বিকেলের শেষ আলো পর্ব-০৭

0
237

#বিকেলের_শেষ_আলো
#লেখনীতে_নূরকথা
#পর্ব_৭

থতমত খেলাম তার এমন কথা শুনে। আমার চোখের দৃষ্টি চঞ্চল হলো‚ কিন্তু তাও আমি তাকালাম তার দিকে। দেখলাম সে আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন সে পুলিশ আর চোর হিসাবে ধরেছে আমাকে।

“অ্যাই চুপ করে আছো কেন?” তিনি জিজ্ঞেস করলেন‚ কিন্তু আমি কী উত্তর দিবো? নিজেকে একটু শক্ত করলাম। এরপর বেশ ভাব নিয়ে বললাম‚ “আপনি কিন্তু অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছেন।”

তিনি মৃদু হেসে উঠলেন। জানতে চাইলেন আদুরে গলায়‚ “তাই নাকি বউ?” আমার উত্তরের অপেক্ষা করলেন না। তিনি বলে গেলেন‚ “আচ্ছা শোনো। মাকে যাওয়ার কথা বলেছিলাম। কিন্তু তিনি রাজি হোননি। আমাদের নতুন বিয়ে। বুঝতেই পারছো তিনি যাবেন না। মায়ের সাথে আমার দূরসম্পর্কের এক বোন থাকবে। সব ব্যবস্থা আল্লাহ তাআলার মেহেরবানিতে হয়ে গেছে। তো ফাইনাল কথা হলো আমি আর তুমিই শুধু যাচ্ছি। বুঝলে?”

“জি।”

“বোঝোনি।”

“এমন সহজ বাংলায় বললে কে না বুঝবে?” একটু অবাক হলাম কারণ আমি সবকিছু বুঝার পরও তিনি এই কথা কেন বলছেন?

“সহজ কথার ভীড়েও অনেক কিন্তু লুকিয়ে থাকে গো বউ। তোমার মোটা মাথায় ঢুকবে না।” এমন কথা শুনে একটু রাগ হলো আমার। বললাম‚ “আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন।”

“তা একটু-আধটু তোমার পাওনা আছেই। সে যাক গে‚ সকাল দশটায় ফ্লাইট। নভো এয়ারে সিট বুক করা আছে। সিলেটে নামার পর ইন শা আল্লাহ দুপুরের খাবার সময় হয়ে যাবে। তো আমরা এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল হিল টাউনে চলে যাবো। আমার বন্ধু এই হোটেলের নাম বলেছে। এখানে রুম বুক করে এরপর বিশ্রাম নিয়ে ইন শা আল্লাহ দুপুরের খাবার খেতে যাবো। কেমন হবে?”

নিরুত্তাপ গলায় জবাব দিলাম‚ “জানি না। আমি এর আগে কখনো কোথাও ঘুরতে যাইনি।”

তিনি আমার কথার পাত্তাই দিলেন না। বললেন‚ “খুব ভালো করেছো। এবার উঠে ব্যাগপত্র অল্পস্বল্প গুছিয়ে রুমের বাইরে যাও। মায়ের খোঁজ নিয়ে এসো।”

আধঘন্টা গোছগাছ করার পর যখন রুমের বাইরে এলাম‚ তখনই মাথায় প্রশ্নটা এলো‚ “আমি তো এই বাড়ির কিছুই চিনি না। ভুলে যদি কোনো নন মাহরামের সাথে দেখা হয়ে যায়?”

