বিপরীতে হিত পর্ব-০৮

0
225

#বিপরীতে_হিত
#পর্ব-৮

গত কয়েকদিন ধরে আদির মেজাজ চরম খারাপ। সে সুমনার পিছু পিছু ঘুরছে ওর সাথে কথা বলার জন্য কিন্তু সুমনা তাকে একটুও পাত্তা দিচ্ছে না। উল্টো তারই বন্ধু মামুনের সাথে হেসে হেঁসে কথা বলে আদির পিত্তি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। মামুনেরও যেন রাতারাতি পরিবর্তন হয়ে গেছে! আগে ছুটির পর সে আদি আর জিনাতের সাথে বসে গ্রুপ স্টাডি করতো, গল্প করতো, তিনজনে মিলে মজার খুনসুটিতে মেতে উঠতো। আর এখন ছুটি হলেই সে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে দিগবিদিগ শুন্য হয়ে ছুটে বেড়িয়ে যায়। তখন আদির হাজারো ডাক ওর কানে যায় না। আদিকে যেন তখন চেনেই না মামুন! আদি অবাক হয়ে ভাবে, এই ছেলের হঠাৎ হলোটা কি? যে ছেলে আদির কথা না শুনে কিছুই করতো না সেই ছেলের আচমকা এতো পরিবর্তন হলো কি করে? আদিকে ছাড়াই দিব্যি একা একা সুমনার সাথে কথা চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ এই তো সেদিন আদিকে জিজ্ঞেস করছিলো, সুমনার ব্যাপারে কি করবে! এসব ভাবতে ভাবতে আদির মনে মেজাজ খারাপের হাজারো বাল্ব জ্বলে উঠলো। বুকের হৃৎপিণ্ডের গতি বেশি হলো, হাত পা নিশপিশ করতে লাগলো।

সকাল থেকে সারাটা ক্লাস এসবই ভেবে যাচ্ছিলো আদি। ফলাফল স্বরুপ ক্লাসে অমনোযোগীতা। ভাববে নাই বা কেন? সকালে আজ সুমনার সাথে দেখা হলো। আদি হাসিমুখে এগিয়ে গেলো সুমনার দিকে। আর সুমনা আদির দিকে তাকিয়ে মুখ বেঁকিয়ে নিয়ে আবার তখনই আদির পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মামুনের সাথে হাসিমুখে দাঁত কেলিয়ে কথা বলতে লাগলো। দুজনে এমনভাবে আলাপ করছিলো যেন দু’জন দু’জনকে অনেকদিন ধরে চেনে। আদি যে ওদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই! শেষ পর্যন্ত আদিই বাধ্য হয়ে মামুনকে জিজ্ঞেস করলো-
“কি রে ক্লাসে যাবি না?”
“হ্যা যাবো। তুই যা আমি আসছি একটু জরুরি আলাপ সেরে।”
আদি প্রচন্ড ইচ্ছে হলো মামুনকে কষে দু গালে দুটো চর মারতে আর বলতে-
“শালা, মেয়ে মানুষ তোমার সাথে একটু হেসে কথা কি বলেছে আর তুমি তোমার বন্ধুকে ভুলে গেছো?”
কিন্তু তা তো আর করা গেলো না, কেননা সামনে সুমনা দাঁড়িয়ে আছে। এমনিতেই আদির উপর ক্ষেপে আছে, মামুনকে মারলে আরো রেগে যাবে নির্ঘাত। আদি রাগে দাঁত কিরমির করতে করতে ক্লাসের দিকে রওনা দিলো। তখনই সুমনা পেছন থেকে ডাকলো। আদি সুমনার ডাক শুনে খুশি হয়ে দাঁত বের করে ওদের দিকে ফিরতেই সুমনা বললো-
“আপনি যেভাবে দাঁত কিরমির করছেন তাতে আপনার দাঁত তো খুলে পরে যাবে? প্লিজ দেখবেন! বন্ধুর উপর রাগ করে আবার দাঁত যেন না ফেলে দেন?”
বলেই সুমনা আর মামুন উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করলো। মামুন হাসতে হাসতে বললো-
“ওহহহ, সুমনা! তুমি এতো মজা করে কথা বলতে পারো জানা ছিলো না? খুব দুষ্টু মেয়ে তো তুমি? এভাবে কাউকে বলতে হয়? তাও আবার আমার বন্ধু? ”
“ওপপপসস,সরি! কম বলা হয়ে গেলোতো? আপনার বন্ধু যেহেতু তাহলে আর একটু বেশি বলা যায়। সরি ভাইয়া! আপনি কিছু মনে করলেন নাতো? আমি তো একটু মজা করলাম জাস্ট?”
“আরে তুমি যে কি বলোনা সুমনা? আদি কেন কিছু মনে করবে? ও এসবে কিছুই মনে করেনি, তাইনা রে আদি?”
আদি হা হয়ে দু’জনার কথা গিলছিলো। মামুনটা কি নির্দ্বিধায় ওকে অপমান করে কথা বলছে এটা দেখে ও আরো অবাক হয়ে গেলো। আদি রাগে দুঃখে কোনো কথারই জবাব না দিয়ে হেঁটে চলে এসেছিলো ক্লাসে। সেই থেকে মনটা একেবারে তেঁতো তেঁতো হয়ে আছে। কোনো ক্লাসই ঠিক মন দিয়ে করতে পারলো না। ও ভেবে রেখেছে আজ যে করেই হোক মামুনের সাথে ছুটির পর কথা বলবে। শালা হারামী শুরু করেছেটা কি?

