#বাড়ির_নাম_বৃষ্টিলেখা
#পর্ব-৪
পুরো ঘটনায় আবির বোকা বনে গেল। সবচেয়ে বেশী অবাক হয়েছে যখন দেখলো চিঠির ব্যাপার নিয়ে বৃষ্টিও খুব সিরিয়াস হয়ে গেছে। বাড়ির লোকেরা সবাই টেনশনে পড়ে গেছে। বাড়ি এসে মেয়েকে হুমকি দিয়ে যাওয়া এতো ভালো লক্ষন না। চিঠি নিয়ে রীতিমতো তদন্তে নেমে পড়েছে সবাই।
আবির চিঠিটা দিয়েছিল পিকুর হাতে। সঙ্গে অবশ্য পিয়াসও ছিলো। চিঠি দেয়ার জন্য দুজনকে দুটো দুই টাকার নোটও দেয়া হয়েছে। ওরা আবিরের কাছ থেকে চিঠি নিয়ে এসে আইসক্রিম কিনতে গেছে। আইসক্রিম নিয়ে খেতে খেতে যখন বাড়ি আসছিলো তখন পলিনের বাবা দোকানে যাচ্ছিলো। ওদের হাতে আইসক্রিম দেখলে দুজনকেই বকা দিবে। সেই ভয়ে কাগজে পেঁচিয়ে আইসক্রিম পকেটে রাখলো। দুর্ভাগ্যবশত আইসক্রিম যে কাগজে পেঁচিয়ে রেখেছে সেটা আবিরের চিঠি ছিলো। কাগজ টা মাঝখান থেকে ছিড়ে দুই ভাই নিয়েছে। আবির অবশ্য সেই ব্যাপার জানে না।
পলিনের কান্না বেড়েই চলছে। মা’কে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আর বলছে, ওমাগো আমি এখন কী করব! রাস্তায় বেরোলেই আমার মুখ জ্বালিয়ে দিবে। আমি কোথায় যাব। আমি আর স্কুলে যাব না। বাড়ি বসে থালাবাসন মাজবো, দাদির সুপুরি কেটে দেব।
পলিনের বাবা, কাকাও অস্থির হয়ে গেছেন। আবির কে দেখে পলিনের বাবা বললেন,
“এই আবির এখন কী করব? থানায় গেলে ভালো হবে?”
আবির আমতা আমতা করে বলল,
“কাকা থানায় গিয়ে কার নামে অভিযোগ করবে তোমরা তো জানোই না যে কে এই কাজ করেছে। ”
বৃষ্টির বাবা বললেন,
“যেই করুক সে তো এই এলাকারই। ধরে ধরে সবার হাতের লেখা মিলিয়ে দেখলেই হবে।”
আবির চুপ করে রইলো। অবশ্য ওর ভয় একটু কম। কারণ এই চিঠি ও লিখেছে বাম হাতে। ছোট বেলায় একবার হাত ভেঙে যাওয়ায় বাম হাতে লেখার প্র্যাকটিস করেছিল। যদিও বৃষ্টি সেটা জানে। মুখ খুললে বিপদ।
বৃষ্টির মা বলল, এই পলু, তোর ক্লাসে এমন কেউ আছে যে তোকে বিরক্ত করে?
