বিপরীতে হিত পর্ব-০৯

0
199

#বিপরীতে_হিত
#পর্ব-৯

বাসায় এসে আদি চুপচাপ শুয়ে ছিলো বিছানায়। দুপুরে খাওয়া হয়নি আজ, ইচ্ছেও করছে না খেতে! মনটা তার অনেক খারাপ, অনেক। সুমনা নিশ্চয়ই মামুনকে সত্য মিথ্যা অনেক কথা বানিয়ে বলেছে। তা না হলে মামুন কখনো ওর সাথে এতো বাজে ব্যবহার করতো না। কিন্তু সুমনা কেন এমন করছে? কেন আদির সাথে একটু কথা বলছে না? কেন এমন ভাব করছে যেন আদিকে চেনেই না? আবার মামুনের সামনে আদিকে পচানোর চেষ্টাই বা কেন করছে? কি লাভ এতে সুমনার? তবে কি সুমনা এখনো পুরনো কথাই মনে গেথে রেখেছে? সেই স্কুল লাইফের স্মৃতি আকরে ধরে বসে আছে এখনো? এখনো আদিকে মনে মনে শত্রু ভাবছে না তো সুমনা? সুমনা কেন বুঝতে পারছে না, আদি শুধু সুমনাকে সরি বলতে চায়। মন থেকেই সরি বলতে চায়। স্কুলে যেটা করেছিলো সেটা ছিলো নিতান্তই অল্প বয়সে করা দুষ্টুমি। না বুঝেই করে ফেলেছিলো। এখন তো সেসবের কিছুই মাথায় নেই। উল্টো জানার কৌতূহল জেগেছে, সুমনা কেন স্কুল চেন্জ করলো আর কেনই না ও এখানে ওর জুনিয়র হলো? ও কি ইয়ার লস দিয়েছিলো? কিন্তু কেন? আদির হঠাৎ স্কুলের দিনগুলো মনে পরে গেলো। কি সুন্দর লম্বা সিল্কি চুল ছিলো সুমনার! অথচ এখন ওর চুল কেবল ঘারের একটু নিচে অবধি। কেবল চুলে আআঠা লাগিয়ে দিয়েছিলো বলেই কি আর কোনোদিন চুল বড় করলো না মেয়েটা? কি অদ্ভুত! এতো জেদি কেন মেয়েটা? ভেবে ভেবে একসা হচ্ছে আদি। নিজেও বুঝতে পারছে না, দিনরাত এক করে সে কেবল সুমনাকে নিয়েই ভাবছে?
“আদি, বাবু! আছিস?”
মায়ের ডাকে ভাবনার সুতো ছেড়ে আদির। মা দরজা নক করছে। আদি জানালা দিয়ে বাইরে দেখলো। কি আশ্চর্য! অন্ধকার হয়ে গেছে দেখছি? মনে মনে অবাক হলো আদি। সন্ধ্যা নেমে গেছে কখন আদি টেরই পায়নি। আদি উঠে যেয়ে দরজা খুললো। আদির মা ঘরে ঢুকেই ছেলের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো-
“বাবু, শরীর খারাপ নাকি তোর? বাসায় এসে কিছু খেলি না? নাকি মন খারাপ?”
আদি মন খারাপ করে মায়ের কোলে মাথা রাখলো-
“মন কিছুটা খারাপ মা।”
ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো রাহেলা-
“কি হয়েছে? বন্ধুদের সাথে কিছু নাকি কোনো মেয়ের কারনে আমার ছেলেটার মন খারাপ?”
মিটিমিটি হাসছিলো রাহেলা। আদি চুপচাপ কিছুক্ষন শুয়ে থাকলো।
“মা, তোমার সুমনার কথা মনে আছে?”
“হ্যা, মনে থাকবে না আবার? যে মেয়েটা তোর জন্য স্কুল ছেড়ে দিলো, সেই তো?”