মনে মনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তাআলার নাম স্মরণ করে হাঁটতে লাগলাম। যে রুমের কাছে আসার পর শব্দ শুনতে পেলাম‚ কোনোরূপ দ্বিধা না করে ঢুকে পড়লাম। দেখলাম দুইজন বয়স্ক মহিলা রান্নার কাজে ব্যস্ত। আমাকে একজন বলে উঠলেন‚ “এ কি বউমা! এত সকালে তুমি রান্নাঘরে কেন?” ইনিই আমার শ্বাশুড়ি। আমাকে কিন্তু বলার সুযোগ দিলেন না। নিজেই বলে গেলেন‚ “না না‚ তোমাদের বেড়ানো শেষ না হওয়া পর্যন্ত রান্নাঘরে আমি তোমাকে ঢুকতে দিচ্ছি না। বেড়ানো শেষ করে এসে দায়িত্ব নিবে। তখন কিন্তু মা আমি বিশ্রাম নিবো ইন শা আল্লাহ। বয়স তো কম হলো না। এবার আল্লাহ তাআলাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চাই।”

চুলায় মুগের ডাল রান্না হচ্ছে। সেখানে মনোযোগ দিয়ে তিনি আবার বললেন‚ “তুমি আর শাপলা সংসার সামলাবে। আমি আর এসবের মধ্যে নেই মা।” শ্বাশুড়ি মায়ের সাথে যেই মহিলা কাজ করছেন বুঝলাম তার নাম শাপলা। আন্দাজ করা উচিত নয়। তবে তিনি হয়তো এই বাড়িতেই থাকেন। আমার ঠিক জানা নেই।

আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। মা আমার কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে সর্তক গলায় জিজ্ঞেস করলেন‚ “আকাশ পাঠিয়ে দিলো। তাই না?”

“আসলে মা……….” আমাকে বলতে দিলেন না।

“ওই ছেলেকে আগেই বলে রেখেছিলাম তোমাকে যেন সাতসকালে তুলে রান্নাঘরে না পাঠায়। কিন্তু আমার কথা শুনলো না। একদম বাপের মতো ঘাড় ত্যাড়া টাইপ। এবার একটু ঠিক করে নাও মা নয়তো ওই ছেলে তোমার জীবন আমার মতোই বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে।” মায়ের কথা শুনে লজ্জাই পেলাম। ভাবিনি তিনি এসব কথা বলবেন।

ছোটোবেলা থেকে শুনে এসেছি শ্বাশুড়িরা দ*জ্জাল টাইপ হয়। বউদের অনেক অত্যা*চার করে। সত্যি বলতে নিজের শ্বাশুড়ি নিয়ে আমি অনেক শ*ঙ্কিত ছিলাম। কিন্তু এখন নিজের সামনে মানুষটাকে দেখে মনে হচ্ছে‚ সব শ্বাশুড়ি খারাপ হয় না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তাআলার ওপর আমার পরিপূর্ণ আস্থা ছিল বলেই আজ এত প্রশস্ত চিন্তা করার মতো একজন শ্বাশুড়ি পেলাম‚ আলহামদুলিল্লাহ!

আমাকে ছেড়ে দিয়ে মা বলে উঠলেন‚ “এসেছো যখন তোমাদের খাবারগুলো নিয়ে যাও। প্রথম কয়েকটা দিন আগে নিজেদের মর্জি বোঝার চেষ্টা করো। আমাকে সময় না দিলেও চলবে মা।”

“কিন্তু মা……….” এবারও কথা বলার সুযোগ পূরণ হলো না। পাশ থেকে শাপলা নামক বয়স্ক মহিলা বেশ গর্ব করে বলে উঠলেন‚ “আল্লায় তোমার কপালে একখান শ্বাশুড়ি লেইখা দিছেন গো বউ। এমন শ্বাশুড়ি কপাল না থাকলে পাওন যায় না। সংসারেও যায়-ঝামেলা নাই। না আছে ননদ আর না আছে দেওর; শ্বশুর পর্যন্ত নাই। এক্কেবারে গা হাত পা ছাড়া।”

“চুপ কর তো শাপলা। খালি বকর বকর। তাড়াতাড়ি শেষ কর। আজ কিন্তু দুপুরের রান্না দেরি করা যাবে না। তোর ভাইপো বাড়িতেই। যহরের নামায পরই যদি খাবার না দেওয়া যায় তাহলে গমগম করবে বাড়ি।” মায়ের মুখে ‘ভাইপো’ শুনে বুঝতে পারলাম‚ শাপলা সম্পর্কে আমার ফুপু হোন। কিন্তু কেমন ফুপু তা ঠাওর করতে পারলাম না।

খাবার সাজিয়ে আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে মা বললেন‚ “নাও মা। অনেক বছর পর মুগ ডাল রান্না করলাম। কেমন হয়েছে বলবে কিন্তু। তুমি তো মুগ ডাল খুব পছন্দ করো।”

আমি অবাক হলাম‚ “এ কথা আপনি জানলেন কেমন করে?”

