#বৃষ্টি_ভেজা_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১৩
‘ পেত্নী আজকে মানুষরূপে শাকচুন্নি হয়ে আসলো কিভাবে?’
ঠিক একটারই ভয় পাচ্ছিলো আরাবী।এতোদিন ওকে একা পেয়েই বলেছে আজ একেবারে নূর আর ইফতির সামনে ওকে পেত্নী বললো।এদিকে জায়ানের কথা বুঝতে না পেরে নূর আর ইফতি ভ্রু-কুচকে তাকিয়ে আছে জায়ানের দিকে।নূর খানিকবাদে বলে উঠে,
-‘ কাকে পেত্নী বলছো ভাইয়া?’
জায়ানের দৃষ্টি ফোনে নিবদ্ধ।ভুলেও চোখ উপরে তুলছে না।ফোন ঘাটতে ঘাটতেই উত্তর দেয়,
-‘ তোর সাথেরটা কে বলছি।অলওয়েজ দেখি সাদা জামা পরে ভুতের মতো এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করে।তাই আজ হঠাৎ অন্য রঙের কিছু পরিধান করেছে এই জন্যেই কথাটা বললাম।’
ইফতি ফিক করে হেসে দিলো।হাসতে হাসতেই বলে,
-‘ তা যা বলেছো ভাই।আমিও খেয়াল করেছি।আরাবী অলওয়েজ সাদা রঙের জামা বেশি পরে।’
নূরও হাসি থামাতে পারলো না ইফতিকে হাসতে দেখে ও নিজেও হেসে দিলো।এদিকে সবার সামনে এইভাবে জায়ান ওকে অপমান করে দিলো ভেবেই কান্না পাচ্ছে আরাবী।সাথে চরম লেভেলের রাগও হলো।তাই কন্ঠে তেজ ঢেলে বলে,
-‘ আমি যাবো না কোথাও।তোমরা সবাই মানুষ।তোমাদের মানুষদের সাথে আমি পেত্নি হলে আমি কেন যাবো?যাবো না আমি।’
আরাবী যাবে না শুনে।তাড়াতাড়ি নূর আর ইফতি হাসি থামিয়ে দিলো।নূর দ্রুত আরাবীর হাত টেনে ধরে বলে,
-‘ না না এমন বলে না।তুমি আমার লক্ষি বোনু।প্লিজ রাগ করোনা।’
আরাবী রাগি চোখে তাকালো নূরের দিকে।বললো,
-‘ আমি না গেলে তোমার কি?ঠিকই তো ভাইয়ের কথা শুনে হাসছিলে দাঁত বের করে।এখন আবার আমাকে টানছো কেন?’
ইফতি আরাবীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।নরম কন্ঠে বলে,
-‘ রাগ করেনা আরাবী।চল এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। তোকে অনেক সুন্দর লাগছে সত্যি।রাগ করিস না!’
আরাবী মুখ ফুলিয়ে রাখলো।এদিকে জায়ান ফোন পকেটে পুরে নিয়ে।গম্ভীর গলায় বলে,
-‘ তোরা কি যাবি?নাকি আমি তোদের ফেলেই চলে যাবো?তখন আসিস একা একা।তোদের এইসব ড্রামা দেখতে আমার ভালো লাগছে না।আমি চলে যাচ্ছি।যাবার হলে দ্রুত গাড়িতে উঠ।’
জায়ান দ্রুত গাড়িতে উঠে বসলো।আরাবী যাবে না বলতে নিলেও পারলো না তার আগে নূর আর ইফতি ওকে একপ্রকার টেনে হিছড়ে গাড়িতে বসিয়ে দিলো।নূর আর আরাবী পিছনের সিটে বসলো আর ড্রাইভিং করবে জায়ান ওর পাশে ইফতি। গাড়ি চলতে লাগলো।আরাবী জানালার কাচ নামিয়ে বাহিরে তাকিয়ে থাকলো।রাতের ঢাকা শহর দেখতে ভীষন ভালো লাগছে।আরাবীর একটু একটু মনে আছে।ও ছোট থাকতে প্রায় বাবা,মার সাথে লংড্রাইভে যেতো রাতের ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়াতো।পথে কিছু দেখলে আবার বায়না ধরে এটা সেটা বাবাকে বলে এনিয়ে নিতো।কি মধুর দিন ছিলো সেগুলো। এখন সব মস্তিষ্কে স্মৃতি হয়ে রয়ে গিয়েছে।আরাবীর চোখের কোণে জমা জলটুকু অতি সাবধানে মুছে নিলো।হঠাৎ জানালার কাচটা ধীরে ধীরে উপরে উঠছে দেখে আরাবী দ্রুত সরে গেলো।আর সাথে সাথে জানালার কাচটা বন্ধ হয়ে গেলো।আরাবী হা করে তাকিয়ে আছে।আচমকা কি হলো বুঝতে পারলো না।আরাবী অবাক কন্ঠে প্রশ্নে করলো,
-‘ এটা এমন আচমকা বন্ধ হলো কেন?আমি তো কিছু করেনি!’
