বিপরীতে হিত পর্ব-০৫

0
231

#বিপরীতে_হিত
#পর্ব-৫

“আজ এতো তাড়াতাড়ি চলে এলি যে? আচ্ছা, এসেছিস ভালো হয়েছে, তোর বাবাও আজ তাড়াতাড়ি ফিরেছে অফিস থেকে। দুপুরের খাবারটা আজ একসাথে খেতে পারবো।”
আশা গরগর করে একনাগাড়ে কথা বলে যায়। সুমনা বিরক্ত হলেও কিছু বললো না। মায়ের কথার জবাব না দিয়ে উল্টো জিজ্ঞেস করলো-
“গাবলু কোথায়? এসেছে স্কুল থেকে?”
“হ্যা, এসেছে তো।”
“আচ্ছা, তুমি তাহলে টেবিলে খাবার লাগাও আমি গোসল করে ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
মাকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সুমনা টুপ করে নিজের রুমে ঢুকে গেলো। এখন কথা বলতে শুরু করলে মা আর থামবে না, তাই আগেভাগেই কেটে পড়া। ক্লাস শেষ হওয়ামাত্র কোনো দিকে না তাকিয়ে আজ ভার্সিটি থেকে বেড়িয়ে এসেছে সুমনা। কেন যেন মনে হচ্ছিল আজ সিনিয়রগুলো আবার ওকে ধরবে। ওর ইনটুইশন পাওয়ার খুব ভালো। যেটা মনে আসে সেটা কেন যেন ফলে যায়। তাই ভাবনাটা মাথায় আসতেই একরকম ভেগে এসেছে সুমনা।

খেতে বসা মাত্রই ছোট ভাই গাবলু জিজ্ঞেস করে বসলো-
“পু, তোমার কপালে কি হয়েছে? একটা আলু বেড়িয়েছে দেখছি?”
গাবলুর কথা শুনে সুমনা হেসে ওর গাল টেনে দিলো-
“ব্যাথা পেয়েছি রে? এইজন্য আলু বেড়িয়েছে।”
বাবা মা দু’জনই একসাথে জিজ্ঞেস করলো –
“কিভাবে ব্যাথা পেলি?”
“তাড়াহুড়ো করে ক্লাসে যাচ্ছিলাম, একজনার সাথে ধাক্কা লেগেছিলো।”
“নিশ্চয়ই কোনো বয় হবে, তাই না পু? সিনেমায় যেমনটা দেখায়?”
“আচ্ছা! আর কি দেখায় সিনেমায়?”
সোহেল আর আশা ছেলেমেয়ের গল্প শুনে মুচকি হাসলো। গাবলু সুমনার কথাশুনে অতি উৎসাহ নিয়ে বলতে শুরু করলো-
“তারপর ঐ যে চোখাচোখি, নাচানাচি, কান্নাকাটি আর শেষে একটু ঢিসুম ঢাসুম হয়ে তারপর মিল হয়।”
“এগুলো তো পুরনো মুভিতে হতো? তুই কি পুরনো মুভি দেখেছিস নাকি?”
“ঐ সবই একই কাহিনী। মা দেখে মাঝে মাঝে, আমিও একটু পাশে বসে দেখি।”
পাকা বুড়োদের মতো ভঙ্গিতে কথা বলে গাবলু। ওর কথার ভঙ্গিতে সুমনা হেসে দিলো। গাবলুর এখন ছয় বছর চলছে। ভাইটা তার পাক্কা পনেরো বছরের ছোট, ভীষণ ভালোবাসে সুমনা তার ভাইকে। ছোটর থেকে নিজেই লালন পালন করেছে। দেখতে একটু নাদুস নুদুস বলে সুমনা ওকে গাবলু বলে ডাকে। আর গাবলুও বোন বলতে অজ্ঞান। সুমনাকে সে আদর করে পু বলে ডাকে।

সুমনা গাবলুর গাল টেনে দিলো-
“স্কুলে তোর কাউকে পচ্ছন্দ হয়েছে?”
সুমনার কথা শুনে গাবলু যেন লজ্জা পেলো।
“পু, কি যে বলো না? আমি তো এখনও অনেক ছোট। তবে বড় হলে আমি রিদিমাকে বিয়ে করবো।”
গাবলুর কথা শুনে আশা, সোহেল, সুমনা সবাই একসাথে হেসে দিলো। সোহেল আশাকে ফোড়ন কাটে-
“দেখলে আশা, ছেলে তোমার কষ্ট কমিয়ে দিলো? তোমার আর কষ্ট করে বউমা খুঁজতে হবে না?”
“তাই তো দেখছি? তবে আমি রিদিমার মায়ের সাথে কথা বলে রাখি, কি বলিস গাবলু?”
“উফফ মা, তোমাকে কতদিন বলেছি আমাকে এ নামে ডাকবে না? এটা শুধু পুর ডাক।”
“ওরে আমার পুর চামচা, আমরা কি তবে?”
গাবলু মায়ের কথার জবাব না দিয়ে মন দিয়ে খেতে লাগলো। সুমনা ততক্ষণে অন্য জগতে। সকালের ছেলেটাকে মনে পড়ে গেলো। গালে হালকা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, উজ্জ্বল শ্যামবর্নের মাঝে চোখ দুটোই যেন ভীষণ রকম জলজলে। সুঠাম দেহের অধিকারী ছেলেটার চুলগুলো একটা লম্বা আর কোকরা। হঠাৎ সুমনার মনেহলো ছেলেটা গিটার বাজিয়ে গান গাইলে বেশ লাগবে। ছেলেটার আউটলুকের সাথে ভালো যাবে। ধুস, কি ভাবছে এসব? সুমনা খাওয়া ছেড়ে উঠে গেলো। আর ভাল্লাগছে না।
“কি রে খাবি না আর?”
“না মা মাথা ব্যাথা করছে। ”
“একটা পেইনকিলার খেয়ে নে। আর কপালের ফোলা জায়গাটায় বরফ লাগা।”
“মা, বরফ আমি লাগিয়ে দিচ্ছি পুকে।”
গাবলু বলে চটপট।
“লাগবে না রে। আমি এখন একটু ঘুমাবো। পরে লাগিয়ে দিস।”
“ওকে।”
সুমনা আর দাঁড়ালো না। নিজের রুমে এসে দরজা আটকে দিলো।

