বাড়ির নাম বৃষ্টিলেখা পর্ব-০৬

0
408

#বাড়ির_নাম_বৃষ্টিলেখা
#পর্ব-৬
বৃষ্টির মা এসে দুজন কে একসঙ্গে দেখে বললেন,

“আমি ভাবছি রেনু উঠে চায়ের পানি চাপিয়েছে। এতো দেখি বৃষ্টিও আছে। আজ না ডাকতেই উঠলি যে!”

বৃষ্টি হেসে বলল, ভালো মেয়ে হবার চেষ্টা করছি মা।

“সেকি কথা! আমার মেয়ে কী খারাপ নাকি! ”

রেনুও হেসে ফেলল। বলল, ওর ঘুম ভেঙেছে তাড়াতাড়ি আজ। এতো চিন্তা কোরো না।

“গল্প শেষ হলে চা খেতে আয়। বাকীদের মনে হয় এতক্ষনে খাওয়াও হয়ে গেছে।”

বৃষ্টি উঠে এলো। ছোট মা’র সঙ্গে কথা বলার পর মন টা একটু হালকা লাগছে। আজ বাড়ি থেকে বেরোতে পারলে ভালো হতো। চিঠিটা এখন অবধি পাঠানো হয় নি। বাবা প্রতিদিন চিঠির প্রসঙ্গ তোলে। কবে যে নিজে পোস্ট অফিসে খোঁজ নিতে যায় কে জানে!

***
পলিন স্কুলে যাবার জন্য তৈরী হচ্ছিলো। বৃষ্টি এসে বলল,

“পলু একটা কাজ করতে পারবি?”

“কী কাজ বুবু?”

“তুই একবার পোস্ট অফিসে যেতে পারবি?”

“একা?”

বৃষ্টি একটু ভাবলো। তারপর বলল,

“আমার শরীর টা ভালো লাগছে না। নাহলে যেতাম। চিঠিটা পাঠানো দরকার। আজ না হলে আবার আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তোদের না তিন দিনের জন্য স্কুল ছুটি থাকবে?”

“হু। আবির ভাই কে নিয়ে যাব?”

বৃষ্টি কঠিন গলায় বলল, না।

“তাহলে আতিফ ভাই কে নিয়ে যাই?”

বৃষ্টি একটু ভেবে বলল, সেটাই ভালো হয়।

পলিন বলল, তুমি একটু বলে দাও। আমার সঙ্গে তো তেমন কথা বলে না।

“ও একটু চুপচাপ ই। ভাইয়ের মতো বকবক করে না। আচ্ছা চল আমি বলে দিচ্ছি। ”

***
আবির আর আতিফ দুই ভাই স্বভাবে দুই রকম। আতিফ একটু কথা বলে কম। নিজের মধ্যে থাকতেই পছন্দ করে। পড়াশোনা নিয়ে খুব সিরিয়াস। বৃষ্টিকে দেখে আতিফ বলল,

“বুবু তুমি নাকি আমায় খুঁজছিলে?”

“হ্যাঁ রে। আমার একটা কাজ করে দিবি?”

“হ্যাঁ বলো। ”

“আমার একটা চিঠি পোস্ট করতে হবে। তুই একটু পলিনের সঙ্গে যেতে পারবি?”

আতিফ মাথা চুলকে বলল, বুবু তুমি আমায় দাও আমি পোস্ট করে দেব।

বৃষ্টি আতিফের কাছে চিঠিটা দিতে চাচ্ছে না। এই ছেলেটা যদি ভাইয়ের কথায় শয়তানি করে চিঠি না পাঠায়! তাই বলল,

“নারে পলুকে সঙ্গে নিয়ে যা। ও ওইদিকে যাবে বলছিল।”

“আচ্ছা।”

***
পলিনের খুব খুশি লাগছে। আতিফের সঙ্গে কথা বলার জন্য ও মুখিয়ে থাকে। আতিফ ছেলেটা সেই প্রথম দিন শুধু ওর কেমন আছ’র উত্তরে ভালো বলে আর কথাই বলে না। পলিনও তাই গায়ে পড়ে আর কথা বলতে পারে না।

বৃষ্টি চিঠি আর টাকা দিয়ে বলল, কোনো শয়তানি করবি না। চিঠি কিন্তু পাঠাবিই।

“আচ্ছা।”

***
রিকশায় বসে পলিন আতিফ কে জিজ্ঞেস করলো,

“আপনি কতদিন থাকবেন? ”

“জানিনা।”

আতিফ সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। পলিনের দিকে তাকাচ্ছেও না। পলিনের আবার কথা না বলে থাকতে পারছে না। পলিন আবারও জিজ্ঞেস করলো,

“আপনি কী সবার সঙ্গেই কথা কম বলেন?”

