বৃষ্টি নামার পরে পর্ব-০৫

0
4264

#বৃষ্টি_নামার_পরে ❤
#লেখিকা-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৫

৬.
“দুম করে পিঠে কিল পড়াতে মৃন্ময় বেশ হকচকিয়ে গেলো।বেশ লেগেছে ওর।গুঞ্জনের উপর খুব রেগে গেলো।এর সাথে যে কি করে কয়েকটা দিন কাটাবে তা ভাবতেই মৃন্ময়ের রাগ হচ্ছে।এ মেয়ে নিশ্চয়ই পাবনার মেন্টাল হসপিটালের পেশেন্ট,নির্ঘাত পালিয়ে এসেছে।দেশের একজন সচেতন নাগরিক হওয়ায় মৃন্ময়ের উচিৎ গুঞ্জন নামক এই পাগলিটাকে হাত-পা বেঁধে পাগলখানায় দিয়ে আসা।তবে এই মুহূর্তে এটা করতে পারবে না সে।বিয়ে করেছে এই পাগলিটাকেই যে সে,এখন একদল মেহমানের সামনে মুখে হাসি হাসি ভাব রেখে বেস্ট কাপলের ড্রামা করতে হবে।ভাবতেই রাগ হচ্ছে ওর।গুঞ্জন ঠিকই বলেছে,এসব নাটকীয়তা মানুষকে একদম মানায় না।যে যেমন সবসময় তাকে নরমাল ভাবেই থাকতে দেওয়া উচিৎ।”

“সেলফোনটা হাতে নিয়ে মৃন্ময় ফোন লাগালো রুহির নাম্বারে।আজ দু’দিন পরে ফোন করছে সে,মেয়েটার খোঁজ রাখা হয়নি ব্যস্ততার কারণে।রিং হবার কিছুক্ষণ পরও ওপাশ থেকে রেসপন্স পাওয়া গেলো না।রুহি হলো গুঞ্জনের চাচাতো বড় বোন,বড় ভালো মেয়ে!এইজন্যই মেয়েটাকে এতো ভালো লাগতো মৃন্ময়ের।বেশ খানিকক্ষণ পরে রুহির মোবাইও থেকে মৃন্ময়ের মোবাইলে একটা ম্যাসেজ আসলো।সেখানে লেখা,মৃন্ময় এখন গুঞ্জনের হাজব্যান্ড।তাই রুহির সাথে যেন আর সম্পর্ক না রাখে।কজ ছোট বোনের হাজব্যান্ডের সাথে যেমন সম্পর্ক থাকা দরকার তেমনই থাকবে,কিন্তু প্রেমঘটিত কোনো সম্পর্ক ও রাখবে না।এটা অন্যায়,রুহি এই অবিচার করতে পারবে না।”

“ম্যাসেজ দেখে মৃন্ময় অনেকক্ষণ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো।এমনটা কিভাবে করতে পারলো রুহি?শেষমেশ ওকে ছেড়ে দিলো?আর যাবেই-বা না কেন?একটা বিবাহিত ছেলের সাথে রুহি কেন কেউই থাকতে চাইবে না।মৃন্ময় হঠাৎ ওর বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভব করলো।”

“এখন সবকিছুর জন্য একমাত্র দায়ী গুঞ্জন।ওর জন্যই সবকিছু হচ্ছে।তাই এর ফল ওকে ভোগ করতেই হবে।এখনো মৃন্ময়কে ও চিনতে পারেনি,কি কি করতে পারে সেটার মজা ও বুঝবে!জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ!”

“কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকার পর মৃন্ময় উঠে দাঁড়ালো।নিচে যেতে হবে,মেহমানরা বোধহয় এসে গিয়েছে।ওদিকে গুঞ্জন না জানি কি করছে,মাথা যে খারাপ,বলার বাইরে!একটা অফ-হোয়াইট রঙের শার্ট,কালো প্যান্ট পড়ে রেডি হয়ে নিচে গেলো।দেখতে পুরাই প্রিন্স চার্মিং!”

