বাড়ির নাম বৃষ্টিলেখা পর্ব-০২

0
549

#বাড়ির_নাম_বৃষ্টিলেখা
#পর্ব-২
এই বাড়িতে সকালের খাবারে রুটি, খিচুড়ি আর গরম ভাত হয়। একেক দিন একেক রকম। আজ হয়েছে গরম ভাতের সঙ্গে আচারের তেল দিয়ে আলুভর্তা। পলিন নিচে নেমেই বলল,

“বড় মা তোমার ভর্তার গন্ধেই তো পেট অর্ধেক ভরে যাচ্ছে।”

বৃষ্টির মা প্লেটে ভাত দিতে দিতে বলল, গন্ধে পেট ভরিয়ে কাজ নেই। তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। বৃষ্টি কই? ও সব গুছিয়ে নিয়েছে?

“বুবু তো সকাল থেকে চিঠিই লিখছে।”

এরমধ্যে বৃষ্টিও এসে গেছে। মা ও’কে দেখে বলল,

“ছবিগুলো দিয়েছিস তো?”

“হ্যাঁ। ”

“আসার সময় পোস্ট অফিস যেতে ভুলিস না যেন। এমনিতেই অনেক দেরি করে ফেলেছিস। ”

পলিন খেতে খেতে বলল, আচ্ছা বড় মা আপাকে এতো দূরে না পাঠালেই না?

“ওমা! একী কথা! বিয়ে তো দিতেই হবে!”

“হ্যাঁ কিন্তু আশেপাশে দিলেও তো হয়!”

বৃষ্টি পা দিয়ে পলিনের পায়ে খোঁচা মারলো৷ পলিন মন খারাপ করে বলল,

“আমাদের দুই বোন কে কাছাকাছি বিয়ে দিলেই তো পারো। এতো দূরে তোমাদের ছেড়ে যাব ভাবলেই তো কান্না পায়। ”

বৃষ্টির মা হেসে ফেলল। রেনু স্কুলে যাবার জন্য তৈরী হয়ে বেরিয়েছে। পলিনের কথা শুনতে পেয়ে বলল,

“তোমার বিয়ে এক্ষুনি দেয়া হবে না। তাই এসব না ভেবে অংক নিয়ে ভাবো। ”

পলিন মুখ ভোতা করে খেতে লাগলো। রেনু বৃষ্টির কাছে এসে বলল,

“বৃষ্টিলেখা আজ এতো চুপচাপ যে?”

বৃষ্টি হেসে বলল, এমনি ছোট মা।

রেনু হেসে বলল, আচ্ছা আমি যাই। তোমরা সাবধানে যেও।

মা চলে যেতেই পলিন বলল, বুবু তুমি মা’কে বলতে পারো তো যে তুমি বিয়ে করতে চাইছো না।

বৃষ্টি গলার স্বর খানিকটা খাদে নামিয়ে বলল,

“তুই সবকিছু বেশী ভাবিস কেন! আমি কী তোকে বলেছি যে বিয়ে করব না! খা চুপচাপ। ”

পলিন আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ খেয়ে নিলো।

***
রাস্তায় নেমে কিছুক্ষণ হাটার পরও রিকশা পাওয়া গেল না। পলিন বলল,

“আজ মনে হয় বৃষ্টি হবে বুবু।”

“হ্যাঁ তাই তো মনে হচ্ছে। ছাতা নিয়ে আসা উচিত ছিলো। ”

“বুবু এক কাজ করলে কেমন হয়?”

“কী? ”

“আজ আমি স্কুলে গেলাম না, তুমিও কলেজে গেলে না। একটা সিনেমা দেখে আসি। ”

“এই অকাজ করলে মা মেরে পিঠ ভেঙে দিবে।”

“আহা বাড়িতে জানবে কী করে! আমরা তো লুকিয়ে যাব।”

বৃষ্টি চোখ পাকিয়ে বলল, তোর মাথায় সবসময় শয়তান নাচানাচি করে তাই না! একদম এসব হবে না।

পলিন ঘ্যানঘ্যান করতে লাগলো। বলল,

“বিয়ে হলে তুমি তো আর থাকবে না। তখন কার কাছে আবদার করব! চলো না। আজকের দিন টা এমনিতেই খারাপ। স্কুলে না যাওয়াই ভালো হবে। ”

“আর বাবা বাড়ি এসে যখন বলবে তুই স্কুলে যাস নি তখন?”

