বিপরীতে হিত পর্ব-০৪

0
223

#বিপরীতে_হিত
#পর্ব-৪

৬ বছর পরঃ

আজ এমনিতেই ক্লাসের জন্য দেরী হয়ে গেছে। হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে দৌড়ে ছুটে আসছিলো আদি। সকালে ডাটা স্ট্রাকচারের ইমপর্টেন্ট ক্লাসটা সে কিছুতেই মিস দিতে চায় না। এমনিতেই এই সাবজেক্ট ঘটে ঢুকতে চায়না কিছুকেই। আর যেটা মাথা ঢোকে না সেটা পড়তে একফোটাও ইচ্ছে করে না আদির। আর সাবজেক্ট টিচারটাও মাশাআল্লাহ বোরিং। একটু যে মজাটজা করবে সে উপায়ও নেই! এই ক্লাসটাতে আদির মেজাজ খুব খিচে থাকে। তবুও করতে হয়। ফাস্ট ইয়ারে টপার হয়ে বিপদে পড়ে গেছে। এমন না যে টপার হওয়ার জন্য দিনরাত গাধার মতো খেটেছে। সাবজেক্টগুলো পড়তে মজা লেগেছে তাই পড়েছে। কিভাবে কিভাবে যেন টপ করে ফেললো। এখন পড়েছে বিপদে, টিচাররা যেন জোর করেই ওকে ফাস্ট বানাতে চায়। আর বাবা মা তো খুশিতে পাগল হওয়ার দশা! একটু কিছু হলেই বলতে শুরু করে, ভালোমতো পড় বাবা, তোকে নিয়ে আমাদের অনেক আশা? আদির বিরক্ত লাগতে শুরু করেছে। কেন রে বাবা! আমাকে নিয়েই আশা করতে হবে কেন? ছোট আরো দুটো আছে ওদের নিয়েও ভাবো? আমাকে নিয়ে পড়ে থাকার দরকারটা কি?
এতো চাপে আদি ভয় পায়। কবে না জানি পড়ালেখার প্রতিই আগ্রহ হারিয়ে ফেলে! ভাবতে ভাবতে কারো সাথে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা খেলে পড়ে গেলো আদি। কাঁধে প্রচন্ড ব্যাথা পেয়েছে, মাথার সাথে মাথা বাড়ি খেয়ে মাথাটা ঝিমঝিম করছে। মাথা ধরে উঠে বসার চেষ্টা করলো আদি, তার আগেই কারো কর্কশ কন্ঠ কানে তালা লাগিয়ে দিলো-
“বলি, চোখ কি মাথার পেছনে আপনার? সামনে কে আসছে দেখতে পান না? জলজ্যান্ত একটা মানুষকে এভাবে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন? মাথাটা তো আস্ত রাখেননি মনেহয়?”
আদি ঘোলা চোখে তাকালো কর্কশ কন্ঠির দিকে। তাকিয়েই চোখে যেন ঘোর লেগে আসছে। ঘোলা চোখের সামনে দাঁড়ানো মেয়েটাকে মনেহচ্ছে কোনো অপ্সরী। আদি মাথার ব্যাথ্যা ভুলে গেলো, ভুলে গেলো তার ডাটা স্ট্রাকচার নামক সাবজেক্টের ইমপর্টেন্ট ক্লাস আছে। আদি চোখে দুটো ভালোমতো কচলে নিয়ে আবার তাকালো মেয়েটার দিকে। অদ্ভুত সুন্দর তো মেয়েটা? ফর্সা গোলগাল মুখ, পাতলা ঠোঁট, খাড়া নাকের ডগায় একটা কালো কুচকুচে তিল যেন নাকের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুন। কালো ঘন চোখের পাপড়ির গভীর চোখ দেখে মনেহচ্ছে আগেও কোথাও দেখেছে? খুব চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু কোথায় দেখেছে এই মুহুর্তে মনে করতে পারলো না আদি। একটা জিনিস শুধু খারাপ লাগলো, মেয়েটার চুল! মেয়েটার চুল ছোট, ঘাড় পর্যন্ত কাটা। আদির মনেহলো, এই মেয়ের মাথায় যদি লম্বা চুল থাকতো তবে বেশ লাগতো দেখতে!
