বিষাদময় প্রহর পর্ব-০১

0
1389

#বিষাদময়_প্রহর
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| সূচনা পর্ব ||

—“জান তুমি এতো কিউট কেন? মন চাচ্ছে এখনই তোমায় গিলে ফেলি উফফফ!!”
হাতের মেহেদী ফু দিয়ে শুকানোর চেষ্টা করছিলাম,
আচমকা এমন কথা কানে আসতেই থতমত খেয়ে চোখ বড় বড় করে পিছে ফিরলাম।
পিছে ফিরে দেখি নিহান ভাই কিছুটা দুরত্ব বজায় রেখে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে কিন্তু তখনকার মতো চেঁচিয়ে না।
আমি কনফিউশনে পরে গেলাম এই ভেবে নিহান ভাই এগুলো কাকে বললো?
এখনো আমার গলা শুকিয়ে আসছে।
আচ্ছা নিহান ভাই তো ফোনে কথা বলছে, এর মানে কি সে ফোনের ওপাশে থাকা মানুষটাকে বললো?
কিন্তু আমি যতোদূর জানি নিহান ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড নেই।
না আর ভাবতে পারছি না।
সোজা নিহান ভাইয়ার সামনে গিয়েই দাঁড়ালাম।
ভাইয়া ফোনে কথা বলতে বলতেই আমার দিকে তাকালো।
কিন্তু সে কি কোনোদিন আমার দিকে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকাতে পারে?
একদম না! প্রতিবারের মতোই রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।
আমি প্রথমে কিছু বললাম না কারণ সে কথা বলছে, যতোই হোক নেতা বলে কথা জরুরি কলও হতে পারে।
নিহান ভাইয়া পরে কথা বলছি বলে ফোন পকেটে রাখলো।
তারপর আমার দিকে একই দৃষ্টি দিয়ে বলে,

—“কি সমস্যা! সঙয়ের মতোন এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?”

—“তুমি জান বললা কাকে?”

—“হোয়াট! আমি আবার কাকে এসব বলবো?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো নিহান যেন সে কিছুই জানে না।

—“আমি স্পষ্ট শুনেছি তুমিই বলেছো।”

—“খাবি এক চড়! জেগে জেগে এতো স্বপ্ন দেখলে বেশিই শুনবি। আমি আবার কাকে বলবো এসব? আজাইরা! যা এখান থেকে, শুধু শুধু আলতু ফালতু বকবক ছাড়া কিছু পারিস না? নাহিদার কাছে যা এখানে কি তোর?” ধমক দিয়ে কথাগুলো বললো নিহান ভাইয়া।
নিহান ভাইয়ার ধমকে আমার বাঘের মতো সাবাসী যেন ফুস হয়ে গেলো।
মাথা নিচু করে হাতদুটো ধুঁতে আগে ওয়াশরুমে চলে গেলাম।
আজ নাহিদার জম্মদিন।
নাহিদা নিহান এবং নিবিড় ভাইয়ার একমাত্র আদরের বোন এবং আমার বেস্টি।
নাহিদাদের সাথে আমাদের ঠিক কি সম্পর্ক তা আমি ঠিক বুঝিনা তবে এইটুকু জানি আমার বাবা আর নিহান ভাইয়ার বাবা নাকি কাছের বন্ধু ছিলো।
যাইহোক আগে আমার পরিচয় দিচ্ছি।
আমি নাফিহা শিফা। নাহিদা এবং আমার নাম প্রায় একই রকম। মা এবং ছোট বোনকে নিয়েই আমার পরিবার। আমি অনার্স ৩য় বর্ষে পড়ছি। ছোট বোন জিনিয়া এবার এসএসসি দিবে। আর আমার বাবা ছিলেন একজন মাফিয়া। তিনি বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে তা নিয়ে আমি কনফিউজড।
আমার হিসাবে তিনি মারা গেছেন, যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে এতো বছরে একবার হলেও খবর নিতেন, সে যাইহোক আমি তাকে মৃত ভেবেই বড় হয়েছি।
বাবার প্রতি রয়েছে আমার চাপা ক্ষোভ যা আমি কাউকেই বুঝতে দেইনা।