*******

বাসায় এসেও নিজের রুমের দরজা আঁটকে শুয়ে ছিলো আদি। মাথা থেকে কিছুতেই মেয়েটার চিন্তা যাচ্ছে না। বারবার কেন যে মেয়েটার মুখচ্ছবি ভেসে উঠছে মানসপটে তাও বুঝে পাচ্ছে না। তার উপর ক্লাস শেষে যখন জুনিয়র মেয়েটাকে দেখতে গেলো তখন তাকেও পেলো না। মেয়েটা নাকি আগেভাগে বেড়িয়ে গেছে। তখন থেকেই কেমন যেন একটা অস্থিরতা গ্রাস করে আছে আদিকে। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে করতেই হঠাৎ শফিকের কথা মনে এলো। শফিক মেডিকেলে পড়ছে। আদিও চান্স পেয়েছিলো কিন্তু পড়েনি। ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে ওর কোনো কালেও ছিলো না। যদিও ওর এই সিদ্ধান্তে বাবা মা দু’জনই খুব কষ্ট পেয়েছিলো। তবুও আদি নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেনি। সে যাইহোক, আচ্ছা শফিককে ফোন দিলে কেমন হয়? ভাবতে ভাবতেই শফিকের নাম্বার ডায়াল করে ফেলে-
“আররে, আদি যে? হঠাৎ এই অধমকে মনে পড়লো যে?”
“ফাজলামি করিস না তো, মুড নাই এখন। একটা হেল্প চাই তোর কাছ থেকে। ”
“কি হয়েছে দোস্ত? এনি প্রবলেম?”
“তোর মনে আছে, আমাদের ক্লাসে একটা নতুন মেয়ে এসেছিলো ক্লাস নাইনে ভর্তি হলো। তারপর হঠাৎ একদিন স্কুল ছেড়ে দিলো?”
“মনে থাকবে না আবার? তোকে যে নাকানি চুবানি খাইয়েছিলো সেই তো?”
শফিকের কথা শুনে রাগে গা জ্বলে গেলেও পাল্টা উত্তর না দিয়ে বললো-
“ওর সাথে দিবাদের অনেক খাতির হয়েছিলো। তুই কি একটু দিবার নাম্বারটা আমাকে দিতে পারবি?”
“তোর কাছেও তো ছিলো?”
“ওটা বন্ধ পাচ্ছি।”
“আচ্ছা, আমি তোকে এসএমএস করে দিচ্ছি। তবে ঘটনা কি বলতো? হঠাৎ সেই মেয়েকে নিয়ে এতো টানাটানি কেন গুরু?”
“পরে বলবো তোকে। আপাতত ফোন রাখছি।”
আদি শফিককে আর কথা বলার সুযোগ দিলো না। ফোন কাটতেই শফিকের ম্যাসেজ এলো। আদি কিছু না ভেবেই দিবার নাম্বারে ডায়াল করলো। দিবাও বিশেষ কোনো ইনফরমেশন দিতে পারলো না। স্কুল
ছাড়ার পর নাকি সুমনা কারো সাথেই যোগাযোগ রাখেনি। দিবার সাথে কথা বলে আদি কিছুক্ষন থম ধরে বসে রইলো। সে বুঝে পেলো না তার আজ হয়েছেটা কি? কেন সে ঐ মেয়ের জন্য এতো উতলা হচ্ছে? নিজেকে নিজের কাছেই অচেনা লাগছে আদির। তবে কি সে মনে মনে নিজেকে অপরাধী ভাবে? একটা মেয়ে শুধু তার কারনে স্কুল ছেড়ে দিলো এইটা কি তার মনে কোন কারনে দাগ কেটেছিলো? তা না হলে এতোদিন বাদে এসে এমনটা হচ্ছে কেন তার?