পরপরেই জায়ানের শীতল কন্ঠের জবাব,
-‘ আমি লাগিয়েছি জানালার কাচ।মাথায় তো গোবর ভরা।জানালার বাহিরে মাথা বের করে রেখেছিলে। আর একটু হলেই অক্কা পেতে।আর দোষ হতো আমার।কারন গাড়িটা আমার।আর আমি চাইনা তোমার মতো মেয়ের জন্যে আমি আমার বা আমার শখের গাড়ির কিছু হোক।’
আরাবী হাবার মতো জায়ানের কথাগুলো শুনে গেলো।লোকটা এইভাবে ক্ষনে ক্ষনে সবার সামনে ওকে অপমান করছে।আর ও কিছু বলতে পারছে না।আর কিইবা বলবে আরাবী?আরাবী তো ঝগরা করতে পারেনা।আর রাগ উঠলে চেঁচিয়ে যে দুটো কথা বলবে তাও সম্ভব না।প্রথমত ও চিৎকার চেচামেচি করে কথা বলতে পারেনা।আর দ্বিতীয়ত আরাবী রেগে একটু জোড়ে কথা বললেই কেঁদে দেয়।ফলস্বরূপ আরাবী আর কিছুই বললো না।চুপচাপ নত মস্তকে বসে রইলো।ইফতি সামনের থেকে ঘার ঘুরিয়ে আরাবীর দিকে তাকালো। তারপর বলে,
-‘ আরাবী একটু খেয়াল রাখতে পারিস না নিজের?ভাই তো ঠিকই বলেছে।যদি তোর কিছু হয়ে যেতো?’
আরাবী কিছুই আর প্রতিউত্তর করলো না।চুপচাপ বসে রইলো।নূর আরাবীকে মন খারাপ করতে না করলো।বুঝালো ওর ভালোর জন্যেই বলেছে সবাই।প্রায় আধাঘন্টা পর গাড়ি থামে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে।একে একে সবাই গাড়ি থেকে নেমে দাড়ালো। আরাবীর ভীষন নার্ভাস লাগছে।এই প্রথম ও এতো বড় কোন রেস্টুরেন্টে এসেছে।তাও আবার গেট টুগেদারে।আরাবীর চিন্তিত চেহারা দেখে ইফতি বললো,
-‘ এতো নার্ভাস হওয়ার কিছু নেই আরাবী।আমরা আছি তো।’
আরাবী মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। জায়ান গাড়ি পার্ক করে আসতেই ওরা রেস্টুরেন্টের ভীতরে প্রবেশ করলো। ওরা সবাই লিফটে উঠলো।কারন রেস্টুরেন্টের ছাদে আজ ওদের আয়োজন।লিফট যখন চালু হলো আরাবী ভয়ে ওর পাশে যে ছিলো তার হাত খামছে ধরলো।কারন আজ সবকিছুই ওর লাইফে প্রথমবার হচ্ছে।উত্তেজনা,ভয়,লজ্জা সব যেন একেবারে ঘিরে ধরেছে ওকে।লিফট থামতেই নূর আর ইফতি আগেভাগেই বেড়িয়ে গেলো।এদিকে নূর ভয়ে এখনো চোখ বন্ধ করে খামছে ধরে আছে পাশের জনের হাত।
-‘হাতটা কি আজ খামছে শেষ করে দেওয়ার প্লান করেছো মিস আরাবী?’
