বাড়ির নাম বৃষ্টিলেখা পর্ব-০৩

0
610

#বাড়ির_নাম_বৃষ্টিলেখা
#পর্ব-৩
(কপি করা নিষেধ। তবে শেয়ার করুন)

যত গর্জে ততো বর্ষে না। ঝড়, বাতাস যেভাবে হচ্ছিলো তাতে সবাই ভেবেছে খুব বৃষ্টি হবে। কিন্তু এক পশলা বৃষ্টি হতেই সব শান্ত। তবে বৃষ্টিদের বাড়ির সামনের জামরুল গাছ টা ভেঙে পড়লো। বৃষ্টির বাবা আর কাকা খুব মুষড়ে পড়লো সে কারনে।

সন্ধ্যে থেকে কারেন্ট নেই। হারিকেনের আলোয় পলিনের পড়াশোনা করতে একটুও ভালো লাগে না। ওর আসলে পড়াশোনা করতেই ভালো লাগে না। অংকের মতো ভয়ংকর সাবজেক্ট টা যদি না থাকতো তাহলে কতো ভালো হতো। আজ পলিনের মন টা অবশ্য ভালো। এতো ঝামেলা ঝঞ্জাটের মধ্যে বুবুর চিঠি পাঠানো হয় নি। এমনকি খাম সহ চিঠিটাই হারিয়ে গেছে। বাড়ির লোক এই খবর জানলে অবশ্য যুদ্ধ ঘোষণা করবে। তবুও ভালো। পলিন বৃষ্টিকে ডেকে বলল,

“বুবু শোনো, আল্লাহও চায় না যে বিদেশি ভুত টার সঙ্গে তোমার বিয়ে হোক। ”

বৃষ্টি শুয়েছিলো। বলল,

“মুখ বন্ধ রাখ নাহলে এক থাপ্পড় খাবি। ”

পলিন মুখ বন্ধ রাখলো না। বলল,

“দুলু আপার মেয়েটা কী সুন্দর হয়েছে দেখেছো?”

“সব বাবুরাই সুন্দর হয়। ”

“ওর আসলে তোমার মতোই একটা সুন্দর নাম দেয়া উচিত।”

বৃষ্টি কথা বলল না। এই নাম ওর মায়ের দেয়া। যার চেহারা ওর ভালো করে মনেও নেই। সাত বছর আগে ওর মা এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। যাবার সময় ও’কে নিয়েও যায় নি। বাবা পরদিন ও’কে নিয়ে নানুরবাড়ি গেলেও মা কঠিন গলায় বলেছিল,

“বাবার সঙ্গে চলে যাও। তুমি অতোটাও ছোট না যে আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। তোমার দাদী, ফুপু, কাকী এদের সঙ্গে থাকো।”

এর মাস খানেক পর ওর মায়ের আরেক জায়গায় বিয়ে হয়। আশ্চর্য ব্যাপার হলো বাবার সঙ্গে তার তখনও ছাড়াছাড়ি পর্যন্ত হয় নি। বিয়ে করে অতি দ্রুত বরের সঙ্গে বিদেশে চলে যায়। না কোনো খবর, না কোনো চিঠি, কোনো কিছুই বৃষ্টির ভাগ্যে জোটে নি। বাবা যখন দ্বিতীয় বিয়ে করলো তখন চিঠি পাঠালো যে মেয়েকে নিতে চায়। বাবা সেই চিঠির উত্তর কী দিয়েছিল তা ওর জানা নেই। তবে ভদ্রমহিলা আর কখনো চিঠি লিখে নি।

পলিন বৃষ্টিকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল,

“বুবু কী ভাবছ?”

বৃষ্টি আনমনে বলে ফেলল, যে আমার নাম টা রেখেছিল তার কথা।

পলিনের মন টা খারাপ হয়ে গেল। বুবুর মা’কে ও দেখেছে তবে কিছুই মনে নেই। এই বাড়িতে কেউ তার কথা মনেও করে না। কী কারনে সে বাড়ি ছেড়েছিল তাও জানে না। এই বাড়ির লোকজন সবাই ই ভালো। তাহলে কী এমন কারণ হতে পারে। আর বড় বাবা সে তো মাটির মানুষ।

বৃষ্টির নানাবাড়ির লোকজনও খুব একটা খোঁজ নেয় না। অথচ তারা সবাই ই খুব বড়লোক। কোনোদিন কী ভাগ্নির কথা মনে পড়ে না!

পলিন হারিকেনের আলো টা কমিয়ে দিয়ে বৃষ্টির মাথার কাছে এসে বসলো। বলল,

“তোমার কী এখন তার কথা মনে পড়ছে?”

“হু।”

“একটা কথা বলোতো বুবু, বড় মা তোমায় এতো ভালোবাসে তবুও তোমার তার কথা মনে পড়ে। নাড়ির টান বুঝি এমনই! ”

বৃষ্টি মৃদু হেসে বলল,

“শোন, আমার কাছে ওনার একটা ছবি ছিলো। মা আসার পর সেটা কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিয়েছি। কারণ আমার মা একজনই। যতবার মা শব্দটা উচ্চারণ করি ততবার ওই একটা সরল মুখই ভেসে ওঠে। আর বললি না নাড়ির টান! নাড়ির টান আমি বুঝি না, তবে আত্মার টান ভালো বুঝি। যেটা তোদের সবার সঙ্গে আছে। ”

পলিন খুব খুশি হলো। বলল,

“তুমিও মায়ের থেকে গুছিয়ে কথা বলে শিখে গেছ! এই কথাটা বড় মা’র সামনে একবার বোলো খুব খুশি হবে।”

বৃষ্টি হেসে বলল, এসব তোকেই বলা যায়। আর কাউকে বলতে পারব না।

পলিন হাসলো। মুখে কিছু বলল না। মনে মনে বলল,

“বুবু আমরা তোমায় খুব খুব ভালোবাসি।”

***
আবির সকালেই চলে এলো। একা আসে নি সঙ্গে টুকুকেও নিয়ে এসেছে। আবির দুলুর মেয়েকে কোলে নিয়ে বলল,

“ওর হাত পা এমন ছোট কেন?”

