বাঁধিব হৃদয়ে তোমায় পর্ব-১১+১২

0
260

#বাঁধিব হৃদয়ে তোমায়
#পর্ব-১১+১২
#সুমাইয়া মনি

‘রাগছিস কেন আবির? আগে কারণটা তো শুনবি।’ সামিম কণ্ঠ খাদে ফেলে বলল।
‘কারণ যাই হোক না কেন সেটা মেটার না। বিভা আমার সঙ্গে কথা তো দূর, নাক থেকে রাগই সরে না তার। আর তোর সঙ্গে কি সুন্দর হেসে কথা বলে কীভাবে? আমি কি ওর শত্রু?’
সামিম ফিক করে হেসে দেয়। আবির চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই হাসি থামিয়ে ‘স্যরি’ উচ্চারণ করে। আবির নজর সরিয়ে নেয়।
সামিম সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
‘রিল্যাক্স আবির। আস্তেধীরে বিভা ঠিক তোর প্রেমে পড়ে যাবে।’
আবির সামিমের দিকে সরল চাহনি তাকায়। খুব করে চায় সামিমের কথাটা যেন ফলে।
.
‘সাকিব ভালো ছেলে নয় মোহনা। ভালো হয়েছে তোদের ব্রেকআপ হয়েছে।’
নিরুত্তর থেকে মোহনা আনমনে হাঁটছে। বিভা ফের বলে,
‘যত তাড়াতাড়ি ভুলে যাবি তোর জন্যই ভালো হবে। ভাঙা মন কাঁচের সমতুল্য রে মোহনা। তবে মায়া, ভালোবাসা দিয়ে, প্রলেপ দিয়ে অবশ্যই জোড়া লাগে, ক্ষত শুকায়।’
মোহনা এবার মুখ খুলে। বলে,
‘ভালোবেসে ছিলাম কতখানি বলে বুঝানো সম্ভব নয়। আমার এই ভালো, খারাপ সময় গুলো নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। এটাই আমার নিঃসঙ্গতার সঙ্গী।’
‘এমন করে বলিস না মোহনা। এগুলো পাগলের প্রলাপ ছাড়া কিছুই না।’
তাচ্ছিল্য হাসে মোহনা। এ হাসি যে কতটা বেদনাদায়ক সেটা বিভা ঢের বুঝতে পারছে।
_____
রাতে……

রিকশার ভাড়া কোনোমতে মিটিয়ে হাঁপিয়ে ছুঁটছে বিভা আফিনদের বাড়ির দিকে। ভেতরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে ডাইনিং টেবিলে বসা তিন মা ছেলে বিভাকে দেখে চমকে উঠে। ঘড়িতে তখন রাত এগারোটা ছুঁই ছুঁই। বিভা একটু দম নিয়ে এগিয়ে এসে আফিনের উদ্দেশ্য করে বলল,
‘ভাইয়া, আপু বাসায় ফিরে নি এখনো।’
আফিন উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ায়,
‘কি বলছো?’
‘হ্যাঁ! ভাইয়া। সকাল এগারোটার দিকে গার্মেন্টসের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে। এখনো বাসায় আসেনি। আপুর ফোনের বেটারিতে সমস্যা ছিল তাই সঙ্গে নিয়ে যায় নি। মা ইতিমধ্যে চিন্তিত হয়ে কান্নাকাটি শুরু করেছে। তাই আপনার কাছে আসলাম।’
‘আগে কেন বলনি? এতক্ষণ মুখ চেয়ে কার আশায় বসে ছিলে?’ কিছুটা রাগী কন্ঠে শুধালো আফিন।
বিভা মাথা নত রেখে বলল,
‘আমরা ভেবেছিলাম আপু হয়তো সন্ধ্যার আগে চলে আসবে…’
আফিন তৎক্ষনাৎ হাত ধুয়ে ফোন হাতে বেরোয়। আইরিন বেগম বিভার কাছে এগিয়ে আসলেন। আবিরের খাওয়াও হয় না। বাইক নিয়ে বেরিয়ে যায় ববিকে খুঁজতে। আজ সারাদিনে ব্যস্ততার কারণে ববির সঙ্গে আফিনের কথা হয়নি। একটু আগেই বাড়ি ফিরে ববিকে মেসেজ দিয়েছিল খেয়ে কল দিবে। উত্তর আসেনি দেখে আফিন ভেবেছে হয়তো ঘুমিয়ে গেছে ববি। আম্মুর ডাকে ফোন রেখে খেতে আসে।
কথাটা ভেবে আফিনের মনে অস্থিরতা ক্রমাগত বাড়ছে।

