বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ পর্ব-১৫+১৬

0
598

#বৃষ্টি_ভেজা_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১৫
-‘ শেষমেষ এই জন্যে ওই মেয়েকেই আমার ছেলের বউ বানাবে তুমি?ওর মেয়েকে কোন দিক দিয়ে আমার ছেলের সাথে মানাবে বলো তুমি?এটা কেমন সিদ্ধান্ত তোমার?’

সাথির এমন কর্কশ গলায় কথাগুলো শুনে। রাগি চোখে তালানে নিহাদ।চেঁচিয়ে বললেন,
-‘ আমি যা করেছি বেশ করেছি।আরাবীর মতো মেয়ে তো প্রতিটা মানুষ চাইবে তার ছেলের বউ হোক।কিন্তু তোমার এতে এতো সমস্যা কিসের?’

সাথি রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলেন,
-‘ ওই মেয়েকে আমি আমার ছেলের বউ হিসেবে মানি না।আর মানবোও না।আমি এই বিয়ে কিছুতেই হতে দিবো না।’

নিহাদ উঠে দাড়ালেন।স্ত্রীর দিকে শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,
-‘ তুমি মানো বা না মানো।জায়ানের সাথে আরাবীরই বিয়ে হবে আর এইটাই আমার ফাইনাল ডিশিসান।আর তোমার এটা ভালো না লাগলে তুমি নিজের রাস্তা মেপে নিতে পারো।অনেক স্বাধিনতা দিয়েছে তোমায় আমার ছেলেমেয়েদের বিষয়ে সকল সিদ্ধান্ত তুমি নিতে।আমি কিছু বলতাম না।তবে আজ আমি যা বলেছি বা করবো।সেটা সবার ভালোর জন্যে।আরাবীর মতো এমন একটা লক্ষী মেয়ে আমার ছেলের বউ হবে এটা ভেবেই আমার গর্বে বুক ফুলে যাচ্ছে।এখন শুধু মিহান, মিলির সাথে কথা বলবো সন্ধ্যায়।আর আরাবী রাজি হলেই হলো।আমি জানি আরাবী আমার কথা ফেলবে না।মেয়েটা বড্ড আদুরে।’

নিহাদ সাহেব কথাগুলো বলেই রুম ত্যাগ করলেন।আর সাথি রাফে ফুসতে লাগলেন বিছানার এক কোনে বসে।

_________________

সন্ধ্যা সাতটা।
মিহানের পরিবারের সবাই বেশ স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।আজ অফিস থেকে ইফতি আর জায়ানকে তাড়াতাড়ি আসতে বলেছে।কিন্তু জায়ান আসেনি। এতো জোড়াজুড়ি করেও আনতে পারিনি ইফতি জায়ানকে।তাই ইফতি একাই চলে এসেছে।নিহাদ সাহেব আজ অফিসে যাননি।আর হঠাৎ ওদের অফিস থেকে তাড়াতাড়ি আসতে বলায় বেশ অবাকই হয়েছে ইফতি।তাই তো জলদি বাড়িতে ফিরেছে।কিন্তু বাড়িতে ফিরে যখন নিহাদ সাহেব একটু আগে যেই কথার উল্লেখ করেছে তাতে যেন ইফতিসহ ওর পুরো পরিবার বিষ্মত হয়ে গিয়েছে।

মিহান অবাকের রেশ ধরেই বললো,
-‘ ভাই তুমি ভেবে বলছো তো সব?’

নিহাদ সাহেব হেসে বলেন,
-‘ আমি ভেবেছি।বহুদিন ধরে শুধু ভেবেই গিয়েছে।অবশেষে আজ ভাবনা শেষ করে তারপরেই তোর কাছে আসলাম।প্লিজ না করবি না।আরাবীর মতো একটা লক্ষী মেয়েকে আমি নির্দ্বিধায় আমার ছেলের বউ বানাবো।’

মিলি ইতস্ততভাবে বললেন,
-‘ কিন্তু ভাইজান।সব ঠিক আছে।তবে আমাদের কাছে আরাবী থাকবে ঠিক আছে।কিন্তু আরাবীর মা’র সাথে কথা বলতে হবে।আর সবচেয়ে বড় কথা।এখানে আরাবীর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

