বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ পর্ব-১৬+১৭

0
508

#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ❤️
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন

১৬.
জাতীয় উদ্যানটি ছিলো নামা বাজারের একদম পাশে। আশেপাশের বন জঙ্গল ঘুরে ওরা ট্রলার দিয়ে এসে নেমেছে কমলার চর। অন্যান্য চরের মতোই এই চরটি। শুধু পেছনে রয়েছে এক গভীর বন। বনে অজস্র হরিণের দর্শন পাওয়া যাবে। বনের গভীরে যেতে ইচ্ছে হলোনা কারোরই। তখন ঘড়িতে বাজে সম্ভবত সাড়ে চারটা। এই চরটির আলাদা কোনো বিশেষত্ব নেই। কানায় কানায় ভরপুর সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ পার করে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের সান্নিধ্যে ওরা এসে পৌছালো কমলার চর। কমলার চরে দশ-বিশ মিনিট ঘুরাঘুরি করে ওরা চৌধুরী খালের যাত্রাপথে নামলো ট্রলারে করে।

অসংখ্য আঁকা-বাঁকা পথ, উপড়ে পরে যাওয়া গাছগাছালির আড়ালে নদীর বাকল ধরে ছুটে গেলা ট্রলার। এটা অনেকটা সুন্দরবনের মতো আবার বলার যায় কিছুটা রাতারগুল এর ন্যায়। গাছের প্রতিচ্ছবিতে স্বচ্ছ পানি হয়ে উঠেছে সবুজ রঙের। খয়েরী দেহের সবুজ ডাল-পালার গাছ গুলো সুবিন্যস্ত ভাবে পরে আছে একের উপর আরেক। হাওয়ায় দুলছে টিকলির চুল। টিকলির ঠিক পেছনে কিছুটা দূরত্বে বসে ছিলো আদর। হাওয়ায় দুলানো অগোছালো চুলের ছড়ায় মুখরিত আদরের আত্মমগ্ন মন বলে উঠলো,

“ওই এলোমেলো চুলে
ব্যর্থতা বয়ে যায় নিঃস্ব এই ললাটে।
হঠাৎ সেই বিকেল থমকায়
তখনি সন্ধ্যায় রাতের আধার নেমে যায়।”

এই দফায় আদর নিজের অবাধ্য বেহায়া মনটাকে আর ধমক দিলো না। সেই এলোমেলো চুলের টিকলির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ আকাশের দিকে আনমনা চোখে তাকালো। কটু শব্দ করে উড়ে চলে গেলো ঈগল। দমবন্ধকর উচ্ছ্বাসে মনটাকে বলে উঠলো, ‘তোর কি হয়েছে?’

আদরের মনের থেকে কোনো উত্তর পাওয়া গেলোনা। আদর ধমকালেই কেবল তার মন তর্কে মাতে। অন্যথায় সে কোনোরকম কথা বলেনা। আদর হতাশ হলো আরো একবার। কবিতা লিখা বা ছন্দ মেলানো ছেড়ে দিয়েছে সেই বহুকাল আগে। ছেড়ে দিয়েছে বললে ভুল হবে। বলা যায়, সময়ের অভাবে তারা একা একাই হারিয়ে গেছে। শেষ হয়তো কবিতা আবৃত্তি কিংবা ছন্দ লিখেছিলো ক্লাস টেনে থাকতে। পড়াশোনায় ব্যস্ত আদর আর সময় করে উঠতে পারেনি নিজের জন্য। তাই হয়তো ছন্দেরা অভিমান করে হারিয়ে গিয়েছিলো। অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, অনেক চেষ্টা করেও যাদের এতোদিন ধরে বেধে আনতে পারেনি তারা আচমকাই আজ নিজ থেকে ধরা দিলো। কেনো?
আদরের ভ্রু কুচকে উঠলো। বিকালের লাল রোদ্দুরে ডুবন্ত টিকলির দিকে এক ঝলক তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলো আলগোছে।

,

চৌধুরী খাল ঘুরতে ঘুরতে দিনান্ত বেলায় এসে ডুবি ডুবি সূর্য দেখে আদর তাড়া দিলো মাঝিকে। নিঝুম দ্বীপের পাড়ে এসে ট্রলার থেকে নামতেই নিস্তব্ধ অসুখী টিকলিকে দেখে আচমকা আদর বলল,

‘মন খারাপ?’

