#বিবাহ_অভিযান (১৩)
#তানজিলা_খাতুন_তানু
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)
– “আমার সাথে আপনার আবার কিসের শত্রুতা?”
রাশির কথা শুনে সোহানের মুখের ভাব কিছুটা পরির্বতন হলো। চোখে -মুখে হিংস্রতা ফুটিয়ে তুলে বলল,
– “শত্রুতা’টা ঠিক তোমার সাথে না তোমার পরিবারের সাথে তোমার বাবার সাথে।”
রাশি অবাকের শীর্ষে পৌঁছে গেল। সোহানের শত্রুতা ওর বাবার সাথে কিন্তু কীভাবে?
– “আমার বাবার সাথে আপনার শত্রুতা মানে?”
সোহান ব্যথাতুর কন্ঠে বলল,
– “শুধুমাত্র তোমার বাবার জন্য আমি আমার মাকে হারিয়েছি, মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছি। তার শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে।”
সবকিছু রাশির মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ওর বাবা কি এমন করেছে যার জন্য সোহান তার মাকে হারিয়েছে আর এখন সেই সবের প্রতিশোধ নিতে যাচ্ছে!
— — —
– “দেখুন ২৪ঘন্টা না হলে আমরা কোনো ডাইরি নিতে পারব না। আপনারা এখন আসতে পারেন।”
সমুদ্র হতাশ হয়ে অয়নের দিকে তাকাল। অয়ন চলে যাবার জন্য বলছে কিন্তু সমুদ্র ভেবে পাচ্ছে না কি করবে। রাশির খোঁজ কীভাবে করবে!
– “সমুদ্র বাড়ি ফিরে চল, ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
– “কি সিদ্ধান্ত নেব। কয়েক ঘন্টা হয়ে গেল রাশির খোঁজ পাচ্ছি না, মেয়েটা কোথায় গেল কিছুই বুঝতে পারছি না।”
– “চিন্তা করিস না, রাশির কিছু হবে না।”
অয়ন কথাটা তো বলে দিল কিন্তু সমুদ্র বিষয়টা এতটা সহজে মেনে নিতে পারছে না। মন তো মানতে চাইছে না, অজানা ভয়ে বারবার কেঁপে উঠছে।
পুলিশ স্টেশন থেকে বের হতেই ওদের আকাশের সাথে দেখা হয়, ওহ তড়িঘড়ি করে আসছিল।
– “সমুদ্র’দা কি হলো?”
– “আর কি হবে! ডাইরি নেয়নি বলেছে ২৪ঘন্টা পার হলে তবে নেবে।”
আকাশ চিন্তিত কন্ঠে বলল,
– “রাশি’দি কোথায় গেল!”
– “জানি না, কিছুই বুঝতে পারছি না।তুমি বরং রাশি’দের বাড়িতে যাও আন্টি আর খুশিকে সামলাও।”
– “আচ্ছা আসছি।”
আকাশ চলে যেতে অয়ন ভাবুক হয়ে বলল,
– “সমুদ্র রাশির সাথে কার শত্রুতা থাকতে পারে বল তো!”
সমুদ্রের কিছুটা একটা খেয়াল পড়াতে এক ছুটে থানার ভেতরে গেল, অয়নও পিছু পিছু গেল। ওদেরকে আবার আসতে দেখে অফিসার বিরক্ত হয়ে বললেন,
– “আপনাদের তো বললাম ২৪ঘন্টার আগে মিসিং ডাইরি হবে না।”
– “মিসিং ডাইরি নয় একজনের নামে কিডন্যাপিং এর কেস করতে চাই।”
অফিসার ও অয়ন দুজনেই সমুদ্রের মুখের দিকে তাকাল, সমুদ্র কার কথা বলছে।
অফিসার মনে মনে কিছুটা বিরক্ত হলেন, রাতের বেলা এইসব ঝামেলা কার ভালো লাগে। কিন্তু দায়িত্ব তো পালন করতেই হবে তাই বললেন,
– “আচ্ছা বলুন কার নামে করতে চান।”
– “সোহান। ছেলেটা রাশিকে বিরক্ত প্রায় বিরক্ত করত আমার মনে হই ওই রাশিকে কিডন্যাপ করেছে।”
– “কিন্তু মিষ্টার আপনি সন্দেহের বশে একজনের নামে কেস করতে চাইছেন, সন্দেহ যদি ভুল হয় তাহলে আপনার কপালে দুঃখ আছে।”
– “সেটা পড়ে দেখা যাবে আপনি fIR লিখুন।”
সোহানের নামে কিডন্যাপিং এর কেস করা হয়। সমুদ্র কিছুটা হলেও চিন্তামুক্ত হলো, ওর সন্দেহ কাজটা সোহানের ছাড়া কারোর না। কিন্তু সোহান যদি রাশির কোনো ক্ষতি করে দেয়! কি চাইছে ছেলেটা?