“এই যে হ্যালো, ওমন হা করে তাকিয়ে দেখছেন কি? কিছু বলছি আমি, শুনতে পারছেন না? এই যে এতোবড় করিডোর আর আপনার কিনা আমার সাথেই ধাক্কা খেতে হলো? যত্তোসব ছাগল পাগল কোথাকার। আমার কপালে যে একটা আলু বানিয়ে দিয়েছেন তা দেখতে পাচ্ছেন? এই যে?”
“আহ, আস্তে! এতো চিৎকার করছেন কেন? কান তো মনেহচ্ছে বয়রা করে দেবেন? শুনতে পাচ্ছি আমি, দয়া করে একটু আস্তে কথা বলুন!”
আদি কানে হাত দিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করলো। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো আসলেও কপালটা বেশ ফুলে আছে।
“তা আপনি যে শুনতে পাচ্ছেন সেটা বুঝবো কি করে? সেই তখন থেকে তো হা করে মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন?”
আদি নিজের হাতটা মেয়েটার দিকে বাড়িয়ে দিলো-
“ধরুন, তুলুন তো আমাকে?”
আদির কথা শুনে মেয়েটা বোকা বোকা মুখ করে তাকিয়ে থাকলো। ভাবছে, এ আবার কেমন পাগল? এতোকিছু হয়ে গেলো আর এই লোক কিনা দিব্যি স্বাভাবিক আচরন করছে? এমন ভাব করছে যেন কিছুই হয়নি?
“এ্যা! কি বলছেন?”
“আরে বাবা, হাত ধরে একটু তুলতে বলছি? মাথাটা আমারও টনটন করছে কিনা?”
“ঢং! ঢং হচ্ছে? দামরা ছেলে কিনা নিজে উঠতে পারছে না?”
মুখ ঝামটা দিলো মেয়েটা। আদি নিজেই মেঝেতে হাতের ভর দিয়ে উঠলো। মেয়েটার মুখের একেবারে সামনে মুখ এনে বললো-
“তোমার চোখ দুটো সুন্দর খুব। আর তোমাকে না আমার খুব চেনা চেনা লাগছে। মনেহচ্ছে তোমাকে আগে কোথাও দেখেছি। দেখেছি কি?”
মেয়েটা ঘাবড়ে গেলো। ঘাবড়ে একটু পিছিয়ে দাঁড়ালো-
“দোষ করে এখন কথা ঘোরানোর চেষ্টা?”
“মোটেই না? সত্যি বলছি, তোমাকে আমার চেনা লাগছে খুব?”
মেয়েটা চরম বিরক্ত হলো –
“পথ ছাড়ুন তো?যেতে দিন, সরি বলা বাদ দিয়ে আপনি আমার সময় নষ্ট করছেন। সরুন!”
মেয়েটা হাটতে নিয়ে আবার পিছিয়ে এলো-
“আপনি আমাকে তুমি করে বললেন কেন?”
“বললাম না, চেনা চেনা লাগছে? আপন মনে হচ্ছে খুব!”
“বেয়াদব লোক একটা! চেনা নেই জানা নেই, হঠাৎ আপনি থেকে উনি তুমিতে চলে গেলেন!”
বলেই মেয়েটা চলে যেতে নিতেই আদি পেছন থেকে চেচিয়ে উঠলো –
“সরি!”
“আপনার সরি আপনার পকেটে রাখুন। ওটা আর আমার চাই না।”
মেয়েটা মাথা ঘুড়িয়ে জবাব দিলো। আদি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে নিজের ক্লাসের দিকে হাঁটা দিলো। আজকের ক্লাসতো মনেহয় শেষই। তবুও যাওয়া যাক!