“বলব শরীর খারাপ ছিলো তাই যাই নি। তোমার সঙ্গে ছিলাম। ”

“চুপ কর। সিনেমা দেখতে গেলে টাকা লাগবে। আমার কাছে বাড়তি টাকা নেই।”

পলিন লাফিয়ে উঠে বলল, তার মানে তুমি যেতে রাজী। টাকার ব্যবস্থা আমি করব।”

“কিভাবে? ”

“বড় মা যে একশ টাকার নোট দিয়েছে ওটা দিয়ে। বড় মা তো বলেই দিয়েছে যে যা খরচ হয় হোক বাকীটা ফেরত দিলেই হবে। আমরা এক কাজ করব, পোস্ট অফিসে যাব না। চিঠি পাঠাতে যা লাগবে সেটা দিয়ে সিনেমার টিকেটের সঙ্গে খাওয়াও হয়ে যাবে।”

বৃষ্টি চোখ পাকিয়ে বলল, তুই তো দিন দিন ভয়ংকর হয়ে উঠছিস।

“চলো না। কতো দিন সিনেমায় যাই না।”

বৃষ্টি কঠিন গলায় বলল, না।

পলিন আর কথা বাড়ালো না। খানিক হেটে রিকশা পাওয়া গেল। রিকশায় উঠে বৃষ্টির মনে হলো পলিন কে স্কুলে পৌছে দিয়েও লাভ নেই। ও স্কুলে না গিয়ে কোথাও ঘাপটি মেরে থাকবে। তাছাড়া ওর নিজেরও আজ কলেজে যেতে ইচ্ছে করছে না। কলেজে গেলেও ফার্স্ট ক্লাস টা মিস করবে। তাই বলল,

“আচ্ছা চল সিনেমা হলে যাব। মুখ ভার করে থাকিস না।”

পলিন রিকশায় বসেই লাফিয়ে উঠলো। বলল,

“বুবু এইজন্যই তোমাকে এতো ভাল্লাগে। ”

বৃষ্টি হেসে বলল, তোর শয়তানি বুদ্ধিতে যে উস্কানি দিবে সেই তো ভালো।

রিকশায় বসেই পলিন বৃষ্টিকে জড়িয়ে ধরলো।

***
সিনেমা দেখে বেরিয়ে বলল, অনেক দিন বিরিয়ানি খাওয়া হয় না। চলো বিরিয়ানি খাই।

“বাড়ি ফিরে তুই নিজেও মার খাবি আমাকেও খাওয়াবি। ”

পলিন আবারও বলতে শুরু করলো, তুমি তো কিছুদিন পর চলেই যাবে…..

বৃষ্টি থামিয়ে বলল,

“হয়েছে আর ভাঙা রেকর্ড ভাজাতে হবে না। চল দেখি তুই কতো খেতে পারিস। ”

বিরিয়ানি খাওয়া শেষ করে দুজন আইসক্রিম খেল। আরও কিছুক্ষন ঘোরাঘুরি করে বাড়ির দিকে যখন রওনা হলো তখন চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। আকাশে একখন্ড মেঘ জমেছে। যখন তখন আকাশ কাঁপিয়ে বৃষ্টি নামবে।

দুজন একরকম দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ির দিকে ছুটছে। বৃষ্টির শাড়ির আঁচল বাতাসে উড়ছে। পলিন বলল,

“বৃষ্টি টা হয়ে যাক ভিজতে ভিজতে যাই।”

“ইশ! না। আমার একদম ভালো লাগে না।”

পলিন একটু জোরেই বলল, আচ্ছা কোনো ভালো জিনিস ই তোমার ভালো লাগে না কেন?

“যেমন? ”

“আবির ভাইয়াও কিন্তু ভালো মানুষ বুবু।”

“ও কী তোকে টাকা দিয়ে রেখেছে সারাক্ষণ ওর নাম জপ করার জন্য?”