নিহাদ সাহেব বসা থেকে উঠে দাড়ালেন। নত মস্তকে দাঁড়িয়ে এতোক্ষন সবটা শুনছিলো আরাবী।বিষ্ময়ে কি রিয়েকশন দিবে সব যেন ভুলে গিয়েছিলো।আজ আচমকা যে নিহাদ সাহেব লোকটার জন্যে ওর হাত চাইবে। কাশ্মিনকালেও ভাবেনি আরাবী।ও কি ঠিক শুনছে না ভুল।বাস্তবে দেখছে না কল্পনা।সেটাও এখনো বুঝতে পারছে না।নিহাদ সাহেব আরাবীর কাছে এসে আরাবীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।চমকে উঠে আরাবী তাকালো।নিহাদ সাহেব হাসিমুখে বললেন,
-‘ কিরে মা? এই বুড়ো বাপটার শেষ ইচ্ছে রাখবি না?তোকে আমি পূত্রবধু না আমার মেয়ে বানিয়ে নিয়ে যাবো।বাবার সকল ভালোবাসা তোকে দিবো।আমি বেঁচে থাকতে তোকে কোন কষ্ট পেতে দিবো না।বল মা তুই কি রাজি এই বিয়েতে?তোকে আমি জোড় করবো না।তুই তোর মনের কথাটাই আমাদের বল।’

নিহাদ সাহেবের কথার পরিপ্রেক্ষিতে কি জবাব দিবে আরাবী তা ও জানে না।একে তো সাথি যে ওকে একটুও সহ্য করতে পারেনা তা ও ভালোভাবেই জানে।আর সবচেয়ে বড় কথা।জায়ান নিজেও তো ওকে দেখতে পারে না।সেখানে এই লোকটাকে বিয়ে করে তার সাথে সারাজীবন কাটাতে হবে।ভাবতেই তো কলিজার পানি শুকিয়ে যায় আরাবীর।আচ্ছা,নিহাদ যে এসব বললো? সে কি জায়ানের থেকে অনুমতি বা মতামত নিয়েছে?লোকটার মতামত ছাড়া তো এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত নিহাদ নিতে পারবে না। আরাবীর সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।কোথা থেকে ঠিক কিভাবে সব মিলাবে তা জানে না আরাবী।এদিকে আরাবীকে এমন চুপ থাকতে দেখে নিহাদ আবারও বলেন,
-‘ কিরে মা? তাহলে কি ধরে নেবো তুই রাজি না?তুই রাজি না হলে আমি তোকে একদম জোড় করবো না!’

আরাবী মাথা নিচু করে নিলো।থেমে থেমে জবাব দিলো,
-‘ আমি জানি না।আপনি আমার মায়ের সাথে কথা বলে নিলে ভালো হয়।আমার মা যা বলবে আমি তাই করবো।আমার মা যদি এতে রাজি হয়।তাহলে ধরে নিবেন আমিও রাজি।কারন আমার মায়ের খুশিতেই আমি খুশি।’

নিহাদ আরাবীর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন।তারপর বলেন,
-‘ আচ্ছা দেখি তোমার মায়ের এড্রেস দেও।আমি কালই যাবো সেখানে।’

আরাবী আৎকে উঠলো।না কিছুতেই সেখানে আর যাওয়া যাবে না।তাহলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।ওই গ্রামের মানুষ ভালো না। আরাবী ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,
-‘ না আংকেল আপনার ওখানে যাওয়া লাগবে না।আপনি ফোনেই কথা বলে নিন।’

-‘ কিন্তু ফোনে……!’

ইফতি আরাবীর ভয়টা স্পষ্ট টের পেলো। তাই তাড়াতাড়ি নিহাদকে সাহেবকে বললো,
-‘ বড় আব্বু।তোমাকে এতো কষ্ট করে যাওয়া লাগবে না।এখন হচ্ছে ডিজিটাল যুগ।একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে ফোনের মাধ্যমেই অনায়াসে সব করা যায়।’

ইফতির কথা নিহাদ সাহেব মেনে নিলেন।তাই বললেন,
-‘ তবে তোমার মায়ের নাম্বারটাই দেও।’

আরাবী আমতা আমতা করে অবশেষে নাম্বারটা দিয়েই দিলো।নিহাদ সাহেব বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে প্রায় অনেকক্ষন কথা বললেন।কি কথা বললেন তা কেউ শুনতে পেলো না।প্রায় অনেকক্ষন পর তিনি হাতের ইশারায় আরাবীকে তার কাছে ডাকলেন।আরাবী গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলো নিহাদের ইশারা পেয়ে।আরাবী নিকটে আসতেই।নিহাদ হাতের ফোনটা এগিয়ে দিলো আরাবীর দিকে।তারপর বললেন,
-‘ নেও।তোমার মার সাথে কথা বলে নেও।’