“কথা কম বলি সেটা কে বলল?”

পলিন থতমত খেল। প্রশ্নের পিঠে পাল্টা প্রশ্ন আসবে সেটা ভাবেনি।

“না দেখে মনে হলো। ”

“কথা কম বলিনি। যতটুকু বলার দরকার ততোটুক বলি।”

“ওহ তাহলে বুঝি মেয়েদের সঙ্গে কথা কম বলেন?”

“সেটা জেনে তোমার কী দরকার? ”

পলিন চুপ করে বলল। এই ছেলে ঠাস ঠাস কথা বলে। আবির ভাই ঠাস ঠাস কথা বললেও সে কথায় মিষ্টতা আছে। কিন্তু এই ছেলের কথায় তিতায় ভরা। পলিন আর কথা বলল না। চুপচাপ রইলো। পোস্ট অফিস ওদের বাড়ি থেকে বেশ দূরে। রিকশায় করে গেলেও ত্রিশ মিনিটের মতো লাগে। পলিন কিছু সময় থেমে থেকে বলল,

“এই যে বাড়ি থেকে দূরে থাকেন আপনার খারাপ লাগে না?”

“না।”

“আমি হলে তো দুদিনেই মরে যেতাম।”

“আচ্ছা।”

“পড়াশোনার জন্য বাড়ির লোকজনের জন্য দূরে থাকা। ভাবলেই দম বন্ধ হয়ে মরে যাব।”

“তা অংকে ফেল করো তাতে মরে যেতে ইচ্ছে করে না?”

পলিনের মুখ শুকিয়ে ছোট হয়ে গেল। ফেল নিয়ে অনেকে অনেক কথা বললেও এতো খারাপ লাগে না। কিন্তু আজ খারাপ লাগছে। পলিনের চোখে পানি এসে যাবে। ওর আবার বিশ্রী এক স্বভাব আছে। নিঃশব্দে কাঁদতে পারে না। ভেউ ভেউ করে কাঁদতে হয়। পলিন চোখ মুছে রিকশাওয়ালাকে বলল,

“চাচা রিকশা থামান তো। আমি নামব।”

আতিফ বলল,

“নামবে মানে কী? পোস্ট অফিস এখনো খানিকটা দূরে।”

রিকশাওয়ালা রিকশা থামাতেই পলিন নেমে গেল। ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিয়ে বলল,

“অর্ধেক ভাড়া নিন। বাকীটা ওনার থেকে নিবেন।”

আতিফ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো।

পলিন কাঁদতে কাঁদতে হাটা শুরু করলো।

আতিফ তখনও তাকিয়ে আছে। এরকম কিছু যে হবে সেটা ও বুঝে উঠতে পারেনি।

বৃষ্টিলেখাদের বাড়ির এই বাউন্ডুলে, ফেলু মেয়েটার জন্য পড়াশোনা ওরিয়েন্টেড ছেলেটা একসময় পাগল হয়ে যাবে। সেই পাগলামীর গল্প যথাসময়ে লেখা হবে।