পলিন কাঁদতে কাঁদতে বলল, ও বড় মা, ক্লাসের অনেকেই তো আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
বৃষ্টির বাবা ধমকে উঠে বলল,
“সে তো তাকিয়ে তাকিয়ে মাকাল ফল দেখে। অংকে ফেল করিস না এইজন্য। ”
পুরো ঘটনায় বৃষ্টি চুপ করে রইলো। হাতের কাগজ টা ভালো করে দেখতে লাগলো। আবিরের গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। হয়তো এক্ষুনি হাটে হাড়ি ভাঙবে৷ মেয়েটাকে একদম বিশ্বাস নেই। এ জীবনে অনেক বার ও’কে কেস খাইয়েছে।
বৃষ্টি বলল, বাবা এই চিঠিতে তো কোনো নাম লেখা নাই। যে পাঠিয়েছে তার নামও নেই, আর কাকে পাঠিয়েছে সেই নামও নেই। হতে পারে আমাকেও দিতে পারে।
সবাই নড়েচড়ে বসলো। এতো আরেক ভয়ের কথা। আবিরের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে অনেকক্ষন। এবার না ফেটে যায়।
তবে এই কথা বলে বৃষ্টি নিজেও বিপদে পড়ে গেল। কাল থেকে কলেজ যাওয়া আপাতত বন্ধ। কিছুদিন পর সব ঠিক থাকলে আবার কলেজে যেতে শুরু করবে। আর পলিন কে রোজ স্কুলে দিয়ে আসা হবে, আর নিয়ে আসা হবে।
আবির আপাতত হাফ ছেড়ে বাঁচলো। এ যাত্রায় গুলিটা কানের পাশ দিয়ে গেছে।
**
বৃষ্টি সন্ধ্যেবেলা আবির দের বাড়িতে গেল। দুলুর ঘরে গিয়ে বলল,
“আপা কেমন আছ?”
“ভালো রে। পলুর কী খবর? ”
“এই তো ভালো। আজ পড়াশোনা বন্ধ। ওর তো ছুতো পেলেই হলো। ”
“ওভাবে বলিস না। আজ যা গেল। আমি নিজেই তো ভয় পেয়েছি। মা তো নফল নামাজ পড়ে ফেলেছে।”
বৃষ্টি হেসে বলল,
“দুলাভাই কবে আসবে। ”
“দুই একদিনে চলে আসবে। আতিফও আসবে। বেচারা পরীক্ষার জন্য আটকে গেছে।”
“ইশ! আতিফ কে কতোদিন দেখিনা। কলেজে ভর্তি হয়ে তো আর এলোই না।”
“এবার আসবে রে। অনেক দিন থাকবেও বলছে।”
“ভালোই হবে। আতিফ টা তো দূরে থেকেই বড় হয়ে গেল। ”
দুলু হাসলো। বৃষ্টিকে ওর বড় ভালো লাগে। মেয়েটা এমনিতে কথা বলে কম। রাগটাও একটু বেশি। তবুও এতো ভালো লাগে! আবিরের সঙ্গে বিয়েটা হলে কতো ভালো হতো। দূরে তো আর যেতে হতো না।
“কী ভাবছ?”
“ভাবছি এই বছর এই সময় তোর সঙ্গে বসে গল্প করছি। পরের বছর তুই কোথায় না কোথায় থাকিস!”
বৃষ্টি হেসে ফেলল। বলল,
“আজকাল যার সঙ্গে দেখা হয় সবাই ঘুরে ফিরে এই কথাই বলে। ”
“এই বয়স টাই এমন। সবাই কেই এমন শুনতে হয়। ”
বৃষ্টি হেসে বলল,
“তোমার কাছে একটা ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে এসেছি। ”
“কী বলবি?”
বৃষ্টির হাতের মুঠোর কাগজ টা খুলে দুলুকে দেখিয়ে বলল,
“এই হাতের লেখা টা চেন?”
দুলু ভালো করে দেখে বলল, না তো।
“মনে হয় তোমার ভাইয়ের হাতের লেখা। ”
দুলু অবাক হলো না। ও আগেই সন্দেহ করেছিল।
বৃষ্টি বলল, পিকু, পিয়াস কে নাকি কাল একটা কাগজ দিয়েছিল। কী লেখা ছিলো জানিনা। বলেছে আমার পড়ার কাগজ। বাকী টা তোমার উপর ছেড়ে দিলাম। তুমি জেনে জানিও। বাড়ির লোক কে আমি জানাই নি। তোমাকেই জানালাম।
দুলু কিছু বলল না। শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
****
পলিন স্কুল থেকে ফিরছে। হাতে একটা আচাড়ের প্যাকেট। প্যাকেট থেকে একেকটা বড়ই বের করে মুখে দিচ্ছে। আবিরও এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলো। পলিন কে দেখে বলল,
“ওই মুটকি!”