বিভা সেখানে দাঁড়ায় না। ‘মা বাসায় একা’ কথাটি আইরিন বেগমকে জানিয়ে চলে যায়৷ পথিমধ্যে এখানে যেখানে চোখ বুলিয়ে ববিকে খুঁজে। ভয়ে ক্রমশ কাতর হয়ে আসছে সে। চোখের পানি গুলো বার বার হাতের উল্টো পিঠে মুছে নিচ্ছে। রাস্তায় এখনো মানুষজনের আনাগোনা রয়েছে। গাড়িও চলাচল করছে। কেউ কেউ বিভার দিকে উৎসুক নজরে তাকাচ্ছে। এতে তার ভাবান্তর নেই। এলোমেলো পা ফেলে হেঁটে চলেছে সে।

আবির গার্মেন্টসে এসে জানতে পারে ববি সকালে এখানে আসেই নি। সেখান থেকে চলে যেতে নিলে আফিন এসে জিজ্ঞাসাবাদ করে কর্মচারীদের। তারা একই কথা বলে। পাহাড় সমান চিন্তা নিয়ে খুঁজতে বের হয় তার প্রিয়তমা’কে। এগলি, ওগলি, রাস্তায় খুঁজে বেড়াচ্ছে।
আবির খু্ঁজচ্ছে, যেখানে যেখানে ববি বাজার করতে যেতো সেই স্থানে। কিন্তু এত রাতে বাজারঘাট বন্ধ থাকায় ব্যর্থ হয় আবির। আপাতত এই দিকটা অফ রাখে। একটার দিকে আফিন থানায় এসে মিসিং কেইস ফাইল করে। আবিরও সঙ্গে ছিল। থানার ওসি না থাকায় কনস্টেবলদের কাছে ববি ডিটেইলস খুলে বলে ছবি দিয়ে আসে। আফিনের কাছে ববির ছবি ছিল। বিয়ে ঠিক করার দিন তুলেছিল।
ববির গার্মেন্টসের কাজের কথা শুনে যেন কনস্টেবল কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়। দুই ভাই সেটা উপেক্ষা করে ববি ছবি সহ বাদবাকি সব বলে বাড়িতে ফিরে। আইরিন বেগম এখনো জেগে ছিল। ছেলের কাছে ববির ব্যাপারে জানতে চাইলে হতাশাজনক মুখ দেখে বুঝতে পারের তিনি। তারও মুখ কালো হয়ে যায়। আফিন বিষণ্ণ মনে সিঁড়ি বেয়ে উঠার সময় কয়েকবার হোঁচট খেতে নেয়। নিজেকে সামলানোর শক্তিটুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছে।
ছেলের এমন অবস্থা দেখে মনঃক্ষুণ্ন হয় তার। আবির তার ভাইকে ধরে রুমে দিয়ে আসতে নিলে আফিন বাঁধা দেয়।
তিনি একটা চলে যায় তার কক্ষে।