****
“আমার নাম পলিন। নাম টা কী সুন্দর? নাম টা আমার বাবার দেয়া। আমাকে আপনি চিনবেন আগের চিঠিটা পড়ে। যেখানে আমার বুবু আমাকে নিয়ে লিখেছে। আমি জানি বুবুকে আপনার খুব পছন্দ হবে। কিন্তু আপনি তাকে বিয়ে করতে আসবেন না কেমন। এটা আপনার কাছে অনুরোধ। আপনি এই অনুরোধ রাখবেন। নাহলে আমি খুব খুব অভিশাপ দেব আপনাকে। আপনি বুবুকে বিয়ে করবেন না কারণ আমাদের বুবুকে অতদূরে পাঠাতে আমরা রাজী না। বাড়ির বড়দের কথায় অতো গুরুত্ব দেয়ার দরকার নেই। ওরা বুঝতে পারছে না যে এরপর ওদের মেয়ের জন্য কেঁদেকেটে অস্থির হতে হবে। কিন্তু আমি বুঝি। আরেকটা কারনে আপনি বুবুকে বিয়ে করবেন না প্লিজ। সেই কারণ হলো বুবুকে একজন পাগলের মতো ভালোবাসে। আপনি উড়ে এসে বুবুকে নিয়ে যাবেন সেটা হতে দেয়া যায় না।

বুবুকে যে ভালোবাসে তার নাম আবির। আবির ভাই দেখতে ফর্সা। চুলগুলো খানিকটা কোকড়া। লম্বা আর রোগা। রোগার কারনে বয়স বোঝা যায় না। দেখতে ছোট লাগে। আবির ভাই আমাদের বাড়ির পাশের লোক। সে বুবুকে খুব ভালোবাসে। সেই খবর আমাদের পাড়ার দোকানদার থেকে শুরু করে লাল, সাদা কুকুর টা পর্যন্ত সবাই জানে। বুবুও জানে। কিন্তু সে বাসে না। তার মনে আবির ভাইকে নিয়ে অনেক রাগ। অনেক বছর ধরে কথাও বলে না। এই রাগের কারণও আপনাকে বলি।

বুবু আর আবির ভাই একসঙ্গে বড় হয়েছে। বুবু আবির ভাইয়ের সঙ্গে স্কুলে যেত। পড়া না পারলে তার কাছে বুঝতে যেত। এভাবে চলতে থাকলে তো মায়া হবেই তাই না! বুবুরও আবির ভাইয়ের জন্য মায়া তৈরী হয়েছিল। একবেলা না দেখে থাকতে পারছিল না। এইরকম ই হয় বুঝলেন। বাড়িতে একটা মুরগী পালতে শুরু করলে তার জন্যও এমন মায়া হয়। সন্ধ্যেবেলা সেই মুরগীকে না দেখতে পারলেও অস্থির লাগে। আর সেখানে আবির ভাই তো আস্ত একটা মানুষ। বুবুর দূর্বলতা আবির ভাই বুঝতে পারলো না। ছোটবেলায় হাবাগোবা টাইপ ছিলো। সে শুধু ক্রিকেট, সিনেমা আর পড়াশোনা বুঝতো। বুবুও মুখে কিছু বলতো না।

একবার একটা ঘটনা ঘটলো। আমাদের পাড়ায় এক পরিবার থাকতে এলো। ব্যটা পুলিশ। সেই পুলিশের মেয়ের নাম লীনা। লীনা বুবুর সঙ্গে ভর্তি হলো। আবির ভাই, বুবু এদের সঙ্গেই স্কুলে যায়। লীনা আমাদের মতো না। চুল কাটা, জামাকাপড় ও অন্যরকম। ক্রিকেট খেলতে পারে। অন্ধকারে ভয় পায় না। খুব সাহস। তার মধ্যে আবার ক্লাসে ফার্স্টও হয়। সেটা দেখে আবির ভাই বুবুকে বললেন, তোর লজ্জা হওয়া উচিত। দেখছিস ও সব পারে। বুবুর খুব জেদ হলো। সে একটা ভয়ংকর কাজ করলো। জীবনেও না নাচা বুবু লীনার সঙ্গে পাল্লা দিতে নাচে নাম লেখালো। স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বুবু নাচতে গিয়ে বিপাকে পড়লো। আগে রিহার্সালে যেটুকু বা ভালো করছিল সেটাও ঘেটে গেল বেশী লোকজন দেখে। বুবু নাচের তাল হারিয়ে ফেলল। লোকজন হাসাহাসি শুরু করলো বুবু তখন উল্টাপাল্টা নাচতে গিয়ে আরও বিপাকে পড়লো। শাড়ি খুলে এলোমেলো হয়ে গেল। চারদিকে হাসির শব্দ। সেই হাসির মধ্যে আবির ভাইয়ের সাদা দাঁতের হাসি ছিলো। সে নাকি ষাড়ের মতো হাসছিল। বুবু ওখান থেকে ছুটে এলো কাঁদতে কাঁদতে। আবির ভাইয়ের সামনে যখন পড়লো তখন সে বলল, আর লীনার সঙ্গে নিজের তুলনা করতে যাস না। এবার তো শাড়ি খুলে ফেলেছিস। পরের বার দেখা যাবে পায়খানা, পিশাব করে ফেলেছিস। বুবু এক ভয়ংকর কান্ড ঘটালো। একটা আঁধলা ইট হাতে নিয়ে আবির ভাইয়ের মাথা বরাবর মারলো।