পলিন ঘাড় ঘুরিয়ে আবির কে দেখে আবারও হাটতে শুরু করলো। আবির আবারও ডেকে বলল,
“এই বাংলা সিনেমার মুটকি নায়িকা।”
পলিন এবার দাঁড়িয়ে বলল,
“দেখো আমাকে এসব বলে ক্ষ্যাপাবে না। আমার এমনিতেই এসব সহ্য হয় না। শুনতে খারাপ লাগে। ”
“ওরে বাব্বা! তা স্কুলে যাচ্ছিস একা একা?”
“কী করব! কদ্দিন বাবা, কাকাকে কষ্ট দেব।”
“হ্যাঁ সেটাই। তুই এমনিতেই ভুত্নীর মতো দেখতে। আলাদা করে এসিড মেরে আর চেহারা কী নষ্ট করবে! ও চেহারা তো এমনিতেই নষ্ট। ”
পলিন কিছু বলল না। অন্যসময় হলে খুব মন খারাপ করতো। কেঁদেও ফেলতো। কিন্তু আজ চুপ করে আছে। আবিরের ছোট ভাই আতিফ এসেছে গতকাল। আতিফ চট্টগ্রাম থাকে পড়াশুনার সুবাদে। পলিন প্রায় দেড় বছর পর আতিফ কে দেখলো। আর চট করে প্রেমে পড়ে গেল। ছেলেটা দেখতে কী যে সুন্দর হয়েছে। তাও আবার কঠিন প্রেম। অংক খাতায় অংক না করে আতিফের নাম লিখে রেখেছে।
পলিন জিজ্ঞেস করলো,
“ভাইয়া তোমার ভাইকে কাল দেখলাম। এবার কী অনেক দিন থাকবে।”
আবির চোখ পাকিয়ে বলল, একদম আমার ভাইয়ের দিকে নজর দিবি না। চোখ গেলে দেব।
“নজর কই দিলাম! আজব!”
“তোর হাবভাব ভালো না। তুই কাল তিন বার আমাদের বাড়িতে এসেছিস। এখন আবার ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করছিস!’
পলিন মুখ বাঁকিয়ে অন্যদিকে তাকালো। আবিরের মাথায় হঠাৎ বুদ্ধি এলো। পলিনকে চটিয়ে লাভ নেই। বরং ও’কে দিয়েই কাজ হাসিল করানো যাবে। বোনে বোনে তো আবার খুব খাতির।
আবির শুকনো কেশে বলল, আতিফের সঙ্গে তোর ভাব করিয়ে দেব। তবে একটা শর্তে। আমার একটা কাজ করে দিতে হবে। আমার একটা জিনিস তোর বুবুকে দিবি।
পলিন দাঁড়িয়ে কোমড়ে দুই হাত রেখে বলল,
“বুবু গত নয় বছরে তোমার সঙ্গে কথা বলেনি। আর আমি তাকে তোমার জিনিস দেব? আর শোনো আমি যখন স্কুলে যাই তখন আমার পিছনে ষোলো টা ছেলে লাইন দেয়। তোমার ভাইয়ের নাম্বার লাগবে না। দেখতে তো ওই ভোঁদর মার্কা চেহারা। হুহ!”
“ষোলোটা ছেলে পিছনে যায় না ঘোড়ার ডিম যায়! দেখলাম তো সকালে দুটো কুত্তা নিয়ে স্কুলে যাচ্ছিস। আর ভোঁদর তো তোর চৌদ্দ গুষ্টি। তুই, তোর বোন সবাই। ”
” বুবু ঠিকই বলে। তুমি আস্ত খাটাশ। ”
আবিরের গলা খানিক টা নরম হলো। বলল,
“আর কী বলে তোর বুবু?”
