বাঁধিব হৃদয়ে তোমায় পর্ব-১৩+১৪

0
265

#বাঁধিব হৃদয়ে তোমায়
#পর্ব-১৩+১৪
#সুমাইয়া মনি

বিশাল সাগরে কূলকিনারাহীন নৌকা যেমন দিনের পর দিন ভেসে বেড়ায় অজানা পথে। তেমনই মানুষের জীবনের সুখসাচ্ছন্দ্যের প্রতীক যখন মুছে যায়। বেঁচে থাকার আশা ভেতর থেকে দুমড়েমুচড়ে মরে যায়। বিভার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রদীপ দু’টি নিভে গেছে।
প্রিয় মানুষদের হারিয়ে আজ সে নিঃস্ব! বেঁচে থাকার আলোয় আঁধারের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছে। এক সপ্তাহের বেশি হলো নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখেছে। আপাতত সে আবিরদের বাড়িতে আছে। সেদিনের পর থেকে তাদের বাড়িতে পা রাখে নি। আবির যেতে দেয় নি। আগের বিভা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। ঘুম, খাওয়াদাওয়া, কথা বলা টোটালি সব বন্ধ হয়ে গেছে। শুঁকিয়ে গেছে অনেকটা। আবির বহু কষ্টে জোর করে দু তিন লোকমা ভাত ছাড়া এর বেশি খাওয়াতে পারে নি। প্রিয় মামুষটির এমন দুঃক্ষে সে নিজেও মাঝেমধ্যে ডিপ্রেশনে থাকে। মোহনা কয়েকবার এসে দেখা করে গিয়েছে। ওর সঙ্গেও বিভা কথা বলে না। বান্ধবীর এমন অবস্থা দেখে হতাশ হয়ে ফিরে বাড়ি।

জানালার পানে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বিভা। ঘড়িতে রাত এগারোটা ছুঁই ছুঁই। বাহিরে কি যেন একটা নিঁখুত ভাবে দেখছে। আবির গায়ে সুয়েটার নেই দেখে চাদরটি কাঁধের ওপর জড়িয়ে দেয়। করুন চোখে তাকিয়ে পাশে বসে।
শীতল হাত জোড় নিজের গরম হাতের আয়াত্তে নেয়। গালের কাছের চুল গুলো কানে গুঁজে দিয়ে মাথাটা আবিরের কাঁধের ওপর রাখে। বিভা সেভাবেই বসে রয়। আবির কোমল স্বরে বলল,
‘বিভা! তুমি কি বুঝো? তোমার বিরহে আমাকে কতখানি পীড়া দেয়। তুমি কি দেখো? আমার ভালোবাসা কতটা গভীর তোমার প্রতি। আমি যে এভাবে তোমাকে আর দেখতে পারছি না। প্রতিনিয়তে সহ্যশক্তি হারিয়ে ফেলি। হারানোর কষ্ট আমি বুঝি। তবুও কি ফিরে আসা যায় না সেই ক্লেশিত দুনিয়া থেকে। আমি যে তোমাকে ফিরে পেতে চাই। ফিরে পেতে চাই সেই বিভাকে যার রাগ নাকের ডগায় আটকে থাকতো। সেই বিভা, যে কি-না বোনের স্বপ্ন পূরণ করার শপথ নিয়েছিল।’
নিরুত্তর থেকে কথা গুলো শুনে বিভা। না আছে মুখে জবাব, না আছে কথা বলার ইচ্ছে। সে তো এক পাথরে পরিনত হয়েছে। যে পাথর শুধু স্থিতিশীলতায় আবদ্ধ থাকে।
কোনো প্রানীর সংস্পর্শ ছাড়া নড়াচড়া করতে জানে না।
আবির আকাশের দিকে তাকিয়ে বড়ো নিঃশ্বাস টেনে নেয়।
প্রতিদিন এই সময়ে বিভার সঙ্গে খোশগল্প করতে আসে। বিভা চুপটি করে শুধু শুনে। কোনো কথা বলে না। আজও এসেছে এক বুক আশা নিয়ে। হয়তো আজ তার প্রেয়সী কথা বলবে। তার এই সুপ্ত আশাটুকু অপূর্ণ রয়ে গেল। বিভার দিকে নজর ফেলে গালে হাত রাখে। তারপর কোলে তুলে বিছানায় শুইশে গায়ে কম্বল টেনে দেয়। কঁপালে আলতো ঠোঁট ছুঁইছে স্লো ভয়েসে ‘গুড নাইট’ বার্তাটি বলে লাইট অফ করে রুম ত্যাগ করে। বাহিরে বেরোবার পর আফিনের কামবার ওপর নজর পড়ে।

