বৃষ্টিবিলাস পর্ব-২৪

0
620

#বৃষ্টিবিলাস
২৪.
#writer_Mousumi_Akter

–ক্লান্ত মনে বাসের সিটে মাথা এলিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ চোখের পানি ফেলছে রোজা।চাইলেই কি পারবে তার জীবনের এই মুহুর্ত গুলো ভুলতে।পারবে কি শুভর ভালবাসা ভুলতে।হোক না সেটা মিথ্যা আর অভিনয়ে ঘেরা তবুও তো ভালবাসা ছিলো রোজার কাছে।সেকেন্ডে সেকেন্ডে শুভর মৃদু হাসি ভেষে উঠছে রোজার মন আর মস্তিষ্কে।এ কদিনে যেনো হাজার বছরের স্মৃতি জড়িয়েছে শুভর সাথে রোজা।মন জ্বলছে, পুড়ছে, দম বন্ধ হয়ে আসছে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে রোজার।বারবার মাথা নাড়া চাড়া দিয়ে ভুলতে চেষ্টা করছে শুভকে আর শুভর সাথে জড়ানো স্মৃতিগুলো।চোখ দুটো রক্তজবার মতো হয়ে আছে রোজার।কিছুতেই শুভকে ভোলা সম্ভব নয়।এক্ষুণি মন চাইছে এই যন্ত্রণা ভুলতে মৃ*ত্যুকে আলিঙ্গন করতে।কিন্তু সেটা করলে ভীষণ স্বার্থপরের মতো কাজ হবে তার বাবার সাথে।রোজার বাবা মেয়েকে প্রাণের অধিক ভালবাসেন।জীবনে একটা ভুল করেছেন রোজার বিয়ের ব্যাপারে এটা রোজার ধারনা।যে মানুষ টা খাইয়ে পরিয়ে সব চাহিদা পূরণ করে বড় করেছে তার সামনে নিজেকে শেষ করে তার জীবন টা মৃ*ত্যু যন্ত্রণার মতো ভয়াবহ করতে চায়না রোজা।যে ভালবাসে না তার জন্য জীবন দিয়ে যে মানুষ গুলো তাকে ভালবাসে তাদের কষ্ট দিতে চায় না রোজা।রোজার বাবার রোজা ছাড়া কেউ নেই।সে ম*রে গেলে কি হবে তার বাবার।এমনিতেই বাবাকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে সে।পৃথিবীর মানুষ গুলো যদি ভেবে থাকে কেউ ঠকানোর পরেও সুই*সাইড করে নি বলে রোজার যন্ত্রণা কম হচ্ছে, ভালবাসা কম ছিলো তাতে রোজার কিছুই যায় আসেনা।রোজা নিজের ভালবাসা মানুষের কাছে প্রমান করতে ইচ্ছুক নয়।ভালবাসা টাও একান্ত তার ছিলো কষ্ট গুলো ও একান্ত তার।বাবা নামক প্রাপ্তির মানুষ টা কম গুরুত্বপূর্ণ না রোজার কাছে।জীবনের সব থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। এই বাবা না থাকলে হয়তো আজ চলন্ত কোনো গাড়ির নিচে পড়ে আত্মব*লি দিতো রোজা।এই কষ্ট ভীষণ কষ্ট,ঠকে যাওয়ার মতো কষ্ট নেই।পথ ফুরাচ্ছে না রোজার।আজ যেনো পথ অনেক বেড়ে গিয়েছে ড্রাইভার যেনো গাড়ি চালাচ্ছেই না।এখুনি কেউ তাকে উড়িয়ে তার বাবার কাছে নিয়ে গেলে ভীষণ খুশী হতো রোজা।অঝরে ঝরা অশ্রু কি কখনো থামবে রোজার চোখে।

