বিবাহিতার সাতকাহন পর্ব-০৭

0
204

#বিবাহিতার সাতকাহন
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৭

শ্বাশুড়ি মা বাসায় এসেই আমাদের তরফ থেকে দেওয়া সকল কাপড় চোপড় ছুড়ে মারলেন। রাগে চিল্লায়ে উঠে ফুপাতে লাগলেন। কেউ উনার রাগ দমন করতে পারল না। বরং যে রাগ কমানোর চেষ্টা করেছে তার দিকেই উনার বাঁকা কথা তেড়ে আসছে। আহাজারি করে বলতে লাগলেন

“এ বউ বিয়ে করিয়ে আমার কপাল পুড়িয়েছি। বউয়ের বাবার বাড়ি থেকেও কথা শুনতে হয়। হায়রে কপাল আমার।”

এসব বলেই আহাজারির মাত্রা বাড়াতে লাগলেন। এবার নুহাশ মাকে শান্ত করতে গেলে তিনি নুহাশের দিকে তেড়ে এসে বললেন

“আমি তো তোকে পেটে ধরেছিলাম তুই কেন আমাকে অপমান হতে দেখে চুপ ছিলি? তুই তো প্রতিবাদ করতে পারতি।”

নুহাশ এবার কিছুটা বিরক্ত হয়েই মাকে জবাব দিল

“মা আমার মনে হয় বিয়ে করাটায় উচিত হয়নি। বিয়ের পর থেকে এত প্যারা ভালো লাগতেছে না। তোমরা থাকো আমি কাজে চলে যাচ্ছি।”

নুহাশ কথাগুলো গজগজ করে বলে দ্রূত ড্রয়িং রুম থেকে বেড রুমের দিকে এগিয়ে গেল। আমিও নুহাশের পিছে ছুট লাগালাম। নুহাশ কাপড়চোপড় গুছাতে লাগল। আমি এবার নুহাশের হাতটা ধরে বললাম

“আপনি তো সাতদিন থাকবেন বলেছিলেন তাহলে এখন কোথায় যাচ্ছেন?”

নুহাশ হাত টা ছাড়িয়ে উত্তর দিল

“তোমাদের বউ শ্বাশুড়ির ঝামেলা আমার একদম ভালো লাগছে না। তুমি এটুকু হ্যান্ডেল করতে পারতেছো না। যখন তোমাদের ঝামেলা মিটবে তখন বাসায় আসব এর আগে না।”

এক নিঃশ্বাসে কথার ঝুড়িমালা ফুরিয়ে নুহাশ ব্যাগ হাতে নিয়ে বের হয়ে গেল। আমি শুধু পেছন দিক হতে তার যাবার পথটা চোখ দিয়ে অবলোকন করলাম। খুব খারাপ লাগছে। যন্ত্রণা আমাকে গ্রাস করছে। পরিবারের সবচেয়ে ছোটো মেয়ে হওয়ায় কখনও পারিবারিক কলহের সম্মূখ হতে হয়নি। কিন্ত বিয়ের পর মনে হলো সকল কলহ যেন আমাকে ঘিরে ধরেছে। বিয়ের আগে দেখা স্বপ্নগুলো যেন ভাঙতে লাগল। জীবনের বিচিত্র এ অধ্যায়টায় একটা সময় আমি মোনাজাতে চাইতাম আজ যেন সব পেয়েও হতাশায় পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছি।

নুহাশ চলে যাওয়ার দোষটাও আমার উপর পড়ল। এ বাসার সকল দোষের দায় নেওয়া মানুষটায় যেন আমি। আমি রুমে এসে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলাম। আপুকে কল দিয়ে সবটা বলার পর আপু এক বাক্যে বলল

“ঐ বাসা থেকে এখনই বের হয়ে চলে আয়। এভাবে এত কষ্ট করে সংসার করা লাগবে না। অনেক হয়েছে। এত সমস্যা তো বিয়ের আগে বুঝিনি। বুঝলে তোকে বিয়েই দিতাম না। মানিয়ে নেওয়ার পরও এত সমস্যা সুতরাং আর মানাতে হবে না। আর নুহাশ বিষয়টা ঠিক না করে এভাবে গা ছাড়া ভাব দেখিয়ে চলে যাওয়া ঠিক হয়নি। ভাতের জন্য কেউ মরে না। আমি এসে তোকে নিয়ে যাচ্ছি। সংসার করার দরকার নেই ডিভোর্স দিয়ে দিবি।”