আর নিহান ভাইয়া! উনি নাহিদার বড় ভাই। সেই সুবাধে মা আমাকে তাকে ভাইয়া বলে ডাকতে বলেছে।
নিহান ভাই একজন পলিটিশিয়ান। তাই তার ভাব-গতি কেমন হতে পারে তা নাহয় না-ই বা বললাম।
লম্বা, ফিটফাট দেখতেও মাহশাআল্লাহ।
কিন্তু ওই যে একটাই সমস্যা, এর রাগ সবসময় নাকের ডগায় ডগায় থাকে আর যেকোনো মুহূর্তেই বোম ফাটাবে।
আমি বুঝিনা এই পলিটিশিয়ানদের আই মিন নিহান ভাইটার এতো রাগ কই থেকে আসে? আমার সাথে তার আচরণ তো মাহশাআল্লাহ সবসময় ধমকের উপর রাখবে। এই কর, সেই কর, চুল কর অসহ্য!
দেখলেন না কিছুক্ষণ আগের কাহিনি।
তবে নিবিড় ভাইয়া ভালো আছে। উনি নিহান ভাইয়ার ছোট, ডিগ্রির পড়াশোনা প্রায় শেষ বললেই চলে।
এবার ফাইলান ইক্সাম দিচ্ছে উনি।
আর নাহিদা! সে আমার কলিজার টুকরা বেস্টু।
আমি আর সে একই ভার্সিটির একই ডিপার্টমেন্টে পড়ছি। ওদের পরিবারের সাথে আমাদের বেশ ভাব আছে।

ওয়াশরুমে গিয়ে হাত ভালোভাবে ধুয়ে টিস্যু দিয়ে ভেজা হাতজোড়া মুছে নিলাম।
জম্মদিনে কোন এলিয়েন মেহেদি দেয় বুঝিনা বাবা।
বুঝলাম নাহিদার মাথায় ভূত চেপেছে তাই মেহেদী ডিজাইনারকে দিয়ে মেহেদী দেওয়াইসে তাই বলে আমাকে এসবের মাঝে টানবে কেন অদ্ভুত!
মেহেদী দিয়েছে তো দিয়েছেই এতো গর্জিয়াস!
আমার হাতের এক বিন্দু জায়গা খালি রাখলো না!!
হলরুমে চলে আসলাম।
হলরুমে অনেক অনেক মানুষ।
হবারই কথা, যতোই হোক নেতার একমাত্র বোনের জম্মদিন বলে কথা।
তাই সবকিছুই একটু বেশি বেশি।
প্রেসের লোকজনরাও আছে সাথে আরও কতো নামী নামী মানুষজন!
এসব বরাবরই বিরক্ত লাগে আমার তবুও কিছু করার নেই। একাকীত্ব কাটাতে এই মুহূর্তে আমার হিদকে প্রয়োজন।
তাই এই ভেজালের মাঝেই তাকে খুঁজে চলেছি।
মা আর জিনিয়াটাও আসেনি।
জিনিয়ার নাকি কাল পরীক্ষা আছে আর মাও নাকি কিছুটা অসুস্থবোধ করছে।
কিন্তু আমার তো কোনোটাই নেই তাই আমাকেই আসতে হলো।
কেন যে এলাম এখানে ভাবতেই রাগ লাগছে।
আজ আবার ওই সিংহটায় আমাকে ধমকাইসে।
এরে কি জম্মের পর মধু খাওয়ায় নাই? এতো কিসের দাপট তার যত্তোসব!

এসব ভাবতে ভাবতেই নাহিদাকে পেয়ে গেলাম।
নাহিদার সাথে অনেকক্ষণ কথা বললাম।
শেষে খেয়ে দেয়ে তাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে চলে এসেছি।
ভাগ্যিস নিহান ভাইয়া অথবা নিবিড় ভাইয়া আশেপাশে ছিলো না। নয়তো দুজনের যেকোনো একজনই আমাকে বাসায় রেখে আসতো কিন্তু আমি তা একদমই চাইনা।
নিবিড় ভাইয়াকে খারাপ লাগে না কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম ওই নেতাসাহেব আরেকদফা বকাঝকা করবে।