–শুভর দেওয়া সমস্ত জিনিস রেখে রোজা চলে গিয়েছে।শুকানো ডালিয়া ফুল টাও রেখে গিয়েছে।শুভ রোজার সমস্ত কাপড় গুছিয়ে রওনা হলো।টেনশনে বারবার নিজের ঠোঁট ভেজাচ্ছে শুভ।বাস স্ট্যান্ডে গিয়েও রোজাকে খুজে পায় নি রোজাকে।শুভ ভীষণ টেনশন করছে রোজার কোনো ক্ষয়-ক্ষতি না হয়। রোজার ভুল না ভাঙানো পর্যন্ত শুভর এই উত্তেজনা যন্ত্রণা কমবে না।নিশ্চয়ই রোজা সব টা শুনে তাকে খুশিতে জড়িয়ে ধরবে।শুভর পুরো জীবন টা রোজার ভাবনা ভেবেই কেটেছে।আজ স্বপ্নের এত কাছাকাছি এসেও সব টা নষ্ট হতে দিবেনা।রোজা হয়তো অভিমানে বাবার পছন্দের সেই বুড়ো লোক কে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাবে।কিন্তু বরের জায়গা আমাকে দেখে খুশিতে পা*গল হয়ে যাবে।শুভ সব পজিটিভ ই ভেবে যাচ্ছে।তবুও যন্ত্রণা কমছে না কিছুতেই।ভালবাসার মানুষ টা ভুল বোঝার মতো যন্ত্রণা কি পৃথিবীর আর কোথাও আছে।এই যন্ত্রণা ভীষণ ভালবাসা একজন প্রেমিক ই ভালো জানে।শুভ ভাড়ার বাইকে রওনা হলো প্রিয়তমার শহরে।

–একের পর সিগারেট টানছে রাজ।জীবন টা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে আজ সিগারেট হাতে করতে বাধ্য হয়েছে রাজ।বুকের ভিতর রোজা নামক অনুভূতি ভয়ানক আকারে ধারণ করেছে তার।এই অনুভূতি কিছুতেই মুছতে পারছে না রাজ।আসলেই কি সম্ভব।কাউকে প্রচন্ড ভালবেসে ফেলার পর তার সাথে গড়ে ওঠা কতগুলো স্মৃতি চাইলেই কি মুছে ফেলা সম্ভব।দরজায় ঘুষি মেরে হাত কেটে কতখানি র*ক্ত বেরিয়েছে রাজের সেদিকে খেয়াল নেই রাজের।মনের যন্ত্রণা তীব্র হওয়ায় হাতের যন্ত্রণা অনুভব ই হচ্ছেনা।আজ যদি শুভর ভালবাসা না হতো রাজ যেকোনো কিছুর বিনিময়ে রোজাকে তার করেই নিতো। রোজার প্রতি রাজের তীব্র ভালবাসা কখনো প্রকাশ করা সম্ভব নয়।রাজ নিজেও জানে সে শুভর থেকে বেশী ভালবাসতে পারেনি কেননা সেই ছোটবেলার ভালবাসা শুভর।তাছাড়া শুভ তার বন্ধু নয় ভাই।শুভ যদি জানে রাজ রোজাকে ভালবাসে নিজেকে শে*ষ করে দিবে।এমন দো’টানার জীবনে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে রাজের।অশ্রুভেজা চোখে নিজের ফোন টা নিয়ে শুভর ছবি বের করে শুভর সাথে কথা বলছে রাজ।শুনেছি মানুষ নাকি ভালবাসার জন্য বন্ধুত্বে বেঈমানি করে।কিন্তু না শুভ আমি আমাদের বন্ধুত্বের অমর্জাদা করতে দিবোনা।আমাদের বন্ধুত্ব পৃথিবীর সব থেকে বেষ্ট ছিলো আছে থাকবে।আমি প্রমান করে দিবো বন্ধুত্বের বাইরে কিসের ভালবাসা।কিসব ভালবাসার কথা ভাবছি।তোকে কষ্ট দিয়ে কি আমি ভালো থাকতে পারবো ভাই।রোজা নামক এই অজান্তে গড়ে ওঠা ভালবাসার কথা আমি আর ভুলেও মনে করবো না শুভ।সরি ইয়ার ভেরি সরি।

রাজের আম্মা রাজের রুমে এসে চেঁচিয়ে ওঠেন র*ক্ত দেখে।সোহানা এগিয়ে এসে বলে একি রাজ কি হয়েছে তোমার।রাজ কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে যায়।রোজার না বলে চলে যাওয়া, শুভর হঠাত চলে যাওয়া, রাজের এমন ব্যবহারে বাড়ির সবাই কিছু না কিছু বুঝতে পারছে।রাজদের ফ্যামিলির হাসি আনন্দ সব বন্ধ হয়ে গেলো।

–প্রায় মধ্যরাতে রাজ বাসায় এসে সোজা নিজের আম্মার ঘরে প্রবেশ করলো।রাজের আম্মা তখন ও জেগে রাজের জন্য।রাজ এসেই মায়ের পায়ের উপর মাথা রেখে বাচ্চাদের মতো কাঁদছে।