*******

শেষ ক্লাসের ঘন্টা পরার সাথে সাথে আদি মামুনের ডেস্কের সামনে দাঁড়ালো-
“তোর সাথে আমার জরুরি কথা আছে। আজ যেন কোথাও না যাস!”
ঠান্ডা গলায় কথাগুলো বলে নিজের ডেস্কে ফেরত এলো আদি। স্যার চলে যাওয়ার পর নিজের বইখাতা গুছচ্ছিলো আদি তখন মামুন আর জিনাত এলো ওর কাছে। আদি একবার ওদের দেখে নিয়ে আবার নিজের কাজে মন দিলো। মামুন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে অধৈর্য্য হলো,বার দুয়েক ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো-
“আদি! কি জরুরি কথা বলবি বল?”
“বয়।”
“আরে ভাই বলনা তাড়াতাড়ি?”
মামুন অস্থির হলো।
“এ কেমন অস্থিরতা, মামুন? ও তো বসতে বলছে, বয়?”
জিনাত বিরক্তির সুরে বললো মামুনকে। মামুন বাধ্য হয়ে বসলো। আদি ব্যাগ গুছিয়ে ঠান্ডা চোখে মামুনের দিকে তাকালো-
“সকালে ওসব কি ছিলো?”
আদির কন্ঠ শুনে মামুন হচকে গেলো-
“ওসব জাস্ট ফান ছিলো দোস্ত!”
“তাই? তোর সাথে করলে ভালো লাগতো? জুনিয়র কোনো মেয়ে তোকেও এভাবে অপমান করতো আর আমি যদি সঙ্গ দিতাম তাহলে তোর ভালো লাগতো?”
“না আ তা লাগতো না! সরি দোস্ত, তুই মাইন্ড করবি জানলে মোনাকে মানা করতাম।”
মামুন আমতাআমতা করলো।
“মোনা!”
আদির কন্ঠে বিস্ময়।
“সুমনা থেকে ছোট করে মোনা বলছি।”
মামুন লজ্জায় একটু লাল হলো। আদি হাত তালি দিলো-
“বাহ, বেশ তো চলছে? দুইদিন আগের আসা মেয়ে আমাকে অপমান করে আর তুই তাতে সাথ দিস আবার তাকে তার নাম ছোট করে ডাকিস? আমাদের সাথে বসার তোর সময় হয় না? এসব কি চলছে শুনি?”
আদির কন্ঠে শ্লেষ আর ঈর্ষা ঝরে পরছে।
“শোন আদি, সকালে ভুল হয়েছে মানছি। তাই বলে এতো কথা কেন বলছিস? ওকে আমার ভালোলাগে, পচ্ছন্দ করি ওকে। মেয়েটাও আমার সাথে কথা বলছে, আমার সঙ্গ ওর ভালো লাগছে। আমাদের দু’জনার কোনো সমস্যা নেই, যত সমস্যা মনেহচ্ছে তোর?”
“একমিনিট একমিনিট! কি হচ্ছে তোদের দুজনার মাঝে? আমি তো আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না? ”
জিনাতের কন্ঠে বিস্ময়। আদি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো মামুনকে-
“ঐই মেয়ে তোর মাথা নষ্ট করে দিয়েছে।”