পলিন একটু থতমত খেল। আবিরের কাছ থেকে ও একশ একুশ টাকা ধার নিয়েছে। এখনো শোধ দেয় নি এক টাকাও। অবশ্য দেয়ার ইচ্ছেও নেই। এই ব্যাপার টা বুবু জানলে ও’কে নির্ঘাত নর্দমায় ফেলে দিবে।

***
বাড়ি ফিরে দেখে লণ্ডভণ্ড অবস্থা। দাদী ছাড়া বাড়িতে আর কেউ নেই। রাস্তায় পিকু, পিয়াস দাঁড়িয়ে ছিলো। ওদের দেখে বলল,

“বড়বুবু ওই বাড়িতে দুলু আপার পেট ফেটে গেছে। সবাই ওখানে গেছে। ”

বৃষ্টি একবার পলিনের দিকে তাকালো। পলিন ততক্ষনে হাসতে শুরু করেছে। বৃষ্টি ঘরের দিকে ছুটে গেল।

দাদী ও’কে দেখে বলল, বুবু তোমার মায়েরা তো ওই বাড়ি গেছে। দুলুর ব্যথা উঠছে। বাড়িতে কেউ নাই।

“দাদী আমিও যাই তাহলে। ”

“তোমরা খাবা না?”

বৃষ্টি আরেকটু হলেই বিরিয়ানির কথা বলে ফেলছিল। অনেক কষ্টে আটকে রেখেছে। পলিনের সঙ্গে থেকে তো ওর স্বভাব নিজের মধ্যে এসে যাচ্ছে!

পলিন বৃষ্টিকে দেখে বলল, চলো আমিও যাই।

“না তুই বাড়ি থাক। দাদী একা। ফুপুও মনে হয় ওই বাড়ি।”

“দাদী থাকতে পারবে। আমি একটু থেকেই চলে আসব।”

বৃষ্টিদের পাশের বাড়িটা দুলু’দের। দুলুর আসল নাম দোলা। দোলা থেকে দুলু হয়ে গেছে। দুলুর ছোট ভাই আবির। আরও একটা ছোট ভাই আছে আতিফ। আবির ঢাকায় থাকে। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে এবার ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা দিলো। আর আতিফ থাকে যশোর মামাবাড়ি। সেখানেই পড়াশোনা করে। দুলুর স্বামী চাকরি করে দিনাজপুরে। বাড়িতে তাই মা আর দুলু ছাড়া কেউ নেই। দুলু অন্তঃসত্ত্বা।

দুলুদের ঘরে ঢুকতেই রেনুর সঙ্গে দেখা। বলল,

“তোমরা কখন ফিরলে? এতো দেরি? ”

“দুলু আপার কী অবস্থা? ”

“ওই তো…. তোমরা এক কাজ করো। বাজারে গিয়ে আবির কে একটা ফোন করো। আকাশের যে অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে। পরে যদি ফোন না করা যায়।”

“বাবা, কাকা কেউ বাড়ি নেই। ”

“না দুজনেই দোকানে।”

পলিন বলল, মা আমিও যাই। বুবু তো আবির ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে না।

রেনু বলল, আচ্ছা।

***
রাস্তায় নেমে বৃষ্টি বলল,

“বাড়িতে দুটো দামড়া ছেলে অথচ কাজের সময় নেই।”

পলিন খিলখিল করে হাসতে লাগলো। হাসি থামিয়ে বলল,

“আবির ভাইয়াকে ফোন টা তুমি করো না। ”

“আমি কেন করব? তুই তো সঙ্গে এসেছিস ও’কে ফোন করবি বলে।”

“আমি তো দেখতে এসেছি যে তুমি কিভাবে কথা বলো।”

“ফাজলামি করবি না। ”

পলিন হাসতে লাগলো।

****
আবির বিকালের এই সময় টা ঘুমায়। ফোনের কর্কশ শব্দে ঘুম টা চটে গেল। কোন দিন যে এই ফোন ভেঙে ফেলে কে জানে! আহারে কতোগুলো টাকা দিয়ে কেনা ফোন। যদিও ওর কেনা না, দুলাভাই কিনে দিয়েছে। তাছাড়া এই ফোন টা থাকার একটা সুবিধা হচ্ছে নিজের একটু দাম বাড়ানো যায়। ফোন দেখলেই সবাই চোখ গোল করে তাকায়।

আবির দেখলো ওদের বাজারের দোকান থেকে ফোন। দ্রুত ফোন রিসিভ করতেই পলিন বলল,

“আবির ভাইয়া আমি পলিন?”