টিকলি চকিতেই তাকালো। আদর হাত বাড়িয়ে দিলো টিকলির দিকে। বলল, ‘আসুন। নেমে আসুন।’

আদরের হাতের দিকে তাকিয়ে টিকলির মনে পড়লো নিঝুম দ্বীপ আসার সময় স্পিডবোটের কথা। যখন সে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো কিন্তু আদর উপেক্ষা করে গেছে। আদর আবার বলল, ‘কি হলো আসুন।’

‘দরকার নেই। আমি একা পারবো।’ টিকলির অকপটে জবাব।

আদর জোরালো ভাবেই বলল, ‘আরে আসুন না।’

আদর হাত ধরতে গেলো। টিকলি দূরে সরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি পারবো।’

বলেই একা একা অনেক কষ্টে সে নেমে এলো। আদর পুরোটা দেখলো। তবুও কিছু বলল না। স্পিডবোটে আসার সময়গুলো মস্তিষ্কের আনাগোনায় স্মৃতিচারণ হ
ঘটলো তারও। টিকলি নামার পরেই আদর কিছু বলার জন্য মুখ খুলল। তখনি টিকলি আদরের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘আজ থেকে আপনাদের আর আমাদের দায়িত্ব বহন করতে হবে না।’

আদরের কথা আদরের মুখেই রয়ে গেলো। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো ক্ষণকাল। নিঝুম দ্বীপে পা রাখার সাথে সাথেই আদর বলেছিলো ওদের আলাদা ঘুরতে। নিজের রাস্তা নিজে দেখে নিতে। তাই কি আজ টিকলি এই কথা বলল? আদরের মনের গহীনে কথাগুলো আসতেই সে নিরর্থক গলায় প্রশ্ন করলো,

‘মানে?’

টিকলি তার চশমার আড়ালে থাকা চোখ দুটোকে শক্ত করে স্থবির কন্ঠে বলল, ‘মানে আমরা আর আপনাদের ঘাড়ে বসে থাকবো না। আজ থেকে আপনারা আপনাদের মতোন ঘুরবেন থাকবেন আর আমরা আমাদের মতো।’

কথাগুলো বলেই টিকলি চলে গেলো। আদর দাঁড়িয়ে রইল একইভাবে। চোখের মনিকোঠায় ফুটে উঠলো নিদারুণ এক অবাকতা। নিস্পৃহ মনটা ভেবে উঠলো কেনো এই অবহেলিত কথাবার্তা? কাল রাতেও তো সব কিছু কত ভালো ছিলো। আজ তবে এসব কথা কেন? হ্যাঁ, এই মুহুর্তে এসে আদরের মনে হচ্ছে সে ভুল করেছে ওভাবে টিকলিকে ইগনোর করে। ওতোটাও অপমান করে কথাবলাটা উচিত হয়নি। তাই বলে কি সেই ক্ষোভ মনের মধ্যে পুষে রাখবে টিকলি?

কাছাকাছি আসতেই টায়রা সব কথা শুনতে পেলো। আদর তখন উদাস চোখে তাকিয়ে ছিলো টিকলির হেটে যাওয়া পথের পদচিহ্ণের দিকে। টায়রা কাছে এসে ইতস্তত ভাবে বলল,

‘ওর কথায় কিছু মনে করবেন না ভাইয়া। আসলে সকালে একটু বকা দিয়েছিলেন তো তাই রাগ করেছে। ও এমনি ওকে অযথা কেউ বকাবকি করলে ও খুব মন খারাপ করে।’

আদর বিস্ময়তা সাথে রাজ্যের করুন এক প্রজার মিনতি স্বরে বলল, ‘আমি তো উনাকে অযথা বকাবকি করেনি টায়রা। কাল রাতেই বলেছিলাম তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে আর উনি….’

টায়রা বলে উঠলো তখনি,

‘ভাইয়া কাল রাতে ও অসুস্থ হয়ে পরেছিলো। সারা রাস্তা জার্নি করে এসে ডাস্ট অ্যালার্জির কারণে অ্যালার্জির ওষুধ খেতে হয়েছে। আর অ্যালার্জির ওষুধ খেলে তো ঘুম হয় প্রচুর। তার উপর আমারো মাথা ব্যথা ছিলো। এতোটুকু জার্নি কখনো করিনি তো তাই আর কি সব মিলিয়ে আজকে ঘুম থেকে উঠতে দুই বোনের ই দেরি হয়ে গেছে।’

আদর কিছুক্ষণ পলকবিহীন তাকিয়ে রইল। বলেছিলাম, না জেনে-বুঝে কথা বলা আদর একদমি পছন্দ করে না। সেই আদর ই আজ না জেনে-বুঝে এতো কথা শুনিয়ে দিলো? খুব অন্যায় করে ফেলেছে আদর। খুব…। এই অন্যায়ের ফয়সালা করবে কীভাবে?

