#বাড়ির_নাম_বৃষ্টিলেখা
#পর্ব-৭
আতিফ কে বাড়ি ফিরতে দেখে বৃষ্টি বলল,
“তুই তো এই গেলি। এর মধ্যে চলে এলি যে?”
আতিফ আমতা আমতা করে বলল,
“পলিন বলল ও একাই যেতে পারবে।”
“এটা কেমন কথা! ও যদি একাই যেতে পারতো তবে তোকে কেন পাঠালাম?”
আতিফ কিছু বলল না। বৃষ্টিকে আতিফের সঙ্গে কথা বলতে দেখেই আবির বেরিয়ে এলো। এসে বলল,
“কী হয়েছে রে?”
আতিফ পলিনের রিকশা থেকে নেমে যাবার কথাটা বলল। সব শুনে আবির ভাব বাচ্যে বৃষ্টির উদ্দেশ্যে বলল,
“এতো টেনশন করতে হবে না। আমি যাচ্ছি।”
বৃষ্টিও ভাববাচ্যে বলল, কাউকে যেচে এতো দরদ দেখাতে হবে না। আমার বোন আমি বুঝব।
আবিরও মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“আতিফ জিজ্ঞেস কর, এতোই যখন বোনের ব্যাপার নিজে বুঝবে তাহলে তোকে কেন পাঠিয়েছিল!”
বৃষ্টি আরও কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। এই ঝগড়া বাড়তে দেয়া যাবে না। বাড়ির লোক জেনে যাবে। তাই হনহন করে হেটে গেল। বৃষ্টি যেতেই আবির আতিফ কে বকাবকি শুরু করলো। খানিকক্ষন বকাবকি করে চলে গেল।
***
পলিন স্কুল থেকে ফেরার পর আজ আর ভাত খেতে বসে নি। বৃষ্টির মা ব্যস্ত গলায় বলল,
“ওমা ভাত খাবি না কেন! বাইরে কিছু খেয়ে এসেছিস?”
“না। ”
“তাহলে খাবি না ক্যান? আয় আমি খাইয়ে দেই।”
“না বড় মা। খেতে ইচ্ছে করলে খাব।”
বৃষ্টি পাশেই ছিলো। বলল,
“মা ছেড়ে দাও। নিশ্চয়ই হাবিজাবি খেয়েছে। খিদে পেলে খেয়ে নিবে।”
মা আর জোর করলো না। বৃষ্টি পলিন কে ঘরে ডেকে বলল,
“আতিফ তোকে কী বলেছে পলু?”
“ছাড়ো বুবু। ”
“আমাকে বল। ”
“সবাই যা বলে। ফেল্টুস। গাধা এসব।”
“তুই কী বলেছিস?”
“কিছু বলিনি। রিকশা থেকে নেমে গেছি।”
“খুব ভালো করেছিস। আতিফ কে যা বলার আমি বলে দেব। তুই মন খারাপ করিস না।”
পলিন তারপরও মন খারাপ করে রইলো। না খেয়েই সারা বিকেল ঘুমালো। সন্ধ্যেবেলা নিজেই পড়তে বসলো।
****
বৃষ্টি পরদিন সকালে আতিফ কে গিয়ে সোজা জিজ্ঞেস করলো,
“এই তুই আমার বোন কে ফেলু বলেছিস কেন?”
আতিফ আমতা আমতা করে বলল,
“না মানে…
পাশে দুলু আর আবির ছিলো। আবির ফোড়ন কেটে বলল,
“ফেলুকে ফেলু বলেছে তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে!”
বৃষ্টি কঠিন গলায় বলল,
“এই আতিফ শোন, আমার বোন কে দেখলে আর উল্টাপাল্টা কথা বলবি না। তুই ও না আর তোর ভাইও না। আমরা ফেলু হই আর যা হই তোদের গলায় ঝুলে পড়ার জন্য মরে যাচ্ছি না।”
আতিফ চুপ করে রইলো। আবির বলল,
“আমরাও গলায় ঝোলানোর জন্য বসে রই নি।”
দুলু দুজনের কাউকেই কিছু বলল না। মিটিমিটি হাসতে লাগলো। দুটোর বয়স হয়েছে কে বলবে! এখনো পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করে যাচ্ছে। বৃষ্টি যে গতিতে এসেছিল আবার সেই গতিতেই চলে গেল। আতিফ বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে৷ পলিন কে তো সবাই ই ফেলু বলে। ও বলায় কী এমন হয়েছে।
আবির এসে আতিফ কে বলল,
“ওই বাড়ির মেয়েদের দেখলে আর রাস্তা দিয়ে হাটবি না। এরা ভয়ংকর জিনিস। ”
দুলু হেসে বলল,
“এই কথা তুই মানিস তো?”
“মানি বলেই তো দূরে থাকি। ”
“আচ্ছা। রাত বিরাতে দক্ষিণের বারান্দায় এমনিই তাকিয়ে থাকিস?”