এই ঘটনায় জীবনে প্রথম বাবা বুবুকে খুব মেরেছিল। এতো মার মেরেছে যে তার প্রথমে জ্বর আর পরে টাইফয়েড হয়েছে। মাথার চুল ফেলে দিতে হয়েছে। বুবু সেই বছর আর স্কুলে যায় নি। খুব অসুস্থ ছিল। ঠিকঠাক খেতোও না। কারোর সঙ্গে কথা বলতো না।

আর ওদিকে হাবাগোবা আবির ভাই মাথায় আঘাত পেয়ে ভালো হয়ে গেলেন। বুবুর সঙ্গে কথা বলতে এলেন ঠিকই কিন্তু বুবু যখন কথা বলল না তখন ভাবলেন কদিন রাগ করে বুবু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঠিক হলো না। অনেক অনুনয় করেও কাজ হলো না। আবির ভাই ধৈর্য্যহারা হয়ে গেলেন। ঘোষণা দিলেন যে বুবু কথা না বললে সে এসএসসি পরীক্ষা দিবেন না। সত্যিই তাই হলো। সবাই খুব করে বুঝিয়েও কাজ হলো না। ওদিকে বুবুকেও বোঝানো হলো। কিন্তু সে তার মতোই কঠিন।

এভাবেই চলছে। আবির ভাই বাড়ি এসে আগে আমাদের বাড়ি আসে এক নজর বুবুকে দেখতে। এই খবর সবার জানা। বাড়ির লোকের আপত্তি নেই আবির ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে। কিন্তু বুবু সাফ জানিয়ে দিয়েছে। আত্মীয় বা পরিচিত কাউকে সে বিয়ে করবে না। কারণ এসব লোকেরা সম্মান দিতে জানে না।

আপনি বড় মানুষ। বলুন এই ভুল টুকু কী সত্যিই ভুল। ছোটবেলায় না বুঝে তো অনেকেই অনেক কিছু বলে ফেলে। আবির ভাই সবসময় ই এমন। কথাবার্তায় লাগাম নেই। তাই বলে দেয়ালের এক পিঠ দেখলে তো হয় না। কারোর বিপদ আপদে সবার আগে যাকে পাওয়া যায় সে হলো ওই লোক টা। এই ভালো মানুষ টা বুবুকে দেখলে টালমাটাল হয়ে যায়। চোখের ধরন পাল্টে যায়। নীচু গলায় যখন জিজ্ঞেস করে বৃষ্টি আমার কথা কিছু বলে, তখন আমার খুব মায়া হয়।

আপনি আসবেন না। চিঠি লিখে জানাবেন যে বুবুকে পছন্দ হয় নি। বাড়ির লোকেরা তাতে একটু অসন্তুষ্ট হলেও মনে মনে খুশি হবে। এই বাড়ির লোকেদের আপনি চিনেন না। আমি মামাবাড়ি বেড়াতে গেলে আমার পছন্দের শিম ভর্তা টা পর্যন্ত এরা খেতে পারে না। তারা কিভাবে সাত সমুদ্রের ওপারে মেয়েকে পাঠিয়ে থাকবে! এরা নিজেরাই পাগল হয়ে যাবে।

আপনি আমার অনুরোধ রাখলে আমি আপনার জন্য দোয়া করব। আমি বুবুর মতো এতো গুছিয়ে লিখতে পারি না। কথা বেশী বলি তাই চিঠিও বড়। আমার চিঠির জবাব দিবেন। আর আমার কথা রাখবেন।

ইতি পলিন।

চলবে….