,

টিকলি একা একা মৃদু পায়ে হেটে যাচ্ছিলো। হঠাৎ চিলের বেগে আগমন ঘটলো আর্দ্রর। পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে আর্দ্রর দেখা পেয়ে টিকলি ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কি ব্যাপার ভাইয়া?’

আর্দ্র টিকলির সঙ্গবরণে হাটতে হাটতেই বলল, ‘কোনো ব্যাপার স্যাপার নেই।’

‘তাহলে খবর টবর কি?’

‘উমমম…ভালো খারাপ দুটোই।’

‘খারাপ কেনো?’

‘তোমার বোনটা সবসময় শুধু ঝগড়া করে৷ তাই খারাপ। এমন দস্যি একটা মেয়ে তোমার মতো অতি সভ্য ভদ্র নিরীহ মানুষের বোন কি করে হলো কে জানে? আচ্ছা, তোমরা আসলে এক মায়ের পেটের বোন তো? কুড়িয়ে টুড়িয়ে আনোনি তো?’

টিকলি হেসে দিলো। ঠোঁটে হাসির রেশ টেনেই বলল,

‘হয়তোবা। মাঝে মাঝে আমারও সেরকমই মনে হয়। এতো রাগচটা মেয়ে।’

‘আচ্ছা তাই? তোমার রাগ নেই?’

আর্দ্রর প্রশ্নে সেকেন্ডের জন্য হয়তো থমকে গেলো টিকলি। মুহুর্তের মাঝে মনে পরলো সকালে আদর বলেছিলো, ‘এতো রাগ কেনো? একে তো নিজে ভুল করেছে আবার আমার উপরই রাগ দেখানো হচ্ছে?’

টিকলির ভাবনার মুহুর্তে আর্দ্র হালকা গলায় টিকলিকে ডেকে উঠলে আনমনায় টিকলি জবাব দিয়ে উঠলো,

‘আপনার ভাইকে জিজ্ঞাসা করবেন। আমি কি সত্যিই খুব বেশি রাগী?’

‘কি বললে?’ ছোট ছোট চোখ করে বলল আর্দ্র।

টিকলি চমকে তাকিয়ে ছাড়া ছাড়া গলায় বলে উঠলো,

‘বললাম আপনার ভাইয়ের থেকে তো আর বেশি রাগী না?’

আর্দ্র মাথা ঝাঁকিয়ে হেসে বলল, ‘তা ঠিক। তবে আমার ভাইয়া প্রচুর ভালো। ‘

টিকলি আর্দ্রর দিকে তাকিয়ে স্ফীত হাসলো। যেই হাসি কিছুটা ব্যাঙ্গাত্মক।

‘হয়তো ভালো। তবে কাঠিন্যতা মানুষের মন কিংবা ভালো মানুষীটা ঢেকে দেয়।’

______________________________

রাতের নিঝুম অন্ধকারে আর্দ্র রিসোর্টের ছাদে দাঁড়িয়ে গুনগুন করছিলো,

‘চান্দের বাতির কসম দিয়া ভালোবাসিলি
সূর্যের আলোয় ঝলমলাইয়া আমায় পোড়াইলি
চান্দের বাতির কসম দিয়া ভালোবাসিলি
সূর্যের আলোয় ঝলমলাইয়া আমায় পোড়াইলি
এখন তো চান্দেও চিনে না
আমারে সূর্যেও চিনে না
চিনবো কেমনে যে চিনাইবো সেও তো চিনে না’

গলা ছেড়ে এইটুকু গাইতেই পেছনে কারোর রাক্ষসী হাসিতে এতো সুন্দর বিরহ গান গান পরিবেশে বিঘ্ন ঘটলো আর্দ্রর। কটমটিয়ে পেছন ফিরে তাকাতেই চোখ জোড়া শীতল হলো। আটকে গেলো। সেই অট্টহাসির দিকে ক্ষণিক নিরস্ত নিবৃত চাহনিতে তাকিয়ে থাকলো অবুঝ হৃদয়। খোলা মনটা বিশাল সত্যি আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,

‘মেয়েটার হাসিটা ওতোটাও খারাপ নয়।’