জায়ানের শীতল কন্ঠের আওয়াজ কানে আসতেই তরিৎ গতিতে চোখ মেলে তাকায় আরাবী।বড় বড় চোখে জায়ানের দিকে তাকালো।জায়ান বিরক্ত হয়ে চোখের ইশারায় ওর হাতটা দেখিয়ে দিলো।আরাবী সেদিকে তাকিয়ে দেখে ও প্রায় একবার নখ পুরো ডাবিয়ে দিয়েছে জায়ানের হাতে।আরাবী দ্রুত হাত সরিয়ে নিলো।মিনমিনে কন্ঠে বলে,
-‘ সরি আসলে আমি…!’
আরাবী তার কথা সম্পূর্ণ করতে পারলো না।তার আগেই জায়ানকে লিফট থেকে বেড়িয়ে যেতে দেখে আরাবী অবাকের শেষ সীমানায় পৌছে গেলো।লিফটে আরো মানুষ উঠতেই আরাবীর হুশ ফিরলো।জায়ান চলে যাচ্ছে।আরাবী দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো সেদিকে।মনে মনে জায়ানকে একশোটা গালি দিলো।লোকট ভীষন খারাপ।কিভাবে ওকে একা ফেলে চলে গেলো।আরাবী প্রায় দৌড়ে এসে জায়ানের নাগাল পেলো।হাপাতে হাপাতে বলে,
-‘ আপনি এমন খারাপ কেন?আমাকে একা ফেলে চলে এলেন।’
জায়ান তাকালো না আরাবীর দিকে।সামনের দিকে দৃষ্টি রেখেই জবাব দিলো,
-‘ তুমি আমার সাথে এসেছো যে আমি তোমার রেস্পন্সিবিলিটি নেবো?যাদের সাথে এসেছো আর যাদের ভরসায় এসেছো।ওদের সাথে সাথে কেন থাকতে পারো না?’
আরাবী মুখ বাকিয়ে ভেংচি কাটলো।শব্দহীনভাবে জায়ানের বলা বাক্যগুলোই ব্যঙ করে আওড়াতো লাগলো।হঠাৎ চোখ চলে যায় জায়ানের দিকে সাথে সাথে আরাবী একদম শান্ত হয়ে যায়।কারন জায়ান ওর দিকে খেয়ে ফেলবো এমন লুক নিয়ে তাকিয়ে আছে।এদিকে নূর আরাবীকে আসতে দেখে দ্রুত আবারও আরাবীর কাছে ফিরে আসলো।নূর আরাবীর কাছে আসতেই জায়ান হনহনিয়ে সামনে চলে গেলো।আরাবী সেদিকে তাকিয়ে রইলো।মনে মনে বললো,
-‘ লোকটা এমন কেন?সবসময় এমন গুমড়ামুখো হয়ে কেন থাকে?’
