বিবাহ অভিযান পর্ব-১৯ এবং শেষ পর্ব

0
149

#বিবাহ_অভিযান (১৯ এবং শেষ পর্ব)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)

রাশি-সমুদ্রের বিয়ের আয়োজনের দায়িত্ব অয়ন,আকাশ আর সোহানের হাতে। যেহেতু রাশির‌ বাবা নেয় সেই কারনে আকাশকেই সব দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।‌অয়ন সমুদ্রের দিকটা সামলাচ্ছে আর সোহান দুইপক্ষতেই আছে। যেই দিকে দরকার পড়ছে সেই দিকেই দৌড় দিচ্ছে।

বিয়ের গেটে দাঁড়িয়ে হুলুস্থুল কাণ্ড। রাশির বোন আর বান্ধবী কিছুতেই ছাড়বে না, তাদের দাবি মানতেই হবে। সমুদ্র করুন চোখে অয়নের দিকে তাকাল, অয়ন ওর কানে ফিসফিস করে বলল,
– “ভাই দিয়ে দে নাহলে বউ ঘরে ঢুকতে দেবে না।”

সমুদ্র হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে ওদের দাবি মতো টাকা দিয়ে দিতেই ওরা হইহই করে গেট ছেড়ে দিয়ে পালাল।‌ অয়ন সমুদ্রের কানে আবারো ফিসফিস করে বলল,
– “এখুনি এত হাই উতোশ করে লাভ নেই। এই তো সবে শুরু এখন দিল্লি বহুত দূর।”

সবটা সমুদ্রের মাথার উপর দিয়ে গেল, অয়নের কথার অর্থ বোঝার মতো সময় আসুক ওহ ঠিক বুঝে যাবে।

—–

রাশির মা মেয়েকে বউ সাজে দেখে খুশিতে কেঁদে ফেললেন, মেয়েটা এই সংসারের জন্য অনেক কিছু করেছেন অবশেষে ওর জীবনে সুখ ধরা দিল। মেয়েটার একটা সংসার হবে, একটা সুখের ঘর হবে। এতদিন ধরে এইটাই তো দেখতে চেয়েছিলেন, মেয়েটাকে একজনের হাতে তুলে শান্তিতে চোখ বন্ধ করবেন।

রাশি মায়ের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল,
– “মা কেঁদো না।দ্যাখো আজ তোমার মেয়ে বিয়ের সাজে সেজেছে, আজ তোমার বিয়ে তুমি খুশি তো মা।”

রাশির মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন। রাশির চোখেও পানি আজকের পর থেকে এই বাড়িটা ওর আর নিজের থাকবে না, সবকিছুই কেমন যেন পর হয়ে যাবে।

খুশি রাশিকে আনতে এসেছিল মা বোনের কান্না দেখে ওহ নিজেকে সামলে রাখতে পারল না, জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল। তিন- মা মেয়ের কান্না দেখে রিতাও কাঁদতে শুরু করেছে, চারজনে জড়িয়ে ধরে সেকি কান্না।রাশি এখনো যাচ্ছে না দেখে আকাশ খুশিকে আনতে এসে দেখে এরা সবাই মিলে কান্নাকাটি করছে, ওহ কাকে ছেড়ে কাকে সামলাবে সেইটাই বুঝতে পারে না।

রিতার ধ্যান ফেরে ওহ কান্না আটকে খুশি আর ওর মাকে আলাদা করে দেয়, রাশির কাঁদতে কাঁদতে অবস্থা খারাপ। রিতা ওর চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলল,,
– “এখুনি কেঁদে বন্যা করে ফেলবি, একটু পানি জমিয়ে রাখ কাজে লাগবে।”

রাশি কিছু না বলে রিতাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়, রিতা তো বড্ড ফ্যাসাদে পড়েছে, না পারছে রাশিকে সামলাতে আর নিজেকে।

কান্নাকাটির মাঝ থেকে রাশি-সমুদ্রের বিয়ে হয়ে যায়। রিতা রাশিকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলল,
– “আজ থেকে আমরা দুজন বন্ধু থেকে জা হয়ে গেলাম।”..