আরাবী ফোনটা হাতে নিয়ে।মিষ্টি হেসে বললো,
-‘ তুই টাই ঠিক আছে আংকেল।আপনি আমাকে তুই বলে ডাকতে পারেন।’

নিহাদ যেন আরাবীর কথায় বেশ খুশি হলেন।আরাবী মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে।আরাবীকে ওর মায়ের সাথে একান্তে কথা বলতে দিয়ে চলে গেলেন।তিনি যেতেই আরাবী ফোনটা কানে লাগিয়ে বলে উঠলো,
-‘ কেমন আছো মা?’

অপাশ হতে আরাবীর মায়ের উচ্ছাসিত কন্ঠস্বর শোনা গেলো।
-‘ আমি অনেক ভালো আছি মা।আমার মেয়েটা যেখানে এতো ভালো আছে।সেখানে আমি ভালো না থেকে পারি।’

আরাবী কিভাবে কি বলবে খুজে পাচ্ছে না।আমতা আমতা করে বললো,
-‘ মা আসলে।ওইযে নিহাদ আংকেল…’

আরাবী মাঝপথে থামিয়ে দিলেন আরাবীর মা।অত্যন্ত খুশি নিয়ে বলেন,
-‘ আমি শুনেছি আরাবী।মা আমার তোর এতো ভালো একটা পরিবার থেকে বিয়ের সম্বন্ধ আসছে এটা তো আমার কেমন যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না।আমি চিনি তাদের মা।তারা অনেক ভালো মানুষ।তুই অনেক ভালো থাকবি মা। আমি জানতাম আমার মেয়েটা জীবনে অনেক সুখী হবে। আজ দেখ তা সত্যি হয়ে যাচ্ছে।’

আরাবী মায়ের এমন খুশি দেখে কি করবে ভেবে পেলো না।আজ অনেকদিন পর তার মা’কে এতোটা হাসিখুশি দেখলো আরাবী।হঠাৎ আরাবীর মায়ের আবার বলে উঠলেন,
-‘ তুই রাজি তো মা?আমি বলবো না তুই আমার কথায় এই বিয়েতে মত দে।তুই তোর মতামত স্বাধিনভাবে দিতে পারবি।তুই রাজি না হলে দরজার নেই।আমি নিহাদ ভাইকে বুঝিয়ে বলে দিবো।’

না আরাবী না করবে না।যা হবে পরে দেখা যাবে।ওর মায়ের খুশি যেখানে আরাবীও সেখানে খুশি।ওর মা যখন এই বিয়ের উছিলায় এতোটা হাসি খুশি হয়েছে সেখানে আরাবী কখনই অমত করবে না।আরাবী হাসিমুখে বলে,
-‘ আমি রাজি মা।আমি রাজি। তোমার মতামতই আমার সবচেয়ে বেশি।আমার মা যেখানে বলেছে এখানে আমি সুখী হবো।সেখানে আমি কিভাবে না করি বলোতো।’

-‘ আমি জানতাম আমার মেয়ে এটাই বলবে।’

আরাবী আরো অনেকক্ষন ওর মায়ের সাথে কথা বললো।কথা বলা শেষে আরাবী সবার দিকে তাকালো।ওর কেমন যেন ওখানে যেতে লজ্জা করছে।শরীরটা কেমন যেন লজ্জায় ভার হয়ে আছে।হঠাৎ ইফতি ডাকলো আরাবীকে,
-‘ এই আরাবী এখানে আয়?কথা বলা শেষ?’

আরাবী মাথা নাড়িয়ে হ্যা জানালো।ইফতি আবারও বললো,
-‘ ওখানে দাঁড়িয়ে কেন এদিকে আয়?কি বললো আন্টি?’

আরাবী না চাইতেও ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সেখানে।কেমন যেন চোখ মিলাতে পারছে না।লজ্জা, আর অসস্থিতে আরাবী পুরো কাবু হয়ে আছে।আরাবী সবার মাঝে আসতেই।নিহাদ অস্থির হয়ে প্রশ্ন করলেন,
-‘ তোর মতামত কি?এইবার বল? তুই কি রাজি মা?’