“এদিকে মেহমান আসার উপলক্ষে ঘুম থেকে উঠে দিদা আর আনিসা চৌধুরী গুঞ্জনকে একটা খয়েরী রঙের শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছেন, আর হালকা লিপস্টিক!ব্যাস,আর চুল ছাড়া।গুঞ্জন সাজতে চাইছিলোই না।কিন্তু শাশুড়ী আর দিদার জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে পড়ে নিলো।আনিসা চৌধুরীর আবার এক কথা,আন্টি ডাকলে হবে না।আম্মু ডাকতে হবে। এদিকে আবার গুঞ্জনদের বাসার লোকজনেরাও আসবে।মৃন্ময়ের বোন আরিশা গুঞ্জনকে নিয়ে অলরেডি শ’খানেক সেলফি তুলে ফেলেছে।”

“বিরক্তির ঠ্যালায় গুঞ্জন সোফায় বসে আছে।এমন সময় সিঁড়ি দিয়ে মৃন্ময়কে নামতে দেখে গুঞ্জন একটু ভয় পেলো।ওইসময় দুম করে যা কিল দিয়েছে,এমন কিল খেয়ে তো ব্যাটার পিঠ বাঁকা হয়ে যাবার কথা।কিন্তু মৃন্ময় তো বেশ সোজা। গুঞ্জন হলে এতক্ষণে লাঠির উপর ভর দিয়ে হাঁটার কথা।তাও দু’চোখ মেলে ভালো করে দেখতেই হঠাৎ করে মৃন্ময়কে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর লোকটি বলে মনে হচ্ছে।আর্মিবাহিনীদের মতো হেয়ার কাট,খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি জাস্ট অসাম লাগছে।শার্টের সাথে কালো প্যান্ট যা মানিয়েছে,গুঞ্জন এবার সত্যিই ক্রাশ নামক বাঁশ খেলো।”

“এদিকে পাবনার পাগলখানার পাগলিকে শাড়ি পড়ে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে দ্বিগুণ আশ্চর্য হলো মৃন্ময়।যে মেয়ে অলওয়েজ লাফালাফি,ঝাপাঝাপি,মারামারি করে তার এ দৃশ্যটা চোখে গেঁথে গিয়েছে।দুদিনেই এই মেয়ে যা করার করে ফেলেছে।এখন এত চুপচাপ দেখে মৃন্ময়ের বেশ শান্তি লাগছে,আবার দেখি শাড়িও পড়েছে,নিশ্চয়ই দিদার কাজ।বাহ,!গুঞ্জনের দিকে তাকিয়ে একটা ডাঁটিয়াল হাসি দিলো।গুঞ্জন তা দেখে রেগে আগুন।ওর গা জ্বলছে।একে যদি থাপড়ানো যেতো তাহলে হিরোগিরি ছুটাই দিতো গুঞ্জন!”

“মেহমানরা এসে গিয়েছে।সারা বাড়িতে হইহই রব।সবাই নতুন বউ দেখায় ব্যস্ত।কেউ কেউ গুঞ্জনের সাথে সেলফি তুলছে,গুঞ্জন রোবটের মতো বসে আছে সবার মাঝখানে।হাসি না পেলেও সবার সামনে মুখটাকে হাসি হাসি করে রেখেছে,মৃন্ময়ের দেখে মনে হচ্ছে কৃত্রিম হাসি।গুঞ্জনকে ঠিক পুতুল পুতুল লাগছে শাড়িতে,কার্টুনের মতো মুখ বানিয়ে বসে আছে।এখন উচিৎ শিক্ষা হয়েছে মেয়ের।মৃন্ময় বসে বসে ওর কান্ড দেখে মিটিমিটি করে হাসছিলো।”

“একটু পর আরিশা মৃন্ময়কে টেনে নিয়ে গুঞ্জনের পাশে বসিয়ে দিলো।সাথে সাথে ফটোগ্রাফাররা পটাপট ছবি তোলা আরম্ভ করলো।এই পোজ, সেই পোজ দিতে দিতে দুইজনই অস্বস্তি বোধ করছিলো।কিন্তু কি আর করা,সবার সামনে ক্লোজআপ মার্কা হাসিমুখে পোজ দিতে হলো।ছবি তোলা শেষ হলে কিছুক্ষণ পর আশেপাশে খুব বেশি একটা কেউ রইলো না।গুঞ্জন মৃন্ময়ের কানে কানে জিজ্ঞেস করলো,

-“কি ব্যাপার, আপনি বাঁকা হননি?”

-“বাঁকা হবো মানে? আমি বাঁকা হবো কোন দুঃখে?হোয়াট ডু ইউ মিন গুঞ্জন?

-“না মানে, আমি আপনাকে এতো জোরে একটা কিল দিয়ে আসলাম তো,তাই ভাবছি।আপনার বাঁকা হয়ে যাবার কথা।”

-“এত শাস্তি তুমি পড়ে পাবে গুঞ্জন।বাট আমাকে অতটাও নরম-সরম ভেবো না।”

-“কেন?আপনি তো নরম-সরম ভোলাভালা আবুল ছেলেই!”