“কোন পলিন? অংকে ছয় পাওয়া পলিন?

“ছয় না, আঠারো পাওয়া পলিন। ”

“আচ্ছা আঠারো পাওয়া পলিন কী খবর তোর?”

“দুলু আপা অসুস্থ। ”

“আপার আবার কী হলো? ”

“আপার বাবু হবে।”

“এখনো হয় নি?”

“না। ”

“ছেলে হবে না মেয়ে হবে?”

“আমি কী জানি? এতো কথা বলতে পারব না। টাকা বেশী হয়ে যাবে।”

“আচ্ছা শোন, তুই একা এসেছিস?”

“না বুবুও আছে। ”

“বৃষ্টি কী করছে?”

পলিন একবার বৃষ্টিকে দেখে বলল, মিনিট বেড়ে যাচ্ছে রাখি।

“শোন বৃষ্টিকে টেনশন করতে বারন কর। আমি আসছি।”

“বুবু টেনশন করবে কেন ওর তো বাবু হচ্ছে না!”

বৃষ্টি পলিনের মাথায় একটা ধাক্কা মেরে বলল,

“ফোন রাখ। ”

পলিন বলল,

“আমি রাখছি। ”

“শোন বৃষ্টিকে বল ওর নামের মতো সুন্দর একটা নাম আপার মেয়ের জন্য ঠিক করতে।”

“তুমি বুঝলে কী করে যে আপার মেয়ে হবে?”

“ওসব বুঝতে হলে আগে অংকে পাশ করতে হবে।”

কথা শেষ হবার আগেই বৃষ্টি ফোন কেটে দিয়ে বলল,

“কতো বিল আসছে দেখেছিস? খেঁজুরে আলাপ জমাতে এখানে এসেছিস। ফাজিল মেয়ে।”

“আমার কী দোষ। আবির ভাইয়া….

” চুপ। চল এখন। ”

বিল মিটিয়ে বাড়ির দিকে দুই বোন হাটতে শুরু করলো। পলিন বলল,

“আবির ভাইয়া তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছে। ”

“আমি কী শুনতে চেয়েছি?”

“বলেছে তোমার নামের মতো সুন্দর একটা নাম ঠিক করে রাখতে আপার বাবুর জন্য। ”

“আমার কাছে ওর জন্য একটা ভালো নাম আছে। সাদা মূলা। বলে দিস।”

পলিন আবারও খিলখিল করে হাসতে লাগলো। বৃষ্টিও হেসে ফেলল।

***
বাড়ি ফিরতেই পিকু দৌড়ে এসে আবার খবর দিলো, দুলু আপার একটা বাবু হইছে। মা বলে হাসপাতাল থেকে কিনে আনছে বাবু। কিন্তু আমরা জানি যে আপার পেট ফেটে যাওয়ায় একটা বাবু বের হইছে।

বৃষ্টি ভাইকে চুপ করিয়ে এসে দুলুদের বাড়ির দিকে গেল। পলিন ছুটে এসে বলল,

“আবির ভাইয়ের কথাই ঠিক। আপার মেয়ে বাবু হইছে। আবির ভাই লোক টা কিন্তু জিনিয়াস তাই না?”

“তোর যখন ও’কে এতো ভালো লাগে তাহলে ওর গলায় ঝুলে পড়।”

পলিন আবারও হাসলো। বৃষ্টি বলল,

“সব কথায় হাসবি না। ”

“এবার অন্য কারনে হাসছি।”

“কী কারন?”

“আবির ভাইকে তুমি কী সুন্দর করে ‘ও’ ডাকো। ঠিক মায়েদের মতো করে। মায়েরা বাবাদের যেমন ডাকে। ”

বৃষ্টি রাগী চোখে তাকালো। পলিন হাসতে লাগলো।

চলবে…..