বাঁধিব হৃদয়ে তোমায় পর্ব-০৭+০৮

0
283

#বাঁধিব হৃদয়ে তোমায়
#পর্ব-০৭+০৮
#সুমাইয়া মনি

বিরতিহীন ফোন বেজে চলেছে আবিরের। ফোন ধরার কোনো ইচ্ছে নেই তার। সামিম কল দিয়েছে। আবির চোখ বন্ধ করে কাঁপালে হাত রেখে শুয়ে রয়েছে। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করে রাগী কন্ঠে বলল,
‘কল দিচ্ছিস কেন? দেখছিস না আমি ধরছি না। তবুও কল দিয়ে যাচ্ছিস। ফোন দিবি না আর।’ বলেই ফোন কেঁটে দিয়ে পাশে রেখে দেয়। আবার সেই আগের ন্যায় শুইয়ে থাকে।
আফিন প্রবেশ করে। রুমে যাওয়ার সময় বাহির থেকে আবিরের তেজি কণ্ঠ শুনতে পায়। তিনদিন ধরে আফিন লক্ষ্য করছে আবির কেমন গোমড়া হয়ে থাকে। ঠিক মতো কথা বলে না। খাওয়া দাওয়ায় মন নেই। পড়তেও বসছে না। আগে প্রায় সময় কলেজের অফিস কক্ষে, তার সঙ্গে বসে গল্প করতো। এখন কলেজেও দেখা যায় না। সারাদিন রুমেই থাকে। নিজেকে কেমন আড়াল করে রাখছে সবার থেকে। আফিন আবিরের পাশে এসে বসে। আবির চোখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে ভাইকে দেখে তড়িঘড়ি করে উঠে বসে কৃত্রিম হেসে জিজ্ঞেস করে,
‘কিছু বলবে ভাইয়া?’
‘বলবি তো তুই। কি হয়েছে তোর সেই বিষয়ে।’
‘কই? কিছু হয়নি তো ভাইয়া। আমি ঠিক আছি।’
‘মিথ্যা বলার চেষ্টা করিস না।’
‘সত্যি বলছি ভাইয়া।’
‘বৃথাতর্ক করিস না আবির। সত্যি বল কি হয়েছে। যদি কোনো সাহায্য করতে পারি আমি তোর।’
আবিরের ঠোঁটের হাসি মিলে যায়। দৃষ্টি নত রেখে নির্বাক কণ্ঠে বলল,
‘আমি বিভাকে ভালোবেসে ফেলেছি ভাইয়া।’
‘ভালো খবর। বিভা কি জানে?’
আবির বিভার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ছোট্ট ঘটনাটি উল্লেখ করে। আফিন মৌন রয়ে বলে উঠে,
‘ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে। বিভা তোকে ভালোবাসে না সেটা বলেছে?’
‘নাহ! তবে ও আমাকে পছন্দ করে না, এটা শিওর।’
‘হুমম, বিভার বড়ো বোনের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল ক’দিন আগে।’
‘কীভাবে?’
‘অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে ভুলবশত সে আমার গাড়ির সামনে এসে পড়েছিল।’
‘বিভার মতোই কি তার বড়ো বোন?’