ধ্যান ভাঙ্গে নূরের ডাকে।
-‘ তুমি রাগ করেছো?আসলে অনেকদিন পর কাজিনদের সাথে দেখা হবে তো।তাই অতি এক্সাটমেন্টের কারনে তোমাকে রেখেই চলে এসেছিলাম।সরি।’
নূরের কথায় আরাবী হেসে বলে,
-‘ না একদম রাগ করেনি।’
নূর হাসি মুখে বললো,
-‘ তাহলে চলো।সবাই এসে পরেছে শুধু আমরাই লেট।’
আরাবী সম্মতি জানিয়ে নূরের সাথে চললো সেখানে। বিশাল বড় একটা টেবিল।সেখানে প্রায় সেখানে বারোজন মানুষজন অনায়াসে বসতে পারবে। নূর আরাবীকে নিয়ে এগিয়ে গেলো সেদিকে। জায়ানদের কাজিন গুষ্টি একেবারে বেশিও না আবার কমও না। জায়ান আর ইফতি নূরের একজনই ফুফু। আর তার হলো এক ছেলে নাম জিহাদ আর এক মেয়ে নাম তিন্নি।জায়ানের মায়েরা দুবোন। আর জায়ান আর নূরের খালামুনির দুই মেয়ে, এক ছেলে। মেয়ে দুটোর নাম মিনহা আর মারিয়া এক ছেলের না তামিম।ইফতির মায়েরা এক ভাই এক বোন।আর ইফতির মামার দুই মেয়ে মেয়েদের নাম লিয়া আর জেনি এক ছেলে আদি।এদিকে জায়ান আর ইফতিকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলো সবাই।নূর আরাবীকে নিয়ে একটা চেয়ারে বসতেই এইবার সবার দৃষ্টি ঘুরে ফিরে আবদ্ধ হয় আরাবীর দিকে। কারন আজ প্রথম ওরা সবাই আরাবীকে দেখেছে।সবাইকে কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরাবী অসস্থিতে পরে যায়।দ্রুত মাথা নিচু করে ফেলে।বিরবির করে নূরকে বলে,
-‘ নূর এরা সবাই আমার দিকে এইভাবে তাকিয়ে আছে কেন?আমার অসস্থি হচ্ছে।’
নূর আরাবীর কথা শুনে।এইবার ওর কাজিনদের দিকে তাকালো।বললো,
-‘ আরে তোরা এইভাবে তাকাচ্ছিস কেন?ও বেচারি ভয় পাচ্ছে।’
নূরের কথায় সবাই যেন একটু নড়েচড়ে বসলো।ইফতির মামাতো ভাই আদি এখনো তাকিয়ে আছে আরাবীর দিকে।আরাবী এতে যেন অসস্থির চরম সীমায় পৌছে গেছো।আদি বাঁকা হাসলো আরাবীর দিকে তাকিয়ে।তারপর বলে,
-‘ এমন সুন্দরী কোথায় থেকে আসলো রে নূর?আগে তো একে কখনো দেখি নি?’
আদি’র কথার ভঙি নূরের পছন্দ হলো না। এই ছেলেটা ওর কাজিনদের মধ্যে সবচেয়ে অসভ্য।আর চরিত্র’দ দিক দিয়েও সবচেয়ে নিকৃষ্ট।নূরকে বহুত জ্বালিয়েছে আদি।পরে জায়ান ব্যাপারটা জানতে পেরে ওকে থার্ড ডিগ্রি দেওয়াতে নূরের উপর আর নজর দেওয়ার সাহস পায়নি।কিন্তু এখন নূর বুঝতে পারলো আদির কুদৃষ্টি আরাবীর দিকে পরেছে। নূর কিছু বলবে তার আগেই জায়ান গম্ভীর কন্ঠ শোনা গেলো,
-‘ সেদিনের কথা কি ভুলে গেছিস আদি?নাকি আবার মনে করিয়ে দিবো?’
