বাড়ির নাম বৃষ্টিলেখা পর্ব-০৫

0
423

#বাড়ির_নাম_বৃষ্টিলেখা
#পর্ব-৫
বৃষ্টি চিঠি লেখা শুরু করেও থেমে গেল। হঠাৎ করে দুলু আপার কথা মনে পড়ে গেল। সামনের বছর এই দিনে হয়তো ও এখানে থাকলো ই না। কে জানে, আবিরের সঙ্গে আবার কবে দেখা হবে! হয়তো কোনোদিন দেখা নাও হতে পারে। আবিরও তো সারাজীবন এখানে থাকবে না। বৃষ্টি বলল,

“থাক রে পলু। চিঠি পাঠাতে হবে না। ”

“কেন বুবু?”

“এমনি।”

“আবির ভাই এতোগুলো পঁচা কথা বলল তাও কিছু বলবি না?”

“তুই কী করে জানলি?”

পলিন জিভ কাটলো। এই চিঠি ও আগেই পড়ে ফেলেছে। বৃষ্টি কঠিন গলায় বলল,

“অন্যের চিঠি না বলে পড়া ঠিক না। ”

“আমি ভাবলাম আবির ভাই বুঝি প্রেমপত্র লিখেছে।”

“তোর পড়াশোনা নাই?”

পলিন থেমে গেল। বুবুর মেজাজ খারাপ। আর না ঘাটানোই ভালো।

ওদিকে আবির চিঠি পাঠিয়ে হাত কামড়াচ্ছে। রাগে উল্টাপাল্টা একটা চিঠি লিখেছিল। রাগ কমে গেলে সেটা বাদ দিয়ে একটা ভালো চিঠি লিখেছিল। পলিন কে ভালো টা দেবার বদলে অন্যটা দিয়ে ফেলেছে। বৃষ্টি এর প্রতিক্রিয়া কী দেখাবে কে জানে! আর কী প্রতিক্রিয়াই বা দেখাবে! কথাই তো বলে না। কিছু একটা বললে তাও কথা ছিলো। দরকার হলে জিনিসপত্র ভেঙে রাগ দেখাক। তাও তো দেখায় না। সব রাগ নিজের মধ্যে রাখে। অসহ্য মেয়ে একটা। আর এই অসহ্য মেয়েটার জন্যই ও পাগল হয়ে গেছে।

আবির বৃষ্টিদের বাড়ির দিকে তাকালো। বিদ্যুৎ থাকলে বাড়ির সামনে নামটাও আবছা দেখা যেত। আবির দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনে মনে বলল,

“এতো রাগ কেন তোর? ভুল তো মানুষের ই হয়। দাঁত থাকতে অনেকেই দাঁতের মর্ম বোঝে না। আমিও সেই দলের।”

***
বৃষ্টির রাতে ঘুম হয় নি ভালো করে। ভোরবেলা ওঠার অভ্যাস নেই। মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙে। আজ আগেই উঠেছে। এই বাড়িতে সবার আগে মায়ের ঘুম ভাঙে। ঘুম থেকে উঠেই চায়ের পানি চাপিয়ে নামাজ পড়ে নেয়। নামাজ শেষ হতে হতে চা হয়ে যায়। ততক্ষনে বাড়ির সবাই আস্তে আস্তে উঠে পড়ে।

বৃষ্টি আজ চায়ের পানি চাপালো। রান্নাবান্না অল্প বিস্তর পারে। খুব একটা আগ্রহ নেই বলে শেখা হয় নি। বাড়ির কেউ আর জোরও করে নি। তবে ও শুনেছে যে ওই বাড়িতে বৃষ্টিকে কিছু করতে হবে না। ওখানে রান্নার লোক আছে।

“আজ কী বৃষ্টিলেখার মন খারাপ? ”

ছোট মা’র গলার শব্দে চমকে উঠলো। হেসে বলল,

“ওমা তুমিও আজ সকালে যে।”

“রাতে ভালো ঘুম হলো না। তুমি এতো সকালে? ”

“আমারও।”

ছোট মা পাশে এসে দাঁড়ালেন। বললেন,

“তোমার মন খারাপ? ”

“না।”

“আমার তো মনে হচ্ছে।”

বৃষ্টি হাসলো।

ছোট মা বললেন,

“কলেজে যেতে পারছ না সেজন্য নাকি অন্য কারনে? ”

“এমনি।”

“বৃষ্টিলেখা? ”

“হ্যাঁ ছোট মা?”