‘নাহ! একদম আলাদা। একটা কাজ কর তুই। বিভার পিছনে আঠার মতো লেগে থাক। ভালোবাসায় থাপ্পড়, বকাঝকা এগুলো কমন বিষয়।’
‘দূরে থাকতে বলেছে ভাইয়া।’ মুখ মলিন করে বলল আবির।
‘হ্যাঁ! তুই দূরে থাকবি। দূরে থেকে কি ভালোবাসা যায় না, অবশ্যই যায়। কিন্তু চেষ্টা করতে হবে। ফিল্ম, ড্রামা তো কম দেখিস নি। রোমান্টিক সিনেমা দেখ আইডিয়া পেয়ে যাবি।’
‘আচ্ছা।’
‘আমি গেলাম। জল কতদূর গড়ালো আমাকে বলিস কিন্তু। আর হ্যাঁ! আমি তোর পক্ষে আছি।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’ মৃদু হেসে বলল আবির।
আফিন হেসে আবিরের গালে আলতো হাত রেখে চলে যায়।
আবির অনেকটা ভরসা পায়। বুকে সাহস সঞ্চয় হয়। ল্যাপটপ নিয়ে বসে রোমান্টিক মুভি বা ড্রামা দেখার জন্য। যদি কোনো আইডিয়া পেয়ে যায়।
___
গাছের নিচে বসে আলাপনে ব্যস্ত দুই বান্ধবী। কথার টপিক আবিরকে নিয়ে। তিনদিন ধরে আবিরকে বিভা দেখতে পাচ্ছে না। এবং-কি বাড়িতে পড়তে যাওয়ার সময়ও নজরে পড়েনি। এই জন্য বিভা স্বস্তি পাচ্ছে। এতে তার কোনো মাথাব্যথাও নেই।
‘এক রাউন্ডে ছক্কা মেরে দিয়েছি মোহনা। এই তিনদিনে আবির বদটাকে একবারও দেখিনি।’ হেসে বলল বিভা।
‘দেখ, পিছু ছাড়লে তো ভালোই হয়।’ অন্যমনস্ক হয়ে বলল।
‘ছাড়তেই হবে। কত বড়ো বেহায়া পোলা ওড়না ধরে টানাটানি করে।’
‘আবিরের কোনো খারাপ রেকর্ড কলেজে নেই। তোর ওড়না ধরে টান দিয়েছে, মেনে নিতে একটু কষ্ট হচ্ছে।’
‘তাহলে কি আমি মিথ্যে কথা বলছি।’ মেকি রাগ নিয়ে বলল বিভা।
‘একদমই না। কিন্তু এই ঘটনায় কতটা সত্যতা আছে, সেটা বুঝতে পারছি না।’ দু কাঁধ উঁচু করে বলে মোহনা।
‘বোঝা লাগবে না তোর। দেখে নিস আবির পাঠায় আমার সামনেও আসবে না।’ কনফিডেন্স নিয়ে বলল বিভা।
‘দেখি।’
‘এক্সকিউজ মি বিভা আপু।’ মেয়েলী কণ্ঠের স্বর শুনে দু’জনে ঘুরে তাকিয়ে দেখে একটি মেয়ে এক গুচ্ছ গোলাপ ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
বিভা জবাব দিল,
‘হ্যাঁ! বলুন।’
‘এই গোলাপ ফুলগুলো আবির ভাইয়া আপনার জন্য পাঠিয়েছে।’ কথাটা বলে ফুল এগিয়ে দিল বিভার দিকে।
বিভা হতবাক দৃষ্টিতে মেয়েটির হাতের দিকে তাকিয়ে আছে।
মোহনা মুখ টিপে হাসতে লাগলো। এই মাত্র বলা কথা বিভার বিফলে গেল। বিভা এটা দেখে রাগ নিয়ে বলল,
‘তোমার আবির ভাইয়া কোথায় বলতে পারো?’
‘ঐতো..’ বলেই তিনতলা ভবনের দিকে ইশা করল মেয়েটি।
বিভা, মোহনা সেদিকে তাকায়। আবির বিভার চাহনি দেখে হাত নাড়িয়ে ‘হাই’ জানায়। বিভা রেগে যায়। ছোঁ মেরে ফুল গুলো নিয়ে দ্রুত এগিয়ে যায় ভবনের দিকে। মোহনা ডেকে থামানোর বৃথা চেষ্টা করে একবার। রেগে থপথপ পা ফেলে বিভা তিনতলা ভবনে সিঁড়ি বেয়ে উঠে। আবির বিভাকে আসতে দেখে পকেটে হাত পুরে ভারী মুড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। চোখে ছিল কালো রঙের সানগ্লাস। বিভা এগিয়ে এসে কাঠ কাঠ কন্ঠে বলল,
‘এটা কী?’ বলেই ফুলগুলো আবিরের পায়ের কাছে ছুঁড়ে দিল। আবিরের তাতে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। ঠোঁটে মৃদু হাসি রেখে বিভার পানে চেয়ে আছে। সে আবার বলল,
‘বলেছিলাম না আমার থেকে দূরে থাকবেন।’
‘দূরেই তো ছিলাম। কাছে তুমি এসেছো।’ একটু বিভার দিকে ঝুঁকে আস্তে করে বলে।
বিভা থমথমে খেয়ে যায় আবিরের কথায়। তবুও হার মানে না। বলল,
‘দূরে থাকা মানে, এখান থেকে ঐখানে না। আমার চোখের সামনে থেকে দূরে তাকতে বলেছি।’
‘এটা তো বলো নি মাই ভাবী বেবি।’
‘বিভা আমার নাম, কোনো ভাবী-টাবী না।’
‘তার মানে তুমি চাও আমি তোমাকে বিভা বেবি বলে ডাকি।’
‘চুপ করুন।’ ধমক দিয়ে বলল বিভা।
আবির ঠোঁটে আঙুল রেখে ‘চুপ’ উচ্চারণ করল। যেটা দেখে বিভা দ্বিগুণ ক্ষেপে যায়। তেজি কণ্ঠে বলল,
‘দেখুন,আমি…’
বাকিটা বলার আগে আবির মুখ দিয়ে দু বার গোঙ্গানির শব্দ বের করল। আবিরের এমন ব্যবহার দেখে ভ্রু জোড়ায় ভাঁজ ফেলে বলে,
‘কি হলো? মুখে ঠাডা পড়েছে।’
‘তুমিই তো চুপ থাকতে বললে। বাই দ্যা এই সেই, তোমাকে দেখতে হলে কি সানগ্লাস খুলতে হবে?’
