বৃষ্টিবিলাস পর্ব-৩৭

0
427

#বৃষ্টিবিলাস
৩৭.
#writer_Mousumi_Akter

নিজের ঘরে মাথায় হাত ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে সুয়ে আছেন ইকবল আহমেদ।রোজা ছুটে গেলো নিজের বাবার ঘরে।মেয়েকে অস্হির দেখেই ইকবল আহমেদ বললেন,কি হয়েছে রে মা।

রোজা বাবার পায়ের কাছে বসে কেঁদে দিলো।

“বাবা শুভ হসপিটালে।ও খুব অসুস্থ বাবা।আমি একবার শুভকে দেখতে চাই বাবা।শুভ অসুস্থ অবস্থায় কোনো মেডিসিন নিচ্ছে না,আমি না গেলে ও ম*রে যাবে।শুভ অনেক অসুস্থ বাবা।আমাকে একবার অনুমতি দাও বাবা।তুমি অনুমতি না দিলে আমি যাবোনা।তবে ওর কিছু হয়ে গেলে আমিও ম*রে যাবো।শুভ আমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছে আমি যায় নি বাবা,কারণ একবার বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আমি ভুল করেছিলাম তোমাকে আর কষ্ট দিতে চায় না আমি বাবা।শুভ রোদ নেই, বৃষ্টি নেই জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়ে থাকে আমিও দেখেও যায় না কখনো ওর কাছে।কিন্তু বাবা আমার নিজের ভীষণ কষ্ট হয়।তুমিতো ছোটবেলা থেকে মা না থাকার জন্য বন্ধুর মতো মিশেছো আমার সাথে।তুমি কি আমাকে দেখে বোঝোনা বাবা আমি কি চায়।আমি ভালো নেই বাবা।আমাকে একবার অনুমতি দাও বাবা তুমি প্লিজ।”

কিন্তু শুভর বাবার করা অপমান যে আমি ভুলতে পারছি না।

কেনো পারছোনা বাবা।শুভ তো আর তোমাকে কোনদিন কিছু বলেনি।কিন্তু আমি শুভর বাবাকে অপমান করেছিলাম।বিয়ের আসর ছেড়ে তো শুভ পালায় নি আমি পালিয়েছিলাম।ওরা যদি আমাকে ক্ষমা করে নিতে পারে তুমি কেনো পারবেনা বাবা ওদের ক্ষমা করতে।জানো বাবা কাকি আমাকে সেদিন শুভর বাবার ছবি দেখিয়েছিলো শুভর ছবি দেখায় নি।আমি সেটা দেখে রাগে শুভর বাবাকে ফোনে বাজে কথা বলেছিলাম।তাছাড়া তুমি নাকি অনেক গুলো টাকা ও নিয়েছিলে শুভর বাবার থেকে আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য।কাকি আমাকে বলেছিলো আমি যেনো এই বিয়ে না করি।এই বয়সী লোকেরা টাকা দিয়ে আমার মতো কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের নামে কিনে নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করে।আমি বলেছিলাম বাবার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলি কাকি বলেছিলো সকালে ভোরেই ওই লোক আসবে আর আমাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হবে।কাকি নিজে টাকা দিয়েছিলো আমাকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য।উনাদের কোনো দোষ নেই বাবা।উনারা তো সত্যি ভীষণ ভালো বাবা।কি দোষ তুমি ভেবে দেখো বাবা।তাছাড়া প্রেস মিডিয়ার লোকজন কে কাকি উস্কিয়ে নিউজ করতে বলেছিলো মান সম্মান বাঁচাতে শুভর বাবা অহনার সাথে বিয়ে ঠিক করেন।তবে বিয়ের প্রস্তাব ও কাকিই আগে দিয়েছিলো।বলো বাবা ওদের কি দোষ আর আমার কি দোষ। ”

ইকবল আহমেদ উঠে বসলেন আর বললেন,

এতকিছু হয়ে গেলো কিছুই জানতে পারলাম না।তুই যা মা শুভর কাছে।আমিও আসছি বাড়িতে একটু কাজ আছে সেটা করে আসছি।যা মা যা।

রোজা হেসে দিয়ে বললো,

সত্যি যাবো?