আবির থতমত খেয়ে গেল। এদের সঙ্গে বড় বড় কথা বলে আসলে লাভ নেই। ওর মনের কথা সবাই ই জানে। শুধু যার জানার কথা সেই জানে না।
***
আজ শুক্রবার। শুক্রবার এই বাড়ির রুটিন অন্যরকম। ফজরের নামাজ শেষে চা খাওয়া হয় না। শুক্রবারে সবাই চা খায় সাড়ে সাত টার দিকে। ছেলেমেয়েরাও এই দিনে একটু বেশি ঘুমায়।
পলিন আজ তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠেছে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে ভালো করে পড়াশোনা করবে। আতিফ বদমায়েশ টাকে এসএসসি পাশ করে দেখিয়ে দিবে। কলেজেও ভর্তি হবে। ফেলু তো দূরে থাক, এরপর কথা বলতে এলে মুখ থ্যাবড়া করে দিবে।
***
বৃষ্টির দাদি পেয়ারা গাছের পাশে মোড়া পেতে বসেছে। সকালের মিঠে রোদ টা গায়ে লাগছে। বৃষ্টি এসে পাশে বসলো। দাদী বলল,
“কী বুবু? ”
“তুমি একা বসে আছ তাই বসলাম।”
দাদী হাসলো। বৃষ্টির চেহারা খানিকটা ওর মায়ের মতো। কিছুটা কাঠিন্য ভাব। ওর মা অবশ্য পুরোটাই কঠিন ছিলো। হাসলে তাকে কেমন দেখতে লাগে সেটা কেউ জানে না। বৃষ্টির চলেফেরা, কথাবার্তায়ও ওর মায়ের ছাপ আছে। বাবার গুন খুব কম পেয়েছে। দাদীকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বৃষ্টি বলল,
“আমার দিকে তাকিয়ে কী ভাবছ?”
“বিয়ার কথা হইতেই তুমি সুন্দর হয়ে গেছ।”
বৃষ্টি মৃদু হেসে বলল, তোমরা সবেতে বিয়ের কথা কেন বলো।
দাদী হেসে বৃষ্টির একটা হাত ধরে বলল,
“তুমি বিয়া নিয়া খুব ভয়ে আছ না? এতো ভয় কিসের গো বুবু? বিয়ার পর তুমি তো তোমার মায়ের কাছে থাকবা।”
বৃষ্টি দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷ বৃষ্টির যার সঙ্গে বিয়ের কথা চলছে সে ওর জন্মদাত্রী মায়ের পছন্দ করা পাত্র। তার স্বামীর আগের পক্ষের ছেলে। বাড়ির লোক আপত্তি করতে পারে নি কারণ ওর মা আগেই বলেছিল মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে তার মতামতের গুরুত্ব দেয়া যেন হয়।
বৃষ্টি হেসে বলল,
“উনি মা হলেই বা কী দাদী? আমি তো ভালো করে চিনিই না।”
“তোমারে কতো চিঠি লিখলো তুমি তো জবাব দিলা না বুবু।”
বৃষ্টি চুপ করে রইলো।
দাদীও চুপ করে আছেন। বৃষ্টির মায়ের নাম ইসমত আরা। পড়াশোনা জানা মেয়ে। বৃষ্টির দাদার অফিসে চাকরি করতো ওর নানা। সেই সুবাদে বিয়ে। বিয়ের দিন থেকেই ইসমত তার কঠিন রুপ দেখিয়ে দিয়েছেন। সে যে সবার চেয়ে আলাদা সেটাও বুঝিয়ে দিয়েছে। বউ ঘরে তোলার সময় বৃষ্টির ফুপু হাত ধরতে গেলে কঠিন গলায় বলেছিল,
“হাত ছাড়েন। আমি একাই হাটতে পারব।”
চাল, চলনে অহংকার প্রকাশ পেল কয়েকদিনেই। সবাই ভাবলো আস্তে আস্তে বুঝি সব ঠিক হয়ে যাবে। ঠিক হলো না। এরপর মেয়ে হলো। তাতেও কোনো কিছু ঠিক হয় নি। সংসারের সব কিছুতে অভিযোগ। ঝগড়াঝাটি করে দরজা বন্ধ করে পড়ে থাকা। একসময় তো বেরিয়েও গেল৷ তুচ্ছ কারণে বেরিয়ে গেল। রেনু যেদিন থেকে এই বাড়িতে এলো সেদিন থেকে শুরু হলো আরেক অশান্তি। মেয়েটা চুপ করে থেকেও শান্তি পায় নি একফোটা। কোনও কোনও দিন তো খাওয়ার খোঁটাও দিয়েছে। তারপর এলো বৃষ্টির মা। বৃষ্টির বাবার সঙ্গে বিয়ের পর পর ই দাদী বলে দিয়েছিল সবাই কে বৃষ্টির মা বলে ডাকতে। সেই থেকে বৃষ্টির মা হিসেবেই সবাই চিনে। ওঁর মেহেরুন্নেছা নাম টাও হারিয়ে গেছে।
দাদী বৃষ্টিকে বলল,
“ঘরে চলো বুবু। তোমার মা আবার ডাকতে আসবে।”
বৃষ্টি বলল,
“আচ্ছা দাদী আমি ঠিক কার মতো? ”
দাদী ওর মাথায় হাত রেখে বলল,
“তুমি তোমার মায়ের মতো বুবু। তোমার বাইরে টা শক্ত হইলেও ভেতর টা নরম। যে তোমারে পেটে ধরছে তুমি শুধু তার গায়ের রঙ টাই পাইছো। মন টা পাইছ তার যার লগে তোমার না আছে রক্তের টান আর না আছে নাড়ির টান। ”
চলবে…