‘দেখতে হলে মানে….’ কথাটা বলেই বুঝে যায় বিভা কেন বলেছে আবির, রেগে নাকের পাটা ফুলিয়ে চোখের ওপর হাত রাখে। যেটা দেখে আবির মুচকি মুচকি হাসে। রাগে গা জ্বলছে তার। বলে,
‘আমি আপনাকে সাফসাফা বলে দিচ্ছি। আমার থেকে আপনি একদম দূরে থাকবেন। চোখের সামনেও যেন না দেখি।’
‘এখন থেকে পিছনে থাকবো। মাথার পিছনে তো আর চোখ নেই।’
‘আপনি একটা অসহ্যকর লোক।’
‘মাত্র? আচ্ছা এই সানগ্লাসটা দেখো, প্রথম দিন যেটা ভেঙে ছিলে সেইম।’ সানগ্লাস খুলে বিভার সামনে ধরে বলল।
বিভা হাত থেকে নিয়ে তিনতলা থেকে ফেলে দিলো। আবির তাতেও কোনো রেসপন্স করে না। বিনিময় হাসে। যেন সে বিভার এমন কর্মকাণ্ডের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। বিভা আরো ক্ষেপে যায়। দাঁত কিড়মিড় করে তাকিয়ে স্থান ত্যাগ করে। বিভার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আবির হাসে।
সামিম, জামিলা, মারুফ ক্লাসরুমে বসে এসব দেখছিল। তারা অবাক না হয়ে পারছে না৷ যেখানে আবির মেয়েদের পাত্তা দেয় না। সেখানে কি-না তাকেই বিভা পাত্তা দিচ্ছে না। প্রেমে পড়লে নাকি মানুষ পাগলে পরিনত হয় বলে শুনেছে। আবির তাঁর চাক্ষুষ সাক্ষী।

প্রাইভেটে আসার পর বিভার মেজাজ তুঙ্গে উঠে যায়। যার মূল কারণ আবির। আজ আফিনকে সরিয়ে সে নিজে থেকেই তাদের পড়াতে এসেছে। অবশ্য সবাইকে আফিনের গুরুত্বপূর্ণ কাজের বাহানাও দিয়েছে। সকলের এতে আপত্তি না থাকলেও, বিভার ঘোর আপত্তি আছে। সে জানে ওর জন্যই আবির ইচ্ছে করে করেছে এটি। সবাইকে বললে হয়তো কেউ এ কথা বিশ্বাস করবে না। প্রথমে কয়েকটা অঙ্ক বোর্ডে করিয়ে বুঝিয়ে দেয়। তারপরই নিজের ফইরামগিরি দেখাতে আরম্ভ করে।
‘একটি গাছের ডালে তিনটি দোয়েল পাখি ছিল। পাখি তিনটি উড়ে, বাকি কয়টা থাকে? বিভা তুমি বলো।’ বিভার উদ্দেশ্যে বলল আবির।

এমনে তো ক্লাস ওয়ান, টুয়ের অঙ্কের প্রশ্ন করছে। তার ওপর তাকেই জিজ্ঞেস করল। বাকি সবাই থাকতে তাকেই শুধু নজরে পড়ে। সবই কঁপাল ভেবে বিভা উঠে দাঁড়ায়। বিরক্ত নিয়ে বলে,
‘একটিও থাকবে না পাখি।’
‘কেন?’