“অ্যাই মেয়ে‚ খবরদার আপনি আপনি করবে না৷ আর আমিও এসব তুমিটুমি বলতে পারবো না। আকাশকে যেমন তুই বলি‚ তোকেও তাই বলবো। শোন মা‚ আমার কোনো মেয়ে নেই। তোর নিজের মায়ের স্থান নিতে পারবো না তা জানি। কিন্তু তোকে আমার নিজের মেয়ের স্থানে রাখতে চাই। ভুলেও আমাকে আপনি করে বলবি না।” এসব কথা শুনলে একটা পাথরের মনও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তাআলা গলিয়ে দিবেন আর আমি তো সামান্য মানবী।

চোখ ছলছল করে উঠলো তা দেখে মা হেসে উঠে ফুপুকে বলবেন‚ “দেখ শাপলা‚ একটু ব*কেছি বলে মেয়ে আমার কান্না জুড়তে বসেছে। মুখখানা দেখেছিস?” জিজ্ঞেস করেই আমার চিবুকে হাত রেখে কাতর গলায় বললেন‚ “তিনি থাকলে কত খুশি হতেন!”

আমি নিজেকে সামলে নিয়েছি আর মা-ও এসব বিষয়ে না গিয়ে বললেন‚ “যা মা। খেয়ে নেয়। আর তোর পছন্দ অপছন্দের সব খবর তোর জামাই আমাকে অনেক আগেই বলে রেখেছে। যত যাই হোক‚ গতকাল থেকে তুই আমার মেয়ে হয়েছিস— এটা মৃত্যুর আগে যেন মাথা থেকে না সরে। বুঝলি?” খুশি আর লজ্জায় তৃপ্ত হওয়া আমার মুখে কথা ফুটলো না। চোখ নামিয়ে শুধু ‘হ্যাঁ’ বোধক মাথা নেড়ে হাঁটতে শুরু করলাম।

রুমে ঢুকতেই তিনি এগিয়ে এসে খাবারের জিনিসগুলো নিয়ে টেবিলের ওপর রাখলেন। এরপর জিজ্ঞেস করলেন‚ “মিষ্টি‚ তুমি কি কাঁদছো?”

“না” বলে যখন তার দিকে তাকালাম‚ তখন বাম চোখ উপচে পড়া অশ্রু বিনা বাঁধায় নেমে পড়লো। আমার কান্না পেলে আগে বাম চোখের কোল ভরে; ডান চোখ অলস হয়ে বসে রয়। আলতো হাতে সেই অশ্রু আঙুলের ডগায় নিলেন। এরপর আমাকে দেখিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন‚ “তাহলে এটা কী?”

চোখ নামিয়ে নিলাম। তিনি আচমকা ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইলেন‚ “বউ‚ কাঁদছো কেন? মায়ের কোনো কথায় কী……….” আমি প্রায় সাথেসাথে প্রতিবাদ করে উঠলাম‚ “না না‚ দয়া করে অন্য কিছু ভাববেন না। আমি সত্যি কাঁদছি না। কিন্তু আমার ভেতরের আনন্দগুলো চেপে রাখতেও পারছি না। এগুলো চোখের পানি হয়ে বের হচ্ছে। দিন না বের হতে। সমস্যা কী? কখনো কখনো খুশিতে কাঁদতে হয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তাআলার এমন খুশি তো সবার জন্য সবসময় নির্ধারণ করে না-ও রাখতে পারেন।”

……….চলবে ইন শা আল্লাহ