মাথা চুলকে উল্টো ঘুরে আর্দ্র নিজেও হেসে দিলো। টায়রার দিকে আবারো তাকাতেই মনে পরলো প্রথম দিনের কথা। সেই মাস্ক পরিহিতা সম্মুখ ভাগের কালো চুলের উপর মুক্তোর মতো জ্বলজ্বল করা পানিগুলো যখন আর্দ্রর সাথে তর্কে মেতে উঠেছিলো। টায়রা তখন হুট করে মাস্ক খুলল। মিনিট খানিকের জন্য আর্দ্র থমকে গেলো। সাগরের গভীরে ডুবে গেলো। বিশাল জলরাশির তলদেশ থেকে উদ্ধার করতে পারলো না তার অনুভূতিগুলোকে। আবার ক্রমেই সেই অনুভূতি গুলো ঝগড়া রাগ অভিমানে রুপান্তরিত হলো। ঠিক এই মুহুর্তটার অনুভূতিগুলোকেও দমিয়ে রেখে আর্দ্র ধমকে উঠলো,

‘হেহে করে হাসছেন কেনো? আপনি জানেন আপনাকে ঠিক রাক্ষসীদের মতো লাগছে। একদম হাসবেন না। আর যেনো হাসির শব্দ আমার কানে না আসে। আপনার হাসি শুনলে আমার গা রি রি করে।’

টায়রা কোমড়ে হাত রেখে বলল, ‘হাজার বার হাসবো। আপনি কানে তুলো গুজেন। এসব ছ্যাকাভ্যাকা টাইপ গান শুনলে কার হাসি আসবে না? পনেরো বার ছ্যাকা খেয়েছে। বেচারা!’

বলেই টায়রা আবারো হাসিতে মত্ত হলো। সেই হাসির দিকে তাকিয়েই আর্দ্র মুগ্ধ কণ্ঠে বলল,

‘হাসবেন না। একদম হাসবেন না। আর শুনুন, কেউ আমাকে ডাম্প করেনা। সবাইকে আমি ডাম্প করি।’

‘আহারে…। মিথ্যা কথা বলতে বলতেই না আরেকটা ব্রেকাপ হয়ে যায়।’ টায়রা আবারো হেসে কুটিকুটি।

আর্দ্র গাল ফুলিয়ে বলল, ‘মিথ্যা কথা না সব সত্যি। আমি জানি কালকেই এই মেয়েটা ফোন দিবে। কিন্তু আমি আর ধরবো না। যেই মেয়ে অকারণে সন্দেহ করে সে প্রেমের মর্ম বুঝে না। আর আপাতত আমি সিঙ্গেল। ব্রেকাপ ট্রেকাপ হওয়ার আর কোনো চান্স নেই।’

‘যারা সন্দেহ করে তারাই প্রেমের মর্ম বুঝে কারণ তারাই বেশি ভালোবাসে।’

‘না। বুঝে না।’

‘আচ্ছা, তাহলে তো আপনিও প্রেমের মর্ম জানেন না। কারণ আপনিও মিথ্যা কথা বলেছেন।’

‘কি মিথ্যা?’ আর্দ্র সিরিয়াস হয়ে প্রশ্ন করলো।

ঠিকঠাক ভাবে দাঁড়িয়ে টায়রা উত্তর দিলো, ‘বলেছেন আপনি নাকি তাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসেন। আসলে কি বাসেন?’

‘না। টু বি অনেস্ট আমি এই পর্যন্ত কাউকেই ভালোবাসেনি। আমি শুধু সবার মাঝে তাকে খুঁজেছি যাকে আমি চাই।’

‘হয়তো সবাইও আপনার মতোই ভেবেছে।’

‘না ভাবেনি তারা।’

‘কে বলেছে? আপনি বেশি জানেন?’

‘হয়তো না। তবে আমি যা জানি তা আপনি জানেন না।’

‘তো আপনি কি কি জানেন?’ টায়রা চোখ উল্টিয়ে প্রশ্ন করলো।

আর্দ্র হেসে টায়রার দিকে এগিয়ে এলো। ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলে, ‘বলবো?’