‘কারণ তিনটি পাখি উড়ে গেছে।’
‘আচ্ছা আমি কি বলেছি পাখি তিনটি উড়ে গেছে? আমি শুধু বলেছি পাখি তিনটি উড়ে।’ আবির দু হাত দু দিকে দিয়ে উড়ন্ত অভিনয় করে দেখিয়ে বলল।
সকলে উচ্চস্বরে হেসে ফেলে। বিভা রাগে ফুঁসছে । বিড়বিড় করে আওড়ায় ‘কল্লা বলেছে।’
‘এগুলো হচ্ছে সাধারণ জ্ঞান। যেগুলো মাথায় গোবর আলা মেয়েরা বুঝে না।’
মাথায় গোবর বলাতে তেলেবেগুনে ক্ষেপে যায় বিভা। এ নিয়ে দু’বার ওঁকে বোকা বানাল। সবার সামনে লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হলো আবার।
_____
‘আফা আমি কঁপাল জোরে বাঁইচা গেছি। যদি না কোম্পানির মালিকে আমারে সাহায্য করতো, তয় আমার মরা লাগতো। খুব ভালো এই কোম্পানির মালিক।’ কান্না জড়িত কন্ঠে মেয়েটি ববিকে বলল। অপারেশন হবার পর ববি মেয়েটিকে আজ দেখতে এসেছে। সঙ্গে আরো দু’জন মেয়েও ছিল।
ববি মেয়েটিকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
‘হুম, আপাতত নিজের দিকে খেয়াল রেখো। আল্লাহর রহমতে সাথীর মতো দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে।’
‘দোয়া কইরেন আমার জন্য আফা।’
‘আচ্ছা। আমি এখন গেলাম।’
‘আইচ্ছা, আবার আইয়েন আফা।’
‘আসব।’
ববি বেরিয়ে আসে। ওর সঙ্গে মেয়ে দু’জনও বের হয়। তিনজনে এক সঙ্গে কথা বলতে বলতে বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
.
.
.
#চলবে?

#বাঁধিব_হৃদয়ে_তোমায়
#পর্ব_০৮
#সুমাইয়া মনি

কলেজে আসার পরপরই বিভা লক্ষ্য করে সকল স্টুডেন্ট কেমন বাঁকা নজরে তাকাচ্ছে। বিভা এটা দেখেও না দেখান ভান ধরে ক্লাসরুমে আসে। ক্লাসরুমে এসেও সবাই ওঁকে দেখে কানে কানে ফিসফিস করে কিছু একটা বলাবলি করছে। বিভা বিরক্ত হয়ে যায়। হঠাৎ করে এমন পরিস্থিতি সে মেনে নিতে পারছে না। কিছুক্ষণ বাদে মোহনা আসে। বিভা কিছুটা হলেও স্বস্তি পায় ওঁকে দেখে। মোহনা পাশে এসে বসে। বিভা নির্মল কণ্ঠে বলে,
‘সবাই আমাকে দেখে এমন রিয়েক্ট করছে কেন? আমি কি কোনো খুন করেছি নাকি।’
‘তোর আপু গার্মেন্টসে চাকরি করে ব্যাপারটা সবাই জেনে গেছে। তাই কানাঘুষা করছে।’
‘এখানে খারাপের কি হলো?’
‘তুই আমি সেটা খারাপ না বুঝলেও ল, অন্যরা তো সেটা খারাপ বুঝছে, ভাবছে। এই কলেজ বেশ নাম করা। এখানে বড়োলোক ঘরের ছেলেমেয়েই বেশি পড়তে আসে। তোর পয়েন্ট ভালো ছিল তাই এডমিশন নিতে সমস্যা হইনি। এ ছাড়া গরিব ঘরের ছেলেমেয়েরা কমই আছে এ কলেজে।’
‘গরীব বলে কি আমরা মানুষ নই?’