হ্যাঁ মা সত্যি যাও,সাবধানে যেও।

রোজা ড্রেস টা চেঞ্জ করে নিয়ে ছুটতে ছুটতে হসপিটাল গেলো।রাস্তাটা কি আজ বেশী লম্বা হয়ে গিয়েছে, পথ ই শেষ হচ্ছেনা।ঘন্টা খানেক পরে রোজা হসপিটালে পৌছালো।হসপিটালের বেডে সুয়ে আছে শুভ।পাশে ওর আম্মু বসে আছে।বাইরে আতিকুল আহমেদ ছোটাছুটি করছেন।রোজাকে দেখেই খুশিতে এগিয়ে গেলেন আতিকুল আহমেদ।রোজার হাত ধরে বললেন,মা আমাকে ক্ষমা করে দিও তুমি।তোমার কাকি এত খারাপ আগে বুঝতে পারিনি।তুমি তো আমার মেয়ের মতোই ক্ষমা করেছো তো আমাকে।রোজা হেসে বললো,বাবা পুরনো কথা ভুলে যায় আমরা।আতিকুল আহমেদ হেসে বললেন,
যাও মা শুভর কাছে।রোজা কেবিনের দরজা খুলতেই শুভর মা খুশিতে আত্মহারা।রোজাকে বললো,মামনি এসেছো তুমি।রোজা একটু লাজুক ভাবে বললো জ্বী আন্টি।অন্তরা আহমেদ বললেন,আবার আন্টি মা ডাক শুনতে চাই। রোজা হেসে দিলো।অন্তরা আহমেদ বললো,দেখো না খেয়ে রোজ ভিজে ভিজে কি অবস্হা করেছে নিজের।রোজা শুভর পাশে বসলো।অন্তরা আহমেদ ওদের কথা বলার সুযোগ করতে বাইরে বেরিয়ে গেলেন।

–রোজা শুভর হাত ধরে বললো,শুভ আমি এসেছি।

শুভ আস্তে করে চোখ খুললো।ঝাপসা থেকে রোজার মুখটা এবার স্পষ্ট হলো।

আবার কি চলে যাবে রোজা?

না শুভ আর যাবো না।

আমাকে ছুঁয়ে বলো।

রোজা শুভর কপালে ঠোঁট ছুইয়ে চুমু দিয়ে বললো,

আর কোনদিন কোথাও যাবো না তোমাকে ছেড়ে।

ইকবল আহমেদ বাড়িতে রীনা পারভীন এর সাথে তুমুল অশান্তি পাকিয়ে বাড়িঘর,সম্পত্তি যা ছিলো সব আলাদা করে ফেললেন।রীণা পারভীন এর সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে বাড়ির ঘর ভাগ করে আসলেন।জীবনে এত রাগ ইকবল আহমেদ কোনদিন ই করেন নি।

হসপিটালে ইকবল আহমেদ এসে আতিকুল আহমেদ এর কাছে ভীষণ অনুতপ্ত হলেন।অনেক অশান্তির পরে সব কিছু যেনো ঠিক হলো।
সাত দিন পরে শুভ সুস্থ হলেই ওদের বিয়ে হবে এমন ই কথা হলো।
———————————————————
নড়াইল এ অহনাকে পেয়ে ভীষণ খুশি সোহানা নোমানসহ রাজের আম্মা।রাজের আম্মা ছেলের বউকে সমস্ত গহনা দিয়ে বরণ করলেন। এই পরিবারে এসে সবার ভালবাসা পেয়ে মুগ্ধ অহনা।মানুষ এতটাও ভালো হতে পারে।রাজ অভিনয় করে হলেও সত্যি সত্যি সবার সামনে স্বামির অভিনয় করছে।যেটা অহনার কাছে ভীষণ ভালো লাগছে।বাইরে গেলেই অহনার জন্য কিছু না কিছু না নিয়ে আসছে না।একজন কেয়ারিং হাজবেন্ড এর সব কিছু পূরণ করছে রাজ।একদিন বিকালে রাজ বাইক এক্সি*ডেন্ট করেছে।খবর টা অহনার কানে আসতেই ভীষণ অস্হির হয়ে পড়লো।ধীরে ধীরে রাজের প্রতি মায়া জন্ম নিতে শুরু হয়েছে অহনার রাজের খুব বেশী চোট লাগেনি।বাসার পাশের দুজন রাজ কে ধরে বাসায় নিয়ে এসছে। অহনাকে বলছে ভাবি ভাইকে একটু ঘরে নিয়ে যান।এই মলম টা লাগিয়ে দিবেন পিঠে একটু চোট লেগেছে ঠিক হয়ে যাবে।আরেকজন বললো,ভাবি যে মিষ্টি ভাই তো দেখে দেখেই সুস্থ হয়ে যাবে।এইসব ছোট ছোট জিনিস গুলো অহনার মনে ভাল লাগার দোলা দিচ্ছিলো।সেদিন রাজ খাটে সুয়ে আছে খালি গায়ে উপুড় হয়ে।পিঠে ব্যাথা প্রচন্ড।সোহানা ঘরে খাবার দিয়ে বলে গিয়েছে অহনা রাজ কে খাবার টা খাইয়ে দিস।সোহানা চলে গেলে রাজ বললো,