–আম্মু তোমার কাছে এসছি একটু কাঁদার জন্য।ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আম্মু।আমি তোমাকে বলেছিলাম রোজাকে তোমার বউমা বানাতে চাই।কিন্তু সেটা সম্ভব নয়।

–ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে রাজের আম্মা বললো,কি হয়েছে সোনা।

–আম্মু রোজা সেই মেয়ে যার সাথে শুভর বিয়ে ঠিক হয়েছে।শুভ আর রোজা দুজন দুজন কে ভালবাসে।আমি জানতাম না আম্মু।জানলে কখনো রোজাকে ভালবাসতাম না।

–কাঁদিস না সোনা।সব ঠিক হয়ে যাবে সময়ের সাথে সাথে।রাজের আম্মার ও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ছেলের জন্য।শুভ ও তার ছেলের মতো।এক ছেলের জন্য অন্য ছেলেকে কিভাবে সে কষ্ট দিবে।সোহানার থেকে সব ঘটনা শুনেছেন বলে রাজ কে আর প্রশ্ন করলো না।

–আম্মু আমাকেই সব ঠিক করতে হবে।আজ আমার ভুলের জন্য শুভ আর রোজার মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিনা।

–তুমি তো ইচ্ছা করে কিছু করোনি সোনা।আমরা অহনার বিয়েতে কাল ই ঢাকা যাচ্ছি।সেখানে গিয়ে রোজাকে সব টা বুঝিয়ে বলবো।

রাতেই সোহানা সব ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছে।

মধ্যরাতে রোজা নিজের বাড়িতে এসে পৌছালো।বাড়ির কলিংবেল কয়েকবার চাপতেই রোজার বাবা চোখে সাদা ফ্রেমের চশমা পরে বেরিয়ে এসে দরজা খুললেন।দরজা খুলেই চমকে গেলেন।নিজের মেয়েকে এভাবে দেখবে ভাবতেই পারে নি রোজার বাবা।বাবাকে দেখেই বাবার পায়ের নিচে পড়ে পা জড়িয়ে ধরলো রোজা।হাউ মাউ করে কেঁদে বললো,আমাকে ক্ষমা করে দাও বাবা।আমি ভুল করে ফেলেছি বাবা। আমাকে শাস্তি দিতে চাইলে দাও বাবা।যার সাথে ইচ্ছা তুমি বিয়ে দাও বাবা।আমি আর আপত্তি করবো না।রোজার বাবার চোখে পানি।একমাত্র মেয়েকে হন্য হয়ে খুজেছিলো এতদিন। মেয়ে ছাড়া ভীষণ অসহায় হয়ে পড়েছিলো রোজার বাবা।মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন মা তুমি এসেছো, আমার কি তুমি ছাড়া কেউ আছে।তুমি আমাকে ছেড়ে গেলে একটা বার ভাবলে না আমার কি হবে।

‘রোজা আরো জোরে কেঁদে বললো,সরি বাবা, আমি ভীষণ অন্যায় করে ফেলেছি।তুমি যা বলবে তাই হবে বাবা।’

“রোজার বাবা বললেন,ভুল আমার ই ছিলো মা।আমি একটা খারাপ ফ্যামিলিতে তোমার বিয়ে ঠিক করেছিলাম।তুমি চলে যাওয়াতে ওরা অনেক বাজে কথা বলেছে।শুধু বাজে কথা বলেছে এমন নয় আরো সাংঘাতিক একটা কাজ করেছে যেটা এক্ষুনি বলতে চাইছি না।’

‘বলবেই তো বাবা।যার মেয়ে পালিয়ে যায় তার বাবাকে তো অপমান হতেই হয়।সব আমার জন্য বাবা।আমি খুব খারাপ মেয়ে।”

‘মা আমার মাথায় হাত রেখে কথা দাও আর কখনো আমার অনুমতি ছাড়া কোথাও যাবেনা।’

‘রোজা বাবার মাথায় হাত রেখে কথা দিলো আর কখনো তার বাবার অনুমতি ছাড়া কোথাও যাবেনা।’

সেদিন সারারাত বাবা মেয়ে মিলে গল্প করলো।অনেক মান অভিমান আর দুঃখ-কষ্টের গল্প করলো।

সে রাতে শুভ ও বাসায় পৌছালো।

চলবে…??