‘বিভা দেখ…’ বাকি কথা শেষ করার আগেই আবির তীব্র রাগ নিয়ে ক্লাসরুমে প্রবেশ করে। ওঁকে দেখে সকলের ফিসফিসানি বন্ধ হয়ে যায়। রাগী দৃষ্টিতে সকলের দিকে একবার তাকিয়ে বিভার হাত ধরে ক্লাসরুম থেকে বের করে নিয়ে যায়। অকস্মাৎ ঘটনায় বিভা সহ বাকি সকলে অবাক। বিভা ক্রোধ কণ্ঠে বলে উঠে,
‘কি করছেন হাত ছাড়ুন।’
আবির বিভার কথা কানে নেয় না। বড়ো বড়ো পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। বিভা আবিরের রাগান্বিত আদল দেখে নিজেও ভড়কে যায়। হঠাৎ এভাবে রেগে যাওয়ার কারণ বোঝার চেষ্টা করছে। এমন কিছু সে করেনি, যার ফলে আবির এতটা রেখে যাবে। নিরুত্তর থেকে যায় বিভা। আবির বিভাকে টানতে টানতে মাঠের মাঝ বরাবর নিয়ে আসে। সেখানে আগে থেকে জামিলা, সামিম, মারুফ থেকেই উপস্থিত ছিল। বিভার হাত ছেড়ে আবির মারুফের হাত থেকে মাইকটি নেয়।
এই ঘটনায় অনেকই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। বাকি দের আবির মাইকের সাহায্যে ডাকে।
‘এই কলেজের সকল স্টুডেন্টদের উদ্দেশ্য করে বলছি। বিভার বোন গার্মেন্টসের একজন দক্ষ শ্রমিক হিসাবে কাজ করে, কোনো আবাসিক হোটেলের পতিতা হিসাবে নয়।’

বিভা আবিরের মুখে এরূপ কথা শুনে চমকে যায়। অপমানে দৃষ্টি নত করে রাখে। আবির পুনোরায় বলল,
‘তোমদের মতো কিছু বড়োলোক ঘরের স্টুডেন্ট রা গরীবের কাজের মর্ম কী করে বুঝবে। ছোট বলে কোনো কাজ নেই। কাজ তো কাজই হয়। পেটের দায়ে মানুষ ভিক্ষা করে সেটাও এক ধরনের কাজের মধ্যেই পড়ে। বিভা ও তার বোনকে নিয়ে কটুক্তি করা বন্ধ করো। যে এই নিউজটি ছড়িয়েছে, তাকে শীঘ্রই ধরা হবে। আর রইলো বিভার সাপোর্ট নিয়ে আমি কেন কথা বলছি। কারণ বিভা আমার ভালোবাসা, আমার প্রেয়সী। প্রেয়সীর ওপর আঙুল তুলে কেউ কথা বলবে আমি সেটা মানতে প্রস্তুত নই। কথাটি মনে রাখবে সবাই।’ এতটুকু বলে আবির থেমে যায়।
বিভা অপমানে, রাগে, কষ্টে কেঁদে মাঠ ত্যাগ করে। দৌঁড়ে কলেজের পিছনের বাগানে ছুঁড়ে আছে। আবির বিভার পিছনে আসে। বাহু ধরে নিজের দিকে ঘুরাবার সঙ্গে সঙ্গে বিভা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। কান্না আটকে বলে,
‘দরকার কি ছিল আপুর বিষয় বলার। যে যা ভাবছে ভাবুক। আর আপনার ভালোবাসার কথা…। একটু আগে আমাকে সবাই কি নজরে দেখতো জানি না। কিন্তু এখন….’
‘এখন তোমাকে কটু দৃষ্টিতে কেউ দেখবে না। যদি কেউ তাকায়ও চোখ উপ্রে ফেলবো।’ রেগে বলল আবির।
‘কেন আমার পিছু পড়ে আছেন? সবার সামনে ভালোবাসার কথা কেন বললেন?’
‘যেটা সত্যি, যেটাই বলেছি। আমার হৃদয়ে তাকেই বাঁধিব যাকে আমার মন চাইবে। পরবর্তীতে এঁরা তোমার বিষয় কিছু বলার আগে আমার কথা একবার হলেও ভাববে।’
‘অনেক করেছেন আর না। প্লিজ আপনি আমার জীবন থেকে সরে যান। আপু যদি এগুলো জানতে পারে কষ্ট পাবে, পড়াশোনা বন্ধ করে দিবে।’ মিনতীর স্বরে বলল।
‘কিচ্ছু হবে না। আমার ওপর ভরসা রাখো বিভা। তোমার উপর থেকে মুভ অন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এই কথাটি যেন দ্বিতীয় বার না শুনি।’
কান্নারত চোখে আবিরের দিকে তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে আসে। আবির আটকায় না। এমুহূর্তে বিভাকে একা ছেড়ে দেওয়াই ভালো বলে মনে করে।

কিছুক্ষণ পর….

