্যার সাইনপেনের জন্য পাঠিয়েছে। সাইপেন নাকি আপনার কাছে আইরিন ম্যাম বলল।’
‘কাম!’
বিভা বড়ো একটা নিশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল। ভেতরে ঢুকে দেখে আবির বিছানায় চিৎ হয়ে ফোন ঘাটছে। পরনে সাদা রঙের সিল্কের গেঞ্জি আর কালো ফুল প্যান্ট। পর্যবেক্ষণ করার পর নজর সরিয়ে নেয়। আবির ফোন রেখে উঠে দাঁড়ায়। বিভার দিকে তাকিয়ে আগাগোড়া দেখে নেয়। বলে,
‘সাইনপেন নিতে হলে ট্যাক্স দিতে হবে।’
বিভা ভ্রু কুঁচকে আবিরের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘এমন কোনো নিয়ম নেই। আর পেন আমার নয় স্যার চেয়েছে।’
‘যে-ই চাক’না কেন। ট্যাক্স দিতে হবে।’
‘আচ্ছা স্যারকে গিয়ে বলছি।’
‘এই না দাঁড়াও দিচ্ছি।’
‘লাইনে এসেছে ট্রেন।’ মনে মনে বলে বিভা।
আবির এক ডজন সাইনপেন আলমারি থেকে বের করে বিভার দিকে এগিয়ে দেয়। বিভা সাইনপেন নিতে নিলে আবির শক্ত করে ধরে রাখে। নজর আবিরের দিকে ফেলতেই দুষ্টু হাসি ঠোঁটে দেখতে পায়। বিভা কন্ঠে তেজ এনে বলে,
‘ছাড়ুন।’
‘ছাড়িয়ে নেও।’ মুচকি হেসে।
বিভা অন্য হাত দিকে আবিরের কব্জিতে চিমটি কাটে। ‘আউচ’ শব্দ তুলে কলম ছেড়ে দেয়। বিভা কলম গুলো নিয়ে দ্রুত বের হতে নিলে আবির এক ছুটে বিভার সামনে এসে দাঁড়ায়। যার দরুন বিভা আবিরের বাহুতে জোরে ধাক্কা খেয়ে পিছন দিকে পড়ে যায়। আবির হো হো করে হাসতে শুরু করে। বিভা কটমট চোখে তাকায়। উঠে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে।
আবির হেসে হেসে বলে,
‘অতি চালাকে পায়ে দড়ি।’
‘সরুন সামনে থেকে।’ ঝাড়ি দিয়ে বলে বিভা।
আবির হাসি থামিয়ে হাত টুকু পিছনে নিয়ে বিভার দিকে একটু ঝুঁকে বলে,
‘না সরলে কি করবে?’
বিভা পিছনে সরে গিয়ে বলে,
‘চিৎকার দিবো।’
‘হাহ! মানসম্মান তোমার যাবে আমার না। কারণ এটা আমার বাড়ি, আর তুমি এখন আমার রুমে আছো।’ তাচ্ছিল্য করে বলে।
‘আপনি খারাপ এটা জানতাম, এতটা খারাপ সেটা বুঝি নি।’ ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলে।
‘বুঝে নেও, দেখে নেও।’
‘সরুন সামনে থেকে দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
‘তাতে আমার গেঞ্জি ছেঁড়া গেল।’
বিভা দরজার ডান দিকে এগিয়ে গেলে হাত রেখে আঁটকে দেয় আবির। বাঁ দিক থেকে যাওয়ার সময়ও আবির একই কাজ করে। দু পাশে হাত দিয়ে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছে।
বিভা এবার প্রচণ্ড ক্ষেপে যায়। এমন অহেতুক ফাজলামো তার মোটেও পছন্দ নয়। বলল,
‘এখন কিন্তু বেশি হচ্ছে।’
‘কম হবে, যদি সুন্দর করে স্যরি বলো।’
‘নাহ!’ মুখ ঘুরিয়ে বলে।
‘আমিও নাহ!’ আবিরও উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে।
বিভা কপালে হাত রাখে। আবির বিভার কপি করে কপালে হাত রাখে। আপাতত নিজেকে শান্ত স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। রাগ ফেলে বলে,
‘স্যরি! এবার যেতে দিন।’
‘উঁমম! যাও।’ বলে সরে দাঁড়ায়। বিভা এগিয়ে আসলে আবির পুনরায় দরজার কাছে হাত রাখে। এবার আর নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না বিভা। হাতে কামড় বসিয়ে দেয়। আবির আস্তে করে চিৎকার দিয়ে বিভাকে ধরতে যাবে ওমনি ধাক্কা মেরে পালিয়ে যায়। আবির দু কদম সরে গিয়ে হাত ঝাড়তে শুরু করে। বিভার পালানো দেখে ফিক করে হেসে দেয়। বিভাকে ছোটখাটো টর্চার করে প্রচণ্ড মজা পাচ্ছে আবির।
______
সাথীর অপারেশন কাল সম্পূর্ণ হয়েছে। এখন তার কাছে ওর মা এবং ববি রয়েছে। মেনেজার কয়েকবার এসে দেখে গিয়েছে। গার্মেন্টসের কর্মচারীরাও এসেছিল। ফলমূল দিয়ে গেছে। ববি বেশ খুশি হয় এই ফ্যাক্টরির মালিকের ওপর৷ তাদের জন্যই সাথীর জীবন বেঁচে গেছে। আল্লাহ রহম করেছে। ববি আরো কিছুক্ষণ থেকে ফ্যাক্টরিতে আসে।
কাজ শুরু করার জন্য। পথিমধ্যে আকবর আলির সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। তাকে দেখে মনে হচ্ছে ববির জন্যই এতক্ষণ অপেক্ষা করেছিল।
‘বেবি শোনো।’
‘ববি!’ বিরক্ত নিয়ে বলে তার নামটি।
‘কি যে করমু কও। খালি ভুইল্লা যাই।’ হেসে বললেন।
‘কিছু বলবেন?’