আরাবী সময় নিলো খানিক।অতঃপর শুকনো ঢোক গিলে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।নিহাদ সাহেব সাথে সাথে ‘ আলহামদুলিল্লাহ! ‘ বললেন।আরাবী লাজুক দৃষ্টিতেই সবাইকে পরখ করলো।সবার মুখেই হাসি।আরাবী বুঝলো এই বিয়েটা হলে সবাই খুশি হবে।আচ্ছা আরাবী সবাই বলছে।কিন্তু যার সাথে বিয়ে হবে সে কি খুশি?সে কি রাজি এই বিয়েতে? আরাবীর মনটা বড্ড খচখচ করছে একবার জায়ানের মতামত জানার জন্যে।ওই একটা ব্যাক্তির কারনেই আরাবীর হৃদয়টা বড্ড অশান্তিতে ভুগছে।আর সাথি? উনি কি রাজি?আর আজ নিহাদের সাথে সাথি এলেন না কেন?উনার ছেলের জীবনের এতো বড় একটা সিদ্ধান্তে উনি নেই।ব্যাপারটা কেমন যেন খটকা লাগলো আরাবীর কাছে। তবে মনের কথা মনেই চেপেই রইলো।আরাবী সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে রুমে দিকে যাওয়ার জন্যে অগ্রসর হচ্ছে।হঠাৎ ওর পাশাপাশি ইফতিও আসলো।ইফতি নিজেও রুমে যাচ্ছে।এখনো অফিসের পোষাক গায়ে। ফ্রেস হবে।ইফতি দুষ্টুমির স্বরে বললো,
-‘ কিরে?অবশেষ বিয়ের সানাই বাজলো তোর?আমি তো প্রচন্ড খুশি এখন একেবারে আমার বোনটা সারাজীবনের জন্যে আমাদের কাছে থেকে যাবে।আমার তো খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে।’

আরাবী বেশ লজ্জা পেলো ইফতির কথায়।তাই তড়িঘড়ি করে নিজের রুমে চলে গেলো।আর ইফতি হাসতে হাসতে শেষ আরাবীর কান্ডে।
______________
বারান্দায় দাঁড়িয়ে আজকের হওয়া সকল ঘটনা ভাবছে আরাবী।রাত তখন ১২ টা বাজে।এতো রাত হয়ে গিয়েছে তাও আরাবীর চোখে ঘুম নেই।মূলত ঘুম থাকলেও অদ্ভুত এক চিন্তায় ঘুম আসছে না। কি হবে সামনে?কি হতে চলেছে ওর সাথে?জায়ান কি বিয়েতে রাজি নাকি জায়ানের মতামত ছাড়াই নিহাদ এসব করলেন।আর সাথিই বা কিভাবে রাজি হলেন?এসব নানান চিন্তায় আরাবীর মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।প্রচন্ড চিন্তায় হাসফাস করছে আরাবী।এমন সময় এই নিস্তব্ধ পরিবেশে হঠাৎ খ্যাচ করে একটা শব্দ হওয়াতে কেঁপে উঠলো আরাবী।ডানপাশে ডাকাতেই চোখজোড়া বড় বড়ব বড় হয়ে যায় আরাবীর।জায়ান তাকিয়ে আছে ওর-ই দিকে।লোকটাকে ভালো দেখাচ্ছে না।কেমন যেন এলোমেলো লাগছে সেই প্রখর দৃষ্টি।আরাবীর সর্বাঙ্গ কাঁপছে কেমন যেন?আরাবী চোখ বন্ধ করে বড় বড় শ্বাস নিলো।হৃদয়টা এতো জোড়ে লাফাচ্ছে কেন?উফ! আরাবী সাহস নিয়ে খানিক এগিয়ে গেলো।মিনমিনে কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-‘ কি হয়েছে আপনার?আপনি ঠিক আছেন?’

এই প্রশ্নটাই করা বোধহয় ভুল হয়েছে আরাবীর।কারন হঠাৎ জায়ান যা করলো তার জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না আরাবী।আরাবীর শ্বাস আটকে যাওয়াদ উপক্রোম হলো।এই বুঝি আরাবী জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পরলো।

#চলবে__________
আসসালামু আলাইকুম!