আদি অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালো।
“কিভাবে মনে আছে মা!”
রাহেলা দুষ্টুমি করে ছেলের নাক টেনে দিলেন।
“আমার ছেলের জীবনে ঐ একটাই মেয়ে এসেছিলো কিনা তাই? তোর মুখে কোনোদিন তো আর কোনো মেয়ের কথা শুনলাম না?”
“কি যে বলো না তুমি? কত মেয়েই তো আছে? জিনাত, পুনম, শেলী…. ”
আদির কন্ঠে লজ্জা।
“ওরা তো আর স্পেশাল কেউ না? আচ্ছা এসব বাদ দে, বল তো কি হয়েছে? হঠাৎ আবার সুমনার কথা উঠলো কেন?”
উৎসুক কন্ঠে জানতে চান রাহেলা।
“ও আমার ডিপার্টমেন্টেই ভর্তি হয়েছে মা।”
“বাহ! বেশ ভালো। তুই তো ওকে স্যরি বলতে চাইছিলি? এখন সুযোগ পেয়েছিস, বলে দে সরি। বলেছিস?”
“সুযোগ কোথায় পেলাম মা? সেদিন বলতে চাইলাম কিন্তু ও আমার কোনো কথাই শুনলো না?”
আদি মাকে বলতে বলতে বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ফুলালো।
“তুই নিশ্চয়ই আবার ওর সাথে কিছু করেছিস? তা না হলে রাগবে কেন খামোখাই?”
“তা একটু করেছিলাম বইকি! ও কিছুতেই নিজের পরিচয় দিতে চাচ্ছিলো না মা, আমার কি দোষ? তুমি তো জানোই, কেউ ত্যাড়ামো করলে আমার মেজাজ খারাপ হয়। ও বেশি ত্যাড়ামো করছিলো, শেষে ওর নিজের মুখ থেকে ওর পরিচয় বের করার জন্য কেবল ওকে কিছুসময় বাথরুমে আঁটকে রেখেছিলাম।”
“কি সর্বনাশ! এসব কেমন ব্যবহার আদি? এমনিতেই মেয়েটা তোর ওপর রেগে ছিলো আগেই, তুই ওকে আরো রাগিয়ে দিয়েছিস।”
আদি মাথা চুলকালো।
“এইজন্যই মেয়ে তোর কোন কথা শুনতে চাচ্ছে না। ওর আর দোষ কি? এভাবে কি কাউকে পোষ মানাতে পারবি?”
“ইশশ, মা! এখানে আবার পোষ মানানোর কথা আসছে কেন? ও কি পাখি নাকি যে পোষ মানাবো?”
“পাখিই তো? মনের পাখি! ওকে তুই মনের খাঁচায় বন্দী করতে চাস না বল?”
“ধুর মা, তোমার সব উল্টো পাল্টা কথা? আমি কেন ওকে মনের পাখি বানাবো? আমার বয়েই গেছে? ওর মতো ঝগরুটে বদমাশ মেয়েকে মনে ঠাই দিতে আমার বয়েই গেছে! ”
“হ্যা, তাইতো ওর ওপর রাগ করে ছেলে আমার সারাদিন না খেয়ে আছে?”
“আরে ওর ওপর মোটেও রাগ করিনি। রাগ করেছি তো অন্য কারনে। মামুন বদটা…”
বলতে যেয়েও থেমে গেলো আদি। নাহ, মাকে এসব বলা যাবে না। মা আবার উল্টো পাল্টা বলা শুরু করবে। বলবে, সুমনা মামুনের সাথে ঘুরলে তোর কি? তুই তো আর ওকে ভালোবাসিস না? তুই তো নিজেই বললি, ও তোর মনের পাখি না? তাহলে মামুনের সাথে সুমনাকে দেখে তোর এতো জ্বলছে কেন? ব্লা ব্লা ব্লা।