“তাতে তোর কি সমস্যা হচ্ছে? মোনা আমাকে বলেছিলো যে, তুই ঝামেলা পাকাবি কোনো না কোনো। কারন তুই নিজেও তো মোনার পিছনে ঘুরছিলি। ও তোকে পাত্তা না দিয়ে আমাকে পাত্তা দিচ্ছে, আমার সাথে কথা বলছে, ঘুরছে, এটা তোর সহ্য হচ্ছে না। তাই না?”
“এই মামুন তুই কি বলছিস এসব আবোলতাবোল?”
জিনাত ধমক দিয়ে থামানোর চেষ্টা করে মামুনকে।
আদি যেন নিশ্বাস নিতে ভুলে গেছে। কথা আর কি বলবে! তবুও অনেক কষ্টে বললো-
“এসব তোর মোনা বলেছে?”
“তা নয়তো কি? সেদিন তোকে জিজ্ঞেস করলাম, মোনাকে পচ্ছন্দ করি বললাম, তুই আমাকে ভেংচি কেটে চলে গেলি। পরে শুনলাম তুই নিজের জন্য ওর পিছনে পিছনে ঘুরছিলি। ও তোকে পাত্তা দেয়নি, তাই তোর ওকে সহ্য হচ্ছে না আমার পাশে। এটাতো সহজ হিসাব! ওর সাথে তোর কি হিসাব নিকাশ চলছে সবই বলেছে মোনা আমাকে। তুই যে এতো নিচ মানসিকতার একটা ছেলে তা জেনে খুব কষ্ট পেয়েছি আমি। তোকে আমার বন্ধু বলতেও ঘৃনা হয় আমার। মেয়েটাকে অসহায় পেয়ে যা ইচ্ছা তাই করতে চেয়েছিলি। কিন্তু আর পারবি না। আমি সবসময় মোনার সাথে আছি। আগে ও একা ছিলো এখন আমি ওর সাথে আছি। বুঝলি? আর যেন ওর পিছনে না ঘুরিস। তা হলে খারাপ হয়ে যাবে, বুঝলি?”
মামুনের কথাগুলো যেন আদির মাথার উপর দিয়ে গেলো। কত কথা বলে গেলো মামুন। সুমনা ওকে কি বলেছে? পুরনো হিসাব নিকাশ? সব কথা মামুনকে বলে দিয়েছে সুমনা? এক সপ্তাহে মামুন ওর এতোটা আপন হয়ে গেলো? অথচ আদি ওর সাথে কথা বলার জন্য কত ঘুরছে, একটাবার আদির সাথে কথা বলা তো দূরে থাক দেখলেই উল্টো ঘুরে চলে যাচ্ছে। যেন, আদি অচ্ছুৎ! মামুনকে কি এমন বলেছে যে, মামুন এতোটা রেগে আছে? আদির মাথা বনবন করে ঘুরছিলো। কিছুই মাথায় ঢুকছিলো না।
“দোস্ত, কি হচ্ছে এসব? মামুন কি সব উল্টো পাল্টা বলে গেলো কিছুই তো বুঝতে পারছি না? কোন মেয়েকে নিয়ে ঝগড়া চলছে তোদের মাঝে? মামুনটা এমন হয়ে গেলো কেন? কি হলো কিছু তো বল?”
জিনাত একা একা বকবক করে চলছে। আদি কিছু না বলে নিঃশব্দে উঠে দাড়ালো। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে হেলতে দুলতে বেড়িয়ে গেলো ক্লাসরুম থেকে। পেছনে জিনাত চেচিয়ে ওকে ডেকে চলেছে।

চলবে—–
©Farhana_Yesmin