বিপরীতে হিত পর্ব-০১

0
448

#বিপরীতে_হিত
#পর্ব-১

“মা, আমি যাবোনা, কিছুতেই যাবোনা?”
সুমনা দৌড়ে আরেক ঘরে গিয়ে লুকোলো। সুমনার মা আশা সেই কখন থেকে মেয়ের পিছনে পিছনে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। এতো বড় ধাড়ি মেয়ের সাথে কি লুকোচুরি খেলে পারা যায়? আশা অল্প সময়ের মধ্যেই হাফিয়ে গেলো। ডাইনিং এ চেয়ার টেনে বসে চিৎকার করলো আশা-
“মনা, কেন যাবি না শুনি? পড়ালেখার ইচ্ছে নেই বুঝি?”
“নতুন স্কুলে কেন ভর্তি করালে? আগের স্কুল কতো ভালো ছিলো? কতো বন্ধু ছিলো আমার? এখানে আমি কাকে চিনি? একেতো নতুন এলাকা, তারউপর নতুন স্কুল! তাও আবার ছেলেমেয়ে একসাথে? কেমন না কেমন হবে কে জানে? আমার খুব ভয় করে। ঢাকার ছেলেপুলেরা খুব দুষ্টু হয়, তমা বলেছিলো।”
“তমা মিথ্যে বলেছে তোকে। ও নিজেই তো ঢাকায় থাকে? এদিকে শোন মা! আমার কাছে আয় তো?”
আশার কন্ঠ নরম হয়। মায়ের নরম কন্ঠ শুনে সুমনা ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে এলো। মাথা নিচু করে মায়ের সামনে দাঁড়ালো। আশা মেয়ের হাত ধরে কোলে বসালেন-
“তোর বাবাকে ঢাকায় ট্রান্সফার করলে আমরা কি করতে পারি বল তো মা? বাবা কি ইচ্ছে করে ঢাকায় এসেছে? আর তোকে কি একা অতদূর রেখে আসতে পারি? ওখানে কার কাছেই বা থাকবি? কেউ আছে আমাদের বগুড়াতে? এখানে বরং তমা আছে, হিজল আছে। তোর খালা আছে, চাচা আছে, আমরা প্রতি উইকেন্ডে কারো না কারো বাসায় বেড়াতে যেতে পারবো। তাছাড়া ওখানেও তো একসময় তুই নতুন ছিলি? এখানে কয়েকদিন ক্লাস কর দেখবি নতুন বন্ধু হয়ে যাবে। যা মা তৈরি হয়ে নে, এখন ক্লাস নাইন, ফাকি দিলে সমস্যা হবে তোর। এমনিতেই মাসের পনেরো দিন পার হয়ে গেছে, এখন না গেলে তুই পিছিয়ে পড়বি। স্কুলটা খুব নামকরা, নিয়মগুলো কড়াকড়ি, ভালো পড়ালেখা হয়। যা তাড়াতাড়ি! ”

আশা মেয়েকে তাড়া দেয়। সুমনা আর কোনো কথা না বলে বাধ্য মেয়ের মতো নিজের রুমে চলে গেলো। ঢাকায় এসেছে আজ পনেরো দিন হলো। ওর বাবা সরকারি চাকুরী করে। তিন চার বছর পর পর এ জায়গা থেকে ও জায়গায় ট্রান্সফার হয়। লাস্ট ছিলো বগুড়ায়। তাও ভাগ্য ভালো যে, পোস্টিং টা বছরের শেষে হয়েছে। তা না হলে বড় বিপদ হয়ে যেতো। সুমনা ক্লাস এইট শেষ করলো, এবার নাইনে উঠলো। ঢাকাতে এসেই ওকে ভর্তি করিয়ে দিলো সৃষ্টি স্কুলে। কম্বাইন্ড স্কুল এইজন্যই আপত্তি সুমনার। এতোদিন বগুড়ায় গার্লস স্কুলে ছিলো সুমনা। এখন কম্বাইন্ড শুনে আর স্কুলে যেতে চাচ্ছে না। একটা ছেলে ভীতি কাজ করছে হয়তো ওর মনে। মেয়ে রেডি হয়ে বেড়িয়ে আসতেই আশা মেয়েকে নিয়ে বেড়িয়ে এলো।

*******

আশা মেয়েকে গেটে নামিয়ে দিয়েই চলে গেলো। বলে গেলো ক্লাস শেষে আবার নিতে আসবেন। সুমনা খুব ভয়ে ভয়ে স্কুল গেট পার হলো। ওর সি সেকশন। ক্লাসরুমটা কোথায় হবে সেটা জিজ্ঞেস করতেও যেন ভয় লাগছে সুমনার। ছেলেমেয়েগুলো ওর দিকে কেমন বাঁকা নজরে তাকাচ্ছে? কাপড় ঠিক নেই নাকি? নিজের জামাটা দু-তিন বার টেনে নিলো সুমনা। ব্যাগ আর বই সামলে করিডোর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো সুমনা। তখনই হঠাৎ চুলে টান পড়লো। ব্যাথায় চিৎকার করে মাথায় হাত দিয়ে বসে পরলো সুমনা। করিডোরে হাসির হুল্লোড় ছুটলো। উঠে দাড়িয়ে সামনে তাকাতেই দেখলো একটা ছেলে দাঁত বের করে হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে। সুমনা তাকাতেই ওকে চোখ টিপ দিয়ে চলে যাচ্ছিলো। সুমনা খুব অবাক হলো, ছেলেটার নির্বিকার ভাব দেখে। একজন অপরিচিত মেয়ের সাথে এমন কাজ করেও ছেলেটার কোনো বিকার নেই। সুমনারও রাগ উঠলো, সে পেছন থেকে ছেলেটার পাছা বরাবর একটা লাথি ছুড়লো। ছেলেটা দূরে গিয়ে পড়লো। চারিদিকে আবার হাসির হুল্লোড়। ছেলেটা পাছায় হাত দিয়ে মুখ কুচকে উঠে দাড়িয়ে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলো সুমনা এবার দাঁত বের করে হাসছে। ইশারা করে জিজ্ঞেস করলো –
কেমন লাগলো?
ছেলেটা দাঁত কিরমির করতে করতে পাছায় হাত দিয়ে চলে গেলো। শাসিয়ে গেলো- দেখো নেবো বলে। সুমনাও ‘হুহ’ বলে মুখ ভেংচালো।