#বৃষ্টি_ভেজা_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১৬
নিস্তব্ধ রজনী।মৃদ্যুমন্দ বাতাস বইছে।সাথে মন মাতানো নানান ফুলের ঘ্রান বাতাসের সাথে।ঝি ঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে।আকাশে মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে।সেই চাঁদের আলোয় আলোকিত চারপাশ।মোহময় এক পরিবেশ।
আরাবী ভয়ে একদম সিটিয়ে আছে রেলিংয়ের সাথে।আর ওর ওকে দুহাতের মাঝে আটকে রেখেছে জায়ান।আরাবীর হৃদস্পন্দন এতোটাই বেড়ে গিয়েছে যে সেই শব্দ বাহিরের মানুষও শুনতে পাবে।বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে আরাবী।মনে হচ্ছে আর একটু পর বোধহয় ও শ্বাসকষ্টে মরে যাবে। একটু আগে যখন আরাবী জায়ানকে দেখে প্রশ্ন করেছিলো।জায়ান প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে প্রায় একপ্রকার লাফিয়ে আরাবীর বারান্দায় এসে পরেছে।আর তৎক্ষনাৎ আরাবীকে নিজের বাহু বেষ্টনীতে নিয়ে নিয়েছে।জায়ান অন্যরকম এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরাবীর দিকে।আরাবী সেই চোখের ভাষা বুঝতে অক্ষম।অবশ্য বুঝবেই বা কি করে?চোখের ভাষা বুঝতে হলে আগে সেই চোখের দিকে তাকাতে হয়।কিন্তু আরাবী তো পারেনা ওই চোখের দিকে তাকাতে।নিতে পারেনা ওই চোখের দৃষ্টি।যেমন এখনো পারছে না।আরাবীর সারা শরীর কাঁপছে থরথর করে।তা দেখে জায়ান গম্ভীর কন্ঠে বললো,
-‘ এখনো তো সামান্য স্পর্শও করেনি।দুজনের মাঝে এখনো বেশ তফাত আছে।তাতেই এমন কাঁপছে।কিন্তু বিয়ের পর তো প্রতিদিন,প্রতিনিয়ত আমার স্পর্শ থাকবে তোমার সর্বাঙ্গে তখন কি করবে মিস আরাবী?’

আরাবী জায়ানের এহেন লাগামছাড়া কথায় ওর বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে।এইগুলো কি বললো জায়ান ওকে?আরাবী শরীরটা কেমন যেন নেতিয়ে যাচ্ছে।হাতে পায়ে এমনকি পুরো শরীরে একফোটা শক্তি পাচ্ছে না।আরাবী ভারসাম্য হারিয়ে পরে যেতে নিতেই জায়ান তার শক্তপোক্ত পুরুষালি হাত দ্বারা আরাবীকে আকড়ে ধরে।ঝংকার খেলে যায় পুরো শরীরে আরাবীর।এই প্রথম! এই প্রথম আজ ওর গায়ে স্পর্শ করেছে জায়ান।লোকটার শীতল হাতের স্পর্শ ভীতরের অন্তর আত্মা শুদ্ধু কাঁপিয়ে তুলছে আরাবীকে।জায়ান আরাবীর চোখের দিকে তাকালো।জায়ানের ঘোলাটে চোখজোড়া যেন একটা সমুদ্র।আরাবীর মনে হয় জায়ানের চোখের দিকে আরাবী তাকালে ওই চোখের সমুদ্রে আরাবী নিজেকে তলিয়ে ফেলবে বেশ বাজেভাবে।তাই তো তাকায় না ওই চোখজোড়ার পানে।জায়ান আরাবীর কানের কাছে মুখ নিলো।জায়ানের গরম নিশ্বাস আরাবীর কাধে এসে বারি খাচ্ছে।শিহরণে আরাবী জায়ানের হাত খামছে ধরে।জায়ান আরাবীর কানে কানে বললো,
-‘ ভেবেছিলাম প্রথম স্পর্শ বিয়ের পর করবো।কিন্তু তুমি তো তা হতে দিলে না।তার আগেই তা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিলে তুমি।’

জায়ান এইবার আরাবীর কানের অনেকটা কাছে ঠোঁট নাড়িয়ে ফিসফিস করে বলে,
-‘ আমার প্রথম স্পর্শে কেমন লাগছে মিস আরাবী? যদি আমি আরেকটু কাছে আসি তোমার?জড়িয়ে ধরি? এখন এইটুকু স্পর্শে আমার হাতটা রক্তাক্ত করেছো?তখন কি আমার পুরো শরীর করবে?’