বুক যেন তার আরো ভার হয়ে এলো। আফিন নিজেও বিভার মতো আচরণ করেছিল চার-পাঁচদিন। বহু কষ্টে আবির আইরিন বেগম তাকে সামলিয়েছে। এখন কিছুটা স্বাভাবিক হলেও ববির কথা মনে পড়তেই কবরস্থানের পাশে গিয়ে বসে থাকে। আবির কয়েকবার মায়ের কথা অনুযায়ী সেখান থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল ভাইকে। রুমে প্রবেশ করে আফিনকে টেবিলের উপর একটি আংটির দিকে চেয়ে থাকতে দেখতে পায়।
এই আংটিটি দিয়ে ববিকে প্রপোজ করতে চেয়েছিল আফিন। কিন্তু তার এই ক্ষুদ্র ইচ্ছে পূর্নতা পেল না। সেই মানুষটিই এখন তার জীবনে স্বপ্ন হয়ে থেকে গেছে। না কখনো তাকে ছোঁয়া যাবে, না দেখা যাবে। আবির ভাইকে এমন অবস্থায় দেখতে পারছে না। প্রেয়সীর মতো তার ভাইও তার কাছে প্রিয় একজন ব্যক্তি। মৃদু আওয়াজ তুলে আফিনকে ডাকে,
‘ভাইয়া।’
‘হুম’ বলে ঘুরে তাকিয়ে বলল,
‘কিছু বলবি?’
‘আর কতদিন আপুর স্মৃতি বুকে নিয়ে কষ্ট পাবে?’
‘ববি আমার এমন এক স্মৃতি। যাকে পেয়েও হারিয়ে ফেলেছি। ভালোবাসা প্রকাশ না করেও ভালোবাসা যায়। এটা যে দ্বিগুণ কষ্টদায়ক হয়।’
‘তোমাদের জন্য আমার খুব কষ্ট হয়। একদিকে বিভা, আরেক দিকে তুমি।’ করুন কণ্ঠে বলল।
‘যে হারায়, সে বুঝি হারানোর যন্ত্রণা কতখানি বেদনাদায়ক! ভুলে যাওয়া এত সহজ নয়।’
‘আমি তোমাকে ভুলে যেতে বলছি না। তুমি যাতে আগের লাইফে ফিরে আসো এটাই চাই।’
আফিন নিরুত্তর রয়ে যায়। আবির আর কিছু বলে না। নিজের কক্ষে ফিরে।
_______
মারুফ, জামিলা বাদে আবির ও সামিম দু’জনে একটি টং দোকানে বসে আছে। সামিম ওঁকে ডেকেছে। একটি সাত বছরের ছেলে এসে দু’জনকে চা দিয়ে যায়। সামিম চা পান করছে। আবির অন্যমনস্কভাবে বসে আছে। সামিম চায়ের কাপ পাশে রেখে আবিরকে বলল,
‘চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে আবির।’
আবির চায়ের কাপের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
‘খেতে ইচ্ছে করছে না।’
সামিম বলল,
‘বিভা এখনো এক্সিডেন্ট থেকে বের হতে পারেনি?’