দু কদম পিছিয়ে টায়রা বলল, ‘ দূরে দাঁড়িয়ে অবশ্যই বলুন।’

আর্দ্র তখন নিবিড় প্রগাঢ় কোনো এক অদৃশ্য অদৃষ্ট মায়াজালে আটকে গিয়ে আত্মমুগ্ধ কণ্ঠে বলে উঠলো,

“প্রেম মানে প্রেমছন্দ, প্রেমমগ্ন, প্রেমগন্ধ, প্রেমমন্দ, প্রেমমত্ত। আর এতোসব প্রেমের মাঝে সন্দেহ করার অবকাশ কোথায়? প্রেমের মাঝে সে সন্দেহ করার ফুরসৎ টাই তো পাবে না। প্রেমের ছন্দে ছন্দে বয়ে যাবে তার হৃদয় গভীরের অচিন পাখির দেহ। অচিনঘরে অচিন পাখির কুহুতানে কেটে যাবে সারা বেলা। মন্দ হয়ে উঠবে প্রেম। কলরবে ছেয়ে যাবে হৃদয়পাটাতন। গন্ধে গন্ধে বয়ে যাবে প্রেমের ক্যানভাস। প্রেমমত্তে মজে গিয়ে জেগে উঠবে নীল আকাশে নতুন চাঁদের প্রতিবিম্ব। সূর্যনিবারণে তপ্ত হয়ে উঠবে প্রেমমগ্ন যুগলবন্দী। তবুও তারা প্রেমে মত্ত।”

চলবে❤️

#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ💗
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন

১৭.
টায়রাকে খুঁজতে ঘর থেকে বের হতেই অনাকাঙ্ক্ষিত বশত টিকলির দেখা হয়ে গেলো আদরের সাথে। উল্টো পায়ে চলে যেতে নিলো। আদর পেছন থেকে ডেকে উঠলো। ঘাড় ঘুরিয়ে টিকলি বলল,

‘বলেছি তো আপনাদের মতো আপনারা থাকবেন আর আমাদের মতো আমরা। আজ থেকে আমরা অপরিচিত। তবে এতো ডাকাডাকি কেনো?’

আদর চেয়েছিলো টিকলিকে সরি বলবে। অনেকবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে সরি প্র‍্যাকটিস করেছে। জীবনে হয়তো এই প্রথম মা ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে সে সরি বলার প্রস্তুতি নিয়েছে। কিন্তু টিকলির এতোসব আগুনের গোলার ন্যায় কথার ছটায় সেসব কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো। সরি প্র‍্যাকটিস টা একদম বৃথা গেলো। আবার ভর করলো রাগ। তবুও রাগ গুলোকে ধামাচাপা দিয়ে আদর এগিয়ে এলো টিকলির দিকে। মুখে গাম্ভীর্য ভাব টেনে বলল,

‘আপনার কি মনে হচ্ছে না আপনি স্বার্থপরের মতো কথা বলছেন?’

টিকলি বিস্মিত হয়েও প্রকাশ করলো না। ভ্রু কুচকে বলল, ‘আমি? স্বার্থপরের মতো কথা বলছি?’

‘অবশ্যই।’

‘ঠিক কি কারণে আপনার এমনটা মনে হলো?’

‘মনে হওয়াটাই কি স্বাভাবিক নয়?’

‘কেনো? কি করেছি আমি?’

‘কি করেন নি? প্রথমত আপনার দরকার ছিলো বলেই আপনি আমাদের সাথে এসেছেন। কারণ আমরা ভালো ভদ্র ছেলে তা তো এক দেখায় বুঝে ফেলেছিলেন। সেই ট্রিকস টাই কাজে লাগিয়েছেন। ভুলিয়ে ভালিয়ে আমাদের সাথে সেইফ মতো এসেছেন। ঘুরেছেন। যখন দেখলেন আজ বিকালে ঘুরা শেষ। ঠিক তখনি আপনার মনে হলো আপনাদের রাস্তা এবং আমাদের রাস্তা আলাদা। আমরা পরিচিত থেকেও হুট করে অপরিচিত হয়ে উঠলাম!’

আদরের কথায় বিষের ব্যথার মতো যন্ত্রণায় কাতরালো টিকলির মনের মনপাখি। চোখ দুটো উপচে উঠলো নোনা জল দ্বারা।
টিকলির মোটা ফ্রেমের চশমার নিচের জলসিক্ত চোখদুটো কি আদর দেখতে পেলো? তার মুখ হঠাৎ পাষণ্ড থেকে নমনীয় হয়ে উঠলো। আদর বলতে শুনলো। টিকলি নাক টেনে বলছে,