আরাবী জায়ানের কথা শুনে তৎক্ষনাৎ জায়ানের হাত ছেড়ে দিলো।তবে ওর কাঁপাকাঁপি মোটেও বন্ধ হলে না। আরাবী অবাকের শেষ সীমানায়। এ কোন জায়ানকে দেখছে আরাবী? এই জায়ানকে তো আরাবী চিনে না।আচ্ছা জায়ান কি মদ টদ খেলো নাকি?ও কি জিজ্ঞেস করবে কথাটা? মনে মনে সাহস নিয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে বললো আরাবী,
-‘ আপনি এমন করছেন কেন?আপনি ড্রিংস করেছেন?’

জায়ানের উত্তর শোনা গেলো না।আরাবীও কিছু আর বললো না।মিনেট পাঁচেক নিস্তব্ধতা বিরাজ করলো দুজনের মাঝে।তবে সেই নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে জায়ান বলে উঠে,
-‘ হ্যা, আমি ড্রিংস করেছি।’

আরাবী কথাটা শ্রবণ হওয়ার সাথে সাথে চমকে তাকায় জায়ানের দিকে।জায়ান আরাবীর সেই চমকিত মুখশ্রীতে নজর বুলিয়ে আবারও বললো,
-‘ তবে এই নেশা সেই নেশা না।এই নেশা ভয়ানক নেশা।যা কোনকিছুর দ্বারাই কাটবে না।আর আমি এই নেশা কাটিয়ে উঠতেও চাইনা।’

আরাবী বার বার শুকনো ঢোক গিলছে জায়ানের ঠোঁট দ্বারা আওড়ানো প্রতিটি বাক্য শুনে। আরাবী যখন নিজের ভাবনায় ব্যস্ত জায়ানকে আরাবীকে হুট করে বারান্দায় রাখা চেয়ারে বসিয়ে দিলো।তারপর দ্রুত অন্যদিকে ফিরে গেলো।সেইভাবেই গভীর কন্ঠে বললো,
-‘ দ্রুত রুমে যাও।অনেক রাত হয়েছে।ঘুমিয়ে পর গিয়ে।’

জায়ান ঠিক যেইভাবে এসেছিলো ঠিক সেইভাবেই চলে গেলো নিজের বারান্দায়।তারপর বারান্দায় লাইট নিভিয়ে দিয়ে রুমের ভীতর চলে গেলো।কিন্তু এক আকাশসম ধোয়াশার মাঝে রেখে গেলো আরাবীকে।জায়ানের করা কর্মকান্ডে আরাবীর মস্তিষ্ক নিশ্চল হয়ে পরেছে প্রায়।এখনো আরাবী ঠিকঠাক শ্বাস নিতে পারছে না। হাসফাস করছে ভীষনভাবে।জায়ানের এমন ধা’ধার মতো বাক্যগুলো আরাবী মিলাতে পারছে না কিছুতেই।এমনিতে তো ভুলেও আরাবীর কাছে আসতো না।আর আজ একেবারে ওর বারান্দায় চলে এসেছে?লোকটা কি পাগল?এইভাবে কেউ রেলিং টপকে কারো বারান্দায় আসে?যদি লোকটার কিছু হয়ে যেতো? আরাবী চিন্তায় চিন্তায় পাগলপ্রায়।আজ জায়ান যেগুলো বললো তা দ্বারা কি বুঝাতে চাইলো আরাবীকে?জায়ানের প্রতিটা বাক্যে তো এটুকু বুঝতে পারছে আরাবী।যে জায়ান নিজেও রাজি এই বিয়েতে।তবে কেন রাজি হলো?কিভাবে রাজি হলো?জায়ান তো প্রথম থেকেই আরাবীকে দেখতে পারেনা।তবে বিয়েতে মত দিলো কেন?আর আজ এসবই বা করার কি কারন? আরাবী আর ভাবলো না।আপাততো ঘুমানো যাক।শরীরটা বড্ড ক্লান্ত লাগছে।আরাবী যখন রুমে প্রবেশ করবে ঠিক সেই মুহূর্তেই সেই চেনা কন্ঠের গম্ভীর কন্ঠ শুনতে পেলো,
– বি প্রিপেয়ার্ড মিস আরাবী।বি প্রিপেয়ার্ড ফোর ম্যারি মি। প্রিপেয়ার্ড ওয়েল ইউরসেল্ফ টু বিকাম মিস টু মিসেস।মাই মিসেস।’