‘তুই যা করেছিস, ঠিক করেছিল আবির। আম্মু, প্রিন্সিপাল স্যারকে আমি ম্যানেজ করে নিবো।’ আফিন আবিরের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল।
‘ভাইয়া আমি কলেজে এসে বন্ধুদের মুখে এসব শুনে নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। ভালোবাসার মানুষটির পরিবার নিয়ে খারাপ মন্তব্য ছড়াবে, আমি সেটা মেনে নিবো না। আসল দোষীকে পাইনি, যে বদনাম ছড়িয়েছে।’ তেজি কণ্ঠে বলল আবির।
আফিন আবিরকে শান্ত কন্ঠে বলল,
‘রাগ নিয়ন্ত্রণ কর। তবে বিভাকে ভালোবাসার বিষয়টি না বললেও হতো আবির। এতে বিভা অনেকটা লজ্জা পেয়েছে।’
‘আমি চাই না বিভার নজর কারো উপর পড়ুক। তাই সবাইকে ওয়ার্ন করেছি। তুমি একটু এই দিকটা সামলে নেও ভাইয়া।’
‘নিবো। তুই বাড়িতে যাহ!’
‘বিভার সঙ্গে কথা বলে তারপর যাব।’
‘প্রাইভেটে যাওয়ার পর কথা বলিস। এখন বাড়িতে ফির।’
আবির কিছু বলে না। আফিনের কথায় সে বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়। এদিকে বিভা কোনোমতে ক্লাস শেষ করেছে। আবিরের ভয়তে ক্লাসের কোনো স্টুডেন্ট ওর দিকে তাকানোর সাহস করেনি। এটা ভয় হিসাবে নিবে, নাকি রেসপেক্টের হিসাবে নিবে, বুঝা মুসকিল তার পক্ষে।
আজ বিভা প্রাইভেটে না গিয়ে বাড়িতে চলে আসে।

বিভার মুখ কালো দেখে বিলকিস বানু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করে না। হয়তো স্যার বকাঝকা করেছে এই জন্য মুখ মলিন হয়ে আছে। পরে ঠিক হয়ে যাবে ভেবে কিছু বলল না।
____
মেশিন চালানোর সময় মাথা কেমন ঘুরে আসে ববির। কাজ অফ রেখে ব্যাগের ভেতর থেকে পানি খেয়ে নেয়। চোখেমুখে পানি দেওয়ার জন্য বাথরুমে আসে। কয়েকবার পানির ঝাঁপটা দিয়ে রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসে বাহিরে। সামনে এগিয়ে যেতেই আকবর আলি আগের ন্যায় আজও পথরোধ করে দাঁড়ায়। ববি কিছুটা হকচকিয়ে উঠে। এই দিকটায় তেমন কেউ ছিল না। যে যার সিপ্টে কাজ করতে ব্যস্ত ছিল। সেটারই ফায়দা উঠিয়েছেন তিনি। ববি কণ্ঠে তেজ এনে শুধায়,
‘কি হলো, পথ আঁটকলেন কেন?’
‘কথা কমু তাই।’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল।
‘কি কথা বলার আছে বলুন।’
‘শেষ বারের মতো কও, আমারে বিয়া করবা কি-না?’
‘আপনার কঁপার ভালো যে আমি আপনাকে এখনো সম্মান করছি। নয়তো সেদিনই আপনার গালে থাপ্পড় দিতাম।’
‘ববি!’ চেঁচালেন তিনি।
‘চিল্লাবেন না। এতদিন সম্মান করেছি এটাই অনেক বেশি। চোখের সামনে থেকে সরুন। তৃতীয় বার আমার সামনে আসবেন না।’
‘তার মানে তুমি আমার প্রস্তাবে রাজি না?’