ঠোঁট টিপে হাসলো রাহেলা। ছেলে বড় হয়েছে ঠিকই কিন্তু বুদ্ধি আর কাজকর্ম সব এখনো বাচ্চাদের মতো। এতো ব্রিলিয়ান্ট ছেলে তার এখনো সেই ক্লাস নাইনের স্মৃতি নিয়ে আঁটকে আছে। আচ্ছা! মেয়েটাও কি আছে নাকি আঁটকে? তা না হলে কি এখনো এতো রাগ করে থাকতো?

আদি মাথা ঝাকা দিয়ে উঠে বসলো। নাহ, মা উল্টো পাল্টা বকে আরো তার মাথা নষ্ট করছে। মা যে কিসব ভাবে না? যতোসব আজগুবি ভাবনা। কিসের মনের পাখি? আদি কেবল মন থেকে সরি বলতে চায় সুমনাকে। এছাড়া আর কিছু না। আদি মাকে বললো-
“মা, ঝটপট খাবার লাগাও তো?খুব খিদে লেগেছে, খাবো। আমি গোসলটা দিয়েই আসছি।”
“ঠিক আছে, আবার ভাবনায় তলিয়ে যাস না যেন?”
রাহেলা চলে গেলো। আদি শিস বাজাতে বাজাতে বাথরুমে ঢুকলো। ওর কেন যেন মন ভালো হয়ে গেলো হঠাৎ করে। মামুনের ওপর অতটাও রাগ লাগছে না আর। সুমনার উপর তো আরো না? মা ঠিকই বলেছে, ওকে বাথরুমে আঁটকে রাখাটা একটা ভুল ছিল। এমনিতেই অতীতে অনেক দোষ করেছিলো, তার উপর নতুন করে দোষ করেছে। এখন সুমনা রেগেমেগে ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে মামুনের সাথে এসব করছে নিশ্চয়ই? এসব দেখে আদি যাতে রাগ করে! কিন্তু এবার আর কোনো ভুল করবে না আদি। সুমনা এবার যত যাই করুক, আদি রাগবে না কিছুতেই। বরং, ভালো ব্যবহার করে সুমনাকে সবকিছুর জন্য সরি বলবে। মনের মধ্যে ভাবনাটা আসতেই আদির মনটা ফুরফুরে হয়ে গেলো।