—- —–
– “দেখুন সোহান রাত বাড়ছে আমাকে যেতে দিন।”
সোহান বাঁকা হেসে বলল,
– “যেতে তো দেবই, ভয় নেয় তোমার শারিরীক কোনো ক্ষতি করার উদ্দেশ্য আমার নয়। যখন তোমার এলাকার সবাই জেনে যাবে তুমি সারারাত বাড়ি ফেরোনি, অপহরন হয়েছ। সবাই ছিঃ ছিঃ করবে, তোমার চরিত্রে আঙুল তুলবে তখন তোমাকে আমি ছেড়ে দেব।”
রাশি আঁতকে উঠল, ছেলেটা এ কোন ভয়ংকর খেলায় মেতে উঠেছে!
– “সোহান আপনি এইসব কি বলছেন? কেন করছেন আমার সাথে!”
– “বললাম না প্রতিশোধ।যেটার আগুন আমি এতগুলো বছর নিজের মধ্যে চেপে রেখেছি।”
রাশি নিজেকে শান্ত করল, সোহানকে উত্তেজিত করলে চলবে না। ঠান্ডা মাথায় সবটা জানতে হবে, কেন হো এইরকম করছে। ওর বাবার সাথে সোহানের মায়ের কিসের শত্রুতা!
– “ঠিকাছে আপনি যেটা চাইছেন সেটাই হবে। আমি এইখানেই থাকব কিন্তু আপনি আমাকে বলুন আমার বাবা আপনার মায়ের সাথে কি করেছে?”
সোহান মাথা তুলে তাকাল, চোখ ছলছল করছে রাশির এই প্রথম সোহানের জন্য বড্ড মায়া হলো।সোহান অনেকটা কষ্ট নিয়ে বলতে শুরু করল,
– “তখন আমার বয়স ১১বছর আর বোনের ৮বছর। আমি ফাইভে ভর্তি হয়েছি নতুন স্কুল সবকিছু নিয়ে ভালোই চলছিল। এর মাঝে মায়ের হঠাৎ করেই চাকরি করার ইচ্ছা জাগে, কয়েক জায়গায় ইন্টারভিউ দেবার পর একটা জায়গায় চাকরিও হয়ে যায়। আর সেই অফিসে তোমার বাবাও জব করতেন। আমার মা দেখতে বেশ সুন্দরী ছিলেন, স্লিম শরীরে কেউ ধরতেই পারত না ওনার ১১বছরের একটা ছেলে আছে। অফিসের সবাই ওনার জন্য পাগল ছিল কিন্তু আমার মা তোমার বাবার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েন।”
রাশির চমকে সোহানের দিকে তাকাল, ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠছে। এতগুলো বছর পর এসে মৃত বাবার চরিত্র সম্পর্কে খারাপ কিছু না শুনতে হয়। ওর কাছে ওর বাবা আইডল, সেই বাবার চরিত্র নিয়ে কিছু শুনতে পারবে না রাশি।
সোহান তাচ্ছিল্যের হেসে বলল,
– “নিজে বিবাহিত হয়েও অন্য পুরুষে আসক্ত হয়ে পড়ে আমার মা। তোমার বাবা’কে নিজের আয়ত্তে আনতে মরিয়া হয়ে উঠে, একদিন এইসব নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয় তারপর তোমার বাবা আমার মাকে থাপ্পর মারে আর অনেক বাজে কথা শোনায় আমার মা সেটা সহ্য করতে পারে না সেইরাতেই সুইসাইড করে।”
রাশি সোহানের মুখের দিকে তাকাল, ছেলেটার চোখে -মুখে স্পষ্ট যন্ত্রনা ফুটে উঠেছে। ছেলেটা মায়ের মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি তাই এইরকম করেছে কিন্তু সোহানের ধারনা তো ভুল সেটা তো ভাঙাতেই হবে।
রাশি মনে মনে সবটা সাজিয়ে নিয়ে বলল,
– “সোহান আমি আপনার সব কথা বুঝতে পারছি কিন্তু এইখানে আমার বাবার দোষ কোথায়? আমার বাবা তো নিজের স্ত্রী-সন্তানের প্রতি লয়াল ছিলেন তাহলে আপনি কেন প্রতিশোধ নিতে চাইছেন?”