দু’চার জনকে জিজ্ঞেস করতেই ক্লাস রুম দেখিয়ে দিলো। রুমে ঢুকতেই দেখলো সবাই যার যার মতো ব্যস্ত। সামনের বেঞ্চগুলো সব ফিলআপ। খুঁজে খুজে পিছনের এক বেঞ্চে জায়গা পেলো। একটা বেঞ্চে দু’জন করে বসার নিয়ম। ও বসার কিছুক্ষণের মধ্যে আর একজন এসে বসলো ওর পাশে। ভালোমতো তাকিয়ে দেখলো, ওর চুল টান দেওয়া ছেলেটাই ওর পাশে বসেছে-
“তুমি?”
চিৎকার দিলো সুমনা।
“তুই?”
পাল্টা চিৎকার দিলো ছেলেটা।
“আমি তোমার সাথে বসবো না, কিছুতেই না! তুমি অন্য কোথাও যেয়ে বসো।”
“আমি কেন যাবো? তোর প্রবলেম তুই যা!”
“আমি আগে এসে বসেছি এই বেঞ্চে!”
“তো? নাম লিখা আছে তোর? ”
“আমি মিসকে কমপ্লেন করবো কিন্তু? ”
“আমি মিসকে কমপ্লেন করবো কিন্তু? ”
ছেলেটা ভ্যাঙালো সুমনাকে।
“মিস্টার ক্লাস নেবে না মিস ক্লাস নেবে জানিস তুই? বিচার দিলে দিবি? আমার কি? এই আদি কাউকে ভয় পায় না, বুঝলি?”
ওহ, এই বদমায়েশ এর নাম তাহলে আদি? আচ্ছা, তুই বয় আমার পাশে, আজ তোকে মজা চাখাবো। মনে মনে দুষ্টু বুদ্ধি আটে সুমনা। ক্লাসে মিস ই আসলো। বাধ্য হয়ে সুমনা বসে পড়লো আদির পাশে। প্রথম ক্লাস ইংরেজি ১ম। রোল কলের সময় সুমনার পরিচয় নিলো মিস। সুমনা যখন নিজের পরিচয় দিচ্ছিলো আদি বিরবির করে ফোড়ন কাটছিলো-
“গাইয়া কোথাকার? গ্রাম থেকে এসেছে, এইজন্যই তো বলি এতো বদ বুদ্ধি মাথায় আসে কোত্থেকে? আর গায়ে কি বিচ্ছিরি গন্ধ মাইরি, একেবারে ক্ষ্যাত, আনস্মার্ট কোথাকার?”
শুনে মনে মনে ফুলছিলো সুমনা। চুপচাপ অপমান হজম করে ক্লাস করছিলো। ঠিক ক্লাসের মাঝামাঝি সময়ে এসে বেঞ্চের নিচ দিয়ে কলম দিয়ে আদিকে দিলো খোঁচা। সেই খোঁচা খেয়ে আদি তিড়িং করে লাফিয়ে উঠতেই মিস ওকে ধমক দিয়ে বসিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ পর আবার খোচা, আদি আবার লাফিয়ে ওঠে। মিস রাগী চোখে তাকাতেই আদি কিছু বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু মিস আদির কোনো কথা না শুনে বিরক্ত হয়ে ওকে ক্লাস থেকে বের করে দেয়। রাগে গজগজ করতে করতে আদি ক্লাস থেকে বেড়িয়ে গেলো। আর সুমনা মুখে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে আদিকে ভেংচি কাটে।

বাকী ক্লাসগুলোও এরকম খোঁচাখুঁচি করতে করতে কেটে গেলো। শেষ ক্লাসের ঘন্টা যখন বাজলো তখন সুমনা নিজেই অবাক হয়ে গেলো। প্রথম দিন, এতো দ্রুত সময় কিভাবে কাটলো? এই বাদরের সাথে ও নিজেও বাঁদরামি করেছে সারাক্ষণ। কি অদ্ভুত! জীবনে প্রথম কোনো ছেলের সাথে ক্লাস করলো তাও আবার এই রকম ঝগড়াঝাটি করে? বাড়ী যাওয়ার পুরোটা পথ এসবই ভাবছিলো সুমনা। আশা মেয়েকে ডেকে ডেকে হয়রান। কি যে ভাবছে স্কুল থেকে বেড়িয়ে, আল্লাহ জানে! তাও চিন্তা মুক্ত হওয়া গেলো, স্কুল নিয়ে কোনো খারাপ কিছু বলেনি। আশা যেন হাফ ছেড়ে বাচলো।

আর এদিকে সুমনা ভাবছে, কালকে কি হবে? আদি কালকে ওকে কিভাবে জ্বালাতে পারে আগে থেকেই ভেবে রাখতে হবে। এই ছেলে হচ্ছে মহা ত্যাদর। নিশ্চয়ই কিছু না কিছু একটা বড়সড় প্ল্যান করে রাখবে ওকে নাজেহাল করার জন্য!

চলবে—–
©Farhana_Yesmin