‘আবির তুই আজ রাতে বিভাদের বাড়িতে গিয়ে থেকে আয়। বাসায় তো তারা দু’জন।’
‘আচ্ছা আমি যাচ্ছি, তুমি ভাইয়ার দিকে খেয়াল রেখো।’
‘হুম।’
‘আর শোন, পথিমধ্যে কিছু খাবার কিনে নিয়ে যাস। মনে হয় না তারা কিছু খেয়েছে।’
‘আচ্ছা আম্মু।’
তৎক্ষনাৎ আবিরও বাইক নিয়ে ছুঁটে বিভাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। বিলকিস বানু জায়নামাজে বসে আছে। আল্লাহর কাছে বার বার মিনতি, কান্নাকাটি করে ববিকে চাইছে। যেখানে আছে যেন সুস্থ ভাবে ফিরে আসে। বিভা খাটে বসে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর পরই আঁখিযুগল পানিতে ঘোলা হয়ে আসছে তার। ববির অকেজো ফোন তার হাতেই রয়েছে। দরজায় করাঘাত হয়, সঙ্গে আবিরের কণ্ঠের স্বরও ভেসে আসে। বিভা ওড়নার দ্বারা চোখ মুছে দরজা খুলে দেয়।
আবির বিভার ফুলা ফুলা চোখ দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না সে কেঁদেছে। পাশে সরে যায়। আবির ভেতরে যাওয়ার পূর্বে বলল,
‘আম্মু আমাকে পাঠিয়েছে তোমরা একা তাই।’
‘সমস্যা নেই আমরা থাকতে পারব।’ মৃদুস্বরে আওড়ায়।
‘তবুও….’ অবশিষ্ট কথা বলার পূর্বে বিলকিস বানু উত্তেজিত হয়ে আবিরের নিকট এগিয়ে এসে বলল,
‘আমার ববির খোঁজ পেয়েছো? কোথায় আছে ববি জানো? নিয়ে আসো না আমার মেয়েকে, নিয়ে আসো বাবা।’ বলে কাঁদতে লাগলেন তিনি।
তার এমন আহাজারি দেখে আবির দৃষ্টি নত করে ফেলে। বিভা ওর মা’কে থামানোর জন্য জড়িয়ে ধরে খাটে বসায়, বলছে ‘আপুকে পেয়ে যাব, তুমি শান্ত হও মা।’
কথা শোনার অবস্থায় আপাতত সে নেই। বিভা বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মা’কে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। আবির তখনো দরজার সামনে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। বিভা ওঁকে ভেতরে আসতে বসে। আবির সরু নিশ্বাস টেনে ভেতরে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়। হাতের খাবার গুলো বিভার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘তোমাদের জন্য এনেছি।’
বিভা প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে আবিরের উদ্দেশ্য বলল,
‘আপনি তো খাননি। খেয়ে নিন।’
‘খাব না, তুমি খাও। আর আন্টিকে খাইয়ে দেও।’
‘মা ঘুমিয়েছে। এখন আর তাকে ডাকব না। আমার খাবার ইচ্ছে নেই।’
আবির কথাটা শুনে খাটের উপর প্যাকেট রেখে টুল নিয়ে উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে। পকেট থেকে ফোন বের করে আম্মুকে জানিয়ে দেয় পৌঁছানোর বিষয়টি। তারপর ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে মনোযোগ সহকারে কিছু একটা ভাবে। এক মুহূর্তে সব উলটপালট হয়ে গেল। পরিস্থিতি কোথা থেকে কোথায় এসে থামলো।
.
.
.
#চলবে?