*******

“তোর সাথে আমার জরুরি কথা আছে সুমনা?”
আদি গত তিনদিন ধরে সুমনার পিছনে পরে আছে। ভার্সিটিতে ও সারাদিন কি করে, কোথায় যায় এসব জানতে পুরো তিন’দিন লেগে গেলো আদির। আদি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো, মামুনের সাথে সুমনা বেশ ভালোই গল্প করে। ক্লাস শেষে মামুন আর সুমনা ঘন্টা খানিক একসাথে আড্ডা দেয়। তারপর সুমনা লাইব্রেরিতে যেয়ে বসে। এরমধ্যে একদিন মামুনকে দেখলো, সুমনাকে নোট দিতে। মামুন নোট কোথায় পাবে? ফাস্ট ইয়ারে তো শালা আদির নোট পড়ে পাশ করলো? মামুন আর সুমনার নোট আদান-প্রদান দেখে আদির রাগে মাথা হট হয়ে যাচ্ছিলো। আদির তৈরি করা নোট, মামুনের বাচ্চা কি সুন্দর নিজের নাম দিয়ে চালিয়ে দিচ্ছে! আদি বড় বড় শ্বাস ফেলে মামুনের চলে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। মামুন চলে গেলেই সুমনা লাইব্রেরিতে যেয়ে বসে, তখন ধরতে হবে ওকে। তা না হলে জীবনেও আদির সাথে কথা বলবে না সুমনা? সুমনা লাইব্রেরিতে বসা মাত্রই আদি নিঃশব্দে ওর পাশের চেয়ারে এসে বসে। আদির কথা শুনে সুমনা ফিসফিস করলো-
“আমি এখানে কোন সিনক্রিয়েট করতে চাইছি না। তুই চলে যা আদি?”
“যাবো না। বাইরে তো কথা বলিস না তাই বাধ্য হয়ে এখানে আসতে হলো।”
“তোর সাথে কথা বলতে আমার রুচিতে বাঁধে। চলে যা তুই?”
“কেন? কি করেছি আমি? একটু না হয় দুষ্টুমি করেছি, তাই বলে এমন করবি আমার সাথে? তাও সেই ছয় বছর আগের করা দুষ্টুমি। ”
“আমি কিছুই করিনি, যা করার তুই করেছিস এবং করছিস!”
“তুই কিছু করছিস না বলেই আমার সব করতে হচ্ছে। কেন করছিস এমন?”
“কি করেছি?”
সরু চোখে তাকালো সুমনা। বুঝতে চাচ্ছে আদি কি বলতে চায়।
“এই যে মামুনের সাথে এসব কি করছিস? ও বোকা ছেলে, তোর এসব ট্রিকস ও বুঝবে না?”
সুমনা সোজা হয়ে বসলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আদির দিকে তাকালো। আদিও তাকিয়ে ছিলো সুমনার দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আদির আরেকবার মনে হলো যে, সে সুমনার চোখের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে। এতো সুন্দর চোখ কেন মেয়েটার? আগেও কি এতো সুন্দর ছিলো? নাকি এখন হয়েছে? আদির চোখে যেন ঘোর লেগে যাচ্ছে! ঘোর কি ওপাশেও লাগছিলো নাকি? সুমনা আদির হাতে চিমটি কাটলো জোরে। আদি ‘আহঃ’ শব্দে ঘোর কাটালো। আশেপাশের টেবিলের অনেকেই তাকালো ওদের দিকে। যারা আদিকে চেনে তারা কেউ কেউ আদিকে একটা মেয়ের সাথে দেখে অবাক হলো। ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট আদি মেয়েদের সাথে ফ্লাটিং করে না এটা ক্যাম্পাসের পুরনোরা জানে। আদি চারপাশে তাকিয়ে সুমনার দিকে চোখ পাকালো, দেখলো সুমনা ঠোঁট টেনে হাসছে। আদি আবার একবার হারিয়ে যেতে চাচ্ছিলো, কারো ঠোঁট টেনে হাঁসাও এতো সুন্দর হয় কি করে? চিমটি খেয়েও আদি চুপচাপ দেখে সুমনা তাকিয়ে দেখলো আদি আবার তাকিয়ে তাকিয়ে ওকে দেখছে। সুমনা বিরক্ত হলো-
“এবার তোর মাথায় বারি দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেবো কিন্তু? পড়তে দিচ্ছিস না কেন? ভাগ এখান থেকে!”
“আগেই বলেছি যাবো না। আগে আমার কথা শুনবি তারপর যাবো।”
আদির কন্ঠে মুগ্ধতা যা সুমনাকে মোটেও স্পর্শ করলো না।
“কি বলবি বল, বলে বিদেয় হ।”
“তুই এতো সুন্দর হয়ে গেলি কবে?”
যেন আদি না আদির ভুত কথা বলছে। আনমনে যে আদি কি বলছে তার কোনো হুঁশ নেই। সুমনা অবাক হয়ে আদির দিকে তাকিয়ে আছে-
“কি বলছিস এসব? এগুলো বলতে এসেছিস?”
আদির টনক নড়লো। ধুশ! কি বলছে এসব? আদি কথা ঘুরানোর জন্য অন্য কথা বলে-
“মামুন যে তোকে নোট দিয়েছে জানিস কার নোট?”
“কার আবার, মামুনের?”
“হুহ,মামুনের। ঐ শালা নোট করেছে নাকি কোনোদিন? আমার নোট নিয়ে পড়ে পাশ করলো, এখন আমার সেই নোট নিজের নাম দিয়ে চালিয়ে তোকে দিচ্ছে। ”
সুমনা রাগত দৃষ্টিতে আদির দিকে তাকিয়ে থেকে ব্যাগ থেকে নোটগুলো বের করে আদির দিকে বাড়িয়ে দিলো-
“নোট চাইতে এসেছিস? নে তোর নোট ফেরত নে। আমার এসব নোট ফোটের প্রয়োজন নেই। আমি নিজের নোট নিজেই তৈরি করে নিতে পারবো! ”
সুমনার কন্ঠে রাগ। আদি বুঝলো আরো একটা ভুল করে ফেললো ও। কি বলতে এসেছিলো আর কি বললো? সব গুবলেট করে দিলো। আরো জগাখিচুরি পাকিয়ে দিলো। আদি বুঝে পেলো না, সুমনার সাথে কথা বলতে আসলেই কেন সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তার?

চলবে—–
©Farhana_Yesmin