জায়ানের দৃষ্টি এখনো ফোনের দিকেই।আদি শয়তানি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলে,
-‘ নো। এখনো ভুলিনি।আর তা আমি ভুলতেও চাইনা।’
ইফতি বুঝলো ব্যাপারটা এখন না থামালে বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে।তাই কথা ঘুরানোর জন্যে বলে উঠলো,
-‘ এভ্রিওয়ান ও হচ্ছে আরাবী। তোরা নিশ্চয়ই জানিস জিহাদ আংকেল আব্বুর বেষ্টফ্রেন্ড ছিলেন।আর আরাবী হলো জিহাদ আংকেলের মেয়ে।’
আরাবী সবাইকে নম্র কন্ঠে সালাম জানালো।সবাই সালামের প্রতিউত্তর দিলো।ইফতি আবার আরাবীকে একে একে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। সবার সাথে পরিচয় শেষে তামিম নামের ছেলেটি ওর চেয়ার ছেড়ে দৌড়ে আরাবীর কাছে আসলো।তামিম হলো ওদের কাজিনদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট।বয়স মাত্র পাঁচ বছর।তামিম আরাবীর কাছে এসেই আরাবীর দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকলো।তারপর হুট করে ওর দুহাত বাড়িয়ে দিলো আরাবীর দিকে।আরাবী অবাক হতেই নূর বললো,
-‘ জলদি কোলে নেহ ওকে।নাহলে এখনই কেঁদে দিবে।’
আরাবী দ্রুত তামিমকে কোলে তুলে নিলো।তামিম আরাবীর কোলে চড়তেই ও চওড়া করে হাসলো।আরাবীর মুখশ্রীতে ওর ছোট্ট ছোট্ট হাত দ্বারা স্পর্শ করলো।তারপর বলে,
-‘ তুমি অনেক সুন্দর।একেবারে ডলদের মতো দেখতে।তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে।আমি তোমাকে বিয়ে করবো বড় হলে।এখন থেকে তুমি আমার বউ।আমি তোমাকে বউ বলে ডাকবো।’
সবাই হেসে দিলো তামিমের কথায়।তামিমের বোন মারিয়া বললো,
-‘ তামিম এসব কি হচ্ছে?তোমাকে আমি কি বলে এনেছিলাম? বলেছিলাম না এখানে এসে কোন দুষ্টামি করবে না।এইজন্যেই তোমাকে আনতে চায়নি।’
তামিমের পছন্দ হলো না মারিয়ার কথা।নাক মুখ কুচকে বললো,
-‘ আমি তো দুষ্টুমি করছি না আপি।আমি তো শুধু আমার বউয়ের কোলে চড়েছি।’
মারিয়া চোখ রাঙিয়ে কিছু বলবে তার আগেই আরাবী মিষ্টি হেসে বলে,
-‘ থাকনা আপু।আমারও ওকে ভীষন ভালো লেগেছে।’
তামিম যেন আরেকটু সাহস পেলো।ওর বোনকে ভেংচি কেটে বলে,
-‘ দেখেছো আমার বউ কতো ভালো।’
এদিকে নূর তামিমের কান টেনে দিয়ে বললো,
-‘ ওরে ফাজিল।এতোদিন না আমি তোর বউ ছিলাম। তুই না বলেছিলি আমাকে বিয়ে করবি বড় হয়ে।তাহলে এটা কি হচ্ছে?’
তামিম ব্যাথা পেয়ে বলে,
-‘ উফ ব্যাথা পাচ্ছি তো।ছাড়ো আমার কান।আছা তোমাকেও বিয়ে করবো।ছাড়ো।’
নূর কান ছেড়ে দিলো।তারপর হাসিতে ফেটে পরলো।বাকিরাও হাসতে হাসতে শেষ।এদিকে আরাবীও হাসছে তামিমের কথায়।হাসির মাঝে ওর দৃষ্টি যায় জায়ানের কাছে।সাথে সাথে কেঁপে উঠলো আরাবী।লোকটা তাকিয়ে আছে ওর দিকে।কেমন যেন ঘোলাটে ওই দৃষ্টিজোড়া।সেই ভয়ানক চোখের দৃষ্টি আরাবী নিতে পারেনা একদম পারেনা। আরাবী দৃষ্টি নত করলো।গালগুলো গরম হয়ে লালাভ আভা ফুটে উঠলো। কিন্তু আরাবীও জানতেই পারলো না।ওর এই লজ্জা মাখা মুখশ্রী যে একজনের হৃদস্পন্দন থামিয়ে দিয়েছে বহু আগে।
#চলবে________