*******

“এই মেয়ে, এই! ”
ডাক শুনে ঘাড় ঘুড়িয়ে পেছনে তাকালো সুমনা। দেখলো প্রথমদিন হেনস্তা করা সিনিয়রদের সাথে গতদিনের ধাক্কা খাওয়া ছেলেটা,দাড়িয়ে আছে। ছেলেটার কপালে একটা ব্যান্ডেজ লাগানো। সুমনা একটু ভাবার চেষ্টা করলো, ছেলেটা ব্যাথা ওর চাইতে বেশি পেয়েছিলো কিনা। মনে করতে পারলো না। ও মনেহয় গতকাল নিজেকে নিয়ে বেশি ব্যস্ত ছিলো।
“এই মেয়ে, কি যেন নাম বলেছিলে তোমার?”
“আজরা জাবিন।”
“উহু, আরেকটা নাম বলেছিলে তো? কি যেন সুমি… না..সু…”
মামুনকে কথা শেষ করতে দিলো না সুমনা, নিজেই জবাব দিয়ে দিলো-
“আজরা জাবিন সুমনা। সুমনা আমার ডাক নাম।”
“ইয়েস সুমনা! এটাই মনে আসছিলো না।”
সুমনা নামটা শুনেই আদির মুখটা উজ্জ্বল হলো। এই তবে সেই? কিন্তু শিওর হবে কি করে? আদি জিনাতের কানে কানে ফিসফিস করে কিছু একটা বললো, সুমনা সেটা দেখেও না দেখার ভাব করলো। তখনই জিনাত ওকে প্রশ্ন করে-
“কোন স্কুল ছিলো তোমার?”
“বি এম স্কুল।”
“কখনো কি তুমি সৃষ্টি স্কুলে পড়েছিলে?”
চমকে গেলো সুমনা। মনটা কেমন একটা বিতৃষ্ণায় ভরে গেলো। যে স্মৃতি ভুলতে চায় তার কথা কেন?হঠাৎই যেন মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়! কে ও যার সাথে ধাক্কা খেলো? আদি নয়তো? না না আদি কেন এখানে থাকবে? আচ্ছা! যদি সত্যি সত্যি আদি হয়? কি করবে ও? আবারও পালাবে? কোথায় পালাবে?আদির দিকে তাকিয়ে তিক্ত গলায় জবাব দেয় সুমনা-
“স্কুলের সাথে এখানে পড়ার কোনো সম্পর্ক আছে কি?”
“না তা নেই! এমনিতেই কিউরিওসিটি বলতে পারো?”
“ওহহহ! বললামই তো আমি বি এম স্কুলে পড়েছি। আমি কি এখন যেতে পারি?”
মামুন আর জিনাত মাথা নাড়ে। আদি ইচ্ছে হচ্ছিল আরো কিছুক্ষন কথা বলে। মেয়েটা যেমন ক্রুর দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো, ও শিওর যে এই সুমনা সেই সুমনাই। তবুও কোনো রিক্স নেওয়া যাবে না এবার। সুমনা কিছুদূর যেতেই আদি জিনাত আর মামুনের কাছ থেকে বিদায় নিলো। ছুটতে ছুটতে সুমনার পিছু নিলো। কিছুদূর যাওয়ার পর ডাকলো-
“সুমনা!”
সুমনা থেমে গেলো। আদি যেয়ে ওর সামনে দাঁড়ালো-
“তুমি কি সেই সুমনা? সৃষ্টি স্কুলে ক্লাস নাইনে ভর্তি হয়েছিলে? আমায় চিনতে পারছো? আমি আদি!”
সুমনা মনে মনে চমকালেও মুখে স্বাভাবিক হাসি ধরে রাখলো-
“আপনি ভুল করছেন ভাইয়া, আমি সেই সুমনা না! আর কালকের জন্য সরি, আপনি দেখছি বেশ ব্যাথা পেয়েছেন?”
সুমনার এমন ভদ্র কথাবার্তা শুনে আদি থতমত খেলো। ও যে সুমনাকে চেনে সে তো এতো ভদ্রভাবে কথা বলে না? তবুও সে শেষ চেষ্টা করলো-
“আমি জানি, তুমি সেই! তোমার সাথে আমার কথা ছিলো একটু!”
“বললাম তো ভাইয়া আমি সে না? পথ ছাড়ুন, যেতে দিন আমাকে।”
সুমনা আদিকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। আদি আনমনে নিজের গাল হাতালো। ও কি খুব অন্যরকম হয়ে গেছে? আগের আদি আর এখনকার আদির মাঝে কি কোনো মিল নেই? একদম কি চেনা যায় না নাকি? নাকি সুমনা ইচ্ছে করে ওকে চিনছে না? নাম বলার পর মেয়েটার মুখের এক্সপ্রেশন একদম চেন্জ হয়ে গেছিলো। ও যে সেই সুমনা, আদি একেবারে হানড্রেড পারসেন্ট শিওর। শয়তানি হাসি দিলো আদি। ওকে গার্ল! সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করে কি করে ঘি তুলতে হয় তা এই আদি ভালোমতোই জানে! তুমি নিজের থেকেই বলবে, তুমি কে?

চলবে—–
©Farhana_Yesmin