“মৃন্ময় বাঁকা হাসি দিয়ে বললো,রিয়েলি গুঞ্জন? আমাকে তোমার ভোলাভালা আবুল ছেলে মনে হয়?আমি বেশ শক্ত-সামর্থ্য ছেলে!তুমি মেয়ে বলে পার পেয়ে যাচ্ছো,নইলে দেখতে এই মৃন্ময় কত কি করতে পারে!”

“গুঞ্জন অবাক হওয়ার ভান করে বললো, তাই নাকি?”

“মৃন্ময় বাঁকা হাসি দিয়ে বললো, একটু পর টের পারে মিস গুঞ্জন।”

“গুঞ্জন চোখদুটো কপালে তুলে বললো,মিস গুঞ্জন মানে কি?আমি মিসেসে মৃন্ময় চৌধুরী। একজন বিবাহিত মেয়েকে মিস ডাকার অপরাধে কি শাস্তি হয় জানেন তো?”

“মৃন্ময় অবাক হওয়ার ভান করে বললো, না জানিনা।আপনিই বলুন!”

“গুঞ্জন মৃন্ময়ের দিকে তাকিয়ে কেমন করে একটা হাসি দিয়ে বললো, তাঁর বউয়ের থেকে দূরে রাখা হয়।ইভেন আপনাকেও সেই পানিশমেন্ট পেতে হবে মিস্টার মৃন্ময় চৌধুরী!”

“মৃন্ময় তার গোলাপি ঠোঁটজোড়ার কোণে হাসি ফুটিয়ে বললো,তাই!ইট’স ওকে।আমিও তেমন বউ পাগল নই যে,বউয়ের আঁচল ধরে বসে থাকবো।তাই এই পানিশমেন্ট আমি মাথা পেতে নেবো এবং নিলাম।”

“গুঞ্জনের হঠাৎ করে খুব কষ্ট লাগছে।সেটা ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা করে মৃন্ময়ের কানের কাছে গিয়ে আস্তে করে বললো,আপনাকে প্রিন্স চার্মিং এর মতো লাগছে।”

“মৃন্ময় বললো, রিয়েলি গুঞ্জন? তোমাকে অনেক ধন্যবাদ সুন্দর বলার জন্য।”

“গুঞ্জন তেড়ে উঠে বললো, আমি কই সুন্দর বললাম?বলেছি প্রিন্স চার্মিং এর মতো লাগছে।বাই দ্যা ওয়ে,আপনার মতো রূপবান পুরুষকে দেখে আমি আপনার উপর ক্রাশিত।দীর্ঘ চব্বিশ বছর বয়সের রেকর্ড ভেঙ্গে আমি আপনার মতো নকল প্রিন্স চার্মিং এর উপর ক্রাশ খেয়েছি, এখন আপনি বলুন আপনি আমার বয়ফ্রেন্ড হবেন কিনা?”

“মৃন্ময় হেসে বললো,জ্বি না।আমি তোমার উপর ক্রাশিত হতে পারছি না গুঞ্জন।অলরেডি আমার ক্রাশিত ব্যক্তিটি তোমাকে বিয়ে করার জন্য আমার সাথে ব্রেকআপ করেছেন।তাই আর যাইহোক, তোমার প্রস্তাবে রাজি হতে পারছি না ইভেন ভবিষ্যতেও না।নেহায়েতই বউ হয়ে আছো,তাই থাকো।”

“গুঞ্জন খুব একটা অবাক হলো না।ও জানতো রুহি যতই ওকে না দেখতে পারুক,একজনের সংসার কখনোই ভাঙবে না।কিন্তু এখানে গুঞ্জনের তো সংসারই নেই তাহলে? তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে আবারও গুঞ্জন মৃন্ময়ের কানে ফিসফিস করে বললো,বলা তো যায় না!একদিন হয়তো পড়তেও পারেন।হয়তো তখন পাগল হয়ে খুঁজলেও নাও পেতে পারেন!”

“মৃন্ময় হেসে বললো,মোটেও না।”

“গুঞ্জন মিষ্টি করে হেসে কেমন কাঠ কাঠ গলায় বললো,
‘life is like riding bicycle
To keep your balance,
You must keep.’