*******

স্যার বেরিয়ে যাওয়ার পর পরই জিনাত আর মামুন ঘিরে ধরলো আদিকে। জিনাত বললো-
“কিরে টপার! আজ ক্লাসে এতো দেরি করে এলি যে? এটা তো তোর ফেবরিট সাবজেক্ট? ”
জিনাত ফোড়ন কাটে। জানে এই সাবজেক্ট আদি পচ্ছন্দ করে না।
“আর বলিস না, একজনার সাথে এমন ধাক্কা খেলাম না….”
কথা শেষ হওয়ার আগেই মামুন বলে-
“দোস্ত ছেলে না মেয়ে?”
“আরে মেয়ে। মেয়ে তো না যেন বোম?”
“বলিস কি রে?”
“হ্যা। তবে মেয়েটাকে আগে দেখিনি রে? আমাদের বিল্ডিংএ ছিলো যেহেতু তাহলে তো এই ডিপার্টমেন্ট এরই হওয়ার কথা? আর সিনিয়রদেরকে তো চিনি, তাহলে মনেহয় জুনিয়র?”
“সেই মেয়ে নাকি আবার? ”
মামুন জিনাতকে ইশারা করে।
“কোন মেয়ে? ”
আদি প্রশ্নবোধক চাহনি ছুড়ে দেয় দু’জনার দিকে।
“আরে দোস্ত! তুই তো ছিলি না, নতুন ব্যাচের ক্লাস শুরু হইছে ঐ দিন। আমরা কয়জন মিলে একটু রেগিং করতে চাইলাম কিন্তু জুনিয়র এক মেয়েতো আমাদেরই রেগ দিয়ে দিলো?”
মামুন বলে। পাশে দাঁড়িয়ে জিনাত মুচকি হাসছিলো।
“তাই নাকি? জুনিয়র মেয়ের এতো সাহস? কি করেছিলো?”
আদি জানতে চায়।
“কি করে নাই তাই বল?”
মামুনের উত্তেজিত কন্ঠস্বর।
“আরে বাবা, না বললে জানবো কি করে?”
“আরে দুজন একসাথে ছিলো। আমরা বললাম একজন গান গাও আর একজন নেচে দেখাও। তো একজন গান ঠিকই গাইলো। কিন্তু আরেকজন যার নাচের পালা সে বলে কিনা, ভাইয়া আমি নাচবো কিন্তু আপনাকেও আমার সাথে নাচতে হবে। ভাবতে পারছিস মেয়ের সাহস কতো?”
আদির বেশ মজা লাগলো শুনে।
“তারপর?”
“তারপর আর কি? আমাদের মামুন যেহেতু নাচার অফার দিয়েছিলো তাই ওকে ওঐ মেয়ের সাথে নাচতে হলো। সে কি নাচ মাইরি! নাচিয়ে নাচিয়ে মামুনকে এমন ঘুরানো ঘুরিয়েছে যে মামুনের মেয়েদের নাচ দেখার শখ চিরজীবনের মতো ঘুচিয়ে দিয়েছে। নিজের বিয়ে করা বউয়ের সাথেও আর কোনোদিন নাচবে না মামুন!”
বলেই হাসতে থাকে জিনাত। মামুন স্ন্যাগ করলো-
“ধুর তুই বেশি বেশি বললি। এতোটাও করেনি?”
“ওলে লে, মেয়ে সুন্দরী বলে ওটাও কম মনেহচ্ছে বুঝি তোমার কাছে?”
জিনাত মুখ ভেংচি দিলো। আদির মনেমনে কিছু ভাবছিলো। অনেক পুরনো স্মৃতি হৃদয়ে হানা দিয়ে গেলো। এরকম দুর্দান্ত সাহসী তো সে একজনই দেখেছে জীবনে। আদি আনমনেই জিজ্ঞেস করে ফেললো-
“কোন মেয়েরে? প্রথম দিনেই এতো সাহস দেখিয়ে ফেলেছে? তাকে তো দেখতে হয়?”
“হ্যা, ক্লাস শেষে দেখাবো তোকে। মেয়েতো আমাকে নাচিয়ে ক্যাম্পাসে বিখ্যাত হয়ে গেছে?”
মামুনের বলার ভঙ্গিতে জিনাত আর আদি দু’জনেই হেসে দিলো। মুখে হাসি থাকলেও মনেমনে ভীষণ অস্থির হলো আদি। মেয়েটাকে দেখার তীব্র বাসনা জাগছে মনে। আবার হঠাৎ হঠাৎ সকালের ধাক্কা খাওয়া মেয়েটাও মনে উকি দিয়ে যাচ্ছে। কেন জানে না অদ্ভুত পুলক জাগছে মনে। বহুদিন বাদে আজ খুব মনে পড়ছে তাকে!

চলবে—–
©Farhana_Yesmin