#বাঁধিব_হৃদয়ে_তোমায়
#পর্ব_১২
#সুমাইয়া মনি

সকালে পুলিশ বুড়িগঙ্গা নদীর চর থেকে একজন মেয়ের মরদেহ উদ্ধার করে। গলায় আঘাতের চিহ্ন দেখে খুন হিসাবে ধরে নেয়। ভিকটিমের মৃত্যু গলা কাঁটার ফলে হয়েছে। যেহেতু কাল আফিন ববির নিঁখোজ বার্তা পুলিশদের জানিয়েছিল। তাই পুলিশরা তাকেই আগে ইনফর্ম করে। আবির ঘুমিয়েছিল। রাতে বিভা, আবির ঘুমায় নি। কথা বলে সময় পাড় করেছে। ফজরের নামাজ পড়ে তারপর ঘুমায়েছে। আবির ঘুমানোর পর বিভা নাস্তা তৈরি করে। অনবরত ফোন বাজায় বিভা রান্না ঘর থেকে বেরোয়। বিলকিস বানু এখনো ঘুমিয়ে আছে। রাতে কয়েক বার ববিকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছিলেন তিনি। বিভা পুনোরায় তাকে সান্ত্বনা দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। আবিরও ঘুমে কাতর ছিল৷ সেইজন্য ফোনের শব্দ ওর কান অব্ধি পৌঁছায় নি। বিভা আবিরের নিকট আসে। তাকে মেঝেতে বিছানা বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে ঘুমানোর জন্য।
ফোন বেজে কেঁটে যায়। আবিরের ফোন হাতে নেওয়ার পূর্বে নজর পড়ে তার আদলের দিকে। গুটিশুটি মেরে বাচ্চাদের মতো ঘুমাচ্ছে। ফর্সা আদল জুড়ে নজর বুলিয়ে নেয় একবার। চোখ জোড়া অবিকল মায়ের মতো দেখতে। নাকটা খাঁড়া। থুতনিতে খোচাখোচা হালকা দাড়ি। লম্বা চুখ গুলো কঁপাল ছেয়ে নেমে আছে। অনায়াসে সেই চুলে দু’টি ঝুঁটি হবে। কাল রাতে কতোই না দু’জনার মাঝে বাক্যবিনিময় হয়েছে। এক মুহূর্তের জন্যও রাগ হয়নি আবিরের উপর। তখন কার সময়ে আপুর কথা মনে পড়েছে। বলেছিল, ‘একটা মানুষকে চিনতে হলে তার সঙ্গে সময় বা বাক্যবিনিময় করতে হয়। মিশতে হয়। ওপর থেকে মানুষকে যাচাই করা বোকামি।’ সে এতদিন সেই বোকামিটাই করেছিল। আবির দুষ্টু ও প্যাঁচালো হলেও তার মনটা অনেক ভালো। যেটা কাল রাতে ঠের বুঝতে পেরেছে সে। আপুর বলা কথা ভাবতেই বুকটা ভার হয়ে এলো। কোথায় আছে, কি অবস্থায় আছে জানা নেই তাদের। হঠাৎ আবার ফোনের রিংটোনে হকচকিয়ে উঠে। ভাবনার ছেদ ঘটে যায়, নজর তাক করে ফোনের স্ক্রিনের ওপর। আফিন ভাইয়া লিখাটি দেখে বিভা ফোন রিসিভ করে।
‘হ্যালো।’
‘বিভা!’
‘হ্যাঁ।’
‘আবির এখনো ঘুমোচ্ছে?’
‘হুম।’
‘ডাকো ওঁকে। বলো তোমাদের নিয়ে ঢাকা মেডিক্যালে আসতে।’
‘কেন ভাইয়া! হঠাৎ মেডিক্যালে?’
আফিনের কথাটা বলার ধৈর্য হচ্ছে না।। পুলিশ তাকে খবর দেওয়ার পর থেকেই ধীরে ধীরে ববিকে হারিয়ে ফেলার ভয় তাকে চারদিক থেকে গ্রাস করে নিচ্ছে। বুক ধড়ফড় করছে। চিনচিন ব্যথা অনুভব হচ্ছে পাঁজরে।
‘ভাইয়া?’
‘হু…’ ধ্যান ভেঙে ছোট করে উত্তর দেয়।
‘বলছেন না যে?’
আফিন মিনিট কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল,
‘নদী থেকে একটি মেয়ের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। সনাক্ত….’
‘থামুন ভাইয়া। এটা আপু হবে না।’
‘আমিও যে এটাই চাইছি…’
‘আমরা আসছি।’
আফিন প্রতিত্তোরে কিছু না বলে ফোন রেখে দেয়। বিভা ফোন কান থেকে সরিয়ে বিমূর্ত অবস্থা দাঁড়িয়ে রয়। ভয়ে গলাটা শুঁকনো অনুভব হচ্ছে। আবির ততক্ষণে উঠে গেছে। বিভাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে,
‘কোনো সমস্যা? কল দিয়েছিল কেউ?’
বিভা নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
‘ভাইয়া কল দিয়েছিল।’
‘কি বলল ভাইয়া। কোনো খবর পাওয়া গেছে কি?’
বিভা সেকেন্ড সময় চুপ থকে আফিনের কথাটি বলল।
আবিরের মনেও ঈষৎ ভয়ে এসে ভর করেছে। খুব করে চাইছে মেয়েটি যেন ববি না হয়!