_________

” গুঞ্জনের বাড়ি থেকে এসেছে ওর মা-বাবা,দুই চাচ্চু,তিন ফুপি,গুঞ্জনের কিছু ফ্রেন্ড,গুঞ্জনের ছোট
দুই জমজ বোন হিয়া,মৃদুল!কাজিনরা সবাই,এহসান,ফায়াজ,ইহিতা,মিশু,জিসান,নিভৃত সবাই।সবাই এলেও নিভৃত আর মৃদুল ছাড়া কেউই গুঞ্জনের সাথে কথা বলেনি।সবাই দাদীমা,আনিসা চৌধুরী, মৃন্ময়ের বাবা ইকবাল চৌধুরী, মৃন্ময়ের কাজিনিদের সাথে কথা বলছে,হাসাহাসি করছে।নিভৃত আর মৃদুল গুঞ্জনকে বেশ পছন্দ করে।সবসময় দুষ্টুমি,হাসাহাসিতেই ওরা ব্যস্ত থাকতো। তাই দুদিন পর গুঞ্জনকে দেখতে পেয়ে ওদের খুশির অন্ত নেই।”

“মৃন্ময় সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলছে।গুঞ্জন বসে বসে সব দেখছিলো।এতক্ষণ ধরে ওর বাড়ির কেউ এমনকি মা-বাবাও যখন গুঞ্জনের সাথে কথা বলতে আসলো না,তখন গুঞ্জন নিজেই উঠে গেলো ওর মায়ের কাছে।জিজ্ঞেস করলো,কেমন আছো আম্মু?”

“মায়া আহমেদ বললো, ভালো আছি।তুমি?”

“গুঞ্জন হেসে বললো, ভালো।”

“ঠিক আছে এখন যাও,বলেই গুঞ্জনের মা অন্যদিকে চলে গেলো।গিয়ে অন্য আরেকজনের সাথে হাসিমুখে কথা কথা বলা শুরু করলো।গুঞ্জন একইভাবে সবার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলো। কিন্তু কেউই ওর সাথে তেমন কোনো কথা বললো না।কেমন বিষের নজরে ওর দিকে দেখছিলো।অবশেষে নিজের বাবার কাছেও একই ব্যবহার পেয়ে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মেয়ে বলে মনে হচ্ছে ওর।”

“বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে।ঘরভর্তি মানুষের মাঝে দমবন্ধ লাগছিলো গুঞ্জনের।তাই সবার চোখ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে ছাদে চলে এলো।আর কেউ খেয়াল করুক বা না-করুক,মৃন্ময় এতক্ষণ সবকিছুই লক্ষ্য করছিলো। এই রাতের বেলা বৃষ্টির মধ্যে ছাদে কি করতে গিয়েছে গুঞ্জন? দেখতে হবে বিষয়টি।মৃন্ময় ও একটু পর গেলো ছাদে।”

“ছাদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে গুঞ্জন। প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে।সেই বৃষ্টিতে ভিজছে গুঞ্জন।কিছুক্ষণ পর পর বিজলি চমকাচ্ছে।মৃন্ময় ডাকলো গুঞ্জনকে,কোনো সারাশব্দ নেই।পেছন ফিরে দেখছেও না মৃন্ময়কে।হয়তো শুনছে না।আচ্ছা,গুঞ্জন কি কাঁদছে?”

“মৃন্ময় এবার গুঞ্জনের কাছে গেলো।এতক্ষণে ভিজে চুপসে গিয়েছে ও।বললো, এই গুঞ্জন!”

“গুঞ্জন বললো,আপনি এখানে কেন?”

“মৃন্ময় রাগী গলায় বললো,আগে বলো তুমি এখানে কেন?”

-“আমার ইচ্ছে!”

“মৃন্ময় রেগে বললো, এসব পাগলামি ইচ্ছে বন্ধ করো। ভেতরে চলো!তোমার কি একটুও ভয় করে না?”

-“না!”

-“এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেও তোমার ভয় লাগছে না?আজব তো!”

-“বৃষ্টিকে আমি ভয় পাই না।ভয় পাই মানুষদের,যারা নিজের সন্তানকে অবহেলা করে!বৃষ্টি কখনো মানুষের ক্ষতি করে না,এসব মানুষেরা নিজের অজান্তেই অন্যকে কষ্ট দিয়ে ফেলে।”

“মৃন্ময় চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনছিলো।কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।ওর কাছে নিজেকে অনুভূতিহীন মনে হচ্ছে।সারাদিন হাসি-ঠাট্টা,মারামারি, দুষ্টুমিতে মেতে থাকা মেয়েটাও যে এতোটা কষ্ট নিজের মনে চেপে রেখেছে তা ভাবতে ওর কষ্ট হচ্ছে।”

চলবে…..ইনশাআল্লাহ!