“বলে সাদা মূলাটা কদ্দিন থাকবে রে। ওর যন্ত্রনায় রাস্তায় বের হওয়া যায় না। তার উপর সেদিন দেখলাম প্যান্টের জিপার খোলা। সেই অবস্থায় রাস্তায় হাটছে। ”
পলিন চলে গেল হাসতে হাসতে। আর আবির বজ্রাহত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
***
পলিন বাড়ি ফিরে হাসতে হাসতে বৃষ্টিকে বলল,
“বুবু আজ আবির ভাই কে মুরগী বানিয়ে এসেছি। ”
“মানে?”
পলিন সব খুলে বলল। বৃষ্টি বলল,
“আমি কখন এগুলো বললাম? ”
“আরে জিপার খোলার ব্যাপার টা আমি বানিয়ে বলেছি। আমাকে দেখলেই মুটকি, ফেল্টুস এসব বলে।”
“ছিঃ! তাই বলে এসব বলবি!”
“তোমার দেখি দরদ উথলে উঠছে।”
“এক থাপ্পড় খাবি।”
পলিন হাসতে লাগলো। বৃষ্টি বলল,
“শোন পলু, এরপর কিছু দিতে চাইলে নিয়ে আসিস।”
পলিন চোখ গোল গোল করে বলল,
“কী বললে?”
“আমার মনে হয় চিঠি টাইপ কিছু দিবে। নিয়ে আসিস। ”
পলিন হা করে তাকিয়ে রইলো।
***
সন্ধ্যেবেলা এক বাটি পিঠা নিয়ে পলিন ওই বাড়ি গেল। দুলুর মেয়েকে কিছুক্ষণ কোলে নিয়ে বসে রইলো। আতিফের দেখা পেল না। আতিফ নাকি বাজারে আছে। আবিরও বাজারে ছিলো। ফিরে পলিন কে দেখে বলল,
“তুই আবার এসেছিস কেন? মেরে দাঁত ফেলে দেবার আগে বের হ। ”
পলিন বলল, তুমি না কী দিবে বলছিলে?
আবির নরম হলো। একটা খাম এনে পলিন কে দিয়ে বলল, এক্ষুনি বিদেয় হ।
***
বৃষ্টি চিঠি পড়া শুরু করলো।
সেখানে লেখা,
“এই তুই কী ভাবিস? সূচিত্রা সেন নাকি ববিতা? নাকি আমার বউ হবার ধান্দায় আছিস। সেই ধান্দায় থাকলে পিঠে বস্তা বেঁধে চলাফেরা করিস। একটা কথা মন দিয়ে শোন, তোর চাঁদপানা মুখ দেখে কনসিডার করে তোর সঙ্গে এডজাস্ট করা যায় ঠিকই কিন্তু বাড়িটাকে নরক বানানোর ইচ্ছে নেই। তোর যা মুখ। ওই মুখের জ্বালায় বাড়িতে এরপর একটা কাক, পক্ষিও বসবে না। তাই তোর ফাজলামি বন্ধ কর। আমাদের পাড়া থেকে বিদায় হ। তুই বিদায় হলে বিশ কেজি জিলিপি বিতরন করব। ”
বৃষ্টি চিঠিটা কুটিকুটি করে ছিড়ে ফেলে দিলো। বইয়ের ভাজ থেকে থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে পলিন কে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“আজ সকালে অসভ্য টা’কে যা বলেছিস তার জন্য বখশিশ। এখন একটা চিঠি লিখব। দিয়ে আসলে শনিবার একটা সিনেমা দেখিয়ে আনব।”
পলিন সানন্দে রাজী হয়ে গেল।
চলবে….