কিছুক্ষণ বাদে তারা তিনজন হাসপাতালে আসে। আফিন পুলিশদের নিয়ে বাহিরে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। ওদের দেখা মাত্রই এগিয়ে যায়। আফিন মেয়েটির লাশকে এখনো দেখেনি। দেখার সাহস হচ্ছে না তার। বিলকিস বানুকে বিভা সেটাই বলেছে যে কারণে তারা এখানে এসেছে। তিনি প্রথমে না যাওয়ার জন্য পাগলামি করলেও, আবির বহু কষ্টে বুঝিয়ে নিয়ে আসে। আফিনকে দেখে তিনি ববির কথা অনবরত জিজ্ঞেস করতে থাকে। কোনো জবাব দেয় না আফিন। একজন মহিলা কনস্টেবল তাদের মর্গে যাওয়ার জন্য ডাকতে আসে। বিভার হাত-পা কাঁপছে। মনে মনে বলছে, এটা যেন আপু না হয়। এগিয়ে যায় তারা। করিডরের লাস্টের দিকে মর্গের ঘর। একে একে সবাই ভেতরে প্রবেশ করে।
বিভা ও তার মায়ের বুকে এক রাশ ভয় এসে জড়ো হয়েছে। বিভা বার বার ঢোক গিলে গলা ভেজানোর চেষ্টা করছে। আফিন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে দেখবে না বলে মন স্থির করেছে। স্ট্রেচারের উপর সাদা কাপড় দ্বারা একটি বডি রাখা। একজন ওয়ার্ড বয় মুখের উপর থেকে কাঁপড় সরিয়ে দেয়। বিভা এক নজর তাকিয়ে চোখ জোড়া খিঁচে বন্ধ করে নেয়। রূহ তার কেঁপে উঠে। খামচে রাখে হাতের মুঠোয় চাদর। সে চাইছে, যা দেখেছে সেটা যেন ভুল প্রমানিত হয়। এটা সম্ভবই নয়! আবির নজর সরিয়ে নিয়ে হাত দ্বারা চোখ ডেকে ফেলে।
বিলকিস বানু তার মেয়েকে দেখে চিনতে পারে। এটাই তার আদরের বড়ো মেয়ে ববি! পানিতে থাকার ফলে শরীরের চামড়া সাদা হয়ে গেছে। গলায় চুরির বড়ো আঘাতের দাগ দেখা যাচ্ছে। তার কালো মায়াবী মেয়েটির চেহারা বিভৎস সাদা দেখাচ্ছে। সে এসব উপেক্ষা করে এগিয়ে যায়। মাথায় হাত বুলিয়ে কৃত্রিম হেসে বিভার উদ্দেশ্যে বলে,
‘ববিকে পেয়েছি রে বিভা। ও ঘুমিয়ে আছে। এ..একটু পরই ঘুম ভেঙে যাবে দেখিস। আয় না তোর আপুর কাছে আয়। কেউ একটা লেপ দেও। আমার মেয়ের শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে। মা তোর শীত করছে। এখনই লেপ দিবে দাঁড়া দাঁড়া। লেপ দিচ্ছো না কেন? আমার মেয়ের শীত লাগছে তো। দেখো শরীর সাদা হয়ে গেছে।’
ওয়ার্ড বয়, কনস্টেবল, পুলিশ রা তার পাগলামি কথা বার্তা শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আফিন দরজার সঙ্গে হেলান দেওয়া অবস্থায় বসে পড়ে। সে বিরাট পাথরে পরিনত হয়েছে। এক ধ্যানে পলকহীন চাহনিতে তাকিয়ে রয়েছে। আবির আাফিনের নিকট আসে। বিভার বন্ধ আঁখিযুগল বেয়ে অশ্রু বর্ষিত হয়। কনস্টেবল মহিরাটি বিভার মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
‘কাকি আপনার মেয়ে মারা গেছে।’
তিনি ধমকের গলায় বলল,
‘চুপ! মিথ্যা বলবে না। ববি ঘুমিয়ে আছে। আমি ডাকলেই উঠে যাবে। দেখবে?’ বলেই ববির মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে বলল,
‘ববি উঠ, উঠ না মা। দেখ আমরা তোর কাছে এসেছি। তোকে নিতে এসেছি। কাল তোকে দেখিনি। মনটা আমার শান্ত ছিল না রে। উঠ জলদি, বাড়ি যাব। উঠ না। উঠ! উঠ! ববিইইই….’ চিৎকার দিয়ে ডেকেই বুকে হাত রেখে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কনস্টেবল মহিরাটি তাকে ধরতে এগিয়ে যায়। বিভা চোখ খুলে ববির আদলের দিকে তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যেতে নিলে আবির পিছন থেকে ধরে ফেলে। সে দিশেহারা! কাকে রেখে কাকে সান্ত্বনা দিবে ভেবে অস্থির। বিধাতা এ কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন করল তাদের!