“তোমার কী কোনো পছন্দ আছে?”

“না।”

“থাকলে বলো। বিয়ের কথাবার্তা শুরু হবার পর পর ই তোমাকে কেমন অন্যরকম লাগছে।”

বৃষ্টি হেসে বলল, তোমাদের ছেড়ে থাকতে হবে ভাবলেই তো সব ওলট, পালট লাগে।

ছোট মা বৃষ্টির হাত ধরে বলল, চলো বাইরে যাই। চায়ের পানি ফুটতে থাকুক। তুমি আমি চা বানালে বাড়ির লোক খেয়ে শান্তি পাবে না।

বৃষ্টি হেসে বলল, চলো।

***
বাইরে বাধানো সিড়িতে দুজন বসলো। ছোট মা বললেন,

“তোমার মন ভালো করার জন্য কী করতে পারি বলোতো?”

“তোমার বিয়ের গল্প বলো।”

“এই গল্প তো তুমি একশবার শুনেছো।”

“কিন্তু তোমার মুখে একবারও শুনিনি। কাকা সবসময় নিজের মতো করে বলে।”

ছোট মা হেসে বললেন, বিয়ের গল্প সাদামাটা। তোমার কাকা যখন চিঠিতে লিখলো যে আমাকে বিয়ে করতে চায় তখন আমি ভয় পেয়ে যাই। কারণ আমি তখন মামার বাসায় থাকি। বাড়িতে অবস্থা তেমন ভালো না। মামার বাসায় থাকলে বাবার সুবিধা হয়। মামা দয়া করে কলেজে ভর্তি করে দিলেন। মামী যদিও কাজের লোক বানিয়ে রেখেছিল। তবে মামার ওই দয়াটুকুর জন্য আজীবন কৃতজ্ঞ।

তোমার কাকাকে আমি আগে দেখিনি। প্রথম দিন পড়াতে এসে উনি তিন বার পানি চাইলেন। আমার তখনই মনে হলো যে তিনি না খেয়ে আছেন। আমার ভাগের খাবার টুকু তাকে পাঠালাম। পরদিনও তেমন। এভাবে কয়েকদিন কেটে যাবার পর উনি জানতে পারলেন। এরপর বিয়ের প্রস্তাব দেবার পর আমি খাবার পাঠানো বন্ধ করলাম। উনি তারপরও কয়েকটা চিঠি পাঠালো। ভাগ্য ভালো যে সেই চিঠি কারোর হাতে পড়ে নি। এর সপ্তাহ দুয়েক পর অন্য ঘটনা ঘটলো। আমার মামীর বোন এলো বেড়াতে। তার কিছু জিনিস খুঁজে না পাওয়ায় আমাকে চোর ধরে নেয়া হলো। সেদিন আমি ভয়ংকর সাহস দেখিয়ে তোমার কাকার সামনে গেলাম। বললাম আমাকে একটু বাড়ি পৌছে দিতে পারবেন।

বৃষ্টি হেসে বলল, তোমার মামীর সেই বোন কী বেঁচে আছে তাহলে একদিন বাড়িতে ডেকে আপ্যায়ন করতে হবে।

ছোট মা হেসে ফেললেন। বললেন,

“বাড়ি ফেরার পথে তোমার কাকা আমার সঙ্গে খুব একটা কথা বললেন না। একবার শুধু জানতে চেয়েছিল কিছু খাব কী না। কিন্তু বাড়িতে ঢুকেই আমার বাবাকে বললেন, আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই। আমার বাবা তো অবাক। কথা নেই বার্তা নেই সোজা ঢুকেই বিয়ে। ”