এসব ভাবতে ভাবতেই হেঁটে চলেছি। রাত আনুমানিক ১২টা ১৫ এর মতো বাজছে।
বেরিয়েছি ১১টার দিকে। সিএনজি বা টেক্সি কোনোটাই পেলাম না তাই আর কি করার হেঁটেই যাচ্ছি।
এই সিএনজির চক্করে আমার ১ ঘন্টা ভোগে চলে গেলো।
কাল আবার ক্লাস তারপর টিউশন।
বাসায় পৌঁছাতে আরও ১৫ মিনিটের মতো লাগবে।
চারপাশে শুনশান নিরবতা।
দূর-দূরান্তে কোনো কাকপক্ষীও নেই।
কিছুক্ষণ পরপর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে।
ল্যাম্পপোস্টের কৃত্রিম আলোতে রাস্তাটা কেমন হলদেটে রূপ ধারণ করেছে।
কিছুক্ষণ পরপর ভোঁ ভোঁ করে কয়েকটা প্রাইভেট কার বা ট্রাক চলে যাচ্ছে।
চারপাশে তাকাতে তাকাতে হাঁটছিলাম হুট করে কেমন মুশলধারে বৃষ্টি নেমে যায়।
জলদি করে নিজের সাইড ব্যাগটা মাথায় দিয়ে দৌড়ে একটা দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম।
যা বৃষ্টি পরছে ২ মিনিটেই কাঁকভেজা হয়ে যাবো।
আর এখন তো প্রায় অর্ধেক ভিঁজেই গিয়েছি।
জলদি করে ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে মাথা মুছতে লাগলাম।
বৃষ্টিতে ভিঁজলে আমার এমনিতেই জ্বর বাঁধে।
আর এখন জ্বর বাঁধাতেও চাইনা।
এই মাসের মাঝের দিকে এমন জ্বর গেছে বিছানা থেকে উঠতে পারিনি সাথে আমার টিউশন আর ক্লাসগুলাও মিস গেছে।
আমি চাইনা আর মিস হোক।
টিউশনি করে সংসার চালানোর চেষ্টা করি কিন্তু মাস শেষে কে যে মোটা অংকের টাকা পাঠায় আমার অজানা।
তবে আমি মাকে ভুলেও সেই টাকা খরচ করতে দেইনা।
আমার ভার্সিটি আর জিনিয়ার স্কুল ফিও কে যেন পে করে দেয়।
আমি জানিনা কে এমন দয়া দেখাচ্ছে আমাদের উপর। এই অজানা লোককে পেলে আমি আমার এবং জিনিয়ার ফিয়ের টাকাটাসহ এতোদিনের পাঠানো সব টাকা ফেরত দিয়ে দিবো।
আমি চাইনা আমি বা আমার পরিবার কারো দয়ায় বেঁচে থাকুক।
তাই কষ্ট করে হলেও নিজে কয়েকটা টিউশনি করে সংসার চালাই। মা এতে প্রচুর বিরক্তিবোধ এবং চটে যায়।
আমার ভাবনার মাঝেই এই বৃষ্টিতেই কোথা থেকে এক লোক এসে আমার গোলা চেপে ধরলো।
আমি চোখ বড় বড় করে লোকটির দিকে তাকালাম। লোকটির মুখমন্ডল দেখতে পারছি না তার কালো মুখোশটার জন্য।
ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে নাফিহা। তার দম যেনো আটকে আছে। সামনে থাকা লোকটা যেন আজ তাকে গলা টিপে মেরেই দম নিবে। নাফিহা কাশছে অনবরত এবং এই মুখোশধারী লোকের হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। বৃষ্টিতে ভিজে ছিপছিপে হয়ে গেছে নাফিহা। ভিজে রীতিমতো কাঁপছে নাফিহা আর সেখানে তার সামনে থাকা লোকটি শক্ত করে তার গলা টিপে ধরেছে।

শেষে নাফিহা নিজেকে ছাড়াতে না পেরে লোকটির পশ্চাৎ দেশে দিলো কষে লাথি।
লোকটি সাথে সাথে আউচ করে সরে গেলো।
আমি গলায় হাত দিয়ে কাশতে কাশতে বসে পরলাম।
অতিরিক্ত ভেঁজার ফলে তার সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে।
মাথাও যেন প্রচন্ডরকম ব্যথা করছে এবং ঘুরছে।
আমি পারছি না এখান থেকে ছুটে পালাতে, বলা যায় সেই শক্তিটাই পাচ্ছিনা।
লোকটি ল্যাঙড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে আবার আমার দিকে এগোচ্ছে।
আধো আধো চোখ মেলে শুধু এইটুকুই দেখতে পারছি।
হুট করে কে যেন তার পিছে থেকে লোকটাকে ছুড়িকাঘাত করে! এমনকি গলায়ও কয়েকটা টান দেয়।
লোকটির আর্তচিৎকার আমার কান অব্দি পৌঁছালো।
সেই বিভৎস দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে তৎক্ষনাৎ জ্ঞান হারালাম।
এরপর কিছু মনে নেই।

চলবে!!!