আপুর কথা শুনে বুকের ভেতর কেমন যেন মোচড়ে উঠল। এত কষ্ট পাওয়ার পরও যেন ডিভোর্স শব্দটা মেনে নিতে পারছি না। তার উপর নুহাশের প্রতি এক প্রবল মায়া যেন আমাকে গ্রাস করতেছে। আমার মনে হচ্ছে নুহাশ যেমনই হোক তাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। হালাল এক বন্ধনের জোরেই হয়তো এমন মনে হচ্ছে। আর সবচেয়ে মূখ্য বিষয় হলো আমি ডিভোর্স দিলে আমার আশেপাশের লোক আমাকে নিয়ে রঙ বেরঙ এর নানান কথা বলবে। এত কথা সইবার মতো ক্ষমতাও তখন আমার থাকবে না। কষ্টই করতে হবে এখনই করি। সংসার টিকিয়ে রাখার চেষ্টাটাই করি বরং। আমি আপুর পরিপ্রেক্ষিতে সোজাসাপটা উত্তর দিলাম

“আপুরে ডিভোর্স ছাড়া কোনো উপায় থাকলে বল। আমি ডিভোর্স দিতে পারব না। ডিভোর্সের পরও আমি শান্তিতে থাকতে পারব না। এ সমাজ আমাকে শান্তিতে থাকতে দিবে না। তাই আপু এছাড়া কোনো উপায় থাকলে বলো।”

আমার কথার জবাবটা হয়তো আপুর ভালো লাগেনি তাই বেশ রেগে গিয়ে উত্তর দিল

“তাহলে এভাবেই ধুকে ধুকে মর। আর পারলে একটু জবাব দিস তাদের কথায়। অন্যায় সহ্য করা আর অন্য করা একই অপরাধ। এমনিতেও তাদের চোখে তুই বেয়াদব সুতরাং দুটো কথার উত্তর দিলে নতুন করে আর বেয়াদব হওয়ার চান্স নেই। তোর সংসার তুই বুঝবি কী করবি। রাখি।”

ফোন কাটার শব্দ কানে আসলো। আমি চুপ করে বসে রইলাম। এভাবে চলতে থাকলে আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আর আত্মহত্যা করার মতো কোনো সাহসও আমার নেই। তবে আপুর কথা মতো একটু জবাব দেওয়ায় যায়। আমি ফোনটা হাতে নিয়ে বেশ সাহস করে নুহাশ কে কল দিলাম। নুহাশ কল ধরতেই বলে উঠলাম

“আপনি আমাকে রেখে কেন চলে গেছেন? আপনাকে ঘিরে আমার চাওয়া কী আপনি বুঝবেন না? আমি এ বাসায় নতুন সবাই আমাকেই কেন সব কিছুর দায়িত্ব ঠুসে দিচ্ছ? আমাকে মানিয়ে নিতে বলা অন্যায় না তবে মানিয়ে নেওয়ার কথা বলে সকল অন্যায় গুলো আমার উপর চাপিয়ে দেওয়া অন্যায়। আপনি তো কথা দিয়েছিলেন আমাকে আপনি ঘুরতে নিয়ে যাবেন। তাহলে কথা না রেখে কেন চলে যাচ্ছেন? মায়ের উপর রাগ অভিমানটা কেন আমার উপর ঝাড়ছেন? দোষটা কী শুধুই আমার? আমি তো বোবার মতো চুপ হয়ে থাকি তারপরও এত দোষের দাসী নাজানি কথা বললে কী হত। আমি সত্যিই আর এসব নিতে পারছি না। আপনি বলে ছিলেন আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন তবে এখন কেন ভালোবাসার মানুষটাকে একা ফেলে রেখে কষ্ট দিচ্ছেন। আপনি বাসায় আসেন। মাকে বুঝিয়ে সব মিটমাট করুন।”

আমার কথায় নুহাশের উত্তর আসলো

“মুমু আমি এত প্যারা নিতে পারি না। না পারি মায়ের পক্ষ হয়ে তোমাকে ছোটো করতে, না পারি তোমার পক্ষ হয়ে মাকে ছোটো করতে। যাইহোক আমি আসতেছি।”

মুমু শান্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলল। এতক্ষণে যেন তার শান্তি লাগছে। বুকটা প্রশান্ত লাগছে। নিজেকে হালকা লাগছে। বৃষ্টির পর রোদের হাসি দিয়ে যেমন দিনটা আলোকিত হয় ঠিক তেমনি মুমুর কান্না জোরা চোখ দুটো ঠোঁটের প্রশস্ত হাসিতে বিলীন হয়ে মুখটা আলোকিত হয়েছে।

মিনেট ১০ পর নুহাশ বাড়িতে ফিরে আসলো। আর এ বাড়ি ফিরে আসাতে যেন সে আরও বড়ো অন্যায় করে ফেলল। নিমিষেই মুমুর হাসি কালো মেঘে ঢেকে গেল। মুখটা মলিন হয়ে চুপসে গেল।

কপি করা নিষেধ