‘ঠিক। আমি খুব স্বার্থপর। আচ্ছা খুব বেশি কি স্বার্থপর? আমি তো আপনার কথাই রাখার চেষ্টা করেছিলাম। আপনার অবহেলা বিরক্তি ভাব তো আমি আগে বুঝতে পারিনি। বুঝতে পেরেছি কমলার দিঘি থেকে। তবুও তেমন কিছু মনে করিনি। কিন্তু আজ সকালেও যখন অযথা বকাবকি করলেন তখনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আচ্ছা? আপনি বলুন তো আপনার দোষ নেই? আমরা না হয় ঘুম থেকে উঠতে পারিনি। দেরি করেছি। কিন্তু আপনি তো একটাবার ফোন দিতে পারতেন। আপনার কাছে তো আমার নাম্বার ছিলো। বিরক্ত দেখেই তো ফোন দেননি তাইনা?’

টিকলির গলা ভেঙে এলো। হয়তো আর এক মিনিট এখানে দাড়ালে অবাধ্য জল গুলো গড়িয়ে পরবে নির্জীব কপোলের উপর। অভিমানী ঠোঁটের উপর। নিজের উপর নোনতা স্বাদ পেয়ে অভিমানী ঠোঁট দুটো তখন আরো বেশি অভিযোগ করে বলবে,

‘তুই তো সচরাচর কাদিস না টিকলি। তবে এখন হঠাৎ কেদে আমাকে লবণযুক্ত পানি খাওয়াচ্ছিস কেনো রে?’

টিকলি উল্টো ঘুরলো। চশমার নিচ দিয়ে চোখ দুটো মুছে চলে যেতেই পেছন থেকে আদর বলে উঠলো,

‘যাবেন না।’

কেনো কে জানে টিকলির পা দুটো ইট পাথর সিমেন্টের এই স্থাপনার সাথে আটকে গেলো। নিস্পৃহতায় ছেয়ে গেলো শরীর। ক্রমেই অসাড়, নিষ্প্রভ, নিষ্প্রাণ হয়ে উঠছে মন। আদর আবার বলল,

‘আপনার নাম্বার ডিলিট হয়ে গেছে।’

নিদারুণ এক অবাকতা নিয়ে টিকলি প্রশ্ন করলো, ‘হয়ে গেছে?’

কেনো জেনো টিকলিকে মিথ্যা কথা বলতে পারলো না আদর। একটু ইতস্তত অপরাধী কণ্ঠে বলল,

‘না। ডিলিট করে দিয়েছিলাম।’

টিকলি অবাক হলো। নিষ্ঠুর হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটের কোণায়। সে কিছু বলল না। পা বাড়ালো আবার চলে যাওয়ার জন্য। আদর তড়িঘড়ি করে বলল,

‘কিন্তু সব দোষ আপনার। এসবের জন্য দায়ী আপনি।’

আবারো পেছন ঘুরে টিকলি বলল, ‘আমি দায়ী?’

‘হুম অবশ্যই।’ পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আদর আবারো বলল,

‘আপনি যদি কমলার দিঘিতে গিয়ে আমাকে রিজেক্ট না করে আর্দ্রর সাথে না আসতেন তাহলে এসব কিছুই হতো না। আপনি আমাকে অপমান করেছেন। সারা পথ আমার সাথে এসে মাঝপথে আমাকে কিছু না বলেই আমারি ছোট ভাইয়ের সাথে আপনি চলে এসেছেন। আপনি একবার বলতে পারতেন আমাকে, যে আমার সাথে আপনার যেতে ভালো লাগছে না। কিন্তু এভাবে আমাকে না বলে কয়ে রিজেক্ট করে আপনি কীভাবে যেতে পারলেন?’

বিস্ময়ের সাগরের হাবুডুবু খেতে খেতে টিকলি আর কোনো কথা খুঁজে পেলো না। বড় বড় পল্লব বিশিষ্ট চোখ জোড়া দিয়ে তাকিয়ে থাকলো শুধু। আদর বলল খুব ই করুণ গলায়,

‘আমি কারো কাছ থেকে রিজেক্ট সহ্য করতে পারিনা টিকলি।’

টিকলি অবচেতনে স্বগতোক্তি করলো, ‘ওহ মাই গড। আপনি একটু বেশি বেশি বুঝেন। মানে কেমনে? কীভাবে সম্ভব? একটা মানুষ এতোটা ভুল ধারণা নিয়ে ভুল বুঝে থাকতে পারে কীভাবে?’