রিতার কথা বুঝতে না পেরে রাশি ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল, রিতা দাঁত বের করে বলল,
– “বরের বন্ধুর বউ জা হবে না তো কি হবে?”

রাশি হিসাবটা মেলাতে পারল না, বরের বন্ধুর বউ জা হয়! এইটা এই প্রথম শুনল কে জানে হয়তো হতোও পারে।

সময় নিয়ে ঘনিয়ে আসল বিদায় পর্ব, রাশির মা কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এই বয়সে মেয়েটাই ছিল একমাত্র সম্বল, রাশির বিয়ে হয়ে যাওয়া মানে উনি বড্ড একা হয়ে যাবেন একাকিত্ব ঘিরে ধরবে। কিভাবে মেয়েকে ছেড়ে থাকবেন সেটাই ভেবে পাচ্ছেন না। রাশিও কাঁদছে, বোনের বিয়ের পর মাকে নিয়েই ওর দুনিয়া ছিল মাকে ছেড়ে যেতে হবে ভাবতেই বুক কেঁপে উঠছে।

রিতা জোর করে রাশিকে গাড়িতে তুলে দিয়ে নিজেও বসে পড়ে তারপর ধমক দিয়ে বলল,
– “আমার বিয়ের সময়ে খুব তো বড়ো বড়ো কথা বলছিলিস এখন কেন কাঁদছিস?”

রাশি উত্তর না দিয়ে রিতার কাঁধে মাথা এলিয়ে দিল, বড্ড ক্লান্ত লাগছে। রিতাও যত্নে আগলে নিল প্রানের বন্ধুকে। এইটা দেখে গাড়ির বাইরে থেকে অয়ন বলল,,
– “এই রিতা সমুদ্রের অধিকারে ভাগ বসিয়ে দিলে?”

রিতা বিরস মুখে বলল,
– “আজকেই শেষ তো, আজকের পর থেকে রাশি পুরোটাই সমুদ্রের।”

অয়ন মৃদু হাসল, সমুদ্রও বুঝল রিতার ওহ বান্ধবীর বিয়ে হয়ে যাওয়াতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। দুজন দুজনের প্রানের বান্ধবী কিনা।

বাড়িতে ফিরে সমস্ত আয়োজন শেষে রাশিকে সমুদ্রের ঘরে বসিয়ে রেখে আসা হলো। রাশি প্রচন্ড নার্ভাস, সমুদ্রের সাথে ভালো বন্ধুত্ব সম্পর্ক থাকলেও আজ থেকে সম্পর্কটা সম্পূর্ণ আলাদা। আজ থেকে ওরা দুজন স্বামী-স্ত্রী। একটা নার্ভাসনেস তো আছেই।

সমুদ্র রুমে এসে দেখল রাশি বিছানায় বসে আছে। ওহ মৃদু হেসে রাশির সামনে দাঁড়াতেই রাশি লজ্জায় আরো কিছুটা নুইয়ে পড়ল। সমুদ্র পাঞ্জাবির পকেট থেকে আংটি বার করে রাশির হাতে পড়িয়ে দিয়ে বলল,
– “তোমার উপহার। আজকে থেকে এই বাড়ি, আমার ঘর এমনকি গোটা আমিটাতে তোমার অধিকার। সবকিছু আগলে রাখার দায়িত্ব তোমার।”

—- —-

রাশি-সমুদ্রের বৌভাতের অনুষ্ঠানে সমুদ্রের অফিসের অনেকেই উপস্থিত ছিল। ওর বন্ধুবান্ধব সকলেই উপস্থিত ছিল।

সমুদ্রের বন্ধুরা সমুদ্রকে খোঁচা দিয়ে বলল,
– “অবশেষে সমুদ্রের বিবাহ অভিযান সম্পন্ন হলো, কি বলিস?”
– “হ্যাঁ সে তো অবশ্যই। আমি তো ভেবেছিলাম ওর আর বিয়েই হবে না।”

সবাই হেঁসে উঠল, সমুদ্র কটমট করে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে আছে। এর মাঝে একজন বন্ধু বলল,
– “তাহলে সমুদ্রও এইবার থেকে আমাদের দলে!”

সমুদ্র বুঝল না, ভ্রু কুঁচকে বলল,
– “কোন দল? কিসের দল?”