‘নাহ! কারো সঙ্গে কথা বলে না। একা রুমে চুপচাপ বসে থাকে। না খাইয়ে দিলে খাবার খেতে চায় না। মানে একটা শক্ত পাথরে পরিনত হয়েছে বিভা। সামিম আমি যে পারছি না এভাবে বিভাকে দেখতে। কি করব বলতে পারিস? আমার কি করা উচিত?’
‘দোস্ত! তোর কষ্টটা আমি বুঝি রে। কিন্তু করবি কি বল? তুই বুঝতে পারছিস, বিভা ওর জীবনে কি হারিয়েছে? বোনের মৃত্যুর খবর শুনে মা মারা গেল। এ ভুবনে যে আপন বলতে কেউ নেই। এই এতিম মেয়েটিকে তোরই আগলে রাখতে হবে। ভালোবেসে ভুলিয়ে দিতে হবে মনের দুঃখ গুলো।’
‘তুই কি মনে করিস, আমি..আমি চেষ্টা করছি না। একা একা পাশে গিয়ে নিজের মনের ভাব গুলো প্রকাশ করি। ও তো চুপচাপ শুনে। অন্যদিনের মতো যদি হতো, এতক্ষণ অনেক বকা শুনতাম ওর কাছ থেকে। আমি যে সেই বিভাকে খুব মিস করছি।’
সামিম আবিরের কথার পিঠে কথা বলে না। আবিরের আর্তনাদ গুলো সে কাছ থেকে উপলব্ধি করতে পারছে।
বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা কাঁটিয়ে সামিম আবার বলল,
‘আফিন ভাইয়ার খবর কি? সে কি পেরেছে ট্রমা থেকে বের হতে?’
‘কিছুটা পেরেছে। পুরোপুরি নয়।’
‘ববি আপুর খুনের তদন্ত কতদূর এগোলো? পুলিশ খুনির কোনো খোঁজ পেয়েছে?’
‘নাহ! এখনো সুরাহা মিলেনি। তদন্ত চলছে।’
‘বিকালে জামিলার বার্থডে পার্টিতে যাবি?’
‘ইচ্ছে তো নেই। কিন্তু যেতে হবে।’
‘বিভাকে নিয়ে আসিস। একা আর কতদিন বন্দী রবে রুমে। সবার মেলে থাকলে হয়তো কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে।’
আবির প্রতিত্তোরে কিছু বলে না। সামিম যা বলেছে, ঠিকিই বলেছে। এই বিষয় নিয়ে ভাবছে আবির।
.
সন্ধ্যার দিকে আইরিন বেগম তার একটি জামদানী শাড়ি পরিয়ে দেয় বিভাকে। তিনি নিজেই হালকা ভাবে সাজিয়ে দিয়ে পুরোপুরি রেডি করিয়ে দেয়। খাটের উপর বসিয়ে আবিরকে ডাকে। আবির বিভাকে দেখে মুগ্ধ হয়। তিনি বেরিয়ে যায়। আবির বিভাকে খুঁটিতে খুঁটিয়ে দেখছে। বিভা উদাস হয়ে বসে আছে। কঁপালে টিপ বিহীন সাজ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। আবির কাজল হাতে নিয়ে ছোট্ট একটি টিপ এঁকে দেয় কঁপালে। এবার ঠিক আছে বলে ফোনে একটি ছবি ক্যাপচার করে রাখে বিভার। হাত ধরে বাহিরে নিয়ে আসে। রওয়ানা হয় তাদের গন্তব্যে।