কথাগুলো শোনা মাত্র দ্রুত পায়ে রুমে প্রবেশ করে দরজা আটকে দিলো আরাবী।দরজার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিলো।লোকটা বোধহয় আজ পাগল হয়ে গিয়েছে।সাথে ওকেও পাগল বানিয়ে ফেলবে।আরাবী গিয়ে বিছানায় সুয়ে পরলো।চোখ বুঝতেই ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসি ফুটে উঠলো।
_____________
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠতে অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে আরাবীর।তাই তো তড়িঘড়ি করে কোনরকম নাকেমুখে খাবার খেয়ে দ্রুত মিলিকে বলে বাড়ির গেটের সামনে আসলো।নূর ইতিমধ্যে ওর জন্যে দাঁড়িয়ে আছে।আরাবী গিয়েই বললো,
-‘ সরি নূর।দেরি হয়ে গিয়েছে।চলো চলো। ‘

নূর নাক মুখ কুচকে বললো,
-‘ সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি আমি তোমার জন্যে।তাড়াতাড়ি চলো।’

আরাবী মাথা নাড়িয়ে দ্রুত গাড়িতে উঠে বসলো।নূর উঠে বসতেই গাড়ি চলতে শুরু করলো।ঘুম না হওয়ায় আরাবীর ঘাড়ের রগ টনটন করছে।এই এক সমস্যা ঘুম না হলে আরাবীর ঘাড় ব্যাথা করে ভীষনভাবে।আরাবী চোখ বুজে পরে রইলো।হঠাৎ ওর কোলের মাঝে কিছু একটা ছিটকে পরায় চমকে চোখ মেলে তাকায় আরাবী।কোলের মাঝে তাকিয়ে দেখে মুভ মলম।আরাবী মুভটা হাতে নিয়ে সামনে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলো।জায়ান গাড়িতে আছে সেটা তো আরাবী খেয়ালই করেনি।জায়ানের পাশে তাকাতে ইফতিকেও দেখতে পেলো। এদিকে আরাবীকে এইভাবে হাবার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে জায়ান ড্রাইভ করতে করতেই বললো,
-‘ মলমটা লাগাতে দিয়েছি।এইভাবে হাতে নিয়ে বসে থেকে পূজো করার জন্যে না।’

আরাবী মুখটা থমথমে করে ফেললো।মুখ ফুলিয়ে মলমটা ব্যাথিত স্থানে ডলে নিলো ভালোভাবে।এইদিকে ইফতি আর নূর ঠোঁট টিপে হাসছে।নূরকে এইভাবে হাসতে দেখে যেন আরাবী তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো,
-‘ এইভাবে হাসছো কেন?হাসার কি হয়েছে?’

নূর ফিক করে হেসে দিলো।কোনরকম হাসি থামিয়ে বলে,
-‘ ও কিছু না।তুমি মলম ভালোভাবে লাগিয়েছো?নাহলে কিন্তু একজন খুব রেগে যাবে।’

নূরের কথা শেষ হতেই জায়ানের গম্ভীর কন্ঠস্বর,
-‘ নূর মার খাবি তুই!’

নূর সাথে সাথে একদম ভদ্র মানুষের ন্যায় বসে রইলো।এদিকে ইফতি দুষ্টুমির স্বরে বললো,
-‘ বাব্বাহ! বিয়ের আগেই বউয়ের জন্যে এতো দরদ?’

জায়ান ভ্রু উচু করে তাকালো ইফতির দিকে।ইফতি সাথে সাথে হাত উপরে উঠিয়ে হাসলো।
এদিকে আরাবী ভাবছে কে বলবে এই গম্ভীরমুখো,রাগি,থমথমে স্বভাবের লোকটা কাল কিইনা করেছে ওর সাথে। কালকের ঘটনাগুলো আবারও মনে পরতেই। একরাশ লজ্জা এসে ঘিরে ধরলো আরাবীকে।নতমস্তকে বসে রইলো আরাবী।তবে ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসি এখনো বিদ্যমান।আর সেই হাসিটুকু যেন চোখ এড়ালো না একজনের।তার হাসিটুকুই যেন সেই ব্যাক্তির হৃদয় থমকে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ঠ।

#চলবে______
ভুলগুলো ক্ষমা করবেন।