আদর কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালো। টিকলি বলল,

‘আপনি নিশ্চয়ই দেখেছেন আর্দ্র ভাইয়া আমার হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছিলো। সেই মুহুর্তে আমি কীভাবে আর্দ্র ভাইয়ার হাত ছাড়িয়ে আপনার সাথে আসবো? আপনাকে বলার সুযোগ টাই তো পাইনি। কিন্তু আমি অনেকবার তাকিয়ে ছিলাম আপনার দিকে।’

আদরের মনে পরলো। হ্যাঁ, টিকলি তাকিয়ে ছিলো। অসহায় চোখে তাকিয়ে ছিলো। ও প্রশ্ন করলো,

‘আর্দ্র কেনো আপনাকে ওভাবে নিয়ে যাচ্ছিলো?’

‘টায়রা আর ভাইয়ার মধ্যে ঝগড়া বেধেছিল তাই তারা দুজন আর দুজনের সাথে যাবে না। তার জন্য বাধ্য হয়ে আমার আর্দ্র ভাইয়ার সাথে যেতে হয়েছে।’

আদর তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। নিজের এতো বোকামির জন্য নিজের গালেই চর লাগাতে ইচ্ছে করলো। আদর হতাশ কণ্ঠে বলল, ‘আসলেই?’

টিকলি আদরের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বিরক্ত নিয়ে চলে যেতে ধরলো।
মনে পরলো, আদর সরি বলতে চেয়েছিলো কিন্তু বলা হয়ে উঠলো না। সে পেছন থেকে ডাক দিলো,

‘টিকলি?’

ঘাড় ঘুরিয়ে টিকলি বিরক্ত নিয়ে বলল, ‘বারবার পিছু ডাকছেন কেনো? যেতে দিবেন না আমাকে নাকি?’

‘নাহ..মানে বলছিলাম যে আপনি আমার উপর রেগে নেই তো?’

ইশশ…সরি বলা হলো না! আদরের নিজের উপরেই রাগ হলো। টিকলি ভ্রু কুচকে বলল, ‘আমার রাগ হলেই আপনার তাতে কি?’

আদর থতমত খেয়ে বলল, ‘কিছুই না।’

টিকলি আবার চলে যেতে ধরলে আদর আবার পেছন ডাকলো। বিরক্তের উচ্চ সীমায় পৌঁছে দাঁত কটমটিয়ে টিকলি বলল, ‘সমস্যা কি আপনার?’

‘আমরা যেমন একসাথে এসেছি একসাথেই যাবো। কাল ই রৌনা হবো।’

টিকলি এক পলক তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো।
উফফ আপসোস… এই বেলায়ও আদরের সরি বলা হয়ে উঠলো না। আদেও বলা হবে কি না কে জানে?

________________________________

ঘরে ঢুকেই টিকলিকে থমথমে মুখে বসে থাকতে দেখে প্রশ্ন ছুড়লো টায়রা,

‘কি হয়েছে রে তোর?’

‘কি হবে?’

ভ্রু কুচকে চিন্তিত কণ্ঠে টায়রা বলল, ‘নাহ। আজকাল একটু বেশি মন খারাপ থাকছে তোর। তাই জিজ্ঞেস করলাম।’

দীর্ঘ শ্বাস ফেলে টিকলি বলল, ‘হয়তো। যাই হোক, ব্যাগ গুছিয়ে রাখিস কাল চলে যাবো।’

টায়রা অবাক হয়ে টিকলির কাছে এসে বসে বলল, ‘কাল ই?’

‘হুম। কাল ই।’

‘কেনো? কাল কেনো? দুটো দিন ও হয়নি এসেছি। মাত্র কাল দুপুরে আসলাম। মাত্র তিনদিন হলো বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। এতো তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাবো?’

হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে টিকলি বলল,

‘আদর সাহেবের নাকি জরুরি কল আসছে বারবার। এদিকে নিঝুম দ্বীপও তো মোটামুটি সব ই দেখা হয়েছে। কাল সকালে মেবি উনারা নামা বাজার সি বীচ আর উপর বাজার সি বীচ দেখিয়ে আনবেন।’

টায়রা মন খারাপ করে কাপড় গুছাতে লাগলো।

‘তুই চাইলে আমরা আরো কিছুদিন থেকে যেতে পারি। ওরা চলে যাক। আমরা না হয় পরে যাবো।’ টিকলি অন্যমনস্ক গলায় বলল।

টায়রা একটু ছন্নছাড়া হয়ে বলে,

‘কি দরকার? কোনো দরকার নেই। এখানে থেকে আর কি করবো? ভালো লাগছে না। একসাথে এসেছে একসাথেই চলে যাই। ঢাকার আশেপাশে বান্ধবীদের বাসায় ঘুরেফিরে আর দুটো দিন নাহয় কাটিয়ে পরে বাড়ি ফিরবো।’

কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ টিকলি খুব গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠে বলে উঠলো,

‘আচ্ছা, টায়রা? তোর কি মনে হয় না আমরা ওদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পরেছি?’