দশ মিনিট পর পৌঁছে যায় পার্টিতে। বিভাকে নিয়ে এসেছে দেখে জামিলা খুশি হয়। বিভাকে অনেক প্রশ্ন করে। কিন্তু কোনো উত্তর মিলে না। এক স্থানে বসিয়ে পাশেই বসে রয় আবির। সামিম, মারুফও কিছুক্ষণ বাদে উপস্থিত হয়। তারাও বিভার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ফল শূন্য! বিভার মুখ থেকে টু শব্দও বের হয়নি।
জামিলা’রা দুই বোন, দুই ভাই। জামিলা সবার ছোট।
ফ্যামিলি, আত্মীয়দের সঙ্গে নিয়ে কেক কাঁটার পর্ব শুরু করে।
আবির, বিভাকে হাতের ইশারায় জামিলাকে দেখায়।
বিভা সেদিকে তাকায় ঠিকিই। কিন্তু কোনো রেসপন্স করে না।
জামিলা ওর বড়ো বোনকে এক পিস কেক খাইতে দিয়ে জড়িয়ে ধরে। এই দৃশ্যটি বিভার ভেতরটায় নাড়া দিকে উঠে।
দু’হাত, ঠোঁট কাঁপতে থাকে। যেন সে অনুভব করছে তার হারিয়ে যাওয়া বড়ো বোনের ভালোবাসা’কে। জামিলা সেখানে দাঁড়িয়ে আবিরকে ডাকে। আবির প্রথম না করে দিলেও, পরক্ষণে জামিলার মনঃক্ষুণ্ন হবে বলে বিভাকে সেখানে বসতে বলে এগিয়ে যায়। নিরবে দু চোখ বেয়ে পানি ঝড়ছে বিভার। চিৎকার করে কাঁদতে না পারলেও, বুকটা তার আর্তচিৎকারে ফেঁটে যাচ্ছে। জামিলার বোন এবং মায়ের ভালোবাসা দেখে হাহাকার বুকে কষ্ট গুলো এক বিশাল দলা পাকিয়ে গেছে ।
এক মুহূর্ত আর থাকতে পারে না। উঠে চারপাশে তাকিয়ে কিছু একটা খোঁজ করে। বাঁ দিকে সিঁড়ি দেখতে পেয়ে বড়োবড়ো পা ফেলে চার তলায় উঠতে আরম্ভ করে। চোখ দিয়ে তখনো পানি ঝড়ছে অনবরত। ছাদের রেলিঙহীন এক প্রান্তে এসে থামে সে। উঁকি দিয়ে নিচের দিকে তাকায়, তার ভয় করে না। এখন তার একটাই উদ্দেশ্য ‘আত্মহত্যা’। চোখের পানি মুছে আকাশের দিকে তাকিয়ে চিল্লিয়ে বলল,
‘হে রব! তাঁদের যখন কেড়ে নিলে আমাকে কেন বাঁচিয়ে রেখেছো? এখন আমার জীবন জিন্দা লাশের চেয়ে কম তো নয়। কি পাপ করেছিলাম? যার শাস্তি আমাকে এভাবে পেতে হলো।? বলো না তুমি? বলো?’ অঝরে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলো বিভা। পরক্ষণেই পানি মুছে ফেলে বলল,
‘আপু, মা! আমিও আসছি। আসছি….’ বলেই ঝাঁপ দিতে নিলে পিছন থেকে একটি যুবকের কণ্ঠের স্বর ভেসে আসে,
‘না বিভা! তুমি ভুল পথে পা বাড়াচ্ছো। এত দ্রুত হেরে গেলে চলবে? আমি যতটুকু জানি, তুমি তো হেরে যাওয়া মেয়ে নও। আমি তোমাকে সাহসী মনে করতাম। কিন্তু তুমি এখন ভীতুর পরিচয় দিতে যাচ্ছো। তুমি হয়তো এটা ভুলে গেছো, তোমার বোন খুন হয়েছে। তোমার মা তার শোকে স্টোক করেছে। রবকে দায়ী করা মোটেও উচিত নয়। তিনি যা করেন, তার বান্দার ভালোর জন্যই করেন। এভাবে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ না করে রহস্য উদঘাটন করো। বোনের খুনের রহস্য!’
.
.
.
#চলবে?