দুলু বলল,

“একদিনের বাচ্চার হাত, পা কী তোর মতো হবে?”

“ওর বাপের কী খবর? আসবে কবে?”

“দুদিনের মধ্যেই আসবে।”

“হাজার টাকা না দিলে মেয়ের মুখ দেখতে দিবি না খবরদার। ”

“বাপ মেয়ের মুখ দেখবে তাতেও টাকা! ”

“হু এটা পানিশমেন্ট। ”

দুলু হাসলো। আবির বাড়ি আসলে মনে হয় বাড়িতে লোকজন আছে। শুধু বাড়ি না, পুরো পাড়া মাতিয়ে রাখে। এবার কতটা মাতিয়ে রাখবে কে জানে! বৃষ্টির বিয়ে ঠিক হয়েছে, এই খবর শুনলে কী পাগলামী করে কে জানে।

আবির বাবুকে দুলুর কোলে দিতে দিতে বলল,

“যাই ওই বাড়ি থেকে একটু ঘুরে আসি।”

“বৃষ্টিকে দেখতে যাচ্ছিস?”

“হু।”

“বৃষ্টি তোকে দু’চোক্ষে দেখতে পারে না।”

“আমিও পারি না।”

“তাহলে দেখতে যাস কেন?”

“ও দেখতে পারে না তাই। ”

দুলু হেসে বলল, পারিসও!

***
আবির খেতে বসেই শুনলো মা বলছে বৃষ্টির জন্য পাত্র দেখা হচ্ছে। পাত্র বিদেশে থাকে। কথাবার্তা চলছে ভালোই। খুব শিগগিরই বিয়ে হয়ে যাবে। আবিরের খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ও বন্ধ হলো। ছোট্ট বেলা থেকে মেয়েটাকে একটু একটু করে বড় হতে দেখলো অথচ বিয়ে করে নিয়ে যাবে অন্যকেউ! ছোট থেকে এতো জ্বালা সহ্য করেছে এমনি এমনি।

আবির ওই বাড়ি আর গেল না। ঘরেই দরজা বন্ধ করে পড়ে রইলো। দুলু ডেকে বলল,

“কেঁদে বুক ভাসাচ্ছিস?”

আবির জবাব দিলো না। চুপচাপ বসে রইলো। অনেক ভেবে চিঠি লিখলো,

“শুনেছি তোমার বাপ, চাচা বিয়ে ঠিক করেছে। তুমিও হয়তো রাজী হবে। তবে জেনে রেখো আমাদের ঘরেও এক বোতল এসিড আছে। সাপের হাত থেকে বাঁচতে মা আনিয়ে রেখেছে। সেই এসিড নিয়ে তোমার বিয়েতে যাব। তুমি কবুল বলার সঙ্গে সঙ্গে সেই এসিড নিজের মুখে ঢেলে দেব। আমি আবির কোনো কিছুই ভুলে যাই না মাঘ মাসের শীতে তোমার জন্য পানিতে চোবানি খেয়েছি। তার শোধ পর্যন্ত নেই নি। এবার নেব। সব শোধ সুদে, আসলে নেব। অনেক হয়েছে আর না। ”

এই চিঠি আবির বৃষ্টিদের বাড়ি কায়দা করে পাঠালো। কোনো জবাব না আসায় আবার লিখলো।

“এসিডের ব্যাপার টা মোটেও নাটক না। সত্যিই কিন্তু মুখ জ্বালিয়ে দেব। ”

দ্বিতীয় চিঠিটা নিজে নিয়ে গেল। বাড়ির লোকের সঙ্গে কথাবার্তা বলে চিঠির ব্যবস্থা করতে লাগলো। বৃষ্টির হাতে চিঠি পাঠাতে গিয়ে বিপাকে পড়লো। বৃষ্টিদের বসার ঘরে দরজার কোনে জুতার র‍্যাকে বৃষ্টির জুতার মধ্যে ফেলতে গিয়ে ভুলে পলিনের জুতায় ফেলল। বিকেলে টিউশন পড়তে যাবার সময় দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া কাগজ জুতার মধ্যে পেল পলিন। খুলেই চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো। বাড়ির যে যেখানে ছিলো ছুটে এলো। পলিনের ফুপাতো ভাই টুকু দাঁড়ি কাটতে গিয়ে গালও কেটে ফেলল চিৎকার শুনে। বসার ঘরে ধুন্দুমার কান্ড। চেচামেচির শব্দ শুনে আবিরদের বাড়ির সবাই ও ছুটে এসেছে। পলিন তখনও বিলাপ করে কাঁদছে আর বলছে ও আল্লাহ, ও খোদা আমারে বাঁচাও। আমার অসহায় বাপ মায়ের মুখের দিক তাকায়ে বাঁচাও। আল্লাহ গো ক্যান আমারে এতো সুন্দর বানাইলা! পাতিলের তলার কালীর মতো গায়ের রঙ ক্যান দিলা না!

চলবে….