‘নাহ! বাংলা কথা বুঝেন না।’ চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলল।
‘আইচ্ছা, আমিও দেখমু তোমার দেমাগ কতদিন থাকে।’ বলেই তিনি চলে গেলেন। ববি রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাঁটতে লাগলো।
মেজাজ খারাপ করার মতো একজন লোক তিনি। মন, মেজাজ বিগড়ে গেছে ববির। সে ব্যাগ নিয়ে বের হয়। আজকে আর কাজ করতে ইচ্ছে করছে না ।
আসার সময় ববি খেয়াল করে অন্য সিপ্টের আরেকটি মেয়েকে ধরাধরি করে মেডিকেলে নিয়ে যাচ্ছে। ববি অবাক হয়। এই মাসে এই মেয়েটিকে নিয়ে তিনজন মেয়ে অসুস্থ হলো। আগের মাসে নাকি অসংখ্য মেয়ে অসুস্থ হয়েছে। তাদের অপারেশন করানো হয়েছে কি-না সে ববি জানে না। তার কাছে বিষয়টি ঘোলাটে লাগে। মাথা ব্যথা করার ফলে আপাতত সে এসব না ভেবে বাসায় ফিরে। পরে একদিন এই বিষয়ে খোঁজ লাগবে বলে ভাবে।
____
বিভা আজ প্রাইভেটে আসেনি। এতে আবির প্রায় পাগলের মতো বিহেভ করতে থাকে। একটু কথা বলার জন্য মন ছটফট করছে। ফোনও ব্যবহার করে না যে কল দিবে। সে সিদ্ধান্ত নেয় বিভাকে একটি ফোন কিনে দিবে। নিচে এসে মোহনাকে বিভার না আসার কারণ জিজ্ঞেস করতেই ‘ওর ভালো লাগছে না’ বিষয়টি জানায়। ক্রেডিট কার্ড নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয় আবির।

সন্ধ্যার দিকে আকাশে মেঘ জমে। মাগরিবের নামাজ শেষ হতেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করেছে। এই শীতের মৌসুমেও বর্ষার উৎপাত একদমই না পছন্দ বিভার। ববি শুয়ে আছে। মাথা ব্যথা এখনো কমেনি। বিলকিস বানু কাঁথা সেলাই করছে। এখনো বিভার মনে সকালের ঘটনা উঁকি দিচ্ছে। বিভা নিজে থেকেই বলতে চেয়েছিল ববিকে। কিন্তু ববির অসুস্থতার কারণে আর বলা হয় না। পড়াতে মন দিতে পারছে না। না চাইতেও আবিরের কথা গুলো কানে পুনোরায় বাজচ্ছে। প্রাইভেটে যায়নি শুধু আবিরের জন্য। হয়তো এতক্ষণ সকালের ঘটনা আইরিন ম্যামও জেনে গেছে। কীভাবে তাকে ফেইস করবে এই ভেবে আজকের পড়া মিস করতে হয়। জোরে বৃষ্টি বর্ষিত হবার আগেই বিলকিস বানু জানালার কপাট দিতে বলে। বিভা এগিয়ে যায় জানালার দিকে। বাহিরে দৃষ্টি পড়তেই সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠে আবিরকে দেখে। এক হাতে ধরে রেখেছে গোলাপি রঙের ছাতা। অন্য হাতে কিছু একটা রয়েছে।
আদল জুড়ে ছেঁয়ে আছে এক রাশ খুশির ঝিলিক। তবে কি তাকে দেখেই ঝিলিক ধরেছে আদলে। এই ছেলের সাহস দেখে বিভা বিস্মিত! সে বিস্ময় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। দ্রুত জানালার কপাট লাগাতে নিলে আবির জানালা শক্ত করে ধরে ফেলে। বিভার দিকে এগিয়ে দেয় হাতের বাক্সটি। বিভার ভয়তে রূহ যেন নেড়ে উঠলো। তবে ভেতরটা সম্মোহনী এক অনুভূতিতে ছেয়ে যাচ্ছে। অনুভূতিটা বলে বুঝানোর মতো নয়। আবির চুপিসারে বলল,
‘এটা নেও, নয়তো চেঁচাবো।’
আবিরের এমন নরম ধমক বার্তা বিভার ভয়ের রেশ আরো দ্বিগুণ বাড়িয়ে তুলে। যদি একবার মা দেখতে পায় কঁপালে শনি আছে ভেবে ঢোক গিলে। উপায় না পেয়ে বিভা বাক্সটি নিয়ে ওড়নার নিচে লুকিয়ে ফেলে জানালা আটকে দেয়।
দ্রুত এগিয়ে আসে পড়ার টেবিলের দিকে। মায়ের দিকে একবার দৃষ্টিপাত ফেলে ওড়না থেকে বের করে ব্যাগের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখে। বুকে হাত রেখে অনুভব করে বুক এখনো ধুকপুক করছে। গলা শুঁকানো। তৃষ্ণা পেয়েছে। পানি খাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায়।
.
.
.
#চলবে?