‘হয়, কইতে তো চাই কত কিছু, তুমি কি হুনবা?’
‘তাড়াতাড়ি বলুন।’
‘আমি তোমারে প্রথম দিন দেইখা ভালোবাইসা ফালাইছি। বিয়া করতে চাই তোমারে।’
নিমিষেই ববির মেজাজ চড়ে যায়। তবুও নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে বলে,
‘বাবার বয়সি লোক হয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতে আপনার লজ্জা করেনা।’
‘লজ্জা করব ক্যা? তুমি কি আমার মাইয়া নাকি। ভাইবা দেখো। আমারে বিয়া করলে রাজরানীর মতো থাকবা।’
‘ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ লাখ টাকার স্বপ্ন আমি দেখিনা। সেখানে রাজরানীর হবার কথা দূর থাক। আর আপনি কীভাবে ভেবে নিলেন আপনার প্রস্তাবে আমি রাজি হবো। সাফসাফ বলে দিচ্ছি, পরর্বতীতে আমাকে বিয়ের কথা বললে পরিণতি ভালো হবে না।’ বলে ববি দ্রুতগতিতে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। আকবর আলি ববির যাওয়ার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় ক্রোধ চোখে। বিড়বিড় করে আওড়ায়,
‘পরিণত তোমার ভালো হইবো না, দেইখা নিও বেবি।’
_________________
পড়া শেষে বিভাকে হেঁটে হেঁটে বাড়িতে ফিরতে হয়। কারণ হাতে টাকা নেই। বাহিরে বেশ ঠান্ডা। রৌদের তাপমাত্রা এতটাও প্রখর নয়। লোকজনও তেমন নেই বললেই চলে। ধীরেধীরে হেঁটে চলেছে সে। আবিরের সঙ্গে তখনকার ঘটনার কথা ভেবে ক্ষুব্ধ রাগ জমাট বাঁধে মনে। কেন জানি আবিরকে সে মেনে নিতে পারছে না। সব কিছুতেই তার বাড়াবাড়ি একদম সহ্য হয় না তার। হঠাৎ মাঝপথে বিভার সামনে একটি বাইক এসে থামে। চকিতে তাকায় বিভা। সঙ্গে তীব্র পারফিউমের সুগন্ধ ভেবে আসে। হেলমেট সরানোর পর চেহারা নজরে আসে। আবির! বিভা ইগনোর করে চলে যেতে চাইলে আবির বলে,
‘হেই ব্রাইট কুইন চলো বাসায় নামিয়ে দেই।’
‘দরকার নেই।’ কপট রাগ নিয়ে বলে।
‘হোয়াই ব্রাইট কুইন?’
বিভা আবিরের পানে তাকায়। প্রথম দিনের ঘটনা তার মনে পড়ে। একটু দম নিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
‘আমি জানি না প্রথম দিনের জন্য আপনি আমার উপর এখনো রেগে আছেন কি-না। তবে সেদিনের জন্য আমি দুঃখিত! আমার ওভাবে বলা উচিত হয়নি। রাগের বশে বলে ফেলেছি। আমার সেই ভুলটি যদি আপনি ধরে রাখেন। এবং ভবিষ্যতে আমার ওপর প্রতিশোধ নেবার চিন্তাভাবনা করেন, আমি বাঁধা দিবো না। এমনটাই হয়ে আসছে। গল্পে, নাটকে, মুভিতে এবং-কি বাস্তবেও। আমি গরীব ঘরের মেয়ে। গরীবদের শুধু বড়োলোক হবার স্বপ্ন থাকে না, বড়ো কিছু হবারও স্বপ্ন তারা দেখে। বড়ো বোন পরিশ্রমের উপার্জিত টাকা ব্যয় করে আমাকে পড়াশোনা করাচ্ছে। তার স্বপ্ন আমি বড়ো কিছু হবো। আমি চাইনা সেই স্বপ্নটা মাঝ পথে কোনো কারণে ভেঙে যাক। আমাকে মাফ করবেন। আমি এটাও চাইনা আমাদের মাঝে কোনো দ্বন্দ্ব থাকুক। আশা করি আমার কথা বুঝতে পেরেছেন। স্যরি।’ কথা গুলো শেষ করে এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না। নিজের গন্তব্যে হাঁটতে শুরু করে।
.
.
.
#চলবে?