কাপড় ভাঁজ করা থামিয়ে ভ্রু কুটি করে টায়রা বলল,

‘হঠাৎ এখন এই প্রশ্ন? আমি বিকালে শুনেছিলাম আদর ভাইয়াকেও এসব বলছিলি তুই। কি হয়েছে তোর?’

‘কিছু হয়নি। তোকে যেটা জিজ্ঞেস করলাম সেটা বল না।’

হাতের কাপড় গুলো ভাঁজ করায় আবার ব্যস্ত হয়ে পরলো টায়রা। অমনোযোগী গলায় বলল,

‘জানি না।’

টিকলি নিষ্প্রাণ শ্বাস ছেড়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখের পাতা বন্ধ করলো। বন্ধ চোখের কোল ঘেঁষে জেগে উঠলো শত না বুঝা গল্পকথা।

_____________________________

ফোনে মগ্ন ভাইকে আদর প্রশ্ন করলো,

‘আচ্ছা আর্দ্র? মানুষ অর্ধপরিচিত কাউকে সরি কীভাবে বলে?’

ফোন থেকে চট করে চোখ উঠালো আর্দ্র। বড় ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো পুরোদস্তুর চার মিনিট। আদরের কুচকানো কালো দুই ভ্রু। কপালে সুক্ষ্ম তিন-চারটি চিন্তার ভাঁজ। মুখে পরাজয়ের চিহ্ন। যেনো কোনো কিছু না পেরে সে বড্ড হতাশ। পরীক্ষার খাতায় দুটো রসগোল্লা পেয়ে সে ভবিষ্যতের চিন্তায় মশগুল।

ভাইকে পর্যবেক্ষণ শেষে আর্দ্র গলা খাকারি দিয়ে বলল,

‘সরি? মানে তুমি কাউকে সরি বলবা?’

আদর চট করে তাকালো আর্দ্রর দিকে। ধাতস্থ হয়েও রাগী কণ্ঠে বলল,

‘তোকে এতো প্রশ্ন করতে বলেছি?’

‘আচ্ছা? অর্ধপরিচিত সেই ব্যক্তিটি কে?’

‘আমি তোকে প্রশ্ন করতে মানা করেছি?’ গরম চোখে তাকিয়ে আদর বলল।

মুখ গোল করে ‘ওহ’ বলে আর্দ্র নিজেও খানিকটা চিন্তিত হয়ে উঠলো। কিছুক্ষণ ভাবা-ভাবির পর বলল,

‘একটা সরি নিয়ে এতো ভাবা-ভাবির কি আছে ভাইয়া? স্রেফ সামনে যাবা যাকে সরি বলার বলে দিয়ে চলে আসবা।’

কথাটা বলেই আর্দ্র আবারো ফোনে ধ্যানমগ্ন হলো। আদর এক ঝলক ভাইয়ের পানে তাকিয়ে ভাবলো, ‘এতো সোজা বুঝি? যদি এতো সহজ ই হতো তবে টিকলি যখন সামনে ছিলো আদর কেনো সরি বলতে পারলো না। বারবার সরি বলতে গিয়েও কেনো অন্য কথা বলল। সরি কি এতো সস্তা? গিয়ে দাড়ালাম আর বলে চলে আসলাম?’ আদর দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো ভাবলো,

‘হয়তো কারো কারো ক্ষেত্রে এতোটাই সোজা। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে এই সরি বলাটা ভীষণ কঠিন।’

ভাবতে ভাবতেই আদর এলোমেলো হয়ে পরলো। উদাস চোখে খুঁজে বেড়ালো আকাঁবাকাঁ নদীর পাড়। নদীর কিনারা খুঁজে না পেয়ে দিশেহারা হয়ে গন্তব্যবিহীন মাঝির ন্যায় ঘুরে বেড়ালো সারা তটিনী জুড়ে। তবুও প্রশ্ন থেকেই গেলো। উত্তর পাওয়া হলো না ওই নদীর বুক থেকে।

চলবে❤️