#বৃষ্টি_ভেজা_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১৪( ধামাকা পর্ব)
আজ সকালটা বেশ ফুড়ফুড়ে মেজাজে উপভোগ করছে আরাবী।ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া, স্নিগ্ধ হিমেল হাওয়া, সাথে নানান ফুলের মনমাতানো ঘ্রান।আরাবী প্রানভরে শ্বাস নিলো আরাবী।কাল রাতের গেট টুগেদারটা বেশ ভালো গিয়েছে।সকলেই বেশ ভালো ছিলো।অনেক জলদি তারা আরাবীর সাথে মিশে গিয়েছে।শুধু ওই আদিকে একদম ভালো লাগেনি আরাবীর।খারাপ লোকটার দৃষ্টিতেই কেমন যেন নোংরামো দেখতে পেয়েছে আরাবী। কি বিশ্রিভাবে বারবার তাকাচ্ছিলো আরাবীর দিকে। এই একটা কারনেই যা একটু খারাপ লেগেছে।নাহলে বেশ ভালোই কেটেছে পুরোটা সময়।সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে তামিমকে।ছেলেটা এতো কিউট।কাল একটু সময়ের জন্যেও আরাবীর কাছ থেকে সরেনি।খাবার টাইমে মারিয়া এতো চেষ্টা করেছিলো পারেনি খাওয়াতে।কিন্তু আরাবী খাইয়ে দিতেই কি সুন্দর সব খেয়ে নিয়েছে।যাবার সময় সেকি কান্না তার।সে আরাবীকে ছাড়া যাবেই না।অবশেষে আরাবী অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়িতে পাঠিয়েছে।আরাবী ভীষন মিস করছে তামিমকে।আরাবী এসব ভাবছে আর মুচঁকি হাসছে।আচমকা কারো গলার স্বর শুনতে পেলো আরাবী।
-‘ কি ব্যাপার আরাবী?একা একা হাসছো যে?’
আরাবী ভাবনা সমাপ্ত করে কথা বলা ব্যাক্তিটির দিকে তাকিয়ে দেখলো এটা নিহাদ।নিহাদকে দেখে আরাবী আগে হাসিমুখে সালাম জানালো।সালামের জবাব নিয়ে নিহাদ বললো,
-‘ এতো সকালে এখানে কি করছো আম্মু?’
নিহাদের কথাগুলো শুনতে আরাবীর এতো ভালোলাগে। এই মাত্র ওকে ‘আম্মু!’ বলে সম্বোধন করলো এতে যেন আরাবীর হৃদয়ে প্রশান্তির ঢেউ খেলে গেলো।আরাবী হালকা হেসে বললো,
-‘ ও কিছু না আংকেল আসলে আমার নামাজ আদায় করে আর ঘুম আসেনা।মূলত অভ্যাস নেই।গ্রামে থাকতেও আমি নামাজ পরে ঘরের বিভিন্ন কাজ করতাম মায়ের সাথে।কিন্তু এখানে তো মামুনি কিছুই করতে দেয়না।তাই আর কি করার প্রতিদিন সকালে বাগানে চলে আসি প্রকৃতি বিলাশ করতে।আপনাদের বাগানটা বেশ সুন্দর।’
নিহাদ হাসলেন আরাবীর কথায়।বললেন,
-‘ এই পুরো বাগানটা সাজিয়েছে আমার ছেলে জায়ান।ছেলেটার ফুল এতো পছন্দ। তাই দেখো না বাগানটা পুরো ফুল গাছ দিয়ে ভরিয়ে ফেলেছে।’
আরাবী বাগানের চারপাশে আবারও চোখ বুলালো।আসলেই বাগানটা খুব সুন্দর। তাইতো আরাবী যখন সময় পায় ছুটে চলে আসে এখানে।আরাবী মনে মনে ভাবলো,
-‘ ওই খারুস,গুমড়ামুখো লোকটারও যে এতো সুন্দর পছন্দ হবে।তা লোকটাকে দেখলে বুঝা যাবে না।’
নিহাদ আরাবীর কাছাকাছি এসে দাড়ালো।নম্র কন্ঠে বলেন,
-‘ আরাবী?আমি এই টাইমে হাটতে বের হয়।একাই হাটি আমি।ডায়বেটিস আছে তো আমার।তবে আজ কি আমার সঙি হবে তুমি?বাবা মেয়ে চমৎকারভাবে ভোরের পরিবেশ উপভোগ করবো।’
আরাবী এতো মায়ামাখানো বাক্যগুলো শুনে চোখ ভরে উঠলো।এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো গাল বেয়ে। তা দেখে নিহাদ বিচলিত কন্ঠে বলেন,
-‘ আরে আরে।কি করছো?কাঁদছো কেন তুমি?’