#বাঁধিব_হৃদয়ে_তোমায়
#পর্ব_১৪
#সুমাইয়া মনি

বাড়িতে ফিরে আবির অস্বাভাবিক আচরণ করে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে জিনিসপত্র ভাংচুর করছে। আফিন ও তার বন্ধু’রা কেউ আটকাতে পারছে না। সকাইকে ঠেলেঠুলে সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলছে বিভাকে এনে দিতে। বিভাকে ছাড়া সে শূন্য! নেই তার কোনো অস্তিত্ব!

আবির প্রায় দশ মিনিট পর ফিরে এসে বিভাকে আর খুঁজে পায় না। হন্ন হয়ে খুঁজে পুরো বাড়িতে। ইতিমধ্যে সকলে বিভাকে খুঁজছে। বিভাকে না পেয়ে সামিম, মারুফকে সঙ্গে নিয়ে এগলি, সেগলি ঘুরে বেড়ায়৷ কোথাও মিলেনা বিভার দেখা। শেষে তারা বাড়িতে ফিরে রাত দুইটার দিকে। এসেই পাগলামি শুরু করেছে আবির। বিভাকে আগলে রাখবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল নিজেকে। এখন তাকেই কি-না হারিয়ে ফেলতে বসেছে।
‘কেন আমাকে ছেড়ে বিভা চলে গেল? এখন আমি কাকে নিয়ে বাঁচবো? বিভাকে এনে দেও ভাইয়া। বিভাকে এনে দেও আমার কাছে। এনে দেও…..’ বলেই চিল্লিয়ে চেয়ার তুলে ডাইনিং টেবিলের ওপর ছুঁড়ে মারল। বিকট আওয়াজ তুলে ভেঙে যায় কাঁচের তৈরি টেবিলটি। কেউ কাছে যেতে পারছে না। আফিন নিজের কথা ভাবছে। আবিরের মতো পাগলামি তার করার দরকার ছিল। কিন্তু…!
দূরে দাঁড়িয়ে মুখে কাপড় গুঁজে আইরিন বেগম কাঁদছে। ছেলের এমন পাগলামি কোনো মা’ই সহ্য করতে পারবে না।
মারুফ, সামিম অসহায় হয়ে বন্ধুর পাগলামি দেখছে। ছুটে এসে আবিরকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করে আফিন।
আবির সরিয়ে দিতে চায় বার বার। শেষে আবিরের মাথা নিজের বুকের কাছে নিয়ে গালে হাত বুলিয়ে বলল,
‘হারিয়ে গেছে দেখে পাগলামি করছিস। যদি ম….’
‘খবরদার! ভাইয়া। ঐ কথা মুখেও আনবে না। আমি শুনতে পারব নাআআ।’ জোরে চিৎকার তুলে আফিনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে কাঁচের টুকরো তুলে ডান হাতের মধ্যখানে চালিয়ে দেয়। গলগল করে রক্ত বের হতে থাকে। আইরিন বেগম ভয় পেয়ে যায়। সামিম, মারুফ, আফিন আবিরকে ধরে হাত থেকে টুকরোটি ফেলে দেয়। আফিন হাত দিয়ে ক্ষতস্থান চেপে রাখে। কিন্তু তাতেও রক্তক্ষরণ কমে না। অধিক রক্ত বের হবার ফলে আবির ধীরেধীরে দূর্বল হয়ে পড়ছে। তবুও স্ট্রং হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করে। তবে পারে না। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাওয়ার আগেই ওরা ধরে নেয়। ধরাধরি করে আবিরের কক্ষে এনে শুইয়ে দেওয়া হয়। হাতের চামড়া অনেকখানি সরে গেছে। যার ফলে সেলাইয়ের প্রয়োজন। এত রাতে ডক্টর পাবে না বলে আফিন অস্থির হয়ে উঠে। আইরিন বেগম কেঁদেই যাচ্ছে। সামিম বার বার শান্ত হতে বলছে তাকে।