অহনা প্রেসার নিওনা প্লিজ আমি খেয়ে নিচ্ছি।আমি জানি তোমার খারাপ লাগছে মানুষের মুখে ভাবি ডাক শুনতে আবার এসব দায়িত্ব নিতে।

অহনা বললো,আমার ভালো লাগছে এসব।আর কোনো সমস্যা নেই আমি খাইয়ে দিচ্ছি।

অহনার মুখের মিষ্টি হাসিতে রাজ বেশ অবাক হলো।নকল বিয়ের সময় অহনা বলেছিলো এক রকম কিন্তু আস্তে আস্তে সসম্পূর্ণ উল্টো করছে।বাইরে না হয় অভিনয় করছে কিন্তু ভেতরেও কেনো?

অহনা রাজকে খাবার খাইয়ে দিলো পিঠে মলম লাগিয়ে দিলো আলতো পরশে।এই স্পর্শ ভীষণ ভালো লাগছিলো রাজের।রাজের এমন মনে হচ্ছিলো অহনা যেনো তার সত্যি বিবাহিত বউ।সেদিন রাজ নিচে ঘুমোতে গেলেও অহনা নিচে ঘুমোতে দেয় নি কারণ রাজ অসুস্থ। এভাবেই একটা সপ্তাহ কেটে গেলো।

ভালোবাসা আসলেই রং বদলায়।রং বদলে গিয়েছিলো অহনা আর রাজের ভালোবাসার।তাদের দুজনের বেষ্ট ফ্রেন্ডের ভালোবাসা এক করতে গিয়ে দুজনে একটা অভিনয়ের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলো।কিন্তু সেই অভিনয় ধীরে ধীরে সত্যিকারের ভালবাসায় রূপ নিচ্ছিলো।

শুভ সুস্থ হলো।রাজ আর অহনা দুজনেই আবার ঢাকায় ফিরে এলো।রোজা আর শুভর বিয়ের জন্য ঠিক করা হোটেল টা বিশাল আলোকরশ্মিতে সাজানো হলো।চারদিকে আলোতে ঝলমল করছে।শুভ আর রোজার বিয়েটা হয়ে গেলো।খুব অদ্ভুত ব্যাপার রাজ বা অহনা কারোর ই এক বিন্দু খারাপ লাগেনি।বরং রাজ আর অহনা শুভ আর রোজার বিয়ে দেখে নিজেদের বিয়ে নিয়ে কল্পনায় বিভোর ছিলো।শুভর চোখ যেমন রোজার দিক থেকে সরছিলো না তেমনি রাজের চোখ অহনার থেকে সরছিলো না।কত অশান্তি,কত ঝামেলা,কত হৃদয়বিদারক দৃশ্য, কত মন ভাঙার কষ্ট ছিলো তবুও এত কিছুর মাঝে চারজন মানুষের বন্ধুত্ব অটুট রইলো।পূর্ণতা পেলো ভালোবাসা।

চলবে….?