আরাবী চোখ মুছে নিলো দ্রুত।ধরা গলায় বলে,
-‘ আসলে বাবা মারা যাওয়ার পর কখনো এভাবে বাবার মতো আদরমাখা কথাগুলো শুনতে পায়নি বছর হলো। কিন্তু এখানে আসার পর পাপা আর আপনি যেভাবে কথা বলেন। এতো সুন্দর ভাবে মায়া মাখিয়ে।আমার বাবার কথা মনে পরে যায়।আমার বাবা থাকলেও তো ঠিক আপনাদের মতো এইভাবে আমাকে স্নেহমাখানো কন্ঠে কথা বলতো আমার সাথে।আমাকে আদর করে ছোট নামে ডাকতো।আপনাদের দেখে আমার বাবার কথা মনে পরে যায়।’
নিহাদ সাহেব আরাবীর কথা শুনে। আরাবীর মাথায় স্নেহপূর্ণ হাত বুলিয়ে দিলো।বললো,
– ‘ বোকা মেয়ে এইজন্যে কাঁদতে হয় নাকি?তুমি যেমন আদুরে একটা মেয়ে।তোমাকে আদুরেভাবে কথা না বলে থাকা যায়?বলো? আর কাঁদবে না কেমন?তোমার হাস্যজ্জ্বল মুখটা দেখতে বেশি ভালো লাগে।তা এখন যাবে আমার সাথে?’
আরাবী হেসে সম্মতি জানালো নিহাদের কথায়।তারপর নিহাদের সাথে হাটতে বেড়িয়ে গেলো।প্রায় ঘন্টাখানিক হেটে বাড়িতে ফিরে আসলো নিহাদ আর আরাবী।আরাবী নিহাদকে বলে বাড়ির ভীতরে চলে গেলো।নিহাদও তার বাড়ির দিকে হাটা ধরলো।নিহাদের মনে অজস্র ভাবনারা উকিঝুকি দিচ্ছে।অবশেষে মন মস্তিষ্কের মাঝে বনাবনি করে নিহাদ সাহেব একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন।এখন উনার এই সিদ্ধান্তটায় সকলে একমত হলেই হবে।আর একমত না হলেও সমস্যা নেই।উনি যা ভেবে নিয়েছেন এইবার তাই করবেন উনি।অনেক হয়েছে স্ত্রী আর ছেলেমেয়েদের স্বাধীনভাবে সব কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দেওয়া।এইবার নিহাদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।কঠিন সিদ্ধান্ত। আর তিনি জানেন তার এই সিদ্ধান্ত কখনো ভুল হতে পারে না।
____________
নিহাদ তার পুরো পরিবার নিয়ে নাস্তা খেতে বসেছে।নিহাদ আঁড়চোখে সবাইকে ক্ষনে ক্ষনে পর্যবেক্ষন করে নিচ্ছেন।সবার খাওয়া শেষ।তাই উঠে চলে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে নিহাদ বলে উঠলেন,
-‘ দাড়াও সবাই।আজ আমার সবার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।’
সবাই থেমে গেলো।সাথি বেশ অবাক হলেন স্বামির কথায়।তিনি বললেন,
-‘ কি এমন বলবে যে সবাইকে থাকতে হবে।নূরের ভার্সিটি আছে,জায়ানের অফিস আছে।তুমিও তো যাবে অফিসে।’
নিহাদ বেশ বিরক্তি নিয়ে তাকালো সাথির দিকে বললো,
-‘ দরকার দেখেই থামিয়েছে। অহেতুক কারন হলে কি ওদের দাড়াতে বলতাম?’