আধাঘন্টা পর বিভার জ্ঞান ফিরে। নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে পাশে আইরিন বেগমকে দেখতে পায়। আবির জানালার দিকে মুখ করে নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জ্ঞান ফিরার ফলে বিভার দিকে ফিরে তাকায়। আপুর কথা মনে উঠতেই আপনাআপনি জল পড়তে আরম্ভ করে। জোরে জোরে কাঁদে সে। আইরিন বেগমের চোখে জল চলে আসে। মায়ের সমতুল্য বড়ো বোনকে হারিয়ে সে দিগ্‌ভ্রান্ত!
প্রতিটা মুহূর্ত কাঁটানো স্মৃতি গুলো চোখের পাতায় দোল খাচ্ছে। সে-ই খুনসুটি, দুষ্টুমি গুলো তাকে মারাত্মক পীড়া দিচ্ছে! আইরিন বেগম কয়েকবার সান্ত্বনা দিতে গিয়েও কেঁদে ফেলেছে। আবির দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে রাখে। বিভার কান্না তার কাছে সহ্যের বাহিরে। বেশকিছুক্ষণ পর মায়ের কথা মাথায় আসে। তৎক্ষনাৎ নজর বুলিয়ে কেবিনে মা’কে দেখতে না পেয়ে চট করে উঠে বসে। কান্না বন্ধ করে বলে,
‘আন্টি মা কোথায়? তাকে দেখতে পাচ্ছি না যে।’
আইরিন বেগম বিভার প্রশ্ন শুনে মুখে কাঁপড় গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে কেবিন ত্যাগ করে। যাওয়ার দিকে তাকিয়ে উদাস হয়ে যায় বিভা। পরক্ষণে নেমে আবিরের সম্মুখীন দাঁড়িয়ে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে,
‘মা কোথায়? তার কথা জিজ্ঞেস করতেই আন্টি চলে গেল কেন? কি লুকাচ্ছে আমার কাছ থেকে?’
আবির বিভার দিক থেকে নজর সরিয়ে নেয়। তার চোখ বলে দিচ্ছে কোনো এক লুকানো বার্তা।
‘বলছেন না কেন? কি লুকাচ্ছেন আপনারা?’
‘বিভা আন্টি….’ মৃদুস্বরে বলতে গিয়েও থেমে যায় আবির।
‘হ্যাঁ! বলুন আম্মু? বলুন না?’ উত্তেজিত হয়ে বলল।
‘আন্টি আর নেই। স্টোক করেছে।’
ধপ করে ফ্লোরে নেতিয়ে বসে বিভা। সর্বাঙ্গের শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। যেন কোনো ভাঙা পুতুল ভেঙে গুঁড়িয়ে পড়েছে মাটিতে। এক শোক কাঁটিয়ে উঠতে না পেরেই, আরেক শোক এসে মুখোমুখি দাঁড়াল। সে বাকরুদ্ধ! আবির হাঁটু গেড়ে বিভা কাছে বসে গালে দু’হাত রাখে।
‘বিভা! আমি আছি তো। তুমি একা নও! আমার দিকে তাকাও বিভা, বিভা?’
বিভার কোনো রেসপন্স নেই! ঢলে পড়ে আবিরের বুকে। ফের জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। আবির খুব শক্ত করে বাহুডোরে জড়িয়ে রাখে। ওর এমন কষ্ট আর দেখতে পাচ্ছে না। এক দিকে তার ভাই প্রিয়তম’কে হারিয়ে শোকাভিভূত! আরেক দিকে তার প্রেয়সী শোকে পাথর! চোখের কোণায় ভীড় করে কিছু অশ্রু। বিভার পৃথিবী জুড়ে আর কেউ রইলো না। এখন সে এতিম, একা!
.
.
.
#চলবে?