পাশ থেকে একজন কলিগ বললেন,
– “ভাই সদ্য বিয়ে করেছ এখন বুঝবে না। যখন বউ কি জিনিস বুঝবে তখন দলের কথা বুঝবে।”

সবটা সমুদ্রের মাথার উপর দিয়ে গেল। ওনার কথা কিছুই বুঝল না।

– “তোমরা কি বলছ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। একটু ক্লিয়ার করে বলো।”

আরেকজন কলিগ বললেন,
– “ভাই সমুদ্র আমরা কেউই বিয়ে করে হ্যাপি না, মানে বিবাহিত মানুষদের জীবনে একটা না একটা ঝামেলা লেগেই আছে।”

সমুদ্র প্রশ্ন করল,
– “কেমন?”

পাশ থেকে সমুদ্রের একজন বন্ধু বলল,
– “যেমন দ্যাখ বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বেবি। তারপর বেবির লালন-পালন, বউয়ের শখ মেটানো, ফ্যামিলি সবকিছুর মাঝে আমরা ছেলেরা চ্যাপ্টা হয়ে যায়।”
– “আর বিয়ের পর বউয়ের তো আরেক রূপ দেখি, একটু কিছু হলেই সন্দেহ, চেঁচামেচি সব মিলিয়ে আমরা সবাই অতিষ্ঠ ভাই।”

সবার মুখে একই কথা শুনে সমুদ্র কাঁদো কাঁদো ফেস করে বলল,
– “তাহলে তোমরা আমাকে বিয়ের জন্য এত ক্ষ্যাপাতে কেন? আমি তো এমনিই ভালো ছিলাম।”

অয়ন সমুদ্রের পিঠ চাপড়ে বলল,
– “ভাই তোর ভালো ওদের সহ্য হতো না, তাই বিয়ের জন্য এত ক্ষ্যাপাতো।”
– “ভাই এখন কি হবে?”

অয়ন আশ্বাস দিয়ে বলল,
– “চিন্তা করিস না। বিয়ে তো করেই ফেলেছিস আর কি করবি। আর তাছাড়া রাশি খুব ভালো মেয়ে, দেখবি তোরা হ্যাপি কাপল হবি।”

ওদের মধ্যে থেকে একজন মধ্যবয়স্ক কলিগ বললেন,
– “সবার সবকিছুর সাথে আমিও একমত। তবে আমাদের বউরাও কিন্তু কম কিছু সহ্য করে না।বিয়ের পর আদরের দুলালী থেকে চাকরানির হয়ে যায়, বছর না ঘুরতে ঘুরতেই বেবি তারপর তাকে সামলাতে সামলাতে নিজেকেই ভুলে যায়। অথচ এই মেয়েটাই একদিন নিজেকে নিয়ে কত ব্যস্ত থাকত, আমাদের সংসারে আসার পর সবকিছুই বিসর্জন দিয়ে দিয়েছে। আমরা যেমন অফিসের কাজ সামলে বিরক্ত হয়ে থাকি ঠিক তেমনি ওরাও ঘরের কাজ সামলে বিরক্ত হয়ে থাকে। একটু কিছু হলে রিয়াক্ট করে ফেলে।‌ তাই আমরা যদি নিজেদের ওয়াইফের সাথে একটু মানিয়ে থাকতে পারি তাহলে আমাদের সংসার সবথেকে সুখের হবে। কারন মেয়েরা যতটা পায় তার থেকে বেশি ফেরত দেয়। আমরা একটু ভালোবাসা, সম্মান দিলে ওরা আমাদের সুখ, শান্তি সবকিছুই দেবে।”

ওনার কথা শুনে সবাই নিজেদের ভুলটা বুঝতে পারল, এইবার শুধু শুধরে নেবার পালা। অয়ন সবাইকে নিয়ে খাবার সাইডে চলে গেল, যাবার আগে অয়ন বলল,
– “ভাই এতদিন বিবাহ অভিযান করছিলিস এইবার সুখের সংসার অভিযান কর।”

সমুদ্র মাথা চুলকে নিজের মনেই বিরবির করল,
– “বিবাহ অভিযান জানি কিন্তু সুখের সংসার অভিযান! সেইটা আবার কি?”

||সমাপ্ত||