জায়ান কপালে আঙ্গুল ঘষলো।তার বাবা মা এখনই ঝগরা লেগে যাবে।তাই জায়ান বলে,
-‘ কি বলবে বাবা?জলদি বলো?’
নিহাদ সাহেব নড়েচড়ে বসলেন ছেলের কথায়।বেশ সময় নিয়ে ধীরকন্ঠে বললেন,
-‘ তুমি কি বিয়ে করবে না?’
জায়ান শান্ত স্বরে জবাব দিলো,
-‘ আমি তো বলেছি বাবা সময় হলে আমিই তোমাকে বলবো?’
নিহাদ রেগে বলেন,
-‘ সেই সময়টা তোমার কখন হবে জায়ান?বয়স তো কম হলো না।ত্রিশ চলছে তোমার।’
সাথি কর্কশ কন্ঠে বলেন,
-‘ আমার ছেলের বয়স নিয়ে কথা বলবে না।কি এমন বয়স হয়েছে হ্যা?আমার ছেলের জন্যে হাজার হাজার মেয়ে পাগল।ওর জন্যে কি মেয়ের অভাব পরবে নাকি?ওর জন্যে তো আমি লাল টুকটুকে বউ আনবো।’
সাথির কথায় নিহাদের বেশ রাগ লাগলো।তাও নিজেকে সামলে বলেন,
-‘ সেটা ভাবলে তো আরো আগেই করতে।এতোদিন এমন হেলাফেলা করতে না। সে যাই হোক আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।আর আমার সিদ্ধান্তই সিদ্ধান্ত।এইটা আর বদলাবে না।আমি অনেক ভেবে চিন্তেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।আশা করি আমার সিদ্ধান্তকে সবাই সম্মান করবে।আর না করলেও না।আমি এখন যা বলবো সেটা হবেই হবে।’
নূর জানে ওর বাবা কখনো এমন সিরিয়াস হয় না।হয় খুব কম।তবে আজ মনে হচ্ছে ওর বাবা অনেক বেশিই সিরিয়াস।নূর ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলো,
-‘ কি ডিশিসান নিয়েছো বাবা?’
নিহাদ শান্ত চোখে একবার সাথির দিকে তাকালেন।তিনি বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে।আবার জায়ানের দিকে তাকালো জায়ান শান্তভাবে উনার দিকে তাকিয়ে আছেন।নিহাদ ফুঁস করে শ্বাস ফেলে বলে উঠলেন,
-‘ আমি জায়ানের বিয়ে ঠিক করেছি।’
সাথি আর নূর বিষ্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকালেন।সাথি অবাক কন্ঠে বলেন,
-‘ এইগুলো কি বলছো তুমি?মাথা ঠিক আছে?আর আমার থেকে তো তুমি একবার জিজ্ঞেসও করোনি।’
নিহাদের শান্ত উত্তর,
-‘ প্রয়োজন মনে করিনি।’
জায়ানের দিকে তাকালেন।জায়ান এখনো শান্তভাবে তাকিয়ে আছে।জায়ান বললো,
-‘ তা বিয়ে ঠিক করেছো ভালো কথা কার সাথে তা তো বলবে?’
নিহাদ সাহেব ছেলের কথায় হেসে জবাব দিলেন,
-‘আরাবীর সাথে।মেয়েটাকে এই কয়দিন আমি খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করেছি।মেয়েটা অনেক ভালো।আমি এতোদিন অনেক ভাবনা চিন্তা করেছি।তারপরেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জায়ান তোমাকে আরাবীকেই বিয়ে করতে হবে।ভাব্বে তোমার বাবা তোমার কাছে তার শেষ আবদার করেছে।’
জায়ান হাতমুঠো করে দাঁড়িয়ে সব কথা নিরবে শুনলো বাবার।বড় বড় কয়েকটা শ্বাস ফেলে তারপর অফিসের ব্যাগ নিয়ে হনহনিয়ে বেড়িয়ে গেলো বাসা থেকে।
#চলবে___________