হঠাৎ আফিনের মনে পড়ে তার বন্ধু এনামুলকে কথা। তিনি একজন ডক্টর। কল দিয়ে জরুরী ভিত্তিতে বাড়িতে ডাকে। এনামুল আধা ঘণ্টা বাদেই বাইক নিয়ে চলে আসে। প্রথমে তাকে ঘুমের ইঞ্জেকশন পুশ করতে বলে আফিন। তারপর ক্ষত স্থানের রক্ত পরিষ্কার করে সেলাই করেন। বিভার কথাটি এনামুল’কে জানায়। এনামুল দুঃখ প্রকাশ করে বলল,
‘মেয়েটিকে দ্রুত খুঁজে বের করার চেষ্টা কর আফিন। আবিরের পাগলামি যা তোর মুখে শুনলাম, উল্টাপাল্টা না কিছু করে বসে।
‘একে তো ববির খুনিকে এখনো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার ওপর বিভা নিঁখোজ! এখন আবার আবিরের… বুঝতে পারছি না কি করব আমি।’ উত্তেজিত হয়ে পড়ে আফিন।
‘স্থির হ দোস্ত! পুলিশকে বলেছিস?’
‘হ্যাঁ! জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা খুঁজছে।’
‘আচ্ছা আমি এখন উঠি। আবিরের কন্ডিশন আমাকে জানাস।’
‘হুম।’
তিনি চলে যায়। আফিন সামিম, মারুফকে যেতে দেয় না। থেকে যেতে বলে।
‘আম্মু, তুমি ঘুমাও। আমি মারুফ, সামিম আবিরের কাছে আছি।’
‘কি হচ্ছে আমার সংসারে জানি না। একটা না একটা ভয়ংকর ঘটনার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কীভাবে ঘুমাবো বল? তোর বাবাকে আমি কি বলব? এখন পর্যন্ত তাকে কিছুই জানানো হয়নি।’
‘চিন্তা কোরো না মা। ঠিক হয়ে যাবে এক সময়। আর এই মুহূর্তে বাবাকে এসব জানানোর প্রয়োজন নেই।’
আইরিন বেগম কিছু বলে না। আফিন তাকে জোর করে রুমে দিয়ে আসে। ঘুমানোর নির্দেশ দেয়। মায়ের মন কি সন্তানের বিপদেআপদে শান্ত থাকতে পারে। কিন্তু আফিনের কঁড়া আদেশে তাকে ঘুমাতে হয়। আবিরের রুমে তিনজন রাত কাঁটিয়ে দেয়। সারারাত আবিরকে পাহাড়া দেয় তারা।
সকাল হতেই আফিন ওদের দু’জনকে রেখে থানায় আসে। ওসি’কে বিভার সম্পর্কে আরো ইনফরমেশন দেওয়ার জন্য।
ওসির সঙ্গে খুঁজতে অনেক স্থানে যায় আফিন।

এদিকে আবির ঘুম থেকে উঠে আবারও পাগলামি আরম্ভ করেছে। না কিছু খাচ্ছে, না কারো কথা শুনছে। সামিম, মারুফ জোর করে কিছুতেই আটকে রাখতে পারছে না। শেষে আফিনকে জানানো হয়। আফিন দ্রুত এনামুল’কে ফোন দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। এনামুলের আসতে বেশিক্ষণ লাগে না।
এসে আবির’কে পুনোরায় ঘুমের ইঞ্জেকশন দিতে হয়।
আবির প্রথমে দিতে চায় নি। চিল্লা পালা করে। এক প্রকার জোর করে দেয় ইঞ্জেকশন। আস্তেধীরে নিস্তেজ হয়ে আসে আবির। তলিয়ে যায় গভীর ঘুমে।

আইরিন বেগম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করলেন।
এনামুল সান্ত্বনা দেয়। তিনি কান্নারত কণ্ঠে বললেন,
‘ছেলেটা আমার কি হয়ে গেছে এক দিনে। আল্লাহ কেন এমন নিষ্ঠুর পরিস্থিতিতে ফেলেছে আমাদের।’ কান্নার গতিবেগ আরো বেড়ে যায় তার।
মুখ বুঁজে শোনা ছাড়া আর কেউ বা কি বলবে! যা হচ্ছে সব চোখের সামনে দৃশ্যমান।