সোহান নিজের চোখের পানিটা মুছে বলল,
– “সেইদিন তোমার বাবা আমার মা’কে অপমান না করলে আমার মা কখনোই সুইসাইড করতেন না। আর আমারও আমার মাকে হারাতাম না।”
রাশি সোহানকে বোঝানোর জন্য বলল,
– “সোহান শান্ত মাথায় ভাবুন, আমি বুঝতে পারছি আমার বাবার প্রতি আপনার রাগ আছে। আপনি তার প্রতিশোধ নিতে চাইছেন কিন্তু একটিবার ভেবে দেখুন আমার বাবার কি কোনো দোষ আছে?”
সোহান কিছুটা শান্ত হলো। ব্যথাতুর কন্ঠে বলল,
– “জানি না, আমি কিছুই জানি না। আমি শুধু প্রতিশোধ নিতে চাই।”
– “তা কিভাবে প্রতিশোধ নেবেন?”
সোহান রাশির দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলল,
– “তোমার বদনাম করে প্রতিশোধ নেব।”
রাশি মৃদু হাসল, সেটা দেখে সোহান ভ্রু কুঁচকে বলল,
– “হাসছো কেন?”
রাশি সোহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
– “আমাকে বদনাম করলেই কি আপনি আপনার মা’কে ফিরে পাবেন?”
সোহান কিছু বুঝল না, মাথা নাড়িয়ে না বলল। রাশি মৃদু হেসে বলল,
– “তাহলে কি লাভ প্রতিশোধ নিয়ে? বিষয়টা কম করে হলেও আজ থেকে ১০বছর আগের, হ্যাঁ একটা ঝামেলা হয়েছিল আর ভুলটা দেখতে গেলে আপনার মায়ের ছিল। আপনার মা অন্যায় করেছিলেন তার জন্য অপমানিত হয়েছিলেন আর সেটা সহ্য করতে না পেরে সুইসাইড করেছেন। এইখানে আমার বাবা কিংবা আমাদের দোষ আছে বলে আমার মনে হই না।”
সোহান চুপ করে রইল। রাশির কথাগুলো ফেলে দেবার মতো না সেটা ওহ জানে কিন্তু মায়ের মৃ’ত্যু টাকে মেনে নিতে পারেনি। ছোট থাকতে মায়ের সুইসাইডের কারন’টা জানতে পারেনি কিন্তু বড়ো হবার সবটা জেনেছিল তারপর থেকে প্রতিশোধ নেবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে, নিজের সবটা দিয়ে রাশির পেছনে পড়েছিল কিন্তু রাশিকে পটাতে পারেনি। তারপর এইসব…
রাশি সোহানের দিকে তাকিয়ে বলল,
– “সোহান আপনি আমার বয়সে কিছুটা ছোট আমার ভাইয়ের মতো। বড়ো বোন হিসাবে বলছি এইসব প্রতিশোধের চিন্তা বাদ দিয়ে যাকে বিয়ে করেছেন, যাকে ভালোবাসেন তাকে নিয়ে সংসার করুন। নাহলে দেখবেন এই প্রতিশোধের চক্করে পড়ে নিজের লাইফ, ভালোবাসা সবটা শেষ হয়ে যাবে। আর আপনার ভালোবাসার মানুষটা যদি জানে আপনি এইসব করেছেন তাহলে সে কি আপনাকে ভালোবাসতে পারবে? আপনার প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারবে?”
সোহান চুপ করে রইল। রাশি সোহানের দিকে তাকিয়ে ওর রিয়াকশন বোঝার চেষ্টা করছে, ছেলেটার চিন্তাভাবনা কি বদলাতে পারল?
#চলবে…