“পলু কিন্তু খানিকটা কাকার স্বভাব পেয়েছে ছোট মা। আচ্ছা তারপর কী হলো? ”

“বাবা তো রেগে গেলেন। কিন্তু সামলে নিলেন আমার মা। মা বললেন মুরব্বিদের নিয়ে আসলে তারা ভেবে দেখবেন। তোমার কাকা পরদিন ই তোমার বাবা, দাদু, ফুপুকে নিয়ে গেলেন। সেখানে ঘটলো আরেক ঘটনা। তোমার কাকা তখনও তেমন কিছু করে না। আমার বাবা তো বেঁকে বসলেন। বেকার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিবেন না। তখন তোমার দাদু আমাকে ডেকে বললেন, রেনু আমি যতদিন আছি ততদিন তোমার খাওয়া পরার অসুবিধে হবে না। ততদিনে আমার ছেলে নিজেকে গুছিয়ে নিবে। তুমি কী সুযোগ দিবে।

আমি তখন বললাম, বাবা বিয়ে করলে আমি আপনার ছেলেকেই করব।

ছোট মা থেমে গেল। বৃষ্টি বলল,

“তারপর? ”

“তারপর বিয়ে হলো। এই বাড়িতে এলাম। এই তো…..

“এটা তো গল্পের শেষ না। এই বাড়িতে শুরুর দিকে তুমি খুব কষ্ট করেছো। সেই গল্পটা শুনতে চাই।”

ছোট মা বৃষ্টির এক হাত মুঠোয় নিয়ে বলল,

“এই গল্পটা না শোনাই থাক তোমার। তোমাকে একটা কথা বলি। এই বাড়িতে তোমার মা’কে নিয়ে কথা কম হলেও তুমি হয়তো কিছু জানো। সেজন্য কথাটা বলা। সব মানুষ একরকম হয় না, তোমার মাও একটু অন্যরকম ছিলেন। একান্নবর্তী পরিবারে উনি থাকতে চান নি। এটা আসলে ওনার দোষ না। উনি অন্য পরিবেশে থেকে অভ্যস্ত তো। তবে উনি বোধহয় ততোটা খারাপ ছিলেন না। আমার সঙ্গে তেমন আলাপ জমেনি সেটা ঠিক…..

বৃষ্টি হেসে বলল, তুমি খুব ভালো মানুষ তাই এভাবে বলছ। আর পরিবেশের কথা বলছ! তাহলে আমারও তো বিয়ের পর অন্য পরিবেশে গিয়ে থাকতে হবে।

“তুমি বড্ড বেশী ভাবছ। কিচ্ছু হবে না। তুমি চমৎকার একটা মেয়ে। আমি নিশ্চিত যার সঙ্গে বিয়ে হবে সেও চমৎকার একজন মানুষ হবে। ”

বৃষ্টি চুপ করে রইলো। ছোট মা বললেন,

“তোমাকে আর একটা কথা বলি, আবিরের সঙ্গে এবার কথা বলো। অনেক তো হলো অভিমান। বিয়ে হয়ে চলে গেলে তখন আফসোস হবে। তখন আর শোধরানোর কিছু থাকবে না। বেশী কিছু বলতে হবে না, শুধু বলবে যে তুমি ওকে ক্ষমা করে দিয়েছো। ”

“কিন্তু আমি তো ও’কে ক্ষমা করিনি।”

“শোন, অভিমানী মেয়ে ক্ষমা আগেই করেছ। এই যে এতো বছর ধরে কথা বলছ না সেটা আসলে অভিমান। ”

বৃষ্টি মাথানিচু করে বসে রইলো।

“অভিমান যা আছে সব ভেতর থেকে বের করে দাও। অভিমান পুষে রাখা মানে জীবনে সেই লোকটার উপস্থিতি বজায় থাকা। নতুন জীবন যখন শুরুই করবে সেখানে অন্যকাউকে জায়গা দেয়া ঠিক হবে!

বৃষ্টি কিছু বলছে না। কাঁদছে নিঃশব্দে।

চলবে…