সারাদিন খোঁজাখুঁজির পরও বিভার কোনো সুরাহা মিলে না। বিধ্বস্ত হয়ে রাতে বাড়ি ফিরে আফিন। কাল আবার খুঁজতে বের হবে। এদিকে তার কলেজ, কোচিংও বন্ধ যাচ্ছে। অবশ্য এতে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই। অবসন্ন শরীর নিয়ে আবিরকে দেখতে আসে আফিন। বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছে তার প্রিয় ছোট ভাইটি। সামিম, মারুফ নিজেদের জামাকাপড় চেঞ্জ করার জন্য বাড়িতে গিয়েছে একটু আগে। কাল রাতে এসেছে আর বাড়ির মুখো হয়নি তারা। বন্ধুর করুণ অবস্থা দেখে বাড়িতে যায় নি আর। এখন আইরিন বেগমের কথা অনুযায়ী বাড়িতে গিয়েছে। কিছুক্ষণ পরেই আবার ফিরে আসবে। আজ রাতেও আবিরের সঙ্গে থাকবে তারা।

আবিরের মাথায় হাত রেখে আফিন মায়া ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ রাখে। এক দিনে আবিরের চোখমুখ কতটা শুঁকনো দেখাচ্ছে।
পেট মিশে গেছে পিঠের সঙ্গে। এক দানা খাবারও পড়েছি পাকস্থলীতে। আইরিন বেগম আফিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘খেতে আয় বাবা আফিন।’
‘নাহ! আম্মু। আমার ভাই না খেয়ে পাগল অবস্থায় শুয়ে রয়েছে। আর ওঁকে ছাড়া আমি খাবার খাব।’
ছেলের কথা শুনে ডুকরে কেঁদে উঠেন তিনি। আফিন ওর আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘আম্মু আমি আমার কষ্ট গুলো চাপা দিয়ে রাখতে পারব। কিন্তু আবিরের কষ্ট গুলো দেখতে পারছি না। আমি যে ভাই হয়ে ছোট ভাইয়ের কষ্টকে কাছ থেকে দেখে মানতে পারছি না আম্মু। কি করব আম্মু বলো? বলে দেও। কীভাবে বলব বিভাবে খুঁজতে ব্যর্থ হয়েছি আমি। যে নিজ থেকে হারিয়ে যায়, তাকে খোঁজা কষ্টকর। বুঝাবো কীভাবে বলতে পারো আম্মু?’ বলেই কেঁদে দেয় আফিন। সামিম, মারুফ ততক্ষণে সেখানে উপস্থিত হয়ে সব কথা শুনেছে। এই একটা মাসের মধ্যে মানুষের জীবনে কতটা পরিবর্তন ঘটতে পারে, সেটা এই পরিবার’কে দেখলে বোঝা যায়।
কতোটা দুরধিগম্য পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে দিন। চাক্ষুষ সাক্ষী কেবল তারা।
‘কেন মনে হচ্ছে বিভা নিজ থেকে হারিয়ে গেছে ভাইয়া? আমি তো বিভাকে নিজের থেকে বেশি ভালোবেসেছিলাম!’ আবিরের কাতর কণ্ঠে প্রশ্নটি শুনে ঘুরে তাকায় সকলে। ওর অনিমেষ দৃষ্টি দেখে দ্রুত চোখের পানি মুছে ফেলে আফিন। স্লোন গতিতে পাশে বসে বলল,
‘আমরা জানি তো তুই বিভাকে অনেক ভালোবাসিস। তুই ভাবিস না, আমি খুঁজবো বিভাকে। শুধু তুই পাগলামি করিস না ভাই।’ নির্মল স্বরে বলল আফিন।
আবির অনাড়ম্বর দৃষ্টিতে সকলের দিকে তাকায়। তারপর অমলিন কণ্ঠে বলল,
‘করব না ভাইয়া। শুধু বিভাকে আমার কাছে এনে দেও। এবার পেলে বিভাকে হৃদয়ের মধ্যখানে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখবো। যেন কক্ষণো পালাতে না পারে। আমাকে একা রেখে হারিয়ে না যেতে পারে। এনে দিবে তো ভাইয়া?
ছোট ভাইয়ের এমন বেদনাপূর্ণ আবদার শুনে আফিন দৃষ্টি নত করে ফেলে। চোখে পানি টলমল করে। তবুও সে প্রতিশ্রুতি দেয় এনে দিবে তার প্রেয়সীকে!
.
.
.
#চলবে?